সকাল বেলা
----এ তো উঁকি ঝুঁকি দিয়ে কাকে খুঁজছেন তারা?
হুট করে নাফিজের কন্ঠ পেয়ে কেঁপে উঠলো তারা।পেছনে মাথা ঘুরিয়ে দেখে নাফিজ পেছনে দাঁড়িয়ে আছে।
এতে তারা আরো অবাক হলো।অন্য দিন তো নাফিজ সামনের রাস্তা দিয়ে আসে।আজকে নাফিজের খোঁজ তো এতক্ষণ ছিলো না।এখন সে কোথ থেকে পেছনের রাস্তা দিয়ে উদয় হলো।
----তারা কি ভাবছেন?
----আপনি এখানে কেন?আপনার না ঐ সামনে দিয়ে আসার কথা!
----আজকে আরো অন্ধকার থাকতে এসেছি।ভেবেছিলাম আজ আপনাকে একটু চমকে দেব।কিন্তু আজ তো আমি নিজেই চমকে গেলাম।
----আপনি নিজে কিভাবে চমকালেন?
----এই যে।আপনি উঁকি দিয়ে রাস্তার দিকে বার বার দেখছিলেন আমি এসেছি কি না!
নাফিজ ভ্রু নাচিয়ে কথাগুলো বললো।আর তারার তো যায় যায় অবস্থা।নাফিজ এভাবে তাকে লজ্জায় ফেলবে এটা তার জানা ছিল না।
----কি বুঝে গেলাম তো?
----কচু বুঝেছেন আপনি।
----কচু!
----হ্যাঁ পানি কচু।নারকেল দুধ দিয়ে রাধলে সেই লাগে খেতে।
----কি করে বুঝব সেই লাগে?
----মানে টাকি!আপনি খাবেন তাঁরপর তো বুঝবেন।
----খাব কি করে?আমার মা এটা রাঁধতে পারে না।
----ওহ!তাহলে তো আর বুঝবেন না।
----বুঝব। যদি আপনি একটু বোঝান।
নাফিজের মুখের দুষ্টু হাসি,চোখের বাকা দৃষ্টি। তারা তো আরো ঘাবড়ে যাচ্ছে ।
----আমি বোঝাব মানে?
----একদিন তো রান্না করে খাওয়ালেন না।রান্না পারেন তো?
----আমি সব রান্নাই প্রায় পারি।শুধু মায়ের জন্য কিছু হয় না।জোর করে যা দু এক সময় কিচেনে যাই।
----তাহলে আরেকবার একটু জোর করে যাবেন।
----কেন?
----আপনার হাতের নারকেল দুধের পানি কচু রান্না খাব।
----আমার হাতের!
----হ্যাঁ।
----সম্ভব না।
----সম্ভব করতে হবে।
----সেটাও সম্ভব না।
----আমি যদি বলি সব সম্ভব হবে।
----কি করে?আপনি কি এখানে একটা কিচেন দেবেন দোকানের মতো।যে আমি এসে রান্না করব ।
----আপনার হাতের রান্না খাওয়ার জন্য সেটাও দিতে রাজী।
নাফিজের কথা শুনে তারা আরো ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গেল।
----আপনি বড্ড অদ্ভুত আচরণ করেন।
----কেন করি বলেছি তো আগের দিন।
----কি বলেছিলেন?ভুলে গেছি।
----করলে কি।আপনি তো বোঝেন না।
----কি বুঝব?
----তারা আপনি বড্ড ছোট্ট।এসব বোঝার বয়স হয়নি।যদি কখনো আপনাকে বোঝানোর সুযোগ পাই ফিজিক্স কেমিস্ট্রি বায়োলজি সব একদম প্রাক্টিক্যালি বুঝিয়ে দেব।
----আপনি কি সাইন্সের টিচার নাকি?
----আমি কেন সাইন্সের টিচার হতে যাব!
----তাহলে এগুলো কি করে বোঝাবেন!
তারা ঠোট উল্টে জবাব দিল।নাফিজ শুধু হা হয়ে তারাকে দেখছে।এটুকু সে বুঝেই গেছে তারা তার কথাটা ঠিকমতো ধরতে পারেনি।
----ঐ এমনি বললাম।ইচ্ছে ছিল সাইন্স এর টিচার হওয়ার।
----ওহ।
----তবে কি জানেন এসব বোঝানোর জন্য টিচার হওয়া লাগে না।
----তাহলে!
----ঐ যে বললাম যদি কখনো সুযোগ হয় সেদিন সব একসাথে বুঝিয়ে দেব।অবশ্য সুযোগ কেন আমি তো আমার করেই ছাড়ব।
তারা নাফিজের কোনো কথা বুঝল না।শুধু নাফিজের দিকে ড্যাপ ড্যাপ করে তাকিয়ে আছে।
----বোঝেননি?
