বিয়ের বাকি পাঁচদিন। তন্ময় ভাই কাল সকাল আসবে আটটায়। আমাকে নির্দেশ দিয়েছেন তিনি এসে যেনো, আমায় ড্রয়িংরুমে দেখতে পান। ইশ, এ-তো সোজা? পাগলের মতো কাঁদিয়েছে আমায়। ছয়মাস দেখতে দেয়নি নিজেকে। আসুক। আমিও তাকে এটার শাস্তি দিয়ে ছাড়বো। জাহিল লোক।
এই ছয়মাসের মাঝে কেউ তন্ময় ভাইকে বাড়িতে ফেরাতে সক্ষম হয়নি। তিন মাসের উর্ধ্বে তিনি কখনও ঢাকা থাকেনা। এটাই তার প্রথম মাসের পর মাস ঢাকা থাকা। বড় মা খুবই দুঃখী। দিনে
দু- তিনবার ভিডিও কল করবে নিজের ছেলেকে। অবশ্য, তখন আমি আঁড়চোখে লুকিয়ে স্ক্রিনের দিক তাকাই তাকে একবার দেখার আশায়। যাক। অবশেষে কাল সাহেব ফিরবেন। আনন্দে বুক কাঁপছে। তেমনি তার উপর ভিষণ অভিমান রয়েছে। এই অভিমান তিনি কীভাবে ভাঙাবেন দেখতে চাই আমি।
কলেজ থেকে বেরোলাম ঘুরতে। সাথে রয়েছে মারজি, এহসান।
দৈনন্দিন জীবনে ঘুরাফেরা আমার ঠিক হয়না। ঘুরতে গেলে অনেক বাঁধা আসবে। বাঁধা আর বাঁধা। এভাবে জীবন উপভোগ করা যায়?
উঁহু। একদম না। এইতো কিছুক্ষণের মাঝে কল আসবে তন্ময় ভাইয়ের। উচ্চ স্বরে দিবেন এক ধমক আমায়। ধমকে বলবেন,
- তুই কী চাস? পা ভাঙব তোর?
হাহ। এগুলো পুরনো ব্যাপার স্যাপার। তার সব জানি। আমার ঘুরাফেরা তিনি একদম নিতে পারেন না। আরে নিজে ঢাকায় কি কি করে, আমি কী নাক গলাই? কৈফিয়ত চাই? চাই না। কারণ, আই এম অ্যা ব্রোড মাইন্ডেড পারসন। মারজি নিচুস্বরে বলল,
- এই ব্যাটা এভাবে তাকাচ্ছে কেন?
এইতো। ফোনটা ওদের দুজনের সামনে ধরলাম। তারপর বললাম,
- জাদু দেখবি?
এহসান ভ্রু কুঁচকে ফেলল,
- জোকার হবি?
এটা কোনো কথা?
- ধুর, গাঁধা। দেখ, এখনই আমার ফোনে কল আসবে।
মারজি ভেঙাল।
- বললেই হচ্ছে?
তৎক্ষণাৎ কল এলো। আমার মুখে বাঁকা হাসি। চোখ টিপ মেরে জবাব দিলাম,
- এটা হচ্ছে, অরুর জাদু। কী বুঝলি?
ফোন রিসিভ করলাম। তার কন্ঠ শান্ত। আগেকার মতো গরম কন্ঠে ধমক দেননি। বরং ধীর আওয়াজে প্রশ্ন করলেন,
- কোথায় তুই?
বাহ। এতো পরিবর্তন? সাব্বাশ তন্ময় সাহেব। এমন পরিবর্তন আপনার হতে নিয়মিত চাই। ভাব নিয়ে বললাম,
- আপনার কী?
- ধৈর্যের পরিক্ষা নিচ্ছিস? আমার? তন্ময়ের?
- কে, আপনি ভাইয়া ?
অপর পাশে কেউ তন্ময় ভাইকে ডাকছেন। সে ধীরে জবাব দিলেন,
- কথা বলছি। একটু পর আসছি।
তারপর আমাকে বললেন,
- তোর জামাই?
- ইশ, বললেই হলো।
- আর মাত্র পাঁচদিন। পাঁচদিন যেতে দে।
লজ্জা পেলাম। তাকে টের পেতে দিলাম না। আঁড়চোখে তাকালাম কৌতূহল মারজির দিক।
- আপনাকে বিয়ে করবে কে?
তার হাসির শব্দ।
- ফোনে এতো সাহস দেখাচ্ছিস, হু? সামনে আসলে তো চোখে চোখ রাখতে পারিস না। কাল আসছি। সামনে এগুলো বলতে না পারলে, দেখবি কী করি তোর।
ঢোক গিললাম। সাহস যোগালাম,
- কি করবেন? আপনি ভয়ে আমার সামনেই আসবেন না।
তিনি হাসলেন,
- আম বিজি। রাত্রে কথা বলব। বাড়ি যা। এখনই যাবি।
- হ্যাঁ, তো যান। বিজি থাকুন। আপনাকে ধরে বসে নেই আমি।
দিলাম কল কেঁটে। কী একটা অবস্থা। কাল থেকে কোনো কল দিল না। যাও দিলো, বলে কি বিজি। থাক, বিজি। জন্মের মতো বিজি থাক। কথা বলতে বলেছে কে? শয়তান। কিছুক্ষণ পর আবারও কল দিলেন। ভাবলাম ধরব না। কিন্তু মন? মন্ কী মানে? ধরে ফেললাম।
- বলুন।
সে এক্সপ্লেইন করলেন। খুব ধীর আওয়াজে।
- অনেকদিনের জন্য ফিরছি। মাস খানেক? তার জন্য এখানকার সব সামলে আসতে হচ্ছে। তারপর আর অভিযোগ পাবি না। আপাতত লক্ষি মেয়ের মতো বাড়ি যাবি।
হু। কিউট। মন ভালো হয়ে গেলো। নিমিষেই পৃথিবীর সব ভালো লাগতে শুরু করল।
বাড়িতে গিয়ে দেখলাম রুবি আপু রূপচর্চায় ব্যস্ত। সামনে বিয়ে। নতুন বঁধু কে অবশ্যই গর্জিয়াস লাগতে হবে। আপু আমাকে তাড়া লাগালেন,
- শোন। দ্রুত ড্রেস চেঞ্জ করে আয়।
- কেনো?
- কেনো মানে? সামনে তোর বিয়ে। রূপচর্চা ইজ ভেরি ইম্পর্ট্যান্ট।
বড় মা হাসলেন। ডাইনিং সাজাতে সাজাতে বললেন,
- পরের বাড়ি তুই যাবি। অরু না। ও রূপচর্চা করলেও এখানেই, না করলেও এখানেই।
- হ্যাঁ, তা ঠিক। তারপরও। বিয়ে তো একবারই হবে তাই না অরু?
- হু। আমি করব। রাতে রূপচর্চা করব। এখন ঘুম ধরেছে।
দীপ্ত উপর থেকে দৌঁড়ে আসছে। হাতে ড্রয়িংবুক। রুবি আপুর পাশে বসে বলল,
- রূপচর্চা করে কী হবে? সেইতো পেত্নীই দেখাবে।
আমি আলগোছে উপরে উঠে যাই। নাহলে আমাকেও হেনস্তা করবে। হলও সেটা। দীপ্ত শব্দ করে আমাকে ইঙ্গিত করলো,
- ভাবীপু, কলেজ কেমন গেলো?
লজ্জা আর লজ্জা। আমি দৌঁড়ে উপরে এলাম। এই ছেলে কী আমাকে মেরে শান্তি হবে? অউফ।
রাতে দরজা শক্ত করে লাগালাম। তিনি সকাল আটটায় চলে আসবেন। সামনে যাবো না তার। শুধু আমি লুকিয়ে দেখব তাকে। কিন্তু তাকে আমাকে দেখতে দিব না। একদম না। বিছানায় শুয়ে এপাশ-ওপাশ করলাম। ঘুম আসছে না। প্রচন্ড অস্থির লাগছে।
ফোন হাতে নিলাম। ছবিগুলো দেখতে লাগলাম। এগুলো সেদিনের ঘুরতে যাওয়ার ছবি। একেক করে দেখতে গিয়ে অনুভব করলাম বুক কাঁপছে। তীব্র ভাবে। ক্রমাগত।
বাড়িতে হৈচৈ। নিশ্চয়ই তন্ময় এসে গেছেন। হালকা করে দরজা খুললাম। এভাবেও আমার সারারাত ঘুম হয়নি। এতক্ষণ যাবত ঘড়ির দিক তাকিয়ে ছিলাম। কখন লোকটা আসবে। সময় যেন যাচ্ছিলো'ই না আজ। অবশেষে তিনি এসেছেন। নিচে নেমে বড় মা'র রুমের দরজার সামনে লোকালাম। এখান হতে তাকে সরাসরি দেখা যাচ্ছে। লোকটা কী আরও সুন্দর হয়ে এলো? কী সাংঘাতিক দেখাচ্ছে। বড় মা'র আদুরে কান্না। ছেলের কাছে অভিযোগ করে যাচ্ছেন। দীপ্তর তন্ময় ভাই, তন্ময় ভাই ডাকাটা অপরিসীম মিষ্টি শোনাচ্ছে। বড় চাচ্চুর গম্ভীর অসহায় কন্ঠ,
- তোমাদের হয়েছে? ছেলেটাকে রুমে যেতে দাও।
তন্ময় ভাই আশেপাশে তাকাচ্ছেন। মাথা দরজার পেছনে লোকালাম। দেখে ফেললে সর্বনাশ। শেষ আমি। আলগোছে উপরে উঠে এলাম। দ্রুত দরজা আটকে ফেললাম।
কিছুক্ষণের মাঝে দরজায় নক। তন্ময় ভাই। সেই এতো আওয়াজ করে নক করেন। খুলব না। তুই যা ভাগ।
দ্বিতীয় বার আর নক আসলো না। কী হলো? মাত্র একবার নক করলো? আমাকে দেখার উত্তেজনাও নেই? এই তার ভালবাসার নমুনা? তখনই মেসেজ রিংটোন বেজে উঠল। দ্রুত চেক করলাম। তন্ময় ভাইয়ের মেসেজ।
- What's wrong with oru? ki bolchilam ami?
এহ। কি বলেছিলাম অরু? বলতে থাক। রিপ্লাই দিব না।
টেবিলে বসলাম। খাতার পেইজে বড়বড় অক্ষরে লিখলাম,
' আমার মাথা ব্যাথা করছে। ঘুম প্রয়োজন। ডোন্ট ডিস্টার্ব '
দ্রুত এটা দরজায় লাগাতে হবে। নাহলে জ্বালাতে চলে আসবে রুবি আর দীপ্ত। ব্যস। লাগাতে যাবো তখনই দীপ্তর আওয়াজ।
- ভাবীপু? তন্ময় ভাই এসেছে।
এই অবাস্তবিক ছেলেটাকে কি করব? কয়েকটা মেইন যায়গায় থাপ্পড় দিব? ও লম্বা আওয়াজে আবারও চেঁচাচ্ছে,
- নিচে আসতে বলেছে ভাইয়া। এক্ষুনি।
খুলব না। একদম খোলা যাবে না। বললাম,
- মাথা ব্যাথা। ঘুমাব। কাউকে ডিস্টার্ব করতে না করে দে।
- কি আমার একটা মাথা। দ্রুত না আসলে তোমার মাথা ফাটাবে। আমি গেলাম।
ভয় দেখাচ্ছে? হু। ভয় কে পায়? আমিতো পাই না। এবার দেখব। এই তন্ময় সাহেব কী করেন। হু। পা উঁচু করে বসলাম।
মুডে আছি।
.
.
.
চলবে...............................