প্রেয়সী - পর্ব ২৩ - নাবিলা ইষ্ক - ধারাবাহিক গল্প


হোটেল ছেড়েছি নয়টায়। হোটেলের আশেপাশে তেমন মানুষজন 
দেখা না গেলেও, হোটেল ছেড়ে কিছুটা দূরে পৌঁছাতেই মানুষের আনাগোনা বেশ দেখা যাচ্ছে। বাচ্চা, বুড়ো , যুবতী-যুবক সব 
ধরনের মানুষের যাতায়াত। কিছুটা দূরে দুজনের প্রতি নজর
 আমার অনেকক্ষণ যাবত। একটি যুবক লোক সাথে তার 
মাঝবয়েসী এক মহিলা। স্পষ্ট কন্ঠে সেই ভদ্রলোক মহিলাকে 
বলছেন, 
- মা, কষ্ট হচ্ছে? গাড়ি আনার ব্যবস্থা করব? 
মহিলা আদুরে কন্ঠে জবাব দিচ্ছেন, 
-' ঠিকাছিরে বাবা। তোর মা এখনও বৃদ্ধ হয়নি। এতটুকু রাস্তা চুটকি দিয়ে শেষ হয়ে যাবে। 
ভদ্রলোক তার মায়ের হাত শক্ত করে চেপে। বারবার এপাশে 
হাঁটতে বলার নির্দেশ দিচ্ছেন। হাসলাম আমি। মা-ছেলে ঘুরতে 
বেরোয় ব্যাপারটা সচরাচর দেখা যায়না। অবশ্য তন্ময় ভাই প্রায় বেরোয়, বড় মা'কে নিয়ে ঘুরতে। সেবার ঢাকায় চারদিন থেকে 
এসেছে দুজন। নানান যায়গা বড় মা'কে দেখিয়েছেন। সাধারণত এই ব্যাপার গুলো সাংঘাতিক হৃদয় স্পর্শ করে আমার। 
তন্ময় ভাই আর দীপ্ত সামনে। দীপ্তর হাত ধরে রেখেছে তন্ময় ভাই। 
দুজন হাঁটছে। স্বাস্থ্যবান দীপ্তর ঝাকড়া চুলগুলো সোনালী রোদের আলোয় ঝিলমিল করছে। চোখে ছোট একজোড়া চশমা। 
হাফ প্যান্ট, গেঞ্জি, স্নিকার্স পড়ে সে দিব্বি তন্ময় ভাইয়ের পায়ে 
পা মেলাচ্ছে। দুজনের মাথায় একই রঙের ক্যাপ। তাদের দিক 
একবার চোখ গেলে দ্বিতীয় বার তাকাতে বাধ্য। আর সেটা হচ্ছেও। আশেপাশে অনেকেই তাকাচ্ছে। কিউট। পেছনে আপু আর ইব্রাহিম ভাই। তারা ঝগড়া করছে না কথা বলছে বোঝা দায়। আমি 
আশপাশে মনোযোগ দিলাম। তখনই পাকনা দীপ্তর কন্ঠ, 
- তৃষ্ণা পেয়েছে। '
ভাগ্যিস মনে করে ছোট ব্যাগে দুবোতল পানি এনেছিলাম। নাহলে কী হতো? ব্যাগ থেকে বোতল একটা বের করে দিলাম। দীপ্ত পানি খেয়ে হাঁপাচ্ছে, 
- বাব্বাহ। আর কতদূর? 
তন্ময় ভাই বললেন,
- এসেছি। 
হ্যাঁ, ওইতো দেখা যাচ্ছে। দূর থেকে ছোট দেখাচ্ছিলো। সামনে এসে বোঝা যাচ্ছে কতটা বিশাল বড়। এতটা উঁচু'তে উঠতে হবে আমাদের। ভয়ে জান না গেলেই হচ্ছে। 

পাহাড়ের অর্ধেক উঠে দীপ্ত আরও হাঁপাচ্ছে। ফরসা মুখ লাল হয়ে এসেছে। ইব্রাহিম ভাই কোলে নিতে চাচ্ছিলেন। দীপ্ত উঠবে না। 
- আমি একজন ম্যানলি ছেলে। কোলে উঠার বয়স নেই। 
বেশ বড় গলায় ভাষন দিল। অথচ যখন তন্ময় ভাই কোলে তুললেন, পিচ্চি একদম শান্ত। চুপচাপ ভাইয়ের কোলে উঠে যাচ্ছে আমাদের আগে। দীপ্ত'কে কোলে নিয়েও কী দ্রুত চলে যাচ্ছে। এদিকে আমি হাঁপাতে হাঁপাতে শেষ। এক পর্যায়ে দেখা গেল, দীপ্ত'কে উপরে রেখে তিনি আবারও এসেছেন। শক্তি দেখাচ্ছে যে? হু। আমি পাত্তা না দিয়ে দ্রুত উঠার প্রচেষ্টায়। তিনি এসে আমার বাহু জড়িয়ে
 ধরলেন। 
- কোলে নিব? 
আশ্চর্য চোখে তাকিয়ে, দ্রুত মাথা নাড়ালাম, 
- উঁহু। না। 
তিনি হাসলেন। বাহু শক্ত করে ধরে এগিয়ে যাচ্ছেন। আমারও আর সরতে ইচ্ছে হলো না। গরম গালের আভাস নিয়ে তার সাথে স্পর্শে রয়ে গেলাম। 

কথায় আছে, অতি কষ্টে সুখ মেলে। কথাটা আসলেই সত্য। এইযে এতক্ষণের কষ্টের ফল, এই চমৎকার দৃষ্য। পাহাড়ের উপর থেকে পুরো পৃথীবি যেন একদম ছোট । পৃথীবির সৌন্দর্য যেমন ফুটে উঠেছে। দীপ্ত শব্দ করে চেঁচাচ্ছে। রুবি আপু ভিডিও করছে। ছবিও তুলছে। হঠাৎ বলল,
- এই তন্ময় দাঁড়া। 
তন্ময় ভাই না করে দিলেন, 
- উঁহু। তুলবো না। '
- আররে অরুর সাথে। 
এবার তিনি আমার দিক তাকালেন। বললেন,
- তাহলে তোলা যায়। 
অমত করলাম না। এই সৌন্দর্যের মাঝে থাক না তার আমার একটি স্মৃতি। যা দেখে আনমনে হাসবো, লজ্জা পাব। তিনি ঠিক পাশে এসে দাঁড়ালেন। আদুরে ভাবে কোমর ছুঁয়ে দিলেন। এখনও আমি তার স্পর্শের ছোঁয়া নিতে পারছিনা। শরীর কাঁপা হতে থামাতে পারছিনা। 
আমার শক্ত হয়ে থাকা দেখে তিনি মিষ্টি হাসলেন। তার ঠোঁট মাথায় ছোঁয়ালেন। শক্ত করে চোখ বন্ধ হয়ে গেল। বুকের ধুকপুকের তীব্রতা আজ অপরিসীম, অপরিচিত।

যখন আমরা ফিরবার পথে চলছিলাম। সামনে এক বৃদ্ধ দাঁড়িয়ে। হাতে বড় এক চায়ের ফ্ল্যাক্স। সাথে ঝুলানো কিছু ওয়ান টাইম কাপ গুলো। বিস্কুট আর সিগারেটও রেখেছেন। আমাদের দেখে
 বললেন, 
- চা খাইয়া যাও গরম গরম। 
দীপ্ত লাফিয়ে উঠলো, 
- চল খাই। 
মানলাম সবাই। চা দিতে দিতে বৃদ্ধের নানান প্রশ্ন, 
- তা আফনারা বিবাহিত? 
প্রশ্ন'টা ক্লিংগি পেছনের কাপল'কে করা হলো। মানে রুবি আপু আর ইব্রাহিম ভাইয়া'কে। আমি হাসলাম। জবাব দিলাম, 
- বিবাহিত না। খুব শীগ্রই হবে। এইতো মাস শেষে তাদের বিয়ে। 
- মাশাল্লাহ। আল্লাহ ঠিক এভাবেই মিলিয়ে রাখুক সারাজীবন। 
রুবি আপু লজ্জা পেল। ততক্ষণত ধন্যবাদ ও জানাল। তন্ময় ভাই চা খাবেন না। তিনি অন্যপাশে ঘুরে দাঁড়িয়ে। চা হাতে চুমুক দিয়েছি তখন বৃদ্ধার আরেক প্রশ্ন, 
- আফনারা দুইজন? 
এটার জবাব কীভাবে দিব? আমি অন্যদিকে তাকালাম। আপু হাসছেন। দীপ্ত আগে আগে তন্ময় ভাইকে দেখিয়ে বলল, 
- এই হচ্ছে আমাদের ভাই। কিন্তু অরু আপুর ভাই, প্রেমিক আর ভবিষ্যৎ হাসবেন্ড। একের ভেতর সব যাকে বলে। 
লজ্জায় মাথা নুইয়ে ফেললাম। সকলে হাসছে। রুবি আপু খুলে বললেন, 
- চাচাতো ভাই-বোন। ওদের দুজনের বিয়ে ঠিক হয়ে আছে। 
ইশ। কবে ঠিক হলো? এই ব্যাপারে কথা হয়েছে, তার সম্পর্কে না জানা আমি। অথচ বাড়ির সকলের মুখে মুখে রয়েছে, 
' বিয়ে ঠিক হয়ে আছে। 
আমার প্রশ্ন হচ্ছে, ' কবে, কই, কখন? আমি শুনিনি কেন?'
বেশ কিছুক্ষণ কথা হলো। সেখানে অনেকক্ষণ ঘুরে, আবারও হোটেলের উদ্দেশ্যে রওনা হলাম। 

আমাদের সকলের অবস্থা আধমরা। শুধু তন্ময় ভাই এখনও শক্ত ভাবে হেঁটে চলছেন। তাকে দেখলে বোঝা যাবে না যে, আমরা ঘন্টার পর ঘন্টা পাহাড় বেয়ে এসেছি। পা খুবই ব্যাথা করছে। রুমে পৌঁছে ফ্রেস হয়ে বিছানায় যাব আগে। ঘুম অত্যন্ত প্রয়োজন। করলাম ও সেটা। হোটেল পৌঁছাতেই আমি আগে ফ্রেস হতে গিয়েছি। এসে খাওয়া ছেড়ে বিছানায় শরীর এলিয়ে দিলাম। ঘুমে চোখ বুঝে আসছে। অথচ আপু চেঁচাচ্ছে, 
- অরু, এখন খাবি। ঘুমাস না। 
এটা কোনো কথা? অথচ ঘুম কথা শুনছে না৷ ঝেকে ধরেছে আমায়। তখনই তন্ময় ভাই হাজির। হাতে প্যাকেট। খাবার নিয়ে এসেছেন। বললেন, 
- উঠ। 
পরপর ইব্রাহিম ভাইও হাজির। উঠতে ইচ্ছে হচ্ছে না। ঘুম ধরেছে প্রচন্ড। ঘুমঘুম চোখে তার দিক তাকালাম। বললাম, 
- উঠে খাব। আপনারা খান। 
তন্ময় ভাই দিলেন এক ধমক। 
- থাপ্পড় খাবি? 
দ্রুত উঠলাম। প্যাঁচা মুখ করে এক কোণায় বসলাম। লোকটার আমাকে ধমকানো থামবে না? ভালবেসে বললেই তো হতো । 
পাষাণ। আধমরা মুখ নিয়ে খাচ্ছি, দেখে সকলেই হাসছে। দীপ্ত 
হাসছে আর খোঁচাচ্ছে আমাকে। খাওয়া শেষে যাওয়ার সময় তন্ময় ভাই আমার গাল টেনে ধরলেন,
- এতো ঘুম কই থেকে আসে? 
এহ। সারারাত ঘুমাতে পারিনি। ঘুম তো আসবেই। আমি তো আর তার মতো রোবট নই। রক্তে মাংসে তৈরি মানুষ।
.
.
.
চলবে..................................

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন