বাসায় এসে নিবিড় নিজের রুমের দরজা বন্ধ করে দিল।রহিমা বেগম ফ্রেশ হয়ে কুয়াশাকে ফোন দিয়ে, কেমন আছিস মা?
-জেঠি মা,আজ রাতটা তো আমার কাছে থাকতেই পারতে!
-কাল সকালেই আসব। নিজের খেয়াল রাখিস মা।
কুয়াশা কিছু বলল না।দীর্ঘশ্বাস ফেলে ফোন রেখে দিল।
নিবিড় সারাদিন কিছু খায়নি। ফোন হাতে নিয়ে স্ক্রিনের দিকে তাকিয়ে আছে অপলক দৃষ্টিতে।কুয়াশার অনেকগুলো ছবি নিবড়ের ফোনে।একটার পর একটা দেখেই যাচ্ছে আর ভাবছে, সাদা শাড়িতে তাকে কেমন লাগছে? হয়তো রংহীন ঝাপসা চেহারায় ফুটে উঠেছে অভিমান আর শত কিংবা হাজারখানেক অভিযোগ। কিন্তু এই সাদা শাড়ি যে তোকে মানায় না,মানায় না রংহীন জীবন। আমি দিব তোকে সব রঙ ফিরিয়ে। আমি ভুল করেছি আমি শুধরাবো। কিন্তু কীভাবে ফিরিয়ে দিব আমি? কুয়াশা আমি জানি আমার প্রতি তোর এখন কতটা ঘৃণা।যতটা বেশি ভালোবেসেছিস হয়তো ততটাই ঘৃণা আমার প্রতি তোর।
তোসাব চলে যাওয়ার কয়েকটা দিন যেতেই জুয়েল আর আজমল হোসেন বসেছেন তোসাবের পরিবাররে সাথে।তোসাবের মা চুপ করে আছেন। আর ফুফু আর তোসাবের বাবাই সব কথা বললেন।শেষ মুহুর্তে সিদ্ধান্ত হলো কুয়াশাকে নিয়ে যাবে আজমল হোসেন।
কুয়াশা কে জামা কাপড় গুছিয়ে নিতে বলতেই ফুফু বললেন, ও কিসের জামা কাপড় নিবে? ওর নিজের কিছু আছে? সব তো আমাদের ছেলের দেওয়াই।
কুয়াশা স্বাভাবিক গলায় মুচকি হেসে বলল, চিন্তা করবেন না ফুফু আমি কিচ্ছু নিব না।যে মানুষটাই আমার থাকল না তার কিছুই আমার প্রয়োজন নেই।শুধু এই সাদা শাড়িটা তো অন্তত নিতে দিবেন।
ফুফু মুখ বাঁকা করে নিজের রুমে চলে গেলেন সাথে তোসাবের বাবাও।তোসাবের মা আর তিন্নির কাছ থেকে বিদায় নিয়ে দুপুরেই চলে এলো কুয়াশা।
কলিং বেলের শব্দ শুনে।শাহানাজ বেগম দরজা খুলে কুয়াশাকে দেখেই জড়িয়ে ধরলেন।কিছুটা সময় নিস্তব্ধ হয়ে মেয়েকে বুকের সাথে মিশিয়ে নিয়ে তারপর ছেড়ে দিলেন।কুয়াশা কিছু না বলেই নিজের রুমে যাওয়া জন্য পা বাড়াতেই আসিফা এসে জড়িয়ে নিলো।কুয়াশা তখনও চুপ হয়ে আছে।আসিফা ছেড়ে দিতেই নিজের রুমে গেলো। ছোট ভাই জাহিদ এসে কুয়াশার মাথায় হালকা স্পর্শ করতেই কুয়াশা মাথা উঠিয়ে তাকাল।
জাহিদের দিকে তাকিয়ে ফ্যালফ্যাল করে কেঁদে জড়িয়ে ধরলো।
জাহিদ নিজের চোখের পানি মুছে,চিন্তা করিস না বোন আমরা সবাই তোর পাশে আছি।
কুয়াশা মাথা উঠিয়ে, কতদিনের জন্য ভাইয়া? এই ভাইয়া, দেখ না আমার শাড়িটা খুব সুন্দর না? আমাকে কেমন মানিয়েছে রে? খুব ভালো দেখতে তাই না? তোরা চেয়েছিলে আমাকে শত রঙে রাঙাতে।কিন্তু আমার কপালে রঙ নেই।বুঝেছিস?
জাহিদ বোনের কথা শুনে আর সামনে দাঁড়িয়ে থাকতে পারল না।পিছাতে পিছাতে রুম থেকে চলেই গেলো। কুয়াশা স্বস্থির নিশ্বাস ফেলে খাটে বসল হেলান দিয়ে। চোখ বন্ধ করে নিজের অভিযোগের খাতাটা খুলতেই সেদিন গায়ে হলুদের রাতে ঘটনা চোখে ভেসে আসছে,
সবাই এক এক করে কুয়াশার কপালে হলুদ ছুঁয়ে সামান্য মিষ্টি দিয়ে মিষ্টিমুখ করল।কুয়াশার চোখ দুটো নিবিড়কে খুঁজতেই একটু দেরি করেই এলো নিবিড় টলমল চোখে। কুয়াশার কপালে হলুদ ছুঁয়ে সামান্য মিষ্টি মুখে দিতেই কুয়াশা মুখ ফিরিয়ে নিল।নিবিড়ও আর জোর করল না।চামচটা রেখে সরে দাঁড়াল দূরে।
রাতে আসিফার সাহায্যে হাতে মেহেদি লাগিয়ে দৌড়ে উঠে এলো ছাদে।আজও সে হাঁপাচ্ছে।নিবিড় হাঁপানো শব্দ শুনে পিছনে তাকিয়ে, তুই?
কুয়াশা হাঁপাতে হাঁপাতে উপর নিচ মাথা নাড়ল।
-কিন্তু তুই এইখানে কেন এসেছিস? সবাই দেখলে বুঝতে পারছিস কি হবে?
-যা হবার হবে। তবুও আজ আমি তোমার কাছে জানতে চাই।আমি আমার উত্তর চাই।
-কিসের উত্তর?
-তোমার চোখ যে কথা বলে,তোমার মন যে কথা বলে।কিন্তু তুমি মুখে অন্যটা বলে সবাইকে ধোঁকা দিচ্ছ সাথে আমাকেও।
নিবিড় শান্ত অসহায় চোখে তাকিয়ে, কি বলে আমার চোখ আর মন?
কুয়াশা সাবলীলভাবে বলল, তুমি আমায় ভালোবাস।তোমার মন বলে আমাকে প্রতিনিয়ত কাছে পেতে।চোখ বলে আমায় দুই নয়ন ভরে দেখতে।আমি ঠিক বলি নি?
কিন্তু তুমি কাউকে বুঝতেই দাও না।শুধু লুকিয়ে রাখতে চাও নিজেকে।কিন্তু কেন?বল আমাকে?
নিবিড় তাকিয়ে আছে কুয়াশার দিকে।খুব সুন্দর দেখাচ্ছে তাকে।এই সাজটা শুধু আমি আমার জন্যই চেয়েছিলাম।শুধু আমার জন্য।কিন্তু আজ এই সাজের মালিক অন্য কেউ হতে যাচ্ছে।কীভাবে মেনে নিব আমি? নিজেকে কীভাবে বুঝাব?
কুয়াশা কান্না জড়িত কন্ঠে, চুপ করে আছো কেন? বলো?
নিবিড় গম্ভীর গলায় বলল,তুই জানলি কি করে আমি এইখানে আছি?আজ ত তোর এখানে আসার কথা নয়।
কুয়াশা তাচ্ছিল্যের হাসি দিয়ে, আমি জানি তুমি অপেক্ষা করছো আমাকে দেখার।আমার সাথে একটু কথা বলার। আমাকে একটু কাছে পাবার। আমি এসেছি ত। এখন নাও না আমায় কাছে টেনে।নাও না তোমার বুকে জড়িয়ে। কথাটা বলে কুয়াশা চোখ বন্ধ করে কাঁদতে লাগল।নিবিড় নিজেকে আটকাতে পারল না।আস্তে করে কুয়াশার কাছে এসে চোখের পানিগুলো মুছে দিয়ে,বোকামি করিস না।নিচে যা। কেউ এসে তোকে এখনে দেখলে বদনাম হবে।তোর ভাইয়া তোকে এবার ছাড় দিবে না।
কুয়াশা কাঁদতে কাঁদতে ঝাঁঝালো গলায় বলল,লাগবে না ছাড়।শুধু তুমি আমায় তোমার বুকে একটু জায়গা দাও।সারাজীবন আমি কাটিয়ে দিতে পারবো।দিবে তোমার পাশে আমায় একটু ঠাই।কথাটা বলেই নিবিড়কে মেহেদি হাতে জড়িয়ে ধরলো। নিবিড় কিছু না বলে মুক্তির মত দাঁড়িয়ে আছে।কুয়াশা থামল না।সে আবার বলতে লাগল, দিবে একটু ঠাই? আচ্ছা ঠিক আছে তুমি আমাকে রেখে আবার বিয়েও করো, ওর সাথেই থেকো,ওর সাথেই ঘুমাইও।তুমি শুধু ঔষধের মতো তিন বেলা আমায় একটু বুকে জড়িয়ে কপালে চুমু দিয়ে বইলো,কুয়াশা আমি তোমাকে ভালোবাসি, শুধু তোমাকে।আর আমার সাথে একটু ভালো করে কথা বইলো, তাতেই চলবে আমার।
কথাটা শুনে নিবিড় কুয়াশাকে নিজের বুক থেকে উঠিয়ে, গালে কষিয়ে একটা থাপ্পড় দিয়ে, চেঁচিয়ে ধমকের স্বরে বলল,যা আমার চোখের সামনে থেকে।এখুনি যাবি তুই।যেখানে তোর মুখ আমি দেখতে চাই না। সে জায়গায় ভালোবাসা আসছে কোথায় থেকে?
তোকে আমি কোনো দিন বলেছি আমি তোকে ভালোবাসি? না ভালোবাসি না।তোর বাবার কারণে আমার বাবা আজ দুনিয়ায় নেই, আর সেই মেয়েকে আমি ঘরে বউ করবো,এইটা তোর ভাবনায় আসে কি করে?
কথাটা বলতেই কুয়াশা ধপাস করে বসে নিবিড়ের পা জড়িয়ে, প্লিজ আমার বাবার অন্যায়ের শাস্তি তুমি আমাকে কেনো দিচ্ছ? আমি তোমাকে কথা দিচ্ছি তোমার জন্য আমি আমার পরিবারকে ছেড়ে দিব। তবুও তুমি আমাকে তোমার ঘরে একটু জায়গা দাও।আমি যে তোমাকে ভালোবেসে মরে গেছি।এই দুনিয়ায় শুধু আমার দেহ আছে আর মন প্রান পড়ে আছে তোমার বুকে।কথাগুলো শুনে নিবিড় আর সহ্য করতে পারছে না।চোখ বন্ধ করলেই চোখের পাতা ছুঁয়ে স্রোতের মতো বেয়ে যাচ্ছে পানি।নিবিড় নিজের মন শক্ত করে ভাবল এইভাবে কুয়াশাকে বুঝানো যাবে না।ওকে এমন কিছু বলতে হবে যাতে ও নিজেকে সংযত করে এইখান থেকে চলে যায়।নিবিড় কড়া গলায় বলল, যে বিয়ের আগেই অন্য একটা ছেলেকে জড়িয়ে ধরতে পারে,কোথায় কোথায় তার বুকে মাথা রাখার ছুতো খুঁজে সেই মেয়েকে বিয়ে? এইটা আমার পক্ষে সম্ভব নয়। তোর মতো মেয়েকে তোসাব নামের ছেলেটার সাথেই মানায়।কথাগুলো বলতেই কুয়াশা স্তম্ভিত হয়ে গেলো।কান্না থামিয়ে স্তব্ধ নির্বিকার মুখে উঠে দাঁড়িয়ে নিবিড়ের দিকে তাকিয়ে আছে অসহায় দুটো চোখে।
-ওইভাবে আমার দিকে তাকিয়ে না থেকে নিজের দিকে তাকিয়ে দেখিস আয়নার সামনে।নিজেকে কতটা নিচে নামিয়েছিস ভালোবাসার কথা বলে বলে।তুই বল, আমি ছেলে হয়েও কি তোর ডাকে সাড়া দিয়েছি কখনো। কিন্তু তুই মেয়ে হয়েও কতটা নির্লজ্জ ভেবে দেখ। রাতের পর রাত আমার সাথে এই ছাদে একা কাটিয়েছিস।তোর ভাগ্য ভালো আমি ছিলাম, অন্য কোনো ছেলে কি তোকে ছাড় দিতো? দিত না।তোসাব ছেলেটাও খারাপ না।তোর সাথে,,,,,,
নিবিড় আরও কিছু বলতে যাবে তখনি কুয়াশা হাত উঠিয়ে থামিয়ে দিল।ব্যাস,,,! আর কিচ্ছু আমি শুনতে চাই না।তুমি আমাকে এক রাতেই অন্ধকার গলিতে পাঠিয়ে দিলে।যেখান থেকে চাইলেও পাপ মুক্ত হতে পারব না।কথায় কথায় বানিয়ে দিলে নষ্টা মেয়ে।
নিবিড় কুয়াশা বলে চিৎকার দিয়ে আরেকটা গালেও থাপ্পড় বসিয়ে দিল।
কুয়াশাকে চুপ হয়ে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে নিবিড় এগিয়ে ধরতেই কুয়াশা ঝাঁঝালো কণ্ঠে, ছাড়ো আমাকে। ছুবে না আমাকে।
কুয়াশার গলাটা কান্নায় আটকে যেতেই দৌড়ে নিচে নেমে গেলো।
নিবিড় নিজের হাত রেলিংএর হাতলে ঘুসি দিয়ে,জোরে জোরে কাঁদতে লাগলো।এই কান্না যে কেউ শুনবে না। শুধু তাকিয়ে দেখছে আকাশ বাতাস।কুয়াশা আমি তোকে কতটা ভালোবাসি তুই নিজেও জানিস না।তুই এক ঘন্টায় আমার কথা যতবার ভাবিস আমি তোর কথা তার দ্বিগুণ ভাবি।তোকে নিয়ে দেখা আমার স্বপ্নগুলো মিথ্যা হয়ে যাচ্ছে সেই কষ্ট আমি কাউকে দেখাতে পারছি না।সবাই জানে আমি স্ট্রং, সবকিছুই সামলে নিতে পারি।তাহলে কেনো পারিনা তোকে ভুলতে? কেনো পারি না নিজেকে সামলাতে।কথাগুলো যত বলছে নিবিড় ততটাই হাউমাউ করে কেঁদেই যাচ্ছে।পরেদিন কুয়াশার বিয়েতে নিজের মনকে শক্ত করে কুয়াশাকে বিদায় দিল।
ঠক্ ঠক্ ঠক্ শব্দ ঘুম ভেঙ্গে গেলো কুয়াশার। কখন যে ভাবতে ভাবতে ঘুমিয়ে গেছে টের পায়নি।আসিফা দুপুরের খাবার নিয়ে এসেছে। দীর্ঘশ্বাস ফেলে, ভাবী, জেঠি মা আমায় দেখতে আসি নি?
আসিফা মুচকি হেসে, এসেছে সাথে নিবিড় ভাইয়াও।কথাটা শুনে চুপ করে নিচের দিকে তাকিয়ে আছে কুয়াশা। আসিফা আবার বললো,আসার সময় জেঠি মা একটা শাড়ি এনেছে তোমার জন্য।তুমি ঘুমাচ্ছিলে তাই তোমাকে জাগায় নি। রেখেই চলে গেছে।
-শাড়ি!
- হ্যাঁ, এখন আসো খেয়ে নাও।
-খেতে ইচ্ছে করছে না।কিন্তু হঠাৎ শাড়ি কেনো দিবে জেঠি মা?সাদা শাড়ি দিয়েছে তাই না?
-না তো।দাঁড়াও আমি নিয়ে আসছি।
আসিফা ড্রইংরুম থেকে বেগুনি রঙের শাড়িটা এনে কুয়াশার সামনে রাখতেই, কুয়াশা কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকতেই চোখের পানিগুলো ঝরঝর করে ঝরছে। আসিফা হতভম্ব হয়ে,কী হয়েছে কুয়াশা?
-কিছু না ভাবী।এই মানুষটা আমায় হয়তো কাঠের পতুল পেয়েছে।তাই শুধু আমাকে কষ্ট দিতেই ভালোবাসে। আমি তো এখন ওকে নিয়ে আর ভাবি না।তাহলে কেনো আমায় এইসব,,,,,
আসিফা কুয়াশার কথার মাঝেই বলল, তুমি সত্যিই কি ভাইয়াকে ভুলতে পেরেছ? না পারো নি।এবং কি উনিও তোমায় ভুলতে পারে নি।
কুয়াশা বিরক্তিকর গলায় বলল,ভাবী প্লিজ আমি ওর কথা শুনতে চাই না।আমাকে একা থাকতে দাও।তুমি যাও তো এখন।
-যাব আগে খেয়ে নাও।মা এসে যদি দেখে তুমি খাও নি। তাহলে আমার উপর রেগে যাবে।
কুয়াশা কিছু আর বলল না।চুপ করে ছিল খানিকটা সময়।