অন্তর্দ্বন্দ্ব - পর্ব ৬২ - সাবরিনা ইমরান - ধারাবাহিক গল্প


রুশানের মেরুদন্ড দিয়ে শীতল স্রোত বয়ে গেলো।রুশান প্রথমে চিনতে না পারলেও ভিনা চিনে ফেলেছে।হ্যাঁ,এটা যাবিরই।চোখে চশমা,স্পষ্ট জ লাইন,এলোমেলো চুল এবং অত্যাধিক শীতল চাহনির এই ব্যাক্তিকে প্রথমে যাবির হিসেবে ধরে ফেলা খুব কঠিন ছিলো।আগের যাবির এবং এই যাবিরের সবকিছুতেই আকাশ পাতাল তফাৎ। একে বাস্তবতা ধারালো সত্য দিয়ে কেটে ছাচে ফেলেছে পোষাক থেকে শুরু করে চাহনি পর্যন্ত।
রুশান কষ্ট করে উঠে দাঁড়ালো।এরপর ধীর পায়ে ভিনার দিকে এগিয়ে গেলো।ভিনা সেদিকে খেয়াল করলো না।এতদিন যাকে হন্যে হয়ে খুঁজেছে সে আজ নিজে ধরা দিয়েছে।খুব অল্প সময়ে ঘটে যাওয়া বড় দুটি ঘটনার প্রভাব পরেছে মস্তিষ্কে।

রুশান এগিয়ে এসে ভিনার কাঁধে হাত দিলো।ভিনা ধীরে হাত সড়িয়ে দিলো।ধরা গলায় বললো-'আমি আসছি'
রুশান বুঝে গেলো মুহূর্তের ব্যবধানে সে তৃতীয় পক্ষ হয়ে গিয়েছে।বুকের ভেতর দামামা বাজছে।ভিনার হাত ধরে টেনে সড়িয়ে নিতে আসতে ইচ্ছে করছে।তবু নিরুপায় হয়ে চলে যেতে হলো রুশানকে। এতটাই বিধ্বস্ত হয়ে গেলো যে চেয়ারের পরিবর্তে সিড়ির উপর যেয়ে বসলো।

তোহা মৃত রুপিনের কেবিন থেকে বের হয়ে হয়ে যাবির এবং ভিনাকে একসাথে দেখলো।কিছুক্ষণ নীরব থেকে যাবিরকে বললো-

-- যাবির ম্যামের গুলশানের বাড়িতে তোমাকে যেতে হবে।আমি ফোন দিয়ে সব স্টাফদের জানিয়ে দিয়েছি।তারা লন রেডি করে রাখবে।তুমি শুধু যেয়ে খাটিয়া,কাফনের কাপড় এবং গোসল দেয়ার জন্য মহিলাদের ব্যবস্থা করো।যাকে দিয়ে তোমার মার সব করিয়েছো,তাকে বললে ভালো হয়।নিচে ম্যামের যে কালো পাজেরো আছে,সেটা নিয়ে যাও।
-- ঠিকাছে
-- ভিনাকে সঙ্গে করে নিয়ে যাও।এখানে বেশিক্ষণ থাকা ঠিক হবে না।

যাবির মাথা নাড়িয়ে সব নিশ্চিত করলো।ভিনা ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে আছে দুইজনের দিকে। মনে হচ্ছে এটা ওর পরিচিত জগৎ নয়।এটা একধরনের ঘোর যেখানে ও সেসব মানুষের একসাথে দেখা পাচ্ছে যাদের ও খুঁজছিলো।যাবির ভিনার দিকে দৃষ্টি ফিরিয়ে নরম গলায় বললো-

-- আসো ভিনা।
-- তুমি এখানে কীভাবে এসেছো?তোহা আপু তোমাকে কীভাবে চিনে?
-- মিসেস জুয়েল আমার মামি হয়,আপন মামি।

ভিনা নিজের কানকে বিশ্বাস করতে পারলো না।ঢোক গিলে কাঁপা কাঁপা ঠোঁটে বললো-
-- আবার বলো...তুমি কী বললে?
-- তোমার রুপিন আন্টি আমার মামি হয়।আমি তার হাজবেন্ড জুয়েল চৌধুরীর একমাত্র ভাগ্নে।

ভিনার মাথা শূন্য হয়ে গেলো।সত্যিগুলো এমন বিচ্ছিরি কেন?এভাবে কেন ওর সামনে আসছে?
ভিনা অনেক কিছু বলতে চাচ্ছে,কিন্তু বলতে পারছে না,গলার কাছে এসে সব শব্দ দলা পাকিয়ে যাচ্ছে।যাবির ভিনার অবস্থা আঁচ করতে পারলো।ভিনার পাশে বসে সরাসরি ভিনার দিকে তাকালো।অমানুষিক কষ্ট এবং অতিরিক্ত কান্নার কারণে চোখ ফুলে লাল হয়ে আছে।গলা শুকিয়ে বারবার ঢোক গিলছে।যাবির ফার্মেসি থেকে পানি এবং স্যালাইন নিয়ে এসে ভিনাকে খাওয়ালো।রুশান সিড়িতে বসে ছিলো।অপেক্ষা করছিলো কখন কথা শেষ হবে দুইজনের।যাবির ভিনার স্বাভাবিক হওয়ার অপেক্ষা করে এরপর বললো-

-- আমার এখন যাওয়া উচিৎ। যদিও তোহা বলেছিলেন তোমাকে নিয়ে যেতে,কিন্তু এখন মৃত বাড়িতে তোমাকে না নিয়ে গেলে ভালো হবে।তোমাকে আমি ফোন দিবো আজকে রাতে।কালকে দেখা করো.....যদি কোনো সমস্যা না হয়।

ভিনা ভ্রান্তভাবে দেয়ালের দিকে তাকিয়ে আছে।যাবিরের কথা শোনার পর সময় নিয়ে বললো-
-- ঠিকাছে।
-- এসে পরো ভিনা।তোমাকে অনেক কথা বলার আছে।

যাবির আর অপেক্ষা করলো না।দ্রুত সেখান থেকে চলে গেলো।সিড়িতে রুশানের সাথে দেখা হয়ে গেলো।যাবির দেখেই শক্ত হয়ে এলো রুশানের চোয়াল।চোখাচোখি হতেই যাবির স্মিত হাসি দিলো। এই হাসি দেখে রুশান রাগে উঠে দাঁড়ালো।

-- দাঁড়াও।
-- আমি ব্যস্ত।তোমার সাথেও কথা হবে সময় হলে।
-- আমার ভিনাকে কেড়ে নেওয়ার চেষ্টা করবে না।

যাবির সিড়ির শেষ মাথায় চলে এসেছিলো। রুশানের কথা শুনে দাঁড়িয়ে গেলো।এবার তিন-চার সিড়ি উপরে উঠে হাত রাখলো রুশানের কাঁধে।

-- ভিনা ডিজার্ভস এ স্ট্রং ম্যান ব্রাদার।
এরপর কাঁধে কয়েকবার চাপড় মেরে চলে গেলো।

রুশান যখন ভিনাকে নিতে উপরে এলো,তখন কাউকে খুঁজে পেলো না।মোবাইলে মেসেজ এসেছে-

' I am on the way home.Will catch u later.Let me be alone for sometime'.

রুশানের বুক চিড়ে দীর্ঘশ্বাস বের হলো।নিজেকে খুব অসহায় মনে হলো নিয়তির কাছে।জীবনে সবকিছু পেয়েও আজকে একজনের জন্য সব অর্থহীন হয়ে পরেছে।এই অর্থহীন জীবনের মানে কী?

_________

ভিনা পুরোনো ডায়রি বের করে পৃষ্ঠাগুলোতে হাত বুলায়।মনে হয় এক টুকরো অতীত ওর সামনে জীবন্ত হয়ে উঠেছে।এই ডায়রিতে শিউলি মারা যাওয়ার পর থেকে যাবিরের সাথেবিচ্ছেদ পর্যন্ত সব লেখা আছে।এক পৃষ্ঠায় যাবিরের নিজের লেখা আছে।

'মা,তুমি যেখানেই থাকো জেনে রেখো তোমার মেয়ে একদিন অনেক বড় হবে'

যাবির পেন্সিল দিয়ে গোটা অক্ষর দিয়ে লিখেছিলো কথাগুলো।মা রে,তোমার এত তো বড় হয়েছে,কিন্তু বড় হতে পারেনি।পারেনি নিজের দ্বন্দ্ব গুলো কাটিয়ে উঠতে।ভিনা কাঁদতে কাঁদতে ক্লান্ত হয়ে গেছে।ভেতর ঝাঝড়া হয়ে যাচ্ছে তবু চোখে পানি আসছে না।ঐ সময়ে মাহভিন ঘরে ঢুকলো।টুকটুক করে ভিনার কাছে এলো।এই ছোট মেয়ে সবসময়ই ছন্দে হাঁটে।দেখতে এত মায়া লাগে বলার মতো না।মাহভিন এসেই ভিনার সামনে খুলে রাখা ডায়রি অবাক চোখে দেখলো।এরপর যাবিরের লেখার উপর আঙ্গুল দিয়ে ছুঁয়ে দিলো,সামনে এসে নাকে ডুবালো কাগজে।কাগজের ঘ্রাণ ওর খুব ভালো লাগে।এরপর ভিনার হাত ধরে কিছুক্ষণ কথা বলে আবার চলে গেলো।এই সামান্য ঘটনায় ভিনার উপর গভীর প্রভাব ফেললো।ঠোঁট কামড়ে বসে রইলো বিছানার কোণায়।এত তীব্র কষ্ট যে বুকের বা পাশে চিনচিন ব্যাথা করছে,শ্বাস নিতেও কষ্ট হচ্ছে।আজকে মাহভিন আর যাবিরের সাথে ভিনার আলাদা সংসার হতে পারতো।দ্বিতীয় পুরুষ হিসেবে রুশানের আগমন ঘটতো না।জীবন অতীত এবং বর্তমানে দুই ভাগ হয়ে যেতো না।অতীত বর্তমান মিলে একটা সুন্দর ভবিষ্যৎ হতে পারতো।কেন সহজ হলো না ওর জীবন,কেন হলো না?

সাইড টেবিলে পরে থাকা মোবাইলে মেসেজ আসলো শেষে।মোবাইল ভাইব্রেট করলো,ভিনা মেসেজ না দেখেই বুঝে গেছে যাবির কোথায় দেখা করতে বলেছে।পুরোনো সেই কলোনিতে,পুকুরপাড় এর কাছে।

ভিনা পুকুর পাড়ে বসে আছে।বরাবরের মতোসবকিছু এলোমেলো।টঙের সেই মামা এখনো আছে।দুইজনকে বহুবছর পর একসাথে দেখে অন্যরকম হাসি দিয়েছে।ভিনার মন খারাপ হয়ে গেলো সেই হাসি দেখে।এই মামা জানে না গত চার বছরে কী হয়েছে।আজকের এই দুইজনের মাঝে শত জনমের দূরত্ব।
যাবির দুই কাপ চা নিয়ে বসলো ভিনার কাছে।মাঝখানে চার আঙ্গুল দূরত্ব,চার হাজার বছরের দূরত্ব।ভিনা পুকুরের স্থির পানির দিকে দৃষ্টি নিবদ্ধ করে রেখেছে।

-- কেমন আছো ভিনা?
-- জেনে লাভ কী যাবির?যেটা বলতে এসেছো বলে ফেলো।চারদিন পর আমার বিয়ে।আমি আর আসতে পারবো না।

যাবির বড় করে নিঃশ্বাস নিলো।ভিনা খেয়াল করলো না যাবির ভেজা চোখে তাকিয়ে আছে ওর দিকে।

-- মাহভিন কেমন আছে?
-- ভালো আছে আমার মেয়ে।
-- রুপিনের কাছ থেকে তাহলে বাচ্চাটা আনতে পেরেছিলে তুমি!

ভিনা চমকে উঠলো।যাবিরের দিকে তাকালো হতবিহ্বল হয়ে।যাবির বড় করে করে নিঃশ্বাস ফেলে চশমা খুলে হাতে নিলো।

-- আমি জানি আমার মুখোমুখি হতে তোমার ভীষণ কষ্ট হচ্ছে।আমার প্রশ্নের উত্তর দেয়াও তোমার জন্য সহজ হবে না।এর জন্য শুধু শুনে যাও তুমি।

ভিনা নিজের জীবনের নির্মম সত্যের মুখোমুখি হলো।

----- আমার মামি রুপিন জুয়েল চৌধুরী ধনী পরিবারের মেয়ে ছিলেন,এটা তুমি জানো।তোমার বাবার সাথে বিয়ে ভেঙে যাওয়ার পর রুপিনের বাবা নিজের স্ট্যাটাসের সাথে মিলিয়ে সুন্দরী,শিক্ষিতা মেয়েকে বিয়ে দেন আমার মামা,জুয়েল চৌধুরীর সাথে।মামা একমাত্র ছেলে নানা নানীর।পৈতৃক সম্পত্তি হিসেবে নিজেদের হস্পিটাল এবং মিলের ব্যবসা ছিলো মামার।আমার মা সাহরা তার আপন ছোট বোন।মা নিজের এই ধনাঢ্য জীবনে অনভ্যস্ত ছিলো।মামা আর মার ক্যারেকটার পুরোই বিপরীত। অনার্সে পড়ার সময় আমার বাবার সাথে মার পরিচয় হয়,এরপর বিয়ে।বাবা গ্রামের হতদরিদ্র পরিবারের বড় ছেলে।সাত ভাইবোনের মধ্যে বাবাই পড়াশোনা করে কষ্ট করে সরকারি চাকরি পেয়ে ঢাকায় স্থায়ী হয়েছে।মা বিয়ের পর পড়াশোনা করেনি।সে একনিষ্ঠ সংসারি হয়েছিলো।মার এই বিয়ের সিদ্ধান্তে তার পরিবারের কেউই খুশি হয়নি।বিশেষ করে মামা একদমই না।সে বোনের বিয়ে ভালো জায়গায় দিতে চেয়েছিলো।সম্পর্কের অবনতির কারণে মা বিয়ের পর নানি বাড়ির সাথে তেমন যোগাযোগ রাখেনি।এমনকি নানা হাসান চৌধুরী বয়সকালে যে উইল করেছিলেন,সেখানেও সম্পত্তি দাবি করেনি।মায়ের আত্মসম্মান বেশি ছিলো।কিন্তু বেশিদিন আর এভাবে থাকতে পারেনি।বাবা হুট করে মারা গেলো আমি ছোট থাকতে।ভেঙে পরলো মায়ের সংসার।পড়াশোনাও শেষ করেনি,এর উপর এই ধাক্কাও সামলাতে পারলো না।অভাবে পরলাম দুইজন।তখন নানা মেয়ের কথা চিন্তা করে উইলে চেঞ্জ আনলেন,তার বেশি অর্ধেক সম্পত্তি মার নামে লিখে দিলেন।তখন মামা বিবাহিত ছিলেন।মামা এবং মামি দুইজনেরই অসন্তোষ ছিলো নানার এই সিদ্ধান্তে। মা এ বিষয়ে বুঝতে পেরে সম্পত্তি না নিয়ে মাসে মাসে কিছু টাকা নিয়ে সংসার চালাতো।এর একবছর পর প্রথমে নানি মারা যায়,এরপর নানা।মায়ের দায়িত্ব পরে মামার উপর।মামা আমার মার সাথে কোনো যোগাযোগ না রাখলেও মাস শেষে মোটা অঙ্কের টাকা পাঠাতেন।মাঝে মাঝে লোক পাঠিয়ে আমাকে তার অফিসে ডেকে নিতেন।তার নিজের কোনো সন্তান ছিলো না দেখে আমাকে অনেক ভালোবাসতেন।এক বছর পর মামাও কীভাবে যেন মারা গেলেন কার এক্সিডেন্ট করে।এখানে বলে রাখি মামা খুব ভালো ড্রাইভিং পারতো।পুরো ব্যাপারটাই ছিলো আনএক্সপেক্টেড।মামা মারা যাওয়ার পর মা ধরেই নিয়েছিলো এখন টাকা আসা বন্ধ হয়ে যাবে।কারণ মামি আমাদের পছন্দ করতো না।সেরকম কিছু হলো না,টাকার পরিমাণ কমিয়ে আনলেও মামি টাকা পাঠাতেন।তার শুকনো লম্বা বদরাগী সেক্রেটারি এসে প্রতি মাসে টাকা দিয়ে যেতো।আমি যখন ফোর কি ফাইভে পরি,মামি এসে মার নামে নানার করে যাওয়া সম্পত্তি নিজের নামে লিখে নেয়।মাকে বলা হয় নানার ব্যবসা বাড়ানোর জন্য নতুন মিল বানানো লাগবে,জায়গা লাগবে।মা এখন মামির নামে সম্পত্তি লিখে দেক,কাজ শেষে মায়ের অংশ মাকে বুঝিয়ে দেয়া হবে।মা সাত পাঁচ না ভেবে লিখে দেয়।আর তাছাড়া সম্পত্তি নিয়ে এত মাথা ব্যথাও ছিলো না তার।খেয়ে পরে বাঁচতে পারলেই চলে।আমি ছোট ছিলাম,বুঝতাম না কিছু।মার একেবারে মৌলিক বিষয়গুলো ছাড়া আর কোনোকিছুতে মন ছিলো না।আমি এসবের কিছুই জানতাম না।

যাবির একটু থামলো।গলা ভেজালো হালকা গরম চা খেয়ে। ভিনার মনোযোগী দৃষ্টি নিবদ্ধ যাবিরের দিকে।যাবির দম নিয়ে আবার বলা শুরু করলো।

----একসময় ঐ সেক্রেটারি আসা বন্ধ হয়ে গেলো।মা যেয়ে কিছুদিন টাকা নিয়ে আসতেন।এইটে ওঠার পর থেকে আমি যেয়ে টাকা নিয়ে আসতাম।মাঝে মাঝে অপেক্ষা করা লাগতো,কখনো তার তোহা নামের সেক্রেটারি থাকলে অপেক্ষা করা লাগতো না।সে আসা মাত্রই হাতে টাকা দিয়ে দিতো।ছোটবেলা থেকেই আমি স্বাভাবিক জীবন চাইতাম।সবার নিজের পরিবার আছে,বাবা অথবা বাবা মা দুইজনই সংসার চালায় সেসব পরিবারে।অন্যের কাছ থেকে টাকা নিয়ে চলাটা আমার কাছে খুব খারাপ লাগতো।আমার সেল্ফ রেস্পেক্ট বেশি ছিলো,কিন্তু মাসের ঐ একদিনেই আমার সব আত্মসম্মান মাটিতে মিশে যেত।আমি স্টুডেন্ট মানুষ,টিউশনি করেই নিজেকে চালিয়ে নিতে পারতাম।কিন্তু মা নিজেকে বন্দি করে অসুস্থ বানিয়ে ফেলেছিলো।প্রতি মাসে তার চিকিৎসার জন্য ভালো খরচ লাগতো।আমার ও কিছু করার ছিলো না।

একসময় তুমি আমার জীবনে আসলে।বিশ্বাস করো ভিনা,আমার মতো ছেলেরা খুব প্র‍্যাক্টিকাল হয়।প্রেম ভালোবাসা আমাদের জন্য বিলাসিতা।কিন্তু আমি তোমাকে ভালোবেসে ফেলেছিলাম।তুমিও আমার মতোই ভাঙাচোরা জীবন নিয়ে বেঁচে ছিলে।আমার খুব ইচ্ছে হলো নিজ হাতে তোমার জীবন সাজিয়ে দিতে,কারণ আমি জানি এর কষ্ট কীরকম।আমি জীবনে এই প্রথমবার শুধু টাকা আয় করা তোমাকে নিয়ে ভালো জীবনের স্বপ্ন দেখা শুরু করলাম।বিশ্বাস করো,আমার জীবনের শ্রেষ্ঠ সময় ছিলো ওটা।তোমার সাথে সম্পর্ক হতে না হতেই জেরিন শুরু করলো ঝামেলা।ওর কাছে আমি ছিলাম ফ্যান্টাসি।মমধ্যবিত্ত রুক্ষ ধরনের ছেলের সাথে ও প্রেম করবে,এই অসম প্রেমে তীব্র ভালোবাসা থাকবে।এটাই ভেবেছিলো জেরিন।অনেক চেষ্টা করেছে ও।মেডিকেল ছেড়েছে,আমার মাকে ফোন দিয়েছে,ওর মাকেও আমাদের বাসায় এনেছে।লাভ হয়নি।ওকে আমার কখনোই ভালো লাগতো না।কিন্তু মা বলেছিলো একবার ভেবে দেখতে,জেরিন অনেক ভালোবাসতো দেখে।আমি আর কথা আগাতে দেইনি।তোমাকে নিয়েই আমার জগৎ ছিলো,সে জগতে আমি সুখি ছিলাম।

যাবির চুপ হয়ে যায়।মাহভিনের দিকে তাকিয়ে থাকে।পরের গল্প বলতে ইচ্ছে হয় না।এত জঞ্জালে ভরা সত্যিকে ছাপিয়ে ভালোবাসার কথা বলতে ইচ্ছে করে।ইচ্ছে করে অতীতে ফিরে যেতে।যাবির ভিনার দিকে তাকায়।ভিনা আবেগে ভরা শুষ্ক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে ওর দিকে।

-সেদিন রাতে যখন তুমি বাসা থেকে বের হয়ে এলে,আমি সত্যি বুঝতে পারছিলাম না কী করবো।আমি কখনো ভাবিনি এমন কিছু হতে পারে।আমার ইচ্ছে ছিলো তুমি একটা ভালো ভার্সিটিতে চান্স পেয়ে গেলে বিয়ে করবো।তুমি আমি দুইজনই টিউশনি অথবা কোনো পার্ট টাইম জব করে চালিয়ে নিতে পারতাম।তোমাকে আমি চিনি,তোমার মেধা ছিলো,ধৈর্য্য ও ছিলো।আমার বিশ্বাস ছিলো আমরা কিছু পারবোই।কিন্তু সেদিন তোমার বাড়ি ছাড়ার পর সব এলোমেলো হয়ে যায়।সে রাতে তোমাকে স্পর্শ করতে চাইনি ভিনা।পারিনি নিজের আবেগের কাছে কঠিন হতে।তুমি যেভাবে ভেঙে পরে আমার কাছে ভালোবাসা চাচ্ছিলে,না বলার ক্ষমতা আমার ছিলো না।পরেরদিন সকালে নিজেকে খুব ছোট মনে হয়েছিলো।তোমার মুখোমুখি হতে পারছিলাম না।প্রিতির বাসায় তোমাকে দিয়ে আসার পর রাস্তায় রাস্তায় ঘন্টার পর ঘন্টা ঘুরেছি।সেদিনই আমি সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম তোমাকে বিয়ে করবো।কিন্তু লিগ্যাল গার্জিয়ান ছাড়া বিয়ে হয় না,তোমার কাছে বার্থ সার্টিফিকেট ও ছিলো না।তখন তোমার পরীক্ষা সামনে।আমি তোমার মনোযোগ নষ্ট করতে চাইনি।মধ্যবিত্তদের জন্য মেধা এবং পড়াশোনাই সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ।আমাদের সংসার করার জন্য তোমার নিজের পায়ে দাঁড়ানো খুব জরুরি ছিলো।আমিও এর মাঝে চাকরি খোঁজা শুরু করি।গ্র‍্যাজুয়েশন কম্পলিট হয়নি দেখে ভালো জব পাইনি।যাই পেয়েছিলাম সেটা ওয়ার্কিং আওয়ার অনেক ঘন্টা,কিন্তু বেতন কম।পড়াশোনা করা যেত না।এসব ঝামেলার মধ্যে তোমার সাথে প্রতিদিন দেখা করতে আসতে পারতাম না।

একদিন আননোন নাম্বার থেকে আমার মোবাইলে ফোন আসে।পরিচয় হিসেবে বলা হয় তোমার দূরসম্পর্কের আত্মীয়।কেমন আত্মীয়,কী নাম কিছুই বলে না।শুধু তোমাকে বাসায় ফেরত পাঠানোর কথা বলে।সাথে এটাও উল্লেখ করে দেয়,ফেরৎ না পাঠালে আমি যে অন্যের টাকায় চলি এটা ফাঁস করে দিবে।মারাত্মক অপমান করে।আমি মুখ চেপে সহ্য করে যাই।কিন্তু তোমাকে জানাই না কারণ ঐযে নিজের অসহায়ত্বের কথা সামনে আনতে চাইনি।একদিন তোমাকে আক্ষেপ নিয়ে বলেছিলাম 'তুমি তো আমাকে কিছুই জানাও না'।তোমার আত্মীয়ের ব্যাপারে বেশি কিছু বলো নি দেখেই এই কথা বলেছি।তার কথাগুলো আমার আত্মসম্মানে অনেক লেগেছিলো।আমি তোমাকে যতদিন পেরেছি,সাপোর্ট দিয়ে গেছি।ফেরৎ পাঠাই নি।একসময় মার শরীর আরো খারাপ হয়।আমার হাত এক ধাক্কায় খালি হয়ে যায়।তখন তোমার পরীক্ষাও সামনে এসে পরে,আইডি কার্ড নেয়ার সময় হয়ে গিয়েছিলো।তোমার সাথে ফিজিকালি ইনভলভ হওয়ার পর থেকে প্রচন্ড গিল্ট কাজ করছিলো।সরাসরি বলতে পারছিলাম না যে আমি তোমার দায়িত্ব নিতে পারছিনা।বিবেকে লাগছিলো।তাই তোমাকে গয়নার কথা বলে বাসায় ফেরৎ পাঠাই।এর কিছুদিন পরই তোমার প্রেগন্যান্সির খবর পেলাম।সত্যি বলতে আমি সময় চেয়ে নিয়েছিলাম বিয়ে করার জন্যই।প্রথমে তোমার ব্যাপারে মাকে কিছু না জানালেও পরে সব জানাতে বাধ্য হই।মা রাজি হয় না।বিশেষ করে প্রেগন্যান্সির খবর শুনে আরো না।তুমুল দ্বন্দ্ব হয় আমাদের মাঝে।তোমার আত্মীয় হয়ে আননোন নাম্বার থেকে ফোন আসার পর থেকেই মামি আমাকে টাকা দেয়া বন্ধ করে দিয়েছিলো।আমি জানতাম না কেন।যেহেতু সে নিজ থেকে বন্ধ করেছে,আমি আর যেচে চাইও নি।কিন্তু যখন তোমার প্রেগন্যান্সির খবর পাই,তখন আমি সব বিসর্জন দিয়েই মামিকে ফোন দেই টাকার জন্য।সেদিন প্রথম জানতে পারি রুপিন তোমার ফুফু হয় এবং সেদিন ঐ ফোন তিনিই করেছিলেন।
.
.
.
চলবে.........................................................................

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

WhatsApp