নয়নতারা - পর্ব ২৬ - সুবহান আরাগ - ধারাবাহিক গল্প


নাফিজ বেরিয়ে যেতেই তার একটু পর আবার কলিংবেলের শব্দ।

----এখন আবার কে এলো?

----সৈকত না বাইরে গিয়েছিল।দেখো ও বোধ হয়।

----হুম।দেখছি।

মাহমুদা বেগম দরজা খুলে দেখেন বাইরে সৈকত দাঁড়িয়ে আছে।

----চাচিমা কতো দেরী করলে।আইসক্রিম সব গলে গেল।

----তুই এই সময় আইসক্রিম এনেছিস?

----হ্যাঁ।তারা তো খুব পছন্দ করে।চলো সবাই একসাথে আইসক্রিম খাব।

সৈকত ভেতরে ঢুকতেই মাহমুদা বেগম দরজা লাগিয়ে দিলেন।

----চাচিমা ঐ ছেলেটা কে বেরোতে দেখলাম যে।

----কোন ছেলেটা?

----ঐ যে তুমি আগের দিন তারাকে বকেছিলে না ঐ ছেলেটার জন্য।কি যেন নাম?

----নাফিজ।

----হ্যাঁ হ্যাঁ।উনি কি এখানে এসেছিল?

----হ্যাঁ।তাঁরা কে বিয়ে করবে সেই প্রস্তাব নিয়ে এসেছিল।

----কিহ!একদম ডিরেক্ট বিয়ে!

----হুম।

----তোমরা কি বললে?রাজি হয়েছো নাকি? 

----আমাদের কিছু বলা লাগেনি।যা বলার তারাই বলে দিয়েছে।সত্যি তো।আমার মেয়ে টা অসুস্থ।বিয়ে করবে বললেই হলো নাকি।এতো সহজ এরকম একটা মেয়ের দায়িত্ব নেওয়া।

----হুম তা যা বলেছো।আচ্ছা চলো সবাই আইসক্রিম খাব।

;;;;;

জানালার কাছে দাঁড়িয়ে আছে।চোখ দুটো নিজের অজান্তেই আজ ভিজে উঠলো তারার।বুকের ভেতর চাপা অভিমান কাজ করছে তারার।

সুদূরের সেই মেহগনির গাছের তলাটা আজ ও ফাঁকা।মাটির ওপর থাকা সাইকেলের চাকার ছাপ গুলো ও মুছে গেছে।মুছে তো যাবেই আজ নিয়ে বেশ কদিন তো হলো কেউ এসে ওখানে সাইকেল টাকে শুইয়ে রাখেনি।ফোনটা হাতে নিল তারা।

"তুমিই নিজেই আমাকে ডাকবে তারা,তুমি না জানলে ও আমি জানি আমি তোমার কাছে বাইরের কেউ নই খুব কাছের কেউ।খুব বেশি কাছের।আচ্ছা তারা রাতের বেলা ঘুমানোর আগে একবার কি মনে পড়বেনা তোমার একবার কি চোখ যাবে না তোমার ফোনের দিকে?একবার কি তোমার মনে হবে না এই গভীর রাতেও ফোনের স্ক্রিনের আলোটা জ্বলে উঠবে।কারোর মেসেজ টোন বেজে উঠবে।অথবা কারোর কল!তুমি ঘুমাতে পারবে তো তারা আমার সাথে কথা না বলে?তারা সকাল টা কি তোমার খুব ভালো কাটবে ভেবেছো?উহুম।একটু ও না।সকালটা তোমাকে আমি ভালো কাটাতে দেব না।তোমার কি একবার চোখ যাবে না সামনের রাস্তার দিকে?একবার কি মনে পড়বে না ঐ মেহগনি গাছের আড়ালে দাঁড়িয়ে কেউ অপেক্ষা করত ঘন্টার পর ঘন্টা শুধু তোমাকে দেখবার জন্য!মনে পড়বে তারা।তারা তোমার মনে আছে সেদিন রেস্টুরেন্টে তুমি কেন গিয়েছিলে?তাও আমার মতো অচেনা মানুষের সাথে?সে কথাটা বাদ ই দিলাম।এটা ভেবে দেখোতো কেন তুমি কলেজ ফাকি দিয়েছিলে?তোমার কি মনে পড়বে না তারা!আমার সামান্য কথা তোমার খারাপ লেগেছিল বলে মুখ ভার করে রেখেছিলে।এখন পারবে তো বাকি দিনগুলো আমাকে না দেখে আমার সাথে কথা না বলে কাটাতে?তোমার জায়গায় তুমি ঠিক তারা।আসলেই কেউ চাইবে না একজন অসুস্থ মেয়েকে নিজের জীবনসঙ্গী করতে।তোমার কথা মতো চাওয়াটা নিত্যন্ত হাস্যকর, কিন্তু কেউ যদি মন থেকে চায়!মনের গভীর থেকে চায়?তবুও কি বলবে এটা হাস্যকর?তুমি বললে তোমাকে কেউ ভালোবাসবে না।কিন্তু কেউ যে ভালোবেসেছে সেটাকেও তুমি অপরাধ করে দিলে!

তুমি পারবে না তারা।আমার কথা মিলিয়ে নিও।তুমি সত্যি পারবে না।তোমার চোখের কোনে যদি আমার জন্য এক ফোটা পানিও আসে না তারা আমি সেদিন আসব।তোমার ভালোবাসার টানে আসব।ভালো থেকো।

ভালোবাসার প্রেয়সী,

ভালোবাসা দিলাম এক টুকরো,

তুমি যতনে রেখে দিও।

ভালোবাসি প্রেয়সী।"

                                  -----ক্যাপ্টেন 

         

মেসেজ টা দেখে আরো কষ্ট হচ্ছে তারার।সেদিন নাফিজ চলে যাওয়ার পর রাতে নাফিজ তারাকে এই মেসেজ টাই দিয়েছিল।তারা কিছু রিপলাই দেবে তার আগেই নাফিজ হয়তো তারার নাম্বার ব্লাকলিস্টে দিয়ে দিয়েছিল।যার জন্য মেসেজ কল কোনটাই আর যায়নি।কষ্ট টা আরো বেড়ে গেল তারার।

----এই আপনি ভালোবাসার কথা বলেছিলেন।আমার নাম্বার টা ব্লাকলিস্টে দিয়ে দিলেন আপনি!আপনি খুব খারাপ ক্যাপ্টেন খুব খারাপ।

তারা ফোনটা বিছানায় ছুড়ে মারলো।পড়ার টেবিলে বসে গেল।একটু পর আবার তাকে কলেজের জন্য বের হতে হবে।তার এক্সাম শুরু হয়েছে যে।

;;;;;

ডাইনিং টেবিলে বসে সৈকত খাবার খাচ্ছে।পাশে মাহমুদা বেগম বসা।

----সৈকত তারা এখনো এলো না যে?

----আসবে আসবে।হয়তো রিভাইজ করছে।

----বুঝলাম না কি হলো ওর।কদিন ধরে সব সময় মন খারাপ করে বসে থাকে।না খাওয়াতে মন।না পড়াশোনা তে।কাল ওর ম্যাথ টিচার তোর চাচুকে ফোন করেছিল।যে মেয়ে ম্যাথে কখনো  ৯০ এর নিচে মার্ক পায় না সে এবারের পরীক্ষা তে ৪৪ পেয়েছে।বুঝতে পারছিস কি অবস্থা!

----কি বলো টাকি।তারা এতো কম নম্বর পেয়েছে!

----হ্যাঁ সেটাই।ওর কি হয়েছে আল্লাহ্ ভালো জানেন।আমার মনে হয় ওকে একটু ডাক্তার দেখানো দরকার।আবার বেশি অসুস্থ হলো কি না।

----চাচিমা ওকে ডাক্তার দেখিয়ে লাভ নেই।তুমি নিজেও ডাক্তার।তুমি বলো এসব কি কোনো রোগের লক্ষণ?

----তাহলে?

----তোমার মেয়ের শরীরের না মনে রোগ হয়েছে।পারলে ঐ মনের ডাক্তার কে ধরে আনো।দেখবে সব ঠিক হয়ে যাবে।

----মানে!

এর মধ্যে ই তারা ওপর থেকে নেমে আসলো।এসে মাহমুদা বেগমের পাশের চেয়ারে বসে কারোর সাথে কথা না বলে নিজের মতো খাবার বেড়ে নিল।মাহমুদা বেগমের বিষয়টা একদম ভালো লাগছে না।তারার সামান্য ব্যথা তিনি সহ্য করতে পারেন না।আর তারার এখন এরকম মুখের ভাব তার একদম ভালো লাগছে না।

----তারা মা।

----হুম।

----কি হয়েছে তোর মা?এরকম চুপচাপ হয়ে থাকিস কেন সব সময়।কেমন উদাস হয়ে থাকিস।কোনো সমস্যা হয়েছে?মাকে বল।

----কিছু হয়নি মা।

----কিছু তো হয়েছে।তোমার স্যার বললো তুমি এবার ম্যাথে ৪৪ পেয়েছো।কেন মা?তোমার কি পড়া বুঝতে অসুবিধা হচ্ছে?তুমি তো কখনো এরকম খারাপ রেজাল্ট করো না।

----জানিনা।

তারা আর কথা না বাড়িয়ে নিজের খাওয়াতে মনোযোগ দিল।মাহমুদা বেগম সৈকতের দিকে তাকালো।

----এই তারা তুই ম্যাথে ৪৪ পেয়েছিস!ছি ছি ছি!এবার দাদু বাড়ি গিয়ে সবাইকে বলে দেব আমি।সব সময় বলতি না তুই ম্যাথে কখনো কম পাস না।

----কেন ছি ছি করার কি আছে?আমি যে অন্যবার ভালো নম্বর পেয়েছি বলে সব সময় যে এটা পাব এটা কি কোনো শাস্ত্রে লেখা আছে?নাকি এটা আমার জন্য আইন হিসেবে সংবিধানে লেখা হয়েছে।

তারা বেশ রেগে কথাগুলো বললো।তারার এমন রূপ দেখে সৈকত মাহমুদা বেগম দুজনেই অবাকের চূড়ান্ত পর্যায়ে।তারার মুখ দিয়ে এরকম কথা তো দূরে থাক তাকে কখনো রাগতে দেখেনি তারা।এতোটাই শান্তশিষ্ট মেয়ে সে।অথচ আজ!

;;;;;

একটা বেজে গেছে।

পরীক্ষার খাতা জমা দিয়ে হল থেকে বেরিয়ে এলো তারা।বাইরে বেরিয়েই দেখে সৈকত আর গাসু দাড়িয়ে আছে।

----গাসু তোমার স্কুল শেষ?

----হ।এর লাগি সাকি ভাইয়ার সাথে আপনেরে লইতা আইছি আফা।

----তারা চল চল।

----হুম চলো।

সৈকত আগে আগে গিয়ে গাড়িতে বসলো।তারা ধীরে ধীরে হাটছে গাসু তার পেছনে বকবক করতে করতে আসছে।

তারা মাথা নিচু করে হাটছে।রোদের তীব্রতা ঘেমে যাচ্ছে তারা।বুকের ধুকপুকানি টা হঠাৎ ই যেন বেড়ে গেল তারার।তারা দাড়িয়ে গেল।

----আফা কি হইচে?খাড়ান কেন?

----কিছু না।গাসু তুমি আগে আগে যাও।অনেক ক্ষণ এক্সাম হলে বসে ছিলাম তো তাই পা একটু ব্যথা করছে।

----হায় হায় গড।কি কইলেন?

----কোনো সমস্যা না গাসু।আমি একটু আস্তে আস্তে যাচ্ছি।তুমি যাও।

----আইচ্ছা।

গাসু পা চালিয়ে সামনের দিকে যাচ্ছে।তারা দাড়িয়ে এদিক ওদিক চোখ বুলাচ্ছে।তারার কেন যেন মনে হচ্ছে কেউ এক দৃষ্টিতে তারার দিকে তাকিয়ে আছে।এদিক ওদিক তাকাতেই হঠাৎ করে চোখ আটকে গেল তারার।

আজ পনেরো দিন পর।সেই চিরচেনা মুখ।ইউনিফর্ম পরিহিত ক্যাপ্টেন নাফিজ।পিকাপে বসে আছে।তারাদের গাড়ির সোজা সুজি একটু দূরে নাফিজের গাড়ি দাড়িয়ে।এক ফালি রোদ নাফিজের মুখের ওপর পড়েছে।ঘর্মাক্ত মুখমণ্ডল লাল হয়ে আছে নাফিজের।কিন্ত দৃষ্টি তার তারার দিকে।একদম যেন চোখে চোখ পড়েছে তারা আর নাফিজের।রোদ পড়াতে নাফিজের উদাস চেহারাটা আরো স্পষ্ট হয়ে ফুটে উঠেছে তারার সামনে।কদিনেই যেন চোখ মুখ কেমন শুকিয়ে গেছে নাফিজের।মন মরা ভাব।একদম বিষন্ন চেহারা।আর দৃষ্টি!

"চোখ যে মনের কথা বলে"

গানের সুর হলেও আসলেই যেন তাই।নাফিজের ছলছল চোখ দুটো রোদে আরো জ্বলজ্বল করছে।চোখ দুটো বলেই দিচ্ছে তার শত অভিমান না বলা কথা গুলো।

নাফিজ কে দেখে তারার বুকের ভেতরটা যেন কামড় দিয়ে উঠলো।

----ক্যাপ্টেন।

তারা নাফিজের দিকে তাকিয়ে হাঁটা শুরু করেছে তার আগেই গাড়ি ঘুরিয়ে চলে গেল নাফিজ।তারা আর ধরতে পারল না।

----ক্যাপ্টেন।

চোখ দুটো ভিজে উঠলো তারার।নাফিজ গাড়ি ঘুরিয়ে চলে গেল।একবার ও তার সাথে কথা বললো না।মেনে নিতে কষ্ট হচ্ছে তারার।পরক্ষণেই আবার এটা ভাবলো তারা, কেন এসেছিল তাহলে নাফিজ।তাও তার কলেজের সামনে।সত্যি সত্যি কি নাফিজ তাকে ভুলে গেছে?ফোন না একদম মনের ব্লাকলিস্টে রেখে দিয়েছে?

;;;;;

বিকেল বেলা।

আজ ও বৃষ্টি হচ্ছে।শীতের মধ্যে ও আজ আবার বৃষ্টি।

তারা বিছানায় বসে জানালার দিকে তাকিয়ে আছে।তারার আজ খুব মনে পড়ছে নাফিজকে।এই তো সেদিন ও এইরকম বৃষ্টিতেই নাফিজের সাথে তারা শেষবারের মতো কথা বলেছিল একদম নির্জনে।আরো আজ এতোদিন পর নাফিজের মুখটা দেখেছে তারা।কতোই না মায়াবী লাগছিল সেই মুখ।ছেলেদের মুখের দিকে তাকালে হয়তো মায়াটা খুঁজে পাওয়া যায় না।কিন্তু কেউ যদি প্রচন্ড কষ্টে থাকে তার মায়াটা ঠিক ভেসে উঠবে।

----ঐ তারা কি করছিস?

সৈকতের গলা শুনে দরজার দিকে তাকালো তারা।সৈকত দাড়িয়ে আছে দরজার কাছে।

----ভাইয়া তুমি।ভেতরে এসো।

----না ঘুমোতে যাব।

----এখন!

----হ্যাঁ রে।আরো আগে ঘুমাতে যেতাম।কিন্তু বৃষ্টি দেখে ভিজতে মন চাইলো।তাই ছাদে গিয়েছিলাম।এখন ফ্রেশ হয়ে এক জব্বর ঘুম দেব।

----ওহ।

----তুই না ঘুমিয়ে বসে আছিস কেন?

----এমনি।ভালো লাগছে না।

----ভালো না লাগলে একটু ছাদ থেকে ঘুরে আয়।

----কেন?

----কেন আবার? বৃষ্টির মধ্যে,ঠান্ডা হাওয়া,এক ঠান্ডা অনুভূতি।তারপর যদি আরো স্পেশাল কিছু থাকে তাহলে আর মন খারাপ তো মন খারাপ।মন খারাপ ব্যাগ গুছিয়ে বাপের বাড়ি চলে যাবে।

----স্পেশাল কিছু টা আবার কি?

----উহ।বড্ড প্রশ্ন করিস তুই।শোন তোর যেতে ইচ্ছে হলে যা।এখন ফিসফিসিয়ে যা বৃষ্টি পড়ছে।ভালোই লাগবে।এজন্য বললাম।ইচ্ছে হলে যা না হলে থাক।আমি গেলাম ঘুমোতে।

সৈকত হাই তুলতে তুলতে চলে গেল নিজের ঘরের দিকে। 

তারা বসে কিছুক্ষণ ভাবলো।আসলেই ছাদে একটু ঘুরে আসলে মন্দ হবে না।বিকেলবেলা বাইরে আরো বৃষ্টি।সবাই নিশ্চয়ই ঘুমোচ্ছে।তাই ছাদে গেলে কারোর চোখেও পড়বে না।তারা বিছানা ছেড়ে ক্রাচ নিয়ে উঠে দাড়ালো।ঘর থেকে বেরিয়ে ছাদে যাওয়ার উদ্দেশ্যেকরে সিঁড়ির দিকে পা বাড়ালো।

;;;;;

ছাদের ওপরের ফুল গাছ গুলোর ওপর ফোটা ফোটা পানি জমে আছে।এখনো ফিসফিসিয়ে বৃষ্টি পড়ছে।ছাদ টা বড্ড পিছলা হয়ে আছে ।তারার বড্ড ভয় করছে পা ফেলতে।তবুও একটা ভালো লাগা কাজ করছে তারার।চুলগুলো খোলা রেখেছে তারা।ঠান্ডা বাতাসে একটু একটু করে উড়ছে চুল গুলো।চোখ বুজে তারা বাতাসের প্রতিটি ছোঁয়া অনুভব করছে।

হঠাৎ করেই হাতে টান পড়লো তারার।দেয়ালের প্রায় কাছাকাছি দাড়িয়ে ছিল সে।এতো টাই জোরে টান পড়লো তারার হাত থেকে ক্রাচ টা ছুটে গেল।মূহুর্তেই কেউ যেন তারাকে টান দিয়ে দেয়ালের সাথে মিশিয়ে দিল।তারার পিঠ দেয়ালে গিয়ে লাগলো।তারা ভয় পেয়ে চোখ বুজে ফেলেছিল।

----শীত কালে বিয়ে করার মধ্যে না একটা বিশেষ মাধুর্য আছে।আমি যে সেই সময় টা একদম নষ্ট করতে চাই না তারা।

কন্ঠস্বর শুনে কেঁপে উঠলো তারা।সামনের ব্যক্তিটি তার হাত দুটো দিয়ে তারার দুই হাত অনেক আগেই নিজের হাত দিয়ে বেধে রেখেছে।

তারা ভয়ে ভয়ে চোখ খুললো।মাথা উঁচু করে তাকাতেই তারার মুখ দিয়ে অস্ফুটস্বরে বেরিয়ে এলো,

----ক্যাপ্টেন!

;;;;;

নাফিজকে নিজের সামনে দেখে তারার বুকটা কেঁপে উঠলো।তারার চাহনি শুধু নাফিজের দিকে।নাফিজ এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে তারার দিকে।যেন কতকাল পরে সে দেখছে তারাকে।এক প্রকার চোখের তৃষ্ণা মেটাতে ব্যস্ত নাফিজ।

বৃষ্টিতে নাফিজের খাড়া চুলগুলো ও ভিজে গেছে।সামনের দিকে কপালের সাথে লেপ্টে গেছে কিছু চুল।মুখেও পানির ফোটা।তারার হার্টবিট যেন বেড়েই যাচ্ছে।নাফিজ তারার একদম কাছেই দাড়িয়ে আছে।

----কি মনে আছে কি কাউকে?কেউ ছিল সেটাও কি ভুলে গেছো?তোমাকে আজ আচ্ছা মতো বোঝাবো এই কেউটাকে ভোলার পরিণাম।

নাফিজের কথা শুনে কেঁপে উঠলো তারা।তারার কাঁপুনি দেখে নাফিজ আরো শক্ত করে তারার বাহু ধরলো।তারা যেন আরো একবার বিদ্যুৎ এ শক খাওয়ার মতো কেঁপে উঠলো।

----ক্যাপ্টেন আপনি এখানে!

---- ওহ যাক একদম ভুনা করে লেবু দিয়ে মেখে খেয়ে ফেলো নি।হাড্ডি গুলো চিবুনোর জন্য এখনো অবশিষ্ট রেখেছো।

নাফিজের কথা শুনে তারা বেশ অবাক হলো।এরকম উদ্ভট টাইপের কথা অবাক হওয়ারই কথা।নাফিজের চোখের দিকে তাকিয়ে আবার ঢোক গিললো তারা।নাফিজের চোখে স্পষ্ট রাগ,চাপা অভিমান সব যেন ফুটে উঠেছে।

----কি হলো কথা বলছো না কেন?

----আপনি এখানে কি করে এলেন?

----তুমি কি ভুলে যাচ্ছো আমি একজন আর্মি অফিসার।উপরে ওঠা ওপর থেকে লাফ দেওয়া এগুলো আমার কাছে কিছুই নয়।

----কেন এসেছেন এখানে?যান এখান থেকে।বাপি মা চলে আসবে।

----আসুক।তাতে আমার কি?

----হাত ছাড়ুন আমার।আপনি কিন্তু লিমিট ক্রস করছেন।

----লিমিট কিছুই ক্রস করিনি।কিন্তু এখন করব।এমনভাবে করব আমার খাচা ছাড়া আর কোথাও তোমার জায়গা হবে না বলে দিলাম।

----পাগল হয়ে গেছেন আপনি?

----অনেক আগেই হয়েছি।এখন শুধু তোমাকে নিয়ে পাবনা যাওয়া বাকি।

----কিহ!

----আমাকে বিয়ে করবে কি না বলো?

----মানে?

----তোমাকে আমার তিন নম্বর বাচ্চার মেজ ভাইয়ের বড় বোনের মা বানাব।

নাফিজের কথা শুনে তারা হা হয়ে নাফিজের দিকে তাকিয়ে আছে।

----হা করে আমার রূপ দেখতে বলিনি।হ্যাঁ কি অবশ্যই হ্যাঁ এটা বলো।

----এটা আবার কোন ধরনের ফাজলামি?

----ফাজলামি এতোদিন অনেক করেছো।আজ তোমার খবর আছে।

----আপনি আমার হাত ছাড়ুন বলছি।না হলে কিন্তু আমি চেঁচিয়ে বাপি মা কে ডেকে আনব।

----বিয়ে করবে কি না বলো?

----আপনি অনেক বড় ভুল করছেন।

----কিসের ভুল?নিজে তো খুব বলতে পারো আমার মতো মেয়েকে কেউ ভালোবাসতে পারে না।ঠিকাছে মানলাম পারে না।কিন্তু কেউ বাসলে সেটাকে কেন অস্বীকার করছো?

----আপনি চলে যান এখান থেকে।

----আমি তো এখানে আসিনি।তুমি আমাকে ডেকে এনেছো?

----কখনো না।আমি কখন আপনাকে ডাকলাম!

নাফিজ এবার নিজের একহাত দিয়ে তারার গালে স্পর্শ করলো।তারার কাপুনিটা আরো বেড়ে গেল।তারা চোখ বুজে ফেললো সাথে সাথে।এর মধ্যে নাফিজ হাত নামিয়ে ফেললো।

----তোমার মনে আছে তারা।আমি বলেছিলাম না তুমি নিজে মুখে আমাকে ডাকবে না।কিন্তু ঠিক ডাকবে।সত্যি বলোতো প্রতিদিন সকালে জানালার কাছে দাঁড়িয়ে দূরের মেহগনি গাছের দিকে তাকিয়ে কেন চোখের পানি ফেলতে?কেন উদাস হয়ে থাকো সব সময়?কেন ফোনে আজো আমার দেওয়া মেসেজ গুলো রেখেছো।কেন প্রতি রাতে মেসেজ গুলো পড়ে আরেকবার চোখ ভেজাও।আর আজ কেন কলেজে ঐ ভাবে তাকিয়ে ছিলে আমার দিকে?বলো।

তারা এবার চোখ খুলে নাফিজের দিকে তাকালো।নাফিজের চোখে পানি এসেই গেছে।তারার চোখ দুটো ও ছলছল করে উঠলো। 

----তুমি কি অস্বীকার করতে পারবে তারা আমার জন্য কোনো অনুভূতি নেই তোমার মনে ?কি হলো বলো?

----আপনি চলে যান ক্যাপ্টেন।

----আমি আমার উওর চাইছি তারা।

----চলে যান আপনি।বললাম না শোনেন না আপনি।কেন নিজের জীবন টা নষ্ট করতে চাইছেন?

----এতক্ষণ ধরে অনেক ভালো ভাবে বোঝালাম তারা।কিন্তু তুমি শুনলে না।এখন আমিও নিরুপায়।এখন যেটা করতে চাইছিলাম না সেটাই করতে হবে আমাকে।

----মানে!কি করবেন আপনি?

----একটা ভয়ঙ্কর কাজ।এর পরে তুমি আর না করতে পারবে না।তোমাকে আমার ই হতে হবে।

কথা গুলো বলেই নাফিজ শক্ত করে তারার দুই বাহু আবার চেপে ধরলো।তারা ছটফট করছে ছাড়ানোর জন্য।নাফিজ ক্রমশ ই এগিয়ে যাচ্ছে সামনে থাকা গোলাপের পাপড়ি দুটোর দিকে।

----ক্যাপ্টেন থামুন বলছি।আপনি এমন কিছু করবেন না।ক্যাপ্টেন!

;;;;;

বৃষ্টি থেমে গেছে।আসরের আজান দিয়ে দিয়েছে।আব্রাহাম সাহেব ঘুম থেকে উঠতেই মাহমুদা বেগম সৈকতকে নিয়ে ঘরে আসলেন।

----শোনো।

----হুম বলো।

----কোথায় যাচ্ছো?

----নামাজ পড়তে হবে না।ওজু করতে যাচ্ছি।

----একটু পরে যাও।

----কেন?

----সৈকত কি বলবে নাকি আমাদের।সেই কখন থেকে অপেক্ষা করছে।তুমি তো ঘুমিয়ে ছিলে।

----কি রে সৈকত কি বলবি?

সৈকত গিয়ে খাটের ওপর বসলো।মাহমুদা বেগম ও ঘরের কোনের চেয়ারটা টেনে বসলেন।

----চাচু চাচিমা শোনো আগে খুব ভালো করে আমার কথা শুনবে।তারপর উওয দেবে।অযথা রাগ করবে না।

----কেন?কি এমন বলবি যে রাখ করব আমরা!

----আছে চাচিমা।

----আহ মাহমুদা।বলতে দেও ওকে।

----নে বল।

----আচ্ছা চাচু তারার জন্য কিছুদিন আগে একটা ছেলে নিজে প্রস্তাব এনেছিল না।মনে আছে তোমার?ঐ যে ক্যাপ্টেন নাফিজ।

----হ্যাঁ কেন?কি হয়েছে?

----তোমরা মেনে নিলে না কেন বলতে পারো আমাকে?

সৈকতের কথা শুনে আব্রাহাম সাহেব আর মাহমুদা বেগম একে অপরের মুখ চাওয়া চাওয়ি করলেন।

----কেন কি হয়েছে?

----আগে আমার কথার উওর তো দেও।

----দেখ তারা রাজী না।আর তার চেয়ে বড় কথা তারার মতো অসুস্থ মেয়েকে ও কেন প্রস্তাব দেবে বলতো?

----অসুস্থ মেয়েকে প্রস্তাব না দেওয়াটা দোষের।দেওয়াটাকেও কেন দোষের বলছো?

সৈকতের কথা শুনে চুপ হয়ে গেলেন আব্রাহাম সাহেব।

----দেখ সৈকত ছেলেটার বয়স দেখেছিস!তারার থেকে কত বড়।

----কত আবার দশ বছরের বড়।তো?ওকে দেখলে কি মনে হয়?আর মেয়ে র বিয়ে দিতে গেলে তো সব সময় ভালো এসটাবলিশ ছেলে চাও তোমরা।তাহলে?অনার্স পাশ করে বেরোলেই কিন্তু সবাই একটা ভালো চাকরি পায় না।একটা ভালো পজিশনে যেতে গেলেও অনেক কষ্ট যেমন করতে হয় তেমন বয়স ও বেড়ে যায়।এই দেখোতো আমার নিজের ই তো সাতাশ চলছে।তাহলে?ছেলে এসটাবলিশ দেখবে আবার বয়স পচিশের কোঠায় চাইবে এটা কিভাবে সম্ভব বলো?

----সেটা ঠিক।

----তাহলে?আর চাচু তুমি নিজেই একজন আর্মি অফিসার।একটা ভালো পর্যায়ে যেতে গেলে তো বয়স বেশি হবেই।

----সব তো বুঝলাম।কিন্তু তুই এই কথা কেন বলছিস ?

----তারার দিকটা দেখেছো?কদিন ধরে না ঠিক মতো খায় না পড়াশোনা করে।সব সময় জানালার ধারে উদাস হয়ে দাড়িয়ে থাকে।কেন বোঝো?

----কেন?

----চাচু তোমার মেয়ে প্রতিদিন সকালে জানালা দিয়ে রাস্তার দিকে তাকিয়ে থাকে।চোখের পানি ফেলে।ঐ রাস্তা দিয়ে তো এ কদিন সকাল বেলা ঐ ক্যাপ্টেনের সাথে চলাফেরা করতো।তারার ও না ঐ নাফিজকে নিয়ে মনে কিছু আছে।না হলে তুমি বলো পরীক্ষা তে তাই সে টেনে টুনে পাশ করছে।কোন পর্যায়ে গেছে ও!

----কিন্তু তারার যদি নাফিজকে ভালো লেগেই থাকে তাহলে ও এতো দিন জানায়নি কেন?

----চাচিমা তোমার বিয়ের সময় কি তুমি তোমার বাবা কে বলতে পেরেছিলে তুমি বিয়ে তে রাজী কিনা?

----এত দূর গড়িয়েছে অনেক আগেই আন্দাজ করেছি আমি।আমার মেয়েটা দিন দিন শুধু মন মরা হয়ে থাকে।

----শোনো আজ নাফিজ আসবে।

----কেন?

----আমি আসতে বলেছি।উনি নিজেও তো ভালো নেই।আমার থেকে তো প্রতিদিন তারার খোঁজ নিত।

----তোর থেকে!

----হ্যাঁ।

----আমি ও তো দেখি নাফিজ অফিসেও কেমন অন্যমনস্ক হয়ে থাকে।

----চাচু আমার মনে হয় এগোনো উচিত।ছেলেটা সত্যি তারাকে ভালোবাসে।আমি নিজেই তো শুনেছি তারার থেকে ছেলেটা কতো কেয়ার করে তারার।

----আমার যে ভয় হয় সৈকত।আমার মেয়েটাকে যদি ও কষ্ট দেয়।ছোট থেকেই এমনিতেই না জানি কতো কষ্ট পেয়েছে।যেদিন ওকে পেয়েছিলাম ওর শরীরের মারের দাগ দেখে বুক কেপে উঠেছিল আমার।আজ ও যেন আমার চোখের সামনে ভাসা ছোট্ট হাত পায়ের ঐ দাগ গুলো।সেই থেকে আজ অবধি কখনো ওকে মারা তো দূরে থাক জোরে কথা বলিনা আমি ওর সাথে।

----চাচু তুমি তো কাছ থেকেই দেখো ঐ ছেলেটাকে।তুমি বলো ও কেমন?

----নাফিজ ছেলেটা সত্যি অনেক ভালো।ইউনিটে যেমন নামডাক আছে তার থেকেও অনেক বেশি ভালো।এতো মেয়ে কলিগদের সাথে কাজ করে কখনো দেখি না কাজের বাইরে কারোর সাথে কথা বলে।আর বড়দের ও যথেষ্ট সম্মান করে।আজান শুনলেই হলো কাজ ফেলে আগে নামাজে ছুটে।ও সত্যি অনেক ভালো ছেলে।

----তাহলে সমস্যা কোথায়?

----আমার তারা সুখি হবে তো?

----চাচু সুখের কথা আল্লাহ ছাড়া কেউ বলতে পারে না।তারা ছোট থেকে অনেক কষ্ট পেয়েছে।এখনো পাচ্ছে।ঠিকমতো চলতে পারে না।আল্লাহ নিশ্চয়ই এতো টা অসুখী ওকে করবেন না।আজ নাফিজ আসবে।তোমরা কথা বলবে ওর সাথে।

----কিন্তু তারা?

----ও রাজী হয়ে বসে আছে।

----কিভাবে?

----ওতো ভেবো না তো।তোমার মেয়ে যথেষ্ট জেদী।সামনে জেদ দেখাবে আর তলে তলে দেখো একদম এক আর্মিকে পটিয়ে বসে আছে।

----আচ্ছা ঠিকাছে।

----তাহলে একটু গোছগাছ করো।

----ও কি ওর মা বাবাকে নিয়ে আসবে?

----হ্যাঁ।আজ একদম প্রস্তুত হয়েই আসবে ওরা।

----আচ্ছা।দেখি তাহলে একটু নাস্তা বানাতে হবে তো।আগের দিন তো ছেলেটাকে কিছু মুখেও দিতে দেইনি।

----যাও যাও।

মাহমুদা বেগম উঠে গেলেন।সৈকত ও উঠে পিছু পিছু গেল।

;;;;;

ভেজা জামা কাপড় বদলে হাঁটুতে মুখ গুঁজে বসে আছে তারা।বিকেলের কথা মনে পড়তেই আবার কেপে উঠছে সে।

----আমি তো সামান্য কথাই বললাম তারা।তুমি তো দেখছি নিজে নিজেই প্রস্তুতি নিয়ে বসে আছো।করব নাকি ভয়ঙ্কর কিছু।

নাফিজের বলা কথাগুলো এখনো বাজছে তারা কানে।

না নাফিজ কোনো ভয়ঙ্কর কাজ করেনি।সে তো চায়না এভাবে তার প্রেয়সীকে পেতে।প্রেয়সীকে নিজের করে একদম তিন কলমা পড়ে পাওয়ার জন্য সে আরো অপেক্ষা করতে রাজী।

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন