নয়নতারা - পর্ব ২৪ - সুবহান আরাগ - ধারাবাহিক গল্প


রাত হয়েছে।

খাবার খেয়ে এসে নাফিজ সবে বিছানায় শুয়েছে।তখনই ফোনটা বেজে উঠলো।ফোনের আওয়াজ শুনে বেশ বিরক্ত বোধ করলো নাফিজ।

----উহ!এখন এতো রাতে আবার কে?

বিরক্তি নিয়ে নাফিজ ফোনটা হাতে নিল।আননোন নাম্বার।এতো রাতে কে হতে পারে এটাই ভাবছে নাফিজ।এর মধ্যে কল টা কেটে গেল।

----যাক।যে হবে হোক।দরকার পড়লে আবার নিজেই কল দেবে।

নাফিজের ভাবনার মাঝেই আবার ফোনের স্ক্রিনে আলো জ্বলে উঠলো।আবার সেই আননোন নাম্বার।নাফিজ এবার ফোন টা রিসিভ করলো।

----হ্যালো।

----আসসালামু আলাইকুম।

নাফিজ তো সালাম শুনে এক প্রকার লাফ দিয়ে উঠে বসলো।নাফিজের মুখে এক বিজয়ী হাসি।এ কন্ঠ যে আর কারোর না তার তারার।

----তারা আপনি?

----সালাম দেওয়া সুন্নত।আর উওর দেওয়া ওয়াজিব।

----ওহ।দুঃখিত।ওয়ালাইকুম আসসালাম।

----আপনি কি ঘুমিয়ে পড়েছিলেন ক্যাপ্টেন?

----না।কেবল শুধু এসে শুয়ে পড়েছি।

----বাপি আজ সন্ধ্যায় আমাকে নিয়ে গিয়ে নতুন ফোন কিনে দিয়েছে।এটা নতুন নাম্বার।

----হ্যাঁ তা তো বুঝেছি।কিন্তু আমার নাম্বার টা কোথায় পেলেন?

----মুখস্থ ছিল।

----মুখস্থ!

----হুম।

মুখস্থ কথাটা বেশ অদ্ভুত লাগল নাফিজের।লাগবে নাই বা কেন?কাছের মানুষ ছাড়া আর কারো নাম্বার তো সাধারণত কেউ মুখস্থ করে না।তবে কি নাফিজ  হতে পেরেছে নাকি সত্যি হয়ে গেছে তারার কাছের কেউ?

ভেবে চলেছে নাফিজ।এপাশে যে তারা কথা বলছে সেদিকে ও হুশ নেই তার।

----ক্যাপ্টেন, ক্যাপ্টেন আপনি কি লাইনে আছেন?ক্যাপ্টেন।

----হুম।আছি আছি।

তারার ডাকে হুশ ফিরলো নাফিজের।

----কথা বলছেন না কেন?

----ওই না কিছু না।একটা কথা বলব?

----কি?

----হঠাৎ আমার নাম্বার টা মুখস্থ করলেন যে?

নাফিজের প্রশ্নে তারা কিছুটা অপ্রস্তুত হয়ে পড়লো।আসলেই তো সে কেন নাফিজের নাম্বার টা মুখস্থ করেছে?

----তারা।

----হুম।

----বললেন না যে।

----এমনি মনে ছিল।তাই।

----শুধুই কি এমনি ?

----এমনি ছাড়া আর কি হবে?আপনি এতো কথা ধরেন কেন বলুন তো?

----আরে রাগছেন কেন?আচ্ছা শুনুন।

----কি?

----সকালে খাতায় যেটা লিখে ছিলাম পড়েছেন?

----ওহ হো।একদম ভুলে গেছি।

----পড়েন নি?

----না।আমার একটুও মনে ছিল না।

----এখন কি শুয়ে পড়েছেন?

----হ্যাঁ।মশারির ভেতরে আছি।

----আচ্ছা ঠিকাছে।কাল সকালে হাঁটতে আসবেন তো?

