প্রেমবিলাস - পর্ব ০২ - আরিশান নূর - ধারাবাহিক গল্প


আলিয়া হু কেন বলল সে নিজেও জানে না। পরক্ষনেই তার ঘোর ভাঙ্গে। হু বলা উচিত হয় নি তার। ভুল করে বসেছে। 

আরহান এসে শ্রাবণ কে জোড় করে বাসার বাইরে বের করে দেয়। সঙ্গে আলিয়ার কাজিনরাও হেল্প করে শ্রাবণ কে বাসার বাইরে বের করতে। শ্রাবণ কিছুতেই যেতে চাইছিল না। 
তাকে জোর করে বের করে দেওয়া হয়। 

আরহান শ্রাবণ যাওয়ার পর কিছুটা জোরে শব্দ করে বলে, আলিয়া তোর মাথা ঠিক আছে? তুই হ্যা কেন বললি? 

আলিয়া চোখ-মুখ শক্ত করে দাঁড়িয়ে আছে। সে কি বলবে বা উত্তর দিবে নিজেও জানে। চোখে পানি চিকচিক করছে। 

আলিয়ার বাবা কঠিন গলায় বলে, ছেলেটাকে তো আমি চিনিই না। কে সে? কোথা থেকে এসেছ ও? আমার মেয়ে ও কিভাবে চিনে? 

আরহান গলার স্বর নিচু করে বলে, বাবা। ও মানসিক ভাবে ভারসাম্য হীন। আমার সাথে একসাথে কলেজে পড়ত। হুট করে কি যেন হয় ওর। এইচএসসি দেয় না। পরে জানতে পারি ও মেন্টাল ডিসওডার হয়ে গেছে। 

আলিয়া চমকে উঠে। ভাইয়া এসব কি বলছে? শ্রাবণ কে দেখে তো বোঝার উপায় নেই ও মানসিক ভাবে ভারসাম্য হীন৷ দেখে তো সুস্থই মনে হয়। আরহান ভাইয়া কি মিথ্যা বলছে? আর যদি মানসিক রোগী হয়েও থাকে তাহলে তার কাছে কেন আসল? এসবের মানে কি?

আলিয়া আব্বুর চিন্তিত হয়ে গেল এবং বলল, ব্যাপার টা কেমন ধোয়াশাময় না? ছেলেটা মানসিক রোগী আবার এখানে এসে সুস্থ মানুষের মতো কথা বলছে। 

আয়ান ও তেড়ে এসে বলে, এখন সব সত্য ফাস হয়েছে জন্য তোমরা লুকাছাপা করার চেষ্টা করছো তাই না? আলিয়ার আগেও বিয়ে হয়েছে। এই ব্যাপার টা তোমরা আমাদের কাছ থেকে লুকিয়েছিলে৷ 

আয়ানের মা বলে উঠে, এইজন্য তোমাদের বিয়ে নিয়ে এতো ব্যস্ততা। তাড়া। আমার আগেই বোঝা উচিত ছিল যে কোথাও ঘাপলা আছে৷ 

আরহান কিছুটা দমে গেল। সে সদর দরজার দিকে তাকিয়ে শ্রাবণ কে দেখতে পেয়ে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে মিনমিন সুরে বলে, আপনাদের বিশ্বাস না হলে বাইরে গিয়ে দেখুন। শ্রাবণ রাস্তায় একা একা কথা বলছে। যান দেখুন গিয়ে। ওলে দেখলেই সব ক্লিয়ার হবে। 

কেউ না গেলেও আয়ানের মা গেল। তার পিছনে পিছনে আলিয়াও যায়। 

তারপর আলিয়া যা দেখল তা দেখার জন্য সে মোটেও প্রস্তুত ছিল না। শ্রাবণ কে বাড়ির বাইরে বের করে দিলেও সে তাদের বাসার গেটের সামনে হাটু গেড়ে বসে আছে। মাটি নিয়ে খেলছে। হুট করে রাস্তায় পড়ে থাকা মাটি সে কুড়ে নিয়ে মুখে তুলে নিয়ে চাবাতে লাগে। 

আর বিড়বিড় করে কিসব বলছে৷ পরনে যে পুরাতন জামা কাপড় তাও না। কিন্তু চুল গুলো উষ্কখুষ্ক। আয়ানের মা সামনে গেলেন না। সম্ভবত সে বিশ্বাস করে নিয়েছে শ্রাবণ পাগল। 

কিন্তু আলিয়া শ্রাবণের কাছে গেল। মাথা নিচু করে বসে আছে শ্রাবণ। 

আলিয়া লক্ষ করল, শ্রাবণের পরনের শার্টটায় ময়লা লেগে গেছে৷ আলিয়াও শ্রাবণের দেখাদেখি হাটু গেড়ে বসে পড়ে।

শ্রাবণ বিড়বিড় করে কিসব বলছে৷ মুখ দিয়ে লালা পড়ছে বাচ্চাদের মতো৷ 

আলিয়া গা ঘিনঘিন করে উঠে। এই মূহুর্তে বিনা সন্দেহে যেকেউ বলে দিতে পারবে শ্রাবণ মানসিক রোগী। 

আলিয়া করুনার চোখে শ্রাবণের দিকে তাকালো। 

কারো উপস্থিতি টের পেয়ে শ্রাবণ মাথা উচিয়ে আলিয়ার দিকে তাকিয়ে হালকা করে হেসে বলে, কেমন আছো আলিয়া? 

শ্রাবণের মুখে নিজের নাম শুনে আলিয়া ভয় পেয়ে যায়৷ চোখে তার ভয়ের আভা।

শ্রাবণ শুন্য দৃষ্টিতে আলিয়ার দিকে তাকিয়ে মৃদ্যু গলায় বলে, আমাকে মনে আছে? 

--উহু। 

শ্রাবণ ভ্রু কুচকে ফেলে। চোখে রাগের ফুলকা জ্বলছে। 

আলিয়া ঘাবড়ে যায়।হুট করে শ্রাবণ এক মুঠ বালি তার হাতে পুড়ে নিয়ে আলিয়ার চোখের দিকে ছুড়ে মারে৷ 

বালি দানা চোখে পড়তেই আলিয়া চিৎকার দিয়ে উঠে। 

আর শ্রাবণ হোহো করে হেসে হাতে তালি বাজাতে থাকে। 

আলিয়া চোখ কচলালে কচলাতে উঠে দাড়ালো। আলিয়ার কন্ঠ শুনে আরহান বাইরে চলে আসে এবং কর্কষ গলায় শ্রাবণ কে উদ্দেশ্য করে বলে, তুই এখনো যাস নি?বের হ আমার বাসা থেকে। 

আরহানের কথা শুনে শ্রাবণ আরো জোড়ে হাসা শুরু করে। এবার আরহান ও কিছুটা ঘাবড়ে যায়। এমন পরিস্থিতি তে কি করা উচিত তার? জানে না সে! 

আরহান দেরি না করে আলিয়াকে নিয়ে বাসার ভেতরে ঢুকতে গেলে শ্রাবণ আপন মনে গান তোলা সুরে বলে উঠে, ভালোবাসি আলিয়া। 

আলিয়া পেছনে ঘুরে শ্রাবনের দিকে বিষ্ফরিত চোখে তাকায়। 

তখনো শ্রাবণ হেসেই চলেছে। শ্রাবণের হাসি দেখে আলিয়ার গা কাটা দিয়ে উঠে। 

বাসার ভেতরে ঢুকতেই আরহানকে প্রশ্নবিদ্ধ করা হয়। সবার আগে তার বাবা জিজ্ঞেস করে,আরহান শ্রাবণ কে চিনে কিভাবে? 

এই প্রশ্নের উত্তর আরহান আগেও দিয়েছিল। তাও আবারো উত্তর দিল। তাহলো, শ্রাবণ তাদের স্কুলে ক্লাস এইটে এসে এডমিট হয়। ক্লাস এইটে আরহানের রোল ছিল এক। আর শ্রাবণ যেহুতু নতুন ছিল তাই লাস্ট বয় ছিল তাদের ক্লাসের। 

কিন্তু ক্লাস নাইনে শ্রাবণের রোল হলো এক আর আরহানের রোল দুই। 

প্রত্যেক বিষয়ে শ্রাবণের নম্বর থাকত ফুল মার্কস। দেখা যেত পরীক্ষায় একটা আনকমন প্রশ্ন এসেছে। ক্লাসের ফাস্ট বয়,সেকেন্ড বয় কেউ পারছে না কিন্তু ক্লাসের লাস্ট বয় যার রোল কিনা পঞ্চান্ন সে গটগট করে সব প্রশ্নের উত্তর লিখে বসে আছে। শ্রাবণ ক্লাসে অমনোযোগী থাকত। প্রায় সময় হেড ডাউন দিয়ে শুয়ে থাকা ছেলেটা যে রোল এক হবে তা কল্পনার বাইরে ছিল। যেহেতু আরহান আর শ্রাবণের রোল পাশাপাশি হলো তাই তাদের মধ্যে বন্ধুত্ব গড়ে উঠে। 

মেয়েরা খুব ভেবে চিনতে বন্ধু নির্বাচন করে মেয়েরা বন্ধু বানানোর সময় খুব কিপটামি করে কিন্তু ছেলেরা ব্যতিক্রম। তাদের ফ্রেন্ড সার্কেলের অভাব নেই৷ তাই পাশাপাশি বসার দরুন আরহানের সাথে ভাব জমে যায় শ্রাবণের। শ্রাবণ কোন দিন টিফিন আনত না। সব সময় আরহানের টিফিন শেয়ার করত। এদিকে শ্রাবণ ও আরহানকে বায়োলজির সব প্রাকটিকালের ছবি একে দিত।জটিল মাইক্রোস্কোপ থেকে শুরু করে আ্যামিবা সব একে দিয়েছিল। শ্রাবণ অদ্ভুত সুন্দর ড্রয়িং করতে পারত! শ্রাবণের আকা ছবির দিকে কেউ মুগ্ধ নয়নে অনায়াসে আধঘন্টা তাকিয়ে থাকতে পারবে। 

এভাবেই স্কুল পাড় করে কলেজে উঠে তারা। শ্রাবণ খুব সিরিয়াস হয়ে যায় পড়াশোনায়। কলেজে শ্রাবণের আইডি কার্ডের শেষ তিন ডিজিট ছিল ১২৩। ল্যাবে শ্রাবণের নাম হয়ে যায় এক দুই তিন। আরহান আর শ্রাবণ সেইম গ্রুপে ছিল। প্রায় সময় আরহান কোন কাজে যখন শ্রাবণ কে ডাকবে তখন শ্রাবণ বলে না ডেকে ডাকত এক দুই তিন এদিকে আয় তো! 

দুইজন একসাথে জুয়োলজি ল্যাবে তেলাপোকা কেটেছিল।সব স্মৃতি ই মনে ধারণা করে রেখেছে আরহান। 

ইশ! কি থেকে কি হয়ে গেল শ্রাবণের জীবনে?শ্রাবণের ইচ্ছা ছিল ট্রিপল ই ইঞ্জিনিয়ার হওয়ার। তাকে মাঝে মাঝে আরহান ইঞ্জিনিয়ার সাহেব বলে ডাকত। তখন শ্রাবণ মুচকি হাসত। সেই ছেলেটা নাকি এখন রাস্তায় রাস্তায় পাগলের তকমা লাগিয়ে ঘুরঘুর করে। নামের আগে ইঞ্জিনিয়ার না বসে বসল পাগল! 

 এইচএসসি পরীক্ষার দুইমাস আগে থেকে শ্রাবণ লাপাত্ত। নাই নাই তো নাই। কোথাও নেই। শ্রাবণের বাসা চিনত না আরহান তাই বাসায় গিয়ে খোজ নিতে পারেনি। শ্রাবণের ফোন নাম্বারে সে কল দিত কিন্তু কেউ ধরত না।রিং বাজতে বাজতে একসময় কেটে যেত। 
 

এডমিট কার্ড ও সংগ্রহ করেনি শ্রাবণ। 
ফলস্বরূপ আরহান যখন বোর্ড এক্সাম দেয় তার সামনের সিট ফাকা পড়ে থাকে। বোর্ড পরীক্ষার হলে যে স্যাররাই গার্ডে আসতেন, তারা একবার হলেও আরহানকে প্রশ্ন করতেন, তোমার সামনের জন কই? দিবে না পরীক্ষা? 

আরহান মন খারাপ করে না বলত। এরপর আর কি? সবাই কোন না কোন ভার্সিটিতে উঠে গেল। শ্রাবণ কে রেখেই ট্রেন তার যাত্রা শুরু করে দিল। নতুন ফ্রেন্ড পেয়ে আস্তে আস্তে আরহান ও ভুলতে বসে শ্রাবণ কে। 

তবে কলেজে থাকতে আরহান উড়ো খবর পেয়েছিল শ্রাবণ আলিয়াকে পছন্দ করে। আরহানের সাথে নাকি দেখেছে আলিয়াকে এক দেখায় পছন্দ করে ফেলেছে৷ এই খবর শুনে সে সোজাসাপটা শ্রাবণ কে প্রশ্ন করলে শ্রাবণ স্বীকার করে নেয়। তাদের মধ্যে মনোমালিন্য হয় কিন্তু শ্রাবণ নিশ্চিত করে সে আলিয়াকে কোন দিন ডিস্টার্ব তো দূরে থাক তার সামনেও যাবে না। 

আরহান চিন্তিত হয়ে যায়। শ্রাবণের কি এখনো আলিয়ার কথা মনে আছে? এখনো মনের মধ্যে পুষে রেখেছে আলিয়াকে? এটা তো খুব মর্মান্তিক ঘটনা হবে তাহলে। সে কিছুতেই তার বোনের ধারে কাছে শ্রাবণ কে আসতে দিবে না।
.
.
.
চলবে...........................

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন