ফোন নিয়ে সোজা মা'র ঘরের দিক রওনা হলাম। তন্ময় ভাই ফোন কিনে দিয়েছেন। সেটা তো দেখাতে হবে। নাহলে পরে আবার এটা নিয়ে কথা উঠবে। ঘরে ঢুকতে নিয়েও ঢুকলাম না, তাদের আলোচনা
শুনে,
--' হ্যাঁ, ধরলাম তন্ময় অরুকে পছন্দ করে। বিশ্বাস করে নিলাম।
বড় ভাই মেনে নিবেন। কিন্তু ভাবী? তার একমাত্র ছেলে৷ যেই ছেলের জন্য বাড়িতে প্রস্তাব আসে বড়সড় ঘর থেকে। কাজে পড়ালেখায় সবদিক দিয়ে উন্নত। সেই ছেলের জন্য সে অরুকে চাইবে? হ্যাঁ, ভাবী ভালবাসে অরুকে। কিন্তু সেটা মেয়ের মতো। তার ছেলের বউ হিসেবে সে, অরুকে মন থেকে মানবে বলে মনে হয়না। আমাদের জন্য, ভাইয়ের জন্য মানলেও, সে মনেমনে তার ছেলের জন্য আরও বড় ঘরের মেয়ে চাইবে। '
--' তোমার ভাবীকে এই মনে হয়? সে অরুর জন্য পাগল। তন্ময়'কে রেখে সে অরুকে দেখেছে। অবশ্যই সে এতে সবচেয়ে বেশি খুশি হবে। '
--' আমারতো তা মনে হলো না। '
--' হবে কীভাবে উল্টাপাল্টা ভাবলে। '
--' তখন দেখলে না, যখন ভাই বলল তন্ময় অরুকে পছন্দ করেন। সে কীভাবে চেঁচালেন। সে একদমই মন থেকে অরুকে নিজের ছেলের বউ মানবে না। স্বামী আর ছেলের খাতিরে মানলেও, মন থেকে না '
--' তুমি থামবে? '
আমি দ্রুত সেখান থেকে চলে এলাম। রুমে যাবার পথে দেখলাম বড় মা রান্নাঘরে কাজ করছেন। আমার মনে কেমন নিমিষে অন্ধকার ছেঁয়ে এলো। সত্যি কী তাই? মা যা বললেন তা কী সত্যি?
রুমে এসে বিছানায় বসে রইলাম। মন আর সায় দিলো না, নতুন ফোন খুলে দেখার। আমাদের সুন্দর পরিবার'টা কি ভেঙে যাবে?
দুপুরে দীপ্ত এসে দরজা টোকাচ্ছে। গোসল দিয়ে কখন ঘুমিয়ে পরেছিলাম খেয়ালই নেই। দরজা খুলে দিতেই বলল,
--' ঘুম আর ঘুম৷ এতো ঘুম পাও কই। '
--' তুইও ঘুমা। '
--' এহ! আমার স্কুল আছে দ্যান প্রাইভেট। স্কুল আর প্রাইভেটের হোমওয়ার্ক। কত কাজ। '
আমি ওর ঝাকড়া চুলগুলো দু'হাতে ধরলাম। সযত্নে তা গুঁছিয়ে দিতে দিতে বললাম,
--' বেবিট্যাক্সি, একঘন্টা ঘুমোলে তোর পড়াশোনা পিছু হবেনা। বরং আরও মন ফুরফুরে হবে। '
--' তুমিই করো মন ফুরফুরে। আমার তো মন বহুত ফুরফুরা। বিয়ে খাবো। তোমার আর তন্ময় ভাইয়ার। আহা। '
গাল দুটো আমার গরম হয়ে উঠছে। কোনোভাবে জবান দিলাম,
--' অসভ্য। অযথা কথা বলবিনা। '
--' অযথা কী? চাচ্চু বলেছেন, তন্ময় ভাইয়ের ইঞ্জিনিয়ারিং শেষ হলেই, বিয়ের কথা ভাববেন৷ ওয়াহ। ভাইয়ার শেষ হতে মাত্র বছর। ধিংকাচিকা নাচ হবে। '
হঠাৎ দীপ্ত চেঁচাল ,
--' ফোন? ওয়াও। '
বলতে বলতে ফোন বক্স থেকে বের করলো।
--' ইশ! কী সুন্দর। তন্ময় ভাই দিয়েছেন? '
ছেলেটা এতো বুঝদার। তা বলার বাহিরে।
--' লেটেস্ট মডেল। উফ, আমাকে গেমস খেলতে দিবে? '
--' অবশ্যই। '
দীপ্ত ফোনে ওয়াইফাই'র প্যাসওয়ার্ড টাইপ করছে। নির্ঘাত এখন গেমস ডাওনলোড দিবে। আমি ফ্রেস হতে গেলাম। ইশ৷ আমার অর্ধেক ঘুমটা। ঘুম সম্পুর্ন না হলে মাথা ধরে। এই-যে আপাতত মাথা ঘুরছে। কোনোভাবে ফ্রেস হয়ে, ঘুমঘুম চোখ নিয়ে বেরোলাম। দীপ্ত তাড়া লাগালো,
--' চলো। খেতে ডাকছেন। '
নিচে নেমে সর্বপ্রথম চোখ গেলো সুমনার দিক। এ কখন আসলো? মেয়েটা পাগল হয়ে গেছে। অযথা। বড় মা আমাকে দেখতেই বললেন,
--' বস অরু। দ্রুত খেয়ে শেষ কর। আজ আমার সাথে শপিংয়ে যাচ্ছিস। রুবিও যাবে। '
চেয়ারে বসতে বসতে বললাম,
--' হঠাৎ। '
রুবি আপুর জবাব,
--' আইরিনের জন্মদিন পার্টি। তন্ময় ভাইয়াকে জোরপূর্বক এনেছেন। একদম মিস দেওয়া যাবেনা। '
আচ্ছা। আইরিন হচ্ছে তন্ময় ভাইয়ার মামাতো বোন। খুবই ভদ্র।
কয়েকমাস আগে এসেছিলো। খুবই বনে ওর আমার আর রুবি আপুর সাথে। দীপ্ত আর ওর তো লেগেই থাকে। দুজন দুজনের দুশমন যেন।
আমি আঁড়চোখে তাকালাম। তন্ময় ভাই খাচ্ছেন। এদিকসেদিক তাকাচ্ছেন না। সুমনা সদার মতো তার পাশে। মেয়েটা বারবার তাকাচ্ছে ভাইয়ার দিক৷ খাবার এগিয়ে দিচ্ছে। টুকটাক কথা বলার চেষ্টা করছে। এই দৃশ্য দেখে আজ আর হাসি আসছেনা। বরং বিরক্তি আর ভয় জাগছে। সুমনা যদি জানে, তন্ময় ভাই আর আমার ব্যাপারটা? ও কীভাবে নিবে? তন্ময় ভাইয়ের প্রতি ওর অনুভূতি তো অপরিসীম। আমিতো সাক্ষী। বারবার তাকে দেখার প্রচেষ্টা। তার কন্ঠ শোনার প্রচেষ্টা। কীভাবে কি হবে?
তন্ময় ভাইয়ার হঠাৎ কন্ঠে কেঁপে উঠলাম। তার হঠাৎ কন্ঠ একদমই আশা করিনি,
--' খাচ্ছিস না যে? '
ডাইনিংের সকলেই আঁড়চোখে তাকিয়ে, আবারও খাওয়াতে মনোযোগী হলেন। ও আচ্ছা। মহারাজ ড্রাইভিং করবেন। তাই তার এতো তাড়া। সেও যাচ্ছেন তাহলে। এদিকে ডান পাশের রুবি আপু, তন্ময় ভাইকে খোঁচাচ্ছেন। আর বিরবির করে কীসব বকছেন। আর হাসছেন। অথচ সে রুবি আপুকে কিছুই বলছেনা। বলবে কী, দুটো একই বয়সের তাই তাদের যায়ও ভালো।
সুমনার চোখে চোখ পড়তেই ও ইশারা করছে। আমি বুঝেও না বুঝার মতো খেতে লাগলাম। আমার আর এগুলো নিতে আর দেখতে ভালো লাগছেনা। কেন? জানি না। কিন্তু অন্য মেয়েদের আর তন্ময় ভাইয়াকে একসাথে আর ভাবিনা। ভাববো না।
সুমনা নিজেই বলল,
--' উমম আমিও যেতে চাই, যদি সমস্যা না হয়। '
বড় মা হাসলেন,
--' সমস্যা কীসের আসবে। '
সুমনার ঠোঁটে বিশ্বজয়ের হাসি। ও ধীরে তন্ময় ভাইয়াকে বলল,
--' তন্ময় ভাই, তোমার সমস্যা হবেনা তো ? '
তন্ময় ভাই হতে কোনো জবাব নেই। সে খেতে ব্যস্ত। সুমনা জবাব না পেয়েও হাসছে। হাসবেই তো। তার সাথে ঘুরবার রাস্তা যে পেয়েছে। হু৷ আমার আর যেতেই ইচ্ছে হচ্ছে না।
সুমনা বারবার বলছে,
--' আমাকে তন্ময় ভাইর পাশে বসতে সাহায্য করিস। প্লিজ। প্লিজ। প্লিজ অরু। '
আমি শক্ত মন নিয়ে তৈরি হচ্ছি। এ কিধরনের জ্বালা। না পারছি বলতে আর না পারছি সইতে।
ভেবে রেখেছি গাড়ির পেছনেই বসব। সুমনা কেমন বারবার বলেছে। মেয়েটা কষ্ট পাবে। অথচ, গাড়ির সামনে যেতেই বড় মা বললেন,
--' সামনে বস। '
আঁড়চোখে সুমনার দিক দেখলাম। বেচারি ইশারা করেই যাচ্ছে। আমি ইনিয়েবিনিয়ে বললাম,
--' বড় মা। মাথা প্রচন্ড ধরেছে। ভাবলাম তোমার কাঁধে মাথা রেখে যাবো। '
বড় মা'র মন গলে গেলো।
--' আচ্ছা আয়। তাহলে রুবি যা তন্ময়ের পাশে বস। '
সুমনাকে রাস্তা না দিয়ে রুবি তন্ময় ভাইয়ের পাশে বসলেন। কি আর করার। সুমনা ভাঙা মন নিয়ে পেছনে বসলো। আমি বড় মা'র কাঁধে মাথা রেখে, চোখ বুঝে। ওদিকে রুবি আপু তন্ময় ভাইয়ের ক্লাস নিচ্ছেন,
--' বিয়ে বিয়ে পাচ্ছে আমাদের তন্ময়ের। বাহ। '
তারপর সুমনা'কে ইঙ্গিত করে বলল,
--' সুমনা জানো কী হয়েছে? আমার হ্যান্ডসাম ভাইয়ের জন্য আবারও প্রস্তাব এসেছে। তাও অফিসারের মেয়ে। '
বলেই হাসতে লাগলো। আঁড়চোখে দেখলাম সুমনার মুখ একটুখানি। আমি ভাবছিলাম, আবাদ বেশি না বলে ফেলে রুবি আপু।
এদিকে এতক্ষণ পর মহারাজ কথা বললেন,
--' ধাক্কা দিয়ে ফালাই দিয়ে চলে যাব। '
রুবি আপু হাসছে,
--' বড় মা আছেন। তুর কল্লাডা চিপে দিবে। '
এবার সবাই হাসলো তন্ময় ভাই বাদে। খসরু ।
শপিংয়ে আমি বড় মা'র সাথে হাঁটছি। রুবি আপু পাশে। তন্ময় ভাই পেছনে তো সুমনাও পেছন পেছন ৷ দেখা গেলো বড় মা প্রথমে বাড়ির বাচ্চাদের জন্য শপিং করলেন। পাঁচ ছয়টা ড্রেস নেওয়া হয়েছে বাচ্চাদের ক্ষেত্রে। সাথে দীপ্তর জন্য ও।
এখন বড়দের জন্য কেনাকাটা বাকি। বড় মা বললেন,
--' তোরা কী নিবি? পছন্দ করছিস না যে? '
বড় মা রুবি আপুকে ড্রেস নিয়ে দিলেন পছন্দের। আমি না করে দিলাম। আমাকে দিলে সুমনার কী হবে? বারবার বলার পরও কিছুই নিলাম না। বড়দের জন্য কেনার ক্ষেত্রে অন্যদিকে যেতে হচ্ছে।
হঠাৎ তন্ময় ভাই ডাকলেন।
--' অরু। '
আমি দ্রুত পেছনে ফিরলাম,
--' জ্বি? '
সুমনা তন্ময় ভাইয়ের সাথে ছিলো। রুবি আপু সুমনার হাত ধরে বলল,
--' সুমনা চলো ড্রেস কালেকশন দেখি। '
পেছন রয়ে গেলাম আমি, একা তন্ময় ভাইয়ার সাথে। সে বললেন,
--' আয়। '
বাধ্য মেয়ের মতো তার পিছু যাচ্ছি। কামিজ কালেকশনের দোকানে থামলেন। গলা আমার শুঁকিয়ে কাঠ।
--' পছন্দ কর। '
হাজার কষ্টে আওয়াজ বের করলাম,
--' উম, লাগবেনা। '
সে আর জিজ্ঞেস করেননি। বরং নিজেই কিছু কামিজ দেখাতে বললেন। পাশে আরও কাস্টমার এসেছে। খেয়াল করতেই,
সে আমার বাহু ধরে তার দিক টেনে নিলেন। কাঁধ হতে আর হাত নামাননি। সেভাবেই ড্রেস পছন্দ করছিলেন। আমি শুধু আঁড়চোখে তার দিক তাকাচ্ছিলাম। বুকের মাঝে তীব্র ঝড় বয়ে যাচ্ছে, তার অজান্তেই।
ফিরবার পথে সুমনা ভাইয়ার পাশে আগে বসেছে। উফ মেয়েটা। রুবি আপু আমার দিক চোখ রাঙাচ্ছেন। আমি কি করলাম? অবশ্য সে সুমনাকে তেমন পছন্দ করেন না। তার উপর যেভাবে তন্ময় ভাইয়ের পাশ হতে নড়ছে না। আবার মধ্য রাস্তায় সুমনা আইসক্রিমের এর স্বর তুলল। তন্ময় ভাই সকলের জন্য আনলেন।
এদিকে বাড়ি ফিরতেই রুবি আপু আমাকে তার রুমে টেনে নিয়ে গেলেন।
--' তুই জানিস না তন্ময় কেমন? ও কথা বলেনা বলেনা, বললে খেয়ে দিবে। সুমনা কীরকম করছিলো দেখেছিস? তুই কীভাবে ওকে সুযোগ দিস, তন্ময়ের পাশে থাকার? '
--' ও বারবার বলছিলো। '
--' ও বললেই হচ্ছে? তুই তন্ময়ের হাতে থাপ্পড় খেয়ে সোজা হবি। দেখে নিস। '
উহ। এখন সব আমার দোষ।
.
.
.
চলবে..................................