নয়নতারা - পর্ব ৩২ - সুবহান আরাগ - ধারাবাহিক গল্প


পথের চারপাশ দিয়ে উঁচু নিচু পাহাড় দেখা যাচ্ছে।সবুজের সমারোহ চারপাশে।পাহাড়ের ছোটো ছোটো পথ।পাহাড়গুলো দেখে মনে হচ্ছে গাড়ির সাথে সাথে তারাও পথ চলছে।মাঝে মাঝে রাস্তায় লোকজন ও দেখা যাচ্ছে।সবার চেহারা অন্য রকম।আদিবাসী হলে যেটা হয় আর কি।বাঙালিও দেখা যাচ্ছে।বেশ ধীরেই এগিয়ে চলছে প্রাইভেট কারটা।

তারা গাড়ির জানালা দিয়ে বাইরের দিকে তাকিয়ে দৃশ্য উপভোগ করছে।ড্রাইভারের পাশে সৈকত বসা।পেছনে আব্রাহাম সাহেব আর মাহমুদা বেগম।তার পেছনে তারা আর নাফিজ।

তিন টা বছর কেটে গেছে।

আজ সবাই মিলে ময়মনসিংহ এর উদ্দেশ্য এ যাচ্ছে।আজ গাসুর বিয়ে।

নাফিজের বেশ রাগ লাগছে তারার প্রতি।বাইরের দিকে তাকিয়েই বসে আছে।নাফিজের দিকে বিন্দুমাত্র খেয়াল নেই তার।নাফিজ তারার গায়ের সাথে আরো ঘেষে বসলো।তারা একটু চমকে উঠলো।জানালা ছেড়ে পেছনে তাকালো।

ভ্রু নাচিয়ে বললো,

----কি?

নাফিজ তারার কানের কাছে মুখ নিয়ে ফিসফিসিয়ে বললো,

----বউ সোনা তুমি কি মাঝে মাঝে ভুলে যাও তোমার একটা বর আছে।

----আজব!ভুলব কেন?

----তাহলে পাত্তা দিচ্ছো না কেন?

----পাত্তার প্রশ্ন আসছে কেন!

----আসবেই তো।আমার বড্ড হিংসে হচ্ছে ঐ পাহাড় গুলোকে দেখে।আরো ঐ গাছগুলোকে।

----কেন?

----ওদের জন্য আমার বউ সোনা আমার দিকে মনোযোগ ই দিচ্ছে না।

নাফিজ কথা গুলো বলে মুখ টা গোমড়া করে একটু দূরে সরে বসলো।তারার বেশ রাগ হচ্ছে।নাফিজ সব সময় এই এক কাজ করবে।তারার মনে হয় বউ পাগলদের জন্য যদি কোনো নোবেল দেওয়া হতো নাফিজ নিশ্চিত সেটা পেত।উঠতে বসতে তারার আঁচল ঝুলে থাকবে।

----আপনি ও না!একটু ও বদলালেন না।

----বদলানো প্রেমিক পুরুষের ধর্ম নয় প্রিয়তমা।প্রেমিক পুরুষের শুধু ভালোবাসতে হয় প্রয়োজনে ভালোবাসা টাকে প্রতি মিনিটে বাড়াতে হয়।প্রবল করতে হয়।তীব্র থেকে তীব্রতর।বদলে যাওয়া সে তো গিরগিটির কাজ।প্রেমিক পুরুষের বদলানো কখনো সুখ দেয় না প্রিয়তমা।

----আসলেই আপনার সাথে পেরে উঠব না আমি।

----গাসুর তো বিয়ে হয়ে যাচ্ছে।তোমার কষ্ট হবে না?

----হবে।খুব কষ্ট হবে।ওকে আমি আমার বোনের মতো ভালোবাসি।কিন্তু আমি চাই ও ভালো থাকুক।

----ওকে এতো তাড়াতাড়ি বিয়ে দিচ্ছে কেন বলোতো?

----কি করবে?ওর পরিবার যথেষ্ট গরীব।আর পড়াশোনা তো ওর কি বলবো।

----কিন্তু আমি তো জানতাম গারোদের মেয়েরাই বাইরে কাজ করে।ওরা মাতৃতান্ত্রিক ।গাসু ওর বর কে খাওয়াবে কি?

----আগে এমন ছিল।এখন সব বদলেছে।ছেলেরাও কাজ করে।চাষ করা বা চাকরি করা বলুন।গাসুর হবু স্বামী ও তো চাকরি করে।আপনাকে তো বলেছিলাম আমি।

----ও।ভুলে গেছি।

----গাসুর কিন্তু এটা প্রেমের বিয়ে।

----তাই নাকি?

----হুম।হৃদ জেডেন আরেং মানে ওর যে বর তার সাথে ছোট থেকেই ওনার কাহিনী ছিল।

----ওরে নাম!

----হুম।আমিও তো ওদের বাড়িতে গেছি কয়েকবার।খুব অতিথিপরায়ণ ওরা।তখন ও দেখতাম গাসু সুযোগ পেলে একটু ঘোরাঘুরি করতে যেত।

----বাপরে!ঐটুক মেয়ে এতো কিছু!

----হুম।

----কিন্তু আমি ভাবছি অন্য কিছু।

----কি?

----ওর মতো হাফ মেন্টাল কে ঐ কি যেন নাম বললে ও ভালোবাসলো কি করে!

----আপনি আমাকে কিভাবে ভালোবেসেছেন?

তারার প্রশ্ন শুনে ভ্রু কুচকে তাকালো নাফিজ।

----মানে?

----ভালোবাসার সংজ্ঞা লাগে না,কারণ লাগে না।অকারণেই এসে যায়।হুট করে।

কথা বলতে বলতে তারা নাফিজের হাত এর ভাজে নিজের হাত রেখে কাঁধে মাথা রেখে বাইরের দিকে মনোযোগ দিল।নাফিজ মুচকি হেসে নিজেও তাকালো বাইরের দিকে।

;;;;;

গাসুদের বাড়ির সামনে এসে নামলো প্রাইভেট কার।দূর থেকে একটা গারো বাচ্চা তাদের দেখে জোরে চিল্লিয়ে তাদের ভাষায় কি যেন বললো।হয়তো সবাইকে ডাকছে।

একটু পরেই গাসুর মা বাবা বোন গাসু চলে আসলো।গাসু দৌড়ে এসে তারাকে জড়িয়ে ধরলো।

----আফা।

----কেমন আছো গাসু?

----ভালা না।আপনার জন্য কষ্ট লাগে।

----আস্তে আস্তে ঠিক হয়ে যাবে।

গাসুকে সরিয়ে দিয়ে গাসুর বোন মমনী মাংসাং এগিয়ে আসলো তারার দিকে।তারার চিনতে কষ্ট হলো না।এর আগেও এখানে এসেছে সে।

----তারা আপা।

----কেমন আছো মমনী?

----খুব ভালা।আপনে?

----আমিও।

পেছন থেকে গাসুর মা তাদের ভাষায় ওনাদের ভেতরে নিয়ে যেতে বললেন।গাসুদের বাড়ি একদম সাধারণ বাড়ি ঘরের মতোই।আধুনিকতা সব জায়গায় ছেয়ে গেছে।এখন আদিবাসীরাও উন্নত হয়েছে।তাদের ঘর বাড়ি চাষ পদ্ধতি কিছু কিছু জিনিস বেশ পরিবর্তন করেছে তারা।

ভেতরে ঢুকতেই মমনী তারা আর নাফিজকে একটা ঘরে নিয়ে বসতে দিল।গাসুর বিয়ে তাই তাকে লাফালাফি কম করতে দেওয়া হচ্ছে।মমনী সব কাজ করছে।

----আপা আপনারা বসেন এখানে।

----মমনী শোনো?

----হ আপা।

----তোমার বিয়ে না দিয়ে আগে গাসুর বিয়ে হচ্ছে যে?

----আপা আমি সন্ন্যাসিনী হতে চাই।আমি মানুষের সেবার কাজে যেতে চাই।মাদার তেরেসার মতো।এজন্য গাসুটার বিয়ে হচ্ছে।

----ও আচ্ছা।

----আপনারা বিশ্রাম করুন।ও আরেকটা জিনিস ভুলে গেছি।

----কি?

মমনী ঘরের বাইরে গেল।একটু পর আবার আসলো।হাতে কিছু কাপড় নিয়ে।নিয়ে তারার হাতে দিল।

----এগুলো কি?

----আমাদের মহিলাদের জাতীয় পোশাক।দকমান্দা আর দকশাড়ি।আর এটা পুরুষদের

ধুতি।আপনাকে আগে কখনো তো দেই নি।বিয়ে উপলক্ষে উপহার এটা আপনার জন্য।পছন্দ হলে পড়বেন।

----আচ্ছা।

মমনী চলে গেল।নাফিজ বসে বসে ঘরের চারপাশে চোখ বুলাচ্ছে।তারা কাপড় গুলো নিয়ে বিছানার ওপর রাখলো।

----রাখলে কেন?পড়বে না?

----পাগল আপনি!আমি ওরকম করে শাড়ি পড়ে বের হব!এদের কালচার এটা।আমার তো না।

----তাহলে নিলে যে?

----খুশি হয়ে দিয়েছে।নিলাম।

----যাই বলো।পড়লে তোমাকে বেশ লাগবে।

নাফিজ তারা দিকে দুষ্টু হাসি দিয়ে বললো।

;;;;;

দুপুর হয়েছে।

মাহমুদা বেগম আর আব্রাহাম সাহেব বাইরে বেরিয়ে ঘুরে দেখছেন।

কয়জন মহিলারা একসাথে এক জায়গায় বসে কাটাকুটি করছে।পেয়াজ রসুন কাটছে।ওপাশে ছোট ছেলেমেয়েরা ছোটাছুটি করছে।বয়স্ক রা এদিকে বড় বড় পাতিলে রান্না বসিয়েছে।একদল ছেলে কলার পাতা কেটে এনেছে।সেগুলোকে কেটে ছোট করছে।

দুপুর গড়িয়ে বেশ বেলা হয়ে গেছে।সবাই খেতে বসেছে।অতিথি দের জন্য আলাদা প্যান্ডেল করা।গারোরা মানুষকে খুব সহজে আপন করে নেয়।আশে পাশের মুসলিম প্রতিবেশী দের ও তারা দাওয়াত দিয়েছে।তাদের খাবারের আয়োজন,তাদের প্যান্ডেল সব কিছু আলাদা।বেশ সম্প্রীতি বজায় রেখে চলে গারোরা।

মমনী তারা সহ সবাইকে নিয়ে প্যান্ডেলে বসিয়ে দিয়ে এসেছে।

----কলার পাতায় খেতে হবে?

----হ্যাঁ আপা।আমাদের এখানে প্লেটে ও দেওয়া হয়।কিন্তু বিয়ের অনুষ্ঠান।কলাপাতার ঐতিহ্য ই আলাদা।অনুষ্ঠানে অন্তত এটা থাকবেই।

তারা তো একবার কলাপাতার দিকে তাকাচ্ছে।একবার খাবারের দিকে।কলা পাতায় কিভাবে খাবে সে এটাই বুঝতে পারছে না।নাফিজ হুট করে তারার হাতের ওপর হাত রাখলো।তারা নাফিজের দিকে তাকাতেই নাফিজ ইশারায় চুপ থাকতে বললো।

----মমনী তুমি যাও।আমরাও আজ উপভোগ করব তোমাদের এই ঐতিহ্য।

----আচ্ছা জামাইবাবু।

মমনী চলে গেল।এদিকে আব্রাহাম সাহেব আর মাহমুদা বেগম ও বেশ ব্রিবত বোধ করছেন।সবজি আর ভাত নিয়েছেন তারা পাতার ওপর।ধরতেই পারছেন না ঠিকমতো।তার মধ্যে আবার তরকারির ঝোল কলাপাতা একটু কাত হওয়ার কারণে চুয়ে পড়ছে।নাফিজ তরকারি তুলে ভাত দিয়ে মেখে তারার মুখের সামনে ধরলো।

----আমাকে দিচ্ছেন কেন?

----তোমার কষ্ট করতে হবে না।চুপচাপ খাও।

----সবাই দেখছে তো।মা বাপি আছে।

‌----থাকুক গে।আমার বউকে আমি খাওয়াচ্ছি।তো?

তারা এদিক ওদিক তাকাচ্ছে।এতক্ষণে আব্রাহাম সাহেব মাহমুদা বেগম সৈকত ও বিষয় টা খেয়াল করে মিটমিট করে হাসছে।তাতে নাফিজের কি?সে দিব্যি ভাতের লোকমা নিয়ে তারার মুখের সামনে ধরে বসে আছে।তারা লজ্জা শরমের মাথা খেয়ে হা করলো।এদিকে যে তার খুব খিদেও পেয়েছে।

কয়েকজন লোক বার বার বড় গামলা নিয়ে সকলের সামনে ঘোরাফেরা করছে।কেউ ভাত তরকারি কিছু নেবে কিনা সেটা দেখছে।

;;;;;

রাতের বেলা।একদল গারো মহিলা ঘিরে রেখেছে গাসুকে।গাসু ও দকমান্দা পড়েছে।গাসুকে এখন গায়ে হলুদ দেওয়া হবে।গারোদের এই নিয়ম।তারা মূলত দুই নিয়মে বিয়েটা করে।দুটোই প্রায় একই।রাতের বেলা মেয়ের গায়ে হলুদ হবে।পরের দিন সকালে বরের বাড়ি থেকে লোক আসবে।গাসুকে নিয়ে যাবে।

পরের দিন সকাল বেলা।

রাতে তেমন একটা ঘুম হয়নি তারার।অনুষ্ঠান দেখছিল সে।নাফিজ অনেক আগেই ঘরে চলে এসেছিল।এখন আবার বাইরে চেঁচামেচির আওয়াজ।বরপক্ষ এসেছে।

মমনী এসে তারা নাফিজ সবাইকে বাইরে নিয়ে গেল।

বর পক্ষ এসেছে।বর কে দেখতে বেরিয়ে এলো সবাই।নাক বোচা, চুল খাড়া খাড়া,ফর্সা গায়ের রঙ।

একটু পর গাসুকে বেশ সাজিয়ে আনা হলো।তাকে হৃদ জোডেন আরেং এর পাশে বসানো হলো।গাসুরা খ্রিষ্টীয় ধর্মের অনুসারী।এজন্য ফাদার (খ্রিস্টীয় ধর্ম যাজক) আসলেন।তিনি আসার পর দুজনকে আশীর্বাদ করলেন।গাসু আর হৃদের মালা বদল হলো।আংটি পড়ালো দুজন দুজনকে।সবাই একে একে আশীর্বাদ করলো দুজনকে।এই অনুষ্ঠান টা অনেকটা এংগেজমেন্ট এর মতো।এর কথা তারা আগেও শুনেছিল গাসুর মুখে।

একটু পর একটা মেয়ে একটা থালা নিয়ে আসলো।থালা ভর্তি পান।তারপর আরেকজন চিনি আনলো।সবাইকে বিতরণ করছে তারা।মমনী তারাদের কাছে একটা থালা নিয়ে আসলো।তাতেও পান একপাশে অপর পাশে চিনি রাখা।

----এগুলো কি জন্য মমনী?

----আপা এই অনুষ্ঠান টাকে আমরা পানচিনি বলি।বর বউয়ের মালাবদল আংটি বদলের পর পানচিনি মুখ করা হয়।পান না খেলেও চিনি সবাইকে মুখে দিতে হবেই।

----আচ্ছা দেও।

মমনী সকলকে পান চিনি দিয়ে চলে গেল।তারা নাফিজ সবাই বসে বসে পান চিবুতে চিবুতে অনুষ্ঠান দেখছে।বর পক্ষ উপহার বিতরণ করছে।আসার সময় তারা পরিবারের বয়স্কদের জন্য শাড়ি,ধুতি সহ বিভিন্ন উপহার নিয়ে এসেছে।

সব অনুষ্ঠান শেষ করতে করতে দুপুর গড়িয়ে গেল।বরপক্ষ খাওয়া দাওয়ার পর গাসুকে নিয়ে গেছে।আজ তারা সেখানেই থাকবে রাতে।রাতে বরপক্ষের বাড়িতে নাচ গান সহ বিভিন্ন অনুষ্ঠান হবে।ছোট রা কবিতা আবৃতি করে।যুবক যুবতীরা নাচ গান করে।বর কনে চাইলে ঘুমাতে ও পারে।কিন্তু বেশিরভাগ সময় সবার জোর জবরদস্তি তে সারারাত জেগে অনুষ্ঠান দেখতে হয় তাদের।

দুপুর বেলা খাওয়ার পর আরেক কান্ড।

গারোদের কৃষ্টি হলো বিভিন্ন অনুষ্ঠানে চু (মদ) খাওয়া। (এটা গারো মহিলারা ভাত পচিয়ে কিভাবে যেন বানায়।রংও সাদা হয়। কিছু কিছু হালকা খয়েরি না লালচে বর্ণের হয়। কিছু তিতা, কিছু কিছু পুরা জুসের মত মিষ্টি। সাদা গুলা বেশির ভাগই পানসে সাদবাত না) 
সবার খাওয়া শেষে বয়স্ক, যোয়ান, পুরুষেরা চু নিয়ে বসেছে। এরও একটা ধরন দেখা যাচ্ছে। চেয়ার সুন্দর করে গোল করে বসানো  বা চারকুনাইচ্চা। মাঝের জন নিজের কাছে ডিকথম (যেখানে ভাতসহ চু থাকে  সেটা ডিকথম) রেখেছে। তার সামনে তিন চারটা ডিকথন আছে। সে বোতল বা বাঁশের তৈরি বোতলের মত গোল একটা জিনিস দিয়ে নাড়াচ্ছে। বোতলের শেষপ্রান্তে ছিদ্র করে নেওয়া হয়েছে। সেটা দিয়া ঐ ডিকথমের ভেতরে থেকে চু নাড়িয়ে জগে ঢালা হচ্ছে। জগভর্তি করে পাশ করে করে  দেওয়া হচ্ছে। গ্রামের প্রাপ্ত বয়স্ক প্প্রায় সবাই আছে প্রায় মানুষ । অতিথি'দেরও দেওয়া হচ্ছে।কেউ না খেলে তাকে আর সেধে দেওয়া হচ্ছে না।

রাত পেরোলেই পরের দিন সকালে গাসুর বিয়ে হবে চার্চে।গারো মেয়েদের বিয়ের সময় মেয়ে ও ছেলে উভয়ের পাশে একটি করে চেয়ার থাকে।সেখানে যার যার পক্ষের সাক্ষী থাকে।এরপর বিয়ে হয়।বিয়ের সময় বর কেন চাইলে তাদের ঐতিহ্য বাহী পোশাক ও পড়তে পারে।চাইলে অন্য পোশাক ও।

;;;;

বিকেল বেলা ।

গারোরা যেহেতু মাতৃতান্ত্রিক ।সকাল  বেলা চার্চে বিয়ের পর গাসু তার জামাইকে নিয়ে নিজ বাড়িতে এসেছে।এখন গাসু তার পরিবার রাস্তার কাছে দাঁড়িয়ে আছে।তারা দের বিদায় দেবে বলে।

----সাকি ভাই।আপনের বিয়েতে কিন্তু মুই যামু।আমারে যেন ভুইলা যাইয়েন না।

----না গাসু।তুমি অবশ্যই যাবে।তারা যদি যায় তবে তুমি ও যাবে।

----আইচ্ছা।

সবার সাথে কথা বলে গাসু এবার তারার সামনে আসলো।তারা তো বার বার চোখ মুছছে।চোখের পানি আটকাতে পারছে না।গাসু এসেই তারাকে জড়িয়ে ধরে কেঁদে দিল।

----এই গাসু।কাদছো কেন?

----আমি আপনারে রাইখা কেমনে থাকব আফা।

----আমার ও কষ্ট হবে গাসু।তুমি যাবে তো।তোমার বর কে নিয়ে যাবে ওখানে।

----আপনে ভুইলা যাবেন নাতো আমারে?

----না গাসু।তোমাকে কি ভোলা যায়?

----আপনে যাইয়েন না আফা।

----গাসু শোনো।

----হ আফা।

----আংআ নাংখো নাম্মিনিগ্গিংআ।(আমি তোমাকে ভালোবাসি)

----আপনেও শিখে গেছেন আফা!

----তুমি আমার জন্য অনেক কিছু শিখেছো।আমি এটা পারব না!

গাসু আবার কেঁদে তারাকে জড়িয়ে ধরলো।

----আংআ নাংখো নাম্মিনিগ্গিংআ আফা।

;;;;; 

মানুষের জীবন টা একদম তাসের ঘরের মতো।একবার একটু বাতাসের ছোঁয়া লাগলেই তাকে ভেঙে পড়তে হয়।কখনো বা ভাঙন টা এমন হয় যে সোজা হয়ে দাঁড়ানোর শক্তি টুকু পর্যন্ত থাকে না।কখনো বা ভাঙন টা এর চেয়েও মারাত্মক হয়ে দাড়ায়।একদম পিষিয়ে ফেলে মাটির সাথে।শ্বাস নেওয়ার জো টুকু ও থাকে না। 

----এসব কেন বলছেন ক্যাপ্টেন? 

তারার প্রশ্ন শুনে বেলকনির গ্রিল থেকে হাত সরিয়ে পেছনে ঘুরলো নাফিজ।তারা দোলনায় বসে উৎসুক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে নাফিজের দিকে। 

----আছে আছে।বলার অনেক কারণ আছে। 

নাফিজ ও তারার পাশে গিয়ে বসলো।তারা ঘাড় ঘুরিয়ে আবার নাফিজকে প্রশ্ন করলো, 

----কি কারণ?শুনি। 

নাফিজ তারার কাঁধে হাত রেখে নিজের কাছে টেনে নিল। 

----তারা পাখি, যদি কখনো এমন হয় আমি হুট করে বেরঙিন হয়ে যাই,আমার অস্তিত্ব গুলো বিবর্ণ হয়ে যায়,নামের অক্ষর গুলো রাবার দিছে মোছার মতো একটু একটু করে মুছে যায় তুমি কি ভুলে যাবে আমাকে? 

নাফিজ এর কথা শুনে কেঁপে উঠলো তারা।নাফিজ এর থেকে নিজেকে ছাড়িয়ে নিল।মাথা উঠিয়ে নাফিজের দিকে তাকালো।এক অজানা ভয়ে কেঁপে উঠলো সে।মূহুর্তে ই যেন চোখের কোনে পানি চলে এলো।দমবন্ধ অনুভূতি অনুভব করছে তারা।বুকের ভেতর এক অজানা ঝড়ের আভাস। 

----কি বলতে চাইছেন কি আপনি?
----আরে কাদছো কেন?
----ফাজলামি করছেন আপনি!আমার সাথে ফাজলামি করছেন!
----ফাজলামি না বউসোনা।তোমার চাঁদের কনা থেকে যদি আমি আস্তে আস্তে বিলীন হয়ে যাই,হারিয়ে যাই অতল গহ্বরে তুমি কি ভুলে যাবে আমাকে?আমার স্পর্শ,প্রেমকাতরতা সেগুলো ও কি বিলীন হয়ে যাবে চিরতরে তোমার মন থেকে?নাকি আমার নাম করে একটা ছোট্ট নয়নতারা গাছ লাগাবে।রোজ তাতে পানি ঢালবে,যত্ন করবে,তাকে  জড়িয়ে ধরে অনুভব করতে চাইবে আমার অস্তিত্ব? 

নাফিজের প্রতিটা প্রশ্ন তারাকে কাঁপিয়ে তুলছে।কি বোঝাতে চাইছে নাফিজ!কিসের বিলীন হতে চায় সে?তারা ঘেমে গেছে নাফিজের কথা শুনে।জোরে জোরে শ্বাস নিচ্ছে।নাফিজ এক নজরে তারার দিকে তাকিয়ে আছে।তারার ছলছল চোখ গুলো ও যেন নাফিজকে প্রশান্তি দিচ্ছে।কেন দিচ্ছে সেটা শুধু নাফিজ ই জানে।তারার কাপুনিটা আরো বাড়িয়ে দিল নাফিজ।তারার ঘর্মাক্ত গালে ঠোট ছোয়ালো। 

তারপর বললো, 

----আমি যদি কখনো মরে যাই তুই কি ভুলে যাবি আমায়?আমাকে মাটি দিয়ে রেখে কি অন্যত্র যাবি সুখের খোঁজে।যদি কোন সুখ পাখি আসে!তোকে নিয়ে যায়।আমার বড্ড ভয় হয় রে।আমার উপস্থিতিতে কারোর হতে পারবি না তুই।আমার অনুপস্থিতি টাতে তোকে হারাতে পারব না রে। 

তারা নাফিজের বুকের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়লো।কান্নায় ভেঙে পড়লো। 

----কি শুরু করেছো তুমি?কেন এসব বলছো?আমাকে ছেড়ে কোথাও যাবে না তুমি।যদি যাও তো জেনে রেখো তোমার এই নয়নতারা বাগানের সব গাছ সেদিন শুকিয়ে যাবে আর তোমার রাণীও হারিয়ে যাবে চিরতরে।কেন কষ্ট দিচ্ছো আমাকে?
----কষ্ট না পাখি।একটা চরম সত্যি।জীবনটা কখনো খুব দুঃখের।কখনো খুব সুখের।সুখ দুঃখ সব কিছুর মাঝে যে আমরা ভুলে যাই এর যে একটা সমাপ্তি আছে।দু চোখ যদি একবার বন্ধ হয় না,অন্ধকার যদি একবার গ্রাস করে নেয়,আমি নাফিজ তখন কেউ চিনবে না রে।থাকবে না কোনো পরিচয় ।আমি সব লাশ। 

নাফিজের কথা শুনে ভয়ে আরো ডুকরে কেঁদে উঠলো তারা।নাফিজকে আরো জোরে জাপটে ধরলো। 

----ক্যাপ্টেন আমি মরে যাব তোমাকে ছাড়া।কি শুরু করেছো তুমি?
----তুই আমাকে জীবনে অনেক কষ্ট দিয়েছিস।কখনো বুঝে কখনো না বুঝে।কষ্ট কেন আমি একতরফা পাব বলতো? 

নাফিজের কথা শুনে নাফিজের বুক থেকে মাথা তুললো তারা।তারা কেঁদে একদম নাকে জলে হয়ে গেছে।কিন্ত নাফিজের মুখে এখনো হাসির রেখা। 

----কি বলতে চাইছেন আপনি?
----দুজনের ই সমান সমান হওয়া উচিত না বল?
----চুপ করুন আপনি।আজ সন্ধ্যা তেও ভালো ছিলেন।কি পাগলামি শুরু করেছেন?
----দেখিস তুই ও কষ্ট পাবি।খুব কষ্ট।তুই না জেনে না জেনে আমাকে যেই কষ্ট টা দিয়েছিলি তার জন্য তুই ও কষ্ট পাবি।
----আপনি কি আমাকে অভিশাপ দিচ্ছেন!
----উহুম।কখনো না।তোকে কখনো আমি অভিশাপ দিতে পারি বল?প্রকৃতির প্রতিশোধ বলে একটা কথা আছে জানিস?
----আমি তো জেনে কষ্ট দিতে চাইনি।সব তো বলেছি আপনাকে।আপনি আমাকে ক্ষমাও করেও দিয়েছেন।কেন পুরানো কথা টানছেন?
----মানুষ অতীতের কর্মফল ভোগ করে মিষ্টি পাখি।জানিস না তুই। 

নাফিজ কথা গুলো বলে উদাস হয়ে রাতের আকাশের দিকে তাকিয়ে আছে।আজকের নাফিজকে বড্ড অচেনা লাগছে তারার।তিন বছরের বৈবাহিক জীবনে কখনো এমন মনে হয়নি তার। তারার চোখের পানিতে ও কোন হেলদেল নেই নাফিজের আজ। 

----একটা সত্যি কথা বলবেন?
----কি?
----আপনার কি এখন নতুন কিছুর প্রয়োজন পড়েছে?
----কি নতুন?
----আমি তো আপনাকে বলেই ছিলাম একদিন ভালো লাগবে দুদিন লাগবে।তৃতীয় দিন থেকে বিতৃষ্ণা চলে আসবে।সেই বিতৃষ্ণার দিন হয়তো চলে এসেছে ক্যাপ্টেন নাফিজ। 

তারার কথা শুনে আকাশ থেকে চোখ সরিয়ে তারার দিকে তাকালো নাফিজ। 

----মানে? 

তারা দেয়ালের কাছ থেকে ক্রাচ নিয়ে উঠে দাড়ালো।ঘরের দিকে পা বাড়ালো। 

----আমার উওর দিয়ে যাও তারা। 

নাফিজের কথাতে দাড়িয়ে গেল তারা।ছলছল চোখে পেছনে ঘুরলো। 

----উওর।বেশ তো শুনে নিন।বলেই দিচ্ছি।আপনি একজন সুস্থ সামর্থ্য বান পুরুষ।কোন কিছুর কমতি নেই আপনার।কেন আমার মতো একটা পঙ্গু মেয়ের জন্য নিজের পুরো জীবন টা নষ্ট করবেন বলুন তো!হাহ। আমিও বোকা।অন্ধ হয়ে গেছিলাম।কিন্ত এটা বুঝিনি বাস্তব বাস্তবই হয়।আর এই বাস্তবতা বড্ড কঠিন।আমার মতো মেয়ের জন্য কখনোই কেউ নিজের পুরো জীবন নষ্ট করবে না।বিতৃষ্ণার দিন হয়তো চলেই এসেছে।নয়তো আমার চোখের পানি যাকে কাদাতো সে আজ হাসে।আমার কষ্ট যে সইতে পারে না সে চায় আজ আমি কষ্ট পাই।সে চায় সে আমার জীবন থেকে বিলীন হয়ে যাক।বিতৃষ্ণা গ্রাস করেই ফেলেছে আপনাকে ক্যাপ্টেন নাফিজ। 

তারা কথা গুলো ভেতরে চলে গেল।নাফিজ এখনো হা হয়ে বসে আছে।নাফিজ তো এটা বুঝতেই পারছে না কি থেকে কি হয়ে গেল।সে বোঝাতে চাইলো কি আর তারা বুঝলো কি?নাফিজের মেজাজ চরম খারাপ পর্যায়ে পৌছালো।নাফিজ রাগে গজগজ করতে করতে উঠে ঘরের ভেতর গেল।তারা বিছানায় বসতে যাবে তার আগে নাফিজ তারার হাত ধরে জোরে টান মারলো।নিজের কাছে আনলো। 

----আহ!কি করছেন টা কি?আমি হাতে ব্যথা পাচ্ছি?
----কি করেছি?আমি করেছি না তুই করেছিস।
----আজব!আমি কি করলাম।
----তুই আস্ত একটা গাধা। মাথা মোটা।মাথা ভর্তি গবর নিয়ে তুই কিভাবে পরীক্ষা য় ফারস্ট হোস বলতো?
----আবার কি শুরু করেছেন হ্যাঁ?
----থাপড়িয়ে তোকে সোজা করব আমি।কিছু না বলতে বলতে বেশি বেড়ে গেছিস।বেশি পেকে গেছিস তাই না।
----আরে।আমি কি করেছি।হাত ছাড়ুন আমার।আমি চলে যাব।চিন্তা করবেন না।আমি কারোর বিতৃষ্ণা হয়ে থাকব না।কাল ই বাপির কাছে চলে যাব।
----তোকে আমি,,,,,। 

নাফিজ তারাকে থাপ্পড় মারার জন্য হাত উঁচু করতেই থেমে গেল আবার।এদিকে কষ্টে তারার বুক ফেটে যাচ্ছে।চোখ দিয়ে টপ টপ করে পানি পড়ছে।আজ কিনা নাফিজ তাকে মারতে চাইছে! 

তারাকে ছেড়ে দিয়ে নাফিজ আবার বেলকনিতে চলে গেল। 

;;;;; 

রাত বারোটা বাজে। 

অনেক কষ্টে নিজেকে শান্ত করলো নাফিজ।নিজের প্রতিই ঘৃনা লাগছে তার।রাগ হয়েছে ভালো কথা।তাই বলে সে তারাকে মারতে উদ্যত হবে ?রাতের ঘটনা মনে পড়তে ভীষণ লজ্জা লাগছে নাফিজের।যত যাই হোক।স্বামী স্ত্রীর মধ্যে ঝগড়া ঝামেলা হতেই পারে।ঐ যেমন কথায় আছে ঘটি বাটি পাশাপাশি থাকলে ঠোকাঠুকি তো একটু হবেই।সবার মতের যে মিল থাকবে এমন তো নয়।কিন্তু রাগ করা ঠিক নয়।রাগ দূরত্ব কে আরো বাড়িয়ে দেয়।অভিমানের দেয়াল টাকে আরো উঁচু করে তোলে।আজ যদি নাফিজ তারার গায়ে হাত তুলতো যাই হোক,সব কিছু হয় তো আবার ঠিক হয়ে যেত।কিন্তু জীবনের শেষ প্রান্ত পর্যন্ত একদিনের জন্য হলেও তারার মনে পড়তো এই ঘটনা।তারার মনে দাগ কাটতো।নাফিজ নিজের কাজের জন্য যথেষ্ট লজ্জিত। 

----আমি ওর স্বামী।ওর সব দায়িত্ব আমার।ওর ভুল গুলো শুধরে দেওয়ার দায়িত্ব ও আমার।ও না বুঝলে ওকে বুঝিয়ে দেওয়ার দায়িত্ব ও আমার।কিন্তু আমি কি করলাম এটা!নাহ।আমার ওর কাছে ক্ষমা চাওয়া উচিত। 

নাফিজ উঠে দাঁড়ালো ।ঘরের দিকে পা বাড়ালো। 

তারা বিছানার ওপর পা ঝুলিয়ে দিব্যি বসে আছে।নাফিজ ঘরে ঢুকে একবার ঘড়ির দিকে তাকালো।ঘড়ির কাটা বারোটা ছেড়ে গেছে।আর সাত মিনিট সময় যোগ হয়েছে সাথে।নাফিজ আবার তারার দিকে তাকালো।মাথা নিচু করে বসে আছে।একটু পর পর ফুলছে।নাক টানছে।চোখ মুছছে বার বার।তারা যে খুব কেদেছে নাফিজ বুঝতেই পারছে। 

নাফিজ তারার সামনে গিয়ে ফ্লোরে ধপ করে বসে পড়লো।নাফিজকে দেখে তারা চমকে উঠলো।নাফিজ তারার হাঁটুর ওপর নিজের হাতদুটো রেখে তার ওপর নিজে মাথা রাখলো।ড্যাপ ড্যাপ করে নাফিজ তারার দিকে তাকিয়ে আছে।চোখ মুখ ফুলে লাল হয়ে আছে তারার।নাফিজের বেশ লাগছে তারাকে এভাবে দেখতে।তারা চোখ মুছে মুখ গোমড়া করে নাফিজের দিকে তাকালো।নাফিজ এর বাচ্চাদের মতো দৃষ্টি দেখে তারা চুপ করে আছে।কি করতে চাইছে নাফিজ? 

----বউসোনা,চাঁদের কনা।আর কাদেনা।তুমি কাদলে আমিও কেঁদে দেব। 

তারা চুপ করে নাফিজের দিকে তাকিয়ে আছে।কোন উওর দিচ্ছে না। 

----বউ সোনা।
---- কি হয়েছে টাকি?
----সরি।
----,,,,,,,,,,,।
----বউসোনা সরি।আমাকে ক্ষমা করে দেও।
----আপনি কোন ভুল করেননি যে আমি আপনাকে ক্ষমা করব।
----বউসোনা।শোনো না।
----সমস্যা কি আপনার?কি শুরু করেছেন?মারতে চাইছিলেন।এখন খাতির জমাতে এসেছেন কেন?
----এতো বেশি বুঝো কেন?
----আমি কি বেশি বুঝেছি!
----যেটা বোঝাতে চাই সেটা বোঝো না।যেটা কল্পনাও করি না সেটা বুঝে বসে থাকো।
----আপনি সব বোঝেন।সরুন পায়ের কাছ থেকে।এভাবে আপনি আমার পায়ের কাছে বসবেন না।
----আমার বউ।আমি পায়ের কাছে বসব না মাথার কাছে তাতে তোমার কি? 

নাফিজ ভ্রু নাচিয়ে তারাকে প্রশ্ন করলো। 

----উহ!
----উহ!
----মাঝরাতে কি শুরু করেছেন বলুন তো?
----তোমার উহ বলাটা না সেই লাগে।
----সরুন।
----ভালোবাসি। 

নাফিজের কথা শুনে তারা থ মেরে বসে আছে।বিরক্ত লাগছে তার নাফিজের কান্ডে। 

----বউসোনা।
----কিইই?
----তোমাকে ছেড়ে যেতে চাইলে কি অনুপস্থিতিতে হারানোর ভয় করতাম।তোমার মনে আছে চকবাজারের সেই অগ্নিকাণ্ডের কথা।
----এখানে ঐ কথা আসছে কেন?
----ঐ যে গ্যাস সিলিন্ডারের মাধ্যমে আগুন ছড়িয়েছিল পুরো বিল্ডিং জুড়ে।
----জানি।ঐ কথা কেন আসছে?
----খবরে দেখেছিলে?গর্ভবতী স্ত্রী নিচে নামতে পারেনি বলে স্বামী ও নামেনি।দুজনে একসাথে আগুনে পুড়ে মারা গেছিল।
----জানি তো।
----আমিও তাই চাই।
----মানে!
----আল্লাহ যদি নিয়েই যান দুজনকে একসাথে যেন নিয়ে যান।আমি তোকে ছাড়া থাকতে পারব না।শুধু এটাই তো বোঝাতে চেয়েছি।আর তুই?সব সময় খালি এক কথা।আমি অসুস্থ।আমি আপনার যোগ্য নই।সহ্যের সীমা ছাড়াস তুই।এতো ভালোবাসি সেটা চোখে পড়ে না।লোকে কি বললো সেটা খুব লাগে তাই না।কখনো আসল জিনিস তো বুঝবি ই না।উল্টা দুই তিন লাইন বেশি বুঝবি। 

নাফিজ বেশ ধমকের শুরু কথাটা বললো।তারা ধমক শুনে কেঁপে উঠে মাথা নিচু করে রইলো।তারার নিজে র এবার নিজের কাছে লজ্জা লাগছে।সে সব সময় নাফিজকে এই কথা বলে। 

----কি হলো?কিছু বল।একটু আগে তো খই ফুটেছিল মুখে।
----শুধু শুধু বলি নাকি।আমার ভয় হয়।আপনি যদি আমাকে ছেড়ে যান।
----বউ সোনা শোনো না।
----কি?
----একটা জিনিস চাইব আজ তোমার কাছে।দেবে?
----কি জিনিস?
----আমি এতো বছর তোর অপেক্ষা।তোকে পাওয়ার সাধনা করেছি।বিনিময়ে তোকে পেয়েছি।কিন্তু আমাকে তুই কিছুই দিস নি।
----কি দেব আমি?ভালোবাসা ছাড়া কিছুই নেই যে দেওয়ার আমার কাছে।
----আছে।ভালোবাসা তো আমি ও দিয়েছি।দিবি বল?
----কি বলে দেখো।নিজের সব দিয়ে দেব তোমার জন্য,জান গেলেও।
----জান গেলে তো হবে না।আগে তুই তারপর সব।
----এবার তো বলো।
----জানিস আজ না ইউনিটে এক সার্জেন্ট সবাইকে মিষ্টি মুখ করিয়েছে।
----কেন?
----ওনার বউয়ের বাচ্চা হয়েছে তাই।
----তো?
----আমি তো বুড়ো হতে চললাম।আমার না খুব ইচ্ছে করছে ছোট পুতুলের হাত পা নিয়ে খেলব।রোজ অফিস থেকে আসার সময় তার জন্য চকলেট আনব।অফিস থেকে এসে আগে আমার রাণীর কপালে চুমু দেব তারপর রাজকন্যার কপালে। 

নাফিজের কথা শুনে তারা বেশ দমে গেল। 

----কি হলো বল দিবি?একটা অস্তিত্ব।আমাদের ভালোবাসার অস্তিত্ব।আমার অস্তিত্ব।দিবি বল?আমি বাবা ডাক শুনতে চাই।একটা তারা চাই।ছোট্ট তারা।আমার আঙুল ধরে যে ঘুরে বেড়াবে।আমার কোলে উঠে শহর ঘুরবে।দিবি বল? 

নাফিজের আবদার শুনে কেঁদেই ফেললো তারা।নাফিজ অবাক হয়ে গেল তারার এই আচরণে। 

----কি হলো?
----আমি পারলাম না ক্যাপ্টেন।আমি নিজে এমন একটা মানুষ নিজে চলতে পারিনা ঠিকমতো।তিন বেলা ভাত খাওয়ার মতো ওষুধ খাই।আমি কিভাবে আরেকটা অস্তিত্ব কে ধারণ করব বলুন?অসম্ভব।
----কেন অসম্ভব?সব ই সম্ভব।এতো গুলো বছর দুজনে কষ্ট পেয়েছি।আল্লাহ কি একটা সুখ দেবে না বল!আমাকে ফিরিয়ে দিস না।এই প্রথম তোর কাছে কিছু চেয়েছি আমি।
----আমি তো ফেরাতে চাইনা ক্যাপ্টেন।আমার ও তো ইচ্ছে করে মা হতে।কিন্ত?
----অপেক্ষার প্রহর বড্ড কষ্টের।আমার জন্য এই কষ্ট টা করতে পারবি না তুই?আমার কষ্টের জন্য আমি চাই এই কষ্ট টা তুই নে।এটা যে তোর কষ্ট না রে।আমাদের দুজনের সুখ এটা।পারবি না আমাকে দিতে? 

নাফিজের আবদার ছলছল চোখ তারাকে আরো ভেঙে গুড়িয়ে দিচ্ছে। 

----বল না।
----আমি আল্লাহর কাছে চাইব।আপনি এই প্রথম আমার কাছে কিছু চেয়েছেন।আমি ও চেষ্টা করব আমাদের ছোট্ট একটা পুতুলের জন্য।কিন্তু সব কিছু মহান আল্লাহর হাতে।
----তবে তাই হোক। 

নাফিজ উঠে বসে তারাকে একটানে বুকে জড়িয়ে নিল। 

----আজ যাত্রাটা তোমার আমার নয়।আমাদের। 

;;;;;

 "মালি পশ্চিম আফ্রিকার একটি রাষ্ট্র। এর রাজধানীর নাম বামাকো। মালিতে শান্তিরক্ষা মিশনে শহিদ হয়েছেন চারজন বাংলাদেশী সেনা"। (১ মার্চ ২০১৮, সূত্র:ভোরের কাগজ) 

টেলিভিশনে খবরটা দেখেই মনটা খারাপ হয়ে গেল তারার। 

এর মধ্যে কলিংবেলের আওয়াজ।তারা ধীরে ধীরে উঠে গিয়ে দরজা খুললো।আগের থেকে আরো বেশি ধীরে চলতে হয় তাকে।দরজা খুলতেই নাফিজ হাসি মুখে দাড়িয়ে আছে।তারাকে দেখে আলতো করে জড়িয়ে ধরলো। 

----দেখো তো।কেউ দেখে ফেলবে।
----হুর।বাদ দেও।
----ভেতরে আসো তো। 

তারা দরজা থেকে একটু সরে যেতেই নাফিজ দুটো ফল ভর্তি পলিথিন নিচ থেকে উঠিয়ে ভেতরে আনলো।তারা দরজা লক করে দিয়ে ভেতরে আসলো। 

----এ তো ফল!আগের গুলো এখনো শেষ হয়নি।
----তাতে কি।আরো বেশি করে খেতে হবে।আরে দাড়িয়ে আছো কেন।বসো বসো।আমার রাজকুমারীর কষ্ট হবে তো। 

তারাকে ধরে নিয়ে নাফিজ বসিয়ে দিল।নিজে ও তারার পাশে বসে তারার পেটের ওপর হাত রাখলো। 

----সোনা।সারাদিন বাবাকে খুব মিস করেছো না?
----কচু করেছে।
----এই তুমি কি বললে?
----একমাস ও হয়নি।বাচ্চা নড়াচড়া করার অনেক দেরী।প্রতিদিন এসে কার সাথে কথা বলেন বলুন তো?
----এই চুপ কর।আমি আমার বেবির সাথে কথা বলছি। 

নাফিজ তারার পেটে হাত রেখে এটা ওটা বলছে।তারা চুপচাপ বসে দেখছে নাফিজের খুশিটা।এই খুশিটার জন্য সাতটা মাস ধরে সে কত কষ্ট করেছে।এই শরীর নিয়েও তাহাজ্জুদের নামাজ,রোজা কিছু বাদ রাখেনি সে।বার বার আল্লাহকে ডেকেছে।কেদেছে তার দরবারে।ঐদিনের পর থেকে নিজের সব ওষুধ ফেলে দিয়েছে।কতবার পায়ে ও যন্ত্রণা উঠেছে তার।তবুও সে সহ্য করেছে মুখ বুজে।এরকম হাই ডোজের ওষুধ খেলে তার বাচ্চা কনসিভ করতে আরো অসুবিধা হত।অবশেষে আল্লাহ ফেরাননি দুজনকে।তারা এক মাসের অন্তঃসত্ত্বা। 

----হয়েছে কথা?
----হুম হয়েছে।একটা সু খবর আছে আরো
যদিও কষ্ট লাগবে।তারপরেও।
----কি সুখবর?
----আমার মিশনের টার্ন এসেছে তারা।যার জন্য এতদিন অপেক্ষা করেছি।
----কিহ!কোন দেশে?
----মালিতে।
----কিহ! 

তারা কেঁদেই ফেললো খবর টা শুনে।নাফিজ তো অবাক হয়ে গেছে। 

----কি হয়েছে?কাদছো কেন?
----কোনো মিশনে যাবেন না আপনি।কোথাও যাবেন না।
----তারা কেন? 

তারা কাঁদতে কাঁদতে খবরে দেখা সব কিছু বলে দিল নাফিজকে। 

----আমি জানি সব।
----জেনে কেন নাম কাটাননি?
----তারা আমরা যখন কসম প্যারেড করিনা প্রত্যেকে নিজ নিজ ধর্ম গ্রন্থ ছুঁয়ে শপথ করি।জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত দেশের জন্য কাজ করব।তার জন্য প্রাণ দিতেও আমরা প্রস্তুত থাকব।তারা শান্তিরক্ষা মিশনে যারা মারা যায় এরা মৃত না।শহিদ বলো।তারা দেশের হয়ে পুরো পৃথিবীর কাছে তারা আমাদের দেশকে তুলে ধরে।এটা নিজ দেশের প্রতি ভালোবাসা তারা।দেশপ্রেম।একজন সৈনিকের কাছে এর চেয়ে বড় উপহার আর কি থাকতে পারে?
----আমি আপনার কাছে কিছু না?
----তুমি আমার কাছে কি সেটি তুমি জানো তারা।কিন্তু একটা কথা কি জানো যখন ১৬ কোটি মানুষের জন্য নিজের প্রাণ নির্দ্বিধায় দেওয়ার শপথ করা হয় তখন না থাকে পরিবার,না থাকে আপনজন।থাকে শুধু দেশ,দেশমাতা।তারা তুমি জানো ছোট বেলায় বই পড়ে কত স্বপ্ন দেখেছি আমি ও একদিন এই শান্তিরক্ষা মিশনে র অংশীদার হব।শান্তিরক্ষা মিশন শুধু আমার দেশ না পৃথিবীর শান্তি রক্ষার জন্য হয়ে থাকে তারা।
----আপনি আমার সুখের সময় টাতে এ খবর নিয়ে এসে বলছেন এটা সুখবর?
----তারা কেন কাদছো?মৃত্যু মানুষের হায়াতের ওপর নির্ভর করে।তারা সবাই মারা যায় না।ফিরে ও আসে।কেন চিন্তা করছো?
----আমি আপনাকে হারাতে চাই না।আমাকে ছেড়ে যাবেন না।
----তারা শান্ত হও। 

তারা নাফিজকে জড়িয়ে ধরে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাদছে। 

;;;;; 

----খেয়েছো?
----হ্যা।তুমি?
----এই তো খেলাম।বাবু কেমন আছে?
----আছে আলহামদুলিল্লাহ।পেটের ভেতর কিক মারে শুধু।ভারি দুষ্টু।
----আমি বলেছিলাম না তুমি পারবে।
----হুম।পেরেছি।
----শুধু আমি পারলাম না।
----কি?
----এই সময়টা তোমার আমাকে সবচেয়ে বেশি দরকার ছিল।আমি থাকতে পারলাম না।
----মিশনে না গেলেও পারতে।
----ঐ যে শপথ।আমি পারিনি তারা।
----আমার চিন্তা করতে হবে।মা বাবা দুজনেই তো আছেন।সেই তুমি যাওয়ার পর থেকে এক কথা।আগে ছেলে,ছেলে বউ।ভিটেমাটি বাদ।
----হুম।কষ্ট হয় খুব।ও আসছে।অথচ ওর প্রতিটি নড়াচড়া অনুভব করতে পারলাম না।
----তুমি না শিখিয়েছো।আমি একজন সৈনিকের স্ত্রী।আমাকে ত্যাগ করতে হবে অনেক কিছু।তাহলে তুমি কেন কষ্ট পাচ্ছো?
----আমার বউটা বেশ বুঝতে শিখেছে।
----না শিখে উপায় আছে?বাপি ও একজন তুমিও একজন।সৈনিকের মেয়ে সৈনিকের স্ত্রী।আমার ত্যাগ তো আরো বেশি।
----তোমার জন্মদিন টাও চলে গেল।এবার একসাথে কাটাতে পারলাম না।
----ইনশাহআল্লাহ সব হবে।তুমি কষ্ট কেন পাও?তোমার কষ্ট আমার সহ্য হয় না।তোমার মুখের হাসি দেখবার জন্য আমি এতো কষ্ট করছি।তুমি যদি এমন করো আমার ভালো লাগবে?
----ভালোবাসি।খুব ভালোবাসি তোকে নয়নতারা ফুল।
----আমিও খুব ভালোবাসি যে।
----শোন।সাবধানে থেকো।ডেলিভারি ডেট কবে?
----সামনের সপ্তাহে।
----আক্ষেপ থেকে যাবে।ও জন্ম নেবে।অথচ দেখো আমি সাথে সাথে কোলেও নিতে পারব না।
----তুমি না সৈনিক?
----হুম।
----দোয়া করো আমাদের জন্য।
----সব সময় করি।তুমি আমার জন্য দোয়া  করো।আজ অনেক বড় মিশন আছে।যথেষ্ট রিস্ক আছে।
----কি বলছো টাকি?
----আরে তেমন কিছু না।চিন্তা করবে না।আমার বেবি কষ্ট পায় না যেন।দোয়া করো শুধু।
----আজ কিন্তু আমাকে ফিরে এসে কল করবে সাথে সাথে বলে দিলাম।আমি চিন্তায় থাকব।এমনিতেই খবরে দেখছি ওখানকার অবস্থা ভালো না।সব সময় চিন্তা হয় আমার।
----তারা পাখি।
----বলো।
----ভালোবাসি।
----আমিও ভালোবাসি।
----আল্লাহ হাফেজ ।
----আল্লাহ হাফেজ। 

;;;; 

সন্ধ্যা হয়ে গেছে।নাফিজের কোন ফোন এখনো আসেনি।চিন্তায় ছটফট করছে তারা। 

----তারা বস তো।এতো টেনশন করিস না।
----মা আমার কেমন যেন লাগছে।আমার কিছু ভালো লাগছে না।খুব কষ্ট হচ্ছে। 

ঘড়ির দিকে তাকালো তারা।সাতটা বাজে।খবরের চ্যানেল বারবার ঘুরে ঘুরে দেখছে তারা।কোথাও যদি খবর দেখায়। 

----নাআআআআহ। 

তারার চিৎকার শুনে ছুটে বসার ঘরে এলো লতিফা। 

----কি হয়েছে?
----মা মা ওওও। 

তারা আর কিছু বলতে পারলো না।লতিফা খবরের শিরোনামে হেডলাইন দেখেই থমকে গেল।হ্যা ঠিক ই দেখছে সে।নাফিজ নাম টাও যে আছে। 

তারার হাত পা যেন অবশ হয়ে আসছে। 

তারার কানে সেই একটা কথাই যেন বাজছে, 

"তারা পাখি, যদি কখনো এমন হয় আমি হুট করে বেরঙিন হয়ে যাই,আমার অস্তিত্ব গুলো বিবর্ণ হয়ে যায়,নামের অক্ষর গুলো রাবার দিছে মোছার মতো একটু একটু করে মুছে যায় তুমি কি ভুলে যাবে আমাকে?"

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন