শ্রাবণ সিগারেট হাতে নিয়ে সামনের দিকে পা বাড়ালো। আস্তে আস্তে হাটছে সে। তার মধ্যে বিন্দুমাত্র তাড়া নেই। বরং শ্রাবণ প্রকৃতি উপভোগ করতে ব্যস্ত। সিগারেটে টান দিয়ে ধোয়া ছাড়ল শ্রাবণ। কুয়াশার ধোয়াশার সঙ্গে সিগারেটের ধোয়া মিশে গেল। এখন আর চেনার উপায় নেই কোনটা কুয়াশার ধোয়া আর কোনটা সিগারেটের!
সে কিছুটা সিগারেটের ধোয়ার মতো। কুয়াশার ধোয়ার সাথে দ্রুত মিশে যায়! যার ফলে পৃথক করে চিনতে পারেনা কেউ তাকে! সে যে আলাদা তা বোঝা দায় হয়ে পড়ে!
শ্রাবণ থমকে দাড়ালো। হুট করে তার হাত-পা কাপতে লাগলো। মাথায় সুক্ষ্ম ব্যথা অনুভব করতে লাগলো সে।
শ্রাবণ অস্থির হয়ে পড়ল। বারবার চারপাশে চোখে বুলিয়ে কাউকে খুজতে লাগলো সে। মিনিট দুইয়ের মাঝেই শ্রাবণ উম্মাদের মতো রাস্তায় ছোটাছুটি শুরু করল। অসাবধানে ছোটার কারনে ইটের সাথে পা লেগে হোচট খেয়ে রাস্তায় পড়ে হাটু ও হাতের কনুই ছিলে গেল। কিন্তু এতে ভ্রুক্ষেপহীন শ্রাবণ। সে বড় বড় করে শ্বাস নিচ্ছে। নাক দিয়ে শ্বাস নিতে পারছে না জন্য মুখ হা করে নিশ্বাস নিচ্ছে। শ্রাবণ অনিচ্ছা সত্ত্বেও চোখ বুজে ফেলে। চোখের সামনে অনেক দৃশ্য কিলবিল করছে। মাথার ব্যথাটা তীব্র থেকে তীব্রতর হচ্ছে৷ শ্রাবণ মাথায় হাত দিয়ে প্রচন্ড জোড়ে চিৎকার করতে লাগলো।
তার চোখ দিয়ে পানি পড়ছে৷ মুখ দিয়ে নিশ্বাস নেওয়ার চেষ্টা করায় মুখ শুকিয়ে আসছে। গলার ভেতরটা শুকিয়ে গেছে। বুকে পানির তৃষ্ণা ভাব অনুভূত হয়ে তার। এক গ্লাস পানি খেতে পারলে আরাম পেত সে।
শ্রাবণ উঠে দাড়ালো। দুই হাত দিয়ে মাথা চেপে ধরে কিছু সময় চোখ বন্ধ করে রেখে, সেভাবেই দাঁড়িয়ে থাকলো। তারপর মিনিট এক পর দৌড় লাগালো। উদ্দেশ্য খুজে পেয়েছে সে। সেদিকেই আগমন করছে।
★★★
আলিয়া ঘুম থেকে জেগে উঠল। চোখ কচলাতে লাগলো আলিয়া। ঘুম পূর্ণ হয় নি। আরো কিছু টা সময় ঘুমালে ভালো হত। আলিয়া ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখে আটটা বাজে। সে তড়িঘড়ি করে উঠে পড়ল।
বাবা তো বেরিয়ে গেছে বোধহয়। শ্রাবণ কে যে দারোয়ানের রুমে রেখে এসেছে। বাবা যদি তাকে দেখে ফেলে --- এই চিন্তা মাথায় পুজি করে আলিয়া কোন মতে গায়ে ওড়না জড়িয়ে বাসার বাইরে আসল।
দারোয়ান রুমের বাইরে দাঁড়িয়ে আছে। আলিয়া দারোয়ানকে দেখে কিছু টা সন্দেহ পোষণ করল মনে মনে। সে দারোয়ানের সামনে গিয়ে বলে, চাচা শ্রাবণ কোথায়?
আলিয়া বাহির থেকেই উকিঝুঁকি মেরে দেখল ভেতরে শ্রাবণ নেই। শ্রাবণ কে না দেখতে পেয়ে তার মনটা ছ্যাত করে উঠে।
এদিকে দারোয়ান আলিয়ার মুখে শ্রাবণের কথা শুনতেই তার মুখ ফ্যাকাসে হয়ে গেল।
আলিয়া আবার প্রশ্ন করে, শ্রাবণ কোথায় চাচা?
দারোয়ান আমতাআমতা করে বলে, ভোরের দিকে চলে গেছে৷
আলিয়া ভ্রু কুচকে বলে, কোথায় গেছে ও?
--জানি না।
আলিয়া কিছুটা আশাভঙ্গ হয়ে বলে, আপনি ওকে যেতে দিলেন কেন? জানেন না ও অসুস্থ?
দারোয়ান এবার মুখ খুলে। সে ভয়ে ভয়ে বলে, মামুনি ছেলেটা সুবিধার না। ওর থেকে দূরে দূরে থাকো।
আলিয়া আবারো ভ্রু কুচকে বলে, কি বলতে চাচ্ছেন আপনি? ক্লিয়ার করে বলেন।
দারোয়ান ঘাবড়ে গেল এবং মিনমিন সুরে বলে, আমার মনে হয় ছেলেটার উপর জ্বীনের আছড় আছে।
আলিয়া রেগে গিয়ে বলে, এসব কোন ধরনের কথা? আজেবাজে কথা বললেন না প্লিজ চাচা।
দারোয়ান মুখ কালো করে বলে, সত্যি বলছি মা।
আলিয়া দারোয়ানের আর কোন কথা না শুনে বাসার ভেতরে ঢুকে পড়ে। শ্রাবণ কোথায় যেতে পারে? কালকে রাতেই বলছিল শ্রাবণ নিজের বাসা চিনে না।আর আজকে জ্বর গায়ে নিয়ে লাপাত্তা হওয়ার কি মানে?
আলিয়া বাসায় যেতেই দেখতে পায় আরহান অফিস যাওয়ার জন্য রেডি হয়ে নাস্তা খেতে বসেছে৷ আলিয়া দ্রুত রান্না ঘরে গিয়ে চা বসালো। তারপর কিছুটা জোড়ে করে বলে, ভাইয়া চা বসিয়েছি। চা খেয়ে তারপর অফিস যা।
আরহান ড্রয়িং রুম থেকে বলে, আচ্ছা। একটু তাড়াতাড়ি কর।
আলিয়া দুই কাপ চা বানিয়ে আরহানের কাছে গেল। আরহান মুচকি হেসে আলিয়ার কাছ থেকে চায়ের কাপ হাতে নিয়ে চা খেতে লাগলো।
আলিয়া কিছুটা সংকোচ নিয়ে বলে, ভাইয়া শোন?
--হুম, বল!
আলিয়া একদন্ড থেমে গড়গড় করে বলে, শ্রাবণ কি আমাকে আগে থেকেই পছন্দ করত? অসুস্থ হওয়ার আগে থেকে? তুই জানিস এই ব্যাপারে কিছু?
আলিয়াকে শ্রাবণ কে নিয়ে প্রশ্ন করতে দেখে আরহান বিষম খায়৷ তার মুখের রঙ বদলে যায়। শ্রাবণ যে আলিয়া কে পছন্দ করে বা ভালোবাসত বহু আগে থেকে এটা জানানো যাবে না। এতে যদি আয়ান আর আলিয়ার সম্পর্কে কোন অসুবিধা হয়?
এসব আজগুবি চিন্তা ভাবনা করে আরহান উত্তরে বলে, না তো। শ্রাবণ তো তোকে চিনত ই না। পছন্দ তো দূরের কথা।
আলিয়া বলে,ওহ।
আরহান আলিয়ার দিকে এক পলক তাকিয়ে থেকে বলে, আলিয়া তুই অযথা চিন্তা করছিস। কিচ্ছু হয় নি বাবু। সব ঠিক আছে। আয়ান ও তো তোর উপর রাগ করেনি। তুই খামোখা টেনশন করছিস। আজকে আমি অফিস থেকে আসলে তোকে নিয়ে বিকেলে ঘুরতে বের হব।
আলিয়া ভাইয়ার কথা শুনে স্মিত হাসল।
★★★
আলিফ সাহেব আয়েশ চা খেয়ে বাথরুম করার জন্য রাস্তার ধারের দেয়ালের সামনে দাড়ালেন। চেইন খুলে মাত্র শুরু করবেন তার আগেই কেউ তাকে পেছন থেকে ধাক্কা দিতে লাগলো। সে বেশ বিরক্ত হলো। কিন্তু আমলে নিল না। নিজের কাজে মনোযোগ দিল। আবারো পেছন থেকে কেউ তাকে ধাক্কা দিতে লাগলো।
এবার সে রেগে গিয়ে পেছনে ঘাড় ঘুরালো। পেছনে একটা যুবক দাঁড়িয়ে আছে। লম্বাচওড়া দেখতে। ফর্সা চেহারা লাল হয়ে আছে। নাকের ডগায় বিন্দু বিন্দু ঘাম। সারা শরীর ঘামে ভেজা।চোখ দুটোতে অস্থিরতা খেলা করছে।
ছেলেটা আলিফ সাহেবকে বলতে লাগলো, তাড়াতাড়ি বাসায় যান৷
আলিফ সাহেব বিরক্ত হয়ে গেল এবং ঝাড়ি মেরে বলে, তুই কে রে? যা ভাগ৷
শ্রাবণ কিছুটা দমে গেলে। তারপর আওয়াজ উচিয়ে বলে, আপনি পনেরো মিনিটের মধ্যে বাসায় না গেলে ময়নার ঘোর বিপদ হবে। সময় নষ্ট করবেন না। আপনার ভাগ্য ভালো যে আমার সাথে দেখা হয়েছে৷ প্রকৃতি গিভস ইউ এ সেকেন্ড চান্স। দ্রুত বাসায় যান। দেরি করবেন না। আপনার কপালে আমি লাল সংকেত দেখতে পাচ্ছি৷ আলিফ সাহবে দেরি করবেন না।
আলিফ সাহেব হতভম্ব হয়ে গেল। কে এই ছেলেটা? তাকে কিভাবে চিনে? সবচেয়ে বড় কথা হলো তার মেয়ের নাম কিভাবে জানলো এই ছেলে? বাসায় কেন যেতে বলল ছেলেটা? ময়না তো অসুস্থ। ঘুমাচ্ছে তার মেয়ে। কি বিপদ হতে পারে?
শ্রাবণ তাগদা দিয়ে বলে, দ্রুত যান আলিফ সাহেব।
আলিফ সাহেব প্যান্টের চেইন লাগিয়ে নিজের বাড়ির দিকে ছুট লাগালো। ছেলেটার কন্ঠে কি যেন ছিল?যেটা সে তা উপেক্ষা করতে পারল না তাই তো নিজের বাসায় যাচ্ছে। মনে হচ্ছে কোন অদৃশ্য শক্তি তাকে জোড় করে বাসায় দিকে নিয়ে যাচ্ছে। আলিফ সাহেব বুঝতে পারছে না কি হচ্ছে তার সাথে।
আলিফ সাহেব তার বাসার সামনে এসে হতবাক হয়ে যায়। তার উপস্থিত বুদ্ধি থেকে শুরু করে চিন্তা করার ক্ষমতা লোপ পায়।সে চোখ বড় করে নিজের বিল্ডিংয়ের সামনে দাড়িয়ে রইল। বিল্ডিং এ আগুন লেগেছে। তার সাত বছরের মেয়েটার প্রচন্ড জ্বর। জন্ডিস ধরা পড়েছে। বাসায় মেয়ে একা। সে ভেতর থেকে গেট লক করে অফিস যাচ্ছিলেন। ভাগিস ছেলেটা তাকে বাসায় ফিরতে বলেছিল। আগুন এখনো পুরোপুরি কাবু করে নি বিল্ডিং টাকে। তার বাসায় আগুন এখনো লাগেনি। আলিফ সাহেব এক মূহুর্ত অপেক্ষা না করে নিজের মেয়েকে বাচানোর জন্য পা বাড়ালেন। কোন দিকে তাকানোর সময় নেই তার। তার কানে মানুষ-জনের চিৎকারের শব্দ ভেসে আসছে। সে সব উপেক্ষা করে নিজের প্রান ভোমরের কাছে ছুট লাগায়।
আগুন লাগার আগেই আলিফ সাহেব বাসায় ঢুকে ঘুমন্ত মেয়েকে কোলে নিয়ে বাসার বাইরে দৌড়ে চলে আসেন। আর মিনিট দশেক দেরি করলেই তার মেয়েটা বাসার ভেতরে আগুনে পুড়ে যেত!
মেয়েকে হারানোর ভয়ের তীব্রতার মাত্রা আলিফ সাহেবের মস্তিষ্ক থেকে একটা অচেনা মানুষ যে তাকে আগুন লাগার আগেই সর্তক করে গেল এটা ভুলিয়ে দিল! কি আশ্চর্য! কি আশ্চর্য!
.
.
.
চলবে.............................