আবার হাসপাতাল! এই হাসপাতাল নাম শুনলেই ভেতরে যন্ত্রণা হয়।হাসপাতালের ভেতরের মানুষের দুঃখের গন্ধ ভেসে বেড়ায়,ভিনার অসহ্য লাগে এসব।এই হাসপাতাল ভেতরের দহনকে আরো বাড়িয়ে দিচ্ছে।এই হাসপাতালেই একদম আলাদা একটি রুমে মাহভিনের জন্ম হয়েছিলো।ভিনার চোখের পানি থামছে না।পুরো রাস্তায় রুশানের সাথে কোনো কথা বলেনি।প্রিতির বাসা থেকে বের হওয়ার সময় শুধু রেহানকে বলে বের হয়েছে।প্রিতিকে জায়গায়নি।এখন হাসপাতালে পৌঁছে এদিক ওদিক খুঁজছে একজনকে।
-- কার জন্য এসেছো ভিনা?সে তোমার কে হয়?
ভিনা ভেজা চোখে রুশানের দিকে তাকালো।উত্তর দিতে পারলো না।হাসপাতালের এদিক ওদিক দৌঁড়াতে থাকলো।ফোন হাতে কাকে যেন বিরতিহীন ভাবে ফোন দিচ্ছে।রুশান কিছু না জেনেই ভিনার সাথে ছুটছে এদিক ওদিক।শক্ত করে ধরে রেখেছে ভিনার হাত। একসময় ভিনা হাত ছাড়িয়ে দৌড়ে গিয়ে একজনকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরলো।হালকা রঙের থ্রি পিস পরা একজন মেয়ে।তার বয়স বোঝা যাচ্ছে না।একবার কমবয়সী মনে হচ্ছে,আবার মনে হচ্ছে অনেক বড় কেউ।
-- তোহা আপু,কীভাবে কী হলো আমি এখনো বুঝতে পারছিনা।আমার প্রিয় মানুষগুলোর সাথে কেন এমন হচ্ছে?
তোহা ভিনার মাথা উঁচু করে চোখে পানি মুছে দিলো।এরপর কপালে চুমু দিয়ে বললো-
-- কান্না করে না আমার লক্ষী। সব ঠিক হয়ে যাবে।জানো কত মানুষের ভালোবাসা তুমি পেয়েছো?
-- আমি মানতেই পারবো না।কতদিন পর পেলাম রুপিন আন্টিকে,তাকে এভাবে কেন দেখতে হলো আমার।
তোহা ভিনাকে ওয়েটিং চেয়ারে বসিয়ে শান্ত করলো।রুশান পাশে দাঁড়ানো ছিলো।তোহা রুশানের দিকে তাকিয়ে বললো-
-- ছেলেটা কি রুশান?
-- হ্যাঁ আপু।তুমি আমার মেসেজ তাহলে পেয়েছিলে?
-- হ্যাঁ। তখন উত্তর দিতে পারিনি।সিচুয়েশন ছিলো না।
-- রুপিন আন্টি এত অসুস্থ কবে থেকে?সে না বাইরে ছিলো?ট্রিটমেন্ট করায়নি?
-- হ্যাঁ,করিয়েছে।চার মাস ভালো ফিল করায় দেশে ব্যাক করেছিলো?
-- আর আমাকে জানালে না তুমি!
-- কীভাবে জানাতাম?শেষ বার তোমার বাবার সাথে ম্যামের যে দ্বন্দ্ব লেগেছে,এরপর জানাতাম কোন মুখে তুমি বলো?
-- আন্টিও একবার চায়নি আমাকে দেখতে?
-- বেশি ইমোশনাল হচ্ছো ভিনা।নিজেকে একটু শক্ত রাখো এখন।ঠিকাছে?
-- খুব খারাপ কিছুই হবে তাইনা তোহা আপু?আমি রুপিন আন্টিকে আর দেখতে পারবো না তাইনা।
তোহা করুণ ভাবে তাকালো।এই মেয়ের বিয়ে হবে কয়েকদিন পর,অথচ বাচ্চাদের মতো হাত পা ছড়িয়ে কাঁদছে।তোহা চুপচাপ সান্ত্বনা দিয়ে গেলো।এর বেশি আর কীই বা করার আছে।
রুশান করিডোরের মাথায় দাঁড়িয়ে ছিলো।এই তোহার সাথে ভিনার সম্পর্ক কী,ভিনা কেন কাঁদছে কিছুই বুঝতে পারছে না।শুধু আঁচ পাচ্ছে খুব কাছের কেউই হবে।রুশান আগে ভিনাকে কখনো কাঁদতে দেখেনি।আশ্চর্য,একজনকে ভালোবাসে অথচ তার দুঃখের সময় কখনো দেখেনি।ভিনা কি এই সাড়ে তিন বছরে একদিন ও মন খারাপ করেনি?করেছে অবশ্যই। মেয়েদের মন আকাশের রঙের মতো।এই খুব হাসি,এই একরাশ মন খারাপ।তবু প্রকাশ কখনো করেনি ভিনা।করিডোরের এ মাথা থেকে রুশান ও মাথায় তাকালো।বুকে শূণ্যতা জেঁকে বসলো।এখনো কি সেই জায়গা তৈরি হয়েছে রুশানের যখন ভিনা ওর বুকে মাথা রেখে অশ্রুবিসর্জন করে সব দুঃখ ভাসিয়ে দিবে?হয়ত হয়েছে,হয়ত হয়নি।হয়ত এই জায়গার জন্য ভিনা নিজে এগিয়ে আসবে না,রুশানের সামনে আসতে হবে।
ভিনা কান্না করে ক্লান্ত হয়ে যাওয়ার পর তোহার কোলে মাথা রাখলো।তোহা নিজেও ক্লান্ত হয়ে চেয়ারে হেলান দিয়েছে।মাথায় বিগত কয়েক বছরের প্রতিক্ষার অবসান হওয়ার তৃপ্তি।
রুপিনের কিডনি ট্রান্সপ্ল্যান্ট হয়েছিলো বছরখানেক আগে।ভালোই ছিলো সবকিছু।সুস্থ হওয়ার পর দেশে ফিরে এসেছিলেন।দেশে ফেরার পর হস্পিটাল,অর্গানিক ফার্ম,বুটিক শপ,রেস্টুরেন্টের ব্যবসা সব এক হাতে সামলাচ্ছিলেন।রুপিন খুবই প্র্যাক্টিকাল মানুষ।আবেগহীন এবং বাস্তববাদী হওয়ার মাঝে বিস্তর তফাৎ আছে।খুব বেশি বড় হওয়ার বাস্তববাদী এবং আবেগহীন দুটোই হতে হয়।এই ধরনের মানুষের যত বেশি সম্পদের সংখ্যা থাকে ঠিক তত কম থাকে আপন মানুষের সংখ্যা।আজকের রুপিনের আইসিউর সামনের মাত্র দুইজন মানুষ নিয়ে ফাঁকা করিডোর নিঃসঙ্গতার জানান দিচ্ছে।
--আমি কি আন্টিকে আর দেখতেই পারবো না?
-- মেনিনজাইটিস হয়েছে রে ভিনা।সার্ভাইভ করার পসিবলিটি কম। এর জন্যই তোমাকে ফোন দিয়ে জানিয়েছি।নাহলে অনেক কিছুই জানতে পারতে না।
-- এই কল আমি চাইনি
-- ইমোশনাল কথা এখন বাদ রাখি।কাজের কথায় আসি।
ভিনা নড়েচড়ে বসলো।তোহা বড় একটা ব্যাগ থেকে কাগজ ভর্তি ফাইল বের করলো।
-- ম্যাম তার সকল লিকুইড মানিসহ এ্যসেট তোমার নামে লিখে দিয়ে গেছে ভিনা।
ভিনা আকাশ থেকে পরলো।রুপিনের সব সম্পত্তি পাওয়া মানে নির্ঘাত শতকোটি টাকা পাওয়া।ভিনা আরো সোজা হয়ে বসে নিজের দুই হাতে নিজের চুলগুলো টেনে পিছনে নিলো।এরপর বড় করে নিঃশ্বাস ফেলে জিজ্ঞেস করলো-
-- তুমি এসব কী বলছো তোহা আপু।
-- এসব কথা এখানে আমি বারবার রিপিট করতে পারবো না ভিনা।সকাল হতেই তুমি চলে যাবে ফাইল নিয়ে রুশানে সাথে।বাসায় আপাতত কারো সাথে শেয়ার করার দরকার নেই।
-- সকালেই কেন?আমি থাকতে চাই,প্লিজ!
-- আমি চাইনা তোমার বাবা জানুক।কিপ ইট কনফিডেনশিয়াল।কোনো সমস্যা হলে আমি ফোন করে জানাবো।তুমি যেন শেষ সময়ে পাশে থাকো আমি নিশ্চিত করবো।আমি ফোন না দিলে একদম আসবে না।ঠিকাছে?
ভিনা বসে রইলো অসাড় হয়ে।কী হবে এত টাকা দিয়ে যদি জীবনে মানুষই না থাকে।কেন জীবন এত অদ্ভুত হয়?যে টাকা চায়,সে টাকা পায় না।যে মানুষ চায়,সে মানুষ পায়না।যার সব আছে,তারও অভাবের শূণ্যতা অনুভূত হয়।মানুষের মতো অসুখী প্রাণি পৃথিবীতে নেই!
ভোরের আলো ফুটতেই তোহা ভিনাকে পাঠিয়ে দিলো রুশানের সাথে।রুপিনের অবস্থা যদি একদমই খারাপ হয়ে যায় ফোন দিবে।ভিনা যেতে চাইলো না।কিন্তু তোহার শক্ত হয়ে রইলো।
রুশান ভিনাকে নিয়ে বাসার পথে আগালো।পুরো রাস্তায় ভিনা প্রয়োজনের বাইরে কোনো কথা বললো না।রুশান এখানে জড়িয়ে গেছে তাই ভিনা বলে দিলো সবই।রুপিন কে,কীরকম সম্পর্ক এমনকি মাহভিনের জন্মের সময়কার কথাও জানালো।শেষে জানালো কীভাবে সম্পর্ক শেষ হয়ে গিয়েছিলো।রুশান সব শুনে একটা কথাই বলেছিলো-
-- মাহভিনকে উনার কাছে দিলে কি খুব সমস্যা হতো.....
ভিনা আহত চোখে তাকালো।এরপর কান্নাজড়ানো কন্ঠে বললো-
-- মায়েরা অনেক কিছু বুঝতে পারে রুশান।আমি ব্যখ্যা দিতে পারবো না সবকিছুর। শুধু মনে হয়েছে মা রুপিন আন্টির চেয়ে বেশি আগলে রাখবে ওকে।রেখেছেও।
রুশান ভিনাকে হাতে কপালে অজস্র চুমু দিলো।দু হাত দিয়ে শক্ত করে জড়িয়ে রাখলো ভিনাকে।ভিনা কাঁদলো না,পাথর হয়ে বসে রইলো।
বাসায় পৌঁছানোর পর কারো সাথে কথা হলো না ভিনার।সোহেল ভিনার মন খারাপ দেখে অনেক বার ভালোমন্দ জিজ্ঞেস করলেন।দুপুরের দিকে প্রিতি ফোন দিয়ে ইচ্ছামতো বকাঝকা করলো,শেষ মেষ কান্না করে দিলো এত গুরুত্বপূর্ণ সময়ে কাছের মানুষকে না পেয়ে।ভিনা ফোন রেখে দিলো কিছুক্ষণ কথা বলেই।মাথা ফাঁকা হয়ে গেছে অনুভূতির জঞ্জাল না সড়াতে পেরে।ভিনা যতক্ষণ নিজের ঘরে থাকলো,মোবাইল রাখলো নিজের কাছে।রুশান বারবার ফোন দেয়ায় মানা করে দিলো ফোন করতে।নার্ভে ভীষণ চাপ পরছে।মানুষ হুট করে মারা গেলেও এত খারাপ লাগে না,যতনা খারাপ লাগে নিশ্চিত মৃত্যুপথযাত্রীর জন্য অপেক্ষা করতে।
পরেরদিন সন্ধ্যাবেলা তোহার ফোন আসলো-
-- এসে পরো এসাপ!
ভিনার মনে হলো এখনি দম আটকে মারা যাবে।কান্না লুকিয়ে একদম স্বাভাবিক হয়ে বের হতে ভয়ানক যুদ্ধ করতে হলো নিজের সাথে।এই নাজুক অবস্থায় গাড়ি ড্রাইভ করতে পারবে না দেখে রুশানকে ডেকে নিলো।বাসায় জানালো রুশানের সাথেই বের হচ্ছে।
পুরো রাস্তায় ভিনা পাগলের মতো চিৎকার করে কান্না করলো।হাসপাতালে পৌঁছেই রুপিনের বেডের কাছে চলে গেলো।রুপিনের চোখ খোলা কিন্তু কথা বলতে পারছে না।ভিনা শুনেছিলো মৃত্যুর আগে মানুষের বাকশক্তি নিয়ে নেয়া হয়।ভিনার সেখানে পৌঁছানোর কয়েক মিনিট পরেই রুপিন মারা যায়।ভিনা স্তব্ধ হয়ে থাকে এত কাছ থেকে আপনজনের মৃত্যু দেখে।রুপিনের হাত ধরে ভিনা ছোট শিশুর মতো কাঁদতে থাকে।এই যন্ত্রণা যেন দ্বিতীয়বার মা হারানোর যন্ত্রণার সমান।
তোহা ভিনাকে টেনে রুমের বাইরে নিয়ে যায়।অনেক ফর্মালিটি এখন পূরণ করতে হবে তার।ভিনা ফ্লোরে বসে কাঁদতে থাকে।রুশান এগিয়ে আসলে ভিনা রুশানের বুকে মুখ গুজে যন্ত্রণায় ছটফট করতে থাকে।একসময় শরীর ছেড়ে দিয়ে রুশানের কোলে ভর রেখে ফোঁপাতে থাকলো।ঠিক সেই মুহূর্তে করিডোরে আসলো একজন।চোখে চশমা হালকা রঙের ইনফর্মাল শার্ট পরা একজন।ভিনা নিজের ঝাপসা চোখ মুছে তাকালো ভালোমতো। এরপর রুশানের বাহুডোর থেকে নিজেকে ছিটকে সড়িয়ে নিলো।কাঁপা কাঁপা হাতে চেয়ার ধরে দাঁড়িয়ে দেখলো সেই মানুষটাকে।অস্ফুট কন্ঠে বলে উঠলো-
-- যাবির.....তুমি এখানে?
.
.
.
চলবে.........................................................................