আলিয়ার এহেন কান্ডে একদম বিচলিত হলো না শ্রাবণ।তার ভাব খানা এমন আলিয়া তাকে এভাবে হুটহাট জড়িয়ে ধরতেই পারে। এতে অস্বাভাবিক কিছু নেই। শ্রাবণ ও পরম যত্নে আলিয়াকে তার বুকে ঠায় দেয়৷
বেশ কিছুক্ষন পর আলিয়া শ্রাবণ কে ছেড়ে দিল। আলিয়াকে জড়িয়ে ধরার ফলে শ্রাবণের বুকে উষ্ণতার আমেজ এসে গেছে।
আলিয়া শ্রাবণের দিকে কড়া চোখে তাকিয়ে ধারালো কন্ঠে বলে, তুমি আমার সাথে কিছু করেছো? জড়িয়ে কেন ধরেছো আমাকে?
শ্রাবণ আলিয়ার দিকে তাকালো এবং নরম গলায় বলে, কিছু করলে বুঝি তুমি এতো শান্ত থাকতে? তুমি তো প্রতিবাদী।চুপ থাকার মেয়ে না তাই না?
--হুম।
তারপর শ্রাবণ জানালার কাছে গিয়ে পর্দা খুলে দিল। মিস্টি রোদেরা এসে আলিয়ার গায়ে পড়ল। চোখে হালকা আলো পড়ায় সে চোখ কুচকে ফেললো। আলিয়া মাত্র খেয়াল করল, রুমটা এতোক্ষন যাবত অন্ধকার ছিল৷
শ্রাবণ চেয়ারটি আলিয়ার সামনে টেনে এনে বলে, তুমি বস, তোমার জন্য নাস্তা আনছি৷
আলিয়া অবাক না হয়ে পারল না। যেই ছেলে দুই দিন আগে তার কাছে ভাত চাচ্ছিল আজকে সেই ছেলে তাকে নাস্তা খাওয়াবে!
আলিয়াকে কোন কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে শ্রাবণ বেরিয়ে পড়ে৷ শ্রাবণের যাওয়ার দিকে তাকিয়ে থেকে আলিয়াও বাসার বাইরে উঁকি দিল। শ্রাবণ কে দেখা যাচ্ছেনা। তবে পাশেই তিনটা গাছ সারি বেধে দাঁড়িয়ে আছে। একটা গোলাপ গাছ। বাকি দুইটা গাছ চিনে না আলিয়া৷ গোলাপ গাছে কোন ফুল নেই। তিনটা গাছই মরতে বসেছে৷
সে আশেপাশে তাকালো। একটা কল আছে। বেসিন কল, পাশেই মগ। ওযু করার জন্য বুঝি এই ব্যবস্থা!
আলিয়া বাসা থেকে বের হয়ে কলের দিকে গেল এবং এক মগ পানি এনে গাছগুলোতে দিল।
তারপর আবার বাসায় ঢুকল। শ্রাবণ এখনো আসেনি। দুই-তিন জন মহিলা তার দিকে তাকিয়ে ছিল। তাই রুমে ঢুকে গেট ভিজিয়ে দেয় আলিয়া।
রুমটাকে এবার সে পর্যবেক্ষন করতে লাগলো।ছোট্ট একটা বাসা। দুই রুমের। বাথরুম নেই। এই রুম আর ওই রুমের মধ্যে একটা মোটা পর্দা দেওয়া। আলিয়া পর্দা সরিয়ে অপর রুমে ঢুকে পড়ে।
এখানে যে শ্রাবণ থাকে তা বুঝতে পারছে আলিয়া। দরজার উপর দিয়ে একটা শার্ট ঝুলানো। ধূসর রঙের শার্টটা।
আলিয়া শাটটা ধরে দেখল। আলতো করে ছুয়ে দিল শার্টটা।
তারপর রুমের মাঝখানে গেল। বিছানা দিয়েই রুমে ভরে গেছে। একটা ছোট চেয়ার। চেয়ারের উপর মোটা একটা বই। বইটা নেড়েচেড়ে দেখে আলিয়া৷ ইংলিশ বই৷ এটা কি শ্রাবণের? কে জানে?
আলিয়া পুরো রুম জুড়ে চোখ বুলালো৷ বিছানার উপরের দেয়ালে একটা সাদা এ ফোর সাইজের পেপারে একটা স্কেচ আকা। স্কচটেপ দিয়ে আটকানো। লাল স্কচটেপ দিয়ে কাগজটার চারদিক আটকানো ফলে খুলে পড়ার চান্স নেই।
ছবিটা অদ্ভুত সুন্দর। স্কেচটা একটা সমুদ্রের পার কে ফোকাস করে আকা।
বিশাল বড় সমুদ্র, সমুদ্রের ঢেউ আসছে। সমুদ্রের কিনারা ঘেঁষে একটা নারকেল গাছের ছায়ার নিচে দুইজন মানব-মানবী বসে আছে । মানব-মানবী দেরকে পেছন দিক দিয়ে আকা। মেয়েটার চুল আবার বালুতে গড়াগড়ি খাচ্ছে। খানিকটা এলেমেলো হয়ে আছে চুলগুলো। ছেলেটা মেয়েটার কোমড় জড়িয়ে ধরে আছে। তাদের দুজনের দৃষ্টি আকাশের সেই পূর্নিমা চাঁদের দিকে। চাদটা নারকেল গাছের উপরে উঁকি দিচ্ছে। তারমানে এই দৃশ্যটা কোন রাতকে কেন্দ্র করে আকা হয়েছে?
আলিয়া আরো একটু ঝুকে স্কেচটার দিকে তাকালো। তার কেন যেন মানব-মানবীর চেহারা দেখতে মন চাচ্ছে।
স্কেচের নিচে খুব সুন্দর নীল রঙের কালি দিয়ে লেখা, প্রেমবিলাস। তারপর নিচে একটু ছোট করে লেখা, শ্রাবণ সিকদার। ২৪-১২-২০১০।এতো পুরাতন স্কেচ টা? আর এটা শ্রাবণ একেছে?
আলিয়ার বিশ্বাস হচ্ছে না এটা শ্রাবণের আকা ৷ সে ছুয়ে দেখল কাগজটা! ছেলেটার এতো প্রতিভা!
হুট করে কাধে কারো ছোয়া পেয়ে ভয় পেয়ে যায় আলিয়া।
--কি হয়েছে আলিয়া?
আলিয়া চোখ তুলে দেখে শ্রাবণ দাঁড়িয়ে আছে৷
সে যেন হাফ ছেড়ে বাচলো। আজকে শ্রাবণ কে দেখে এক অন্য রকমের অনুভূতি জন্মাচ্ছে আলিয়ার মনে!
কেমন যেন লেগে উঠছে শ্রাবণকে দেখলে!
শ্রাবণ আলিয়ার দিকে তাকিয়ে মুচকি হেসে বলে, এখানে চলে এসেছো কেন? রুম প্রদশর্নের জন্য?
আলিয়ার কেন যেন এই কথা শুনে বেশ লজ্জা লাগলো। সে মাথা নিচু করে নেয়।
শ্রাবণ বলে উঠে, তোমার জন্য বিস্কুট আর কেক এনেছি। এই বাসায় প্লেট যে কই থাকে জানি না। আমি প্যাকেট খুলে দিচ্ছি। তুমি প্যাকেট থেকে নিয়ে নিয়ে খেয়ে নিও। ঠিক আছে?
--হুম। (ঘোর লাগা স্বরে)
আলিয়ার মন ও মস্তিষ্ক ওই স্কেচের উপর পড়ে আছে। এক অদ্ভুত ভালো লাগা কাজ করছে অজানা নামহীন ও অবাস্তব সেই ছেলে-মেয়েটার জন্য! ওরা কারা? আদৌ কি তাদের কোন পরিচয় আছে কি?
শ্রাবণ বলে, বস। বিছানায় বস।
আলিয়া ধপ করে বিছানায় বসে এবং হাত দুটি বিছানায় রাখে। ভেজা কিছুর উপর হাত রেখেছে সে৷ আলিয়ার মনে একটা প্রশ্ন জাগলো তা হলো শ্রাবণের সবকিছু ই কি ভেজা থাকে?
পরক্ষণে তাকিয়ে দেখে চাদরের উপর ভেজা গামছা । সে স্মিত হাসল।
শ্রাবণ এক গ্লাস লেবুর শরবত আলিয়ার হাতে দিয়ে বলে, যেই গাছে পানি দিলা মাত্র, সেই গাছের লেবু দিয়ে বানিয়েছি। খেয়ে দেখো। ভালো লাগবে৷
শ্রাবণের কথামতো আলিয়া শরবতে চুমুক দিল। প্রচুন্ড মিস্টি হয়েছে।
সে শ্রাবণ কে বলে, চিনি অতিরিক্ত বেশি৷
শ্রাবণ হেসে জবাব দেয়, শরবতে মিস্টি বেশি দিতে হয়। নাহলে শরবত খেয়ে মজা পাওয়া যায় না৷
--ওহ!
শ্রাবণ আলিয়ার পাশে বসল। এতে বিরক্ত হয় আলিয়া। সে এখান থেকে সুন্দর মতো স্কেচটা দেখছিল, শ্রাবণ পাশে বসায় তা আর সম্ভব হচ্ছে না৷
শ্রাবণ একটা এনার্জি প্লাস বিস্কুট আলিয়ার হাতে ধরিয়ে দেয়। আলিয়া একটা বিস্কুট হাতে নিয়ে খেতে লাগলো। শ্রাবণ ও তাকে দেখে একেবারে দুইটা বিস্কুট নিয়ে খাওয়া শুরু করল।
আলিয়ার গলা দিয়ে খাবার নামছে না। তারপর ও সে জোড় করে একটা বিস্কুট অনেক কষ্টে খেল৷
তারপর শ্রাবণ কে সরাসরি জিজ্ঞেস করে, ছবি টা খুব সুন্দর। তুমি একেছো?
শ্রাবণ সহজ গলায় বলে, হ্যা৷ আমার আকা। নাম রেখেছি প্রেমবিলাস৷ নামটা সুন্দর না?
--মারাত্মক!
--থ্যাংক্সস ফর ইউর কমপ্লিমেন্ট!
আলিয়া মৃদ্যু হেসে বলে, ছেলে-মেয়ে দুইজন কি করছে?
শ্রাবণ উত্তর দেয়, প্রেমবিলাস করছে৷
--প্রেমবিলাস মানে কি শ্রাবণ?
শ্রাবণ আলিয়ার গা ঘেষে বসে আস্তে করে গলার স্বরে মলিনতা এনে বলে, বৃষ্টির পানি গায়ে লাগালে তাকে বৃষ্টিবিলাস বলে, চন্দ্রের আলো গায়ে মাখালে তাকে চন্দ্রবিলাস বলে তেমনি প্রেমের মায়া গায়ে জড়ালে তাকে প্রেমবিলাস বলে!
--ওহ৷
--ছেলেটা আর মেয়েটা ভালোবাসায় মাতোয়ারা হয়ে প্রেমের মায়া বৃষ্টিতে ভিজছে৷ এই বৃষ্টি চোখে দেখা যায় না। প্রেমের বৃষ্টি তো তাই শুধু অনুভব করা যায়। কেবল অনুভব করা যাবে!
আলিয়া স্কেচের দিকে তাকালো তার কেন যেন খুব ঘুম পাচ্ছে । বিছানায় শুয়ে পড়লে ভালো হত৷।
শ্রাবণ হুট করে আলিয়ার কোলে তার মাথা রাখল৷ আলিয়া ভড়কে গেল।
শ্রাবণ আলিয়ার হাত দুটো আলতো করে চেপে ধরে বলে, জানো, আমার একটা অসুখ আছে৷ খুব ভয়ংকর অসুখ। সম্ভবত সিজোফ্রেনিয়া। এটার নিরাময় কি আমি জানি না৷ অনেক সাইক্রিয়েটিস্ট দেখিয়েছি লাভ হয়নি। আমার দুই বছর কোন স্মৃতি শক্তি ছিল না৷ সব ভুলে গিয়েছিলাম৷ সিংগাপুরে ট্রিটমেন্ট চলেছে আমার। এতো অসুস্থ থাকার পর ও আমি তোমাকে ভুলিনি। আমি জানি আমাকে তুমি কোন দিন মানবে না। মানা উচিত ও নয়৷ আমি তোমার জায়গায় হলে কোন দিন মানতাম না। কিন্তু কি করব বল? মানুষ মাত্র স্বার্থপর জীব, ভালোবাসার কাঙ্গাল!আমার মন বলে, তোমাকে পেলে আমি সেড়ে উঠব। এটা আমার ভুল ধারণা বোধহয়!
শ্রাবণের চোখ দিয়ে পানি টপটপ করে পড়ছে। আলিয়ার চোখেও পানি এসে গেল। কেন এই সিজোফ্রেনিয়ায় আক্রান্ত রোগীর জন্য তার কষ্ট লাগছে? বুকে তোলপাড় উঠছে? কেন মনে কালবৈশাখী ঝড় বয়ে যাচ্ছে? আলিয়ার জানা নেই এই উত্তর!
আলিয়া শ্রাবণ কে তার থেকে দূরে সরানোর চেষ্টা করল। শ্রাবণ তা বুঝতে পেরে আলিয়ার কোমড় চেপে ধরে তাকে আটকিয়ে বলে, আর আধ ঘন্টা অপেক্ষা কর। প্লিজ।
--কেন?
--কেন এর উত্তর নেই। তবে তোমাকে আধ ঘন্টার আগে ছাড়ব না।
আলিয়া আতকে উঠে বলে, তুমি আমার ক্ষতি করবে তাই না?
শ্রাবণ এক ঝটকায় আলিয়ার কোল থেকে মাথা তুলে তার চোখের দিকে তাকালো এবং করুন গলায় বলে, তোমাকে ভালোবাসি আলিয়া! আমার কাছে ভালোবাসার অপর নাম হলো পবিত্রতা। তোমার ভয় পাওয়ার কোন দরকার নেই।
আলিয়া মাথা নিচু করে ফেলে।শ্রাবণ বললো, গাড়ি সঙ্গে এনেছো?
--হুম।
-- আচ্ছা। জানো ছবির মেয়েটাকে তুমি চিনো।
আলিয়া অদ্ভুত ভাবে তাকায় শ্রাবণের দিকে।
শ্রাবণ মুচকি হেসে বলে, বল তো এবার
মেয়েটা কে?
--আমি জানি না।
--ভালো ভাবে দেখো। চিনে ফেলবে৷
আলিয়া স্কেচের দিকে তাকালো। মেয়েটার চুল ছাড়া কিছুই দেখা যাচ্ছে না। কারন মেয়েটা ছেলেটার কাধে হেলান দিয়ে রেখেছে। মেয়েটাকে দেখে মনে হচ্ছে পারলে ছেলেটার বুকের ভেতর ঢুকে যায়!
আলিয়া মনোযোগ সহকারে ছবির দিকে অনেকক্ষণ তাকিয়ে থাকে। বেশ কিছুক্ষন পর শ্রাবণ তার কানে ফিসফিস করে বলে, নিজেকেও চিনতে পারলে না?
আলিয়া শ্রাবণের দিকে চমকে উঠে তাকায়৷
শ্রাবণ ঠোঁটে একটা মিস্টি হাসি ঝুলিয়ে রাখে।
আলিয়া আবার স্কেচটার দিকে তাকালো। এবার সত্যি সত্যি তার কাছে ও মেয়েটাকে একদম অবিকল নিজের মতো লাগছে!
হুট করে বাইরে থেকে আওয়াজ আসতে লাগে।
শ্রাবণ আলিয়ার হাত ধরে রুমের বাইরে নিয়ে গিয়ে, মেইন গেট খুলে বলে, যাও।
--কোথায়? (অবাক হয়ে)
শ্রাবণ শান্ত গলায় বলে, সতের নং বাসার ভেতরে যাও।
--আর্শ্চয্য! আমি কেন ওই খানে যাব?
--হবু ডাক্তার না তুমি? চিকিৎসা দাও।
--তুমি কি বলছো আমি কিছুই বুঝতে পারছি না!
--আসো আমার সাথে।
তারপর শ্রাবণ আলিয়াকে নিয়ে সতের নং বাসায় যায়।
সেখানে একজন প্রেগন্যান্ট মহিলা প্রসব ব্যথায় কাতরাচ্ছে৷
শ্রাবণ আলিয়ার কানে ফিসফিস করে বলে, গাড়ি করে ওনাকে হাসপাতালে নিও যাও।
আলিয়া শ্রাবণের কথায় একধরনের আদেশের সুর টের পেল। তার মধ্যে কি যেন হলো। সে দ্রুত ড্রাইভার কে কল দিয়ে আসতে বললো৷
মিনিট দশ পর আলিয়ার গাড়ি তে করে মহিলাটাকে হাসপাতালে নেওয়া হয়।
শ্রাবণ যায় নি সঙ্গে। সে আলিয়ার গাড়ির দিকে তাকিয়ে থেকে বলে উঠে, তুমি খুব শীঘ্রই বেগুনি রঙের শাড়ি পড়ে আমার কাছে আসবে। তোমাকে আসতে হবেই!
জানো প্রিয়, তোমাকে বেগুনি শাড়িতে সেদিন নয়নতারা ফুলের মতো লাগবে!
.
.
.
চলবে................................