রাত বারোটায় বিভানের ফ্লাইট ল্যান্ড করে দিল্লী বিমানবন্দরে।জুলি নিজের বাসার জন্য বেরিয়ে গেলো আর বেলা কে নিয়ে বিভান বেরিয়ে পড়লো নিজেদের বাসার উদ্দেশ্যে।সারারাস্তায় বেলা কেমন যেন অস্থিরতার মাঝে ছিলো।বিভান গাড়িতে বেলার হাত ধরেই ছিলো।বেলার হাত কাঁপছে তা বিভান বুঝতে পারে।তবে বেলা কেন এমন করছে বুঝতে পারছেনা।বিভান বারবার জিজ্ঞেস করছিলো,
''বেলা কি হয়েছে তোমার? "
বেলা মলিন কন্ঠেই বারবার জবাব দিয়ে গেছে,
'' আমার কিছু ভালো লাগছেনা।বুকটা যেন বন্ধ হয়ে আসছে ধীরে ধীরে।"
বিভান বেলার মুখ নিজের দিকে ফিরিয়ে বলল,
''পানি খাবে?"
''উহুম।"
বিভান এবার কিছু না বলে বেলাকে বুকে টেনে নেয়।অন্তত এভাবে যদি শান্তি পায়।ঘরে পৌছুতেই ফোড়ন কাঁটেন বন্দনা আখতার।তিক্ত কন্ঠে বললেন,
''বাহ!!!বৌকে নিয়ে খুব ঘুরলি।দেখি আমার জন্য কি আনলি।নাকি আমাকে ভুলে গেছিস?"
মায়ের কথায় কিছুটা অস্বস্তি বোধ করে বিভান।ওরা মাত্রই এলো অবশ্যই ক্লান্ত।কিন্তু মা ও না? তারপরও মুখে ম্লান হাসি এনে বিভান বলল,
''সব এনেছি মা।তবে কাল বের করি?এমনিতেই আমার মাথা খুব ব্যাথা করছে।"
বন্দনা আখতার বললেন,
''ঠিক আছে গিয়ে রেস্ট কর।"
বেলাকে নিয়ে বিভান এগুতে গেলে বন্দনা আখতার বললেন,
''বেলা রাতের খাবারটা রেডি করতে হেল্প কর।কুক আজ বাড়ি গেছে।"
বিভান বলল,
''মা হঠাৎ বাড়ি কেন?"
''ওর বাবা অসুস্থ।বেলা আয়।"
বিভান বেলার দিকে একবার তাকিয়ে মায়ের দিকে চোখসরিয়ে এনে বলল,
''মা আটঘন্টা প্লেনে ছিলাম।দুজনেই খুব টায়ার্ড।বাহির থেকে আনিয়ে দেই।বলো কি খাবে?"
প্রচন্ড বিরক্তিকর মুখে বন্দনা আখতার বললেন,
''শোন বাবা অনেক মাথায় চড়িয়েছিস আর না।বাসে তো আর আসেনি।প্লেনে এসেছে।এতো আরামের কি হলো?জমিদার ও?"
বিভান রেগে যায়।বেলা অশ্রুসজল চোখে স্বামীর দিকে তাকায়।লোকটা নিশ্চয়ই মায়ের সাথে তর্ক করবে কিন্তু বেলা চায়না।ও কিছু বলতে গেলে বিভান রেগে গেলে ও স্বাভাবিক কন্ঠে বলল,
''মা এখানে জমিদার গরীবের কথা উঠেনি
তুমি জানো প্লেনে বসা আরামদায়ক না।পা রাখতে কষ্ট হয়।আর আটঘন্টার সময় কিন্তু কম না।আজ বাহির থেকে খাও। কাল ও রান্না করুক।"
বন্দনা আখতার কিছু বলতে গেলে বেলা বিভানের হাত ছাড়িয়ে বলল,
''আমি ঠিক আছি মা।একদম খারাপ লাগছেনা আমার।বিভান আপনি গিয়ে টেস্ট করুন।মা বলুন কি বানাবো?"
''আপনি জমিদার গিয়ে শুয়ে পড়ুন।আপনার কিছু করতে হবেনা।ছেলেটাকে তো একদম আঁচলে বেঁধে ফেলেছিস।"
বিভান প্রচন্ড রেগে বেলাকে নিয়ে উপরে যেতে চাইলে বেলা বলল,
''আমি খাবার রেডি করে আসি।আপনি যান।"
বিভান প্রচন্ড রেগে বলল,
''you are unbelievable Bella."
বলেই রুমে চলে যায় বিভান।বন্দনা আখতার বেলার দিকে মুখ ভেংচি দিয়ে রুমে চলে যায়।বেলা চোখ মুছক নেয়।ওর খুব খারাপ লাগছে।কিন্তু বেশি খারাপ লাগছে লোকটা চলে গেলো।খুব রেগে গেছে সে।বেলা পাকঘরে এসে গরম পানি বসিয়ে সেখানে লবন আর আটা দেয়। প্রায় দেড় ঘন্টার মধ্যে সবজি আর রুটি বানিয়ে কাজের লোকের সাহায্যে খাবার টেবিলে আনে বেলা।মায়ের রুমে যেতে ও ভয় করছে।তারপর ও ওনার রুমের সামনে এসে দাঁড়ায় বেলা।ওনি খাটে শুয়ে আছেন।বেলা বলল,
"'মা খেতে আসুন।"
বন্দনা আখতার বললেন,
''নিজে গিয়ে গিল সব।আমার খেতে হবেনা।"
''মা ওনার কথায় রাগ করবেননা।ওনি মন থেকে বলেনি।"
বন্দনা আখতার খাট থেকে নেমে তেড়ে এসে বললেন,
''আমার ছেলে ও।ওর সাথে রাগ করবো কি করবোনা সেটা আমার ব্যাপার তোর না।তুই ছোটলোকের বাচ্চা আমার ছেলেকে কেড়ে নিয়েছিস।তোর উপর আল্লাহর নালত পড়বে।"
বেলা কেঁদে বলল,
''মা এভাবে বলবেননা।আপনি আমাকে কেন পছন্দ করেননা জানিনা।আমি আপনার মন জুগিয়ে চলার অনেক চেষ্টা করেছি পারিনি।"
''পারবিওনা।আমি তোকে কখনো মানতে পারবোনা।আমার ছেলের জীবন থেকে সরে যা।তোকে আমার সহ্য হয়না।"
বেলা কিছু বলতে পারেনা।থমকে দাঁড়িয়ে থাকে।বন্দনা আখতার কিছু না বলে ওর সামনে দরজা লাগিয়ে দেয় জোরে।য়ার কারনে বেলার পায়ের ছোট আঙ্গুলের ওপর দরজা চলে আসে।বেলা চিৎকার করতে পারেনা।সেখানে আঙ্গুল ধরে বসে পড়ে।আঙ্গুল টা সাথে সাথে অনেক গরম হয়ে গেলো।বেলার গলা আটকে আসছে।চোখজোড়া বেয়ে অজস্র অশ্রু কনা গড়িয়ে পড়ছে।বেলা পা থেকে আঙ্গুল সরিয়ে দেখলো একদম নীল হয়ে গেছে।কষ্ট করে উঠে দাঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে রুমে আসে।বিভান বিছানায় শুয়ে ফোন চালাচ্ছে।বেলা চোখ মুছে গলা পরিষ্কার করে বলল,
''খেতে চলুন।"
''না।"
বেলা এবার ওর কাছে এসে হাত টেনে বলল,
''প্লিজ।খুব কষ্ট করে বানিয়েছি চলুন।"
বিভান হাত সরিয়ে ধমকে বলল,
''বেলা প্লিজ জ্বালিওনা।"
বেলা আবার ও ওর হাত টেনে বলল,
''চলুন আমার খিদে পেয়েছে।"
বিভান এবার জোরে চিৎকার করে বলল,
''বললাম না যেতে।"
বলেই বেলা কে অজান্তে ধাক্কা দিয়ে বসে।বেলা ফ্লোরে পড়ে যায়।পায়ের ওপর জোরে চাপ লাগে।তারওপর ওর পিঠে খুব ব্যাথা।বিভানের হুঁশ হয়।নিচে বসে বেলাকে ধরে বলল,
''আ'ম সরি বেলা।এমন করতে চাইনি।"
বেলা কেঁদে যাচ্ছে।বিভানের হাত সরিয়ে রুম থেকে বেরিয়ে গেলো কাঁদতে কাঁদতে।বিভান দৌড়ে এলো ওর পিছু পিছু।বেলা গেস্ট রুমে ঢুকে দরজা লক করে কাঁদতে শুরু করে।এমন টা কখনো করেনি সে তাহলে আজ কেন?
....................সকালে ঘুম থেকে উঠে আদনান। কুঞ্জনের মাথায় চুমু খেয়ে বাবার গায়ে কাঁথা জড়িয়ে দেয়।আজ বেশ ভালো লাগছে।হালকা শক্তি ও পাচ্ছে।খবরের কাগজ নিয়ে বসলো ও।সাঁঝ ও উঠেছে।নিশাদ অবাক হয়ে বলল,
''কিরে এতো সকালে?"
সাঁঝ কুরআনশরীফ পড়ছিলো।ভাইয়ের ডাকে ও নিশাদের দিকে তাকিয়ে বলল,
''ফজরের নামাজ পড়ে ঘুমাইনি।কুরআন শরীফ নিয়ে বসলাম।ঘুম পাচ্ছেনা।"
''এক কাপ চা করে দিস কুরআন তেলওয়াত শেষ হলে।"
''এক্ষুনি করে দিচ্ছি।"
''আরে না আগে শেষ কর।জোরে পড় আমি ও শুনবো।"
সাঁঝ হেসে জোরে পড়তে থাকে।সাতটায় বাবা উঠে দেখেন নিশাদ টেবিলে বসে চা খাচ্ছে।ইকরাম রাহমান বললেন,
''শরীর কেমন?"
''আলহামদুলিল্লাহ আব্বা।"
''হুম।সাঁঝ আমারেও এক কাপ চা দে।"
সাঁঝ রুটি বেলতে বেলতে বলল,
''আনতেছি আব্বা।ওনি বসে খবরের কাগজ পড়তে থাকেন।কিছু মুহূর্ত পার হতেই কলিংবেল বেজে উঠে।সাঁঝ রুটি ছেড়ে দরজা খুলে দিতে আসে।দরজা খুলে দেখলো অপরপাশে আদনান দাঁড়ানো।ওর কাল আসার কথা কিন্তু আজ এসেছে দেখে সাঁঝ বলল,
''কিরে চলে আসলি?"
''ভিতরে ঢুকতে দে।"
হাঁপাতে হাঁপাতে বলল আদনান।নিশাদ ইকরাম রাহমান ছুঁটে এলো আদনানের কথা শুনে।ওর শার্ট পুরো ভেজা। নিশাদ আদনানের পানে চায়
।ভাইকে ভালো দেখাচ্ছেনা।ইকরাম রাহমান জিজ্ঞেস করেন,
''কিরে আজ এলি যে?"
''আদনান সোফায় বসে বলল,
'আব্বা আমি পালিয়ে এসেছি।"
নিশাদ অবাক হয়ে বলল,
''মানে কি?তোর কাজ তো শেষ হয়নি।"
''ভাই কোন কাজ নাই।তারা ফ্রড।কাজের নামে মানুষের টাকা মেরে খায়।"
অতঃপর আদনান সব খুলে বলল।ওরা ওর সাথে কি করেছিলো।
ইতোমধ্যেই বাকিরা উঠে গেছে।জুলেখা বানু ছেলের কথা শুনে কেঁদে দেন।নিশাদ জিজ্ঞেস করলো,
''কিভাবে আসলি তুই?"
''ভাই যে ছেলে আমার জন্য খাবার এনেছিলো ও আমাকে খুব সাহায্য করে।কোম্পানির ওরা খাবার পরে যে যার রুমে চলে যায়।আমি ঐ ছেলে কে বললাম ভাই আমাকে একটু সাহায্য করো আমি বাসায় যাবো।ঐ ছেলে আমাকে বাহিরে বের করে আনে।একটা ব্যাপারটা হলো সিকিউরিটি তেমন কঠোর না।তাই কিছু টা সহজ হয়ে গেছিলো।সেখান থেকে বেরিয়ে আমি রাকিবকে কল দিয়ে বললাম আমাকে পাঁচশত বিকাশ করার জন্য কারন বসের সেক্রেটারি আমার টাকা দেয়নি আর।তার সাথে দেখা হয়নি।বন্ধু বলল ও পাঠাচ্ছে।ও টাকা পাঠানোর পর আমি ঐ ছেলের সাহায্যে বাসে উঠি।কুমিল্লা পর্যন্ত আসার পর বিকাশের টাকাটা তুলে নিতে যাই কিন্তু প্রত্যেকটা দোকান বন্ধ।তারপর ফার্মগেটে এসে টাকা নেই।"
সব শুনে জুলেখা বানু কেঁদে বললেন,
''আল্লাহর অশেষ রহমত তুই আইছোস।"
নিশাদ বলল,
"'ওরা কই?"
''চিটাংগে।"
বলেই উঠে দাঁড়ায় আদনান।মেইন ডোর খুলে বেরিয়ে যেতে নিলে নিশাদ জিজ্ঞেস করে,
'' কই যাস?"
''কেস করবো ওদের নামে।শুধু আমার সাথে না ওরা অনেকের সাথে এমন করছে।"
নিশাদ বলল,
''আমি ও আসি।একা যাবি না তুই।"
''ঠিক আছে ভাইয়া।"
নিশাদ কাপড় পাল্টে আদনানকে নিয়ে বেরিয়ে যায়।পুলিশ কম্পলেইন করতে গেলে ইন্সপেক্টর কোম্পানীর নাম শুনে বললেন,
''আপনারা ইন্টারভিউ নেয়ার আগে কোম্পানীর সম্পর্কে ভালো করে খোঁজ নেবেননা।এরা কোন কোম্পানীর লোক না।এমনকি এই নামে কোন কোম্পানীই নাই।এরা নানান কথায় ফাঁসায় এবং প্রশিক্ষণের নামে মানুষের টাকা মেরে খায়।আপনারা বড় বাঁচা বেঁচে গেলেন।তবে চট্টগ্রামের থানায় কল দিয়ে বলে দেয়া হয়েছে।তারা ওদের ধরবে।আপনারা বাসায় যান।কি হয় না হয় সেটা আপনাদের জানায় দিবো।"
নিশাদ আর আদনান বেরিয়ে আসে।আদনান শান্তির নিশ্বাস ফেললো।ভীষন ভালো লাগছে ওর এখন।নিশাদ বলল,
''কোন খোঁজ নিয়েছিলি এলাই করার আগে।"
''ভাই গুগলে এতো ভালো রিভিউ ছিলো আমি ভাবতেই পারিনি ওরা এমন।"
''তাহলে বুঝ কতোবড় গর্দভ তুই।আমাকে তো একবার বলতে পারতিস।কিন্তু বলিসনি পাকনামি করে চলে গেলি।"
রেগে বলল নিশাদ।আদনান মন খারাপ করে বলল,
''এমন আর কখনো হবেনা ভাই।মাফ করে দে।"
নিশাদ নিজেকে কিছুটা সামলে বলল,
''যা হওয়ার হয়ে গেলো।এরপর থেকে যা করবি আমাকে জানাবি।তবে পালিয়ে এসে ভালো করেছিস। বুদ্ধিমানের কাজ হয়েছে।"
আদনান ম্লান হেসে ভাইকে জড়িয়ে ধরে।"
..................এদিকে বিকেলে রিদ্ধিকে পড়িয়ে সাঁঝ লিফ্টে উঠে।হয়ত আশা করছিলো সাইমন কে দেখবে।কিন্তু পায়নি।লিফ্ট তিনতলায় নামে।সাঁঝের বুক কেমন যেন করতে থাকে।কারন সাইমনরা তিনলায় থাকে।লিফ্ট একতলায় আসে।সাঁঝ বেরিয়ে সিড়ি দিয়ে উঠে যেতে শুরু করে দৌড়ে।আজ যেভাবে হোক কথা ও বলবেই।সে এভাবে না কথা বলে থাকতে পারবেনা।সাঁঝ নিজের কৃতকর্মে লজ্জিত।তিনতলায় এসে সাইমনদের বাসার দরজার সামনে থামে ও।কলিং বেল বাজাতেই সিয়াম এসে দরজা খুলল।সাঁঝ ভিতরে এসে বলল,
''ভাইয়া সাইমন আছেন?"
''হ্যা কিন্তু তুমি?"
''ওনার সাথে কথা আছে আমার খুব দরকার।"
সিয়াম ভিতর থেকে জোরে ডাকলো,
''সাইমন এদিকে আয়।"
সাইমন কন্ঠস্বর শুনতে পায় সাঁঝ।সে বলছিলো,
''আসি।"
সাঁঝের হৃদকম্পন যেন অনেকটাই বেড়ে।অশ্রুগুলো আড়ালে মুছে নেয় ও।
!!!!
চোখজোড়া ভরে আসতে চায় সাঁঝের।তবে সামলে নেয় ও নিজেকে।সাইমন এসে ভাইয়ের পাশে দাঁড়িয়ে সাঁঝকে দেখতে পায়।সাঁঝ সাইমন একে অপরের দিকে চেয়ে আছে।সিয়াম সাইমনের দিকে চেয়ে বলল,
''তোকে ডাকছিলো ও।"
সাইমন ভাইয়ের দিকে তাকায় তার কথা শুনে তারপর আবার সাঁঝের দিকে ফিরে।সাঁঝ কথা বলতে পারছেনা ওর গলা কাঁপছে।সাইমন বলল,
''কি বলবে?"
সাঁঝ কি যেন বলার চেষ্টা করে ও পারছেনা।ওর চোখজোড়া বড্ড দূর্বল লাগছে।নাক ঠোঁট একদম লাল হয়ে আছে।সাইমন ভাইয়ের আবার তাকাতেই সিয়াম বলল,
''আমি রুমে যাই তুই কথা বল।"
বলেই রুমে চলে গেলো সিয়াম।সাইমন এসে সাঁঝের হাত ধরে টেনে বাহিরে নিয়ে লিফ্টের পাশের জানালার সামনে দাঁড়ালো।সাঁঝের চোখ ভিজে এসেছে।সাইমন বলল,
''বলো।"
সাঁঝ অশ্রুসজল চোখে সাইমনের দিকে তাকায়।সাইমন ভ্রু উঁচিয়ে সাঁঝের দিকে মাথা ঝাঁকিয়ে ইশারায় জানতে চাইলো হয়েছে কি?সাঁঝ এবার চাহনি নিচু করে কম্পিত কন্ঠে বলল,
''মাফ করবেন।সেদিন ঐ কথা গুলো বলতে চাইনি।আমি ঠিক ছিলাম না সেদিন।বিশ্বাস করেন।এরপর আমি ভালো ছিলাম না।আপনার না থাকা কথা না বলা আমার জন্য ভীষন কষ্ট দায়ক ছিলো।আপনার সাথে অনেক কথা বলতে চেয়েছিলাম আপনি বলেননি।আপনাকে অনেক খুঁজেছিলাম।শুধু মাত্র সরি বলার জন্য।"
''সরি বলা হয়েছে না?যাও এখন।"
গম্ভীর কন্ঠে বলল সাইমন।সাঁঝ অবাক চোখে চেয়ে আছে।লোকটার এতোই কঠিন হৃদয় সে সাঁঝকে মাফ করতে পারছেনা।সাঁঝ আবার বলল,
''প্লিজ আমি সত্যি দুঃখিত।"
সাইমন আবার ও বলল,
''বুঝলাম যাও তুমি।"
সাঁঝ নিঃশব্দে কেঁদে পিছনে ফিরে চলে আসতে থাকে।হঠাৎ অনূভব হলো ওর পেট কেউ জড়িয়ে ধরেছে পিছন থেকে।সাঁঝ কেঁপে উঠে।ওর মনে হচ্ছে ওর কাঁধে মুখমন্ডল অধিক শান্তিতে বিরাজমান।সাঁঝ পাশে তাকিয়ে দেখার চেষ্টা করে।সাইমন ওকে আরো শক্ত করে জড়িয়ে ধরে।সাঁঝ বলল,
''আপনি.... কি করছেন?"
''প্লিজ থামাবেনা।অনেকদিন ের সুখের খোঁজ পেলাম।আজ থামাবেনা।"
''হুম।"
সাইমন ওকে আচমকা সামনে ফিরিয়ে নেয় কিছুসময় পর।সাঁঝ ওর দিকে তাকায়।সাইমন ওকে কাছে টেনে বলল,
''ভালবাসো?"
''আপনি মাফ করেননি।"
কাঁদো গলায় বলল সাঁঝ।সাইমন ওর মুখ তুলে ধরে চিবুক ছুঁইয়ে।আবার ও বলল,
''আগে বলো ভালবাসো?"
''জানিনা।বাট এটা বুঝতে পেরেছি আর এক মুহূর্ত ও আপনাকে ছাড়া থাকতে পারবোনা।"
সাইমন আর অপেক্ষা করতে পারেনা।কারন ওর হৃদয় খুব দ্রত চলছে।মেয়েটাকে ওর বুকে চাই একদম ঠিক বাঁপাশটায়।সাইমন সাঁঝকে বুকে টেনে নিয়ে ওর কাঁধে মুখ ডুবিয়ে দেয়।সাঁঝ প্রথমত সাইমনকে জড়িয়ে ধরতে পারছিলোনা কিন্তু ধীরে ধীরে ওর হাতদুটো সাইমনের পিঠ স্পর্শ করে।সাইমন বলল,
''সাঁঝ তোমাকে ছাড়াও থাকতে পারবোনা।"
সাঁঝ নিজের চোখ জোড়া বুজে নেয় সুখে।কেন যেন মনে হচ্ছে জীবনটা অসাধারন।পৃথিবীটাও অনেক সুন্দর।সাইমন সরে এসে সাঁঝের চিবুক ধরে নিজের কাছে টেনে এনে কপালে চুমু দিতেই সাঁঝ সরে এসে বলল,
''আমার যেতে হবে।"
বলেই মাথা নিচু করে।সাইমন দুষ্টু হেসে বলল,
''অপেক্ষা করো।চাবি নিয়ে আসছি।"
''একা যেতে পারবো।"
''অতিরিক্ত কোন কথা বলোনা।দাঁড়াও আমি আসছি।"
সাঁঝ দাঁড়িয়ে রইলো।সাইমন ঘরে ঢুকে যায়।সাঁঝ একমুহূর্তের জন্য অন্য একজগতে চলে গিয়েছিলো সেই সময়ে।লোকটা যখন ওর কপালে স্পর্শ করেছিলো পুরো শরীর জুড়ে নেমে এসেছিলো অদ্ভুত শিহরন।অন্য এক অনুভূতি।তবে সেটার নাম নেই কোন,নেই কোন কারন।সাঁঝ লোকটার পাশে থাকতে চায় তবে কোন কারন ছাড়া কারন তাকে ওর চাই।তবে সেটা কি মায়া, ভালো লাগা নাকি.......সাঁঝ ভাবতে পারেনা।সাইমন কাপড় পাল্টে এসে ওর সামনে দাঁড়িয়ে বলল,
'' চলো।"
সাঁঝ মাথা ঝাঁকায়।ওরা লিফ্ট দিয়ে নেমে আসে।লিফটের ভিতর সাইমন ওর হাত এক মুহূর্তের জন্য ও ছাড়েনি।যদি হারিয়ে যায়।সাঁঝ হাত ছাড়ানোর মুচড়াচ্ছিলো হাত।সাইমন একপলক ওদের দিকে চেয়ে ওকে বলল,
''প্রবলেম হচ্ছে?"
''না।মানে আমার হাত!!"
''দেখো আজ থেকে তোমার কোন কিছুর ওপর তোমার অধিকার নেই।তোমার নিজের ওপর ও।সো একদম নড়বেনা।"
সাঁঝ অবাক চোখে চেয়ে রইলো সাইমনের পানে।
..........................সেদিন রাতে অনেক নক করার পরও দরজা খুলেনি বেলা।ভিতর থেকে ওর কান্নার শব্দ ভেসে আসছিলো।বিভান বলছিলো,
''বেলা কথা শুনো আমার। আমি ইচ্ছে করে করিনি।বেলা বেরিয়ে আসো।"
বেলা কাঁদতে কাঁদতে বলল,
''চলে যান।আমি একা থাকতে চাই।"
''বেলা প্লিজ মাফ করে দাও।"
''বিভান প্লিজ চলে যান আপনি।"
অনেক বলার পর ও বেরিয়ে আসেনি বেলা।রুমে এসে খাটে বসে থাকে বিভান।ও কি করে ফেললো।বেলা কে ফেলে দিলো।ও জানে মেয়েটার পিঠে সমস্যা।এটা ও কি করে পারলো।বিভান মুখে হাত চেঁপে মাথা নিচু করে থাকবে।ওর জন্য আজ বেলা কষ্ট পাচ্ছে।বেলা যন্ত্রনায় কাঁতরাচ্ছে ওর জন্যই।বিভানের শরীর কেঁপে উঠতে থাকে।এদিকে বেলা কাঁদতে থাকে দরজার সামনে বসে।তেরটা বছর ও সহ্য করে আসছে।কারন ওর শ্বশুর ওদের সাথে নেই।বিভানের তার মাকে দরকার।অন্তত বিভানের কারনেই বেলা সবটা সহ্য করে এসেছে।বন্দনা আখতার ওকে মেরেছে, অকথ্য ভাষায় গালাগালি করেছিলো বেলা প্রতিউত্তর করেনি তবে মাঝে মধ্যে প্রতিবাদ করেছিলো সহ্য করতে না পেরে।এই তেরোটা বছর তার হৃদয়ে বেলার জন্য এতোটুকু ঠাঁই হয়নি।আর কখনো হবে ও না।তবে বেলা ভালো থাকতে চেয়েছিলো যার জন্য সে ওকে অবহেলা করলো আঘাত করলো।শুধু বিছানায় কি ওদের সম্পর্ক আবধ্য?স্ত্রীর মুখ দেখে কি বুঝতে পারেনা?বেলার কষ্টটা বিভান বুঝতে পারেনি।তার মায়ের দ্বারা আঘাত গুলো তার চোখে পড়েনি।অবশ্য বেলা নিজেই পড়তে দেয়নি।সে শক্ত থেকেছে খুশি থেকেছে লোকটার জন্য। সেরাত দুজনে ঘুমোতে পারেনি একটু ও।পরদিন সকাল বিভান ঘুম থেকে উঠে দেখলো ওর অফিসের কাপড় গোসলের গরম পানি সব রেডি শুধু বেলা রুমে নেই।বিভান গোসল সেড়ে নিচে আসে।বেলা টেবিলে খাবাররেডি করছিলো।বিভান পাশে এসে বলল,
''বেলা রুমে এসো কথা আছে।"
বিভানের কথা এড়িয়ে বেলা কাজ করতে থাকলো।বিভান ওর হাত ধরে বলল,
''বেলা অবুঝ হয়োনা চলো রুমে।"
''নাস্তা করে নিন।চা নিয়ে আসছি আমি।"
বলে চলে যেতে চাইলে বিভান ওর হাত টেনে বলল,
''প্লিজ বেলা এমন করোনা।কথা শুনো।"
বেলা হাত ছাড়িয়ে পাকঘরে চলে যায়।বিভান মাকে দেখে আর কিছুই বলতে পারেনা।সেদিন বেলার বিদায় ছাড়াই বেরিয়ে যেতে হয় বিভানকে।সারাটাূিন প্রচন্ড অস্থিরতার মাঝেই কাঁটে সময় বিভানের।
.......................আজ অনেকদিন পর সুস্থ বোধ করছে নিশাদ।তাই সকালে রেডি হচ্ছিলো অফিসে যাবার জন্য।জুলেখা বানু নিশাদের রুমে এসে বললেন,
''কই যাস আব্বা?"
''আম্মা অফিসে।"
মায়ের দিকে একটু হাসলো নিশাদ।জুলেখা বানু বললেন,
''তোর শরীলডা এহনো ভালা হইলোনা।আরো দুডা দিন রেস্ট কর।"
শার্টের কলার ঠিক করে বিভান বলল,
''আম্মা এমনটা হয়না।চারদিন ধরে ঘরে শুয়ে আছি।বস রাগ করবেন।"
''ওনিরে কয়া দে না।"
''না আম্মা সেটা হয়না।"
''সব হয়।তুই কইয়া দেখ না।"
''আম্মা একজনের আন্ডারে জব করি।জানোই তো কিভাবে জবটা পেয়েছিলাম।এমনিতেই এতোদিনের ছুটি নিয়েছিলাম আরো চাইলে রাগ করবেন স্যার।"
জুলেখা বানু মলিন কন্ঠে আবার বললেন,
''কিন্তু তোর শরীল?"
''আলহামদুলিল্লাহ ভাল আছি আম্মা।আদনানের একটু খেয়াল রাইখো।এতোদিন কষ্টে আছিলো।ওরে দুধ গরম কইরা দিও।শক্তি পাইবো।আর আজকে ওর জন্য চাকরী খুঁজবো ভালো দেখে।"
জুলেখা বানুর মুখে ম্লান হাসি ফুঁটে উঠে।নিশাদ নাস্তা করে বেরিয়ে আসে।বাহিরে বেশ গরম।নিশাদ হেঁটে ফার্মগেটে চলে আসে।তারপর বাসের জন্য দাঁড়ায়।একটা পেটমোটা রং উঠানো বাস দেখতে পায়।ও সহ আর ও আটজন ছিলো সেখানে।নিশাদ দৌড়ে বাসের কাছে চলে যায় এবং উঠে একটা খালি সিটে বসে পড়ে।ওর পুরো শরীর বেয়ে ঘাম ঝড়ছে।মোহাম্মদপুরে ভাল একটা কোম্পানীর নাম শুনেছিলো।সেখানকার স্যালারীও ভালো।আদনানের রেজাল্ট ও বেশ।আল্লাহর নাম নিয়ে জবটা হয়ে গেলেই হলো।ও আজকেই সেখানে গিয়ে খোঁজ নিবে।অফিসে গিয়ে নিশাদের মাথায় আকাশ ভেঙ্গে পড়ে।একজন লোক ওর ডেস্কে বসে আছে।ফারুজ খান তার সাথে জম্পেশ আড্ডা দিচ্ছে।নিশাদ সেখানে এগিয়ে এসে ফারুজ খানকে বলল,
''অফিস টাইম তো শুরু হয়ে গেছে।"
ফারুজ খান বিরক্তি নিয়ে ওর দিকে তাকিয়ে বললেন,
''তো?"
''কাজ শুরু করতে হবে।"
''আরে যাও তুমি।"
তারা আবার ও গল্প করতে শুরু করেন।নিশাদ বলল,
''যাও মানে কি?কাজ করতে হবে তো?"
ওর রাগ লাগছিলো তবে রেগে গেলে চলবেনা।ফারুজ খান কর্নপাত করেননি।নিশাদ বাধ্য হয়ে এগিয়ে গেলো ওর বস বোরহান সাহেবের রুমে।নক করে ঢুকে পড়ে।ওর দিকে তাকিয়ে বোরহান সাহেব বললেন,
''ভালো আছো?"
''জি স্যার।"
''কি বলবে?"
''স্যার ফারুজ স্যার একজনকে আমার ডেস্কে বসিয়ে গল্প করছে।ওনাকে বলতেই বলল সরে যেতে।"
বোরহান নিজের চশমা খুলে টেবিলের ওপর রেখে গলা ঝেঁড়ে বললেন,
''দেখো নিশাদ ফারুজ চায় তার শালা তোমার জায়গায় জবটা করবে।"
নিশাদ যেন সব অন্ধকার দেখতে থাকে।ও বুঝতে পারেনস কি হচ্ছে।নিশাদ জানতে চাইলো,
''এর মানে কি স্যার?জবটা আমার লাগবে।আপনারা এভাবে বলতে পারেননা।আমি জবটা না করলে আমার ভাই বোন বাবা মা ওদের কি হবে।বুঝার চেষ্টা করুন স্যার।প্লিজ স্যার।"
বোরহান সাহেব চশমা চোখে লাগিয়ে বললেন,
''দেখো নিশাদ তোমার জায়গায় এখন পর্যন্ত কাউকে নিচ্ছিনা কারন তোমার পারফরম্যান্স ভালো।নিজেকে আরেকটু ডেভেলপ করো।আর এতোদিন ছুটিতে থেকোনা।"
নিশাদ যেন স্বস্তির নিশ্বাস ফেললো।ও বলল,
''স্যার আসলে শরীরটাই এতো খারাপ ছিলল।আর হবেনা স্যার।আমি আরো বেশি এক্টিভ হবো।"
''হুম।তুমি যাও ফারুজকে পাঠিয়ে দিও আমার কাছে। "
''জি স্যার।"
বেরিয়ে আসে নিশাদ।কিছু মুহূর্তের জন্য ভাবছিলো মনে হয় সব শেষ হয়ে যাবে।কিন্তু আল্লাহ তা'লার অশেষ রহমতে সব যেন ফিরে পেলো নিশাদ।বুকটা হালকা লাগছে।ফারুজ খানের কাছে এসে নিশাদ বলল,
''স্যার ডাকছে।"
ফারুজ খান বিরক্তিকর দৃষ্টি নিয়ে তার শালাকে বললেন,
''আমি আসছি তুমি বসো।"
''জি দুলাভাই।"
পাশ থেকে তার শালা বলে উঠে।ফারুজ খান ঢুকে যায়।পরমুহূর্তে ফারুজ খান বেরিয়ে এসে তার শালাকে বললেন,
''নাঈম তুমি চলে যাও পরে কথা হবে।"
''কিন্তু দুলাভাই আমার চাকরী!!!!"
হতাশা জড়িত কন্ঠে বলল নাঈম নামের লোকটা।ফারুজ খান রাগান্বিত কন্ঠে বললেন,
''কিছু নেই বেরিয়ে যাও তুমি।"
নাঈম আর কিছুই বললোনা।তল্পিতল্পা নিয়ে বেরিয়ে গেলো।
এদিকে অফিস শেষ করে মোহাম্মদ পুরে চলে আসে নিশাদ।এখান থেকে অবশ্য কাছেই ছিলো।অফিসে ঢুকেই নিশাদ দেখলো ভীষন সুন্দর একটা অফিস।অনেক সাজানো গুছানো।মেইন ডোর দিয়ে ঢুকতেই একদম সামনে রিসিপশন।নিশাদ হেঁটে হেঁটে সেদিকে গেলো।রিসিপশনের একজন লোককে জিজ্ঞেস করলো,
''ইন্টারভিউ কবে থেকে শুরু হবে?"
''কাল থেকে শুরু হবে।আপনাকে ডেকেছিলো?"
''না আমার জন্য না।আসলে আমার ভাই দিবে তো।সেজন্য একটু খোঁজ নিতে আসলাম আরকি।"
''ওহ আচ্ছা স্যার।
অতঃপর লোকটা বেশ কিছু ইনফরমেশন দিলো নিশাদকে অফিস বিষয়ক।অফিস টা থেকে বেরিয়ে এসে হাঁটতে শুরু করে নিশাদ বাস স্টেশনের দিকে।সন্ধ্যায় সাড়ে আটটা বাজে।