মেজর আব্রাহাম মেয়ের বা পাশে এসে মেয়ের হাত ধরে গল্প করতে করতে আসছেন।তারার ডান হাতের সাথে ক্রাচ লাগানো।ক্রাচের ওপর ভর করে অনেকটা খোড়াতে খোঁড়াতে সে হাটছে।বাবা মেয়ে দুজনেই হাসি ঠাট্টা তে ব্যস্ত।
তারার টোল পড়া হাসিটা যেন নাফিজকে আরো বেশি আকর্ষণ করছে।এক অজানা অনুভূতি,অজানা টান,অজানা শুভ্রতা নাফিজের ভেতর তোলপাড় করে দিচ্ছে।নাফিজ শুধু এটাই ভাবছে কি অদ্ভুত নিয়তি,এতো ফুটফুটে একটা মেয়ে দুটো পা আছে ঠিকই কিন্তু ঠিকভাবে চলার ক্ষমতা নেই।
----বাপি,দেখেছো কতো সিলেবাস বাকি আছে আমার?
----তাতে কি হয়েছে।আমি তো জানি আমার তারা মা সব খুব দ্রুত শেষ করতে পারবে।
----কিন্তু পরীক্ষার তো বেশি দিন নেই।
----আল্লাহ ভরসা মা।আল্লাহ তোকে আজ অবধি কখনো প্রথম ছাড়া দ্বিতীয় হতে দেন নি।দেখবি ইনশাহআল্লাহ এবার ও তুই প্রথম হবি ক্লাসে।দেখে নিস।
----জাযাকাল্লাহ খাইরুন।
আব্রাহাম সাহেব এগিয়ে আসতে আসতে একদম নাফিজের সামনেই চলে আসলেন।আব্রাহাম সাহেবকে দেখেই মারিয়া নাফিজ স্যালুট করলো।
----স্যার ইনি ক্যাপ্টেন নাফিজ।গতকাল ইউনিটে জয়েন্ট করেছেন।
আব্রাহাম সাহেব মুখে হাসির রেখা টেনে নাফিজের দিকে তাকালেন।ওনার একটা হাত নাফিজের কাধের ওপর রেখে দুটো থাবা দিলেন।
----শুভ কামনা ক্যাপ্টেন নাফিজ।বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর একজন অন্যতম গর্ব আপনি।
----স্যার।
----অনেকক্ষণ অপেক্ষা করছেন আপনারা।চলুন ভেতরে যাওয়া যাক।
----জি স্যার।
----তারা মা চলো।
ক্যাপ্টেন নাফিজ নামটা শুনে তারা একবার ভালো করে নাফিজের দিকে চোখ বুলিয়ে নিল।তারার এই দৃষ্টি নাফিজের চোখ এড়ায়নি।
----বাপি,ইনিই কি সেই ক্যাপ্টেন নাফিজ?যার কথা তোমার মুখে শুনি।
----হ্যাঁ মা।ইনিই সেই ক্যাপ্টেন নাফিজ।নাফিজ এটা আমার মেয়ে তারা।
আব্রাহাম সাহেবের কথা শুনে নাফিজ মুচকি হেসে তারার দিকে তাকালো।তারা একবার আব্রাহাম সাহেবের দিকে তাকাচ্ছে আরেকবার নাফিজের দিকে।তারপর মাথা নিচু করেই তারা সালাম দিল।
----আসসালামু আলাইকুম।
----ওয়ালাইকুম আসসালাম।
----চলুন।আমরা ভেতরে যাই।
মেজর আব্রাহাম তারা কে নিয়ে ভেতরের দিকে গেলেন।মারিয়া ও পেছনে গেল।নাফিজ এখনো নিজের জায়গায় দাঁড়িয়ে আছে।
"প্রেয়সীর ঘন কালো চুল,টোল পড়া গাল,স্থির দৃষ্টি,সুমধুর কন্ঠ বড়ই বেদনাদায়ক।সুখকর বেদনা।"
দুচোখ বন্ধ করে একটা লম্বা শ্বাস নিয়ে ক্যাপটা মাথায় দিয়ে নাফিজ নিজেও ভেতরের দিকে পা বাড়ালো।
;;;;;
"আইঝা ওইঝা,ঘাস পেত্নী, সাকচুন্নি ঝুপ যা,
ঝাটার বাড়ি,কলকেপড়া ছ্যাকা,
তুই যাবি তোর বাপ যাবে
আইঝা ওইঝা,,,,,,"
তারা ভেতরে ঢুকে দাড়িয়ে আছে।দাঁড়িয়ে গাসুর কান্ড দেখছে।এটা তার কাছে নতুন না।তিনটা শুকনো মরিচ নিয়ে গাসু এসব বিড়বিড় করতে করতে তারার মাথা থেকে পা অবধি বুলিয়ে নিচ্ছে।
সোফায় বসে আব্রাহাম সাহেব গাসুর কান্ড দেখে মাথা নাড়লেন।যার অর্থ-এই পাগলকে কিছু বলে লাভ নেই।সোফার এপাশে বসে ক্যাপ্টেন মারিয়া আর নাফিজ গাসুর কান্ড দেখে এমনভাবে তাকিয়ে আছে যেন তারা চিড়িয়াখানায় এসেছে।
----তুমি আবার শুরু করেছো গাসু?
মাহমুদা বেগম চায়ের ট্রে নিয়ে বসার ঘরে আসলেন।মাহমুদা বেগমের ডাক শুনে গাসু নিজের গীত থামিয়ে মাহমুদা বেগমের দিকে তাকালো।
----কি করুম ম্যাডাম?হামি তো আফার নজর কাটাচ্ছি।আমার চাঁদের লগন দেখতে আফাটা।কাক পক্ষী কু নজর দেবে।আই গাসু ন হইতে দিতাম।
----তা ঠিক আছে।তাই বলে এসব বলে।শুধু মরিচ ছুইয়ে পরে আগুনে দিলেই তো হয়।তা না।
----উহ ম্যাডাম।আপনি বুঝেতেছেন। না।এই যে আফারে আজকে আরো বড় বড় ডাইমন রা নজর দিছে হের লিগে এতো কিছু।
----ডাইমন?
----আরে আফা আপনি ও বুঝলেন না।এই কষ্ট কই রাখুম।হো গড দেখো আফাও মোর ইংলিশ বুঝে না।আফা এর মানে রাক্ষস।
----ওহ আল্লাহ।ওটা Demon(রাক্ষস)।
----হ।এক্কেরে নাইট।এইটাই।
----আবার নাইট!
----ঐ যে সঠিক।বুঝেন না আফা।
----হ্যাঁ বুঝলাম।
----তয় ম্যাডাম।আসল কথা হলো আইজকে এই ডাইমন রা আফার ছবিতে নজর দিছে।আর আই গাসুয়া সিমসাং মোর আফার দিকে কারোর নজর ন লাগতে দিতাম।
গাসু নাফিজের দিকে তাকিয়ে ভেংচি কেটে আবার নিজের কাজে মনোযোগ দিল।এদিকে নাফিজ সেই লজ্জা পাচ্ছে।গাসুর কথার উদ্দেশ্য সে ঠিক বুঝতে পেরেছে।
"ছু মন্তর ছু,কালা কুত্তার ঘু,থু থু"
----আফা হইয়া গেছে।আপনে উপরে যান।
গাসু দাঁত কেলিয়ে মরিচ তিনটা নিয়ে গিয়ে চুলার আগুনে ফেললো।অদ্ভুত ব্যাপার মরিচ পুড়ছে অথচ একটু ও গন্ধ বের হচ্ছে না।
----ও ম্যাডাম।দেহেন কইছিলাম আফারে আবার কেডা নজর দিকে।
----হ্যাঁ।তুমি এবার ওসব আকাজ বাদ দিয়ে তারা কে নিয়ে উপরে যাও।
রান্নাঘর থেকে গাসুর গলা শুনে চেঁচিয়ে উওর দিলেন মাহমুদা বেগম।
;;;;;
----মা জানো,আজ একটা সিনড্রেইলা দেখেছি।তবে ছোটো না বড় একটা সিনড্রেইলা।আমার মিষ্টিও নিশ্চয়ই এরকম একটা সিনড্রেইলা হবে বলো।
কফির মগ হাতে নিয়ে জানালার কাছে দাড়িয়ে আছে নাফিজ।পেছনে লতিফা খাটের ওপর বসা।চোখ বুজলেই আজ নাফিজের শুধু একটা চেহারায় যেন ভাসছে।
----কি বলছিস তুই?
----হ্যাঁ মা সত্যি।একদম সত্যি।
----নাফিজ তোকে একটা কথা বলবো?
----বলো।
----উনত্রিশ বছর বয়স হয়ে গেছে তোর।ভালো চাকরি করিস।ভালো পজিশন সব আছে।এবার একটা বিয়ে,,,,,,
----সম্ভব না মা।তুমি কেন এই কথাটা বার বার বলো?আমি পারছি না মা।অনেক তো চেষ্টা করেছি ভুলে থাকার।কিন্তু কোনো লাভ কি হলো।আজ ও ঘুমানোর সময় চোখ বন্ধ করলে ভেসে আসে মিষ্টির মুখটা।কিভাবে হাত নাড়িয়ে বিদায় দিয়েছিল আমাকে।কানে ভেসে আসে সেই শেষ কথা,"টা টা নাফিজ ভাইয়া"।
----জীবন থেমে থাকে না নাফিজ।আমিও চাই মিষ্টিকে খুঁজে পেতে।কিন্তু কি করবি বল।ও বেচে আছে কি না সেটাও আমরা জানিনা।আর যদি বেচে থাকে তো নিশ্চয়ই অনেক বড় হয়ে গেছে আমাদের মিষ্টি বুড়ি।তুই ওকে সামনে দেখলেও চিনতে পারবি না।আর যদি কখনো তুই ওকে পাস তখন যদি দেখিস এতোদিনে ওর বিয়ে হয়ে গেছে।তুই বল কি করবি তখন?
----মা তুমি এ কথা বলো না।
----আচ্ছা ঘুমিয়ে পড়।
----আচ্ছা।
লতিফা উঠে নিজের ঘরের দিকে চলে গেল।
নাফিজ জানালা দিয়ে বাইরের আকাশের দিকে তাকিয়ে আছে।অনেকদিন পর রাতের আকাশে ছোটো ছোটো তারা দেখা দিয়েছে।
----মিষ্টি,মা কি বললো?সত্যি কি আমি তোকে চিনতে পারব না?মিষ্টি কোথায় তুই?তুই আমার মিষ্টি পাখি হয়ে আছিস।নাকি আমার মনের খাচা থেকে উড়াল দিয়ে অন্য কারোর খাঁচায় আবদ্ধ হয়েছিস।এতোটা কষ্ট দিস না মিষ্টি।আমি যে দমবন্ধ হয়ে মরে যাব।
নাফিজ চোখ বন্ধ করে বাইরের ঠান্ডা বাতাসকে ভেতরে টেনে নিচ্ছে শ্বাস নিয়ে।চোখ বন্ধ করলেই আজ মিষ্টির জায়গায় আরেকটা মুখ ভেসে আসছে।সাথে সাথে চোখ খুললো নাফিজ।জোরে জোরে শ্বাস নিচ্ছে।বুকের ভেতর ধুকপুকানিটা বেড়েই যাচ্ছে।
----না না।এরকম কেন হচ্ছে?তারা।সত্যি আকাশের খসে পড়া তারা।কিন্তু কেন আমার নয়নতারা বাগানে আজ নতুন ফুলের মুখ দেখছি বার বার।এটা তো হওয়ার নয়।আমার বাগান যে শুধুই আমার বেবি সিনড্রেইলার।
;;;;
"ভোরের পাখি,
তুমি কি শুনতে পাও?
আমি যে তোমাকে ডেকে ডেকে মরিয়া হয়ে যাচ্ছি,
আচ্ছা তুমি কি আমাকে ধার দেবে?
কিছুক্ষণের জন্য,
তোমার ঐ ডানা দুটো।
আমি উড়বো,ডানা মেলে উড়ে যাব ঐ দূরে,
ঘুরে বেরাব পুরো পৃথিবী,
জানো আমার না খুব ইচ্ছে করে
খরগোশের মতো লাফিয়ে বেড়াবে,
চিতাবাঘের মতো দৌড়াব,
শীতের বিকেলে সাইকেল নিয়ে ঘুরবো,
সাইকেলের সামনে থাকবে এক বিশাল ঝুড়ি,
ঝুড়ি ভরা ফুল,
আমি ঘুরব,খুব ঘুরব,
কিন্তু আমি যে পারি না।
দু কদম হাঁটতে পারিনা ঠিকমতো,
জানো আমি খুব চাই
কারোর হাত ধরে হাঁটতে,
যে আমাকে নিয়ে যাবে ঐ পাহাড়ের চূড়ায়,
আর তার সাইকেলের পেছনে বসে আমি ঘুরে বেড়াব,
আমার ইচ্ছা গুলো বড় বেমানান জানো তো,
এমন কেউ নেই,
আমি আমার সুপ্ত ইচ্ছে গুলোর নির্বাক কবি"(স্বরচিত)
----তারা,তারা মামোনি,,,,
মাহমুদা বেগমের গলা শুনে খাতার ভাজে কলম টা রেখে দিয়ে খাতাটা বন্ধ করে দিল তারা।পেছনে তাকিয়ে দেখে মাহমুদা বেগম খাবারের প্লেট হাতে দাঁড়িয়ে আছেন।
----মা বলো।
----এই দেখ তোর জন্য লুচি বানিয়েছি।
----এখন কেন করতে গেলে?সারাদিন হসপিটাল থেকে এসে ক্লান্ত হয়ে যাও এমনি তুমি।
----ও কিছু না।নে হা কর।খেতে হবে।
----আমিও ডাইনিং এ যেতাম।
----তোর বাবা একটু ইউনিটে গেছে।তাই তোর খাবার ঘরে আনলাম।ওষুধ খেতে হবে তো।
----গাসু খেয়েছে?
----হ্যাঁ।নে হা কর।
মাহমুদা বেগম তারাকে গালে তুলে লুচি আর আলুর দম খাইয়ে দিচ্ছেন।
;;;;;;
"হে আল্লাহ,তুমি পরম করুণাময়,রহমানুর রহিম।আমি জীবনের এক কঠিন পরিস্থিতিতে পড়েছি।না পারছি অতীত ভুলতে না সামনে এগিয়ে যেতে।আমার চিন্তা নিজেকে নিয়ে নয়।আমার বাবা মাকে নিয়ে।অনেক কষ্ট করেছেন তারা আমার জন্য।তুমি আমার সহায় হও রহমানুর রহিম।সঠিক পথ দেখাও।সাহায্য কর আমাকে।রাব্বীর হাম হুমা কামা রাবাইয়ানী সগীরা।আমিন।"
দু হাতের তালু দিয়ে পুরো মুখমণ্ডলে ঘষে নিয়ে মোনাজাত শেষ করলো নাফিজ।জায়নামাজ উঠিয়ে নিয়ে সুন্দর করে গুছিয়ে রেখে জানালা খুলে দিল।
সকালের স্নিগ্ধ বাতাসে চোখ বুজে মন ভরে শ্বাস নিল নাফিজ।সচারচর তার সকালে ওঠা হয়না।নামাজ আদায় করে আবার ঘুমিয়ে পড়ে সে।আজ যেন তার আর বিছানায় যেতে মন চাইছে না।
----উহ,হিমশীতল।বড়ই হিমশীতল আবহাওয়া।যাই একটু ঘুরে আসি।ইউনিটে যাওয়ার এখনো দেড় ঘন্টা দেরী আছে।
কালো রঙের ট্রাউজার,গায়ে জ্যাকেট জড়িয়ে ফোনটা পকেটে নিয়ে নাফিজ ঘর থেকে বেরিয়ে গেল।
----কি রে এতো সকালে কোথায় যাচ্ছিস?
লতিফার কথায় দাড়িয়ে গেল নাফিজ।
----মা তুমি উঠে পড়েছো?
----হ্যাঁ।তুই বের হবি।রান্না করতে হবে না।
----ওহ।
----কোথায় যাচ্ছিস?
----একটু হাঁটাহাটি করতে।এই জায়গা টা বেশ লেগেছে আমার।অনেক সুন্দর।অতোটা কোলাহল নেই।
----আচ্ছা।তাড়াতাড়ি আসিস।
----আচ্ছা।
----তুই কি সাইকেল নিয়ে যাচ্ছিস নাকি?
----হ্যাঁ মা।তাহলে দেরী হলে তাড়াতাড়ি ফিরতে পারব।
----আচ্ছা যা।ফি আমানিল্লাহ।
সাইকেলের চাবি নিয়ে গ্যারেজ থেকে সাইকেল নিয়ে বেরিয়ে পড়লো নাফিজ।কিন্তু কোথায় যাবে সে?এটাই ভেবে পারছে না।
----কোথায় যাব?এখানে তো অনেক জায়গা আছে।
নয়নতারা বাগানের কথা মনে পড়তেই নাফিজের মুখে হাসি ফুটলো।
----হ্যাঁ সেখানেই যাব।ফুল গুলো যে আমাকে বড্ড টানছে কাল থেকে।কিন্তু কেন?
নাফিজ আর না ভেবে রওনা দিল।
;;;;;
"হাই সারি রিন্নামা দুকরুক সুয়ে রেন্নামা থাংসিরুরু জাজং নাম্মা নংমাওয়ান্না লেংয়ান্ন"
(অর্থ:আসো বন্ধুরা আজ সবাই খেলতে যাই,আজকে চাঁদ টা অনেক সুন্দর)
"এই এক খ্যাপ, এই দুই খ্যাপ,
এই তিন খ্যাপ,এই পাঁচ খ্যাপ,
উউরি বাববাহ,,,"
----গাসু তোর পায়ে পড়ি বোইন চুপ কর।
গাসু লাফানো থামিয়ে তারার দিকে তাকালো।
----আফা কি হইচ্চে?
----এগুলো কি বলছো তুমি?আমার মাথার তার গুলো কি সব ছিড়ে ফেলার সিদ্ধান্ত নিয়েছো?
----ছ্যা ছ্যা,তারা আফা।কি বললেন আপ হে?আই গাসুয়া সিমসাং আপনের মাথার তার ছিড়ুম।ন কখনো।
----এই দেখো আবার শুরু।তুমি যে কোন ভাষা থেকে কোন ভাষায় চলে যাও আমি কিছু বুঝিনা।আচ্ছা বাদ দেও।এতো লাফাচ্ছো কেন তুমি?
----আরে আফা আমি তো পাইএইসজিকাল সাইজ করতেছি?
----কিহ!সেটা আবার কি?
----আরে আফা আপনে ও দেখি ইংলিশ ফিনিশ বোঝেন না।এর মানে ব্যায়াম।
----ওহ আল্লাহ।ওটা ফিজিক্যাল এক্সারসাইজ।
----ঐ হইলো।
----আচ্ছা মা কি উঠেছে?
----না আফা।ম্যাডাম তো নামাজ পইড়া ঘুমাইছে।
----তাহলে আর কে ঠেকায় আমাদের?
গাসু আর তারা দুজনেই দুজনের দিকে তাকিয়ে রহস্যময়ী হাসি দিল।
;;;;;
----ও বাবাই, বাবাই আমাকে একটু ভাত খেতে দেও না।খুব খিদে পেয়েছে বাবাই?
প্রতিদিনের মতো আজ ও সকালে উঠেই মিষ্টির শেষ কথা গুলো মনে পড়তেই বুকটা ছ্যাত করে উঠলো ফজলে শেখের।চোখের কোন দিয়ে আনমনেই পানি গড়িয়ে পড়লো।
----আপনার চা।
তানিয়ার কথায় পেছনে ঘুরে তাকালো ফজলে শেখ।
----তোর হাতের জিনিস খেতে আমার ঘেন্না লাগে।মরতে পারিস না তুই।
ফজলে শেখের কথা শুনে অন্যদিনের মতো আজও তানিয়ার বুক ফেটে কান্না আসছে।চোখের কোনে পানি টলটল করছে।
----আপনি সব সময় এই এক কথা কেন বলেন?
----কথা শুনতে যখন পারিস না দূর হতে পারিস না।এখনো কেনো আমার বাড়িতে পড়ে আছিস?
----কোথায় যাব আমি?বাপের বাড়ি গেলে ভাই ভাই বউ দূর দূর করে তাড়িয়ে দেয়।বোনের বাড়ি গেলে এক অবস্থা।আরো বোনের বাচ্চা হবে।অপয়া অলক্ষী বলে ঝাটা লাথি দেয় সবাই।কোথায় যাব বলতে পারেন?
----অপয়া বলবে না তো কি তোকে মাথায় তুলে নাচবে।তিন বার বাচ্চা জন্ম দিলি সব মরা বাচ্চা।পাঁচ বার তো জন্মানোর আগেই বাচ্চা খেয়ে নিয়েছিস।তোকে কে ঠাঁই দেবে?
আঁচলে মুখ গুঁজে ডুকরে কেঁদে উঠলো তানিয়া।
----আমার মিষ্টি কোথায় আল্লাহ জানে।কি অবস্থায় আছে?তোর জন্য আমার মেয়েটাকে আমিও দূর দূর করেছি।এখন দেখ।দেখ নিজের অবস্থা।আজ সন্তান থাকতেও নিঃসন্তান হয়ে রয়েছি আমি।মা মরার আগেও ঠিক ই বলেছিল ঐ বাচ্চা মেয়েটার চোখের পানির এক ফোঁটাও বৃথা যাবে না।আমার মিষ্টি মা কোথায় আছে?বেচে আছে নাকি,,,,কিছু জানিনা আমি।
পাঞ্জাবির হাতা দিয়ে চোখের পানি মুছলেন ফজলে শেখ।
;;;;;
ফোনের স্ক্রিনের দিকে তাকিয়ে আছে তানহা।ইউনিফর্ম পড়া অবস্থায় আরো চোখে কালো সানগ্লাস পড়া।নাফিজের হ্যান্ডসাম লুকটা যেন আরো বেশি ফুটে উঠেছে।
এই নিয়ে কতোবার যে নাফিজের ফেসবুক আইডি তানহা ঘেঁটেছে তার হিসেব নেই।রোজ সকালে একবার করে ঘেঁটে দেখা, ঘুমানোর আগে একবার ,কাজের ফাঁকে কখনো বা নাফিজের কেবিনের সামনে দিয়ে যাওয়ার সময় একটু উঁকি দেওয়া তানহার রুটিন হয়ে দাঁড়িয়েছে।
----তানহা আপু,তানহা আপু।
মানহার ডাক শুনে তাড়াতাড়ি ফোন লক করে পেছনে ঘুরলো তানহা।
----কি হয়েছে?
----মামীর নাকি আবার কোমড়ে ব্যথা করছে।তোমাকে রান্না করতে বললো।
----আমার অফিস আছে।সারাদিন খাটা খাটুনি করে রাতে ও রান্না করতে হয়।এই একটা বেলাও কি কোমড়ে ব্যথার অজুহাত দিতে হবে ঐ মহিলার!
----কি করবে বলো?আমাদের কি বা করার আছে?তাও তো এখন তুমি চাকরি করো আরো কতো বড় পদে তাই কম কষ্ট দেয়।আগে তো তোমাকে আমাকে কতো না খাইয়ে রেখেছে।
----আমাদের ই মায়ের সম্পত্তি বেচে কিনে খাচ্ছে অথচ দেখ আমাদের সাথে কি ব্যবহার টাই না করে।
----দেখা ছাড়া কি করার আছে বলো।চলো আমি তোমার হাতে হাতে এগিয়ে দেই।
----তোর স্কুল আছে না?
----আছে তো।
----তুই যা।পড়তে বস।
----না।তুমি অনেক কষ্ট কর সারাদিন।আমি একটু সাহায্য করি।
----না।আমি পারব।তুই যা।এবার দেখি একটা কাজের লোক রাখব।
বোনের মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে তানহা রান্না ঘরের দিকে গেল।
;;;;;
দুটো চোখ দেখে সাইকেল টাকে ঘাসের ওপর শুইয়ে দিয়ে গাছের আড়ালে দাঁড়িয়ে পড়লো নাফিজ।
জানালার নীল রঙের থাইগ্লাসের অপর প্রান্ত থেকে দুটো চোখ বার বার বাইরে উঁকি দিয়ে চারপাশ দেখছে।
গাছের আড়ালে দাঁড়িয়ে নাফিজের দৃষ্টিও ঐ চোখের দিকে।
----আফা,কি দেখলেন?কেউ আছেনি?
----না গাসু কেউ নেই।
----কইছিলাম না আপনি এতো টেনশন নিয়ে ন না।এতো সকালে কে আসবে?
----চলো চলো তাড়াতাড়ি যাই।
----চলেন আফা।
চোখ দুটো আড়াল হতেই নাফিজের মনটা কেমন খারাপ হয়ে গেল।ঐ চোখের চঞ্চল দৃষ্টিতে এতক্ষণ নাফিজ যেন একটা ঘোরের মধ্যে ছিল।
তারা আর গাসু পা টিপে টিপে বের হচ্ছে।তারাও খুব সাবধানে ক্রাচ নিয়ে হাটছে।যেই দরজা খুলতে যাবে ঘটলো আরেক বিপত্তি।
----তারা,গাসু দুটো তে এই ভোর বেলা কোথায় যাচ্ছো?
মাহমুদা বেগমের কথা শুনে জ্বিভ কামড়ে তারা পেছনে ঘুরলো।
----আসলে মা ঐ একটু হাঁটতে যাচ্ছিলাম।এখন তো রাস্তায় কোনো লোক নেই।
----সে ঠিকাছে।কিন্তু ঠান্ডা ঠান্ডা পড়ছে।তোমার ঠান্ডা লেগে যাবে।যাওয়া যাবে না।যাও দুজনে ঘরে যাও।
----মা একটু যাই না।বেশিক্ষণ না দশ মিনিট।
তারার অনুরোধের চাহনি দেখে মাহমুদা বেগম আর না করতে পারলেন না।
----আচ্ছা ঠিকাছে।দশ মিনিট ই কিন্তু।বেশিক্ষণ বাইরে থেকো না তোমার আবার গলা ব্যথা করবে।
----আচ্ছা।গাসু চল চল।
দুজনের কান্ড দেখে মাহমুদা বেগম মুচকি হাসলেন।
নাফিজের মনটা কেন যে খারাপ হলো সে নিজেও বুঝতে পারছে না।হঠাৎ করেই সামনে তাকাতে নাফিজের মনটা এক অজানা আনন্দে ভরে উঠলো।ঠোঁটের কোনে হাসির রেখা ফুটে উঠলো।
----আফা মন খুইলা শ্বাস নেন।হামি দেখতাছি।কেউ আইবো না।আইলে ঝাটা পেটা করুম।
----গাসু আজ তো মা দেখে ফেললো।
----হ সেটাই।
----আজ আর যাব না।আরেক দিন গিয়ে খেয়ে আসবো।
গাসু আর তারা দুজনেই আরেকবার রহস্যময়ী হাসি দিল।
লাল রঙের কুর্তি,সাদা রঙের প্লাজু, গলায় সাদা রঙের স্কার্ফ পেঁচিয়ে খোলা চুলে বাগানের মধ্যে ধীরে ধীরে হাটছে তারা।মাঝে মাঝে একটু নিচু হয়ে পরম আবেশের সাথে হাত বুলিয়ে দিচ্ছে তার নয়নতারার গায়ে।
তারার উড়ন্ত কালো ঘন চুল,টোল পড়া হাসি সবকিছু যেন নাফিজের ভেতরে তোলপাড় করে দিচ্ছে।এক নজরে নাফিজ লুকিয়ে তাকিয়ে আছে তারার দিকে।
"নয়নতারা
তুমি কি বলতে পারো
সে কবে আসবে?
কখন আসবে সেই প্রহর।
আমি তার জন্য অধীর আগ্রহে বসে আছি।
অপেক্ষার দিন গুনে চলেছি
প্রতি মূহুর্তে,
সে কি আদৌ আসবে?"