আলিয়া ভাইয়ার মুখে শ্রাবণের সাথে ঘটে যাওয়া ঘটনা শুনে হতবিহবল হয়ে গেল।সে সোফায় ধপ করে বসে পড়ে। হুট করে এক ঝাক মন খারাপে রা এসে তাকে ঘিরে ধরল। শ্রাবণের জন্য তার কষ্ট হচ্ছে খুব। ছেলেটার জন্য মায়া হচ্ছে, করুণা হচ্ছে আলিয়ার৷
আলিয়া মনে মনে ভাবছে, শ্রাবণের পরিবারের সদস্যরা কোথায়?ওর বাবা-মা, ভাই-বোন কোথায়? কেউ কি তার খোজ রাখে নি? পাগল জন্য দূর দূর করে তাড়িয়ে দিয়েছে? পাগল রা নাকি পরিবারের বোঝা হয়। পাগলদেরকে নাকি স্বজনরা দূরে নিয়ে গিয়ে ফেলে দিয়ে চলে আসে। এসব লোকমুখে শুনে এসেছে। সবাই তো এক নয়। আলিয়ার চোখে বারবার শ্রাবণের চেহারা ভেসে আসছে।
তার চোখ ছলছল করে উঠে।
আলিয়া নিজেও জানে না কেন তার শ্রাবণের জন্য খারাপ লাগছে? কেন? খারাপ লাগার পেছনে কি কোন অদৃশ্য মায়াজাল আছে?
হুট করে হাতে কারো স্পর্শ পেল আলিয়া। চোখ তুলে তাকিয়ে দেখে আয়ান তার হাত ধরেছে৷
আলিয়া ভ্রু কুচকে আয়ানের দিকে তাকালো। আয়ান তাকে আশস্ত দিয়ে বলে, সর্যি আলিয়া। হুট করে কোথা থেকে কোন পাগল এসে কিসব বললো আর আমি রেগে গেলাম। আই এম এক্সট্রেমলি সর্যি।
আলিয়া অদ্ভুত ক্রোধ নয়নে আয়ানের দিকে তাকিয়ে রইল।
আয়ান কথা না বাড়িয়ে আলিয়ার হাতে রিং পড়িয়ে দিল। আলিয়া চমকে উঠে। কিছু সময় আগেও রিং পড়া নিয়ে সে খুব উত্তেজিত ছিল কিন্তু এখন আঙুলে রিংটাকে দেখেই তার মনে হচ্ছে লোহার শিকল।
হুট করে তার মনোভাব কেন পরিবর্তন হলো সে জানে না। কিছুক্ষন আগেও সে খুশি ছিল৷ কিন্তু এখন সে বিরক্ত।বেশ বিরক্ত। বিরক্তির মাত্রা চক্রবৃদ্ধি হাতে বেড়েই চলেছে।
আলিয়া হাতের রিংটার দিকে তাকিয়ে উসখুস করতে লাগলো। মনে হচ্ছে এই মূহুর্তে রিংটা ছুড়ে ফেললে সে কিছুটা শান্তি পেত। এ যেন অলংকার নয় বরং তার কাছে এক টুকরো আগুনের ফুলকা।
আয়ান গলার স্বর আরো একটু উচু করে বলে, আমার মায়ের পক্ষ থেকেও আমি ক্ষমাপ্রার্থী। এভাবে হুটহাট করে রেগে গিয়ে আলিয়াকে কথা শুনানো উচিত হয় নি আমাদের৷। আসলে ছেলেটাকে কেউ দেখলে বলবেই না ও পাগল!
ছেলেটা পাগল শুনতেই আলিয়ার গা কেমন করে উঠে। আচ্ছা আয়ান এভাবে সোজাসাপটা পাগল না বললেও তো পারত! কি হত যদি বলত ছেলেটা অসুস্থ। মুখের ভাষাও অনেক কিছু বুঝিয়ে দেয়। আলিয়ার এই মূহুর্তে আয়ানকে কড়া কিছু কথা শোনাতে মন চাচ্ছে কিন্তু তার এতো সাহস নেই। তাই চুপচাপ নিরব শ্রোতা হয়ে বসে রইল। মনে হাজারো চিন্তা ঘুরপাক খাচ্ছে তার।
আলিয়ার আব্বু আয়ানের কথায় স্মিত হেসে বলে, এক পলকের জন্য আমি ও ছেলেটার কথা শুনে হতভম্ব হয়ে গিয়েছিলাম। ওর কথা বিশ্বাস করতে বাধ্য হচ্ছিলাম।তোমার দোষ নেই বাবা।
আয়ান হালকা হাসল। অনুষ্ঠান শেষের দিকে। খাওয়ার পর্ব শুরু হলো। আয়ানকে বেশ যত্ন নিয়ে খাওয়ানো হলো। আলিয়া পুরোটা সময় বরফের মতো জমে গুটিসুটি মেরে সোফায় বসে থাকে। তার চোখের সামনে শ্রাবণের মাটি খাওয়ার দৃশ্যটা ভেসে উঠল। আচ্ছা ছেলেটা কি ক্ষুধার্ত? খিদে পেয়েছে কি ওর?
এমন চিন্তা মাথায় আসতেই আলিয়া সটাং করে দাঁড়িয়ে গিয়ে প্রায় দৌড়ে সদর দরজা অতিক্রম করল। শ্রাবণ যেই জায়গায় বসে ছিল সেখানটায় গেল। কিন্তু শ্রাবণ নেই।
আলিয়া সুক্ষ্ম ভাবে লক্ষ করল, শ্রাবণ যেখানটায় বসে ছিল তার চারিপাশে ধুলাবালি। বালিতে হাতের আঙুল দিয়ে কিছু লেখা।
আলিয়া ঝুকে লেখাটা পড়তে লাগে। অসুন্দর হাতের লেখা। তাও সে কষ্ট করে পড়লো,
'প্রেম ছেড়ে যায় প্রিয়, ভালোবাসা না!'
আলিয়া আরেকদফা চকমে উঠে। এইটা শ্রাবণ লিখেছে? এর সারমর্ম কি শ্রাবণ জানে? নাকি কারো কাছে শুনে লিখেছে।
বাসার ভেতর।থেকে আলিয়া কে ডাকা হচ্ছে। আলিয়া আর এক দন্ড থামতে পারল না। পেছন ঘুরে বাসায় ঢুকতে লাগলো। বাসায় আসার পথে অনেকটা আশা নিয়ে সে পেছনে ঘুরে তাকায়। যদি শ্রাবণকে দেখতে পায়। কিন্তু না। শ্রাবণ তাদের বাসার ধারে কাছেও নেই। আলিয়া বাসায় ঢুকে পড়ে।
বিকেলের পর পর আয়ানরা চলে যায়। আয়ানরা যাওয়ার পর আলিয়া তার রুমে আসে এবং ফ্রেস হয়ে নেয়।
তারপর বারান্দায় গিয়ে দাড়ালো। বারান্দায় ঠান্ডা হাওয়া বইছে। আযান পড়ে গেছে। পাখিরা নীড়ে ফিরছে। আকাশে হালকা হলদে আভা বিরাজ করছে। সূর্য আগেই ঢলে পড়েছে। কাজেই আকাশের দিকে তাকালো যাচ্ছে। আজকের আকাশটা খুব সুন্দর! চারিপাশে হলদুরের একটা আবরণ সৃষ্টি হয়ে এক মনোমুগ্ধকর পরিবেশের আগমন ঘটেছে কিন্তু ঠান্ডা খুব । শৈত্যপ্রবাহ চলছে।
আলিয়া আকাশের দিকে তাকিয়ে বিড়বিড় করে বলে, প্রেম চলে যায় প্রিয় কিন্তু ভালোবাসা না এর মানে কি?
রসায়নের ভাষায় এর ব্যাখাটা আলিয়া মনে হয় জানে। কোন বিক্রিয়া শেষে উৎপাদে যেমন একটা হাইড্রোজেন কখনো থাকবে না। গ্যাস আকারে উড়ে যাবে তাহলে কি এটা প্রেম? যেখানে একজনের মন থাকে! ভালোবাসা মানে হলো সামহাউ দুইটা হাইড্রোজেন মিলে এইচ টু হয়ে স্থিতিশীল আকারে,,,, উৎপাদ আকারে রয়ে গেল।ভালোবাসায় দুজনের দুটো মন একসাথে থাকে জন্য তা উবে যায় না। ব্যাপার টা কি কিছুটা এমন? জানে না আলিয়া। আর সে জনতেও চায় না।
বিকেল গড়িয়ে রাত হয়ে গেল৷ আলিয়া রুমে চুপচাপ বসে আছে। কিছুই ভালো লাগছে না তার। সত্য বলতে অস্থির লাগছে তার। হাসফাস লাগছে। সর্বক্ষন সে শ্রাবণ কে নিয়েই ভাবছে। শ্রাবণ কে সে দুই মাস আগে চিনেছে। এই দুই মাসে একবারো শ্রাবণের কথা আলিয়ার মাথায় আসে নি।
★★★
আরহান তার রুমে বসে আছে। সেও চিন্তিত। মূলত এর কারন শ্রাবণ। হুট করে এতো বছর পর শ্রাবণ আসল কোথা থেকে? আর শ্রাবণ তাদের বাসা কিভাবে চিনল? আলিয়াকে কিভাবে চিনল? আরহান যতোদূর জানে শ্রাবণের গ্রামের বাড়ি কুষ্টিয়া তে। এতো দিন কি শ্রাবণ কুষ্টিয়া ছিল?
শ্রাবণের সাথে কি হয়েছিল সেটা অজানা আরহানের। তবে সে বুঝতে পারছে খুব খারাপ কিছুই ঘটেছিল বোধহয়। শ্রাবণ যে আলিয়াকে পছন্দ করত এটা কেবল সে আর শ্রাবণ জানে। আলিয়া এ ব্যাপারে কিছু ই জানে না। দুইমাস আগে হুট করে রাস্তায় শ্রাবণের সাথে দেখা হয় তার। সেই দিন আলিয়াও আরহানের সাথে ছিল বিধায় আলিয়ার সাথেও শ্রাবণের দেখা হয়। বসুন্ধরা শপিং মলের সামনে দেখা। শ্রাবণ আরহানকে দেখে হাসছিল। আরহানের তখনই সন্দেহ হয়।এতো বছর পর শ্রাবণকে দেখে জড়িয়ে ধরে আরহান কিন্তু কোন প্রতিক্রিয়া দেখায় না শ্রাবণ। শ্রাবণ কে বেশ কিছু প্রশ্ন করে আরহান। কিন্তু শ্রাবণ একটা প্রশ্নেরও উত্তর না দিয়ে আলিয়ার দিকে এক ধ্যানে চেয়ে থেকে বিড়বিড় করতে থাকে৷
আলিয়া অস্বস্তিতে পড়ে যায়। এরপর শ্রাবণ হুট করে কোথাও দৌড়ে চলে যায়। আর দেখা হয় নি। আজকে এভাবে শ্রাবণ আচমকা তাদের বাসা এসে গন্ডগোল বাধিয়ে দিয়ে গেল।
রাতের দিকে আলিয়ার ঘুম ভেঙে যায়। তখন প্রায় সাড়ে বারোটা বাজে। আগে আগে ঘুমিয়ে পড়া আলিয়ার স্বভাব। সে বেশি রাত জাগতে পারেনা। ঘুম ভাঙ্গার পর বিছানায় কিছুক্ষন গড়াগড়ি খেল আলিয়া। ঘুম আসার কোন লক্ষন নেই। উপায় না পেয়ে উঠে পড়ল সে।
বাথরুমে গিয়ে মুখে চোখে পানি দিল আলিয়া। তারপর এক গ্লাস পানি খেল। তাও কেমন অস্থির অস্থির লাগছে তার!
সে বারান্দায় গেল এবং বারান্দায় গিয়ে যা দেখল সে, তা দেখার পর তার মাথায় আকাশ ভেঙে পড়ার উপক্রম। শ্রাবণ দাঁড়িয়ে আছে।
তার দিকে মাথা উচু করে শ্রাবণ দাঁড়িয়ে আছে৷ আলিয়াকে দেখা মাত্র শ্রাবণ হাত নাড়ল।
আলিয়া ভয় পেয়ে রুমে চলে আসে। শ্রাবণ এতো রাতে তার বাসার সামনে? বাসার কেউ জানলে কি বলবে? ভয় লাগছে তার।
আলিয়া গট করে বারান্দা লাগিয়ে রুমে এসে শুয়ে পড়ল। আধ ঘন্টা কেটে যাওয়ার পর ও তার মন খচখচ করতেই আছে। উপায় না পেয়ে নিজের স্বস্তির জন্য সে পুনরায় উঠে দাড়ালো এবং বারান্দায় গেল।
শ্রাবণ এই শীতের মধ্যে এখনো দাঁড়িয়ে আছে। শ্রাবণ কে দেখে আলিয়ার হাত-পা কাপছে৷
আশ্চর্য! ছেলেটা তার পেছনে কেন লেগে আছে?
শ্রাবণ আওয়াজ করে আলিয়া বলে ডেকে উঠে। আলিয়া চমকে উঠে আশেপাশে তাকায়। কেউ শুনে ফেলে নি তো আবার?
শ্রাবণ পুনরায় ডাকে আলিয়া বলে। আলিয়া ইশারায় শ্রাবণ কে চুপ করতে অনুরোধ জানায়।
শ্রাবণ হয়তোবা আলিয়ার ইশারা বুঝতে সক্ষম হয়। তাই চুপ হয়ে যায়৷ কিন্তু ইশারায় আলিয়াকে নিচে ডাকে।
আলিয়া অনিচ্ছা সত্ত্বেও শ্রাবণের ডাকে সাড়া দিয়ে চুপিসারে নিচে নেমে সদর দরজা অতিক্রম করে। আলিয়া যেতে চাচ্ছে না৷ মন বাধা দিচ্ছে কিন্তু পা দ্রুত বেগে সামনে আগাচ্ছে৷ মনে হচ্ছে কেউ তাকে অপারেট করছে।
আলিয়া নিচে নামতেই মৃদ্যু কেপে উঠে। বাইরে খুব ঠান্ডা। ভেতর থেকে বোঝা যাচ্ছিল না যে এতো শীত পড়েছে বাইরে। শ্রাবণ এই শীতের মধ্যে তার বাসার সামনে কি করছে?
আলিয়াকে আসতে দেখে শ্রাবণ তড়িঘড়ি করে আলিয়ার কাছে গিয়ে বলে, আমি ভাত খাব।
আলিয়া অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করে, কি বললে?
শ্রাবণ আনন্দ ভাব নিয়ে বলে, গরম গরম ভাত দিয়ে গরুর মাংস খাব। আমার খিদা লাগছে। ভাত খাব আমি। গরুর মাংস দিয়ে।
আলিয়ার শ্রাবমের জন্য মায়া লাগলো। আজকে ছেলেটা সুস্থ থাকলে এভাবে কারো কাছে ভাত খেতে চাইত না। তার চোখে জল চলে আসল। আগে কখনো এমন পরিস্থিতি তে পড়েনি আলিয়া।
শ্রাবণ আলিয়ার কিছুটা কাছে এসে বলে, বাসায় আজকে গরুর মাংস রান্না হয়েছে৷ আমি গন্ধ পেয়েছি।
--হ্যা। হয়েছে। খাবে তুমি?(নরম গলায়)
--হুম। ভাত খাব।
আলিয়া দ্বিধা নিয়ে বলে, ভাত তো নেই৷ পোলাও খাবে?
শ্রাবণ একবার ডান আর বাম দিকে মাথা ঘুরিয়ে না বোধক ইচ্ছা পোষন করল।
আলিয়া বিপত্তি তে পড়ে যায়৷ শ্রাবণ কে ভাত খাওয়াবে কিভাবে? বাসায় যদি কেউ টের পেয়ে যায়? যাওয়ার ই তো কথা। কেউ না পেলেও বাবা নিশ্চয়ই পাবে৷ বাবার ঘুম খুব পাতলা। সামান্য শব্দেই সে সজাগ হয়ে যান। শ্রাবণ তো বাসায় গিয়ে চুপচাপ থাকবে না৷
--কি হলো আলিয়া? খেতে দাও। খিদা লাগছে আমার।
আলিয়া চিন্তায় পড়ে গেল। শ্রাবণ কে কিভাবে খাওয়াবে? এভাবে তো তাকে ফিরিয়ে দেওয়া ও যায় না। অসহায়বোধ তাকে আকড়ে ধরল।
শ্রাবণ হুট করে আরো এক ধাপ এগিয়ে এসে আলিয়ার সামনে দাড়িয়ে তার হাত ধরল। আলিয়া কেপে উঠে। শ্রাবণের হাত বরফের মতো ঠান্ডা। বরফ শীতল হাত দিয়ে শ্রাবণ আলিয়ার হাতের আয়ানের দেওয়া রিং টা খুলে নিল। এবং রিংটা হাতে নিয়ে একধ্যানে সেটার দিকে তাকিয়ে থাকে শ্রাবণ।
আলিয়া হতভম্ব চোখে শ্রাবণ কে দেখতে লাগে।
.
.
.
চলবে...........................