প্রেয়সী - পর্ব ২৮ - নাবিলা ইষ্ক - ধারাবাহিক গল্প


ছাঁদের সিঁড়ি'তে ঝাপটি মেরে দাঁড়িয়ে। পা উঠতে চাচ্ছে না। এ কোন মসিবত। এমনটা কেন হচ্ছে? প্রতিদিনের তুলনায় আজ বেশ নেকামো করছি। কোথার থেকে আসে এই নেকামো গুলো? করবো না নেকামি। দ্রুত পায়ে চার-পাঁচ সিঁড়ি উঠে আবারও দাঁড়িয়ে পরলাম। বুকের স্রোতের গতিপথ খুঁজে পাচ্ছি না। প্রচন্ড নার্ভাস লাগছে। এনিহাও, আইরিন দেখে ফেলেছে। তৎক্ষণাৎ আওয়াজ দিল,
- এই অরু। দ্রুত উঠো। 
সকলে চলে এসেছে। তারমানে কতটা দেরি করেছি আমি সেটা আর উল্লেখ না করি। বুকের ধুকপুকানি নিয়ে ধীরে ছাঁদের দিক চললাম। সর্বপ্রথম নজরে আসলো, স্পষ্ট লাইটিং দ্বারা ছাঁদের ডেকোরেশন। 
চমৎকার এক বড় ছবি ফ্রেম করা সামনে। বড় চাচ্চু আর বড় মা'র। 
তারা দুজন সেই ছবিটির সামনে দাঁড়িয়ে। বড় চাচ্চুর পাঞ্জাবী ধবধবে সাদা রঙ আকর্ষণ কাড়ছে। তেমন বড় মা'য়ের টকটকে লাল রঙের বেনারসি। দুজনের চমৎকার কম্বিনেশনের ড্রেস-আপ দেখে, আশেপাশেও নজর গেল। চাচা-চাচী থেকে ধরে সকলে পাঞ্জাবী আর শাড়ি পরেছে। সেইম গোউজ ফর মিষ্টার তন্ময়। তিনিও পাঞ্জাবী পরেছেন। মেরুন রঙের। তার মুখের দিক তাকাতেই গলা শুঁকিয়ে আসলো। তার এই দৃষ্টির জন্যই তো সাজতে ইচ্ছে হয়না আজকাল। তারউপর শাড়ি পরিধান করেছি। ভাবা যায়? 
বড় মা'র মুখে আনন্দতা ছুঁয়ে। জ্বলজ্বল চোখে আমার দিক তাকালেন। লজ্জিত কন্ঠে বললেন, 
- দেখ, অরু। কী করেছে ছেলেটা। এতবড় ছবি কেউ ফ্রেম করে? তুই আমায় বল। 
আবারও তন্ময় ভাইয়ের দিক চোখ গেল । তিনি এখনও আমার দিক চেয়ে। আজ যেন আমার শরীরের সব শক্তি সে কেঁড়ে নিচ্ছে তার চাহনি দিয়ে। লোকটা এমন কেন করছে? হালকা হেসে জবাব দিলাম, 
- বাহ রে। এনিভার্সিরি বছরে একবার আসে বুঝলে। এতটুকু কিছুই না। 
বড় চাচ্চু বেশ আনন্দে আছেন। কী সুন্দর ভাবে স্ত্রী আর ছেলে'কে নিয়ে দাঁড়িয়ে। তিনজন কে একসাথে চমৎকার দেখাচ্ছে। আইরিন চেঁচাচ্ছে, 
- তন্ময় ভাইয়া, ক্যামেরা সামনে। অরু'কে পড়ে দেখে নিও। আপাতত ছবি তুলে যাও, আমরা তুলব। 
বড়ো'রা সকলের একসাথে এখানে। কী লজ্জাজনক পরিস্থিতি। 
এটা এভাবে বলার বিষয়? লজ্জায় আর মুখ তুলতে সক্ষম হলাম না। আরিফ ভাইয়া এসেছে পাশে। দুষ্টু স্বরে বলতে লাগলো, 
- আমরা তো জানতামই না, আমাদের এই ছোট্ট অরু তন্ময়ের
 হবু স্ত্রী। আমাদের জানালে না কেন? লুকিয়ে লুকিয়ে দুজন বেশ ছিলে, হু? ভাগ্যিস আম্মু বলেছিল। নাহলে অন্ধকারে রাখতে।
আমি কী কম লজ্জায় ছিলাম? হ্যাঁ? আর কত লজ্জায় পড়তে হবে আজ? আর কী বলতাম? আমি নিজেও জানি না ভালভাবে। আপনাদের কি বলব? 
আঁড়চোখে তাকিয়ে বললাম, 
- তেমন কিছুনা। 
- বাহ বাহ। 
দেখা গেলো আরিফ ভাইয়ের সাথে আইরিন, রুবি আপু এঁরাও এক হলো। সকলে মিলে আমাকে হেনোস্তা শুরু করে দিল। 
আইরিন হঠাৎ তন্ময় ভাইয়ের দিক নজর ছুঁড়ে বলল,
- আজ তো অরু গায়ি কামসে। কতক্ষণ যাবত তন্ময় ভাই শুধু অরু'র দিক তাকিয়ে। 
এভাবেই বড্ড ভীতু হয়ে আছি। এদের সাথে থাকলে আমার শ্বাস আটকে আসবে। দ্রুত শাড়ির কুঁচি ধরে অন্যদিকে চললাম। 

বাবা সামনে। সাদা পাঞ্জাবি পড়েছে। এখনও কতটা ইয়াং দেখাচ্ছে। মনেই হয়না তিনি পঞ্চাশ পেরিয়েছেন। এখনও চল্লিশে আছেন মনে হচ্ছে। সে একধ্যানে সামনে তাকিয়ে। তার মন কী খারাপ? এমন দেখাচ্ছে কেন? সে কী মা'কে মিস করছেন? আমি দ্রুত বাবার এক হাত চেপে ধরলাম। বাবা হঠাৎ আমাকে দেখে হেসে ফেললেন। বাবা আজকাল খুবই নরম হয়ে গিয়েছেন। আগের তুলনায় বেশি শান্ত কন্ঠে কথা বলেন। কথা বলার সময় সর্বদা মা মা শব্দ ব্যাবহার করেন। সবসময় দেখা হলে, খেয়েছি নাকি জিজ্ঞেস করবে। কোনো সমস্যা হচ্ছে কী না। এই হয়তো বাবার মাঝে বাবা-মা দুজনের ভালবাসা। আবদার ধরলাম, 
- ছবি তুলব। আসো। 
তাকে একপ্রকার টেনে নিলাম। কাঁধে মাথা রেখে আমরা কয়েক ছবি তুললাম। বাবা বাচ্চাদের মতো হেসে অভিযোগ করছে,
- আমার ছবি তোলার বয়স আছে নাকি? বোকা মেয়ে। 
- ইশ। এখনও কত্ত ইয়াং লাগে জানো? 
- সেটাতো শুধু তোমার চোখে। 
রুবি আপু আইরিন ও মতামত জানালো, 
- মেয়েরা হাপুসহুপুস হয়ে আশেপাশে পরে আছে চাচ্চুর জন্য । 
সকলে হাসছে। বাবাও হাসছে। এইতো বাবার মন খারাপ চলে গেলো। 

বড় চাচ্চু আর বড় মা যখন কেক কাটছিলেন আমি শক্ত করে বাবার হাত ধরে দাঁড়িয়ে। এরপর থেকে আমরা মায়ের ছবির সাথে এনিভার্সিরি পালন করব। তাও করব। স্মৃতি থেকে মুছতে দিব না। 
বাবা হয়তো আমার চিন্তাভাবনা বুঝতে পেরেছেন। সে দিব্বি হেসে আমার মাথা বুলিয়ে দিলেন। এতকিছুর মাঝে আমি তন্ময় ভাইয়ের দিক তাকানোর সাহস দেখালাম না। তার নজর আমি বুঝতে পারছি। কিন্তু তার দিক তাকানোর শক্তি পাচ্ছি না। 
চাচী, বড় মা চলে যাচ্ছেন। এত শব্দে তাদের মাথা ধরেছে। আসলেই। বক্সের তীব্র আওয়াজে আমার মাথাই তো ঘুরছে। 

মদ এনেছে ভাইয়ারা। কত্তবড় সাহস। ছাঁদের এক কোণায় কী সুন্দর করে টেবিল করে রেখেছে। এইসব খাবে এরা? দেখা গেলো একা শুধু উনারা না। বাবা সহ দু-চাচ্চুও খেলেন কিছুটা। কিছুটা খেয়ে বড় চাচ্চু নির্দেশ দিলেন, 
- বেশি খেও না। রাত হচ্ছে। দ্রুত শেষ করো এগুলো। 
চাচ্চুরা চলে যাচ্ছেন। বাবা আমাকে বললেন, 
- আর থেকে কী করবে? 
সুযোগ ভালো। চলে যাওয়া উত্তম। কিন্তু কীভাবে যাবো? সয়তান আছে কতগুলো। আইরিন দ্রুত সামনে চলে এলো, 
- আরে চাচ্চু। কেমতে? এখনও আমাদের এঞ্জয় করা বাকি। 
বাবা হেসে চলে গেলেন। রয়ে গেলাম আমি এদের সাথে। তন্ময় 
ভাই সমানে ড্রিংক করে যাচ্ছেন। আরিফ আর রবিন ভাইও করছেন। শুধু ইব্রাহিম ভাই দাঁড়িয়ে। তার সামনে তার নায়িকা। 
রুবি আপু কাঁচা খেয়ে ফেলবে ভাইয়াকে। যদি তিনি একটুও খান। 
অসহায় ভাবে আইরিন দীপ্তর ঝাকানাকা নাচ দেখছি। দুজন হাঈ বিটে মাত্রাতিরিক্ত ডান্স দিচ্ছে। চোরা চোখে তন্ময় ভাইয়ের দিক তাকালাম। তিনি আমার দিক তাকিয়ে। যেমন অপেক্ষায় আছেন কখন বলব ' আপনি এই হাবিজাবি খাওয়া বন্ধ করুন। '। 
অথচ আমি বলতে অক্ষম। হঠাৎ তার সাথে চোখাচোখি হলো। শ্বাস বন্ধ হওয়ার জোগাড়। ভাবলাম কেটে পড়ি। আজ তার অবস্থা ভালো না। 
আবার ড্রিংক করলে তার মাথা ঠিক থাকে না। কিন্তু আইরিন রুবি আপু যেতে দিচ্ছে না। 

