"তারা
রাতের স্বপ্ন গুলো খুব বেশি গভীর হয়,
একদম গভীরতায় ছেয়ে যায়।
এই গভীরতা তখন পূর্ণতা পায়
যখন শুদ্ধ মনটাও বড্ড বেহায়া হয়ে যায়,
এক টুকরো ভালোবাসার আসায়।"
----কি রে তারা দাড়িয়ে আছিস কেন?ভেতরে যাবি না?
সৈকতের কথাতে ধ্যান ভাঙলো তারার।নাফিজের কথা গুলো তার মাথায় শুধু ঘুরপাক খাচ্ছে।একদম জটলা বেধে বসে আছে।তাই তো বাড়ির দরজার সামনে দাঁড়িয়ে ও ভেতরে না ঢুকে বাইরে দাঁড়িয়ে সে কল্পনাতে মগ্ন।
----তারা কি হলো তোর?
----কিছু না।ভেতরে চলো।
ঘরের ভেতর ঢুকেই আরেক দফা শক খেলো তারা।হুট করে এতো মানুষ বাড়ি তে।তারা সোফার দিকে তাকিয়ে দেখে সৈকতের মা বাবা বসে আছে।তার অপর পাশে তারার বড় খালা আর ছোট খালাও আছে।কিন্তু হঠাৎ করে বাড়িতে এ তো লোকজন কেন?তারা উওর খুঁজে পাচ্ছে না।যতদূর মনে পড়ে আজ তার জন্মদিন ও না।তার জন্মদিনেই মূলত পুরো বাড়িটা গমগম করে।আব্রাহাম সাহেব খুব বড় করে উদযাপন করেন।তাহলে?
----মামোনি দাড়িয়ে আছিস কেন?চল চল দেখ কারা এসেছে।
আব্রাহাম সাহেব এসে তারাকে নিয়ে সোফার দিকে গেলেন।
----এই যে আমাদের আসল লোক চলে এসেছে।মামোনি সালাম দেও।
----হুম।আসসালামু আলাইকুম।
তারা সবাই কে সালাম দিয়ে টুকটাক কথা বললো।
----বাপি শোনো।
----কি হয়েছে মা?
----এক টু এদিকে আসোতো।
----কেন?
----আসো না।
----আচ্ছা চলো।
তারা আব্রাহাম সাহেবকে নিয়ে রান্নাঘরে গেল।
----কি হয়েছে মা?
----বাপি বাড়িতে হঠাৎ এতো লোকজন কেন?কি হয়েছে?কালকে তো বলোনি এতো লোকজন আসবে।
----আসলে মা আজ,,,,,।
আব্রাহাম সাহেবের কথা শেষ হওয়ার আগেই মাহমুদা বেগমের ডাক পড়লো।
বাইরে থেকে চেচিয়ে মাহমুদা বেগম বললেন,
----তারা বাবা, কোথায় তুমি?এদিকে আসো তো।বাজার চলে এসেছে।
----আসছি।
আব্রাহাম সাহেব মাহমুদা বেগমকে উওর দিয়ে তারার মাথায় হাত বুলিয়ে চলে গেলেন।
----আরে বাপি,,।
----মা পরে আসছি।তোর মা ডাকছে।
----যাহ।কি হয়েছে কিছুই বুঝলাম না।
তারা মুড অফ করে নিজের ঘরে চলে গেল।কি একটা অদ্ভুত ব্যাপার।হুট করে বাড়িতে এতো লোকজন।অথচ তারা কিছুই জানেনা।আজ সকাল অবধি ও বাড়ি ফাঁকা ছিল।মরনিং ওয়াল্ক থেকে আসার পর তারা যেন নিজের বাড়ি চিনতেই পারছে না।একদম বাড়ি ভর্তি মানুষ গমগম করছে।
;;;;;
----এই তোর সাহস কম না তুই আবার আমার মিষ্টির ছবিতে হাত দিয়েছিস!
তানিয়ার হাত থেকে অ্যালবাম টা কেড়ে নিয়ে তানিয়াকে ধাক্কা মেরে ফ্লোরে ফেলে দিলেন ফজলে শেখ।ব্যথায় কেদে উঠলো তানিয়া।
----কি এমন করেছি আমি?ওকে খুব দেখতে ইচ্ছে করছিল।
----ও তাই বুঝি।তোর আবার ওকে দেখতেও ইচ্ছে করে!শয়তান ডাইনী একটা।তোর মতো মেয়ে মানুষ যেন কারোর পেটে না জন্মায়।মেয়ে হয়ে কিভাবে পেরেছিলি ঐ টুকু বাচ্চার ওপর দা দিয়ে আক্রমণ করতে।
----কতোবার বলেছি আমার ভুল হয়ে গেছে।আপনি বলুন এই ভুলের জন্য কি আমি কম সাজা পাচ্ছি?
----রাখ তোর ভুল।এটাকে ভুল বলেনা।পাপ করেছিস পাপ।আর কিসের ক্ষমা চাইছিস?তোর ক্ষমাতে কি আমার মিষ্টি ফিরে আসবে?
----আপনিই বা কেন এতো কথা বলছেন?আপনি তো ওর আপন বাবা ছিলেন। আমি না হয় সৎ মা ছিলাম।আপনি কি করেছেন ওর সাথে?
----যা করেছি সব তোর পাল্লায় পড়ে।
----ও এখন তো সব আমার দোষ।আপনি কি ছোট বাচ্চা ছিলেন?সব সময় কেন একা আমাকে দোষ দেন আপনি?
তানিয়ার কথা শুনে বাকরুদ্ধ হয়ে গেলেন ফজলে শেখ।অ্যালবাম টা হাতে নিয়ে বিছানায় ধপ করে বসে পড়লেন।
আসলেই তানিয়ার কথা ঠিক।তানিয়াও ভুল কিছু বলেনি।আফসোস আর আফসোস আছে শুধু আজ ফজলে শেখের কাছে।কিন্তু এই আফসোস যদি আরো কয়েকটা বছর আগে করতেন তিনি তাহলে হয়তো এভাবে পিতা হয়ে ও পিতৃহীন হয়ে থাকতে হতো না তাকে।
;;;;;
তারা হাত মুখ ধুয়ে ফ্রেশ হয়ে বিছানায় এসে বসেছে।এর মধ্যে হুড়মুড় করে ঘরে গাসু ঢুকে পড়লো।
----আফাআআ।
গাসুর ডাক শুনে কেঁপে উঠলো তারা। বিরক্তি নিয়ে গাসুর দিকে তাকালো।
----এগুলো কি গাসু?এভাবে কেউ ডাকে?তুমি জানো আমি কতো ভয় পেয়ে গেছি।
----নো ডরাই আফা।নো ডরাই।কাহিনী একখানা ঘইটা গেছে গা।
----কি হয়েছে?
----আফা বাড়ির সামনে কেবল দুই ভ্যান ভইরা বাজার আসছে।মেজর সাব আনছে।এততো এততো মাংস,মাছ,আরো যেন কি কি।
----সত্যি!
----হ্যাঁ।
----ও বাড়িতে মেহমান আছে এজন্য হয়তো।
----না আফা তাই না।
----তাহলে?
----আইজ নাকি কি অনুষ্ঠান আছে।
----অনুষ্ঠান!কিসের?
----হ।এইরাম কি যেন শুনলাম ।সাকি ভাই কইতেছিল।আরো কইছে আপনেরে যেন না বলতাম।এর লিগে এতো এতো বাজার।আরো লোক আইতো।আরো জানেন কি হইছে?
----কি হয়েছে?
----মেজর সাব ইউনিট থেইকা দুইডা রানধুনি আনছে।হেরা নাকি আইজ রাধবো।
----আমি তো বুঝতে পারছি না কিসের অনুষ্ঠান?
----আই ও বুঝতেছি না।যাক আফা আপনে বহেন।আই যাইতাম।ম্যাডাম নিচে থাকতে কইছে।
গাসু আবার দৌড় দিয়ে বেরিয়ে গেল।তারা গালে হাত দিয়ে বসে আছে।গভীর চিন্তায় পড়ে গেল সে।কিসের অনুষ্ঠান হুট করে।সে কিছুই বুঝতে পারছে না।
ক্রিং,,,ক্রিং,,,ক্রিং,,,
ফোনের শব্দ হলো।তারা নিজের ধ্যান থেকে বেরিয়ে ফোনটা হাতে নিয়ে রিসিভ করল।
----আসসালামু আলাইকুম,বলুন ক্যাপ্টেন।
----ওয়ালাইকুম আসসালাম।বাহ তুমি দেখছি কল হতেই রিসিভ করলে।আমার অপেক্ষা তে ছিলে নাকি?
----না।আর আমার ফোনে কল লিস্ট ঘাটলে শুধু আপনার নাম্বার ই বের হবে।
----কেন?
----আপনি ছাড়া আর কারোর সাথে কথা হয় না যে এই জন্য।
----ওহ।
----হুম।
----কি করছো?
----কিছু না।এমনি বসে আছি।
----কিছুই করছো না?
----না।
----আচ্ছা এখন রেস্ট নেও।এক টু পরে আস্তে আস্তে করবে।আজ অনেক কাজ তোমার।
----কিসের কাজ?
----আছে আছে।
----আচ্ছা ক্যাপ্টেন শুনুন।
----হুম।
----আজ না অনেক মেহমান এসেছে আমাদের বাড়ি তে।
----আসবেই তো।
----কেন?আর আপনি এমন করে বলছেন আপনি যেন সব জানেন।
----জানি জানি।শুধু তুমি কিছু জানো না।
----আজব!সবাই সব জানে।আর আমি বসে আছি কেন?আমাকে কেউ কিছু বলছে না।আপনি বলুন না।
----আচ্ছা বলছি।
----হুম বলুন।
----আই লাভ ইউ।
তারা নাফিজের কথা শুনে বোকা বনে গেল।এদিকে ফোনের এপারে নাফিজ জোরে জোরে হাসছে।
----কি হলো তারা পাখি?চুপ করে গেলে কেন?
----কথাই বলব না আপনার সাথে আমি।
----আরে আরে শোনো না।
----শুনব না।
----শোনো।ভালোর জন্যই বলছি।এখন না শুনলে পরে নিজেই ফোন দেবে আমাকে।আমি কিন্তু একদম কল রিসিভ করব না।আগেই বলে দিলাম।
----কি?
----হাতে যেন আজ আমার নাম টা দেখি।গোটা গোটা অক্ষরে।
----মানে?
----আর ফোনে ক্যাপ্টেন নাম না দিয়ে হাসবেন্ড লিখে দিও।
নাফিজের শেষ কথাটা শুনে তারা বড়সড় শক খেল।
----মানে!
----আচ্ছা শোনো।তোমার কি ফুল পছন্দ?
----আগে আমার উওর দিন।
----না আগে আমারটা দেও।
----না আমার টা।
----ঠিকাছে আর কথা বলব না কখনো।
----যাক বাবা।আমি আবার কি করলাম!
----উওর দেও।
----নয়নতারা।
----এখন তো এতো পাব না।আরো ফুল লাগবে।
----এতো ফুল কেন লাগবে?কি করবেন?
----আছে আছে।এবার বলো দ্বিতীয় পছন্দ কোন ফুল?
----সাদা গোলাপ।
----আচ্ছা ঠিকাছে।রাখছি।
----আরে আরে আমার উওর দিন।
----আল্লাহ হাফেজ।
নাফিজ ফোন কেটে দিল।তারা আরেক দফা বোকা বনে বসে আছে।
তারার মেজাজ টাই খারাপ হয়ে গেল।সবাই কি আজ তাকে বোকা বানানোর প্রতিযোগিতায় নেমেছে না কি?এটাই বুঝতে পারছে না তারা।
;;;;;
বিকেলবেলা।
নিচ তলায় সবাই হৈ হুল্লোড় করছে।তারা নিজের ঘরে বসে আছে।সে ও নিচে গিয়েছিল।কিন্ত কেউ যেন তারাকে পাত্তাই দিচ্ছে না।তারপর আবার তারার মাথায় ঘুরপাক খাচ্ছে নাফিজের অন্য মেসেজ।
দুপুর বেলা নাফিজ মেসেজ দিয়েছিল তারাকে।
তাতে লেখা ছিল-"তারা পাখি,আজ সকাল তো তোমার যেভাবে কাটলো সেটাকে মনে রেখো।কাল সকালটা যেভাবে কাটতে চলেছে সেটাকেও কাটানোর প্রস্তুতি নেও।গতকাল রাতটা যেভাবে কাটিয়েছো আজকের রাতটা আরো অন্য ভাবে কাটানোর জন্য প্রস্তুত হও।তোমার জন্য তোমার প্রেমিক পুরুষ তোমার ক্যাপ্টেন বিশেষ কিছু ঘটাতে চলেছে।তুমি কল্পনা ও করতে পারবে না।"
এরপর তারা কয়েকবার নাফিজকে কল করেছিল।কিন্তু নাফিজ রিসিভ করে নি।
তারার ভাবনার মধ্যে দরজা খুলে ভেতরে ঢুকলো মাহমুদা বেগম।সাথে একটা মেয়ে।
----ম্যাডাম ওনাকে সাজাতে হবে?
----হ্যাঁ ও আমার মেয়ে তারা।তুমি একটু বাইরে অপেক্ষা করো।আমি ওর সাথে কথা বলে নেই।
----ঠিকাছে।
মেয়েটা বাইরে চলে গেলে মাহমুদা বেগম তারার পাশে গিয়ে বসলেন।
----মা আমাকে সাজাবে কেন?
----আজ যে আমার ছোট্ট মা টার বিয়ে।এই দিনটা না সাজলে হয়।
----কিহ!
তারা যেন আকাশ থেকে পড়লো মাহমুদা বেগমের কথা শুনে।এতো বড় শক খাবে সে কল্পনা ও করতে পারেনি।
----কি বলছো মা?কিসের বিয়ে?কার সাথে বিয়ে?
----কেন?নাফিজের সাথে।
----কিহ!কি বলছো কি মা।হুট করে।আমাকে তো কিছু বলোনি তোমরা।
----আসলে মা কাল রাতেই নাফিজের মা বাবার সাথে কথা বলে এটা ঠিক করেছিলাম।ও পরিবার সম্পর্কে সৈকত সব খোঁজ খবর নিয়েছে।ওদের গ্রামের বাড়ি তোর ফুফুর বাসা থেকে দু গ্রাম পরে।ও নিজে খোঁজ নিয়েছে।দেখ মা তুমি আর নাফিজ যেভাবে কথা বলছো ফোনে টুকটাক যা চলাফেরা করছো এগুলো হারাম মা।এজন্য হুট করে সিদ্ধান্ত নিয়েছে তোমার বাপি।আজ তোমাদের কাবিন করে রাখা হবে।তোমার পরীক্ষা শেষ হলে অনুষ্ঠান করব আমরা।এতে না তোমার সমস্যা হবে না নাফিজের।এজন্য আমাদের কাছের আত্মীয় স্বজন দের যা বলেছি।আর সবাই ও চলে এসেছে।
----তুমি আমাকে এখন কেন বললে?কাল কেন জানাও নি?
----তুমি একটুও টেনশন করতে পারো না মা।উল্টে অসুস্থ হয়ে পড়ো।এজন্য জানাই নি।
----ক্যাপ্টেন জানে সব?
----হ্যাঁ।ও তো সব জানে।ও আরো বললো তোমাকে সন্ধ্যার আগে জানাতে।
----উনি বললো আর তুমি শুনলে!
----রাগ করে না মা।তোমার তো এমনিতেই আপত্তি ছিল না।হয়তো হুট করে হচ্ছে সব।মাথা ঠান্ডা করো।সব ঠিক হয়ে যাবে।
----হুম।
----ঐ মেয়েটা তোমাকে মেহেদী পরিয়ে দেবে।সাজিয়ে দেবে।সন্ধ্যার পর পরই নাফিজরা চলে আসবে।রেডি হয়ে নেও।ঠিকাছে?
----হুম।
মাহমুদা বেগম তারার মাথায় হাত বুলিয়ে তাকে জড়িয়ে ধরে কপালে চুমু দিয়ে চলে গেলেন।
তারা তো রেগে লাল টমেটো হয়ে যাচ্ছে।
----কততোবড় ফাজিল এই লোকটা।এই ছিল তোর মনে?কি করল?এইভাবে কেউ বিয়ে করে।আমি নিশ্চিত নিজেই লাফিয়েছে।না হলে বাপি কখনো এতো তাড়াহুড়ো করে কিছু করতো না।
;;;;;
মেহেদী রাঙা হাত দুটো ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে দেখছে তারা।পানি দিয়ে ধোয়ার পর হাত দুটো চকচক করছে।দু হাতের তালুতে ছোট্ট করে লেখা নাফিজ।নাফিজের নাম দেখে তারা আরো লজ্জায় রঙিন হয়ে গেল।
নিচ থেকে আওয়াজ হলো,"বর এসেছে।"
তারার বুকটা যেন কেঁপে উঠলো।
----আফা বর আইছে গা।মুই দেইখা আসি ফুলচোরডা রে কিরাম লাগতেছে।
গাসু আর দেরী না করে দৌড় দিয়ে বেরিয়ে গেল।বিউটিশিয়ান মেয়েটা তারার চুল ঠিক করছে।তারা যেন কাঁপছে রীতিমতো।একঁটু আগেও তার এতো ভয় করছিল না।কিন্তু এখন?
বিয়ে মানে শুধু কবুল বলা নয়।এই কবুল বলেই একটা মেয়ে তার সমস্ত কিছু তুলে দেয় একজন অচেনা মানুষের কাছে।সারা জীবনের জন্য।পরিচিত হলেও এই সময় টা প্রত্যেক মেয়ের কাছেই চেনা মানুষ টা ও অচেনা হয়ে যায়।আর অচেনা হলে তো কথাই নেই।
একটু পরেই নাফিজের এক কাজিন একটা ল্যাগেজ নিয়ে ভেতরে ঢুকলো।
----বাহ!মাশাল্লাহ।আমার ভাই তো দেখছি একটা ডানাকাটা পরী খুঁজে এনেছে।
মেয়েটি তারার পাশে গিয়ে বসলো।তারা একটু অবাক চোখে মেয়েটির দিকে তাকিয়ে আছে।অচেনা হলে যা হয় আর কি।
----ভাবি আমি তোমার ননদ।আমার নাম মিশকা।
----ওহ।
----নেও।তোমার বর লাল বেনারসি ও কিনেছে।লাল গাউন ও কিনেছে।
----লাল গাউন!
----হ্যাঁ।লাল বেনারসি কিনেছে এজন্য যাতে নাকি তোমার আফসোস না হয় তোমার বিয়েতে লাল বেনারসি পাও নি।আর গাউন কিনেছে তুমি পড়বে বলে।তোমার হাঁটতে অসুবিধা হবে এজন্য শাড়ি পড়াতে একদম নিষেধ করেছে।
তারা যেন আরো অবাক হলো মিশকার কথাতে।এতোটা ভেবেছে নাফিজ তাকে নিয়ে।নাফিজের প্রতি তারার ভালো লাগাটা যেন আরেক ধাপ বেড়ে গেল।
;;;;;
বর বেশে নিচে অপেক্ষা করছে নাফিজ।পাশে নাফিজের দু জন কলিগ আর একজন কাজিন বসা।সবাই হাসাহাসি করছে।ঠাট্টা করছে।তারার কাজিনরাও বেশ মজা করছে।কিন্ত নাফিজের সেদিকে নজর নেই।তার নজর বারবার সিঁড়ির দিকে।এতো মানুষের মাঝে নাফিজ অপেক্ষা করছে কখন তার প্রেয়সীকে সে বধূ বেশে দেখবে।
----কি গো দুলাভাই তারার জন্য অপেক্ষা করছো বুঝি?
----ইয়ে মানে সৈকত।
----উহুম।আমি কিন্তু তারার বড়।সম্পর্কে বড়।ভাই বলো।
----আচ্ছা সৈকত ভাইয়া।
----আরে না সৈকত বলো।আমি তো মজা করছিলাম।ঐ যে চলে এসেছে।
সৈকত বেশ চেঁচিয়ে কথাটা বললো।সৈকতের সাথে সাথে সবাই সিঁড়ির দিকে তাকালো।নাফিজ তো হা হয়ে তাকিয়ে আছে।
লাল রঙের জর্জেট এর গাউন,নিচে গোল্ডেন রঙের মোটা ভারী লেস বসানো।গাউন টা অনেক কাজ করা।তারার মুখেও একদম হালকা মেকাপ।গায়ে হালকা গহনা।মাথায় গোল্ডেন রঙের হিজাব পড়া।আর লাল ওড়না টা সুন্দর করে মাথায় দেওয়া।মিশকা গাসুর সাথে তারা ধীরে ধীরে নামছে।সবাই হা হয়ে তারার দিকে তাকিয়ে আছে।
অবশেষে নাফিজের অপেক্ষার অবসান হলো।তারা কে নাফিজের পাশে বসানো হলো।নাফিজ এর চোখ শুধু তারার দিকে।একটু পর পর মাথা ঘুরিয়ে তারাকে দেখছে।এদিকে মানুষ যে এটা নিয়ে হাসাহাসি করছে সেটা নিয়ে তার যেন চিন্তাই নেই।তারা বেশ লজ্জা পাচ্ছে নাফিজের এমন আচরণে।আরো সবার কথা তো আছেই।
কবুল বলার সময় টা নাফিজ চোখ বুজে শুধু কল্পনা করেছিল।একটা ছোট্ট পরী তার নয়নতারা বাগানে খেলছিল।হুট করে সে যেন হোচট খেয়ে পড়ে গেল।আর তার ওঠার নাম নেই।একটু পর যেন সেখানে আরেকটা পরী উঠে দাড়ালো।কিন্তু এ যে সেই ছোট্ট পরীটা নয়।নাফিজের তারা পাখি।
;;;;;
বিদায়ের সময় তারাকে জড়িয়ে ধরে খুব কেদেছেন আব্রাহাম সাহেব আর মাহমুদা বেগম।তারা দুদিন বাদেই আবার আসবে।তবুও যেন তারা সান্ত্বনা পাচ্ছে না।
অবশেষে গাড়ি এসে থামলো নাফিজের কোয়াটারের সামনে।তারার হাত ধরে নাফিজ তারাকে নামালো।লতিফা বরন করলো ছেলে বউকে।
----এবার আমার ঘরে চলো মা।
----কিন্ত চাচি ভাবি এই পা নিয়ে আরো এতো ভারী সাজ।তিন তলা অবধি উঠবে কিভাবে?
মিশকা র কথা শুনে মন খারাপ হয়ে গেল তারার।খুব কষ্ট হচ্ছে তার।এর মধ্যে নাফিজ এমন একটা কাজ করলো সবাই তাতে অবাক হলেও লতিফা বেশ খুশি হয়েছেন।
তারার হাত থেকে ক্রাচ টা সরিয়ে লতিফার হাতে দিয়ে নাফিজ তারাকে কোলে তুলে নিল।
----বিয়ে করেছি দুজনে সারাজীবন একসাথে পথ চলব বলে।একে অপরের পাশে থাকব বলে।তাই এই চলাটাও দুজনে একসাথে চলব।
নাফিজ আর কাউকে তোয়াক্কা না করে তারাকে কোলে নিয়ে সিঁড়ির দিকে গেল।নাফিজের এমন কথাতে তারার খুশিতে চোখ ছলছল করে উঠলো।তবে কি সত্যি সত্যি সে তাকে পেল যাকে সে চেয়েছে।
;;;;;
সাদা রঙের গোলাপ আর নয়নতারা ফুল মিক্স করে সাজানো পুরো ঘর।ভিতরে ছোটো ছোটো লাইটিং।অসম্ভব সুন্দর লাগছে পুরো ঘর টাকে।তারা বিছানার মাঝখানে বসে আছে।এদিক ওদিক চোখ বুলাচ্ছে।এজন্য হয় তো নাফিজ তাকে জিজ্ঞেস করেছিল প্রিয় ফুল নিয়ে।নাফিজের এখনো আসার নাম নেই।
হুট করে দরজা খোলার আওয়াজ হলো।তারা কিছুটা কেঁপে উঠলো।সাথে সাথে দরজার দিকে তাকালো।নাফিজ দরজাটা লক করে তারার দিকে তাকিয়ে মুচকি হাসি দিল।
বিছানার দিকে এগিয়ে গেল নাফিজ।
"অবশেষে অপেক্ষার অবসান হলো,
তোমাকে বলেছিলাম না
কোনো এক বিকেলে
আমরা দুজনে
হব কপোত-কপোতী "
;;;;;
নাফিজের কথা শুনে তারা লজ্জায় চোখ নামিয়ে নিল।এক হাত কোলের ওপর আরেক হাত দিয়ে বিছানার চাদর খামচে ধরে রেখেছে তারা।নাফিজ দুষ্টু হাসি দিয়ে বিছানার দিকে এগিয়ে গেল।তারার পাশে বসে তারা কোলের ওপর রাখা হাত টির ওপর নিজের হাত রাখলো।নাফিজের স্পর্শে তারার হৃদস্পন্দন যেন আরো বেড়ে গেল।তারা ঈষৎ কেঁপে উঠলো।তারার কাঁপুনি দেখে নাফিজের মুখের হাসিটা আরো দ্বিগুণ বেড়ে গেল।তারা নাফিজের হাতের নিচ থেকে নিজের হাত সরাতে যাবে তার আগে নাফিজ আরো শক্ত করে তারার হাত ধরে বসলো।
----তারা পাখি,তুমি কার থেকে হাট ছুটাচ্ছো?একবার ভেবে তো দেখবে।কতো তো চেষ্টা করেছো পেরেছো কি আমার হাত থেকে ছাড়া পেতে।
নাফিজের কথায় তারা মাথা তুলে নাফিজের দিকে তাকালো।কিন্তু ঐ যে নাফিজের নেশাক্ত দৃষ্টি মুখের বাকা হাসি।তারাকে আর তাকিয়ে থাকতে দিল না।উল্টে আরো লজ্জায় ফেলে দিল।তারা আবার নিজের চোখ নামিয়ে নিল।
----বলেছিলাম তোমার জন্য অদ্ভুত কিছু অপেক্ষা করছে।কি হলো কথা তো বলো?মাই ওয়াইফ তুমি এতো লজ্জা পেলে তো আমি আরো মরিয়া হয়ে যাব।বউ সোনা কিছু তো বলো।
নাফিজের কথা শুনে তারার আরো লজ্জা লাগছে।মনে মনে সে ছক কষে নিচ্ছে।আগের নাফিজ কি ছিল আর এখন সে কাকে দেখছে।কি বেশরম কথা বার্তা।
----তারা পাখি,বউ সোনা,আমার চাঁদের কনা কিছু তো বলো।
----আপনি এরকম কেন?
----কি রকম?
----খুব খারাপ একটা লোক।আপনাকে যা দেখেছিলাম আপনি মোটেও তেমন নন।
তারার কথা শুনে নাফিজ হো হো করে হেসে উঠলো।তারা এবার মুখের ওপর থেকে আধ লম্বা ঘোমটা নিজেই খুলে ফেললো।রাগী দৃষ্টিতে নাফিজের দিকে তাকালো।
----আপনি হাসছেন?ফাজিল লোক কোথাকার।
----যাক বাবা আমি কি করলাম!
----একদম ঠিক করেননি।এমন হুট করে কেন বিয়ে করেছেন?আমি জানি আমার বাপি এতো তাড়াতাড়ি বিয়ে দিত না।সব আপনার কার সাজি।
----তা যা বলেছো।
----তার মানে আপনি সত্যি সত্যি এই কাজ করেছেন!
----হুম।ইমোশনাল ড্রামা।যাতে আর তুমি পালাতে না পারো।
----আস্ত খারাপ একটা।
নাফিজ আবার তারার কথা শুনে হো হো করে হেসে উঠলো।হঠাৎ করেই নাফিজ হাসি থামিয়ে দিল।অবাক চোখে সে তারার দিকে তাকিয়ে আছে।এতক্ষণে তার খেয়াল হলো তারা পুরো ঘোমটা খুলে ফেলেছে রাগের মাথায়।বিয়ের সময় মাথায় হিজাব থাকাতে তারার ঘন কালো চুল গুলো নাফিজ দেখ তে পায়নি।এখন যেন তারাকে আরো বেশি সুন্দর লাগছে।নাফিজ হা হয়ে তাকিয়ে আছে তারার দিকে।
----ক্যাপ্টেন কি হলো?আপনি কোন দিকে তাকিয়ে আছেন বলুন তো?
----উহ।চুপ করো।দেখতে দেও।নেকি পাচ্ছি।
----মানে?
----নিজের স্ত্রীর দিকে ভালোবাসার দৃষ্টিতে তাকালেও নাকি নেকি পাওয়া যায়।
নাফিজের কথায় তারা আবার লজ্জা পেয়ে গেল।নাফিজ তারার দিকে আরেকটু সরে গেল।একদম তারার গা ঘেঁষে বসলো।তারা পাশে সরতে যাবে তার আগে নাফিজ তার বাহু দিয়ে তারাকে ঘিরে ধরলো।তারা তো আরো কেঁপে উঠছে।একবার নাফিজের দিকে তাকাচ্ছে একবার তার হাতের দিকে।এদিকে লজ্জা ও পাচ্ছে।নাফিজের সেদিকে কোন হেলদেল নেই।সে একদৃষ্টিতে তারার দিকে তাকিয়ে আছে।এর মধ্যে নাফিজ অদ্ভুত একটা কান্ড ঘটিয়ে বসলো।তারার থুতনি ধরে তারার মুখটা উঁচু করে তারার কপালে চুমু দিল নাফিজ।সাথে সাথে তারা চোখ বুজে ফেললো।
নাফিজের মুখ থেকে বেরিয়ে আসলো,
----মাশাল্লাহ।
নাফিজ আবার তারার দিকে তাকিয়ে আছে।
----তারা পাখি খুব বড় কাজ আছে।চলো সেটা সেরে নেই।
তারা এবার চোখ খুললো।
----কিককি কাজ?
----তোতলাচ্ছো কেন!আরে নামাজ পড়বো দুজনে একসাথে।চলো।
----আমি এই ভারী গাউন গহনা পড়ে কিভাবে পড়বো?
----আচ্ছা দাঁড়াও আমি খুলে দিচ্ছি।
নাফিজের কথা শুনে তারার চোখ বড় বড় হয়ে গেল।তারা নাফিজকে হালকা ধাক্কা দিয়ে একটু দূরে সরে আসলো।
ঢোক গিলে বললো,
----আপনি খুলে দেবেন মানে?
নাফিজ তারার কথার উওর না দিয়ে তারার হাত ধরে নিজের কাছে টেনে আনলো।তারপর তারার হাত থেকে চুড়ি গুলো খুলতে লাগলো।এদিকে তো তারার কাঁপতে কাঁপতে অবস্থা খারাপ।নাফিজ একে একে তারার সব গহনা খুলে দিল।
----চলো।এবার ওয়াশরুমে গিয়ে ফ্রেশ হয়ে নিবে।
নাফিজ খাট থেকে নেমে গেল।তারার নামার অপেক্ষা করছে সে।তারা খাটের ওপর পা ঝুলিয়ে বসে আছে।আর এদিক ওদিক তাকাচ্ছে।
----কি খুজছো?
----আমার ক্রাচ কোথায়?
----তোমার সামনে ই দাড়িয়ে আছে।
----কই নেই তো।
নাফিজ এবার তারার সামনে ফ্লোরে হাঁটু গেড়ে বসলো।তারার হাত দুটো নিজের হাতের মুঠোয় নিল।
----কেন?আমাকে চোখে পড়ে না।
----আপনি!মানে?
----হ্যাঁ আমি।যতক্ষণ আমি থাকব তোমার অবলম্বন হয়ে থাকব।আর কাউকে তোমার কাছে ঘেঁষতে দেব না।
নাফিজের কথাতে তারা চোখে যেন পানি ছলছল করছে।এতোটা সে পাবে কখনো সেটা যে সে কখনো আশা করেনি।নাফিজের তারার হাতের তালু দুটো দেখে দু হাতের তালুতে চুমু দিল।তারা আবার কেপে উঠলো।
----তোমার সবকিছু জুড়ে শুধু আমি থাকব।আমার বিচরণ ই চলবে।আর কারোর বিচরণ তোমার জগতে সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ।
নাফিজের কথা শুনে তারা মুচকি হাসি দিয়ে নাফিজের দিকে তাকালো।
----বসো।তোমার ড্রেস নিয়ে আসি আগে।
নাফিজ উঠে দাঁড়ালো।নিজের আলমারি খুলে একটা সাদা রঙের জামদানি শাড়ি বের করলো।সাথে অনুষঙ্গিক কাপড় গুলো।
----চলো এগুলো পড়বে।
----কিহ!শাড়ি!আমি জীবনে কখনো শাড়ি পড়িনি।শাড়ি পড়তে পারি না।হাঁটতে পারব না আমি।আঁচল ধরবো নাকি নিজেকে।
----তোমার হাত ধরার লোক এখন যেমন আছে,পথ চলার লোক যেমন আছে,তো আঁচল ধরার লোক ও আছে।তুমি বাকি গুলো,পড়ে এসো।আমি শাড়ি পড়িয়ে দেব।
নাফিজের কথা শুনে তারার চোখ বের হয়ে আসার উপক্রম।
----কিহ!নাআ।
----কিসের না।আমার বউকে আমি শাড়ি পড়াবো। তোমার তাতে কি?
----আমি পারব না।
নাফিজ তারার সাথে আর কথা বাড়ালো না।ওয়াশরুমের দিকে গেল।তারা চুপচাপ বসে নাফিজের কান্ড দেখছে।একটু পর নাফিজ বেরিয়ে এসে চট করে তারাকে কোলে তুলে নিল।এতোটাই দ্রুত করলো তারাও আচমকা ভয় পেয়ে গেছিল।
----কোথায় নিয়ে যাচ্ছেন আপনি?
----ওয়াশরুমে কাপড় রেখে এসেছি।ওগুলো পড়ে এসো।
নাফিজ তারাকে এনে ওয়াশরুমে ভেতর নামিয়ে দিল।
----দাঁড়াতে পারবে তো?
----দাঁড়াতে পারব।বেশিক্ষণ না।পায়ে ব্যথা করবে।
----ঠিকাছে।আমি বাইরে দাঁড়িয়ে আছি।তাড়াতাড়ি এগুলো পড়ে নেও।আমাকে ডাক দিও।আমি আসলে হাত মুখ ধুয়ে নেবে।আমি শাড়ি পরিয়ে দেব।
----আমি পারব না।
তারা লজ্জায় কাঁচুমাচু হয়ে যাচ্ছে।কিভাবে সে নাফিজের সামনে দাড়াবে।আর নাফিজ তাকে শাড়ি পড়াবে।
----তারা কি হলো?কোনো কথা শুনব না আমি।বেশি বকবক করলে না নিজের হাতে চেন্জ করিয়ে দেব।
----নাহহহ!
নাফিজ মুখে বাকা হাসি ফুটিয়ে বললো,
----তাহলে তাড়াতাড়ি করো।আমি বাইরে আসি।ঠিকাছে বউ সোনা।
নাফিজ ওয়াশরুমের বাইরে বেরিয়ে এসে দরজা টা টেনে দিল।তারা আর উপায় না পেয়ে ব্লাউজ পেটিকোট পড়ে নিল।টাওয়েল টা ভালো করে গায়ে জড়িয়ে নিল।
----কি পরিমাণ বজ্জাত লোক একটা।ছি ছি।লজ্জা বলতে কিছু নেই।
তারা নিজেই আবার নিজের ভাবনাতে ডুব দিল।আসলেই সে কিসের লজ্জার কথা ভাবছে।নাফিজ এখন তার স্বামী।লজ্জা পেলেও তার আটকানোর কোনো উপায় নেই।লজ্জা তো লজ্জা।লজ্জার বাপ ও ধুয়ে মুছে পালাবে।শত হলেও এখন সে বিবাহিত।
নিজেকে মনে মনে সান্ত্বনা দিয়ে তারা নাফিজকে ডাক দিল,
----ক্যাপ্টেন শুনছেন।আমার হয়ে গেছে।
তারার ডাক শোনা মাত্র ই নাফিজ ওয়াশরুমের দরজা আলগা করে ভেতরে ঢুকলো।তারাকে দেখে কিছুক্ষণ থ মেরে দাড়িয়ে ছিল নাফিজ।আরো তারা চুলটা ছেড়ে রেখেছে।গোল্ডেন রঙের ম্যাচিং ব্লাউজ পেটিকোট গায়ে সাদা তোয়ালে জড়ানো।নাফিজের কাছে তারাকে যেন স্নো বল মনে হচ্ছে।
----টাওয়েল জড়ানোর কি ছিল তারা পাখি?আমিই তো।
নাফিজ হো হো করে হেসে উঠলো।তারা বেচারী তো লজ্জায় শেষ।নাফিজ আর লজ্জা পাওয়ার সুযোগ না দিয়ে তারাকে কোলে তুলে ভেতরে আনলো।দাঁড় করিয়ে শাড়িটা হাতে নিল।
----আসলে এতো দ্রুত হয়েছে।পুরো মার্কেট ঘুরে মনের মতো নীল শাড়ি পাই নি।তাই এটা এনেছি।পরে আবার আমার স্বপ্ন পূরণ করব।
তারাকে সুন্দর করে শাড়ি পড়িয়ে দিল নাফিজ।তারা শুধু অবাক চোখে নাফিজের পদক্ষেপ গুলো পর্যবেক্ষণ করছে।
নাফিজ তারাকে শাড়ি পড়িয়ে দিচ্ছে ঠিক ই।কিন্তু একটা মেয়েকে এভাবে দেখে তার চোখে বিন্দুমাত্র অন্য কিছুর ছাপ নেই।
----নেও হয়ে গেছে।চলো ওজু করে নেবে।
তারাকে কোলে নিয়ে আবার ওয়াশরুমের দিকে গেল নাফিজ।
;;;;;
নামাজ শেষ করে বেলকনিতে বসে আছে নবদম্পতি।নাফিজের দোলনা খুব পছন্দ ।একলা সময় টা সে দোলনায় বসে কাটাতে ভালোবাসে।তারাকে দোলনায় বসিয়ে একটু করে দোল দিচ্ছে নাফিজ।হালকা বাতাসে তারার চুলগুলো এলোমেলো হয়ে উড়ছে।দোলনার দোলের সাথে অবাধ্যচুলগুলো নাফিজের মুখে ও এসে পড়ছে।নাফিজ যেন অন্য রকম ভাবে উপভোগ করছে এটা।দোলনা থামিয়ে নাফিজ এবার তারার পাশে গিয়ে বসলো।তারাকে হালকা করে জড়িয়ে তারার মাথাটা নিজের বুকের পাশে রাখলো।এক হাত দিয়ে নাফিজ তারার চুলে বিলি কেটে দিচ্ছে।আরেক হাত দিয়ে তারার আঙুল ধরে রেখেছে।তারা কিছু বলছে না।তার ভেতর ও একটা ভালো লাগা কাজ করছে।তারার বারবার এটা মনে হচ্ছে এটা তার জীবনের শ্রেষ্ঠ রাত।
----তারা।
----হুম।
----একটা কথা বলব।
----কি?
----তারা আমার জীবনের একটা অতীত আছে।
----কিসের অতীত?
তারা মাথা উঁচু করে নাফিজের দিকে তাকালো।নাফিজ একবার তারার দিকে তাকিয়ে তারার কপালে চুমু দিয়ে উঠে দাঁড়ালো।বেলকনির গ্রিল ধরে দাড়ালো।
----তারা আমি তোমার আগে একজন কে ভালোবাসতাম।বলতে গেলে আজ ও বাসি।
----কিহ!
নাফিজের কথাটা যেন তারার ঠিক হজম হলো না।তারার বুকে যেন কেউ তীর ছুড়ে দিল।তারার চোখে সাথে সাথেই পানি চলে এসেছে।নাফিজের সেদিকে খেয়াল নেই।এক মনে সে আকাশের দিকে তাকিয়ে আছে।
----হ্যা তারা।আমার মিষ্টি।মিষ্টি পাখি।
----মিষ্টি!
----হ্যাঁ আমার ছোট্ট মিষ্টি।আমার বাগানের ছোট্ট রাণী টা।
;;;;;
উদাস হয়ে বিছানায় হেলান দিয়ে শুয়ে আছেন মাহমুদা বেগম।আব্রাহাম সাহেব পাশে বসে তাকে সান্ত্বনা দিচ্ছেন।
----আমার কষ্ট হচ্ছে খুব।আমার সোনাটা কি করছে?ও রাতে খেয়েছে তো?ওষুধ খেয়েছে তো?
----মাহমুদা চিন্তা করোনা।আজ আমার মামোনি আজ নতুন জীবনে পা দিয়েছে।ওর জন্য দোয়া করো।
----দোয়া তো করি ।মায়ের কি দোয়া করতে হয়!আমার কলিজাটা কে ছিড়ে দিয়েছি যেন আজ।
----মাহমুদা কেঁদো না।ও চলে আসবে তো।
----আচ্ছা আমরা যে নাফিজের থেকে এতো বড় সত্যি টা লুকালাম।ও যদি কখনো জানতে পারে আমার তারার বায়োলজিকাল মা বাবা না।তাহলে?
----তাহলে মানে।আমরা ই ওর বাবা মা।ওকে জানতে দেব না।আর জানলে বা কি।আমার তারা কি আর পাঁচটা মেয়ের মতোন নাকি?নাফিজ কি পারবে ওর মতো আরেকটা মেয়ে এতো সহজে খুজতে।
----সেটা ঠিক।তবুও।
----তবুও কিছু না।ঘুমা ও তুমি।বড্ড চিন্তা করছো বেশি।
আব্রাহাম সাহেব মাহমুদা বেগম কে টেনে বালিশে শুইয়ে দিলেন।
;;;;;
----হ্যাঁ তারা।মিষ্টি পাখি আমার জীবনের অংশ।
নাফিজ মিষ্টিকে নিয়ে তার সমস্ত অতীত তারাকে বলে দিল।নাফিজের চোখ বেয়ে পানি পড়ছে।নাফিজ তবুও বাইরের দিকে তাকিয়ে আছে।এদিকে যে তারার চোখেও পানি সেটা আর সে দেখলো না।
----মিষ্টি কে কখনো পাননি আপনি?তাহলে কেন আর খুঁজলেন না ওকে?
----খুঁজে কি করতাম।মিথ্যার জাল আর কতো।
----মানে?
----আমার এই ইমোশন নিয়েও মানুষ খেলেছে।জানো ইউনিটে শুরুর দিকে ক্যাপ্টেন তানিয়া নিজেকে মিষ্টি বলে দাবি করেছিল।
----তারপর?
----ঐ দিন বাড়ি এসে সারারাত ঘুম হয়নি আমার।ভেবেছিলাম তবে কি উনিই আমার মিষ্টি।কিন্তু পরে যখন নিজের খেয়াল হলো বিশেষ করে বয়স তখন বুঝলাম আমার মিষ্টির এখনো এতোটাও বড় হওয়ার কথা নয় যে সে একজন অফিসার হবে।আর সত্যি বলতে শুধু ভেবেছিলাম।চোখ বুজলে মিষ্টির সাথে তাকে মেলাতে পারিনি।তাই আর কাউকে বিশ্বাস করি না।ঐদিনের পর আমার জীবনে নতুন মোড় শুরু।মায়ের চোখের পানি বাবার হতাশা দেখে প্রচুর কাদতাম।পরে মসজিদের ইমাম ও বোঝালেন এভাবে জীবন চলে না।আর হুট করে তুমিও কোথ থেকে আমার জীবনে এসে পড়লে।আমার সব কিছু যেন আরেকবার এলোমেলো হয়ে গেল।আর সেই এলোমেলো থেকেই আরেকবার বাঁচার আশা পেয়েছি।
----এখন যদি কেউ এসে বলে সে মিষ্টি তাহলে?
----বলবে না।বলা এতো সহজ নয়।আমি তার থেকে প্রমাণ নেব।সব প্রমাণ।আরেকবার চিনতে ভুল করব না।
নাফিজ চোখ মুছে পেছনে তাকালো।
----তারা তুমি কাদছো কেন?
----আসলে এতোটা ভালো কেউ কাউকে বাসতে পারে জানা ছিল না।চোখে পানি চলে এলো।
----আমি আজ ও ওকে খুঁজি।যদি খুঁজে পাই।
----কেন?ও যদি ফিরে আসে তখন কি করবেন আপনি?আমাকে বেছে নেবেন নাকি ওকে?
তারা জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে নাফিজের দিকে তাকিয়ে আছে।তারার দৃষ্টি দেখে নাফিজের মনে দুষ্টু বুদ্ধি জাগলো।
দুষ্টুমি করে নাফিজ বললো,
----দুজনকেই মেনে নেব।
----মানে?মানে মিষ্টিকে ও বিয়ে করে নেব।আর তোমার ও একটা সাথী থাকবে।
তারা যেন তেলে বেগুনে জ্বলে উঠলো নাফিজের কথা শুনে।
----কখনো না।আমি অসুস্থ বলে ভাববেন না যে আপনাকে ভাগ করব।আপনার যদি তাকে নিয়ে এতোই আশা থাকে কেন বিয়ে করেছেন আমাকে?কেন এতো কিছু ঘটিয়েছেন?তার চেয়ে বলে দিন আমি এখনি চলে যাব।
তারা রেগে ওঠার চেষ্টা করছে তার আগে নাফিজ তারাকে টেনে এনে বুকে সাথে জড়িয়ে নিল।
----এই।একদম না।সাহস দেখি কম না তোমার?ঠ্যাঙ কেটে হাতে ধরিয়ে দেব।
----ছাড়ুন আমাকে।
----ছাড়ব না।
বেশ কিছুক্ষণ অতিক্রান্ত হলো।নাফিজ এখনো তারাকে বুকের সাথে জড়িয়ে রেখেছে।তারা চুপটি করে নাফিজের হার্টবিট গুলো শুনছে।
----তারা আমার জীবন টা এখন আর আগের মতো নেই।তারা মিষ্টি ছিল আমার অপেক্ষা আমার ভালোবাসা।কিন্তু তারা সে তো শুধু আমার না।আমার পরিবারের মুখের হাসি,আমার নতুন করে বাঁচার কারণ,আমি রাত জাগা রাত গুলোর ঘুমন্ত হওয়ার কারণ,আমার মুখে হাসি ফোটানোর কারণ।আমি মিষ্টিকে ভুল তে পারব না।কিন্তু তারাকে ভুলতে পারব না আর ছাড়তে তো পারবোই না।মিষ্টি যদি কখনো আসে ওর জন্য আমি ওর জীবন নতুন করে সাজিয়ে দেওয়ার দায়িত্ব নিতে পারি।কিন্তু তারার জন্য দেওয়া না দায়িত্ব নিতে পারি।আর ছোট্ট মিষ্টির জন্য আমার ভালোবাসা টা যে এক তরফা।পুচকু যে তখন বোঝে নি আমার অনুভূতি টা।ও শুধূ তার নাফিজ ভাইয়াকে বন্ধু ভাবতো কাছের বন্ধু,খেলার সাথী।আর তারার প্রতি ভালোবাসা টা দুই তরফা।আমি যে তারার শুধূ বন্ধু না তার ক্যাপ্টেন,তার ভালোবাসা আজ তার স্বামী।দুটো এখন আলাদা হয়ে গেছে তারা।তোমাকে ছাড়া সম্ভব না আমার।
নাফিজ বুকের সাথে আরো শক্ত করে জড়িয়ে ধরলো তারাকে।নাফিজের চোখের ফোটা ফোটা পানি তারার পিঠে পড়ছে।এদিকে তারার চোখেও পানি।এই পানির অর্থ শুধু তারাই জানে।
নাফিজের মনে মনে একটা কথাই বলছে,
----পারব না পাখি।তোমাকে হারাতে পারব না।
আর তারা তো মনে মনে আজ আরেক কথা বলছে,
----আল্লাহ তুমি আজ এরকম একটা রাত দেবে আমাকে কল্পনা করতে পারিনি আমি।ভেবেছিলাম এটা শ্রেষ্ট রাত।না এটা আমার জীবনের সর্বশ্রেষ্ঠ রাত।এতোদিন ভেবেছি আমার জীবন মানেই রাতের অন্ধকার,আজ আমার জীবন এর আলো মানেই সেই রাতের আধার।আমার অতীত বর্তমান আজ সব মিশে গেছে।একাকার হয়ে গেছে।আমি পারি নি এটা ভাবতে।আজ ভালোবাসার শব্দ টা আরেকবার পরিচয় করালো আমাকে।এই মানুষটাকে আরো ভালো বাসব আমি।ওর ভালোবাসার পাল্লা যে বড্ড বেশি ভারী হয়ে গেছে।সে নিজেও জানে না।আমি তোমাকে ভালোবাসি খুব ভালোবাসি ক্যাপ্টেন নাফিজ ভাইয়া।
তারা নীরবে চোখের পানি ফেলে গেল।নাফিজ এবার তারাকে বুক থেকে তুললো।তারার চোখের পানি মুছে দিল।
----দেখো না কতোটা স্বার্থপর আমি।আমার জন্য তোমাকে ও আজ কাদিয়ে দিলাম।
তারাও হাত দিয়ে নাফিজের চোখের পানি মুছে দিল।
----উহুম।আপনিই না বলেছিলেন এখন যে যা হবে সব দুজনের।
নাফিজ মুচকি হেসে তারার কপালে চুমু দিল।তারার গালে চুমুতে ভরিয়ে দিল।তারা কেঁপে উঠছে।তার লজ্জা লাগছে।কিন্ত আজ যাই হয়ে যাক সে হার মানবে।নাফিজের ভালোবাসার কাছে।
নাফিজ তারার ঠোঁটে চুমু দিল।
----May I?
তারা লজ্জা পেয়ে নাফিজের বুকে মুখ লুকালো।নাফিজ দুষ্টু হেসে তারাকে কোলে নিয়ে বেলকনি থেকে ঘরের দিকে গেল।