----উহুম।
----আচ্ছা আর বুঝতে হবে না।চলুন হাঁটা শুরু করি।
----হুম।
----আচ্ছা গাসুয়া কোথায়?
----ও আজকে বাগানে কাজ করছে।ইচ্ছে করে আসেনি।
----কেন?উনি তো আপনাকে একা ছাড়ে না।কিছু বললেই তো ওনার বিশ্ববিখ্যাত ডায়লগ আর মুড়ো ঝাটা নিয়ে চলে আসে।
নাফিজের কথা শুনে তারা হো হো করে হেসে দিল।
----আসলেই।মুড়ো ঝাটা ওর খুব প্রিয়।
----হুম।তবে উনি আপনাকে খুব ভালোবাসে।
----হ্যাঁ তা ঠিক।আমিও ওকে খুব ভালোবাসি।মা বাপি র পরে গাসুকেই আমি সবচেয়ে বেশি ভালোবাসি।
----আর কাউকে বাসেন না?
----আর কাকে বাসব?এটাই তো আমার পরিবার।আর তো কেউ নেই।
----না বলছি সারাজীবন কি এভাবে থাকবেন?আর কাউকে ভবিষ্যতে ভালোবাসবেন না?
নাফিজের কথা শুনে তারা দাড়িয়ে গেল।নাফিজের দিকে ঘুরলো।
----আর কেউ বলতে ?
----কেন আপনার বুঝি বিয়ে টিয়ে হবে না!আপনার হাসবেন্ড কে ভালোবাসবেন না?
----হাহ!বিয়ে!ক্যাপ্টেন আপনি কি পাগল হয়েছেন?
----কেন?
----আমি নিজে চলতে পারি না ঠিকমতো।আমাকে কেউ কেন নিজের জীবনের অংশ বানাতে চাইবে?আর সৌন্দর্য সবকিছু নয় ক্যাপ্টেন।দুদিন তিনদিন ।একসময় মোহ কেটে যাবে।তখন মনে হবে একজন এরকম মেয়ে জীবনের বোঝা ছাড়া কিছুই নয়।
তারা কথা গুলো বলে সামনের দিকে যেতে লাগল।নাফিজের খুব খারাপ লাগছে তারার কথা শুনে।
;;;;;
----মাহমুদা,মাহমুদা।
আব্রাহাম সাহেবের গলা শুনে মাহমুদা বেগম রান্না ঘর থেকে উপরে আসলেন।
----কি হয়েছে?
----ইব্রাহীম ভাই ফোন করেছিল।
----হুম।তো?
----যশোরে নাকি সৈকতের কি একটা কাজ আছে।ও আমাদের বাড়িতে আসবে।
----ও।তাহলে তো ভালো।কবে আসবে?তারা শুনে খুব খুশি হবে।
----এই তো দু তিন দিন পর হয়তো।
----আচ্ছা আসুক।
মাহমুদা বেগম কথা শেষ করে নিচের দিকে চলে গেলেন।
;;;;;
নাফিজের চোখ আপাতত সামনে দাঁড়িয়ে থাকা পাশাপাশি দুটো খেজুর গাছের দিকে।নাফিজ এটাই বোঝার চেষ্টা করছে তারা এক দৃষ্টিতে কি দেখছে সেখানে।
----আপনি কি দেখছেন তারা?
----ক্যাপ্টেন আপনি কখনো খেজুর গাছের সামনে দাঁড়িয়ে দাড়িয়ে খেজুরের রস খেয়েছেন?
;;;;;
তারা মুখে এক রহস্যময়ী হাসির রেখা টেনে রেখেছে।নাফিজ তো কিছু বুঝতেই পারছে না তারার কান্ড।
----মানে?আপনি কি করবেন তারা?
----হুশ।চুপ থাকবেন।শুধু দেখে যাবেন।
----আচ্ছা।
তারা নিজের সাইড ব্যাগ থেকে দুটো পলিথিন বের করলো।তারপর নিচু হতে চেষ্টা করলো।
----কি করছেন?কি লাগবে বলুন আমি দিচ্ছি।
----ঐ দুটো ইটের ঢিলা দিন তো।
----কেন?
----থাক আমি নিচ্ছি।
----আরে রাগছেন কেন?আমিই দিচ্ছি।
নাফিজ দুটো ঢিলা তুলে তারা র হাতে দিল।
----এবার তো বলুন কি করবেন?
----ডাকাতি।
----কিহ!
----হ্যাঁ।
তারা নাফিজকে ইশারায় খেজুর গাছের সাথে বাধা মাটির ঠিলের দিকে তাকাতে বললো।দেখেই বোঝা যাচ্ছে রস সংগ্রহের জন্য এভাবে মাটির ঠিলা ওখানে বেধে রাখা হয়েছে।
----আপনি কি করতে চলেছেন তারা!
----কোনো কথা বলবেন না।একদম স্টাচু হয়ে দাড়িয়ে থাকবেন।
তারা একটু সামনে এগিয়ে গিয়ে একটা ঠিলার দিকে তাক করে ঢিল ছুড়লো।কিন্তু দূরভাগ্য লক্ষ্য চ্যুত হলো।তারা এবার আরেকটা ছুড়ে মারতেই একদম ঠিলের গায়ে লাগলো।কিছু অংশ ফেটে গিয়ে ফুটো হয়ে গেল।আর ভেতরে থাকা রস চুয়ে পড়তে থাকলো।তারা আর দেরী না করে পলিথিন টা মেলে ছিদ্র বরাবর ধরলো।আর রস টুপটুপ করে পলিথিনের ভেতরে এসে পড়ছে।
নাফিজ পুরো হা হয়ে তাকিয়ে আছে তারা র দিকে।তারা যে এরকম কাজ করবে সেটা নাফিজের ধারনা র বাইরে ছিল।
বেশ কিছুক্ষণ পর পলিথিন টা ভরে গেল।তারা পলিথিনের মুখটাতে ভালো করে গিট্টু দিল।
----মেজরের মেয়ে হয়ে আপনি দিনে দুপুরে ডাকাতি করছেন তারা!
নাফিজের কথা শুনে তারা নাফিজের দিকে ভ্রু কুঁচকে তাকালো।
----তো কি হয়েছে?
----আমি স্যারকে বলে দেব।
----পাপী মরে সাত ঘর নিয়ে।
----মানে?
----আপনি ও আমার সাথে ছিলেন।
----ওরে!আপনার মাথায় যে এরকম দুষ্ট বুদ্ধির গোডাউন আছে জানতাম না তো।
----হি হি।
----এবার কি করবেন?
----খাব।
----কিভাবে?
----এই ভাবে।
তারা বলতে বলতে দাঁত দিয়ে পলিথিনের এক কোনাতে ছিদ্র করলো।সেখানে সাথে সাথে মুখ লাগালো।ছিদ্র দিয়ে রস বেরোচ্ছে আর তারা সেটা খাচ্ছে।
নাফিজ এবার অবাকের চূড়ান্ত পর্যায়ে।তারার বুদ্ধি দেখে সে পুরো শকড হয়ে গেছে।
----একা একা খাবেন?
তারা বেশ খানিকটা রস খেয়ে নাফিজের দিকে তাকালো।
----আপনি খাবেন?
----কেন নয়।ডাকাত যখন হয়েছি তাহলে প্রাপ্ত সম্পদে আমার ও অধিকার আছে।
----কিন্তু কিভাবে?আপনার কথা তো আমার মনেই ছিল না।আমি এটা এঁটো করে ফেলেছি।
নাফিজ তারার দিকে একপলক তাকিয়ে তারার থেকে রসভরতি পলিথিন টা ছিনিয়ে নিয়ে তারার মুখ লাগানো অংশ টিতে নিজেও মুখ লাগিয়ে খেতে শুরু করলো।
নাফিজের কান্ডে তারা বেশ অবাক।দেখতে দেখতে বাকি রসটুকু নাফিজ শেষ করে ফেললো।
----এরকম একটা জিনিস আপনি লোভ দিয়ে একা একা খাচ্ছিলেন!এটা মোটেও ঠিক না তারা।
----আরেকটা কাজ করবেন?
----কি?
তারা ব্যাগ থেকে বের করে দুটো হাজার টাকার কচকচে নোট নাফিজের হাতে দিল।
----এটা দিয়ে কি হবে?
----যেই ঠিলে টা ফুটো করেছি ওটাতে বেধে দেবেন।
----কেন?
----গাছের মালিকের আর আফসোস থাকবে না।
----এতো দেখছি চোরের ওপর বাটপারি।
----এরকম আগেও করেছি।অন্য বার গাসু থাকে।কিন্তু আজ এলো না।
----কেন?
----ওর নাকি ভয় হচ্ছে আমরা ধরা পরে যাব আর আপনি ও সাথে থাকবেন এজন্য।
----ও আচ্ছা।এরকম দুষ্টু আপনি আমার তো বিশ্বাস ও হয় না।
----জানেন বাপিকেও একদিন এরকম রস নিয়ে খাইয়েছিলাম।বাপি টের পাইনি।উল্টে আরো দু হাজার টাকা বকশিশ দিয়েছিল আমাকে।
----স্যার যদি একবার জানতো এটা আপনি কোন উপায়ে এনেছেন তাহলে কি হতো?
----বকুনি একটাও বাকি থাকতো না।এমনিতেই বাপি কখনো আমাকে বকেনা। কিন্তু এটার জন্য ঠিক বকতো।
----আচ্ছা চলুন এবার।না হলে কেউ দেখে ফেলবে।
----চলুন চলুন।
নাফিজ তারা দুজনেই বাড়ির উদ্দেশ্যে রওনা হলো।
;;;;;
"ঘুমিয়ে পড়েছেন?নাকি জেগে আছেন?"
----ক্যাপ্টেন
ফোনের মেসেজ টা দেখে নিজের অজান্তেই মুখে হাসি ফুটলো তারার।ঘড়ির দিকে একবার তাকিয়ে নিল।এগারোটা বাজে।
তারা বই নিয়ে টেবিলে বসে আছে।কিন্তু মন তো ছিল অন্য দিকে।বার বার ফোনের দিকে তাকিয়ে দেখছিল।ইদানীং নাফিজের সাথে মেসেজ আদান প্রদান, কথা বলা সব হয় তার।কিন্তু পুরোটাই বন্ধুর মতো।
তারা বিছানার দিকে তাকালো।গাসু বিছানা ঠিক করছে।
----গাসু।
----জে আফা।
----তুমি ঘুমাতে যাও।
----না।আপনি তো এহনো হাডি করবেন।
----হাডি আবার কি?
----পড়াশোনা।
----ও আল্লাহ।ওটা স্ট্যাডি।
----ঐ তো।
----তুমি যাও।আমিও ঘুমাব।
----আইচ্ছা।
গাসু খাট থেকে নেমে যেতেই তারা গিয়ে দরজা লক করে দিল।তারপর টেবিলে বসেই ফোনটা হাতে নিয়ে নাফিজকে কল দিল।
----হ্যালো।
----জেগে আছেন তাহলে?
----হ্যাঁ।পড়ছিলাম আর কি।
----ও।
----খেয়েছেন?
----হ্যাঁ।
----আপনি কিন্তু এখনো আমাকে রান্না করে খাওয়ালেন না তারা।
----কিভাবে করব?ওতো সকালে।
----তার মানে আপনার করার ইচ্ছে আছে।
নাফিজের কথা শুনে তারা নিজের জিভ কামড়ে ধরলো।বেচারী লজ্জা তে পড়ে গেছে।
----ইয়ে মানে।
----কি মানে?
----এই যে শুনুন আপনি কি মনে করেন নিজেকে হ্যাঁ?আপনি নিজেই তো বারবার বলেছিলেন।এটা নিয়ে এতো বলার কি আছে?
----আপনি রেগে যাচ্ছেন কেন তারা?থাক আর বলব না।
----হুম।
----তারা।
----কি?
----আমি আপনার কি হই?
----মানে?
----কিছু না।
----আপনি এ তো কথা প্যাচান কেন?
----আপনি কিন্তু আমার বড় কিছু হন।
----কি?
----কিছু না। শুভ রাত্রি।
নাফিজ ফোন কেটে দিল।তারা চোখ বুজে নাফিজের কথা গুলো ভাবছে।প্রতিদিন ই নাফিজ তাকে এমন কিছু কথা বলে সে নিজেই ঘাবড়ে যায় আসলে নাফিজ তাকে কি বলতে চায়।
----ধুর।একটু সামনা সামনি কথা বলতে পারেনা নাকি?ফাজিল লোক একটা।আর কথা বলবো না এনার সাথে।
তারা রেগে বই একটা জোরে খাটের ওপর ছুড়ে মারলো।
;;;;;
----সাপ তার বাম চোখে কম দেখে।কখনো যদি দেখো তোমাকে সাপে তাড়া করেছে তো তুমি তোমার বাম দিকে ঘুরে দৌড় দেবে।
----তুমি এতো খবর কিভাবে জানো সৈকত ভাইয়া?
----জানি জানি।কিছু কিছু জিনিস আছে বাস্তব জীবনে খুব কাজে দেয়।এগুলো জেনে রাখা উচিত।
রাত তিনটা বাজে।খাবার টেবিলে সবাই বসে আছে।আর সৈকত খাবার সামনে নিয়ে কথা বলছে।সবার মনোযোগ সৈকতের দিকে।
একটু আগে ঢাকা থেকে ফিরেছে সে রাতের গাড়িতে।