 রাত একটা বাজছে। রবিন ভাই সম্পুর্ন মাতাল। অথচ বেশ নিজেকে দমিয়ে রুমে চলে গেলেন। এদিকে আরিফ ভাইয়েরও অবস্থা একই। কিন্তু নিজেকে কন্ট্রোল করতে অক্ষম।
 আইরিন ভালোভাবে ধরে নিচে নামাচ্ছে। আর বলছে, 
- এটা কোনো কথা? গরু একটা। খায় কেন, না নিতে পারলে। 
সকলের মাঝে তন্ময় ভাই দাঁড়িয়ে। তাকে দেখে বোঝা দায়, তার অবস্থা কেমন। খুব নরমালি ইব্রাহিম ভাইয়ের সাথে কথা বলছেন। তার কি মাথায় চড়ে নি? চড়বে কীভাবে? তিনি তো এগুলো সদা খান। খেতে খেতে অভ্যস্ত হয়ে আছেন। নেমে যাই। আজকের মতো বেঁচে গেলাম। কারণ সোজা। ভাইবোন সকলেই ছিলো একসাথে। 
এমন মুহুর্তে তার উল্টাপাল্টা কথাবার্তা সাজে না। 
নামতে নেবার সময়, তন্ময় ভাই মুখ খুললেন ,
- অরু। তুই থাক। 
 তার স্পষ্ট শব্দের কন্ঠে রুবি আপু হাসছেন। ইব্রাহিম ভাইয়ের হাত চেপে নিতে নিতে বললেন, 
- আমাদের এখানে আর কাজ নেই। 
এই প্রথম ওদের সাথে আমিও যেতে নিচ্ছিলাম। ভয় আর অনুভূতি'তে শ্বাসরুদ্ধকর অবস্থায় আছি। পেছন হতে তন্ময় ভাই হাত চেপে ধরলেন। বহু কষ্টে তার দিক তাকালাম। সেই লাগামহীন চাহনি। এভাবে তাকিয়ে আছে কেন? ছাঁদ সম্পুর্ন খালি হতেই তিনি কাছাকাছি আসলেন। শুকনো কন্ঠে বললাম,
- শীত করছে। আমি যাই। 
তিনি ছাড়লেন। পরপর গিয়ে সুইচ টিপলেন। সঙ্গে সঙ্গে সকল লাঈটস বন্ধ হয়ে গেলো। চাঁদের আলোয় তাকে দেখা যাচ্ছে। 
এই অনুভূতির কোনো নাম আছে? হ্যাঁ। স্রোতশূন্য অবস্থান। তাকে আসতে দেখে পিছু হাঁটলাম। বারবার গলা, ঠোঁট শুকিয়ে আসছে। 
পেছনে ছাঁদের শেষ সীমানার দেয়াল। নিজেকে শক্ত করলাম। কিছুটা কেশে বললাম,
- দেখুন, আমি যাই। 
 ভাজেভাজে থাকা শাড়ি ভেদ করে আমার কোমর ধরে, দেয়ালের সাথে স্পর্শ করালেন। পরপর নিজেও কাছাকাছি আসলেন। তার শরীর থেকে মদের তীব্র গন্ধ। 
অথচ তার লাগামহীন হাতের স্পর্শে কিছুতেই মনোযোগ দিতে পারছিনা। তার হাত সরাতে চাইলাম। তিনি শক্ত করে ধরলেন। 
আমার কোমর কী কালচে করতে চাচ্ছেন? মদ খাওয়ার সাথে কী তার জ্ঞান হারিয়ে গিয়েছে? ব্যথায় কিছুটা কুঁকড়ে উঠলাম। 
বলতে নিচ্ছিলাম, 
- ছাড়ুন, প্লি.....'
 তার অধর যুগলের তীব্র স্পর্শে সম্পুর্ন কথা অসম্পূর্ণ রয়ে গেলো। জীবনের সমাপ্তি ঘটতে চলেছে এমন অনুভূতি'তে আমি চমকে রইলাম। তিনি এমন আচরণ কখনও করেন নি। অথচ ভাবনাচিন্তা মাথায় আসছে না। তার মুখের তীব্র মদের টেস্টে কপাল কুঁচকে আসছে। আবার অনুভূতি'তে চোখ ভিজে আসছে।  
.
.
.
চলবে..................................

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন