অন্তর্দ্বন্দ্ব - পর্ব ৬৪ - সাবরিনা ইমরান - ধারাবাহিক গল্প


-- তোহা আপু,তুমি তো বুদ্ধিমতী ছিলে।তুমি কেন বলেছিলে আমার বাচ্চা এ্যবোর্ট করতে?তুমি যাবিরকে জেল থেকে বের করেছো,নতুন বাসার জন্য এ্যডভান্স টাকা দিয়েছো।তুমি কি চাইলে পারতে না তখন যাবিরের হাতে কিছু টাকা দিতে যখন আমি প্রেগন্যান্ট ছিলাম?ওর মায়ের চিকিৎসার খরচ টাই নাহয় দিতে।আমি কখনো ফিরে যেতাম না কারো কাছে।আজকে আমার জীবন এমন হতো না!

তোহা ব্যাগ গুছানোয় মন দিলো।ভিনার প্রশ্নের উত্তর ওর কাছে নেই।উত্তর নেই বললে ভুল হবে,উত্তর দিতে চাচ্ছে না আসলে।

-- বলো আপু!আমার কথার উত্তর দিচ্ছো না কেন!ও আমাকে বিয়ে করতে চেয়েছিলো।আজকে আমি বিবাহিত থাকলে অন্তত আমার বাচ্চাকে নিজের বলে পরিচয় দিতে পারতাম।বাবা মা ছাড়া বাচ্চার জীবন কেমন হয় তুমি জানো না?

-- তুমি কিছু জিনিস বুঝতে পারছো না ভিনা।যাবির তোমাকে সবকিছু বলেনি কারণ নিজেও অনেক কিছু জানে না।

-- বলো আমাকে।অন্ধকারে রেখে কী লাভ হবে আমাকে বলো তুমি?

-- যাবির তোমাকে বিয়ে করতে চেয়েছিলো।
-- হ্যাঁ,আমাকে বলেছে।
-- তোমাকে বিয়ে করলে কী হতো সেটা কি জানো?
-- জানি।খেতে পারতাম না,পড়তে পারতাম না।কিন্তু নিজের স্বামী সন্তান নিয়ে তো থাকতে পারতাম। 
-- আসলেই পারতে?
-- কেন পারতাম না?বলো কেন পারতাম না?
-- বুঝবে না।
-- মানে?

ভিনার ভেতরে অন্যরকম ভয় ঢুকে গেলো।আবার কোন সত্যের মুখোমুখি হতে হবে এখন?

-- আমাকে তোমার অনেক ভালো মনে হচ্ছে তাইনা ভিনা?আমি আসলে ভালো না।কখনো মনে প্রশ্ন জাগেনি রুপিনের মতো এত জঘন্য মহিলার সাথে আমি এত বছর ধরে আমি কাজ করছি,এর শুরু কীভাবে হলো?

ভিনা ঠায় দাঁড়িয়ে আছে।কান হাতে দিয়ে দৌড়ে পালিয়ে যেতে ইচ্ছে করছে।পারবে না সে জীবনে ঘৃণার মানুষের সংখ্যা বাড়াতে।

-- আমি বাইরে চলে যাচ্ছি।আর দেশে ফিরবো না।তুমি চাইলেও আর আমাকে খুঁজে আমাকে।আমার অস্তিত্ব রুপিনকে ঘিরে ছিলো।এখন তোহা নামের কেউ থাকবে না।তাই তোমাকে বলে যাই,যদিও ইচ্ছা ছিলো না।হাতে গোণা দুই একজনই আমাকে ভালোবাসে।তাদের ভালোবাসা হারানোর কষ্ট অনেক বেশি।অবশ্য তোমার সাথে আর দেখাও হবে না আমার।

ভিনা অবাক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে।সবার এত রূপ কেন পৃথিবীতে। এত কেন হিসাব? তোহা সেদিকে ভ্রুক্ষেপ করলো না।ভ্যানিটি ব্যাগে পাসপোর্ট এবং প্রয়োজনীয় কাগজপত্র ঢুকাতে লাগলো।কিছুটা বিরতি বলা শুরু করলো।

-- যাবিরের বাবা ছোট চাকরী করতেন।গ্রামের হতদরিদ্র পরিবার থেকে উঠে এসেছিলেন,যোগ্যতাও ছিলো ভালো।সাহরা,মানে যাবিরের মা যিনি,উনার সাথে প্রেম হয় যাবিরের বাবা মোর্শেদের।প্রেম ঠিকি ছিলো,সাথে টাকার প্রতি টান ও ছিলো।মোর্শেদের... দেখো নাম ধরে বলছি দেখে মাইন্ড করোনা।আমি এত সম্বোধন পছন্দ করি না।যাই হোক,মোর্শেদ সাহরাকে বিয়ে করেন।বউকে ভালোবাসলেও বউয়ের পরিবার থেকে বিচ্ছিন্ন হওয়ার বিষয়টা পছন্দ করে নাই ঐ লোক।তার কথা টাকা থাকলে টাকা ভোগ করবে না কেন,এ আবার কোন জাতের পাগল।মোর্শেদ বউয়ের মন রক্ষা করে নানা ভাবে চেষ্টা করতো বাপের বাড়ি থেকে সম্পত্তি আনার।পারে নাই।এত্ত সোজা নাকি?বেচারা একেবারে হতদরিদ্র পরিবার থেকে এসেছে,ভাগ্য করে বড়লোকের মেয়েকে বিয়ে করতে পেরেছে তাও যদি একটু বিলাসিতা না করতে পারে তাহলে জীবনই বৃথা।তুমি তো টাকার অভাব দেখোনি কখনো।বুঝবা না মানুষের হাহাকার কেমন হয়।

যাই হোক,সময় কম,পয়েন্টে আসি।সাহরা যত সরল এবং জটিলতা ছাড়া ছিলেন,মোর্শেদের বুদ্ধি তত বেশি ছিলো।নিরপেক্ষভাবে দেখলে উনার চাওয়া অন্যায় ছিলো না।বউয়ের প্রাপ্য সম্পত্তি চাচ্ছিলেন শুধু।এখন বউয়ের দাবি না থাকলে এবং বউয়ের পরিবারের খেয়াল না থাকলেও তো মুশকিল।এই চৌধুরীদের মধ্যে অনেক ঝামেলা ছিলো।নামটাই কেমন বড়লোক ধরনের,জীবন ও তো তেমনই হবে।একঘরে যদি একাধিক একি ক্লাসের মানুষ থাকে,দ্বন্দ্ব লাগবে।রুপিনের যখন বিয়ে হয়,তখন হাসান চৌধুরীর বয়স হয়েছে।উনি চলেন ছেলের বুদ্ধিতে।আর ছেলে চলে বউয়ের বুদ্ধিতে।তাহলে ঘরের মাথা কে হলো?রুপিন।রুপিনের খেদমতের জন্য সবসময় একজন মেয়ে থাকতো।বুঝতেই পারছো এ ধরনের কাজের লোকেরা মালিকদের জীবনের সব গোপন খবর জানতে পারে।তাই মোর্শেদ তার পাঁচ মেয়ের দায়গ্রস্ত খালাতো ভাইয়ের বড় মেয়েকে ঢাকায় নাম পালটে নিয়ে আসে। যে এজেন্সির মাধ্যমে যোগাযোগ করে এসব লোক নিয়োগ দেয়া হতো সেটার মাধ্যমে অবশেষে ঐ মেয়েকে রুপিনের একেবারে বেডরুম পর্যন্ত পাঠাতে সাক্সেস্ফুল হয়।এই মেয়েই পরে রুপিনের সেক্রেটারি হয়।

ভিনা এতক্ষণ মাথা নিচু করে সব শুনছিলো।শেষ বাক্য শোনার পর বিস্ফোরিত চোখে তোহার দিকে তাকালো।এরপর চাপা উত্তেজনায় বলে উঠলো-

-- তার মানে...তুমিই সেই সেক্রেটারি?সে হিসাবে..

-- সে হিসাবে আমি যাবিরের দূর সম্পর্কের বোন।কিন্তু সত্যিকার অর্থে যাবিরের সাথে একসাথে আমি বড় হইনি তবে স্নেহ করতাম।ওকে আমি ঠিকভাবে চিনতাম ও না।মাত্র চৌদ্দ বছর বয়সে ঢাকায় এসেছিলাম।এসেই কাজে ঢুকি রুপিনের জন্য।পড়াশোনা সেভেন পর্যন্ত করেছিলাম।ঢাকায় আসার পর এসএসসি পর্যন্ত পড়তে পারি।অবশ্য সবই একটা ব্র‍্যান্ডিং এর অংশ ছিলো।বড়লোকদের হাজার অপকর্ম ঢাকার জন্য নিষ্পাপ একটা ইমেজ ক্রিয়েট করতে হয়।রুপিন কাজের মেয়েকে মানে আমাকে এসএসসি পর্যন্ত পড়িয়ে,এর প্রচারণা করে বেশ ভালো ইমেজ ক্রিয়েট করেছিলেন।আমার কিছু গুণ ছিলো,আমি মানুষকে খুব ভালো সান্ত্বনা দিতে পারি,কনভিন্স করতে পারি।পাপে ডুবে থাকা মানুষের দিনশেষে অনেক মানসিক যন্ত্রণা হয়।সেই যন্ত্রণা কাটানোর জন্য আমার টাইপ মানুষের খুব প্রয়োজন।পাপ কাজের জাস্টিফিকেশন করে রুপিনকে অভয় দিয়ে আমি কাছের মানুষ হয়ে গিয়েছিলাম।কিন্তু সত্য চাপা থাকে না।কার মাধ্যমে আমি এসেছি রুপিন জেনে যায়।আমাকে সেদিন প্রচন্ড মারধর করা হয়েছিলো,কিন্তু শেষমেষ রুপিন মেরে ফেলেনি।কারণ ঐতো,আমার মতো কাউকে পাবে না।আর আমার অনেক প্রচারণা হয়েছে তার ইমেজের জন্য,হুট করে মরে গেলে অনেক প্রশ্ন আসবে।তাই সে যাবিরের বাবা মোর্শেদকে মেরে ফেলে।সম্পত্তিও বাঁচলো,আর রুপিনের পার্সোনাল লাইফ নিয়েও কেউ ব্ল্যাকমেইল করার থাকলো।যদিও রুপিন বলেছিলো এটা তার প্রথম খুন,আমি সেটা বিশ্বাস করিনি।নারসিসিস্ট ছিলো প্রচন্ড রকমের।আমার বিশ্বাস ছোট বেলা থেকেই এসব করার অভ্যাস আছে।প্রথম বার খুন করলে কেমন লাগে আমি জানি।

ভিনা বিস্ময়ের শেষ থাকলো না।বাকশক্তি হারিয়ে ফেললো সব শুনে।

-- এখনি এই চাহনি দিও না।আরো অনেক কিছু আছে।
রুপিন নিয়মিত সাইকিয়াট্রিস্ট দেখাতো।হাই পাওয়ারের ঔষধ খাওয়া লাগতো।এইযে মরে গেলো কিডনি ড্যামেজ হয়ে। ঔষধ দিয়ে কয়দিন চলবে বলো।যাই হোক।রুপিন আমাকে রাখলো।তখন আমার বয়স উনিশ বিশ হবে আরকি।জানে না মারার জন্য আমি কৃতজ্ঞ থাকলাম রুপিনের প্রতি।কিন্তু মোর্শেদ মারা যাওয়ার পর একা হয়ে গেলাম।আগে নিজে গ্রামে কথা বলে টাকা পাঠাতাম।
এসব ঝামেলা হওয়ার পর বাসায় যোগাযোগ করা বন্ধ হয়ে গেলো।পরিবার বলতে আমার কেউ থাকলো না এক যাবির ছাড়া।আমি এক সময় রুপিনের সেক্রেটারি হলাম।তারা সব কর্ম আর অপকর্মের হিসাব আমার রাখতাম।বাইরের দুনিয়ায় মানুষের সাথে চলার জন্য শুদ্ধ বাংলা ইংলিশ শিখলাম। যাবির তখন বড় হয়েছে,টাকা নিতে আসতো।আমি কখনো ওকে বসিয়ে রাখতাম না।মায়া লাগতো।এই ভরা পৃথিবীতে এই ছোট ভাই ছাড়া কেউ নেই।তাও দেখা করা মানা ছিলো।সবসময় দেখা হতো না।

ভিনা এতক্ষণ চুপ করে ছিলো।প্রাণহীন কন্ঠে প্রশ্ন করে উঠলো-

-- সে মোর্শেদকে..মানে যাবিরের বাবাকে মেরেছে।তাহলে যাবির আর তার মাকে মারলো না কেন?কোনো বড় ব্যাপার তো ছিলো না।
-- আমি মারতে দেইনি।রুপিনের আধিপত্যের লোভ।আমি তাকে সম্পত্তি নিজের নামে করিয়ে নিতে বলি।সাহরা করেও দেন।সাহরা বেঁচেছিলেন শুধুমাত্র তার নির্লোভ স্বভাবের জন্য।মোর্শেদের মতো চতুর হলে অক্কা পেতেন আগেই।আর যাবির বেঁচেছিলো আমার জন্য।আমার চার বোন ছিলো,তাও কোনো যোগাযোগ রাখতে পারিনি।যাবিরকে স্নেহ করতাম।তাই এই জায়গায় রুপিন আর হাত দেয়নি।আমার যেমন রুপিনকে প্রয়োজন,রুপিনের ও আমাকে প্রয়োজন।গিভ এন্ড টেক সম্পর্ক। কিন্তু রুপিন যাবির আর ওর মাকে নিজের উপর ডিপেন্ডেন্ট করে রেখেছিলো।কোনো ভয় ছিলো না ওদের নিয়ে।

-- তার উইক পয়েন্ট শুধু তুমিই ছিলে?

তোহা অনেক জোরে হেসে উঠলো।হাসতে হাসতে চুল খোপা করে ভিনার কপালে টোকা দিলো।

-- উইক পয়েন্ট কী বুঝো?আমি তার প্রয়োজন ছিলাম।প্রয়োজনের বাইরে যে ভালোবাসার অনুভূতি হয়,সেটাকে উইক পয়েন্ট ধরা যেতে পারে।তোমাকে বলেছি না,কত মানুষের ভালোবাসা যে তুমি পেয়েছো,নিজেও জানো না।রুপিনের উইক পয়েন্ট যদি ধরতেই হয়,তাহলে সেটা ছিলো দুইজন মানুষ। তোমার বাবা আর তুমি।তোমার বাবা তো তোমার মা কে বিয়ে করেছিলো।রুপিন নিজে ব্যবস্থা করে দিয়েছিলো।কিন্তু রুপিন নিজে সংসার করতে পারে নাই।জুয়েলের পরকীয়া ছিলো হস্পিটালের এক নার্সের সাথে।কলহ আর কলহ!এরপর মাছি মারার মতো জুয়েলকেও মেরে ফেলেছিলো কার এক্সিডেন্টে।

-- তুমি জেনেও চুপ ছিলে?
-- আমার পরিবার কে চালাতো?তোমার বাবা?রুড হয়ে যাচ্ছি বেশি?কিন্তু এটাই সত্যি।কেউ কাউকে দেখে না।থাকতে হয় এভাবেই।আসল কথায় আসি।মুনার বাবা মারা যাওয়ার দিন তোমার বাবা আর মুনা রাতে আসেনি।সেদিন রুপিন এসেছিলো তোমার সাথে থাকতে।রুপিন শকুনের চোখ দিয়েই সেদিন তোমার যে সম্পর্ক আছে,সেটা টের পেয়েছিলো।বোকা মেয়ে তুমি,ইউজ করতে মার পুরোনো মোবাইল,লক ও ছিলো না।রুপিন সেদিন ই জানতে পারব তোমার আর যাবিরের সম্পর্কের কথা।এখন এই যাবির কোন যাবির সে শিওর ছিলো না।সে ভাবতেও পারেনি এতবড় পৃথিবীতে তুমি তার ভাগ্নের সাথে যেয়েই প্রেম করবে। তোমার বাবা তোমার নিখোঁজ হওয়ার খবর জানানোর পর সে খোঁজ নিয়ে জানতে পারে তুমি তার সোনার টুকরা ভাগ্নেকে বিয়ে করছো।সেদিন রুপিন যাবিরকে কী পরিমাণ অপমান করেছে ভাবতেও পারবে না।অন্য কোনো ছেলে হলে এই অপমানের পরে মেয়ের দিকে ফিরেও তাকাতো না।রুপিন যে কী ধুরন্ধর তুমি ভাবতেও পারবে না ভিনা।তাছাড়া যে অপমান করেছে,মুখে বললেও তোমার বিশ্বাস হতো না,আর এত ছোট কেউ নিজেকে করতে পারে না।তাও হজম করেছে।আমার ভাই তোমাকে প্রথমে রুপিনের ব্যাপারেও জানায়নি,বাসার ব্যাপারেও জানায়নি যেন শান্তিমতো পড়তে পারো।এরপর হাত টানাটানি শুরু হলে তোমাকে বাসায় পাঠায় গয়না দিয়ে।এরমধ্যে যে তোমরা ঝামেলা পাকিয়েছো সেটা তো আমি জানতাম না।পরে জানলাম তুমি প্রেগন্যান্ট।তোমার প্রেগন্যান্সির খবর শুনে আমি নিজে টাস্কি খেয়েছি।বাচ্চার খবর শুনে এক সপ্তাহর মধ্যে বিয়ের সিদ্ধান্ত নেয় যাবির।আগে নিজের মাকে জানায়।সাহরাকে আমি বোকা ভাবতাম,নির্ভেজাল ভাবতাম।ওমা!সব শুনে হা পিত্যেশ শুরু করলো।সেই কি কান্না।যাবির রুপিনকে জানানোর পর মিটিং বসলো।আমি,রুপিন,যাবির আর সাহরা।রুপিন বললো তোমাকে বিয়ে করে ওর পোষাবে না।ছেড়ে দিতে বললো।যাবির রাজি হলো না।অনেক্ষণ তর্ক বিতর্ক শুনলো।রুপিন পিন মারা কথা সাহরার সামনে যাবিরকে বললো।পুরো পরিস্থিতি আগুন।শেষে সালিশে ঠিক হয় রুপিন তোমার দায়িত্ব নিবে।যাবির চাকরি পেয়ে সংসার চালানোর লায়েক হলে তোমার সাথে বিয়ে দিয়ে দিবে।ছেলে ওখানেও বেঁকে বসলো।সে বিয়েই করবে।যাবির বিয়ের জন্য টাকা যোগাড় করা শুরু করলো,আবারো পারলো না।সাহরা মনে হয় দুনিয়ায় জন্মই হয়েছিলেন অসুস্থ থাকার জন্য।ডাক্তার হস্পিটাল দৌড়াদৌড়িতে যাবির শেষ। আর বললে না আমি কেন টাকা দিলাম না,দিতে পারিনি বলো।রুপিন আমার বেতনই হাতে দেয়নি তখন।আমি যদি যাবিরকে হেল্প করার চেষ্টা করতাম,বড় ঝামেলা লেগে যেত।রুপিন দুনিয়া থেকে বিদায় দিতো ওকে,ঝামেলা পছন্দ করতো না।খুব সাবধানে থাকতে হয়েছে আমাকে।যাবিরের নিজের অবস্থা তখন খারাপ,তাও বিয়ে করতে চেয়েছে।কিন্তু রুপিন ওর কাছে ইমোশনাল সব কথাবার্তা বলেছে।ও ভেবেছে রুপিন তোমার ফুপু হয়।তার কাছে তুমি আর বাচ্চা থাকলে অন্তত যত্ন আত্তি আর ডেলিভারিতে সমস্যা হবে না।তাছাড়া রুপিন বাইরের না,তোমার ফুপুই ছিলো।যাবির রুপিনের কোনো অপকর্ম সম্পর্কে জানতো না।বেশির ভাগ মামি সম্প্রদায় কেমন হয় তোমার হয়ত জানা আছে।যাবির ভেবেছে মামি দেখেই যাবিরের সাথে এমন বৈরি আচরণ, তোমাকে সে সত্যিই ভালোবাসতো এবং এটা সত্যিও।যাবির তোমাকে নিয়ে সব জানাতে চেয়েছিলো।বাট খেয়াল করে দেখো।তুমি আনম্যারিড হয়ে একজনের আনওয়ান্টেড বাচ্চা ক্যারি করছো।তার সাথে তোমার যোগাযোগ আছে,সে তোমাকে বিয়েও করতে চায়।এসব জানা সত্ত্বেও কি তুমি অন্যের বাসায় নিজের অবৈধ বাচ্চা জন্ম দিতে যেতে।স্যরি ফর মাই ওয়ার্ডস, কিন্তু যার মধ্যে এতটুকু লজ্জা আছে,সে এটা করতো না।যাবিরের কাছে বিয়ে ছাড়া অনেক ভালো সেকেন্ড অপশন ছিলো দেখে ঐটাই চুজ করেছে।অপশন না দিলে তোমাকে ঠিকি বিয়ে করতো।

ভিনা ফুপিয়ে উঠলো-

-- সেটাই কি ভালো হতো না?

-- না হতো না।তোমার জন্য হতো না।কারণ যাবির আর বেঁচেই থাকতো না।

-- মানে?
-- রুপিন কখনো চায়নি তুমি আর যাবির এক হও।যাবিরকে বিয়ে করা মানে রুপিনের আসল রূপের একাংশ জানা প্লাস সম্পত্তি নিয়ে ইন্সিকিউরিটি। তাই সে প্রথমে শুধু তোমার বাচ্চার দায়িত্ব নেয়।পরে ভেবে দেখে বাচ্চা থাকলেই তোমরা এক হয়ে যাবা,তাই বিদেশ পালানোর চিন্তা করে।সমস্যা তখনই বাধে।বাচ্চা এ্যবোরশন এর কথা বলেছি কারণ বাচ্চাটা সত্যিই বাইরে নিয়ে গেলে তুমি পাগল হয়ে যেতা স্ট্রেইট।আর এই বাচ্চার দায়িত্ব নেয়ার অজুহাতে সে তোমার এবং তোমার বাবার কাছে ফেরেশতা হয়ে যেত।এই বাচ্চা তার কাছে জ্যাকপট ছিলো তোমার বাবার মন জেতার জন্য।তুমি আর যাবির বিয়ে করলেও সে যাবিরকে সড়িয়ে এই বাচ্চার দায়িত্ব নিতো।কারণ সে নিজের স্বার্থ ভালো বুঝে।আমি খুবই ক্রুয়েল পরিবেশে জীবনের বেশিরভাগ সময় কাটিয়েছি,তাই ইমোশন আমার মধ্যে খুব কম।অবশ্য পরে আমিই তোমার বাচ্চা যেন তোমার কাছে ফিরে যায় সে চেষ্টা করেছি।যাই হোক আমি জানি তুমি যাবিরের থেকে একি কথাই শুনেছো।আমি আবার সেগুলো রিপিট করলাম নিজের সিচুয়েশন বোঝানোর জন্য।এখন তোমার বিয়ের আয়োজন চলছে,তুমি বিয়ে করে ফেলো।

ভিনা চোখ মুছে বড় করে নিঃশ্বাস ফেলে সরাসরি তীক্ষ্ণভাবে তোহার দিকে তাকালো।

-- তুমি এখনো সবকিছু বলোনি।আমি জানি আর সাড়ে চার ঘন্টা পর তোমার ফ্লাইট।আর আধা ঘন্টা।আমি তোমাকে আর কখনো পাবো না আমি বুঝে গেছি।আমাকে সব বলে যাও।

তোহা বিছানা ছেড়ে জানালার পাশে যেয়ে দাঁড়ালো।বন্ধ জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে কথা শুরু করলো।

-- জুয়েল চৌধুরীকে মারার পর রুপিন একদম একা হয়ে গিয়েছিলেন।মানুষ জীবনে সব সহ্য করতে পারে,একাকীত্ব সহ্য করতে পারে না।তোমার মা এবং বাবার বন্ডিং খুব ভালো ছিলো।হাজবেন্ড হিসেবে তোমার বাবার তুলনা হয়না।অসম্ভব কেয়ারিং ছিলেন।মধ্যবয়সী রুপিন তার প্রেমে পরলেন।তখন তার নিজের বাচ্চা নেয়ার সুযোগ ছিলো না,হাই ডোজের ঔষধ খেতেন।হয়ত তোমার বাবার প্রতি প্রেম থেকে তোমাকে অনেক ভালোবাসতেন।তোমার বাচ্চার দায়িত্ব ও নিতে চেয়েছিলেন তোমার বাবার মন পাওয়ার জন্য।সত্যি বলতে তোমার প্রতি ভালোবাসায় তার কোনো খাঁদ ছিলো না।একদিন রুপিন ড্রিংক করতে করতে কান্না করে বললো,তোমার বাবাকে বিয়ে করতে চায়।আজকে তার সাথেই রুপিনের সংসার হওয়ার কথা ছিলো।তিনি নিজের জিনিস অন্যকে দিয়ে দিয়েছেন এসব এসব।আমি পাত্তা দেইনি।পরদিন আমাকে বললো তোমার মাকে মেরে ফেলবে।আমি মানা করলাম,মা*র জিদ আরো বাড়লো।আমাকে নিয়ে তোমার মার বাসায় গেলো এবং....আমাকে দিয়েই তোমার মাকে খুন করালো।আমি চাইনি বিশ্বাস করো।রুপিন সামনে দাঁড়ানো ছিলো,আমি শুধু বালিশ চাপা দিয়েছিলাম।আমি খুব হালকাভাবেই দিচ্ছিলাম যেন তোমার মা সার্ভাইভ করে।আমি জানতাম না তোমার মা হার্টের প্যাশেন্ট ছিলো। আমি ভেবেছিলাম রুপিন হয়ত রুম থেকে চলে যাবে,আমি বালিশ ফেলে দিবো।কিন্তু সে পাক্কা বিশ মিনিট ওখানেই দাঁড়িয়ে ছিলো।আমি পারিনি আর কিছু করতে।আজ থেকে দশ বছর আগের কথা,আমার বয়স মাত্র বাইশ ছিলো।আজকের মতো এতটা কঠিন হইনি আমি।আমি পারিনি রুপিনকে ঠেকাতে।কিন্তু পরবর্তী জীবনে আমি প্রায়শ্চিত্তের চেষ্টা করেছি অন্তত।রুপিন এত জলদি মরতো না,তোমার কথা ভেবে ওষুধের ডোজ বাড়িয়ে দিয়েছিলাম।কিন্তু তোমার ভাগ্য কত ভালো ভিনা।মানুষ,অমানুষ সবার ভালোবাসা পেয়েছো।রুপিন মারা যাওয়ার আগেও তোমার নামে সম্পত্তি লিখে দিয়ে গেছে,সেই সম্পত্তি যার এত লোভ ছিলো তার।আমি জানি এই সম্পত্তি তুমি ঠিকভাবেই কাজে লাগাবে।

ভিনা বাকরুদ্ধ হয়ে গেলো।আজ থেকে ছয়বছর আগের স্বপ্নের কথা মনে পরে গেলো।রক্তের পুকুর,মাঝখানে নৌকায় ভিনা বসা,ওর মার বুকে কেউ ছুড়ি বসিয়ে দিচ্ছে।

ভিনা বাকরুদ্ধ হয়ে গেলো।প্রচন্ড রাগে গা থরথর করে কাঁপছিলো।উত্তেজনায় এক পর্যায়ে জ্ঞান হারালো।ততক্ষণে তোহা চলে গেছে।এই তোহাকে আর পাওয়া যাবে না।ভিনা জানে না ওর সাধারণ জীবনে যত নারীই এসেছে,সবার জীবন কেন এত কষ্ট এবং যন্ত্রণা।তোহা এমন সময়ে সব স্বীকার করলো যখন রুপিন মারা গেছে,আর নিজেও হারিয়ে গেছে।কী হবে এই স্বীকারোক্তি দিয়ে?ভিনা পাথর হয়ে বসে থাকলো খালি ফ্ল্যাটে।মানুষ ভালোবাসার জন্য হাহাকার করে,আর ওর কপালে ভালোবাসা কাল হয়ে এসেছে।
.
.
.
চলবে.........................................................................

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

WhatsApp