খানিকটা সময় আগেই ইশিতার হলুদ হয়ে গেলো।নিশাদ পাঞ্জাবী পাল্টে একটা টিশার্ট পরে খাটে এসে শরীর এলিয়ে দিলো।সারাদিনের কর্মব্যাস্ততায় শরীরটা একদম ক্লান্তিতে ভরে গেছে।চোখজোড়া বুজে নেয় নিশাদ।আজ সারাটাক্ষন ইদ্রি চোখের সামনে ছিলো।হলুদ শাড়ীতে আজ পরী লাগছিলো মেয়েটাকে। বাঙ্গালী বধু বেশে ইদ্রি যখন ওর সামনে হাঁটছিলো তখন নিশাদের হৃদয়ের ধুকপুকানি বেড়ে যায়।অস্থির হয়ে উঠতে শুরু করে শরীর মন।নিশাদ একটা সিগারেট ধরিয়ে রুম থেকে বেরিয়ে বারান্দায় আসতেই খেয়াল করলো ইদ্রি শিকে মুখ লাগিয়ে দাঁড়িয়ে।শরীর কেঁপে কেঁপে উঠছে ওর।নিশাদ ওর থেকে বেশ দূরত্বে দাঁড়িয়ে।এক বার তাকালো ইদ্রির দিকে।ইদ্রি ওকে এখনো খেয়াল করেনি।মেয়েটা কাঁদছে মৃদু শব্দ করে।চাঁদের মিষ্টি আলোয় ইদ্রির আলোকিত মুখটা দেখতে পায় নিশাদ।ইদ্রি শিক দুহাতে চেঁপে ধরে কাঁদছে।আবার মাঝে মাঝে শিকে কপাল চেঁপে ধরে জোরে কাঁদছে।নিশাদের ইচ্ছে হচ্ছে এই মুহূর্তে ওকে জড়িয়ে ধরে বলতে ভালোবাসি ইদ্রি।বড় ভালোবাসি।তোমাকে আমি কতোটা চাই ভাবতে ও পারবেনা।প্লিজ কেঁদো না আমি তোমার ইদ্রি।সবসময় তোমার সাথে আছি থাকবো।
ইদ্রি কাঁদতে কাঁদতে পাশে তাকিয়ে নিশাদকে দেখে আরো বেশি কাঁদতে শুরু করে।নিশাদ পলকহীন ভাবে ইদ্রিকে দেখছিলো।হঠাৎ ইদ্রি ওর দিকে এগিয়ে এসে কেঁদে কিছু বলতে নিচ্ছিলো তখনই নিশাদ বেরিয়ে গেল ওর সামনে থেকে।ইদ্রি কাঁদতে কাঁদতে বসে পড়ে।নিশাদ রুমে এসে দরজা লাগায়।সিগারেট কখন কমে আসতে আসতে আঙ্গুলে লেগে গিয়েছে খেয়ালই করেনি নিশাদ।রুমে এসে দেখলো আঙ্গুলের মাথা জ্বলছে।সেদিকে খেয়াল না করে শুয়ে পড়ে বিছানায়।কাল ইশিতার বিয়ে। তারপর যত দ্রুত সম্ভব ঢাকায় ফিরে যাবে সাঁঝ কুঞ্জন কে নিয়ে।
ইমতিয়াজ নিচে মামাদের সাথে কথা বলে রুমে আসতে থাকে।এই কয়েকদিন যাবৎ নিশাদ ইদ্রিকে খেয়াল করছে ও।নিশাদ ইদ্রির একে অপরের দিকে তাকানো।সেই তাকানো ভিন্ন ধরনের।ইমতিয়াজ ওদের তাকানো লক্ষ করেছিলো।এই দুটো মানুষকে খুব ভাল করে চিনে ইমতিয়াজ।ওরা একে অপরের দিকে তাকালে যেন সব শেষ হয়ে গেছে।শুধু ওরাই আছে।যেন দুজোড়া চোখে মায়া ভালোবাসা ভরা।সেই চোখজোড়ায় একে অপরের প্রতিটান অনূভব করতে পারে।পরক্ষনে নিজেকে শান্ত করে ইমতিয়াজ। কিসব ভাবছে নিজের বোনকে নিয়ে।এসব ঠিক নয়।অন্তত নিশাদ আর ইদ্রিকে নিয়ে এসব ভাবনা ঠিক নয়।নিশাদকে ও খুব ভালো করে চিনে।নিশাদ কখনো ওকে না জানিয়ে কিছু করবেনা।আর ইদ্রি এখনো বাচ্চা ওর এসব বোঝার বয়স হয়নি।
হঠাৎ ইমতিয়াজের পা থেমে যায়।পিছন থেকে সাঁঝের ডাক পড়ে।ইমতিয়াজ হাঁটা বন্ধ করে পিছনে তাকায়।সাঁঝ বলল,
''ভাইয়া বড় ভাই কই?"
''আমার রুমে বোধহয়।চলে যাচ্ছো?"
''জি ভাইয়া।রাত হয়ে গেছে।বেরুতে হবে।"
''নিশাদ টায়ার্ড। যাওয়ার সময় দেখছিলাম কেমন করছে চোখ।তোমার প্রবলেম না থাকলে এগিয়ে দেই আমি?"
সাঁঝ কিছুটা অস্বস্তি বোধ করে।মাথা নেড়ে বলল,
''না ভাইয়া আমি আর কুঞ্জন চলে যাবো। "
''ভাইয়া লাগবেনা।"
''দেখো নিশাদ থাকলে এই কাজটাই করতো রাইট?"
সাঁঝ কিছু বলতে যাচ্ছিলো তখন কুঞ্জন বলল,
''আরে ভাইয়া চলেন।"
সাঁঝ ধীরে বলতে লাগলো,
''ভাইয়া না আসলে ও হতো।একাই যেতে পারতাম।"
ইমতিয়াজ তাড়া দিয়ে বলল,
''আরেহ এতো ফর্মালিটি কেন করো বলো তো?চলো নিয়ে যাই।"
বলেই কুঞ্জনকে নিয়ে হাঁটতে শুরু করে ইমতিয়াজ। সাঁঝ কোন উপায় না পেয়ে ওদের সাথে হাঁটতে থাকে।নিশাদ সমুদ্র সৈকতের সামনে দাঁড়িয়ে।ওর চোখের সামনে অনেকগুলো মেয়ে গোল হয়ে নাচছে।মেয়েদের খোলা চুলগুলো বাতাসে উড়ছে।নিশাদ মন্ত্রমুগ্ধের মতো নাচ দেখছে।হঠাৎ দেখলো মেয়েগুলোর নাচ শেষ।ওরা আলাদা হতেই মাঝ থেকে বেরিয়ে আসে ইদ্রি।ওর গায়ে সাদা শাড়ী জড়ানো।ইদ্রি নিশাদের সামনে এসে দাঁড়িয়ে মৃদু হেসে ওর গাল স্পর্শ করে বলল,
''ভালবাসেন?"
নিশাদ চোখজোড়া জ্বলজ্বল করে উঠে।নিজের গালে রাখা ইদ্রির হাতটি স্পর্শ করে বলল,
''খুব ভালবাসি।"
ইদ্রি দাঁত বের করে হাসছে।ভীষন মায়াবী লাগছে ইদ্রিকে।নিশাদ ইদ্রির কোমড় ধরে নিজের দিকে টেনে আনে।ইদ্রি কেঁপে উঠে নিশাদের ফতুয়ার কোনা চেঁপে ধরে বলল,
''এত কাছে টানবেননা মরে যাবো।"
''এতো ভালবাসবো যে মরে যাওয়ার সুযোগ থাকবেনা।"
কথাটা বলেই ইদ্রির ঠোঁটে ঠোঁট ডুবায় নিশাদ।পিছনে হাত রেখে ব্লাউজের ফিতা খুলে নিতেই ইদ্রি নিশাদের ঠোঁটজোড়ার মাঝেই ঠোঁট নেড়ে বলল,
''নিশাদ এত টাও ভালবাসেননা যে আপনার দূরত্বটাও মেনে নিতে পারবোনা।"
নিশাদ ইদ্রির কাঁধে মুখ ডুবিয়ে সমুদ্র সৈকতের বালিতে শুইয়ে দেয়।শোনা সমুদ্র স্রোতের আঁছড়ে পড়ার ধ্বনি।
আর দুজনের ঘন ঘন উন্মাদনায় পূর্ন নিশ্বাসের ধ্বনি।নিশাদের ঘুম ভেঙ্গে যায়।খেয়াল করলো ওর ঠোঁটের ওপরে জমে আছে বিন্দু বিন্দু ঘাম।নিশাদ বসেই মাথা চেঁপে ধরে।এগুলো কি দেখলো ও?ইদ্রির সাথে কিভাবে?বেশ চিন্তায় ওড়ে যায় নিশাদ।এমন টা না যে ইদ্রির সাথে এসব ভাবছিলো।কিন্তু এমন স্বপ্ন??এটা সত্য ইদ্রিকে ও খুব করে চায় কিন্তু তাই বলে!!!!!নিশাদ ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখলো রাত দশটা বাজে।ওর খেয়াল হলো সাঁঝ আর কুঞ্জনের কথা।নিশাদ বেরিয়ে আসে রুম থেকে।সিড়ির কাছে আসতে দেখলো মামারা বসে চা খাচ্ছেন।বাহিরে বিয়ের স্টেজের বাঁশা এনে রাখা হয়েছে।নিশাদ নিচে আসতে থাকে।মেজ মামা ওকে দেখে বললেন,
''কি বাবা ঘুম হলো?"
নিশাদ কিছুটা লজ্জা পায়।ধীরে বলল,
''জি মামা।"
ওনি কিছু না বলে হাসেন।নিশাদ কিছু বলতে গেলে বড় মামা বললেন,
"ইমতিয়াজকে খুঁজছিলে?ও একটু আগে তোমার ভাইবোন কে এগিয়ে দিতে গেলো।"
নিশাদ কিছুটা নিশ্চিন্ত হয়।বড় মামা আবার বললেন,
''চা খাবে?চা দিতে বলি?"
''নিশাদ চুপ করে সোফায় এসে বসে।বড় মামা জোরে বললেন,
''ইদ্রি আম্মু একটু চা নিয়ে আয় তো।"
নিশাদ এবার অস্বস্তুি বোধ করতে থাকে।সে স্বপ্নের কারনে হয়ত ইদ্রির সামনে নিজেকে উপস্থাপন করতে চাইছেনা।কিছুসময় পর ইদ্রি চা নিয়ে এসে নিশাদের হাতে দেয়।নিশাদ অনিচ্ছাসত্ত্বেও ইদ্রির দিকে তাকায়।চোখজোড়া বেশ ফুলে গেছে।ম্লান হাসলো ইদ্রি।নিশাদ শীঘ্রই চোখ সরিয়ে নেয়।
ইমতিয়াজ সাঁঝ আর কুঞ্জন কে দিয়ে এসে আইসক্রিম কিনে ঘরে।অবশ্য ওদের ও আইস্ক্রীম দিয়ে এসে ছিলো।ইমতিয়াজ আইস্ক্রীমের প্যাকেট টা এনে ইদ্রির হাতে দিয়ে বলল,
''সবাইকে দিয়ে আয়।আর বেগুনী কালারটা তোর কিন্তু।তোর ফেবারিট।"
হঠাৎ বড় মামা বললেন আইসক্রিম বাহিরে বসে খাই।আইস্ক্রীম হাতে ঠান্ডা একটা পরিবেশ খারাপ লাগবেনা কিন্তু।
সাথে সাথে ইশিতা আপু ও রাজি। ঠিক হলো ভূবন তীর্থ কাব্য আর ফারহান ওদের ও আসতে বলবে।ইমতিয়াজ ওদের বলল আরো চারটা আইসক্রীম নিয়ে আসতে।ইদ্রি সবার হাতে আইসক্রিম ধরিয়ে দিতে থাকে। নিশাদের হাতে বেগুনী রং এর কোন আইস্ক্রীমটা ধরিয়ে সরে যায় সেখান থেকে।অবশেষে ভূবনরাও এলো।ওরা সবাই বাহিরে জড়ো হলো।স্টেজ সাজানোর জন্য ছোট্ট লাইট লাগানো হয়েছে।সেখানে ওরা মাদুর বিছিয়ে বসলো।
ইমতিয়াজ নিশাদের হাতে ইদ্রির আইস্ক্রীম টা দেখে অবাক।কারন সাধারন এটা ইদ্রি কারোর সাথেই শেয়ার করেনি।তাহলে নিশাদকে দিলো।আইস্ক্রীম থেকে চোখ সরিয়ে ইদ্রির দিকে তাকায় ইমতিয়াজ।দেখলো ইদ্রির নজর নিশাদে পড়ে আছে।ইমতিয়াজ সোজা তাকিয়ে কিছুটা চিন্তিত হয়।ভূবন আর ইশিতার ও আড়চোখে প্রেম সব মিলিয়ে জমে উঠেছে ওদের আড্ডার আসর।হঠাৎ আড্ডার মাঝে ভূবন বলল,
''এখানে আসলাম কিন্তু কোথাও যাওয়া হলোনা।অন্তত নতুন জামাই হিসেবে ও তো কোথাও যেতে পারি।"
ভূবনের কথায় বড় মামা বললেন,
''কিরে ইমতিয়াজ ভুল বলেনি ও।কোথাও তো যেতে ও পারিস।"
ইমতিয়াজ বলল,
''কোথায় যাবো?"
সাথে সাথে মেজ মামা বললেন,
''আরে অনেক সুন্দর একটা মন্দির আছে সেখণে যেতে পারো তো।ভালো লাগবে।"
ইমতিয়াজ মামার দিকে তাকিয়ে ভ্রু কুঁচকে বলল,
''মন্দির?"
''হ্যা মন্দির।তাও আবার পাঁচশত বছর পুরোনো।নবরত্ন মন্দির।"
সাথে সাথে বন্ধুরা জানালো ওরা ও যাবে।ঠিক হলো ওরা সেই মন্দিরে যাবে।একটায় খেয়ে রুমে ফিরে নিশাদ আর ইমতিয়াজ। নিশাদ ব্রাশ করে এসে শুয়ে চোখ বুজে।ইমতিয়াজ বলল,
''কাল তো যাচ্ছি তাহলে।সাঁঝ কুঞ্জন কে ও বল।বেচারারাও তো বিয়ের চক্করে কোথাও ঘুরতে ও পারেনি।নিশাদ ইমতিয়াজের দিকে তাকিয়ে বলল,
''বলা যায়।"
পরদিন সকাল দশটায় সবাই রেডি। সাঁঝ নিজে সেজে ইদ্রিকে ও সাজাতে বসলো।ইদ্রি গতরাত রুমে এসে ভীষন কেঁদেছিলো।যতোদিন যাচ্ছে নিশাদকে হারানোর তীব্র ভয়টা বেড়েই যাচ্ছে।ও কি করবে?কাকে বলবে?কে ওকে নিশাদকে মিলিয়ে দিতে পারবে?সাঁঝ ইদ্রিকে চুপচাপ দেখে বলল,
''সব ঠিক আছে?"
''জি আপু। কেন?"
''এমনি।এতো মনমরা লাগছে তোমাকে।তাই বললাম।"
''না আসলে বিয়ের কারনে হয়ত ওভাবে রেস্ট পাচ্ছিনা।"
সাঁঝ হেসে ইদ্রির গাল টিপে বলল,
''ওলে পিচ্চি নিজের বিয়ের সময় কি করবে?এখনি এতো টায়ার্ড হলে?"
সাঁঝের কথায় ইদ্রি ম্লান হাসে।
এদিকে সাঁঝের আগমনে ইমতিয়াজ যেন উন্মাদ হয়ে যাচ্ছে।এখনো একবারও সাঁঝের সাথে একা কথা বলার সুযোগ হয়ে উঠেনি। অন্তত বিয়ের আগে যে করেই হোক কথা বলবে ও।হয়ত নবরত্ন মন্দিরটাই ওদের প্রেমময় জীবনের সুত্রপাত হতে পারে।
চলবে
!!!!
কাছে পেয়ে ও প্রিয়তমা কে বাহুডোরে জড়িয়ে নিতে না পারার মতো বেদনা এই দুনিয়ায় হয়ত কমই রয়েছে।ভালবাসায় বিরহ তো অনেকরকমই হয় কিন্তু প্রথম ভালবাসায় বিরহের মতো যন্ত্রনা হয়ত আর নেই। সবার নসিবে তো প্রেম ভালবাসা জোটেনা কেউ পেয়ে যায় তার প্রিয়তমাকে বাহুপাশে জোৎসনা স্নাত রাতে,আর কেউ বা পায় না তার প্রেয়সীকে সামাজিক অবস্থা আর নিজের অসহায়ত্বের কারনে।
একঘন্টা আগে
বিয়ে সম্পন্ন হয়েছিলো ভূবন আর ইশিতার।আজ তীর্থের কাতারে পড়ে গেলো ভূবন। সেটা নিয়ে বাকিরা মজা করছিল ওর সাথে।ফারহান তো গান ধরে ফেললো।ও গাইছিলো,
ভালবাসিয়া গেলাম ফাঁসিয়া
করতে হবে এবার বিয়া
সোনারি চান পিতলা ঘুঘু
যাবে কোথায় পালাইয়া...............
ফারহানের গানে সবাই জোরে হাসতে লাগলো।নিশাদ ম্লান হাসছে ওদের কথায়।আজ সাঁঝ ও রয়ে গেছে এখানে।কারন কাল বিকেলে বেরুবে ওরা বৌভাতের পর।সাঁঝ ইদ্রির সাথে ওর রুমে।কুঞ্জন ভাইয়ের বন্ধুদের সাথে বসে।ভূবন জিজ্ঞেস করলো,
''কুঞ্জন প্রেম টেম করিস নাকি রে?"
''না ভাই ওসব হবেনা।"
''আরে ফ্লার্ট তো করিস রাইট?"
কুঞ্জন কিছু বলতে গিয়ে পাশ ফিরে নিশাদের দিকে তাকায়।নিশাদের মুখে ম্লান হাসি।কুঞ্জন মাথা নেড়ে বলল,
''না ভাইয়া ওসব হয় না।"
''প্রেম তো বুঝো।তাইনা?"
পাশ থেকে ফারহান বলে উঠে।কুঞ্জন মৃদু হাসে।কল্যান বলল,
''তোর ভাইটাকে তো শিখাতে পারিস।লাগে তো হিরোর মতো কিন্তু কাজ ছয় বাচ্চার বাপের মতো।"
নিশাদ কিছু বলেনা।মুখ নিচু করে হাসতে থাকে।আধঘন্টা পরে সবাই চলে গেলো।নিশাদ ইমতিয়াজ কে ডেকে বলল,
''কুঞ্জন কে শুইয়ে দে আমি ছাদ থেকে আসি।"
ইমতিয়াজ হেসে বলল,
''বিড়ি টানবি নাকি?"
নিশাদ মাথা ঝাঁকায়।ইমতিয়াজ ওর পিঠে হাত দিয়ে বলল,
''যাহ।"
নিশাদ তিনতলা বেয়ে উঠে ছাদে চলে যায়।ছাদটা বেশ ঠান্ডা নিরিবিলি।বিভিন্ন ফুল গাছে ভরে আছে।আশপাশ দেখে নিশাদ একদম কোনায় এসে সিগারেট ধরায়।বাহিরের ঠান্ডা বাতাসটা মুখে এসে লাগছে।বিড়িটা প্রায় শেষ হয়ে এসেছিলো।হঠাৎ মনে হলো ওর পাশে কেউ দাঁড়িয়ে।নিশাদ সিগারেটের শেষ টান দিয়ে সামনে ফিরতেই কেউ ওকে এসে জড়িয়ে ধরে আষ্টেপৃষ্টে। থতমত খেয়ে উঠে নিশাদ।ওর পিঠে একজোড়া নরম হাত বিচরন করছে।নিশাদ হাত বাড়িয়ে তার মাথা স্পর্শ করতেই ইদ্রি কেঁদে উঠে বলছিলো,
''আমি সত্যি আপনাকে খুব ভালবাসি।প্লিজ সব ভুলে আমাকে ভালবাসুন।আপনাকে পেতে এমন করেছিলাম নিশাদ।খুব ভালবাসি।আপনাকে ছাড়া থাকতে পারবোনা।আপনি চাইলে ভাইয়াকে আমি আমার নাম বলবো।"
এতক্ষন ইদ্রি কথায় হারিয়ে গিয়েছিলো নিশাদ।ইচ্ছে হচ্ছিলো জড়িয়ে বলতে আমি ও খুব ভালবাসি ইদ্রি।তোমাকে ছেড়ে থাকতে ভীষন কষ্ট হয় আমারও।কিন্তু আমি অসহায়।পারবোনা তোমাকে নিতে কারন সামর্থ্য নেই আমার।কিন্তু ইমতিয়াজের কথা শুনতেই নিশাদ ইদ্রিকে ধাক্কা দিয়ে নিজ থেকে সরিয়ে বলল,
''এত বড় সাহস কি করে হয় তোমার?এত বড় নির্লজ্জ মেয়ে আর কোথাও দেখিনি।"
ইদ্রি কাছে এসে নিশাদের হাত ধরে বলল ,
''এভাবে কেন বলছেন?কেন বুঝছেননা আমি ভালবাসি।"
এদিকে ইমতিয়াজ কুঞ্জনকে শুইয়ে দিয়ে ভাবছিলো ছাদে গিয়ে নিশাদকে সাঁঝের কথা বলবে।ছাদের উদ্দেশ্যে বের হয় ইমতিয়াজ।এদিকে নিশাদ ইদ্রির হাত ছাড়িয়ে ওকে ধাক্কা দিয়ে বলল,
''আমার ভাবতে কষ্ট হচ্ছে তুমি ইমতিয়াজের বোন..সেই শুরু থেকে তোমার নোংরা ইঙ্গিতগুলোকে আমি প্রশ্রয় না দিয়ে তোমার প্রতি শিক্ষকের দায়িত্ব পালনে নিজের সর্বোচ্চ দিয়ে যাচ্ছিলাম..কিন্তু একবার না দুইবার না বারবার এমনকি নিজের বান্ধুবিদের সামনে নিয়ে আমাকে মিথ্যা পরিচয় দিয়েছো...আমি তোমার প্রেমিক লাগি?? এই মেয়ে এই?? এভাবে আর কয়জনকে ফাঁসিয়েছ তুমি.........সত্যি করে বলতো?.. তোমার মত মেয়েদের আমার হাড়ে হাড়ে চেনা আছে...তোমার ভুলগুলোকে আমার উপরে চাপিয়ে তোমার মা পর্যন্ত আমাকে কথা শুনিয়েছিলো। আমি চুপ ছিলাম...এখন গিয়ে বলি তার আদরের কন্যার চরিত্র কেমন নাকি আগে তোমার ভাইকে বলবো......... "
ইদ্রি এতক্ষন নিশাদের কথায় কিছু বলতে পারছিলোনা।খুব অবাক লাগছিলো ওর।শেষমেষ নিশাদ ওর চরিত্র নিয়ে ও কথা বলতে ছাড়লোনা।ইদ্রি কেঁদে বলল,
''আমি ভালবাসি।কেন এতো বাজে বলছেন?"
নিশাদ ওর হাতের কব্জি চেঁপে ধরে চিৎকার করে বলল,
তুমি আমাকে ভালবাসো না?খুব ভালবাসো?এখন কি করতে হবে? শুতে হবে?
কথা গুলো বলে ইদ্রিকে টেনে নিয়ে যেতে চাইছিলো। কিন্তু ইদ্রি নিজের হাত ছাড়াতে চাইছিলো কেঁদে কেঁদে।নিশাদের চেহারা একদম রক্তবর্ণ ধারন করেছে।ইদ্রির ভয় লাগছিলো।ইদ্রি ওর হাত ছাড়াতে দেখে নিশাদ আরো চিৎকার করে বলল,
কি হলো হাত ছাড়াও কেন?তুমি না ভালবাসো।আসো আমরা শুই।তুমিতো এটাই চাও?কারন আমি জানি তোমার মতো হাই সোসাইটির মেয়েরা এমনই চাইতে পারে।আমি আমার মিডেল ক্লাশে ভালো আছি তুমি নিজের চরিত্রের সাথে মিলিয়ে কাউকে পটাও।নিজের চেহারাটাও দেখাবেনা আমাকে।এর পর সামনে আসলে এমন কিছু করে ফেলবো যে চিন্তাও করতে পারবেনা।"
ইদ্রি জোরে কাঁদতে থাকে।নিশাদ আবার ও চিৎকার করে বলল,
''যাও আমার সামনে থেকে নির্লজ্জ মেয়ে কোথাকার।বেয়াদব কোথাকার।"
ইদ্রি আর অপেক্ষা না করেই দৌড়ে বেরিয়ে যায় কাঁদতে কাঁদতে।কান্নায় এতটাই ভেঙ্গে পড়েছিলো যে পাশে দাঁড়িয়ে থাকা নিজের ভাই ইমতিয়াজ কে ও খেয়াল করেনি ইদ্রি।ইমতিয়াজ এতক্ষন ওদের কথা শুনতে শুনতে কেঁদে ফেলে একমুহূর্তে। কিছুক্ষনের জন্য মনে হচ্ছিলো নিশাদ কিভাবে ওর বোনকে এত বাজে কথা বলতে পারে কিন্তু ওর সেই সন্দেহ কেঁটে গেলো যখন শুনলো নিশাদের আর্তনাদ।ইদ্রি বেরিয়ে যাওয়ার মুহূর্তে নিশাদ ওর যাওয়ার পানে চেয়েছিলো।হঠাৎ মনে হতে লাগলো কি করে ফেললো ও?হাঁটু গেড়ে নিচে বসে পড়ে নিশাদ।দুগাল বেয়ে অশ্রুগুলো দ্রুত গড়িয়ে পড়তে থাকে।গলা বুক প্রচন্ড ভারি হয়ে আসতে থাকে।আর পারেনা নিজেকে সামলাতে।চিৎকার করে কেঁদে উঠে নিশাদ।কাঁদতে কাঁদতে বলছিলো,
''এই চৌত্রিশ বছরের জীবনে কোন মেয়ের দিকে তাকানো তো দূরে থাক প্রেম ভালোবাসা নিয়ে একমুহূর্ত ভাবার সুযোগটাও আমি পাইনি..নিজের আবেগ নিজের স্বপ্নকে ধাক্কা দিয়ে জলাঞ্জলি দিয়েছি আমার ছোটভাইবোন গুলোর পড়াশোনার খরচ জোগাতে..বোনের স্কুলের ফী কিভাবে দিবো সেই টেনশনে কখনো নির্ঘুম রাত কেটেছে তো কখনো বাবার চিকিৎসার টাকা কিভাবে ম্যানেজ করবো সেই চিন্তায় মাইগ্রেন এর ব্যাথায় নীরব যন্ত্রনা সহ্য করেছি...তার উপর এই ঢাকা শহরে প্রাইভেট সেক্টরে চাকরি করে টিকে থাকতে গিয়ে অসংখবার অদৃশ্য জুলুম এর কাছে নিজের যোগ্যতাকে পরাজিত হতে দেখেছি..রিকশা ভাড়া দেয়ার যোগ্যতা যেখানে আমার মাঝে মাঝে থাকে না সেখানে তোমার মতো বার্বি ডলকে কিভাবে নিজের সাথে জড়াই বলো....আমি যাদের ভালোবাসি তারা আমার কাছে থেকে আমাকে ভালোবাসার চেয়েও তাদের সুখটা আমার কাছে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ আর তুমি....? তুমি আমার প্রথম প্রেম আমার প্রথম ভালো লাগা আমার প্রথম ভালোবাসা যাকে অসংখবার ভোলার চেষ্টা করে মস্তিষ্ক হৃদয়ের কাছে হেরে গেছে..তোমার একদিনের খরচ জোটানোর ক্ষমতাও এই অধমের নেই... আমার রন্ধ্রে রন্ধ্রে আজকাল যে বাস করে আমার শিরা উপশিরা আজ যার জন্য কাঁপে সেই সব থেকে মূল্যবান মানুষটাকে আমি কষ্ট দিয়ে নিজের কাছে রাখার চেয়ে তার অন্তরে নিজের প্রতি সীমাহীন ঘৃণার জন্ম দিয়ে তাকে অন্তহীন দূরত্বে পাঠাতে যা যা করা প্রয়োজন আমি সব করেছি সামনে ও করবো..সেটার জন্য আমাকে মারতে মারতে রক্তাক্ত করে মেরে ফেললেও আমি পিছপা হবো না কখনো...তোমার সুখের জন্য যদি তোমার ভাইকেও হারাতে হয় আমি তাই করবো..আমার কাছে তোমার প্রতি আমার অন্তরের একান্ত অনুভূতি, ভালোবাসা আমার বন্ধুত্বের কাছেও দুর্বল ইদ্রি...আমি তোমার সুখের জন্য তোমাকে অপমান করতে পারবো তোমার ভাইকে হারাতে পারবো কিন্তু তোমাকে কষ্ট করে নিজের কাছে বেঁধে রাখার অঙ্গীকার করতে পারবোনা.. নিজের হৃদয়ের সবটা জুড়ে যার নাম তার মূল্য দিতে এই অযোগ্য আমি আজ তাকেই বিসর্জন দিলাম।"
চিৎকার করে কাঁদতে থাকে নিশাদ।ইমতিয়াজ মুখে হাত চেঁপে কাঁদতে থাকে।ইদ্রি নিশাদকে যতোটা ভালবাসে তার চেয়ে ইদ্রির প্রতি নিশাদের ভালবাসা টা অনেক গভীর।ইমতিয়াজ ভাবছিলো এখন নিশাদ ওকে দেখলে সমস্যা।তাই ইমতিয়াজ কাঁদতে কাঁদতে নিচে আসছিলো।নিচতলায় আসতেই শুনতে পায় সিড়ির কোনায় কারোর ফিসফিসিয়ে কথা বলার শব্দ।কথাগুলো ছিলো কোন এক মেয়ের।সে বলছিলো,
''দেখুন বাজে চিন্তা করবেন না।ভাইয়ার বন্ধুরা আমাকে বোন হিসেবে মানে।আর হয়ত ফাজলামো করে।দেখো সাইমন আমি আপনার থাকবো।আপনাকে ভালবাসি।কেন বুঝেননা। আচ্ছা শুনেন আমরা কাল বিকেলে ঢাকার জন্য বের হবো আপনি দাদুকে পাঠিয়ে দেবেন।তাহলে বিয়েটাও হলো আপনার চিন্তাও দূর।"
ইমতিয়াজ যতোই নিচে নামছিলো ওর বুক ধুকপুক করছিলো।নিচে আসতেই যেন জীবনের সবচেয়ে বড় ধাক্কাটা ও খেলো যার জন্য ও প্রস্তুত ছিলোনা।সাঁঝ কথা বলছিলো।শেষ কথাটি ছিলো,
''খুব ভালবাসি সাইমন।"
সাঁঝ ইমতিয়াজ কে খেয়াল করেনি।ইমতিয়াজ সরে আসে।পাশ থেকে শুনতে পাচ্ছিলো ইদ্রির চিৎকার করে কান্নার আওয়াজ।ইদ্রি কাঁদতে কাঁদতে বলছিলো,
''নিশাদ আপনি কিভাবে বলতে পারলেন এভাবে?কেন এভাবে আমার ভালবাসাকে অপমান করলেন?শুধু আপনার ভালবাসা চেয়েছিলাম।কিন্তু বিনিময়ে পেলাম আপনার অপমান।নিজের চরিত্রে ও দাগ লেগে গেলো আপনাকে ভালবেসে।"
ইমতিয়াজ নীরব শ্রোতা হয়ে রুমে চলে গেলো।
....................................তুইঙ্কেল তুইঙ্কেল লিতেল স্তাল,হাউ আই ওয়ান্দাল হোয়াত ইউ আল,আপ আবাব দা ওয়াল তো আই, লাইতে দাইমন্দ ইনদা স্তাই!!!!!
মেয়ের এমন আধোবোলে রাইমস শুনে হেসে উঠে বিভান আর বেলা।কয়েকদিনে এ ছড়াটা শিখাতে পেরেছে ওরা।বিভান মেয়েকে টেনে গালে চুমু দিয়ে বলল,
''আম্মু জনি জনি টা বলো তো।"
পুর্না মুখ শুকনো করে বলল,
''পালি না তো।"
বিভান মেয়েকে কোলে টেনে বলল,
''বাবা ও বলবো।"
পূর্না দাঁত দেখিয়ে হাসতে থাকে।বেলা হাসছে মেয়ে আর বিভানকে দেখে।বিভান আর পূর্না এইতো ওর দুনিয়া ওর সব। বেলার চোখের কোনা ভরে আসে।
হেসে বিভানকে দেখতে থাকে।মেয়েকে নিয়ে রাইমস বলছে।বিভান রাইমস বলতে বলতে বেলার দিকে তাকিয়ে দেখলো বেলা ওকে দেখছে।চোখের কোনা জ্বলজ্বল করছে।বিভান মাথা নেড়ে ইশারা করে কি হয়েছে?বেলা হেসে মাথা নেড়ে দুহাতে চুমু খেয়ে দুজনের দিকে ছুড়ে দিলো।বিভান হেসে চুমু টা হাতে নিয়ে মেয়ের দিকে মন দেয়।রাতের খাবার অনেক আগেই শেষ হয়ে গিয়েছিলো।বেলা বিভান আর পূর্না খাটে শুয়ে আছে।বেলা মাঝে শুয়েছে।বিভান বেলার অজান্তেই ওর হাত ধরে বেলার আঙ্গুল গুলো নিজের আঙ্গুলের ভাজে ঢুকিয়ে নিতে থাকে।বেলা পাশে তাকিয়ে মৃদু হাসে।বিভান বেলাকে দেখছিলো। হঠাৎ এগিয়ে এসে বেলার কপাল আর চোখজোড়ার পাতায় চুমু দিয়ে ওর ঠোঁটের কাছে আসতে বেলা ফিসফিস করে বলল,
''মেয়ে আছে।"
বিভানের চোখ বন্ধ ছিলো।বেলার কথায় আধোচোখ খুলে বলল,
''মেয়ে ঘুম।"
''উঠে গেলে?"
বেলাকে টেনে একদম কাছে এনে বিভান বলল,
''উঠবেনা।এবার চুপ থাকো।"
বিভান বেলার ঠোঁটে চুমু খেতে থাকে।একহাতে বেলার ব্লাউজের পিছনের বোতামে হাত দেয়। বেলা বিভানের পিঠে হাত রেখে বলল,
''ও উঠে যাবে।"
''উহুম বেলা।চুপ থাকো।ও আমাদের দেখলে ফের ঘুমিয়ে যাবে।প্লিজ এবার চুপ থাকো।মেয়ে তোমার থেকে বেশি বুঝে আমাকে।"
বেলা হেসে বিভানের ভালবাসায় নিজেকে ডুবিয়ে দেয়।