কনফিউশন - পর্ব ৩৩ - মৌরি মরিয়ম - ধারাবাহিক গল্প


তিরার এই বেহাল অবস্থাতেও আরশি তার কাছে যেতে পারছিল না পরীক্ষার জন্য। পরীক্ষা শেষ হতেই চলে গেল। নিজের চোখে তিরার এই অবস্থা দেখে আরশি আর সহ্য করতে পারল না। সাথে সাথেই কল করল যাদিদকে। এর আগে যাদিদের সাথে কখনো ফোনে কথা বলার প্রয়োজন পড়েনি। তাই যাদিদ আরশির নাম্বারটাও চেনে না। ফোন ধরে কিছুটা চমকে গেল সে যখন আরশি নিজের পরিচয় দিল। যাদিদ আরশির ফোন একেবারেই আশা করেনি।
"ভাইয়া আমার আপনার সাথে কিছু কথা ছিল।"
"বলো।"
"আমি আপনাকে অনুরোধ করছি ভাইয়া তিরাকে এভাবে কষ্ট দেবেন না। এই কষ্ট ওর সহ্যক্ষমতার বাইরে।"
"আরশি আমি আমার ব্যক্তিগত ব্যাপারে কথা বলার অধিকার আমার মাকেও দেইনা।"
এ কথার পর আর কিছু বলা কোনো সুস্থ স্বাভাবিক মানুষের পক্ষে বলা সম্ভব না। আরশিও পারল না। খুব রাগ হলো তার। তিরাকে বলল,
"তুই এই একগুঁয়ে লোকটাকে ডিভোর্স দিয়ে দে।"
তিরা অবাক হয়ে বলল,
"কী বলছিস তুই? এসব কথা মুখেও আনবিনা।"
"কেন? যে তিরা খুব ছোট ছোট কারণে দুনিয়ার পাগল প্রেমিকদের ছেড়েছে সে এতকিছু হয়ে যাওয়ার পরেও একটা একগুঁয়ে দায়িত্বজ্ঞানহীন লোককে ছাড়তে পারবে না?"
"প্রেমিক আর স্বামী এক না। তুই বুঝবিনা।"
"আল্লাহ যেন কখনো আমাকে এসব না বোঝায়। তবে তোর জায়গায় থাকলে আমি অবশ্যই ডিভোর্স দিতাম। এবং আরো অনেক আগে।"
"ভালোবাসলে পারতি না। এত সোজা না।"
"ভালোবাসা আত্মসম্মানের থেকে বড় না তিরা।"
"যাদিদের বাচ্চা আমার পেটে আরশি।"
"যে বাবা বাচ্চার প্রতি এমন অন্যায় করতে পারে সেই বাবাকে কোনো দরকার নেই এই বাচ্চার। ওকে তুই নিজেই মানুষ করবি।"
"আমি পারব না।"
"তাহলে কী করতে চাস তুই?"
"আমি এ বাড়িতেই থাকব। বাবা মা আমার অনেক খেয়াল রাখে। আমি তাদের সাথেই থাকব। এই ঘরে যাদিদের সাথে অনেক স্মৃতি, প্রত্যেকটা কোণায় কোণায় যাদিদের স্পর্শ। এই ঘরেই থাকব। এখানেই বাচ্চা জন্মাবে, এখানেই বড় হবে। কতদিন ফিরবে না যাদিদ? কতমাস? কতবছর? যেদিনই হোক একদিন তো ফিরবে? অবশ্যই ফিরবে। না ফিরলে ডিভোর্স দিয়ে দিত।"
আর কিছুই বলল না আরশি। পুরো ছুটি তিরার সাথে কাটিয়ে ঢাকায় ফিরে গেল।

এভাবেই কেটে গেল আরো কয়েক মাস। তিরা ও বাচ্চা মোটামুটি সুস্থ্যই আছে। প্রেগন্যান্সির ৭ মাস চলছে। একদিন হঠাৎ করেই রেহানা আলমের মাথায় একটা বুদ্ধি এলো। সে লুকিয়ে তিরার কিছু ভিডিও করলো। যাতে তিরা কিছু টের না পায়। খুব সাধারন ভিডিও। এই যেমন তিরা খাচ্ছে, ঘুমাচ্ছে, পেট ধরে হাঁটছে এইসব। তারপর তা পাঠিয়ে দিল যাদিদকে। ভিডিওগুলো দেখে যাদিদের মধ্যে কী যেন হয়ে গেল। অস্থির লাগছে তার, খুব অস্থির। তিরা অনেক মোটা হয়ে গেছে, তার চোখের নিচে কালি পড়েছে, বিদ্ধস্ত চেহারা। সেই চোখ ধাঁধানো সৌন্দর্যের কিছুই অবশিষ্ট নেই। যাদিদ বারবার ভিডিওগুলো প্লে করে তিরার পেট দেখছিল। অস্থির ভাবে পায়চারি করছিল। ইচ্ছে করছে এক্ষুণি তিরার কাছে ছুটে যেতে। কিন্তু এই মুহুর্তে ছুটি মিলবে কি? ছুটি তার পাওনা আছে তবে হুট করেই ছুটি পাবে না জানে সে! অস্থিরতায় হাত পা কাঁপতে লাগলো! 

ছেলেকে ভিডিও পাঠিয়ে রেহানা বেশ নিশ্চিন্তে ছিলেন। একরকম ধরেই নিয়েছিলেন যাদিদ যেভাবেই হোক আসবে। কিন্তু পুরো একটি সপ্তাহ পার হয়ে গেলেও যখন সে আসলো না তখন রেহানার মন খারাপ হয়ে গেল। এখন মনে হচ্ছে এই ছেলেকে এত তাড়াতাড়ি বিয়ে করানোই ভুল হয়েছে। ছেলে বয়সে এবং হাতে-পায়ে বড় হয়েছে কিন্তু বিয়ের উপযুক্ত হয়নি। যাদিদ এখনই বিয়ে করতে চাইছিল না, সেই শখ করে বিয়ে দিয়ে সর্বনাশ ডেকে এনেছেন!

তিরা সকালবেলা দাঁত ব্রাশ করে বাথরুম থেকে বের হয়ে চমকে গেল। যাদিদ দাঁড়িয়ে আছে তার সামনে। ভাবলেশহীন মুখে তাকিয়ে আছে তার দিকে। তিরা কয়েক সেকেন্ড যেতেই আবার বাথরুমে ঢুকে দরজা বন্ধ করে দিল। যাদিদ ভ্রু কুঁচকে তাকিয়ে রইল, এটা কী হলো!

;;;;;;

তিরা বাথরুমের দরজা লাগিয়ে কাঁদতে শুরু করেছে। থরথর করে কাঁপছে সে। ওদিকে যাদিদ কিছুক্ষণ অপেক্ষা করার পর দরজায় টোকা দিল,
"তিরা.. বেরিয়ে এসো।"
তিরা কোনো জবাব দিল না। যাদিদ আরো কিছুক্ষণ অপেক্ষা করার পর বাথরুমের লকের চাবি খুঁজতে লাগলো। চাবি খুঁজে না পেয়ে যাদিদ আবার দরজায় টোকা দিয়ে বলল,
"দরজা খোলো তিরা, নাহয় দরজা ভেঙে ফেলব।"
এবারো তিরা দরজা খুলল না। কোনো জবাবও দিল না। এবার যাদিদ রাগে ফেটে পড়ল। দরজায় ধাক্কা দিয়ে দরজা ভাঙার চেষ্টা করতে লাগলো। শব্দ শুনে রেহানা চলে এলেন। ছেলেকে এই অবস্থায় দেখে বললেন,
"তোর কি মাথা খারাপ হয়েছে যাদিদ? একে তো এতদিন ধরে ওকে কষ্ট দিলি তার উপর এখন আবার জেদ দেখাচ্ছিস! ওর যখন ইচ্ছা বের হবে।"
"মা তিরা অনেকক্ষণ ধরে বাথরুমে। এতবার ডেকেছি কোনো সাড়া দেয়নি। যদি আগেরবারের মত অজ্ঞান হয়ে যায়? ফর গড সেক তোমার কাছে চাবি থাকলে দাও, নাহয় আমি দরজা ভেঙে ফেলব।"
এ কথা শুনে রেহানারও চিন্তা হতে লাগলো। সে বলল,
"এ ঘরের সব চাবি তো আমি তিরাকে বুঝিয়ে দিয়েছি। আমার কাছে নেই।"
রেহানা চাবি খুঁজতে লাগলেন। ওদিকে যাদিদ আবার দরজায় ধাক্কা দিতে লাগলো। দরজা যখন কিছুটা আলগা হলো তখন ভেতরে একটা শব্দ হলো। যাদিদ রেহানা সবাই শব্দ শুনে চমকে গেল। যাদিদ আরো জোরে ধাক্কা দিলো। কয়েক সেকেন্ডের মধ্যেই দরজা ভেঙে গেল। যাদিদ দেখল তিরা বাথরুমের জানালার গ্রিলের সাথে গলায় ওড়না পেঁচিয়ে ঝুলে আছে। যেহেতু ওদের বাথরুমের উচ্চতা ঘরের মতই ১০ ফুট উঁচু তাই এটা সম্ভব হয়েছে। তিরা বালতি উল্টো করে তার উপর উঠে গলায় ওড়না পেঁচিয়ে বালতিটা লাথি মেরে ফেলে দিয়েছে। যাদিদ দৌড়ে গিয়ে তিরাকে কোলে নিয়ে গলা থেকে ওড়না খুলে তাকে ঘরে এনে বিছানায় বসালো। 
রেহানা চিৎকার করে বললেন,
"এ কি করছিলি মা। কেন করছিলি?"
তিরা কিছুক্ষণ কাশলো। তার চোখে পানি। যাদিদ হঠাৎ করেই প্রচন্ড এক চড় বসালো তিরার গালে। রাগান্বিত স্বরে বলল,
"মরার এত শখ? এতদিন মরতে পারলি না? আজকে আমাকে দেখে মরতে ইচ্ছে করল?"
তিরা এবার শব্দ করে কাঁদতে লাগলো। রেহানা ছেলেকে ধমকে বলল,
"যাদিদ তোর সাহস তো কম না!"
যাদিদ মায়ের দিকে ফিরে বলল,
"মা প্লিজ তুমি তোমার ঘরে যাও। আমাদেরকে কথা বলতে দাও।"
রেহানা কি করবেন বুঝতে পারছিলেন না। ছেলেকে এত রাগান্বিত অবস্থায় তিরার কাছে একা রেখে যেতে সাহস হচ্ছেনা। কিন্তু যাদিদ এমনভাবে বলছে এখানে থাকাও সম্ভব না। যাদিদ আবার বলল,
"মা প্লিজ।"
রেহানা ঘর থেকে বের হতেই যাদিদ দরজা লাগিয়ে দিল। রেহানার এত ভয় করছিল যে তিনি দরজার পাশেই দাঁড়িয়ে রইলেন। যাদিদ তিরার সামনে দাঁড়িয়ে বলল,
"কী সমস্যা তোমার?"
তিরা কাঁদছে, কোনো কথা বলছে না। যাদিদ এবার আরো রেগে গিয়ে বলল,
"আমাকে দেখেই মরতে ইচ্ছে হলো! তা তোমার সমস্যা যদি আমি হই তাহলে পাগলের মত দিনরাত ফোন করতে কেন আমাকে? এত চিঠি লিখতে কেন? কেন বারবার আসতে বলতে?"
রাগে সারা শরীর কাঁপছে যাদিদের। তিরা চোখ মুছে উঠে গেল তার সামনে থেকে। দরজা খুলে ডাইনিং এ গিয়ে নাস্তা করতে বসলো। রেহানা তিরার কাছে গিয়ে বলল,
"মা আর কিছু দেব?"
"আপেলের জুস খাব মা।"
"এক্ষুণি বানিয়ে দিচ্ছি।"
যাদিদ দরজায় দাঁড়িয়ে এতক্ষণ সবকিছু দেখছিল। এবার ঘরে গিয়ে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে দুহাতে মাথা ধরে বসে রইলো। তিরা নাস্তা খেয়ে রান্নাঘরে এসে ঢুকলো। এটা ওটা করার বাহানায় রান্নাঘরেই রইলো। রেহানা বললেন,
"ঘরে যাও তিরা। যাদিদ অপেক্ষা করছে।"
"আমি ওর সামনে যেতে পারব না মা।"
"কেন?"
"ও রেগে আছে। আর আমিও কোনো কথা খুঁজে পাচ্ছি না।"
"ও এতদিন যেমন অপরাধ করেছে। আজ তুমিও একটা ভয়ঙ্কর অপরাধ করেছ। ওর রেগে যাওয়া স্বাভাবিক। কিন্তু তুমি ঘরে যাও কিছু হবে না। ও এতদিন পর এসেছে তোমার দূরে থাকা ঠিক হবে না।"
তিরা ঘরে গেল। তিরাকে ঘরে ঢুকতে দেখে সাথে সাথেই যাদিদ কাপড় পালটে ঘর থেকে বের হয়ে গেল। 

যাদিদ ড্রয়িং রুমে চুপচাপ বসে আছে। রেহানা এসে পাশে বসতেই যাদিদ বলল,
"বাবা কোথায় মা?"
"তুই আসার একটু আগেই অফিসে গেল।"
"এত তাড়াতাড়ি অফিস?"
"আজ একটু আগে বেরিয়েছে। হয়তো অফিসের আগে কোনো কাজ আছে।"
"বাবা কি সব জানে মা?"
"কোন সব?"
"তিরা ওর পাস্ট সম্পর্কে তোমাকে যা বলেছে সেসব।"
"না তোর বাবাকে এসব কেন বলতে যাব?"
"মা তুমি কি জানো তুমি খুব ভালো একটা মানুষ?"
রেহানা হেসে বললেন,
"তিরার কাছে যা।"
"নাহ আমার মনে হয় এখন ওর সামনে না যাওয়াই ভাল। মাথা অনেক গরম হয়ে আছে। শেষে রাগের মাথায় এমন কিছু বলে ফেলব বা করে ফেলব যেটা আরো খারাপ হবে।"
রেহানা ছেলের মাথায় হাত বুলিয়ে বললেন,
"কিছুই হবে না। তুই ঘরে যা, একবার ওর পেটের দিকে তাকা। চিন্তা কর সেখানে কে আছে। ফুটফুটে একটা মেয়ের মুখ দেখতে পাবি। দেখবি মাথা ঠান্ডা হয়ে গেছে।"
যাদিদ চমকে গিয়ে বলল,
"মেয়ে হবে?"
রেহানা হেসে বলল,
"হ্যাঁ।"
যাদিদ চুপ। তবে ভেতরে ভেতরে একটা অস্থিরতা হচ্ছে। রেহানা বললেন,
"এতকিছু করেও তোকে আনতে পারলাম না। আর তিরার পেট দেখাতেই চলে এলি। নিজের সন্তান এমনই হয়।"
যাদিদ একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল,
"শুধু এজন্য আসিনি।"
"তাহলে?"
"তিরার এই বিদ্ধস্ত অবস্থা দেখে মায়া লাগছিল। এতদিনের রাগ যে কোথায় গেল!"
রেহানা হাসলো। যাদিদ বলল,
"মা আমি কি চলে যাব?"
"এ আবার কেমন কথা? চলে চাবি কেন? কয়দিনের ছুটি?"
"এক মাসের ছুটি নিয়ে এসেছিলাম।"
"দারুণ! এক মাসের ছুটি! শুনলে তিরা পাগল হয়ে যাবে খুশিতে।"
"তিরা আমাকে দেখেই যা করল তা তো দেখলেই। আমি চোখের সামনে থাকলে যদি আবারও কোনো অঘটন ঘটিয়ে ফেলে?"
"তিরা কেন এমন কাজ করতে যাচ্ছিল আমি জানিনা। কিন্তু ৭ টা মাস বাচ্চা পেটে নিয়ে স্বামীর উপেক্ষা সহ্য করা অনেক কঠিন কাজ বাবা। একটু রাগ একটু অভিমান তো ওর হতেই পারে।"
"তাই বলে মরতে যাবে? আমি এসেছি, আমার সাথে ঝগড়া করতো। রাগ করে কথা না বলত। কিংবা অন্যকোনো ভাবে রাগ দেখাতো। মরতে কেন গেল? মরে গেলে ওর এই রাগ-অভিমানের কী দাম থাকতো?"
"ঘরে যা বাবা। তিরার সাথে কথা বল। সব মিটে যাবে দেখিস। তোকে অনেক বেশি ভালোবাসে মেয়েটা। আমি নিজের চোখে দেখেছি।"

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন