অন্তর্দ্বন্দ্ব - পর্ব ৫৮ - সাবরিনা ইমরান - ধারাবাহিক গল্প


ভিনা অন্যমনস্ক ভাবে হেঁটে আসতেই রুশান দৌড়ে গিয়ে জড়িয়ে ধরলো।ভিনা ভয় পেয়ে গেলো,দুই হাতে দিয়ে ধাক্কা দিয়ে সড়িয়ে দিলো রুশানকে।

-- আরে আরে!আমি তো!ভয় পেলে কেন?
-- আ...আমি খেয়াল করিনি।এক্সট্রিমলি স্যরি।
-- আবার স্যরি বলছে,দেখো কান্ড।কী হয়েছে তোমার?আপসেট মনে হচ্ছে দেখে।দাদির শরীর ভালো আছে?
-- হ্যাঁ...মানে আগের মতই আছে।
-- জিজ্ঞেস করলে না কেন এসেছি?
-- কেন?
-- এভাবে বলবো না।অনেক কাহিনি।নতুন যে কফিশপ খুলেছে ঐটায় চলো গিয়ে বসি।
-- আমি টাকা আনিনি বেশি,আর বাসার ট্রাউজার পরে এসে পড়েছি।
-- তাতে কী?আমার কাছে তো মানিব্যাগ আছে।তাছাড়া তোমার থেকে এখনই চোখ ফেরানো যাচ্ছেনা।

ভিনা মলিনভাবে হেসে হাঁটা শুরু করলো।অমনোযোগী হয়ে হাঁটছিলো দেখে রুশান কাছে টেনে এনে হাঁটলো ভিনার কাধে হাত রেখে। ভিনা আতঙ্কে নিজের ঊর্ধ্বশ্বাস আটকে রাখে।ছিমছাম এই কফি শপের এক জানালার পাশের চেয়ার দুইজন বসলো।সাজসজ্জা এবং স্টাফদের এটিকেট দেখেই বোঝা যাচ্ছে এক্সপেন্সিভ জায়গা।রুশান এসব ব্যাপারে খুবই চুজি।ভালো জায়গা,ভালো পরিবেশ না হলে চলবেই না।বিশেষ করে যখন কোনো গুরুত্বপূর্ণ কথা বলার থাকে,তখন খুব আয়োজন করে ভালো জায়গায় নিয়ে যায়।ভিনা টঙে ছুটে যেতে ইচ্ছে হলো কেন যেন।খোলা আকাশের নিচে গরম চা নিয়ে বসার জন্য ভেতর খচখচ করছে।

-- গেস হোয়াট?সুরাইয়া বিদায় হবে কিছুদিন পরই।
-- এত সোজা?তুমি কি মনে করেছো তোমার মা এত সোজাভাবে যেতে দিবে?
-- মা কেন দিবে?সুরাইয়া নিজেই ভাগছে।
-- কীভাবে?
-- আমি বলেছি আমি ইম্পোটেন্ট তাই মা ঘরেই বিয়ে দিতে চাচ্ছে।বাইরের মানুষ জেনে ফেললে তো মান সম্মান থাকবে না।ছেলের অক্ষমতার বলি দিবে তোমাকে।
-- আর ইউ কিডিং?
-- না,সত্যি বলছি।এমনভাবে অভিনয় করেছি যে সুরাইয়া বিশ্বাস করতে বাধ্য হয়েছে।চাল চলনেও চেঞ্জ এনেছি।বেশি হাত নাড়িয়ে কথা বলতাম,পা ব্যাকায় চলতাম।মেয়ে ভয়ে শেষ। 
-- তোমার মা জানলে কী করবে বুঝতে পারছো?তোমাকে টেস্ট করতে পাঠাবে।
-- জানবে কীভাবে?সুরাইয়া কি বলবে যে সে সে* করতে পারবে না দেখে বিয়ে করবে না?বলবে তোমার মনে হয়?
-- বললে?
-- মা ওকে নিজেই বের করে দিবে ছেলের নামে এত বড় অপবাদ দেয়ার কারণে।তখন তো এটাও প্রশ্ন আসবে ও কীভাবে জানলো?কেমন প্যাচ লাগবে জাস্ট ইমাজিন করো।
-- আমি তাও আশ্বস্ত হচ্ছি না।
-- তাহলে আরেকটু শুনে নাও।সুরাইয়ার বয়ফ্রেন্ডের সাথে যোগাযোগ করেছি।ওদের বিয়ে পরশু।আমি যাবো সাক্ষী হিসেবে।তার চেয়েও বড় কথা,আজকে সকাল থেকে সুরাইয়া আমাকে ভাই ভাই বলে ডাকছে।ডু ইউ ওয়ান্ট এনিথিং মোর টু হেয়ার?

ভিনা অবাক হল রুশানের কথায়,কিন্তু উচ্ছ্বাস চোখে মুখে প্রকাশ পেলো না।রুশান খেয়াল করলো বিষয়টা।

-- তোমার মোবাইলটা দেও দেখি।আমার মোবাইলে চার্জ নেই।মেয়ের বয়ফ্রেন্ডের প্রোফাইল দেখাচ্ছি তোমাকে।বায়ো দেয়া 'পেইন ইজ মাই লাইফ'।

ভিনা হেসে ফেললো কথা শুনে।এরপর মোবাইল দিলো রুশানের হাতে।রুশান মোবাইল হাতে নিয়েই ভ্রু কুঁচকে ফেললো।এরপর হুট করেই রাগে পুরো চেহারা লাল হয়ে গেলো।

-- এসব কী?আমাকে বলোনি কেন আগে?
-- কী?

ভিনার সাথে সাথে মনে পরলো এবং মোবাইল হাত থেকে টেনে নিয়ে গেলো।

-- আবারো আমার প্রাইভেসিতে ইন্টারফেয়ার করছো রুশান।
-- রিয়েলি?আমার মা তোমাকে মেসেজ দিয়েছে জানাওনি কেন আগে?
-- কোথায় মেসেজ?নেই তো কোনো।
-- মাত্র দিয়েছে।কনভো দেখেই বোঝা যাচ্ছে আগে মেসেজ ছিলো।বলো কী বলেছে?
-- কিছু না।এটা নিয়ে কোনো বাড়াবাড়ি করার দরকার নেই।মনে রেখো,আমারই ইমেজ খারাপ হবে।উনি মনে করবেন আমি তোমাকে প্রোভোক করেছি।
-- আমার ***
-- ছি রুশান!ওয়াচ ইওর ওয়ার্ডস!

রুশান রাগে টেবিল ছেড়ে উঠে চলে গেলো।ভিনা কিছু বললো না।মাথা ঠান্ডা করে আবার ফিরুক,সমস্যা নেই।ভিনার মানসিক ভাবে বিপর্যস্ত হওয়ার কারণগুলোর মাঝে জেবা অন্যতম। সুরাইয়া কে বাসায় আনার কিছুদিন পরই উনি ভিনার নাম্বার জোগাড় করে ভিনাকে মেসেজ দিয়েছেন।খুবই ধারালো বুদ্ধির মহিলা হওয়ায় ভিনাকে কোনো বাজে কথা বলেননি,হুমকি দেননি।উনি মেসেজে মিষ্টি করে লিখেছেন-

'ভিনা মা,রুশানের ক্লোজ ফ্রেন্ড হওয়ায় তোমাকেই আগে খবরটা জানাচ্ছি। আমি আমার ভাইয়ের মেয়ের সাথে খুব জলদিই ওর বিয়ে দিবো।রুশান বোকা ছেলে,হয়ত জলদি বিয়েটা করতে চাইবে না।ভালো বন্ধু হিসেবে বোঝানোর দায়িত্ব তোমাকে দিলাম।আমার বিশ্বাস তুমি পারবে।'

 ভিনা মেসেজ দেখেও রিয়েক্ট করেনি। সুন্দর ভাষায় কীভাবে মানুষকে থ্রেট দিতে হয় কেউ জেবার কাছ থেকে শিখুক।ভিনা জেবার চেয়ে বেশি রুশানকে চিনে,কারণ একসাথে অনেক সময় কাটিয়েছে। জেবা ভারিক্কি বজায় রাখতে সবসময়ই ছেলেদের থেকে দূরেই থেকেছেন।জেবার সাথে ছেলেদের মানসিক দূরত্ব অনেক বেশি।এর জন্যই ভিনা ভীত হয়নি।রুশান কখনোই বিয়ের মতো জীবনের বড় সিদ্ধান্তে অন্যের হস্তক্ষেপ মেনে নিবে না।কিন্তু ভেতরে চাপ অনুভব করেছে,ঐ বাড়িতে বউ হয়ে গেলে জেবার সাথে শীতল দ্বন্দ্ব তৈরি হবে ভিনার।

বেশ কিছুক্ষণ পর রুশান আবার এসে চেয়ারে বসলো।ভিনার হাত ধরে বললো-
-- বলো মা কী বলেছে?তার লাস্ট মেসেজ ছিলো 'রুশানের সাথে কথা বলেছো?রাজি করিয়েছো?'
কী রাজি করাতে বলেছে?
-- কমনসেন্স খাটাও,বুঝে যাবে।এখন তোমার মার বদনাম করার ইচ্ছা আমার হচ্ছেনা।
-- ঠিকাছে।তুমি যখন চাচ্ছোনা আমি কথা বলবো না।
-- থ্যাঙ্কিউ।
-- আর বেশিদিন নেই ভিনা।সুরাইয়া চলে যাওয়ার পরই আমরা চট করে বিয়ে করে ফেলবো।বাবাকে আগে থেকেই জানিয়ে রেখেছি।

ভিনার চেহারা হাস্যোজ্জ্বল হওয়ার পরিবর্তে মলিন হয়ে গেলো।অনেক কষ্টে হাসি আনলো মুখে।

-- সমস্যা নেই।ধীরে সুস্থে বিয়ে করা যাবে।এত তাড়াহুড়ো করতে হবে না।
-- করতে হবে।আমি জলদিই বিয়ে করবো তোমাকে। 
-- প্রিতি আপুর ভালোমতো ডেলিভারি হতে দাও।ভাতিজা অথবা ভাতিজিকে নিয়ে অনুষ্ঠান করলে কত ভালো হবে ভেবে দেখো।
-- তখন আবার করবো।অনুষ্ঠান করতে কী।তাছাড়া তোমার দাদির শরীর ও তো ভালো না।
-- সমস্যা সব ঠিক হোক।এরপর আমরা বিয়ে করবো।এখন আমি বাসায় যাই।কাজ আছে।

রুশান বরাবরের মতো ভিনার কপালে চুমু দিয়ে বিদায় নিলো।এমনি সময়ে ভিনাকে বাসা পর্যন্ত এগিয়ে দিয়ে আসতো,আজকে ক্যাফে থেকে বের হয়েই নিজের বাসায় পৌঁছালো সবচেয়ে কম সময়ে।
বাসায় পৌঁছেই সোজা জেবার ঘরে ঢুকলো।

-- তোমার সাথে কথা আছে।আমার ঘরে আসো।

জেবা বিরক্ত হয়ে পেপার রেখে দিয়ে রুশানের ঘরে গেলেন।রুশান সজোরে দরজা বন্ধ করে জেবাকে নিজের মুখোমুখি বসালো।এক হাতে নতুন চকচকে ব্লেড।

-- দেখছো এটা কী?
-- ফাযলামি হচ্ছে নাকি?এসব দেখাচ্ছো কেন আমাকে?
-- এই ব্লেড তখন কেনা,যখন ভিনা আমার সাথে সম্পর্কে যেতে চায়নি।আমাকে দূরে সড়িয়ে রেখেছিলো যার কারণে আমি মানসিকভাবে অসুস্থ হয়ে গিয়েছিলাম।

জেবা মুখ শক্ত করে বসে থাকলেন।চোখ থেকে আগুনের হলকা বের হচ্ছে,হাত কাঁপছে রাগে।

-- অনেক কষ্টে আমি বের হয়েছি এই অশান্তি থেকে।এখন যদি কেউ আমার জীবনে আর বিন্দুমাত্র ইন্টারফেয়ার করে,এই ব্লেডটাকে আমি কাজে লাগাবো।তুমি কি বুঝতে পেরেছো আমি কী বলেছি?

জেবা চুপচাপ শুনে গেলেন।আর টু শব্দ করার সাহস পেলেন।তার ভেতরে ঝড় বয়ে যাচ্ছে।তিনি অন্তর্দ্বন্দ্বে পরেছেন।ছেলেকে মৃত্যুর মাধ্যমে হারানো ভালো হবে নাকি অন্য মেয়ের হাতে তুলে দিয়ে খোয়ানো ভালো হবে হিসাব কষছেন।হ্যাঁ, হিসাব কষতে হচ্ছে।কারণ তার পরিকল্পনা বিফলে গেছে।

_________________________

ভিনা বাসায় ফিরে হাত মুখ ধুয়ে ফ্রেশ হয়ে যখন নিজের ঘরের দরজা লাগাতে যাবে,তখনই মুনা আসলো।মুনার চেহারা দেখে চিন্তিত মনে হচ্ছিলো।

-- ভিনা তুমি কি ব্যস্ত?
-- না,বলো তুমি কী হয়েছে।
-- আমার মনে হয় একদিন তোমার প্রিতিকে দেখতে যাওয়া দরকার।
-- সেটা তো যাবোই আমি।কেন কিছু হয়েছে এমনিতে?
-- প্রিতির শরীরটা না ভালো না।হালকা ব্লিডিং হচ্ছে বলছিলো।এমন আমারো.....

মুনা থেমে গেলেন।কিছু কথা সহজে বলা যায় না।বড় করে দম নিয়ে বললেন-

-- এসময়ে ব্লিডিং খুব খারাপ। ওর শরীর ও খুব খারাপ যাচ্ছে।হস্পিটালাইজড করতে হতে পারে।
-- আমি কালই যাবো। 
-- ঠিকাছে।

কথা শেষ করে ভিনা দরজা লাগিয়ে দিলো।প্রিতির জন্য ভয় হচ্ছে ভীষণ। কিন্তু সেটা ছাপিয়ে যাচ্ছে চিঠির কথাগুলো।ভিনা সাবধানে ব্যাগে রাখা চিঠি বের করলো।দ্বিতীয়বার বের করে পড়লো সেই চিঠি।

'হতভাগী ভিনা।জানি না এই কঠিন সত্যের ধাক্কা তুমি কীভাবে সহ্য করবে।তবুও পরামর্শ রইলো সত্য না জেনে কোনো বড় সিদ্ধান্ত না নেয়ার।

ইতি,তোমার শুভাকাঙ্ক্ষী। '

ভিনা জানে না পরবর্তীতে কী হতে যাচ্ছে।রুশান যত জলদি সম্ভব বিয়ে করতে চাচ্ছে।আসলেও কি বিয়ে করা ঠিক হবে এত জলদি?
.
.
.
চলবে..........................................................................

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

WhatsApp