অন্তর্দ্বন্দ্ব - পর্ব ৫৫ - সাবরিনা ইমরান - ধারাবাহিক গল্প


-- এই ছেড়িরে কেউ দেহে না ক্যান? বেবাকতা আউলায়ে ফেলতাসে।

মাহভিনকে দুই হাত দিয়ে শক্ত করে নিজের কোলে বসিয়ে রেখে জমিরা বিবি চেঁচাচ্ছেন।মাহভিনের হাতে ভাঙা ক্রেয়নের টুকরো।গেলো সপ্তাহে ভিনা শখ করে কিনে এনেছে ওর জন্য।এখন এই ক্রেয়ন দিয়ে পুরো ঘরের দেয়াল আঁকিবুকি করে শেষ করে ফেলছে।তাও চলতো,কিন্তু সকাল থেকে নতুন সমস্যা করছে,ফ্লোরে চিনি ছিটিয়ে ক্রেয়ন দিয়ে ঘষে সেগুলো খাচ্ছে।চিনি চুমকি এনে দিয়েছে খাওয়ার জন্য,কে জানে পিচ্চি এত তেলেসমাতি করবে।

প্রথম প্রথম এই হুংকার শুনলে মুনা দৌড়ে আসতো ঊর্ধ্বশ্বাসে।এখন এসব অভ্যাস হয়ে গেছে।ছোট মাছ বাছতে বাছতে চুমকিকে হালকা স্বরে বললো-

-- যা দেখতো, কী হয়েছে।
-- না খালা,আমারে ঝামটি মারবে নে।আমি পারুম না যাইতে।মোমেনা খালারে কন।
-- মাফ চাই।মোমেনা গেলে পুরো সংসার উদ্ধার হয়ে যাবে।এই ছোট মাছ বেছে দিয়েছি।সেদিন দেখিয়েছি না কীভাবে রান্না করতে হয়?ওভাবে মশলা দিয়ে চুলায় বসিয়ে দে।
মুনা হাত ধুয়ে ড্রয়িং রুমে আসলো।মাহভিন জমিরা বিবির কোলে ঘাপটি মেরে বসে আছে।দুই হাত আর মুখে রঙ লাগানো,ঠোঁটের চারপাশে চিনিও লেগে আছে।

-- কী রে মুইনা,মাইয়ারা খাওন দেও না ক্যান তুমি,ছেড়ি এডি কী খায় সারাদিন?গতর দেখসো,হাড্ডি গুনা যাইবো।
-- কী করবো মা,খায় না তো ঠিকমতো। 
-- কী খাওন দেও দেহি না আমি?ঝাল কম কইরা বাচ্চা মুরগি পেঁপে দিয়া পাকাও।আমিও খামু।
-- ছোট মাছ তো এখনি হয়ে যাবে মা।আপনি খেয়ে নেন।
-- এত কথা ভাল ঠেহে না।আর ঐ জমিদারনি কই?বইসা বইসা খাওনের লেইগা বেতন দেয়া হয় বেডিরে?তুমি যাইবা ক্যান পাক করতে।ঐ ধামড়িরে যাইতে কও চুলার পাড়ে।

মুনা মাথা ঝাকিয়ে চলে আসলো।মোমেনা কে জমিরা বিবি দুই চোখে দেখতে পারে না,মোমেনাও না।দুই বুড়ির মধ্যে সারাদিন খিটিরমিটির লেগেই থাকে। সত্যিকার অর্থে মুনা কাজের জন্য মোমেনাকে রাখে নি।কাজ চুমকিই ভালো পারে।কিন্তু মোমেনা একা মানুষ,এর উপর বয়স হয়েছে।আগের কর্মের কারণেও মুনার ভীষণ অনুতাপ হয়।সবমিলিয়েই সে মোমেনাকে এই বাসায় রেখেছে। মোমেনা তেমন কিছু না করলেও ভিনার খুব খেয়াল রাখে।ভিনার প্রতি আলাদা টান আছে তার।মাহভিনের চেয়ে ভিনার প্রতিই তার দরদ বেশি।

মুনা রান্নাঘরে এসে ফ্রিজ থেকে মুরগি বের করে পানিতে ভিজালো।এরপর সিঙ্কের সামনের জানালা দিয়ে বাইরে দেখতে লাগলো।গত এক বছরে অনেক কিছু বদলে গেছে।মানুষের জীবনে দীর্ঘদিন পর পর একটা বাঁক আসে।গত এক বছরে সেই বাঁক এসেছে জীবনে।হুট করেই সব হয়েছে।তবে এবারের পরিবর্তনটা শান্তির।

সোহেলের শরীর খারাপ হওয়ার পর আশেপাশের সবকিছুতেই এর প্রভাব পরেছে।একে তো শরীর খারাপ,এর উপর ব্যবসায় প্রতারণার শিকার হয়ে বিশাল লোকসান হয়ে গিয়েছিলো।কাছের বন্ধু যে এভাবে প্রতারণা করবে,বুঝতে পারেননি তিনি।এমনকি জয়েন্ট একাউন্ট থেকেও সব টাকা তুলে নিয়ে গিয়েছিলো সেই লোক।ভিনার জন্য ভীষণ প্রতিকূল ছিলো সেই সময়টা।ওপেন ক্রেডিট হওয়ায় প্রথমেই সেমিস্টার ড্রপ দিলো।এরপর মনোযোগ দিলো মাহভিন'স নামের নিজের তৈরি একসময়কার অনলাইন বিজনেসে।পেইজ পাব্লিশ করে,গ্রুপ আনয়ার্কাইভ করে পুরোনো সব কাস্টমারদের সাথে যোগাযোগ করলো।কাদের কে রাখার ইচ্ছা থাকলেও সম্ভব হলো না।হুট করে স্বচ্ছল অবস্থা থেকে হাত টানাটানি শুরু হয়ে যাওয়ায় বেতন দেয়া সম্ভব ছিলো না।যেহেতু সেমিস্টার ড্রপ দিয়েছে,তাই পুরো মনোযোগ ব্যবসায়েই দিলো।প্রোডাক্ট কালেক্ট করা,হিসাব রাখা,ডেলিভারি কোম্পানিকে পাঠানো সব সামলালো এক হাতেই।তবে বেশিদিন এই অমানুষিক পরিশ্রম করতে হলো না।রুশান একদিন হাজির হলো বাসায় ।সেদিন ও সোহেলের সাথে কথা বলেই ভিনার দিকে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিয়েছিলো।শুরুতেই সোহেলের সম্মতি পেয়ে যাওয়ায় ভিনা না করার কোনো সুযোগ পেলো না।রুশান কীভাবে যেন এক্সট্রা কোর্স সহ সেমিস্টার নিয়েও দিনশেষে মাহভিন'স এর কাজগুলো গুছিয়ে ফেলতো।এমনকি একটু বেশি লাভের জন্য আশপাশের অর্ডারে নিজেই যেত প্রোডাক্টের ডেলিভারির জন্য।ভিনা মানা করলেও রুশান শুনে নি।ভালোবাসা,অনুতাপ,আকাঙ্ক্ষা যাই হোক না কেন,আগের চেয়ে বেশি মন দিয়ে রুশান কাজ করতো।

ভিনা দিনরাত এক করে দিলেও মাস শেষে বেশি লাভের টাকা হাতে পেতো না।বাস্তবতা স্বপ্নময় নয়।হুট করে কারো কিছু হয় না।যেই লাভ হতো সেটা দিয়ে সংসারের বেসিক নিড পুরণ করাই কষ্টকর হয়ে যায়।এমন অনেক রাত গেছে,ভিনা ঘন্টার পর ঘন্টা চুপচাপ বসে থেকেছে বিছানায় ভোর পর্যন্ত। এত চাপ নেয়া সম্ভব হচ্ছিলো না।
তখন ভিনাই সিদ্ধান্ত নিলো নিজেদের ফ্ল্যাট বিক্রি করে কম ভাড়ায় অন্য জায়গায় যাওয়ার জন্য,সাথে একটা গাড়িও বিক্রি করে দিতে বললো।সোহেল সার্বিক অবস্থা বিবেচনা করে নিরুপায় হয়েই রাজি হলেন মেয়ের সিদ্ধান্তে।এর মাস খানেক পর ফ্ল্যাট,জমির দলিল রেডি করলেন,ভালো ক্রেতাও পেয়ে গেলেন।মনস্থির করলেন,এই টাকা ভিনা এবং মাহভিনের পড়াশোনা ও বিয়ের জন্য রাখবেন।ব্যবসা আগের মতো করতে হলে তখন বড় অঙ্কের মূলধন প্রয়োজন ছিলো।সব বিক্রি করে মেয়েদের ভবিষ্যতের জন্য কিছু রেখে ব্যবসা করা সম্ভব ছিলো না।এর কয়েকদিন পর ঘটলো বেশ নাটকীয় ঘটনা।জমিরা বিবি সপ্তাহ খানেক থাকার জন্য এসেছিলেন,কিন্তু মাসের পর মাস পেরোলেও আর ফেরৎ যাননি।তিনি আগের মতোই সবার সাথে খিটখিট করতেন,কথা শোনাতেন।কিন্তু কেন যেন ভিনাকে আঘাত করে তেমন কিছু বলতেন না।মুনা সহ সবাই ভেবেছিলো জমিরা বিবি মাহভিনকে ভালোভাবে নিবেন না।ছেলের দ্বিতীয় মেয়ে তার চক্ষুশূল হবে এটা যেন অলিখিত সত্য ছিলো।কিন্তু দিনশেষে দেখা গেলো জমিরা বিবি মাহভিনকে কোলে নিয়ে বসে আছেন,ওর খাবারে দেরি হলে সবাইকে ধমকে দিচ্ছেন।মাহভিনের ছোট চুলে ঘষে তেল লাগিয়ে দিচ্ছেন,এমনকি রাতে ঘুম পাড়াচ্ছেন ও নিজের কাছে।পরিবারে সোহেলের অসুস্থতা,ব্যবসায়ে লোকসান,আর্থিক অস্বচ্ছলতা এসে পরায় জমিরা বিবির এই পরিবর্তন গুলো কারো চোখেই খুব বড় করে ধরা পরেনি। সবাই চিন্তিত ছিলো এই অনাকাঙ্ক্ষিত সময়ে।জমিরা বিবি ধীরে ধীরে নিজের হই চইয়ের পরিমাণ আরো কমিয়ে শুধু চুমকি এবং মোমেনা পর্যন্ত সীমাবদ্ধ করে ফেললেন।কারো সাথেই আর তেমন আঘাত করে কথা বলতেন না।বাড়ি গাড়ি বিক্রির কথাবার্তা চলার সময় জমিরা বিবি যেন আরো নিশ্চুপ থাকতে লাগলেন।মাঝে মাঝে শুধু নিজের কীপ্যাড মোবাইলে চুমকিকে দিয়ে কাকে যেন ফোন দেয়াতেন।

এই নিশ্চুপ জমিরা বিবিই নাটকীয় ঘটনার পরিচালক এবং একইসাথে প্রযোজক। একদিন হুট করে সোহেলের চাচা,জমিরা বিবির দেবর গম্ভীর মুখে আসলেন।সাথে তার অন্য দুই ছেলেও আসলো মুখ থম থম করে।জমিরা বিবির দেবর ইদ্রিস সাহেব তার হাতে ফাইলভর্তি কাগজ এবং নগদ টাকা সহ ব্যাগ দিলেন।সোহেলের অন্য দুই ভাই বিদেশ থেকে হুট করে এসে পরায় সোহেল অবাক হয়ে গিয়েছিলেন।ঘটনার কিছুই বুঝতে পারছিলেন না।

নিরুত্তাপ জমিরা বিবিকে দেখে সোহেলের মেজ ভাই শাকিল তাড়স্বরে চেঁচিয়ে উঠে বললো-
-- এই তোমার বিচার আম্মা!মা হয়ে পেটের বাচ্চার সাথে অবিচার করলা তুমি!
-- আমারে অবিচার শিখাইস না হারামজাদা।তোগোরে পেটে ধরনই আমার পাপ ছেলো।আইজকা আমি মইরা গেলেও তো তোরা আইতি না।সম্পত্তি নিয়া টান দিসি দেইখা একেবারে নীতিকথা শোনাইতে আইসা পরসোস বিদেশ থেইকা?মর তোরা!

পেছন থেকে সোহেলের বড় ভাই সাবের এসে মায়ের সামনে দাঁড়ালো।
-- সোহেল কি খুব ভালো কাজ করসে?কয়দিন যোগাযোগ রাখসে ও?বিয়ের পর বউ নিয়া আলাদা হয় নাই ও?তাহলে আমাদের কেন দোষ দিচ্ছো শুধু?
-- আমি আলাদা করসিলাম অয় না।আর তোগোরে এত কথা কওনের সাহস দিসে কে?আমার সম্পত্তি আমার যারে মন চায় ওরে দিমু।
-- কিন্তু আমাদের ভাগও দিতে হবে তাহলে।
-- দিমু না আমি।যা মামলা মোকদ্দমা কর তোরা।মায়ের লগে যুদ্ধ করবার কোর্টে যাবি,এইডিই তো বাকী রইসে তোগো। 

শাকিল আর সাবের রাগে গালাগালি ও শুরু করে দিলো।জমিরা বিবি সেগুলো কানে নিলেন না।ইদ্রিস সাহেব শেষ বার আস্তে করে বললেন-
-- ভাবি একটু ভাইবা দেখেন।বিশাল ঝামেলা হবে।
-- ওগোর আব্বার জায়গা ওরা পাইলে পাইবো।কিন্তু আমার জায়গা আমি এ দুইটারে দিমু না।আমিও আইন কম জানি না,ওরা জোর কইরা আমার জায়গা নিবার পারবো না।
-- আপনার জায়গার পরিমাণ তো বেশি,এইটা শাকিল আর সাবের কে দেন।অন্য ভাগ সোহেলকে দিয়েন।
-- কইসি না আমি মাতবরি চাইনা কোনো।আমার সোয়ামি আমার নামে বেশি জায়গা দিসে। আমি কাইড়া নেইনা।আমারটাও কাউরে কাইরা নিতে দিমু না।

ইদ্রিস সাহেব গম্ভীর মুখে কাগজ পত্র এগিয়ে দিলেন বিনাবাক্য ব্যয়ে।জমিরা বিবি নিজের কয়েক বিঘা জায়গা এবং জমানো টাকা সোহেলকে দিয়ে দিচ্ছেন।এর অর্থমূল্য অনেক বেশি।শাকিল এবং সাবেরকে এসব না দেয়ার কারণ এরা কেউই মায়ের খোঁজ নেয়নি গত কয় বছরে।এমনকি নিজেদের সন্তানকেও দাদির কাছে একবারো আনেনি।জমিরা বিবির স্বামী স্ত্রীকে ভালোমতো খেয়ে পরে বাঁচার ব্যবস্থা করে দিয়েছিলেন বিধায় ছেলেদের মুখাপেক্ষী হননি।হলে যে কী হতো,ভাবতেই গা কাঁটা দেয় তার।
অনেক তামাশা আর কাদা ছোড়াছুড়ির পর সবাই চলে গেলো।সোহেল তখনো বিশ্বাস করতে পারেননি তার মা এই কান্ড ঘটাবেন।নিজেকে মায়ের অপছন্দের তালিকায়ই ভেবেছিলো সে।এ ব্যপারে সোহেল কথা বলতে গিয়েও পারেননি।জমিরা বিবি শুষ্ক গলায় বলেছিলেন-
-- এখন দেখ,ব্যবসা দাঁড় করাইতে পারোস নাকি।

ভিনা পুরো সময়ে নিজের ঘরেই ছিলো।মুরুব্বিদের এই অশান্তি অসহ্য লাগে ওর।মেহমান যাওয়ার পরই মুনার কাছ থেকে শুনেছিলো পুরো ঘটনা।তাই পরে দাদির জন্য শরবত সহ ট্রে নিয়ে গিয়ে দরজায় টোকা দিলো।
-- আয় 

ভিনা ট্রে টেবিলের পাশে রেখে ফ্লোরে বসে মাথা নিচু করে বললো-
-- আমাদের বাঁচিয়ে দিলেন দাদি।বাবার খুব কষ্ট হচ্ছিলো সব দেখে।আপনি তার জন্য এত বড় ত্যাগ করলেন....

জমিরা পাশ ফিরেই শুয়ে রইলেন।উঠে বসলেন না।একসময় কান্না চেপে বলে উঠলেন-

-- এই সয় সম্পত্তি দিয়া কী করুম। দুই দিন পর উপরে ডাক আইবো।এহন পোলার লগে থাকুম,নাতিনাতকল নিয়া খেলুম এর চেয়ে বেশি কি কিছু চাওনের আছে?
-- নাতি তো নেই দাদি,মনে কষ্ট নিয়েননা।
-- আর নাতি.....পোলাগুলা যে বদ হইছে।নাতিন দেইখাই পরান ঠান্ডা করুম।
-- আসি দাদি,কিছু লাগলে বলবেন।

জমিরা বিবি চোখ মুছে উঠে বসলেন।বালিশের পাশ থেকে হাতে একটা থলে নিলেন।

-- খাড়াও...
-- জ্বি দাদি?

জমিরা বিবি কিছুক্ষণ চুপ থেকে থাকলেন।চোখ থেকে টপটপ করে পানি পরছে।

-- তোমার মারে কইয়ো,আমারে মাফ কইরা দিতে।

ভিনা স্তম্ভিত হয়ে গেলো কথা শুনে।এটা কি সত্যিই জমিরা বিবি?

-- দাদি....
-- তোমার সাথেও কম অন্যায় করি নাই। তাও তুমি আমারে খবর দিলা,আমার পোলার কাছে আসতে দিলা...তুমি মাফ কইরা দিও ভাই।আমি ওহন বুঝি তোমার মায়ে কেমন ছিলো।বড় অন্যায় হইয়া গেসে আমার।
-- আমি কিছু মনে রাখিনি দাদি।
-- তোমার মারে কিছু দেওন হয় নাই।এইখানে দুইটা সোনার বালা আসে।তোমারে দিলাম আমি।যতনে রাইখো।

ভিনা থলে হাতে নিলো,খুলে দেখলো না।শুধু জমিরা বিবিকে একবার জড়িয়ে ধরে ছুটে ঘর থেকে বের হয়ে এলো।বহুদিন পর আনন্দের অশ্রু এসেছে চোখে,বহুদিন পর!

__________________________

রুশান হন্তদন্ত হয়ে বের এলো নিচে।ফারুক সাহেব চোখের ইশারায় জিজ্ঞেস করলে কী হয়েছে।রুশান বললো 'অপেক্ষা করছে'।
পাশ থেকে জেবা ভ্রু কুঁচকে জিজ্ঞেস করলেন 'কে অপেক্ষা করছে?'
রুশান গেট বন্ধ করার আগে চিৎকার করে বললো- 'প্যারা!আজকে পরীক্ষা আছে'।

জেবা আশ্বস্ত হতে পারলেন না।তিনি অনেকদিন ধরে খেয়াল করছেন এই বাবা ছেলের মাঝে কী যেন চলছে।মাঝে মাঝে দেখে মনে হয় এরা সাইন ল্যাংগুয়েজ এ কথা বলে। সরাসরি প্রশ্ন করেও কোনো সদুত্তর পাননি ফারুক সাহেবের কাছ থেকে।রুশানকে এখন হুট হাট কিছু বলেন না।বহু কষ্টে ছেলে স্বাভাবিক হয়েছে।তাই একটু সাবধানেই থাকেন।যাই হোক না কেন,মনে খচখচ করছে।এই অস্বস্তি নিয়েই জেবা চায়ের কাপে চুমুক দিলেন। 

--স্যরি,আম লেট!
-- ইটস ওকে।বেশি লেট হয়নি।

রুশান গাড়ির দরজা খুলে পাশে বসলো।ভিনা রেয়ার ভিউ মিরর ঠিক করে রুশানের দিকে তাকালো।রুশান সাথে সাথেই সিট বেল্ট ভালোমতো লাগিয়ে নিলো।

-- আচ্ছা,কয়টা এয়ার ব্যাগ আছে গাড়িতে?
-- কেন?ভরসা পাচ্ছো না?
-- আরে না!কিউরিওসিটি থেকে জিজ্ঞেস করেছি।

ভিনা হালকা হাসি দিয়ে গাড়ি স্টার্ট করলো।রুশান শার্টের হাতা ঠিক করার বাহানায় আড় চোখে তাকিয়ে আছে ভিনার দিকে। ভাগ্যিস সেদিন বুকে সাহস নিয়ে সোহেলকে বলেছিলো কথাগুলো।নাহলে আজকে এই চমৎকার মানু্ষটাকে হারিয়ে ফেলতে হতো বোকামি এবং অযথা আবেগের কারণে।

ভিনা এখন প্রিতির বাসায় থাকে না।জমিরা বিবি এখন ভিনাদের সাথেই স্থায়ীভাবে থাকছেন।তার সামনে প্রিতির বাসায় থাকাটা সহজ না।এখন অবশ্য থাকার প্রয়োজনও নেই।মাহভিন'স,পড়াশোনা এসব নিয়ে এত ব্যস্ত থাকা হয় যে মাহভিনের দিকে তাকিয়ে অতীতে ডুবে যাওয়ার সুযোগ নেই।সোহেল এখন এ বিষয়ে একদমই নিশ্চন্ত। জমিরা বিবি টাকা দেয়ার পর সোহেল নতুন করে ব্যবসায়ে হাত দিয়েছেন।সবকিছু ঠিকঠাক সামলেও নিয়েছেন নিজের ইতিবাচক ইমেজ থাকার কারণে।সমস্যা সমাধান হওয়ার পর ভিনা সিদ্ধান্ত নেয় ড্রাইভিং শিখবে।নতুন সেমিস্টার শুরু করার আগেই ফাঁকা সময়ে ড্রাইচিং শিখে নিয়েছে।অন্তত বিয়ের রাতের ঘটনা থেকে শিক্ষা পেয়েছে যে সবদিক দিয়ে যোগ্য হওয়া কত জরুরি!প্রয়োজনের সময়ে কোনো মানুষ পাশে দাঁড়ায় না।

ভিনা ড্রাইভিং শেখার পর থেকে প্রায়দিনই রুশানকে পিক করে ভার্সিটিতে যায়।রুশান এ ব্যাপারটা অনেক উপভোগ করে।ড্রাইভিং এর সময়ে ভিনার পুরো মনোযোগ রাস্তায় থাকে।রুশান তখন অনেক খানি সময় পায় বাধাহীনভাবে প্রিয় মানুষকে দেখার।

-- আন্টি কেমন আছেন?

রুশান চমকে গেলো হটাৎ প্রশ্নে।

-- এইতো,ভালোই আছে।
-- আচ্ছা।

ভিনা জ্যামে আটকে থাকার কারণে কিছুক্ষণ চোখ বন্ধ করে হেলান দিলো।

-- আমি মা কে জলদিই জানাবো। 
-- আমি তো এ বিষয়ে কিছুই জিজ্ঞেস করিনি।
-- আমি জানি।কিন্তু তোমার জানার দরকার আছে দেখেই বললাম।
-- জানালেই সব হয়ে যাবে?
-- মানে?
-- জানালেই কি তোমার মা রাজি হবে?এক ছেলে তো পছন্দে বিয়ে করেছে,আরেক ছেলেকে যদি নিজে বিয়ে দিতে চান?
-- এসব কিছুই হবে না।উই উইল হ্যান্ডেল।
-- উই?
-- আমি,বাবা আর ভাইয়া মিলে ট্যাকেল করে নিবো।
-- তুমি সত্যিই এত পজিটিভ?
-- আমি তোমাকেই বিয়ে করবো,যত যাই হোক।

ভিনা বড় করে দম ফেললো। জ্যাম ছুটে যাওয়ায় আর কথা বাড়ালো না।রুশান আরো কথা বলতে চাচ্ছিলো।সত্যি বলতে রুশান টের পায় যে,ভিনা বিয়ে নিয়ে সিরিয়াস না।যা হয়েছে আগে,এরপর প্রেম ভালোবাসা বিয়ের উপর থেকে ভরসা উঠে যাওয়া অস্বাভাবিক কিছুই না।ভিনা রুশানকে পছন্দ করলেও ভালোবাসে না।ভালোবাসা ভীষণ কঠিন।কষ্ট হলো ভিনা আগেই একজনকে ভালোবেসে ফেলেছে।কতখানি ভালোবেসেছে সেটা মাহভিনের দিকে তাকালেই বোঝা যায়।এতকিছুর পর ও সেই প্রতারকের সন্তানকে জন্ম দিয়েছে,বড় করছে।এমন ভালোবাসার শতভাগের এক ভাগ ও রুশান পাবে?

না হয়তো। রেহান বহু আগে বলেছিলো,ভালোবাসা কিছুই দেখে না।শারীরিক ত্রুটি,স্ট্যাটাস,পাস্ট...কিছুই না।রুশান ভালোবাসে ভিনাকে।এক তরফা ভালোবাসতে হবে জেনেও ভালোবাসে।ভালোবাসতে হয়,ভালোবাসার লোভ করা যায় না।কেউ এই লোভ করলে তার জীবন মানসিক অশান্তিতে শেষ হয়ে যাবে।এই ভুল রুশান করেছিলো।ভেবেছিলো ভিনা আর ভালোবাসবে না,ভালোবাসা না পেলে কী হবে।
দীর্ঘসময় পর এই খোলস থেকে বের হয়ে এসেছিলো।ভালোবাসা না পেলেও ভালোবাসার সুযোগ কেন চলে যেতে দিবে?নিয়তিকে মেনে নিয়েই ভিনা রুশানের হাত ধরেছে।অনেক শক্ত ভাবেই।

ভিনা ভার্সিটির সামনে রুশানকে নামিয়ে দিলো।ভিনাকে নামতে না দেখে রুশান গাড়ির ফ্রন্ট ডোরের সামনে এসে ঝুঁকে দাঁড়ালো।

-- আজকে বুধবার রুশ।

রুশান সড়ে দাঁড়ালো তৎক্ষনাৎ ।খুব কষ্টে মুখে হাসি এনে বললো-
-- বেস্ট অফ লাক মাই লেডি।

মাই লেডি কথাটা শুনে ভিনা কোনো প্রতিক্রিয়া দেখালো না,ভালোমতো জানে রুশান কেন এমনটা বলেছে।সোজা গাড়ি ঘুরিয়ে যান্ত্রিক শহরের মেইন রোডে হারিয়ে গেলো।

আজকে বুধবার।এইদিন ভিনার একটাই ক্লাস থাকে,তাও তিনটার দিকে।এই একদিন ভিনা ভার্সিটিতে আগে এসে বেরিয়ে যায়....যাবিরের খোঁজে।যেদিন প্রথমবার রুশানের সাথে বিয়ে নিয়ে কথা হয়েছিলো,তখনই ভিনা জানিয়ে দিয়েছিলো এই অসমাপ্ত খোঁজের শেষ করতে চায়।পিছুটান নিয়ে নতুন জীবন শুরু করবে না।কিছু প্রশ্নের উত্তর পেয়ে গেলেই সব মায়া কাটিয়ে পিছুটান পিছনে ফেলে এগিয়ে যেতে পারবে জীবনে।নাহলে নানা অবাস্তব সম্ভাবনায় মনকে বন্দি করে ফেলবে।ভিনার যুক্তি শুনে রুশান সেদিন বুকে পাথর রেখে হ্যাঁ বলেছিলো।কিন্তু খোঁজ যেন শেষই হয়না।যাবির ভিনার সাথে লুকোচুরি খেলছে মনে হয়,খুব সাবধানে নিজেকে বাঁচিয়ে রাখছে।যত যাই হোক,রুশান জানে দিনশেষে ভিনা ওর।ভিনার বাবা সোহেল নিজে কথা দিয়েছেন।এর উপরে কিছুই হতে পারে না।

তবুও রুশান তপ্ত রোদে দাঁড়িয়ে দীর্ঘশ্বাস ফেলে মনে মনে বললো-
'ঠিক কী করলে এই রুশকে তুমি ভালোবাসবে ভিনা?'
.
.
.
চলবে.........................................................................

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

WhatsApp