----আল্লাহ বাঁচালে ইনশাহআল্লাহ যাব।

----ঠিকাছে।তখন পড়ে তারপর আসবেন।আমি আপনার উওরের অপেক্ষা তে থাকব।

----কি এমন লিখেছেন আপনি?

----তেমন কিছুই না। শুধু আপনি থেকে তুমি তে যাওয়ার ছোট্ট যাত্রা শুরু করেছি।

----মানে?

----এতো মানে মানে করতে হবে না।ঘুমিয়ে পড়ুন।

----আচ্ছা।আল্লাহ হাফেজ।

----আল্লাহ হাফেজ।

তারা ফোন কেটে দিল।নাফিজ ফোন অফ করতে যাবে তার আগেই ভেসে উঠলো স্ক্রিনে থাকা বউ সেজে বসে থাকা ছোট্ট মিষ্টির ছবি।

নাফিজের বুকের ভেতরটা যেন কামড় দিয়ে উঠলো।ফোনটাকে বুকের বা পাশে রাখল নাফিজ।

----কেন চলে গেলি মিষ্টি পাখি?আমাকে বড্ড একা করে গেছিস তুই।এতোটা কষ্ট কেন দিলি আমাকে?তোর নাফিজ ভাইয়াকে এতো বড় কষ্ট দিতে পারলি?

বুকের ভেতরে র ব্যথাটা যেন আবার বেড়ে উঠলো নাফিজের।

"অপেক্ষা যে বড় যন্ত্রণা দায়ক।শুধু পোড়ায়, দগ্ধ করে,কিন্তু ঝলসে যায় না শরীর টা,দেখা যায় না তার তীব্রতা,শুধু অনুভবে থেকে যায়।"

আচ্ছা কখনো যদি এমন হয় ,মিষ্টি ফিরে এসেছে তার নাফিজ ভাইয়ার কাছে।কিন্তু তার আগে তারা চলে এসেছে নাফিজের নয়নতারা বাগানে।কি হবে তখন?

ভাবতেই নাফিজ উঠে বসলো।সত্যি তো এটা তো সে ভেবে দেখেনি।

----না আমি পারব না তারাকে ভুলতে।আমি পারব না ওকে ছাড়তে।কিন্তু আমি যে তোকে ও ছাড়তে পারব না মিষ্টি।

জোরে জোরে দম নিচ্ছে নাফিজ।সত্যি তো যদি কখনো এমন হয় তখন কি করবে সে? বর্তমানকেই উচিত ভবিষ্যতের জন্য প্রস্তুত থাকা।

সিদ্ধান্ত নিয়েই নিল নাফিজ।

----আমি তারাকে ভালোবাসি।খুব বেশি ভালোবেসে ফেলেছি।আমার বিশ্বাস তারার মনেও আমার জন্য এক টুকরো হলেও অনুভূতি আছে।নাহলে কেন ই বা সেও আমার অপেক্ষা তে থাকবে।যেই সময় টা আমার তোকে একান্ত প্রয়োজন ছিল মিষ্টি সে সময় টা আমি তোকে পাইনি।কদিন আগেও এক রাত ঘুমোতে পারতাম না আমি নিশ্চিন্তে।কিন্তু আজ।আজ আমার স্বস্তি ফেলার মতো জায়গা আছে।আমার স্বস্তি আমি খুঁজে পাই ঐ ছোট্ট তারার মাঝে।হতে পারে ও অপূর্ণ।কিন্তু ও যে আমাকে নিজের অজান্তেই পূর্ণ করেছে।

"আমি পারব না তাকে ছাড়তে যে আমার অসময়ে ছিল,

আমি পারব না তাকে ছাড়তে যার ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র চাহনি,

যার ক্ষুদ্র বিচরণ আমাকে জাগিয়ে দিয়েছিল,

আমাকে গ্রহণ করতে শিখিয়েছিল নতুন করে জীবনের আনন্দ টাকে,

তার জন্য যদি অতীত আমার পিছুটান হয় হোক,

সেই অতীত আমি ছাড়ব,

কিন্তু অসময় কে ছাড়তে পারব না সু সময়ের  স্রোতে।"

ভবিষ্যত মানুষের অজানা।তবুও প্রস্তুতি নিতে হয়।নাফিজ ও প্রস্তুত এরকম অনাকাঙিক্ষত ভবিষ্যতের জন্য।

;;;;;

রাত দুটো বাজে।

তারার চোখে ঘুম নেই।সে যে শুয়ে শুয়ে আরেক গভীর চিন্তায় মগ্ন।

----আচ্ছা ক্যাপ্টেন,আপনার সাথে আমার কেন এতো সংযোগ বলতে পারেন?আমাদের মাঝে না আছে বন্ধুত্ব,না আছে আত্মীয়তা।কিন্তু আছে এক অদৃশ্য সম্পর্ক।কিন্তু সেটা কিসের।

ভাবতে ভাবতে আবার চোখ বুজলো তারা।কিন্তু আর বেশিক্ষণ থাকতে পারল না।তার আগে আবার চোখ খুলে ফেললো।

----উহ।সেই এক স্বপ্ন।কেন বার বার তাড়া করে আমাকে?আমি তো পাই না তাকে।কিভাবে পাব?আমি জানিনা সে কোথায়?সে কেমন আছে?তার কি আদৌ মনে আছে আমার কথা?আমি শুধু একবার চাই আল্লাহ।শুধু একবার শেষবারের জন্য হলেও আমার একমাত্র বন্ধু টার সাথে সাক্ষাত করতে।আমি যে আজ ও পারিনা আর কাউকে বন্ধু ভাবতে।

;;;;;

সকাল বেলা।

নাফিজ সবে সাইকেল নিয়ে তারা দের বাড়ির সামনে আসছে।হঠাৎ করে সামনে থাকা মানুষ টিকে দেখে নাফিজের মুখে হাসি ফুটলো।

আজ তারা নাফিজের আগে চলে এসেছে।নাফিজ মুচকি হেসে তারার পাশে গিয়ে সাইকেল দাঁড় করালো।

----আজ দেখি লেডিস ফারসট।

----হুম।আপনি আজ ফেল্টু করেছেন?

----আফা এই ফুলচোর ডার ও কি কাল পাতিহাঁস পরীক্ষা ছিল?

গাসুর কথা শুনে নাফিজের হাসি নিমিষেই উধাও হয়ে গেল।।তারা ভ্রু কুচকে গাসুর দিকে তাকালো।

----গাসু হচ্ছে টা কি?কিসের সাথে কি মিলাচ্ছো?

----তারা গাসু কি বলছেন?

----কি আর বলবে?সব সময় এর ওর টা দেখে লিখবে।তাতে টেনে টুনে জেএসসি পাশ করে ছিল।এখন আল্লাহ জানে কি করবে এই মেয়ে।কাল ইতিহাস পরীক্ষা তে ফেল্টু মারছে।

----না আফা।আমি ফেল করিনাই।

----কিভাবে?

----স্যার তো আমার খাতা দেখে খুব খুশি হয়েছিল।তাই তো দেখি স্যার খাতার ওপর দুটো রসগোল্লা একেছেন।স্যার খুশিতে মিষ্টি খাইতে চাইছিল বোধ হয়।

গাসু নিজের মতো বকে এদিক ওদিক লাফ ঝাঁপ দিচ্ছে।গাসুর কথা শুনে তারা আর নাফিজ হেসেই যাচ্ছে।

----তারা।

----হুম।

----খাতা পড়েছিলেন?

----উহ।মনে নেই।সরি।

----আচ্ছা আজ এখান থেকে গিয়ে পড়বেন বলে দিলাম।

----ঠিকাছে।চলুন হাটি।

----চলুন।

;;;;;

সকাল বেলা কিছু কাপড় চোপড় ইস্ত্রি করতে বসেছেন মাহমুদা বেগম।

----তারা কোথায় মাহমুদা?

----ও তো গাসুকে নিয়ে মর্নিং ওয়ালক এ গেছে।

----ও।সৈকত ওঠেনি?

----না।ঘুমোচ্ছে মনে হয়।তাই ডাকিনি।শোনো তোমার শার্ট দু টো ইস্ত্রি করেছি।আর কিছূ থাকলে দিও।আমার তারা র জামা দুটো  ওর ঘরে দিয়ে আসি।

----আচ্ছা।

মাহমুদা বেগম তারার জামা নিয়ে তারার ঘরে গেলেন।জামা দুটো আলমারিতে রাখলেন।

----দেখোতো মেয়ের কাজ।পড়ার টেবিল টা এলোমেলো করে রেখেছে কেমন?

মাহমুদা বেগম তারার টেবিলের ওপর থেকে বই খাতা সব গুছিয়ে দিচ্ছেন।

----দেখো অবস্থা।খাতায় মাত্র দুই পৃষ্ঠা আছে।এখনো বলেনি মেয়েটা যে খাতা শেষের পথে।একে নিয়ে পারি না।দেখি সব খাতা গুলোর পৃষ্ঠার অবস্থা।

মাহমুদা বেগম তারার  সব খাতা গুলো উল্টে পাল্টে দেখছেন।যে গুলো শেষের পথে সেগুলো আলাদা করছেন।হঠাৎ করেই তার চোখ আটকে গেল একটা খাতার মাঝে।

----আরে।এটা কার হাতের লেখা!এটা তো তারা র নয়।আর কি সব লেখা এটা।প্রেয়সী!

পুরোটা পড়ে মাহমুদা বেগম বেশ অবাক হলেন।আরো নিচে লেখা ক্যাপ্টেন নাফিজ।

;;;;;

----এগুলো কি তারা?কি হলো উওর দেও।

----মা  আমি সত্যি বলছি।আমি লেখাটা পড়িনি।তুমি বললে কেবল জানলাম।

তারা মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে আছে বসার রুমে।তারার সামনে মাহমুদা বেগম খাতার লেখাটা বের করে রেখেছেন।সৈকত গাসু দুজনেই অনেক চেষ্টা করেছে মাহমুদা বেগমকে বোঝানোর।কিন্তু মাহমুদা বেগমকে থামানোর সাধ্য আজ তাদের নেই।কথায় আছে,নিরাগের রাগ বেশি।ঠান্ডা মানুষ গুলোই ভয়ঙ্কর রাগি হয়।মাহমুদা বেগম ও হয়তো তার ব্যতিক্রম নন।

এমনিতেই তারার ওপর ক্ষিপ্ত তিনি।তারপর আবার তারাকে খুঁজতে বেরোনোর সময় নাফিজকে ও তারার সাথে দেখে ফেলেন।ব্যস আগুনে যেন আরেক চামচ ঘি ঢেলে পড়লো।

----এই শিখিয়েছি?এই শিখিয়েছি আমি তোমাকে!

----চাচিমা ও ভুল করে ফেলছে হয়তো।

----তুমি চুপ করো সৈকত।ভুল!কিসের ভুল?ও কি ছোট বাচ্চা?আজ অবধি কখনো তোমার সাথে আমি জোর গলাতে কথাও বলিনি।এতো টাই গর্ব ছিল আমার তোমাকে নিয়ে।কখনো তোমার বাপি আমি তোমার গায়ে হাত তুলেছি কিংবা দুটো কথা শুনিয়েছি এটা কি তুমি বলতে পারবে বলো তারা?

তারা কেঁদেই ফেলেছে।নিঃশব্দে চোখের পানি ফেলে মাথা নিচু করে তারা উওর দিল,

----মা বিশ্বাস করো তুমি যেটা ভাবছো তেমন কিছু না।ক্যাপ্টেনের সাথে আমার কোনো অন্য সম্পর্ক নেই।

----তাহলে প্রতিদিন সকালে কেন এতো তাড়াহুড়ো তোমার বাইরে যাওয়ার।বলো আমাকে?বন্ধুত্ব করেছো।বন্ধুত্ব!তাও একজন পুরুষের সাথে।আরো সে কি না কতো বয়সে বড় তোমার থেকে।

----মা উনি আমার বন্ধু নন।

----তাহলে?

----উনি আমার কাছে ক্যাপ্টেন।শুধুই ক্যাপ্টেন।এছাড়া কোনো সম্পর্ক না।মানুষ হিসেবে ওনাকে আমি সম্মান করি।এর বেশি কিছু না।

----ক্যাপ্টেন !এটা কোনো কথা হলো না তারা।তোমাকে কি আমি এই শিক্ষা দিয়েছি।একজন পর পুরুষের সাথে দিনের পর দিন তুমি সকাল সকাল এভাবে চলাফেরা করেছো।রেস্টুরেন্টে পর্যন্ত গিয়েছো তুমি তার সাথে।ফোনে ও কথা বলেছো।তোমার লজ্জা করলো না একবার ও।

----মা আমি অনেক বড় পাপ করে ফেলেছি।এতো কিছু আমি সত্যি মাথায় আনিনি।

তারার কান্না দেখে মাহমুদা বেগমের ও বুকটা ফেটে যাচ্ছে।কিন্তু তাকে তো নরম হওয়া চলবে না।ছেলে মেয়েরা ভুল করলে বাবা মায়ের কষ্টের কাছে সন্তানের কষ্ট কিছুই না।আর বাবা মা যদি তখন শাসন না করে কোমল হয়ে যান তবে এই ভুল আবার করে তারা।

----ম্যাডাম আফারে মাফ কইরা দেন।আফা সত্যি আর কিছু করেনি।হামি তো সব সময় আফার লগে থাকতাম।সব দোষ ঐ গাছবান্দর ফুলচোর ডার।

----তুমি চুপ করো গাসু।তুমি তো আরেক নাটের গুরু।তোমাকে ও দেখছি।দুটোতেই বড্ড পেকে গেছো তাই না?

----মা গাসুকে কিছু বলো না।ওর কোনো দোষ নেই।আমার দোষ সব।তুমি আমাকে বকো। কিন্তু ওকে কিছু বলো না।

এরকম পরিস্থিতিতে ও গাসুর প্রতি তারার ভালোবাসা দেখে আরেক দফা অবাক হলেন মাহমুদা বেগম।রাগের মধ্যে ও মনটা শিথিল হয়ে গেল তার।রাগের মাথায় তিনি এটাও ভুলে গেছিলেন শাসনের মধ্যে ও ভালোবাসা থাকতে হয়।নইলে হিতে বিপরীত হতে পারে।

তারা কাছে গিয়ে তারার চোখ মুছে দিলেন তিনি।তারা ছলছল চোখে মাহমুদা বেগমের দিকে তাকালো।

----চল বসবি।অনেকক্ষণ দাঁড়িয়ে আছিস।পায়ে ব্যথা করবে।

তারাকে নিয়ে মাহমুদা বেগম সোফায় বসালেন।তারপর নিজে তারার পাশে বসলেন।তারা চোখটা শাড়ির আঁচল দিয়ে ভালো করে মুছে দিয়ে তারা কপালে গালে চুমু দিয়ে তারা কে বুকের সাথে জড়িয়ে নিলেন।তারাও নাক টানতে টানতে মাহমুদা বেগমের বুকে মুখ গুজলো।

মা মেয়ের দৃশ্যটা দেখে গাসু আর সৈকতের মুখে স্বস্তির হাসি ফুটে উঠলো।

----সাকি ভাই দেহেন,মেডাম একদম গইলা গেছে গা।

----তুমি বেশি প্যাকপ্যাক করো না গাসু।তোমার ওপর কিন্তু খেপে আছে চাচিমা।

----হ বুঝিবারছি। মেডাম সেই হাঙগ্রি হইয়া আছেন।

----হাঙগ্রি!চাচিমা না কেবল খাবার খেলো।

----এর সাইথা খাবার টানতেছেন কির লিগে?

----কেন?তুমি তো বললে হাঙগ্রি।

----আরে সাকি ভাই,সকিনার বাপ এটা মানে হইলো গিয়ে ভ্যাম্পায়ার।

-‌---ভ্যাম্পায়ার!

----উরে!বুঝেন না।রাগ রাগ।

---- ও টেম্পার।

----হ।

----আর ওটা হাঙগ্রি না এঙগ্রি হবে।

----ঐ তো হলেই হইতো।জানেন আমার তো ঐ পেহলি বার থেইকা ঐ ফুলচোর ডারে সন্দেহ হয়।

----ফুলচোর টা কে?

----ঐ যে গাছ বান্দরডা।চ্যাপটেন।

----গাসু বোইনরে ওটা ক্যাপ্টেন।

----ঐ তার মানে তাই।

----সন্দেহ হয় কেন?

----জানেন ঐ বজ্জাত ব্যাটার বস্তা আমাকে কি বলছিল?

----কি বলছিল?

----হে নাকি আমাগো ফুল বাগানের সব থেইকা সুন্দর ফুলডা ডাকাতি কইরা লইবো।এই জন্য তারা আফার লগে খাতের করতে আইছে।আই বুঝিবারছি। ব্যাটা ফুল চুরি কইরা ব্যবসা করব।

নাফিজের কথার অর্থ গাসু না বুঝতে পারলেও সৈকতের বুঝতে সময় লাগলো না।

----ও সাকি ভাই।কি ভাবেন?

----তুমি বাল বুঝেছো গাসু।

‌----বাল!হেইডা আবার কি?

----বাল হলো একটি উৎকৃষ্ট শব্দ বাঙালিদের কাছে।ইহা তাহাদের নিকট অতি জনপ্রিয়।তাদের দৈনন্দিন কথার মধ্য এটা থাকবেই।

----বুঝলাম না।

----বাল মানে চুল, কেশ বুঝেছো।

----হু বুঝছি।আমার তারা আফার মাথায় ও তো হেব্বি লম্বা বাল আছে।

----হুশ।চুপ কর।ঐ দেখো ওরা দুজন কি করছে।

মাহমুদা বেগম তারাকে জড়িয়ে মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছেন।

----তুমি বোঝো না মা এটা পাপ কাজ।আমি কি তোমার খারাপ চাই বলো?

----না মা।

----তাহলে!আর এরকম করবে না।

----মা তুমি ওনাকে যেরকম ভাবছো উনি সেরকম নয়।তোমাকে বললাম তো কতো বার উনি আমাকে সাহায্য করেছেন।

----যা করেছেন সেটা তার ভালো গুন নিঃসন্দেহে ।কিন্তু তুমি নিজে তো দেখেছো লেখাটা।ওর মানে কি দাঁড়ায় বুঝেছো তো?

----হুম।

----আর ওনার সাথে যোগাযোগ করবে না।একদম মাথা থেকে ঝেড়ে ফেলবে এসব।সামনে তোমার পরীক্ষা।ওটাতেই মন দেও।ঠিকাছে।

----হুম।

----চলো এখন খেয়ে নেবে।ওষুধ খেতে হবে তো।

----হুম চলো।

;;;;;

একটার পর একটা ছবি ছিড়ে ফেললো নাফিজ।লতিফা চুপচাপ দাড়িয়ে ছেলের কান্ড দেখছে।

----নে এবার তো থাম।

----কেন থামবো?তোমাকে বলে ছিনা আমি অন্য কাউকে ভাবতে পারব না।কেনো এসব মেয়েদের ছবি তুমি এনেছো?

----তাহলে কি করব আমি?আমাকে কি একটু বাঁচতে দিবি তুই?

----মা তুমি এসব কেন বলছো?

----কেন বলি বুঝিস না?কতো বয়স হয়েছে তোর দেখেছিস?তোর বাবা ও তোকে নিয়ে চিন্তায় থাকে।তোর কথা ভেবে কি না করেছি আমি।ভিটে মাটি ছেড়ে তোর সাথে এদিক ওদিক সব জায়গায় যাই।বয়স হচ্ছে আমাদের।তোর বাবা ও অবসরের মানুষ।এতো বছর বাড়ির ছাদের নিচে মাথা দেওয়ার সুযোগ পায়নি।এখন শেষ জীবনটাও কি মানুষটা এভাবে কাটাবে!আমাদের কথা একবার ভাব।তোকে কতোবার বলেছি মিষ্টি আসবে কি আসবে না তার কোনো নিশ্চয়তা নেই নাফিজ।আমি নিজে ও চাই ওকে খুঁজে পেতে।কিন্ত এতো গুলো বছর কেটে গেছে নাফিজ।ও ফিরবে না।

লতিফা কেঁদেই দিয়েছে প্রায়।নাফিজ নিজেও নিজের কাছে লজ্জিত।তার মা বাবা তার জন্য অনেক ত্যাগ করেছেন জীবনে।আর আজ সে তার বাবা মায়ের কান্নার কারণ হয়ে যাচ্ছে।

----মা আমি তো চেষ্টা করছি মিষ্টিকে ভোলার।ভুলতে কোনো দিন পারব না।কিন্তু বিশ্বাস করো শুধু তোমাদের জন্য আমি নিজেকে শক্ত করেছি।অন্য কাউকে নিয়ে বাঁচার স্বপ্ন দেখছি।শুধু তোমাদের জন্য।যার জন্য মিষ্টির নামটা ও দিন দিন আমার মনের কোনে আড়াল হয়ে যাচ্ছে।

----কেউ টা কে নাফিজ?এটা কি ঐ মেয়েটা?তোর স্যারের মেয়ে!

নাফিজ মাথা নিচু করে উওর দিল,

----হ্যাঁ মা।তারা।

----নাফিজ তোর কি মাথা খারাপ হয়েছে?আমি সেদিন ভেবেছিলাম হয়তো তুই মজা করছিস।এরকম দুষ্টুমি আগেও করেছিস।কিন্তু!

----কিন্তু কি মা?ও চলতে পারে না ঠিকমতো এটাই তো?

----হ্যাঁ।তুই একজন সুস্থ সবল মানুষ।তুই কেন ঐ অসুস্থ মেয়েটাকে নিয়ে জীবন শুরু করতে চাইছিস।

----মা একটা কথা বলবে?

----কি?

----আল্লাহ না করুক এখন যদি তোমার কোনো এক্সিডেন্ট হয় আর তোমার ও পায়ে সমস্যা হয় তুমি হাঁটার ক্ষমতা হারিয়ে ফেল।তখন কি তুমি বাবাকে বলবে তুমি অন্য কারোর সাথে জীবন গড়ো,আমি অসুস্থ মানুষ ।

----নাফিজ!

----মা আমি সত্যি টা বলছি।একটা সত্যি।একবার তুমি নিজের দিকটা ভেবে দেখো।

----নাফিজ মেয়েটা সুন্দরী।যাকে বলে ভয়ঙ্কর সুন্দরী।রূপ এর মোহ কিন্তু কাটতে সময় লাগে না নাফিজ।

----মা আমি তো ওর রূপের মোহে পড়িনি।

----তাহলে?

----হ্যাঁ ও সুন্দরী।অসম্ভব সুন্দরী।কিন্তু মা আমি যে ওর সৌন্দর্যের চেয়ে বেশি অন্য কিছু দেখেছি।

----মানে?

----মা জানো, আমি যখন আমার মিষ্টি পাখি র সাথে থাকতাম আমার ভেতর কেমন একটা অনুভূতি কাজ করতো।যতক্ষণ ওর সাথে থাকতাম কখনো মন চাইতো না চলে আসি।এই একি অনুভূতি টা হয় আমার যখন তারার আশে পাশে থাকি।ও যেন চুম্বক আর আমি যেন লোহা।চুম্বকের মতো টানতে থাকে আমাকে।কেন জানিনা?আর এই অনুভূতি টা আমাকে এমন ভাবে গ্রাস করেছে আমি দূরে যেতে পারিনা ওর থেকে।জানো মা আমি প্রতি সময় মোনাজাতে আমার মিষ্টি কে রাখি।প্রতিবার।তারা র সাথে দেখা হওয়ার পর থেকে কি হয়েছে জানিনা।চোখ বুজলে যেন মিষ্টির পাশে তারার মুখ,ওর কথা বলা সবকিছু যেন ভাসে আমার চোখে।আমি সব সময় অনুভব করি তারা আমার সাথেই আছে।আমি মিষ্টি কে ভালো বাসি মা।অনেক ভালোবাসি।কিন্তু ও যে আমার জীবনের একটা মরীচিকা হয়ে থেকে গেল।আমি তারাকে ভালোবেসে ফেলেছি।আমি তারার হাত ধরে মরীচিকা টা দেখে যাব একা একা।আমি মিষ্টিকে চেয়েছি শুধু আমার জন্য।কিন্তু তারাকে চাইছি আমাদের জন্য।তোমার আর বাবার কষ্ট টা আমি আর দেখতে পারছি না।নিজে ও স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলতে চাইছি।এজন্য মা।

লতিফা নাফিজের কাঁধে গিয়ে হাত রাখলো।

----তুই যাতে সুখী হোস আমরা তাতেই খুশি।শুধু এই উদাস নাফিজ টাকে আমি দেখতে চাই না।যা করবি তাড়াতাড়ি কর।হজে যাওয়ার আগে তোর বিয়ে দিয়ে যেতে চাই।

----দোয়া করো মা।

লতিফা নাফিজের মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে চলে গেল।

----মিষ্টির জায়গা মিষ্টির ই আছে।তারার জায়গাটা ও তার জায়গাতেই আছে।মিষ্টির জায়গা টা যেমন তারাকে দিতে পারব না,তারার জায়গা টাও মিষ্টিকে দিতে পারব না।

;;;;;

ফোনের রিংটোনের শব্দে বালিশ থেকে মাথা তুললো তারা।উপুড় হয়ে শুয়ে ছিল সে।ফোনটা হাতে নিয়ে নাফিজের নামটা দেখেই বুকটা কেপে উঠলো তার।

সকালের ঘটনা মনে পড়তেই তারার মন খারাপ হয়ে গেল।দেখতে দেখতে কল কেটে গেল।ফোনটা সাইলেন্ট করে তারা ফোনটা কে দূরে ঠেলে দিয়ে শুয়ে পড়লো।

----আমি এমনটা আপনার থেকে আশা করিনি ক্যাপ্টেন।নিজের বাবা মা না হয়েও মা আর বাপি অনেক করেছে আমার জন্য।আমি তাদের কষ্ট দিতে পারব না।

অনেকবার রিং হওয়ার পরেও তারা ফোন রিসিভ করলো না।এপাশে নাফিজের মনটা খারাপ হয়ে গেল।

----আপনি এমন কেন করলেন তারা?আপনার সাথে কথা না বললে যে আমার ঘুম আসবে না।আপনি যে ওষুধ হয়ে গেছেন আমার।আচ্ছা আপনি কি খাতা টি পড়েছেন তারা?নাকি আবার ও ভুলে গেছেন।যাই করুন কাল আপনাকে অনেক কিছু বলার আছে তারা।অনেক কিছু।

ফোনেদ স্ক্রিনে মিষ্টির ছবিটির ওপর হাত বুলিয়ে বুকের ওপর রাখলো নাফিজ।কিন্তু তার ঘুমের ওষুধ নেই।আজ আরেকটা রাত আধা নিরঘূম কাটবে নাফিজের।

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন