অন্তর্দ্বন্দ্ব - পর্ব ৫৯ - সাবরিনা ইমরান - ধারাবাহিক গল্প


-- ব্যস্ত নাকি ভিনা?
-- না,এমনি বসে ছিলাম।তোমার খুব ব্যস্ততা যাচ্ছে দেখি।
-- হ্যাঁ।মিটিং এ ছিলাম।এই বয়সে এত ধকল ভালো লাগে না।আবার বাসায় একা বসতে থাকতেও ভালো লাগে না।কী যে ঝামেলায় পড়লাম।
-- একবার সুহৃদা আপুর সাথে কথা বলুন না।
-- তোমার ইন্টারভিউ কেমন গেলো?

প্রফেসর রুদমিলা ভিনার কথা সরাসরি এড়িয়ে গেলেন।ভিনার কষ্ট লাগলো।কেন এমন করবে সুহৃদা?এরকম মমতাময়ী মা কে কেউ দূরে রাখতে পারে?নাকি মায়ের বুদ্ধিমত্তার কাছে নিজেকে ছোট মনে হয় দেখে এত দূরত্ব?।
ভিনা ইদানিং বেশি অন্যমনস্ক থাকতে শুরু করেছে।সবার কোনো না কোনো কথা নিয়ে হুট করেই ডুবে যায়। নিজের সাথে নিজের নীরব কথোপকথন চলে।

-- এবসেন্ট মাইন্ডেড হয়ে আছো ভিনা।বাসার সমস্যা কি বেশি হচ্ছে?
-- না।রিসেন্টলি দাদি মারা গেছে তো।খুব খালি খালি লাগে।
-- কতদিন হলো যেন?
-- বারোদিন।
-- খারাপই লাগে।এভাবেই সবাইকে চলে যেতে হবে একদিন।
-- এভাবেও চলে যাওয়া খারাপ না।দীর্ঘায়ু জীবনের শেষ দিকে সন্তান নাতি-নাতনিদের সাথে স্বাভাবিক মৃত্যু সবারই চাওয়া।অসময়ে চলে যাওয়া মানুষদের জন্য কষ্ট হয়।হারিয়ে যাওয়া মানুষদের জন্য ও....
-- তুমি খুব স্ট্রেসড হয়ে আছো।স্বাভাবিক। এতদিন তোমার সাথে পরিচয়,অথচ বেশিরভাগ সময়ে মলিনভাবে দেখতে হলো তোমাকে।
-- জীবনটাই এমন।
-- ইন্টারভিউ কেমন হলো বললে না তো।
-- হয়েছে মোটামুটি।ট্রিকি কোয়েশ্চেন করে।
-- তা তো করবেই।আমার মনে হয় হয়ে যাবে।হয়ে গেলেও কি লাভ হবে কোনো?
-- এখনি বলতে পারছিনা। 
-- স্ট্যাবিলিটি দেখলাম না তোমার লাইফে।গতবার হুট করে বিয়ে ঠিক হয়ে হুট করে ভেঙে গেলো।এবার যদিও এঙ্গেজমেন্ট হয়েছে,রুশানকেও আমার ভালো লেগেছে।কিন্তু আরেকটু অপেক্ষা করা কি ঠিক হতো না?সব গুছিয়ে নিয়ে এরপর বিয়ে নিয়ে ভাবতে।
-- আমার ভাবায় কি জীবন চলে?চললে তো ভালোই হতো।
-- মন খারাপ করোনা ভিনা।আজকে আর বেশিক্ষণ আটকাবো না তোমাকে।তোমার রিসেন্ট পেপারটা সাবমিট করে চলে যাও বাসায়।রেস্ট নাও প্রোপারলি।
-- থ্যাঙ্কিউ 

ভিনা ফাইল থেকে কাগজপত্র বের করে খুব অল্প সময়ে কাজ শেষ করে বাসার দিকে রওনা দিলো।আজকে রুশানের ক্লাস আছে তাই আসতে পারেনি,ভিনার ও অপেক্ষা করতে ইচ্ছে করলো না।এ জায়গায় রুশান থাকলে ঠিকি অপেক্ষা করতো।

ভিনা নিজের হাতের দিকে তাকালো।ছোট ডায়মন্ডের ছিমছাম একটা রিং অনামিকায় শোভা পাচ্ছে।এ ধরনের আংটি আগে অনেক পরা হয়েছে,কিন্তু এটা ভিন্ন।দুই সপ্তাহ আগেই ভিনা এবং রুশানের এঙ্গেজমেন্ট হয়েছে।চিঠি পাওয়ার এক সপ্তাহ পরই রুশান সপরিবারে প্রস্তাব নিয়ে আসে।ভিনা সেদিন রুশানের কথা সিরিয়াসলি নেয়নি,পরে দেখা গেলো আসলেই সুরাইয়া রুশানের সাথে অজ্ঞাত কারণে বিয়েতে না করে দিয়েছে এবং অন্য ছেলেকে বিয়ে করে ফেলেছে।জেবার মাথায় হাত দিয়ে বসা ছাড়া উপায় ছিলো না।যদিও তিনি বুঝতে পারছেন এর সাথে রুশান জড়িত তবুও তার কিছু করার নেই।ভিনা খুশি ছিলো রুশান কথা রেখেছে।ভেতরে প্রশান্তি কাজ করছিলো এইভেবে যে এবার আর ভুল মানুষকে বেছে নেয়নি।তবে চিঠির কারণে মনে যে উদ্বেগ এবং আশঙ্কা তৈরি হয়েছে সেটাও ফেলে দিতে পারেনি।তাই চেয়েছিলো কথা পাকাপাকি হয়ে থাক,বিয়ে পরে হবে।ভিনার এই মতামত মেনে নেয়নি রুশান।বিয়ের ক্ষেত্রে সে নাছোড়বান্দা। পারলে এক মিনিটে কাজি এনে বিয়ে সেড়ে ফেলে।এই অস্থিরতা ভিনার পছন্দ হয়নি।

-- তাড়াহুড়োর কাজ কখনো ভালো হয় না রুশ।
-- কিছুক্ষেত্রে সময়ের মূল্য অনেক বেশি থাকে।এক মিনিট সময়ের এদিক ওদিক সারাজীবনের ক্ষতি করে দিতে পারে।
-- তোমার কথা কিছুই বুঝতে পারছিনা আমি।প্রস্তাব তো দিয়ে দিয়েছোই,এখন আবার ভয় কিসের?
-- আমি নিজেও জানি না।শুধু জানি তোমাকে বিয়ে না করলে তুমি হারিয়ে যাবে।
-- কীসব ফালতু কথা রুশান!
-- আমি তোমাকে অনেক ভালোবাসি ভিনা।মানুষ যখন কারো সাথে খুব ইনভলভ হয়ে যায়,তখন সেই মানুষকে ঘিরে হওয়া ইন্টিউশন সত্যি হয়ে যায়।

ভিনা হতবাক হয়ে গেলো।রুশান একদম সত্যি কথা বলেছে এর প্রমাণ ভিনা নিজেই।যাবির ছেড়ে চলে যাওয়ার আগে ভিনাও টের পেয়েছিলো বিচ্ছেদের কথা।এক্ষেত্রে রুশানকে দোষ দিয়ে লাভ নেই। ভিনা না করতে পারলো না।দূর্বলভাবে বললো,

--প্রিতি আপুর ডেলিভারি হোক,তার শরীর ভালো না।
-- কোনো আয়োজন নেই। বাসায় এসে কাজি বিয়ে পরিয়ে দিয়ে যাবে।এর আগে শুধু এঙ্গেজমেন্ট হবে,আর ছোট করে হলুদ হবে।তিন দিনের ফুল প্যাকেজ।না করো না ভিনা।তোমার দাদিও আমাদের বিয়ে দেখে যাক।

শেষের কথায় ভিনার অমতের সু্যোগ নেই।সবই ঠিক আছে তবু কিছু একটা ভুল মনে হচ্ছে ভিনার।ভিনা নিজেও চায় তার দাদি বিয়ে দেখে যাক।কিন্তু সব এত জলদি হচ্ছে কেন।সুখ আসুক জীবনে,একটু আয়োজন করে আসুক,দীর্ঘসময় নিয়ে আসুক।

প্রস্তাব পাঠানোর এক সপ্তাহের মাঝে এনগেজমেন্ট,হলুদ এবং বিয়ের শপিং করে ফেললো দুই পরিবারের সদস্যরা।রেহান এসব চায়নি তখনো,তারও মনের ইচ্ছা সুস্থ বউ বাচ্চা নিয়ে ভাইয়ের বিয়ে ধুমধাম করে খাবে।রুশানের অস্থিরতা দেখে এবং প্রিতির অনুরোধে রেহান অনিচ্ছা সত্ত্বেও বিয়ের আয়োজনে অংশ নিলো।কিন্তু ভাগ্য বলেও একটা কথা আছে।কথা ছিলো সপ্তাহের বুধবার এনগেজমেন্ট,বৃহস্পতিবার হলুদ এবং শুক্রবার কাবিন হবে।জেবা ছেলের বিয়েতে অনেক নাখোশ থাকলেও আয়োজনে ত্রুটি রাখলেন না।

যথারীতি বুধবার এঙ্গেজমেন্ট হয়।সন্ধ্যায় দুই পরিবার এর কাছের মানুষদের নিয়ে এঙ্গেজমেন্টের আয়োজন করা হয়েছিলো।রুশান যখন সোহেলের সাথে বিয়ের কথা বলেছিলো,তখন ভিনা সবার অগোচরে একটি কাজ করেছিলো,লাভ হয়নি কোনো।এত জলদি সবকিছু হওয়ায় ভিনা ঠিক বুঝতেও পারছিলো না কিছু,একরকম নাম্ব হয়ে গিয়েছিলো।সময় এবং পরিস্থিতির স্রোতে গা ভাসিয়ে দিচ্ছিলো যখন বুঝতে পেরেছে কিছুই করার নেই।এঙ্গেজমেন্ট হওয়ার সময়ে জমিরা বিবি দীর্ঘদিন পর শুধুমাত্র নাতনির জন্য ঘর থেকে বের হয়ে অনেক কষ্টে সোফায় বসলেন।শারীরিক ভাবে কষ্ট হলেও মুখে হাসির কমতি ছিলো না।প্রিতিও এসেছিলো রেহানকে অনুরোধ করে।রেহান ও আর না করেনি।এনগেজমেন্ট এ প্রিতিকে প্রাণোচ্ছল দেখে রেহান নিজেও অনেক খুশি ছিলো।

রুশান নাটকীয়ভাবে অনেক দ্রুত ভিনার হাত টান দিয়ে আংটি পরিয়ে দিয়েছিলো।সবাই এই কান্ডে হেসে ফেললেও জেবা শক্ত হয়ে বসে রইলেন।ভিনা ধীরে সুস্থে আংটি পরানো মাত্রই রুশান সবার সামনে ভিনার হাতে চুমু খায়।ভিনা লজ্জায় লাল হয়ে যায় রুশানের বাড়াবাড়িতে।রাতের বেলায় দুই পরিবার যখন নিজেদের মধ্যে আলাপ চারিতায় ব্যস্ত,তখন রুশান ভিনাকে ডেকে নিলো আড়ালে।
শক্ত করে জড়িয়ে ধরে বললো-

-- এখনি ডেকে ফেলি কাজি?এখনি কবুল বলে তোমাকে বাসায় নিয়ে যাই আমার সাথে?
-- পরশুদিনই তো কাবিন,আর একদিন অপেক্ষা করতে পারবে না?পাগল হয়েছো?
-- হ্যাঁ হয়েছি।চলো পালায় যাই। 
-- ওহহো,ছাড়ো আমাকে।

রুশান ভিনাকে ছাড়লো না।আরো শক্ত করে নিজের কাছে টেনে নিলো।
-- তোমাকে হারিয়ে ফেলবো না তো ভিনা?

ভিনা স্তব্ধ হয়ে গেলো রুশানের কান্নাজড়ানো ভারি গলা শুনে।ধীরে ধীরে রুশান নিজেকে আরো কাছে আনলো,গভীর ভালোবাসায় অধরবন্দী করলো ভিনাকে।জীবনে প্রথমবার প্রেয়সীর প্রতি ভালোবাসা প্রকাশ ঘটেছিলো সেই মুহূর্তে।ভিনা একসময় নিজেকে ছাড়িয়ে নিলো।লজ্জায় অন্যদিকে ফিরিয়ে নিলো চোখ।

-- কালকের দিন সবচেয়ে বাজেভাবে যাবে।বাবা শুক্রবারেই বিয়ে দেয়ার জিদ না করলে এখনি তোমাকে তুলে নিয়ে যেতাম।

রুশান কথা বাড়ানোর আগেই মুনা খেতে ডাকতে আসলো দুইজনকে।ভিনা দৃষ্টি বাঁচিয়ে জলদি চলে এলো। রুশান শুধু মন্ত্রমুগ্ধ হয়ে থাকলো প্রেয়সীকে কাছে পাবার মুহূর্তে।এই খুশির মুহূর্ত বেশিক্ষণ স্থায়ী হলো না।গভীর রাতে রুশানরা বিদায় নেওয়ার পরই জমিরা অসুস্থ হয়ে পরেন।তার নাক দিয়ে রক্ত পরতে থাকে।সবাই বুঝে যায় স্ট্রোক হয়েছে।ভিনা এনগেজমেন্টর কাপড় তখনো পরা ছিলো।এই অবস্থায়ই জমিরা বিবিকে ড্রাইভ করে হস্পিটালে নিয়ে যায়।প্রথমে আইসিউতে নিয়ে,পরে লাইফ সাপোর্টে নেয়া হয় জমিরা বিবিকে।ভিনা কল্পনাও করতে পারেনি জমিরা বিবি তার শেষ ইচ্ছা পূরণের দ্বারপ্রান্তে এসে এভাবে বিদায় নিতে যাচ্ছেন।ভিনা দুইদিন পর্যন্ত নাওয়া খাওয়া ছেড়ে জায়নামাজে পরে রইলো।কিন্তু জন্ম,মৃত্যু মানুষের হাতে নেই।সবাইকে নিরাশ করে ভিনার বিয়ের দিন শুক্রবারেই জমিরা বিবি মারা যান।

জমিরা বিবি মারা যাওয়ার খবরে দুই ছেলের কারো মধ্যেই প্রতিক্রিয়া দেখা যায়নি।শুধুমাত্র ভিনার বাবা সোহেল ভেঙে পড়েছিলেন।গ্রামে না দিয়ে মাকে শহরেই কবর দেয়ার ব্যবস্থা করেন সোহেল।স্ত্রীর কবরের এক সাড়ি পরেই জমিরা বিবিকে দাফন করা হয়।এই আকস্মিক মৃত্যুতে সবার প্রতিক্রিয়া যেমন থাকার কথা তেমনই ছিলো।অস্বাভাবিক ছিলো রুশানের প্রতিক্রিয়া। 

-- আমি সেদিনই বলেছিলাম বিয়ে করে ফেলি।দেখলে কী হলো!
-- ইউ আর বিং এন ইনসেন্সিটিভ পার্সন রুশান!একজন মানুষ মারা গেছে বুঝতে পারছো তুমি?
-- সেদিন বিয়ে হলে তোমার দাদিও দেখে যেতে পারতো।তোমরা তো জানতেই সে বেশিদিন বাঁচবে না।জানতে না?
-- এত বিয়ে বিয়ে করছো কেন তুমি?
-- অবশ্যই ফিজিকাল নিডের কারণে না ভিনা।বিয়ের ব্যাপারে যত দেরি হয়,তত অনিশ্চয়তা বাড়তে থাকে।
-- ভাগ্যে যা থাকে তাই হবে।
-- ভাগ্য অনেক নিষ্ঠুরও হয়।

মৃত বাড়িতে চল্লিশ দিন পর্যন্ত কোনো অনুষ্ঠান করা যায়না।তাই এখন বিয়ের প্রশ্নই আসে না।কোথায় যেন ভিনা স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললো।এই সময়টা দরকার ছিলো।কারণ ছাড়া এই পৃথিবীতে কিছু হয় না।রুশান প্রতিদিন আসে ভিনার সাথে দেখা করতে।অদ্ভুত অস্থিরতা কাজ করে ওর মধ্যে।

বেনামি চিঠি,এ যুগে কে বেনামি চিঠি দিবে?মোবাইলে অন্য নাম্বার দিয়েও তো ফোন দিতে পারতো।ভিনার মনে হয় কোনো পিয়ন এসে চিঠি দেয়নি।যে চিঠি লিখেছে,সেই সরাসরি দিয়েছে।অন্য দাড়োয়ানদের জিজ্ঞেস করতে হবে বাসায় যেয়ে।আরো আগে খোঁজ নেয়া উচিৎ ছিলো।নানা ঝামেলায় এতটাই জড়িয়ে পরেছিলো যে আর খোঁজ নেয়া হয়নি।এই চিঠিই ধরা হয়নি কত সপ্তাহ।এত বোকামি কেন করে মাঝে মাঝে।এত দিন পর সেই দাড়োয়ান আছে নাকি কে জানে।

 দুই লাইনের চিঠিতে ভিনা কতবার যে হাত বুলিয়েছে,কত সময় যে নষ্ট করেছে হিসাব নেই।এখনো বসে আছে চিঠি নিয়ে।চিঠির প্রতিটা ভাজে ভাজে কেউ মায়া,চিন্তা, ভালোবাসা মেখে রেখেছে।এত রুক্ষ সংক্ষিপ্ত চিঠি,তবুও আপন আপন ঘ্রাণ পাওয়া যায়।যতবার চিঠিটা দেখে,ততবার নতুন কোনো আবেগ খুঁজে পায়। 

চিঠি রেখে ভিনা ঘুমিয়ে গেলো নিজের অজান্তেই। মাঝরাতে দুঃস্বপ্নে বুক ধরফর করে উঠে বসলো।পুরো শরীর ঘামে ভিজে গেছে।আবারো দুঃস্বপ্ন!ভিনার ভেতরে ভয় কাজ করতে থাকলো।অনুভব করলো ঘর ভারি হয়ে গেছে।এই ঘর ভারি একজনের মৃত্যুতে হয় না।এই বাড়িতে আরো মৃত্যু হবে।
.
.
.
চলবে..........................................................................

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

WhatsApp