প্রেমবিলাস - পর্ব ০৫ - আরিশান নূর - ধারাবাহিক গল্প


হুট করে শ্রাবণ আলিয়াকে জড়িয়ে ধরল। আলিয়া চমকে দূরে সরে আসে। শ্রাবণ আলিয়ার দিকে অসহায় চোখে তাকিয়ে বলে,তুমি কি আমাকে ঘৃণা করো?

আলিয়ার চোখ ছলছল করে উঠল। শ্রাবণ কে ঘৃণা করার প্রশ্নই ওঠে না।

 ঘৃণা তাকেই করা হয় যে আপনার ক্ষতি করবে বা অতীতে করেছে৷ শ্রাবণ তো তার কোন ক্ষতি করেনি। বরং সে অবলা! তার প্রতি আলিয়ার কোন রাগ নেই। 

শ্রাবণ উঠে বসল। তার যে হাত-পা কাপছে সেটা আলিয়া দূরে দাঁড়িয়ে থেকেই ধরে ফেলে। 

আলিয়া শ্রাবণের কাছে আগাতে গেলেই শ্রাবণ মুখভর্তি বমি করে ফেলে হরহর করে। আলিয়া দ্রুত গিয়ে শ্রাবণের মাথা চেপে ধরে। শ্রাবণ বড় বড় করে শ্বাস নিচ্ছে। 

আলিয়া নরম গলায় বলে, তোমার কি কষ্ট হচ্ছে শ্রাবণ? 

শ্রাবণ মাথা নিচু করে বলে, নাহ। আমার কষ্ট হয় না।  

আলিয়া ভ্রু কুচকে শ্রাবণের দিকে তাকালো। ছেলেটার চোখ লাল হয়ে গেছে। গালের মাঝ বরাবর টসটসে দুইটা নোনাজল লেগে আছে। কিন্তু বর্তমানে তার চোখ শুকনা। 

আলিয়া পরম যত্নে শ্রাবণের গালে লেগে থাকা চোখের পানি মুছে দিল। শ্রাবণ অদ্ভুত ভাবে তার দিকে তাকিয়ে থাকে। 

আলিয়া মিস্টি করে হেসে শ্রাবণ কে উদ্দেশ্য করে বলে, তুমি শুয়ে রেস্ট নাও। আমি তোমার মাথায় পানি ঢালার ব্যবস্থা করছি। তোমার জ্বর এসেছে। শুয়ে পড়ো। 

শ্রাবণ বলে উঠে, আচ্ছা। 

আলিয়া দ্রুত পায়ে রুম ছাড়ল। দারোয়ান চাচা একটা মোটা চাদর গায়ে দিয়ে সিগারেট টানছিল। 
তাকে আসতে দেখে সিগারেট ফেলে দিল। 

আলিয়া দারোয়ান চাচার সামনে দাড়িয়ে চিন্তিত মুখে বলে, শ্রাবণের খুব জ্বর এসেছে। এখন কি করা যায়?

দারোয়ান বললেন, শ্রাবণ কে? 

--যেই ছেলেটা আপনার রুমে শুয়ে আছে ওর নাম শ্রাবণ। 

--ও। 

--এখন আমি ওর মাথায় পানি ঢালব। আপনি বালতি ভর্তি পানি নিয়ে আসেন আর সঙ্গে মগ আনবেন। 

--আচ্ছা। মামনি। 

দারোয়ান দশ মিনিট পর পানিভরে আনলেন এবং রুমে রেখে আসলেন। 

আলিয়া চুপিসারে রুমে ঢুকে গেটটা ভিজিয়ে দিয়ে শ্রাবণের মাথার কাছে চেয়ার টেনে বসল এবং তার মাথায় পানি ঢালা শুরু করে। শ্রাবণ মাথা উচিয়ে একবার আলিয়াকে দেখে নেয়। তারপর চোখ বন্ধ করে বিড়বিড় করে কি যেন বলতে লাগে যা বোধগম্য হয় না আলিয়ার৷ 

আলিয়ার শোনার ইচ্ছাও ছিলনা। সে এমনি টেনশনে আছে। বাবা যদি বাই চান্স সজাগ হয়ে যান? আলিয়া এমনি ভয়ে আছে তাই শ্রাবণ কি বলছে তার কানে যাচ্ছে না। 

কিন্তু শ্রাবণ ঘুমিয়ে যাওয়ার আগে অস্পষ্ট স্বরে যা বলল সেটা শুনতে পেল আলিয়া। শ্রাবণ জাবর কাটার মতো করে বলছিল, ভালোবাসি আলিয়া, ভালোবাসি আলিয়া,,,,,,,

আলিয়া ভড়কে গেল। কেন যেন সে শ্রাবণের মুখের কথাটা শুনতে চাচ্ছে না। আলিয়া বিরক্ত হয়ে উঠে দাড়ালো। শ্রাবণ হয়তোবা ততোক্ষণে ঘুমিয়ে গেছে৷ 

আলিয়া শ্রাবণ কে রেখে রুম ত্যাগ করে। তখন ভোরের আলো ফুটতে শুরু করে দিয়েছে৷ 

আলিয়া তার নিজের রুমে যেতেই আযান দিয়ে দেয়। এতো দ্রুত কিভাবে রাত অতিবাহিত হলো সেটাই বুঝে পাচ্ছে না আলিয়া। ঘড়ির দিকে তাকালো। সাড়ে পাচটা বাজে। বাইরে গেট খোলার শব্দ পেল সে। 

বাবা উঠে গেছেন। নিশ্চয়ই নামাজ পড়তে যাচ্ছেন। আচ্ছা আজকে যদি বাবা দারোয়ান চাচার রুমে ঢুকে পড়ে? তাহলে কি হবে? শ্রাবণ কে দেখলে কেলেংকারি ঘটে যাবে? আলিয়ার গায়ের রক্ত পানি হয়ে আসছে৷ এমনি বাবা খুব শান্ত স্বভাবের কিন্তু কঠিন রাগী। আলিয়া তার বাবাকে জমের মতো ভয় পায়। আলিয়ার বাবার নাম জসিমউদ্দিন খন্ডকার। প্রচন্ড রাগী তিনি। জসীম সাহেবকে আলিয়ার মাও খুব ভয় পেতেন। আট বছর আগে আলিয়ার মা না ফেরার দেশে চলে যান। প্রথম প্রথম মাকে ছাড়া থাকতে খুব কষ্ট হত। পরে একটা সময় সবটা সামলে নেয়। 

আলিয়া বাথরুমে গিয়ে ওযু করে এসে নামাজে দাঁড়ায়। নামাজ শেষ করে বারান্দায় গিয়ে দাড়ালো। হীম শীতল বাতাস বইছি। আলিয়ার বারান্দা দিয়ে দারোয়ানের রুমের পিছনের অংশ দেখা যায়। আলিয়া এক ধ্যানে রুমটার দিকে তাকিয়ে আছে। হুট করে তার চোখ হাতের আঙুলের দিকে পড়ল। রিংটা শ্রাবণ ফেলে দিয়েছে। 

আচ্ছা আয়ান যদি জানে আলিয়া তার দেওয়া আংটি হারিয়ে ফেলেছে তবে কেমন রিয়্যাক্ট করবে? রেগে যাবে নাতো?আলিয়া ঢোক গিলল। এই মূহুর্তে তার চায়ের পিপাসা পাচ্ছে। এক কাপ কড়া লিকারের দুধ চা খেতে পারলে মন্দ হত না! 

আবারো গেট খুলার শব্দ ভেসে আসছে। বাবা চলে এসেছেন বুঝি। 

★★★

জসীম সাহেব এই হাড় ভাঙ্গা শীতেও এক ওয়াক্তের নামাজ একদিন ও মিস দেয় নি। প্রতিদিন মসজিদে গিয়ে নামাজ পড়েন। গত বছর হজ্ব করে এসেছেন তিনি। এই এলাকায় তার কদর খুব৷ সম্মানিত ব্যক্তি সে। বড় বাজারে একটা ইলেকট্রনিকসের দোকান আছে তার। পুলপাড়ে তিনটা কাপড়ের দোকান। তার দুই ছেলে-মেয়ে। দুজন ই শিক্ষিত। আরহান বায়োকেমিস্টে পড়েছে আর আলিয়া ডাক্তারি পড়ে। পড়া শেষ হয়নি এখনো। 

জসীম সাহেব লোক মুখে শুনে এসেছে ডাক্তারি পড়া মেয়েদের তাড়াতাড়ি বিয়ে দিতে হয়। ডাক্তারি পড়তে গিয়ে নাকি মেয়েদের বিয়ে না করার ভুত ঘাড়ে চাপে। তাই তো জসীম সাহেবের আলিয়ার বিয়ে নিয়ে খুব তাড়া। মেয়েটার একটা ভালো বিবাহ হলেই আল্লাহর কাছে কোটি কোটি শুকরিয়া। তার মেয়েটা দেখতে শুনতেও ভালো। খালি চোখের নিচে একটু কালি। একটু না বেশ ভালোই কালি আছে। ছোট্ট বেলা থেকেই আলিয়ার চোখে কালি।তার মায়ের ও চোখে কালি ছিল। 

ডাক্তার মেয়ে জন্য চোখে কালি হওয়া আলিয়ার জন্য দোষের কিছু না। বছর দুয়েক আগে আলিয়া চোখে চশমা নিয়েছে। জসীম সাহেব তার কন্যাকে খুব ভালোবাসেন। কিন্তু মেয়েকে পাশে বসিয়ে গল্প করা হয়না। ছেলে-মেয়েরা বড় হলে বাবার সাথে একটা অদৃশ্য দূরত্ব তৈরি হয়। এজন্য দরকার একজন মা। মা এই দূরত্ব টা কিছুটা হলেও ঘুচিয়ে দেয়। তার বেলায় এটা সম্ভব হচ্ছেনা।

জসীম সাহেব দেখলেন দারোয়ান তার রুমের সামনে দাড়িয়ে আছে। সে ভ্রু কুচকে দারোয়ানকে প্রশ্ন করে,কুদ্দুস কোন সমস্যা? 

দারোয়ান হচকচিয়ে উঠে বলে, না তো স্যার। কোন সমস্যা নাই। 

--ওহহ। আচ্ছা। ঠিক আছে। আমি ভাবলাম কোন সমস্যা জন্য বাইরে দাঁড়িয়ে আছো। 

জসীম সাহেব তার বাসায় ঢুকে যায়। দারোয়ান ও রুমে ঢুকে। বাইরে দাঁড়ানো যাচ্ছে না। খুব শীত। আর মশার উপদ্রব তো আছে। 

রুমে ঢুকতেই কুদ্দুস দারোয়ান চমকে উঠে। শ্রাবণ মাথা নিচু করে বসে আছে। 

কুদ্দুস কে আসতে দেখে শ্রাবণ মাথা নিচু করে বলে, বাইরে দাঁড়িয়ে ছিলে কেন কুদ্দুস ভাই?

কুদ্দুস চমকে উঠে আরেকদফা। এই পাগল তার নাম কেমনে জানলো? 

সে আমতা আমতা করে বলে, তুই আমার নাম কেমনে জানলি?

শ্রাবণ রহস্যময় হাসি হাসল। তারপর মুখে গুরুগম্ভীর ভাব এনে বলে, আমি অনেক কিছু ই জানি। একটা সিগারেট দেন তো। সিগারেট ধরাব। 

কুদ্দুস ভ্রু কুচকে বলে, আমি সিগারেট খাইনা। 

--মিথ্যা কথা বলবেন না। পাপ হবে পাপ। পকেটে দুইটা সিগারেট আছে৷ একটা আমাকে দেন আর একটা আপনি খান। 

কুদ্দুস অবাক হয়ে গেল এবং বলল তুই কেমনে জানলি আমার কাছে দুইটা সিগারেট আছে? 

শ্রাবণ মুচকি হেসে বলে, লাইটার আছে? 

--না। 

--তাহলে সিগারেট কিভাবে ধরাবো?

কুদ্দুস চিন্তিত গলায় বলে, তুই না পাগল? পাগলে আবার এতো সুন্দর করে কথা কেমন বলে? 

শ্রাবণ শব্দ করে হেসে বলে, পাগল দের কি সুন্দর করে কথা বলা মানা নাকি?সিগারেট দেন ভাই। আমার কাছে লাইটার আছে। 

কুদ্দুস সিগারেট এগিয়ে দিল। শ্রাবণ লাইটার বের করে সিগারেট ধরিয়ে আয়েশী ভঙ্গিতে সিগারেটে ফুক দিল। তারপর কুদ্দুসের দিকে লাইটার এগিয়ে দেয়। 

কুদ্দুস সিগারেট ধরালো। তার কপালে চিন্তার ভাজ। শ্রাবণ কে তার সুবিধার লাগছে না। 

শ্রাবণ সিগারেট খেতে খেতে বলল, আপনার প্রথম পক্ষের বউ জানে ঢাকায় আপনি আরেকটা বিয়ে করে দ্বিতীয় বউ ঘরে তুলছেন? 

কুদ্দুস হা হয়ে গেল। তার হাত থেকে সিগারেট টা পড়ে গেল। সে ঘামতে শুরু করল। ভয়ে ভয়ে বলে,কেমনে জানলেন এই খবর?

--আমি অনেক কিছু ই জানি৷ 

--আর কি কি জানেন?(ভয় পেয়ে) 

শ্রাবণ বড়ই আগ্রহ নিয়ে বলে, সিন্নাবার আকরিকের ধাতু কি জানেন? মার্কারি! সিন্নাবার নামটা সুন্দর না? 

কুদ্দুস না বুঝেই বলে,হু। 

শ্রাবণ দ্বিগুন উল্লাস নিয়ে বলে, এক মিটার কাকে বলে বলেন তো! 

--জানি না তো। 

--আচ্ছা আমিই বলছি। শূন্য মাধ্যমে এক সেকেন্ডের 299,792,458 ভাগের এক ভাগ সময়ে আলো যে দূরত্ব অতিক্রম করে সেটা হলো এক মিটার। বুঝেছেন? উঠি এবার। 

কুদ্দুস মাথা নাড়ালো। শ্রাবণ হনহন করে বের হয়ে যায় আলিয়ার বাসা থেকে। যাওয়ার আগে পেছনে ফিরে আলিয়ার রুমের দিকে তাকিয়ে মুচকি হাসে এবং বলল, খুব শ্রীঘই আবার দেখা হবে আলিয়া!
.
.
.
চলবে..............................

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন