নয়নতারা - পর্ব ১৬ - সুবহান আরাগ - ধারাবাহিক গল্প


পরম আদরের সাথে ফুল গুলোতে হাত বুলাতে বুলাতে কবিতা আওড়ে যাচ্ছে তারা।

----তারা,তারা মা ভেতরে এসো।আর বাইরে থাকা যাবে না।

মাহমুদা বেগমের গলা শুনে তারা ক্রাচ নিয়ে খুব সাবধানে উঠে দাড়ালো।

----গাসু,চলো।আর বেশিক্ষণ থাকলে মা বকবে।
----হ আফা চলেন।

তারার এক হাত ধরে গাসু তারাকে নিয়ে বাড়ির ভেতর চলে গেল।

----এতো তাড়াতাড়ি যাওয়ার কি ছিল?আরেকটু বাইরে থাকতেন।সময় টা যদি এখানে থেমে যেত,আমি আরো কিছুক্ষণ দেখতাম জ্বলন্ত পরী কে।

আচমকা নাফিজের মুখ ফসকে কথাটা বেরিয়ে গেল।নিজেই নিজের কাছে বেশ অপ্রস্তুত হয়ে পড়লো নাফিজ।

----ধ্যাত কি ভাবছি, কি বলছি আমি।অফিসে যেতে হবে।দেরী হয়ে গেল।

সাইকেল টা উঠিয়ে নিয়ে নাফিজ কুয়াটারের উদ্দেশ্যে রওনা হলো।

;;;;;;

----মা আর খাব না।তুমি দেখো পেট ফুলে ঢোল হয়ে গেছে।
----তারা একদম দুষ্টুমি করবে না।হা কর।
----মা সত্যি বলছি।তুমি সব সময় এই বাচ্চাদের মতো আমাকে খাইয়ে দেও কেন বলোতো?আমি তো বড় হয়ে গেছি। 
----তুমি বড় হও আর যাই হও আমার কাছে সেই বাচ্চাটিই আছো।শোনো টিফিন রেডি করে দিয়েছি ব্রেক টাইমে খেয়ে নেবে।আর ওষুধ ও খেয়ে নিও।
----আবার টিফিন!
----হ্যাঁ।আমি যেন বক্স খালি পাই বাড়ি এসে।আর হ্যাঁ কাউকে দান করতে যেও না।খাওয়ার ভয়ে তো তুমি একদম টিফিন দান করে বেড়াও।

মাহমুদা বেগমের কথা শুনে তারা মুখ গোমড়া করে খাবার টেবিলে বসে আছে।এদিকে পাশে বসে গাসু মুখে খাবার পুরছে আর মিটমিট করে হাসছে।

----যাই কন ম্যাডাম,আফা কিন্তু হেব্বি ইন্টিজিন্ট।
----ইন্টিজেন্ট!সেটা আবার কি গাসু?
----ওহ ম্যাডাম আপনে বুঝলেন না।বুদ্ধিমান।
----ওটা ইন্টেলিজেন্ট।তোমাদের দুটোকে নিয়ে আমি পাগল হয়ে যাব।একজনের দুষ্টুমি আর তোমার ইংলিশ।উহ!
----পাগল হলে আগে ভাগে বলো ডা:মাহমুদা।তোমার জন্য পাবনায় একটা সিট বুক করে ফেলি।কি বলো?

আব্রাহাম সাহেবের গলা শুনে সামনে রাগি দৃষ্টিতে তাকালেন মাহমুদা বেগম।আব্রাহাম সাহেবের কথা শুনে গাসু আর তারা হেসেই যাচ্ছে।

----এই এলেন আরেকজন।এমনিতেই এই দুটোকে নিয়ে পারিনা।তুমি এসেছো আগুনে ঘি ঢালতে।
----যাই বল তারা মা,তোর মাকে পাগলা গারদে দেখলে কেমন লাগবে বলতো।আমি বরং একটু চোখ বুজে কল্পনা করে নেই।

তারার পাশের চেয়ারটা তে বসতে বসতে কথাগুলো বললেন আব্রাহাম সাহেব।

----তা যা বলেছো বাপি।মাকে কিন্তু হেব্বি লাগবে।
----হ মেজর সাব।হেব্বি লাগতো।
----তোদের দুটোর আজকে খবর আছে।আর তোমার ও।আমাকে নিয়ে মজা হচ্ছে তাই না।
----তাহলে কাকে নিয়ে করব গিন্নি?
----হুহ,বুড়ো হয়ে গেল ঢঙ গেল না।

আব্রাহাম সাহেবের দিকে মুখ ঘুরিয়ে খাবার বাড়তে শুরু করলেন মাহমুদা বেগম।

;;;;;

----আমার ঘরে আমার বিছানায় তুই কি করছিস নীলা?

নীলা মুখে হাত দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে।ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদছে।নাফিজ রক্তচক্ষু হয়ে দাঁড়িয়ে আছে।

----সেটাই তো।নীলা এটা কোন ধরনের অসভ্যতা।তুই নাফিজের ঘরে কি করছিস?
---- মা আমি তো খেয়াল ই করিনি।গোসল করে বেরিয়েই দেখি বিছানায় নীলা,,,,,ছি।এতো নোংরা মানসিকতা তোর।

নীলা লাফ মেরে গিয়ে নাফিজকে জড়িয়ে ধরতে গেলে ধাক্কা দিয়ে নাফিজ নীলা কে ফেলে দেয়।

----আআআ।
----অসভ্য মেয়ে।তুই আমার বোন ভাবতেও ঘেন্না লাগছে আমার।
----আমি তোমাকে খুব ভালোবাসি নাফিজ ভাইয়া।তুমি কি দেখতে পাও না।সব সময় আমার সাথে এক ব্যবহার কর।আর কি আছে ঐ ছোট্ট মেয়ে টার মধ্যে।ঐ বাচ্চাটার জন্য তুমি ফিরেও দেখো না আমাকে।
----একদম চুপ।মিষ্টিকে এর মধ্যে টানবি না একদম।
----তা কি করব।ঐ মরা বাচ্চাটার জন্য এত দরদ কেন তোমার?
----নীলা,,,,

নাফিজ নীলার দিকে তেড়ে যেতে গেলে লতিফা আটকে দেয়।

----মা ওকে তো আমি আজকে মেরেই ফেলব।ওর সাহস কি করে হয় আমার মিষ্টিকে মৃত বলে।
----মরা কে মরা বলবো নাতো কি বলব। 
----নীলা চুপ কর তুই।
----মা আজকেই তোমার এই ভাইঝি কে এই বাড়ি থেকে বের করবে।না হলে অফিস থেকে এসে যদি দেখি ওকে আমি নিজেই ওকে ঘাড় ধাক্কা দিয়ে বের করে দেব বলে দিলাম।

;;;;;

"এগারো মাসের বাচ্চাকে ধরষন করলো সাতাশ বছরের যুবক"।

খবরের কাগজে হেডলাইন টা দেখে বুকটা কেঁপে উঠলো নাফিজের।ব্রেক টাইমে খবরের পাতা উল্টাচ্ছিল সে।এরকম একটা খবর দেখবে কল্পনা ও করতে পারেনি সে।তার কাছে সব অবিশ্বাস্য লাগছে।আদৌ খবরটা সত্যি তো।সত্যতা পরখ করার জন্য নাফিজ ফোন থেকে ইন্টারনেটে ঢুকলো সার্চ দিতে।

ইন্টারনেটের ছবি দেখে আরো আৎকে উঠলো নাফিজ।এবার আর অবিশ্বাসের কিছুই নেই।ছোট্ট বাচ্চাটির ভেজাইনার রক্তাক্ত ছবি টা তো আর মিথ্যা হতে পারে না।ছবিটা দেখার সাথেই ফোন লক করে দিল নাফিজ।

----এরা মানুষ নাকি জানোয়ার।ছিহ!আচ্ছা আমার মিষ্টি কার হাতে পড়েছিল।ও ঠিকাছে তো?

মিষ্টির কথা মনে পড়তেই বুকটা কেঁপে উঠলো নাফিজের।তার মিষ্টি ও যে ছোটো ছিল।মিষ্টি ঠিকাছে তো।মিষ্টির কোনো ক্ষতি কেউ করেনি তো।মিষ্টি বেচে আছে তো?আজ নাফিজ বড্ড চিন্তিত হয়ে আছে মিষ্টিকে নিয়ে।

আসলেই তো শুধু কি একজন প্রাপ্ত বয়স্ক মেয়ে, আজ তো একটা মেয়ে শিশু ও নিরাপদ নেই।ছোটো বাচ্চা দেখলে যে কেউ কোলে নিতে চাইবে আদর করতে চাইবে এটা ঠিক।কিন্তু কে জানে কারোর মনে এরকম ছোট্ট নিষ্পাপ শিশুটিকে নিয়েও এরকম পরিকল্পনা চিন্তা ভাবনা থাকতে পারে।

আপনি কার কাছে আপনার মেয়ে বাচ্চাটিকে তুলে দিচ্ছেন?খেয়াল রাখছেন তো?ও সে তো ওর চাচা,অমুক তমুক আংকেল।তাতে কি হয়েছে?পুরুষ তো।আপনি কি দেখেন না প্রায়ই এরকম অমুক তমুক আত্মীয়ের দ্বারাই প্রতিনিয়ত কতো শিশু কতো মেয়ে ধরষনের শিকার হচ্ছে।কতজনের খবর পাই আমরা?সবার খবর তো আর খবরের কাগজে উঠে আসে না।কিছু খবর খড়ের গাদার মতো নিচেই চাপা পড়ে যায়।

আদৌ কি সম্ভব হচ্ছে একটা মেয়ে বা মেয়ে শিশুর নিরাপত্তা দেওয়া?সম্ভব সেদিন হবে যেদিন পাল্টাবে আমার মানসিকতা,আমাদের সমাজ।সমাজকে কেউ বদলাতে পারে না।সমাজকে বদলাতে হলে আগে বদলাতে হবে নিজেদের।আমি যদি সচেতন হই তাহলে দেখবেন এই সচেতনতা একটা মেয়ে শিশুর নিরাপত্তা হলেও নিশ্চিত করবে।

চুলায় রান্নার কাজ,অমুক তমুক কাজ সব করার জন্য নিজের বাচ্চাকে কার হাতে তুলে দিচ্ছেন ভুলে যাবেন না।কথায় আছে,"নিজের দাঁত কে ও বিশ্বাস নেই।সুযোগ পেলে একটা কামড় বসিয়ে দেয়।" আমি এটাও বলব না আত্মীয় রা খারাপ।সবাই এক নয়।হ্যাঁ আসলেই সবাই এক নয়।আপনার বাচ্চাটাকে যেই আত্মীয়ের কাছে তুলে দিচ্ছেন দেখা গেল তার এরকম কোনো খারাপ মানসিকতা নেই।কিন্তু ঐ বাচ্চাটি! ওর ক্ষেত্রে কি বলবেন আপনি?

সে যত কাছের মানুষ ই হোক না কেন।নিজের বাচ্চার নিরাপত্তার জন্য হলেও তার তদারকি আপনাকে করতে হবে।চোখে চোখে রাখতে হবে আপনার বাচ্চাটাকে কোথায় নিয়ে যাচ্ছে?হতে পারে এই সামান্য সচেতনতা একটু হলেও কমাতে পারে এরকম নৃশংস পাশবিক ঘটনার হার।দিতে পারে আপনার মা,বোন,মেয়ের,আমার নিরাপত্তা ।

বসে বসে এসব চিন্তা ভাবনা করে যাচ্ছে নাফিজ।

----আসতে পারি ক্যাপ্টেন নাফিজ?

হঠাৎ করে মেয়েলি কন্ঠ শুনে ধ্যান ভাঙলো নাফিজের।সামনে তাকিয়ে দেখে হাসিমুখ নিয়ে ক্যাপ্টেন তানহা দাঁড়িয়ে আছে।

----জি আসুন।

না চাইতে ও ভদ্রতার খাতিরে ক্যাপ্টেন তানহাকে ভেতরে আসতে বললো নাফিজ।প্রয়োজন ছাড়া কোনো মেয়ের সাথে কথা বলতে একটুও পছন্দ করেনা নাফিজ।যদি এটা ভাবা হয় সে ঘৃনা করে তবে সেটা ভুল।মেয়েদের অনেক সম্মান করে সে।কিন্তু ঐ যে সেই ছোট্ট মিষ্টির মুখ নাফিজকে সবকিছু থেকে আটকে রাখে।

----কি ভাবছিলেন?
----আমি?
----হ্যাঁ।আসলে অনেকক্ষণ দাঁড়িয়ে ছিলাম দরজার কাছে আপনার কোনো সাড়া দেখলাম না।তাই ভাবলাম।
----ওহ।
----আপনার সাথে একটা কথা ছিল।
----বলুন।
----ওরিয়েন্টেশনের দিন আপনি বললেন না আপনি কাউকে খুঁজছেন?
----হুম।
----আচ্ছা সে যদি আপনার সামনে সত্যি সত্যি আসে আপনি কি করবেন?

তানহার কথা শুনে নাফিজের বিরক্তি দূর হয়ে যেন চেহারায় কিছু পাওয়ার আকাঙ্ক্ষা ভেসে উঠলো।

----আপনি কি জানেন কোথায় পাব মিষ্টিকে?
----জানিনা।এমনি জিজ্ঞাসা করলাম?

তানহার কথা শুনে নাফিজের মুখটা যেন অমাবস্যার চাঁদের মতো হয়ে গেল।

----আচ্ছা আপনাকে যদি বলি আমি,,,,,,,,,

তানহা কথা শেষ করতে পারল না তার আগেই টেলিফোন বেজে উঠলো।নাফিজ ফোন টা কানে নিল।

----ক্যাপ্টেন নাফিজ বলছি।
----,,,,,,,,,
----ওকে স্যার।আমি আসছি।

নাফিজ ফোন রেখে উঠে দাড়ালো।

----কি হলো?
----আমাকে স্যার ডাকছেন।আসি।

নাফিজ বেরিয়ে গেল।তানহার মুড টাই খারাপ হয়ে গেল যেন।

;;;;;

----আরে তারা মামোনি, কেমন আছো?

মেজর ইমরানের কথায় পিছে ঘুরলো তারা।

----জি আংকেল আলহামদুলিল্লাহ।আপনি কেমন আছেন?
----এই তো।অনেকদিন পর ইউনিটে এলে।আংকেল দের কে ভুলে গেছো নাকি?
----না আংকেল।এমনি আসা হয়নি।কলেজ তাড়াতাড়ি ছুটি দিয়ে দিল তাই ভাবলাম বাপির কাছ থেকে ঘুরে যাই।
----ভালো করেছো।কি খাবে তাই বল?
----না আংকেল।কিছু খাব না।
----আরে বলোতো।
----ও এতোক্খন বসে বসে চারটা রসমালাই খেয়েছে।এখন আর ওকে খাওয়ানোর চিন্তা করো না ইমরান।

মেজর আব্রাহামের কথায় সামনে তাকালেন ইমরান সাহেব।

----আরে আব্রাহাম।কতোদিন পরে অফিসে জয়েন করেছো তুমি।সকাল থেকে তো দেখাই হলো না।
-‐--এসেই তো একটা কাছে গিয়েছিলাম তাই দেখা হয়নি।
----বাপি মারিয়া আপু কোথায় ?
‌----ওহ।ক্যাপ্টেন মারিয়ার সাথে তোমার তো অনেক ভাব তারা মামোনি। যাও ও নিজের অফিসেই আছে।
----আচ্ছা আংকেল।
----সাবধানে যেও মা।
----আচ্ছা বাপি।

তারা ক্রাচ নিয়ে উঠে দাড়িয়ে মারিয়ার কেবিনের দিকে যেতে লাগল।

কাজ শেষ করে নিজের কেবিনেই ঢুকছিল নাফিজ।কিন্তু একজন কে দেখে দাঁড়িয়ে যায়।

নাফিজের কেবিনে উল্টা দিকে ঘুরে কেউ একজন কাউকে খুঁজছে মনে হয়।ব্যক্তিটি আর কেউ নয় তারা।হাতের ক্রাচ দেখে নাফিজের চিনতে অসুবিধা হলো না।

----আপনি আমার কেবিনে কি করছেন তারা?

পুরুষ কন্ঠ শুনে ঘুরে তাকালো তারা।

----আপনি?
----হ্যাঁ আমার কেবিনে আমি ছাড়া কে থাকবে?
----আপনার কেবিন?
----হ্যাঁ।
----এটা না মারিয়া আপু মানে ক্যাপ্টেন মারিয়ার কেবিন?
----ও।আপনি ওনাকে খুঁজছেন?
----হ্যাঁ।
----আসলে এটা আগে ওনার ছিল।আমি আসার পর ওনাকে বাম পাশের বিল্ডিং এ শিফট করা হয়েছে।এটা এখন আমার কেবিন।আপনি বাইরে নেমপ্লেট দেখেননি?
---- দুঃখিত স্যার।আমি আসলে দেখিনি।
----স্যার?আপনি আমাকে স্যার বলছেন কেন?আমি আপনার বাবাকে স্যার বলি।
----তাহলে কি বলবো।আংকেল?
----আংকেল!
----হ্যাঁ। বাপির কলিগদের তো আমি আংকেল বলি।তাই আপনাকেও আজ থেকে আংকেল বলব।
----তাই বলে আংকেল!

নাফিজের যেন কান্না পাচ্ছে তারার কথা শুনে।শেষমেশ কি না তার মতো হ্যান্ডসাম একটা ছেলেকে তারা আংকেল বলে সম্বোধন করলো।

;;;;;

----আংকেল আপনি কি ভাবছেন?

তারার কথা শুনে নাফিজের চেহারায় একদম কাদো কাদো ভাব।

----আপনার আমাকে কোন দিক থেকে আংকেল মনে হয় তারা বলতে পারেন?আমার কি চুল পেকে সাদা হয়ে গেছে নাকি বয়সের থলথলে ছাপ আমার মুখে।নাকি আমার মুখে ইয়া বড় মোজ আছে।নাকি মোটা কালো ফ্রেমের চশমা পড়ে আমি ঘুরে বেড়াই।কি হলো বলুন?

তারা দুদিকে মাথা নাড়িয়ে না বোধক উওর দিল।

----না একদম না।
----তাহলে?
----তাহলে কি বলব।বাপির কলিগদের তো আংকেল বলি তাই আপনাকেও,,,,,,আচ্ছা ভাইয়া বলবো।

তারা বেশ হাসি মুখে উৎসুক হয়ে উওর দিলেও নাফিজের যেন আরেকবার চোখ বের হয়ে আসার উপক্রম।

----ভাইয়া!
----হ্যাঁ ভাইয়া।
----আমি আপনার কোন জন্মের ভাই ছিলাম তারা?

নাফিজের অসহায় দৃষ্টিতে তারার দিকে তাকিয়ে আছে।তারা চুপচাপ দাঁড়িয়ে আছে।একবার নিচের দিকে তাকাচ্ছে আরেকবার নাফিজের দিকে।বেজায় প্যাচালে পড়ে গেছে সে।

----তাহলে কি বলব?
----আপনি বরং ক্যাপ্টেন নাফিজ বলেই আমাকে সম্বোধন করবেন।
----অসম্ভব!
----অসম্ভব কেন?
----বড়দের কে নাম ধরে ডাকতে নেই।বাপি শুনলে রাগ করবে।
----তাহলে?
----আমি বরং আপনাকে শুধু ক্যাপ্টেন বলেই সম্বোধন করি।আপনি একজন সৈনিক হিসেবে দেশের গর্ব।আপনি সবার কাছেই এই ক্যাপ্টেন হিসেবেই পরিচিত।নামে কি এসে যায়।
----আচ্ছা ঠিকাছে।

নাফিজ মুচকি হেসে তারার দিকে তাকালো।

----আমাকে মারিয়া আপুর কেবিনটা একটু দেখিয়ে দেবেন ক্যাপ্টেন?
----ক্যাপ্টেন নাফিজকে আর দেখাতে হবে।আমি নিজেই চলে এসেছি।

দরজার কাছে দাঁড়িয়ে কথাগুলো বললেন ক্যাপ্টেন মারিয়া।দুজনের চোখাচোখি হওয়াতে তারা মারিয়া কে দেখে একটা মিষ্টি হাসি উপহার দিল।

----মারিয়া আপু।
----আমি স্যারের কাছে শুনলাম তুমি আমার কাছে যাচ্ছো।অপেক্ষা র পরেও পেলাম না।তোমাকে খুঁজতে খুঁজতে আমি শেষ।
----আসলে আমি তো জানিনা আপনার কেবিন শিফট করা হয়েছে।
----হুম।সেটা বুঝেছি।এবার চলো।
----ক্যাপ্টেন দুঃখিত।শুধু শুধু আপনার কাজে ব্যাঘাত ঘটালাম আমি।

তারার কথা শুনে নাফিজ বেশ আহত দৃষ্টি নিয়ে উওর দিল,

----কোনো ব্যাঘাত ঘটান নি।
----আসি।
----আবার আসবেন।
----ঠিকাছে।আল্লাহ হাফেজ।
----আল্লাহ হাফেজ।

তারা কথা শেষ করে ধীর পায়ে মারিয়ার দিকে এগিয়ে গেল।মারিয়ার হাত ধরে বেরিয়ে গেল।নাফিজ এখনো তারার যাওয়ার দিকে তাকিয়ে আছে।

----খুব কি ক্ষতি হতো কিছুক্ষণ টাকে বেশিক্ষণ রাখতে।আমি তার নিঃশব্দ হাসিতে আরো একবার মাতোয়ারা হতাম।

নিজের ধ্যান ভেঙে গেল নাফিজের।

----ক্যাপ্টেন।কথাটা আপনার মুখে খুব মানিয়েছে তারা।আপনি কি বলতে পারেন তারা কি জাদু করেছেন আপনি।আজকাল নিজের বাগানের চেয়ে আপনার বাগানটাকেই কেন বেশি ভালো লাগে।কেন এতো টান লাগে?এতো মায়া কিসের?বলতে পারেন?

;;;;;

এক সপ্তাহ কেটে গেছে

----মানুষ কখনোই নিজের অতীত কে ধরে সামনে এগোতে পারে না।আমার ও খুব খারাপ লাগলো সব শুনে।কিন্তু তুমি কি চাও তোমার মা বাবাকে কষ্ট দিতে।জন্ম দান থেকে শুরু করে আজ এই অবধি তুমি এসেছো সব আল্লাহর রহমত।কিন্তু তোমাকে এতদূর আনার জন্য কষ্ট করেছে তোমার মা বাবা।কখনো তাদের কষ্ট দিও না।পিছুটান যদি থেকে থাকে তবে সেটা না ভুলতে পারলেও ভোলার চেষ্টা করতে হবে।
----আমি তো ভুলতে পারছি না।প্রতি নামাজে আমি আল্লাহর কাছে এই একটাই দোয়া করি।তিনি যেন আমাকে সঠিক পথ দেখান।আমি যে বুঝতে পারছি না আমার কি করা উচিত।
----একটা কথা কি জানো আল্লাহ তোমাকে সঠিক পথ দেখাবেন কিন্তু তোমাকে ও সেই পথে যাওয়ার জন্য প্রস্তুত হতে হবে।আল্লাহ তোমাকে বিবেক বুদ্ধি সব দিয়েছেন।তোমাকে আশরাফুল মাখলুকাত সৃষ্টির সেরা জীব হিসেবে সৃষ্টি করেছেন।তোমার নিজের ভালো মন্দ বোঝার ক্ষমতা তোমার আছে।তুমি নিজের যেই পথটা ভালো লাগে সেটাই ধর।সেটা যদি সঠিক পথ হয় আল্লাহ নিজেই তোমাকে সেদিকে ধাবিত করবেন।আর খারাপ হলে তিনি ই তোমাকে সেখান থেকে ফিরিয়ে আনবেন।সবকিছু ই হবে কিন্তু সিদ্ধান্ত তোমাকে নিতে হবে।
----তাহলে আমি তাই করব ইমাম সাহেব।আমার মায়ের চোখের পানি যে আমি দেখতে পারছি না।
----ফি আমানিল্লাহ।আল্লাহ নিশ্চয়ই তোমার সহায় হবেন।
----আসি ইমাম সাহেব।
----আল্লাহ হাফেজ।
----আল্লাহ হাফেজ।

ঈশার নামাজ আদায় করে মসজিদের ইমাম সাহেবের সাথে নিজের মনের কথাগুলো বলছিল নাফিজ।বড্ড উতলা হয়ে যাচ্ছে আজকাল সে।তার নয়নতারা বাগানের এই নতুন ফুলের আগমন সে যে মেনে নিতে পারছে না।কেন হচ্ছে এমন?প্রশ্নের উওর নিয়ে বড় সংশয় আজ নাফিজের মনে।

;;;;;

কলিংবেলের আওয়াজ হতেই বিছানা ছেড়ে উঠে পড়লো লতিফা।শরীরটা একদম ভালো নেই তার।কোমড়ে ব্যথায় সারাদিন বিছানায় শুয়ে ছিল সে।

----তুই এসে গেছিস।এতো দেরি করলি কেন?

দরজা খুলে নাফিজকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে কথাগুলো বললো লতিফা।

----ঐ নামাজ পড়ে ইমাম সাহেবের সাথে গল্প করছিলাম।
----ওহ।
----চলো ভিতরে চলো।তোমার কি অবস্থা তাই বলো।
----আছি।তুই দরজাটা লাগিয়ে দিস।
----আচ্ছা তুমি যাও।

নাফিজ দরজাটা লাগিয়ে দিয়ে লতিফার পিছু পিছু ঘরে গেল।

----মা কাল সিএম এইচ এ যাবে।ডাক্তার দেখাতে হবে তোমাকে।
----আমি তো এখানকার কিছু চিনি না তেমন।
----আমি স্যারকে বলেছি।কাল দু ঘন্টা আউটপাশ নিয়েছি।তোমাকে ডাক্তার দেখাতে যাব।
----আচ্ছা।

এর মধ্যে নাফিজের ফোনের রিংটোন বেজে উঠলো।

----কে ফোন করেছে রে নাফিজ?
----দাঁড়াও দেখছি।

নাফিজ স্ক্রিনে নীলার নাম দেখে প্রচন্ড রেগে যায়।

----মা দেখেছো তোমার ভাইঝির যদি লজ্জা বলতে কিছু থাকে।দেখো বাড়ি পাঠিয়ে দিয়েছি এখন আবার ফোন করেছে।
----আগে রিসিভ করে দেখ কি বলে।

নাফিজ ফোন রিসিভ করতেই ওপাশে নীলার কান্নার আওয়াজ ভেসে এলো।

----নাফিজ ভাইয়া,তুমি এটা করতে পারলে নাফিজ ভাইয়া।
----ছাগলের মতো ভ্যা ভ্যা না করে কি হয়েছে বল।
----নাফিজ ভাইয়া,বাবা আমার বিয়ে ফাইনাল করে ফেলেছে।দুদিন পর আমার বিয়ে।

কথা বলেই আরো জোরে নাক টেনে কেঁদে দিল নীলা।

----শুকরিয়া আলহামদুলিল্লাহ।আহ কতোদিন বিয়ে খাওয়া হয়না।শোন তোর ঐ কিপ্টে বাপ আমার হাড় কিপ্টে মামুকে বলিস একটা এড়ে জবাই দিতে।নিজের মেয়ের বিয়েতে যেন আর কিপ্টামি না করে।আমি কিন্তু কবজি কেন হাত পা সব ডুবিয়ে খাব বলে দিলাম।
----আ নাফিজ ভাইয়া তুমি এভাবে আমাকে বলতে পারলে!
----তাড়াতাড়ি দাওয়াত দিতে বলিস।আর কখনো যেন আমাকে ফোন দিতে না দেখি।ফাজিল মেয়ে।

নাফিজ নীলাকে ধমকিয়েই ফোন কেটে দিল।

----কি হয়েছে রে?
----কি আর হবে।তোমার ভাইঝির ন্যাকামো সব।মামু ওরা বিয়ে দিচ্ছে।সেই নালিশ করতে এসেছে।
----ওহ।তুই কি করবি ভেবে দেখেছিস?
----কিসের কি করব মা?
----আমার একদম ভালো লাগে না তোকে উদাস হয়ে দেখতে।তুই তোর ঐ ছেলে বেলার আবেগটাকে এতো টা মনের ভেতর জেকে রেখেছিস তোকে কি বলব আমি নিজেও বুঝতে পারিনা।

উদাস হয়ে নাফিজ জানালার দিকে তাকিয়ে আছে।জানালার একটা কপাট লাগানো আরেকটা আধখোলা হয়ে আছে।ফাঁক দিয়ে বাকা চাঁদের খণ্ডাংশ দেখা যাচ্ছে।আকাশ ভরা তারা।

----মা জানোতো,একটা জ্বলন্ত পরী আমার জীবনে এসে সব কিছু রঙিন করেছিল,আমি তাকে নিয়েই নিজের কল্পনার জগতে ডুবে থাকতাম।আমার একটা ফুলের রাজ্য হবে।মাঝখানে সেই ছোট্ট পরীটা রানী হয়ে বসে থাকবে আমার রানী।কিন্তু সেই জ্বলন্ত পরীটা আমাকে আবার বেরঙিন করে দিয়ে চলে গেল।কিন্তু আজ এতো বছর পর আবার আরেকটা জ্বলন্ত পরী আমার বাগানে ঢুকে পড়েছে।তার সাথে না হয় চেনা,না হয় জানা,আমি শুধু দূর থেকে তাকে দেখি।তাকে এক নজর দেখার জন্য ছুটে যাই।আমার তৃষ্ণার্ত মন তাকে দেখার জন্য ছটফট করে।আমি যেন এক ঘোরে চলে যাই।এই জ্বলন্ত পরীর আগমন টা কেন হলো বলতে পারো?

নাফিজের উদাস মনের প্রশ্নের জবাব লতিফার কাছে নেই।সে শুধু চেয়ে আছে ছেলের মুখপানে।কিছু পাওয়ার আশা যেন সে আবার দেখতে পাচ্ছে নাফিজের চোখে।

;;;;;

----আআআ বাপি খুব ব্যথা করছে।আমি সহ্য করতে পারছি না।
----এই তো মা।তোমার মা ইনজেকশন দিচ্ছে দেখ সব ঠিক হয়ে যাবে।
----আফা আপনে কাইনদেন না।আপনার কান্না দেখলে যে আমার ও কান্না পায়।
----গাসু আমার খুব যন্ত্রণা করছে।

বিছানায় ছটফট করছে তারা।সিঁড়ি দিয়ে নামতে গিয়ে বেখেয়াল বশত সিঁড়ি থেকে পড়ে গেছিল সে।পায়ে আঘাত লেগেই প্রচন্ড যন্ত্রণা তে ছটফট করছে সে।

মেয়ের কান্না দেখে কেঁদেই দিয়েছেন আব্রাহাম সাহেব।মাহমুদা বেগম ইনজেকশন পুশ করতেই আস্তে আস্তে নিস্তেজ হয়ে যায় তারা।

তারা কে ভালো করে শুইয়ে দিয়ে মাথার কাছে বসে আছেন মাহমুদা বেগম।তিনি ও কাঁদছেন।

----মাহমুদা কিসের ইনজেকশন দিলে?
----ঘুমের ইনজেকশন দিয়েছি।ও ঘুমোক রাতটা ধরে।কি কষ্ট না পেয়েছে আমার মেয়েটা।
----কাইনদেন না ম্যাডাম।
----আমার তখন তোমাকে নিচে ডাকা উচিত হয়নি গাসু।ও নিচে নামার সময় তুমি থাকলে এ অঘটন ঘটতো না।কতো কষ্ট পাচ্ছে ও।
----এসব বলতে নেই মাহমুদা।বিপদ মহান আল্লাহর একটা পরীক্ষা।তিনি পরীক্ষা নেন তার বান্দাদের।ধৈর্য ধরো।কাল ওকে সি এম এইচ এ নিয়ে যেতে হবে।
----হ্যাঁ।তুমি ডাক্তার কে কিন্তু আগেই বলে দিও।
----চিন্তা করো না।আমি ও যাব ওকে নিয়ে।

;;;;;

অনেকক্ষন ধরে গাছের আড়ালে দাঁড়িয়ে আছে নাফিজ।সূর্য ও উঠে গেছে চারপাশ আস্তে আস্তে পরিষ্কার হচ্ছে।কেটে যাচ্ছে আঁধারের ঘনঘটা।

----কি হলো আজ?এমন তো হওয়ার কথা নয়।তারা তো প্রতিদিন আরো সকালে বাগানে আসে।আজ কি হলো ওনার।উনি কি আজ আসবেন না।একবার কি দেখতে পারব না ওনাকে।

নাফিজের মুখটা নিমিষেই মলিন হয়ে গেল।প্রতিদিন অনেক ভোরে উঠে দ্রুত সাইকেল চালিয়ে আসা আবার দ্রুত যাওয়া তারপর অফিস করা যেন নাফিজের অভ্যাসে পরিণত হয়েছে।প্রতিদিন সে এক নজর দেখতে আসে তারা কে।তারা ও প্রতিদিন খুব ভোরে হাঁটা চলা করে বাড়ির সামনে।কিন্তু কেন আসে উওর নাফিজের জানা নেই।

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন