শ্রাবণকে অদ্ভুত ভাবে অবলোকন করতে থাকে আলিয়া। যতোক্ষণ শ্রাবণের অবয়ব দেখতে পেল আলিয়া, ততোক্ষণই সে শ্রাবণের যাওয়ার দিকটায় তাকিয়ে ছিল।
আলিয়া সামনে পা বাড়ালো। সুনসান রাস্তা, নিস্তব্ধতায় ঘেরা রাত।মেইন রোড দিয়ে গাড়ি সাই-সই করে যাওয়া-আসা করছে৷
আলিয়া সেদিকে কিছুক্ষন তাকিয়ে থেকে রাস্তার সাইড ঘেঁষে হাটা ধরল। আলিয়ার ধানমণ্ডি একালার রাস্তাগুলো কেন যেন খুব ভালো লাগে। প্রশস্ত রাস্তা। মানুষ-জন আর গাড়ি দিয়ে ভরা থাকলেও, খুব ভালো লাগে আলিয়ার। সে সমানেতালে জোড়ে জোড়েই হাটছে।
সারা রাস্তা জুড়ে ল্যাম্পপোস্ট। ল্যাম্পপোস্টের সোডিয়াম আলো চারিদিকে ছড়িয়ে পড়েছে।সবকিছুতেই একটা হলদে ভাব লেগে আছে। গাছের পাতা গুলোকেও হলুদ লাগছে!!!
জোড়ে জোড়ে হাটার ফলে আলিয়ার শরীরে কিছু ক্লান্তিরা এসে হানা দিল যার দরুণ সে রাস্তার ধারে থেমে যায় এবং বড় বড় করে শ্বাস নিতে থাকে।
তখনই তার সামনে আরহানের গাড়ি এসে থামল। আরহান কোন রকমে গাড়ি পার্ক করে আলিয়ার কাছে এসে কিছুটা আহত গলায় বলে, তুই এভাবে চলে আসলি কেন? জানিস আমি কতোটা টেনশনে পড়ে গিয়েছিলাম?হুট করে রেস্টুরেন্ট থেকে বেরিয়ে এলি কেন? কিছু হয়েছিল? আয়ান কিছু বলেছে তোকে?
আলিয়া মাথা নিচু করে বলে, নাহ। এমনি ভালো লাগছিল তাই চলে এসেছি ওখান থেকে৷
আরহান আলিয়ার কাছে এসে দাঁড়িয়ে বলে, আমি জানি আয়ান আসায় তুই প্রচন্ড রেগে গিয়েছিলি। আমাকে ক্ষমা করে দে। আমার উচিত ছিল তোর কাছ থেকে পারমিশন নিয়ে আয়ানকে ডাকা৷
আলিয়া স্মিত হেসে বলে, ইটস ওকে। আমরা ভাই-বোন বের হয়েছিলাম, সেখানে অন্যকাউকে আসতে বলা তোর ঠিক হয় নি।
আরহান আলিয়ার কথায় কিছু একটা ভাবতে শুরু করে। আলিয়ার কি আয়ানকে অন্য কেউ বলা ঠিক হলো? কিছু দিন পর আয়ান আলিয়ার জীবনের সবটা জুড়ে থাকবে, তাহলে কি আলিয়া এখনো আয়ানকে মানতে পারি নি?
আলিয়া ভাইয়ার দিকে তাকিয়ে বলে, কি ভাবছিস?
--কিছু না। তোর জন্য রেস্টুরেন্ট থেকে খাবার প্যাকেট করে এনেছি। বাসায় গিয়ে একসাথে খাব।
--বাবার জন্য নিস নি?
আরহান গাড়ির লক খুলতে খুলতে বলল, যে পরিমাণ খাবার আছে সেটায় ইজিলি তিন জনের হয়ে যাবে। ভেতরে ঢুক।
--হুম।
আলিয়া গাড়ি তে উঠে বসল। গাড়ি চলতে শুরু করল। গাড়ি স্টার্ট দেওয়ার সঙ্গে সঙ্গে, গাড়ি থেকে কিছু দূরে ফুটপাতের সামনে আলিয়া শ্রাবণ কে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে হতভম্ব হয়ে যায়!
শ্রাবণ হাতে একটা ডাব নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। আলিয়াকে দেখে মুচকি হেসে ডাবের স্ট্রতে চুমুক দিল।
আলিয়ার চোখ পড়ল শ্রাবণের থেকে এক হাত পেছনেই একটা ডাব ওয়ালা ভ্যান নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে।
আলিয়া আরহানের দিকে ঘুরর তাকে ডাক দিয়ে বলে, ভাইয়া ওইটা শ্রাবণ না? ডাব হাতে নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে?
আরহান গাড়ি থামিয়ে বলে, আলিয়া সামনে তো ডাব হাতে নিয়ে কেউ দাঁড়িয়ে নেই।
আলিয়া তার ভাইয়ের আশ্চর্যের দৃষ্টিতে তাকালো। তারপর পুনরায় ডাবওয়ালার দিকে তাকালো এবং চারপাশ ভালো ভাবে লক্ষ করতে লাগে। আসলেই শ্রাবণ তো নেই। তবে কি সে ভুল দেখেছে?
আলিয়া একবার চোখ বন্ধ করল। তারপর একটা দম ফেলে হাতের ভাজ করা কাগজটার দিকে তাকালো। কাগজটা তো আছে। তারমানে শ্রাবণের সাথে তার দেখা হয়েছিল!
আলিয়া আবারো ডাবের ভ্যানটার দিকে তাকিয়ে দেখে নিল। নাহ শ্রাবণ নেই। সে সারা রাস্তা কাগজটা শক্ত করে চেপে ধরে বসে থাকে। শক্ত করে চেপে না ধরলে যদি হারিয়ে যায়?
বাসায় এসে আলিয়া তার পড়ার টেবিলের ড্রয়ারে কাগজের টুকরাটা রেখে দিয়ে ফ্রেস হয়ে খাওয়ার রুমে যায়। তারপর বাবা আর ভাইয়ের সাথে ডিনার সেরে নিজের রুমে যায়।
রুম আসতেই হুট করে কারেন্ট চলে যায়। আলিয়াদের আইপিএস নষ্ট। বাসাটা এতোও বড় না যে জেনারেটর লাগবে।
রহিম আফরোজ থেকে বছর আট আগে জসীম সাহেব এই আইপিএস কিনে এনেছিলেন।
গত সাত মাস ধরে কোন ধরনের সার্ভিসিং না নেওয়ায় কিছু দিন আগে আইপিএস টা নষ্ট হয়ে গেল। আইপিএস এর ব্যাটারি নষ্ট।
আলিয়ার অন্ধকার ভালোই লাগে। শীতের রাতে সারারাত কারেন্ট না থাকলেও সমস্যা নেই তার।আলিয়া রুমের ভিতরে ঢুকে ফোনের ফ্লাশ লাইট জ্বালালো।
হুট করে বারান্দায় সে ঢিল ছোড়ার আওয়াজ পেল৷ তার রুমের বারান্দায় এর আগে কোন দিন সে ঢিল ছোড়ার শব্দ পায় নি। ঢাকা শহরে সাধারণত প্রেমিকদের প্রেমিকার বাসায় এভাবে ঢিল মারতে দেখে যায়। তার এমন কোন প্রেমিক নেই। কিংবা কেউ তার জন্য এতোটাও অস্থির হয়ে বসে নেই!
"তার জন্য কেউ অস্থির হয়ে বসে নেই" এই কথাটা ভাবার সঙ্গে সঙ্গে শ্রাবণের কথা মাথায় নাড়া দিয়ে উঠল৷
আলিয়া দ্রুত পায়ে বারান্দায় গেল। আসলেই কেউ রুমের বারান্দায় ইট ছুড়ে মেরেছে৷ ইটের সাথে একটা কাগজ বাধা।
ইটের টুকরা হাতে নেওয়ার জন্য আলিয়া বারান্দার ভেতরে প্রবেশ করে। তখনি তার পা কিসের সাথে যেন বাধা পেল। সম্ভবত পলিথিনের কোন প্যাকেট জাতীয় কিছু হবে! আওয়াজ শুনে এটাই অনুমান করে নিল আলিয়া। সে ফ্লাশ লাইটে নিচের দিকে ফেলল।
সত্যি একটা নীল কালারের পলিথিন তার বারান্দায় পড়ে আছে৷ সে পলিথিন টা হাতে তুলে নেয়। এবং ইটের টুকরা থেকে কাগজ খুলে নিয়ে ইটটা বাইরে গেটের দিকে ছুড়ে মারে। তার কেন যেন মনে হচ্ছে এইসব শ্রাবণ করেছে।
তার ধারনা ভুল ও হতে পারে। আলিয়া গেটের বাইরের দিকে ফ্লাশ লাইট ধরল কিন্তু কিছুই দেখতে পেলনা। ফ্লাশ লাইটের ধক কম। ওতো দূর আলো পৌছাতে পারেনি। বিধায় কোন কিছু চোখে পড়েনি আলিয়ার। সে হতাশ হয়ে ভিতরে ঢুকে যায়।
তার মিনিট পাচ পর কারেন্ট চলে আসে। ঢাকা শহরে এখন আর ঘন্টার পর ঘন্টা লোডশেডিং হয় না। বরংচ দশ মিনিট এর চেয়ে কম সময়েও মাঝে মাঝে কারেন্ট চলে আসে৷।
আলো জ্বলে উঠায় আলিয়া সব পরিষ্কার ভাবে দেখতে পেল। পলিথিনের ব্যাগের ভেতরে একটা বেগুনে শাড়ি। সিল্ক নাকি জর্জেট তা বোঝা যাচ্ছে না। আলিয়া নিশ্চিত হলো যে শ্রাবণ ই ঢিল ছুড়েছিল।
মনের অজান্তেই শাড়িটার দিকে তাকিয়ে আলিয়ার ঠোঁটে এক চিলকে হাসি ফুটে উঠল। সে পলিথিন টা সরিয়ে শাড়িটা হাতে নিল।
হালকা বেগুনি রঙের শাড়িটা আর পাড়টা মোটা এবং গাড় বেগুনি। ভেতরে সাদা পাথর বসানো।শাড়িটা মসলিনের। খুব ভালো মানের মসলিন তা আলিয়া দিব্যি টের পাচ্ছে। তবে নতুন না শাড়িটা। পুরোনো। বেশ পুরোনো। শাড়িটা থেকে গুমটে এক ধরনের গন্ধ ভেসে আসছে। ভেজা ভেজা ও লাগছে।
আলিয়া লক্ষ করল, শাড়ির মাঝে সামান্য একটা জায়গা ছেঁড়া।
সে শাড়িটা সুন্দর করে মেলে ধরে বিছানার এক পাশে রাখল।
এতো এতো ক্রুটি থাকার পর শাড়িটা আলিয়ার খুব পছন্দ হয়েছে। এক দেখায় খুব মনে ধরেছে তার শাড়িটা। শাড়িটার রঙ টা খুব পছন্দ হয়েছে তার!
আলিয়া এবার কাগজ টা খুললো। এই কাগজটাও স্যাতস্যাতে। ভেজা ভেজা। মনে হচ্ছে পানির উপর রাখা ছিল। একদম ভিজে যায় নি। কিঞ্চিৎ ভিজে গেছে৷ যার ফলে লেখাগুলো থেকে কালি সরে সরে আসছে৷
আলিয়া পড়তে শুরু করে। গোটা গোটা অসুন্দর হাতের লেখা। কাগজের টুকরোয় লেখাটা কিছুটা এমনঃ
শাড়িটা আমার মায়ের।সোনারগাঁও থেকে কেনা। খাটি ঢাকাই মসলিন। প্রায় একশ বছর আগের পুরোনো শাড়ি। আমার দাদার বাপের আমলের এই শাড়িটা বুঝলে? বংশ পরম্পরায় এই শাড়িটা মা পেয়েছিল। এতো দিন আমার কাছে ছিল। আজকে তোমার হাতে হ্যান্ড ওভার করলাম। আমার মায়ের একমাত্র ও শেষ স্মৃতি এই শাড়ি টা। খুব অমূল্য রত্ন এই শাড়িটা আমার জন্য।
একটা কথা কি জানো তুমি?
"অমূল্য রতনকেই অমূল্য রতন দেওয়া হয়!"
আলিয়া চোখ ভিজে উঠতে লাগে। কেন যেন শ্রাবণের মায়ের জন্য একটা অদৃশ্য টান অনুভব করতে লাগলো সে। মায়া টি কি শ্রাবণের মায়ের জন্য নাকি তার ছেলের জন্য? আপাতত এই মূহুর্তে উত্তর টা জানা নেই আলিয়ার।
আরো এক লাইন লেখা আছে কাগজে। সেটা পড়ল না আলিয়া। সে কাগজটা রেখে দিল। তারপর ঠিকানার কাগজটা বের করে গুগল ম্যাপে লোকেশন টা বের করে ফেলে আলিয়া। তার বাসা থেকে বেশ ভালোই দূরে। যাবে কি সে? শ্রাবণ যে তাকে আমন্ত্রণ দিয়েছে? সাড়া দিবে কি শ্রাবণের ডাকে? সবচেয়ে বড় এবং জটিল বিষয় হলো, তার যাওয়া কি ঠিক হবে?
★★★
আলিয়ার বাসার সামনে দাড়িয়ে আছে শ্রাবণ। তার পাশেই দারোয়ান কুদ্দুস বিরস মুখে দাঁড়িয়ে আছে। শ্রাবণ আলিয়া ভিতরে ঢুকে যাওয়ার পর পরই কুদ্দুস মিয়ার কাছ থেকে সিগারেট চেয়ে নিয়েছে। আপাতত সে তৃপ্তি করে সিগারেট খাচ্ছে।
শ্রাবণ সিগারেট ফেলে দিল এবং জলন্ত সিগারেট টাকে পা দিয়ে মুচড়ে দিল। আগুন নিভে গেল।
এরপর শ্রাবণ কুদ্দুস মিয়ার দিকে তাকিয়ে এক গাল হেসে বলে, আপনি দুই বউ নিয়ে কিভাবে আছেন? এই ব্যাপারে যদি কিছু বলতেন খুব উপকৃত হতাম।
কুদ্দুস মনে মনে বিরক্ত হলো। ব্যাটা তার সত্যটা কোন ভাবে জানতে পেরে এখন মাথায় চড়ে বসেছে।
সে মিনমিন করে বলে, আমি দুই বউকেই সমান ভালোবাসি। ওরাও আমাকে ভালোবাসে। আমি তো এইটাই বুঝতে পারছি না তোর এতে এতো কি মাথাব্যথা?
শ্রাবণ ভ্রু কুচকে বলে, প্রথমত, আমাকে আপনি বলে ডাকবেন আর সেকেন্ড ফ্যাক্ট হচ্ছে, অবশ্যই ইটস মাই হেড এক। কেউ পাবে কেউ পাবে না, তা হবে না, তা হবে না ---এই স্লোগানে আমি একমত। আমি একজনকে এতোটা ভালোবাসার পর ও পাচ্ছি না আর আপনি কাউকেই না ভালোবেসে দুইজনের ভালোবাসা পাচ্ছেন এটা আমি ঠিক মেনে নিতে পারছি না। মানতে কষ্ট হচ্ছে আমার। জানেন কুদ্দুস ভাই, দুই-তিন জনের প্রেমে পড়ার চেয়ে, একজনের প্রেমে বারে বারে পড়া খুবই সৌভাগ্যের বিষয়। অনেকেই বলে, নিজের চেয়ে নাকি অন্য কাউকে ভালোবাসা যায় না। আমি মনে করি এটা ডাহা মিথ্যা কথা৷ নিজের চেয়েও বেশি অন্য কাউকে ভালোবাসা যায়! বরং নিজের চেয়ে অন্য কাউকে দ্বিগুন ভালোবাসা যায়!
তারপর এল দন্ডে থেমে।শ্রাবণ বলে উঠে,
ভালোবাসা আপাততদৃষ্টিতে চারটি অক্ষরের সংযোগস্থল। কিন্তু আসলেই কি তাই? আচ্ছা, আমি যদি বলি, ভালোবাসা শুধু চার অক্ষরের তৈরি একটি শব্দ নয়।বরংচ এই চারটি অক্ষরের মাঝেই বিশ্বের সকল অক্ষর লুকিয়ে আছে।সেই অক্ষরগুলি দিয়ে বানানো যাবে হাজারো শব্দ, আবার সেই সব শব্দগুলি দিয়ে বানানো যাবে আরো অনেক বাক্য। বাক্যগুলি দিয়ে রচিত হবে নতুন নতুন গল্প উপন্যাস। সবচেয়ে মজার বিষয় হল আমরা প্রতেক্যেই ভালবাসার অক্ষর দিয়ে লেখা কোন না কোন উপন্যাসের চরিত্র।"
-----Nur
কুদ্দুস মিয়ার মাথায় শ্রাবণের বলা কথার কিছু ই ঢুকল না। তিনি চুপ করে থাকলেন।
শ্রাবণ একবার আলিয়ার রুমের দিকে তাকিয়ে বিড়বিড় করে বলে, শুভরাত্রি আলিয়া!!
আমার একটাই গুপ্ত চাওয়া--একবার যদি তুমি আমায় ছুয়ে দিতে!
★★★
সকাল বেলা উঠেই আলিয়া গোসল সেরে নিল। আলিয়া যেদিন কোথায় বাইরে যায় সেদিনটা করে সকাল সকাল গোসল সেরে নেয়। আর যেদিন বাসায় থাকে সেদিন বেলা করে গোসল করে। আজকে কেন যেন সে আগে আগেই গোসল করে নিল। আজকে শুক্রবার।
সে রান্নাঘরে পা রাখল। বিয়ের আগে আগে মেয়েরা রান্নাঘর মুখী হয়ে পড়ে। কিছুক্ষন পর পর কোন কারন ছাড়াই তারা রান্নাঘরে যাবে। এর কোন বৈজ্ঞানিক ব্যাখা নেই। আলিয়াও রান্নাঘরে গিয়ে দুধ গরম করতে দিল। সেমাই বানাবে। দুধ সেমাই।আলিয়া ঠিক করল, সেমাইয়ে অনেক গুলো বাদাম দিবে। তাহলে স্বাদ দ্বিগুন বৃদ্ধি পাবে।
আলিয়া বাদাম খুব পছন্দ করে। বিশেষ করে কাজু বাদাম আর চিনা বাদাম। কাজু বাদামের দাম অনেক। এক কেজি বারোশ-তের শ করে নেয়। যেহুতু তাদের আর্থিক কোন সংকট নেই তাই বাবা প্রতি মাসেই এক কেজি কাজু বাদাম কিনে আনে। আলিয়া প্রতিদিন পড়ার সময় এক বাটি বাদাম নিয়ে বসে।
এসব ভাবতে ভাবতেই দুধ উপছে পড়ে গেল। সে দ্রুত চুলা বন্ধ করল। কিন্তু দুভার্গ্যবশত দুধ ফেটে গেছে তাই আর সেমাই বানানো হলো না আলিয়ার।
সে নাস্তার টেবিলে গিয়ে বসল। তাদের বাসায় রান্না করার জন্য একজন মহিলা আছে। তিনি পরেটা আর সব্জি দিয়ে গেলেন। আলিয়ায়া খাওয়া শুরু করল।
তার বাবা তখনই খাওয়ার রুমে আসলেন। জসীম সাহেব অনেক আগেই নাস্তা সেরেছেন। সে এখন দোকানে যাচ্ছেন। শুক্রবার বেচা-বাট্টা বেশ জমে।
আলিয়া বাবাকে বলে উঠে, বাবা, আমি একটু পর বের হব। একটা কাজ আছে।
জসীম সাহেব বিনীত গলায় বলে, ঠিক আছে। গাড়ি রেখে যাচ্ছি। তুমি গাড়ি নিয়ে যেও।
--আচ্ছা৷
বাবার যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে আলিয়া রুমে এসে কালো রঙের একটা সালোয়ার কামিজ পড়ে কাগজের টুকরো হাতে নিয়ে বের হলো।
ড্রাইভার কে ঠিকানা বলতেই তিনি গাড়ি চালানো শুরু করল। তার নাকি রাস্তা চেনা। আধ ঘন্টায় পৌছে গেল আলিয়া। রাস্তা ফাকা। জ্যাম একদম ই নেই। শুক্রবার সকালে ঢাকায় জ্যাম থাকে না।
আলিয়া ঠিকানা অনুযায়ী হাটা ধরল। বস্তির মতো একটা জায়গায় এসে থামল সে৷ ঠিকানা ঠিকই আছে।
কুঞ্জি ভিলা লেখাটার দিকে তাকিয়ে আলিয়া অবাক না হয়ে পারল না। এমন বস্তি বাড়ির ও এতো সুন্দর নাম হতে পারে এটা কল্পনা ও করতে পারেনি সে।
কুঞ্জি ভিলার ১৮ নং বাড়ির কথা উল্লেখ করেছে শ্রাবণ। আলিয়া ভেতরে ঢুকে। ১,২,৩ এভাবে ক্রমিক নং দিয়ে ছোট ছোট বাসা গুলো সাজানো। বস্তিতে প্রবেশ করতেই ভোটকা একটা গন্ধ নাকে এলো আলিয়া। আলিয়া নাকে ওড়না চেপে ধরে। পরমূর্হুতে ওড়নাটা ছেড়ে দিল। এটা ঠিক না। সে নিজ ইচ্ছায় এখানে এসেছে। এভাবে নাকে হাত দেওয়াটার মাধ্যমে এখানকার মানুষ কে তুচ্ছ করা প্রকাশ পাচ্ছে।
বস্তিটা একদমই পরিষ্কার না। বাড়ি গুলোর সামন দিয়ে ড্রেন চলে গেছে। ড্রেনের ঢাকনা নেই। ড্রেনের ভেতর দিয়ে পানির সঙ্গে ভাত-তরকারি সব একত্রে উঁকি মারছে। এক জায়গায় আবার স্যানিটারি ন্যাপকিন ও দেখল আলিয়া। সে সবকিছু উপেক্ষা করে ১৮নং বাসায় গেল এবং কাড়া নাড়ল।
কেউ গেট খুলল না। আলিয়া আর এক দন্ড না থেমে গেটটাতে সজোড়ে ধাক্কা দিল। সঙ্গে সঙ্গে গেট খুলে গেল৷
গেট খুলতেই সে শ্রাবণ কে দেখতে পেল। শ্রাবণ একদম গেটের বিপরীত বরাবর বসে আছে। একটা ক্যাটক্যাটা আকাশি রঙের আরএফএলের চেয়ারে বসে আছে৷ পরনে কালকের শার্টটাই। শুধু ইন করা নেই আর ইস্ত্রি নষ্ট হয়ে গেছে। রাতে ঘুমানোর জন্য শার্টের মাঝ বরাবর একটা ভাজ পড়ে গেছে। চুল খানিকটা এলোমেলো হয়ে আছে।
শ্রাবণ আলিয়াকে মৃদ্যু হেসে উঠে দাড়ালো এবং শান্ত গলায় বলে, আসতে একটু দেরি হলো যে?
আলিয়া ভ্রু কুচকালো। শ্রাবণ একবার আলিয়াকে দেখে নিয়ে বলে, তোমাকে অপূর্ব লাগছে!
আলিয়া খানিকটা লজ্জা পেল। তার গালে লাল আভা ফুটে ওঠে।
শ্রাবণ পুনরায় মৃদ্যু হেসে আলিয়ার চোখে চোখ রাখল। শ্রাবণের চোখে নেশা জাতীয় কিছু আছে নিশ্চয়ই। সব এলেমেলো করে দিচ্ছে৷ আলিয়ার বুকের ভেতরটা ধুকপুক করতে শুরু করল। আলিয়া উসখুস করতে লাগলো এবং আশেপাশে চোখ বুলিয়ে প্রশ্ন করে, তোমার আত্মীয় কোথায়?
--আপাতত বাসায় নেই।
--কোথায় গেছে?
--বাজারে৷
--কখন আসবেন?
শ্রাবণ রহস্যময় হাসি হেসে বলে, তুমি চলে যাওয়ার ঠিক দশ মিনিট পর আসবে।
--ইচ্ছা করেই তাকে সরিয়ে দিয়েছো?
শ্রাবণ মাথা ঝাকিয়ে বলে, হ্যা৷ তোমার সাথে কিছু সময় কাটাতে চাই।
আলিয়া ভ্রু যুগল কিঞ্চিৎ কুচকে বলে উঠে, আমার আসার কথা ছিল দুপুরে। তুমি সকালে কেন ওনাকে বাসা থেকে বের করে দিয়েছো? তুমি কিভাবে জানলে আমি এখন আসব?
শ্রাবণ আলিয়ার কিছু টা নিকটে এসে আলিয়ার চোখ বরাবর তার চোখ রেখে বলে,আমি জানতাম তুমি এখন আসবে৷
--কিভাবে?
--জানি না কিভাবে। কিন্তু এটা জানি তুমি সকালে আসবে। জানো আমার দুইটা বিশেষ ক্ষমতা আছে৷ প্রথমটা হলো আমি মানুষের বিপদ আচ করতে পারি আর সেকেন্ড টা হলো, আমি চাইলেই যে কাউকে দিয়ে যেকোন কাজ করাতে পারি।
শ্রাবণের কথার মাঝেই হুট করে আলিয়া শ্রাবণের বুকে আছড়ে এবং তার গালে আলতো করে ঠোঁট স্পর্শ করে।
শ্রাবণ মৃদ্যু হেসে আলিয়াকে জড়িয়ে ধরে৷
.
.
.
চলবে.............................