রংধনু - পর্ব ৩৭ - তাবাসসুম রিয়ানা - ধারাবাহিক গল্প


ভিডিও কল আসছিলো আদনানের ল্যাপটপে।অফিসে জয়েন করার পর ওকে ল্যাপটপ দিয়েছিলো অফিস থেকে।সেটা ও নিজের ব্যাক্তিগত কাজে লাগাতে পারবে।আদনান সবাইকে রুমে ডেকে বিভান কে বার্তা প্রেরন করে।নিশাদ অসুস্থ শরীর নিয়ে খুব কষ্টে এসে দাঁড়ায় এক কোনে।কুঞ্জন পিছনে তাকিয়ে বলল, 
''ভাই তুই সামনে আয়।"
সাঁঝ ভাইকে টেনে খাটে এনে বসিয়ে দেয়।নিশাদের পাশ ঘেষে বসে আছে লাবনী।নিশাদ চারপাশে তাকিয়ে সাাঁঝ কে জিজ্ঞেস করলো,
''আম্মা কই?"
সাঁঝ হুমায়রা কে গুতো দিয়ে বলল,
''এই যা আম্মাকে ডেকে আন।আব্বা যেন না জানে।"
হুমায়রা গাল ভেঙচি দিয়ে বেরিয়ে গেলো রুম থেকে।ততক্ষনে ল্যাপটপে বিভানের কল আসে।আদনান কল রিসিভ করতেই ওদের সামনে বেলা বিভান আর ছোট্ট পূর্না।ইতোমধ্যে হুমায়রা মাকে নিয়ে ও হাজির।জুলেখা বানুকে নিশাদের অপরপাশে বসিয়ে ওরা ল্যাপটপের দিকে তাকায়।বেলা আর বিভান বলে উঠলো,
''হ্যাপি বার্থডে টু ইউ নিশাদ।"
নিশাদের মুখে ম্লান হাসি ফুঁটে উঠে।বেলা আর বিভানকে উদ্দেশ্য করে বলল,
''থ্যাংক ইউ আপা আর ভাইয়া।"
বেলা ওখান থেকে বলছিলো, 
''সরি আমি না ভুলেই গেছিলাম।তোর শরীর কি খারাপ?"
নিশাদ মাথা ঝাঁকিয়ে বলল,
''না আপা তেমন কিছুনা।মাইগ্রেনের ব্যাথা উঠে গেছিলো।এখন কম আছে।"
বিভান এতক্ষন শুনছিলো ওদের কথা।পাশ থেকে পূর্নাকো কোলে নিয়ে বলল,
''ডাক্তার দেখাতে পারো নিশাদ।স্থায়ী চিকিৎসা নেই মাইগ্রেনের?"
নিশাদ মাথা নাড়লো।অসুস্থ গলায় বলল,
''না ভাই।রোদে বেরুলেই আমার সমস্যা।"
''ওহ।"
বেলা আর বিভান দুজনে একসাথেই মাকে সালাম দিলো।মাতো বেলাকে দেখে কাঁদতে শুরু করে দিয়েছিলো।বেলাও কেঁদে ফেলে।মা আর মেয়ের কথোপকথন চলছিলো আর সাঁঝ সহ বাকিরা ছোট্ট পূর্না।কে দেখে চলেছে বিস্ময়কর দৃষ্টিতে।নিশাদ বিভানের সাথে কথা বলছিলো।হঠাৎ ছোট্ট পূর্না ওর আধো কন্ঠে বিভানকে বলল,
''বাবা মা আল ওনি কাঁদতে কেন?
বিভান হেসে মেয়ের দিকে তাকিয়ে বলল,
''তুমি যেমন তোমার মায়ের মেয়ে তেমনি তোমার মা ওনার মেয়ে।"
''তত্তি।ওনি কি আমাল কি অবে?"
''নানু মামনি।নানু হবে তোমার।আর ওদের দেখতে পারছোনা সবাই তোমার খালামনি আর মামা।"
ওদের কথায় নিশাদ অনেকটা অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলো,
''ভাই কাহিনী কি?"
বিভান একটু শব্দ করে হেসে বলল,
''তোমাদের তো পরিচয় করিয়েই দেয়া হয়নি। ও আমাদের মেয়ে বিভাবতী শেখ পূর্না।কাল নিয়ে এসেছি ওকে।"
সাঁঝ লোভ সামলাতে না পেরে বলল,
''ভাইয়া এই পুতুল কই পেলেন?"
বিভান আরো বেশি হেসে বলল,
''এই পুতুল রাস্তায় ফুল বেঁচছিলো।ভাবলাম এই পুতুলকে আমাদের সবচেয়ে বেশি দরকার।"
হুমায়রা নিশাদ পূর্নাকে দেখে হাসছিলো।লাবনী বলল,
''ভাইয়া আমাদের কাছে পাঠায় দেন আদর করে বড় করে দিবো।"
কুঞ্জন লাবনী কে খোঁচা মেরে বলল,
''তোকে দেখলে  বাচ্চা মানুষ ভয় পেয়ে যাবে।তার থেকে আমাকে দেখলে ভালো লাগবে।তাইনা পূ্র্না!!!আমি ছোট মামা তোমার।আসো কোলে আসো।"
লাবনী রেগে বলল, 
''নিজের চেহারা দেখ কাউয়া কোথাকার।"
তারপর পূর্নার দিকে তাকিয়ে বলল,
''পুনু আমি তোমার ছোট খালামনি।উম্মামমাহ!!!!!"
সাঁঝ ওদের কথায় হাসছিলো।আদনান বেলা কে জিজ্ঞেস করলো,
''আপা তোর ফিলিংস কেমন ওকে পেয়ে?"
বেলা মেয়ের দিকে তাকিয়ে ওর গালে চুমু খেয়ে বলল,
''সব পেয়ে গেছি রে।"
জুলেখা বানু অশ্রুসজল চোখে বলল, 
''বেলা তোর খুশি দেইক্কা ফরান জুড়াইয়া গেলো মা।অনেক ভালো থাক নাতনীরে লইয়া।"
বিভান হেসে বলল,
''মা দোয়া করবেন আমাদের জন্য।"
ওদের কথা শেষে নিশাদ উঠে রুমে চলে আসে।সন্ধ্যায় ইমতিয়াজের সাথে দেখা হবে।ইমতিয়াজ না জানি ওকে কি ভাবছে?ইমতিয়াজ কি সব জানে?ও কি নিশাদের ওপর খুব রেগে থাকবে?বন্ধুত্ব টা থাকবে তো?কথা গুলো ভাবতে ভাবতে নিশাদের মাথা ভার হয়ে আসে।খাটে বসে পড়ে ধুপ করে।যে হাত দিয়ে ইদ্রিকে মেরেছিলো সেটা চোখের সামনে ধরে নিশাদ। না জানি ইদ্রি কেমন আছে?
..........................সেই যে রুমে ঢুকেছে ইদ্রি বের হয়নি এখন ও পর্যন্ত।বিকেল পর্যন্ত গুঁমড়ে কেঁদেছে মেয়েটা।মাঝে মাঝে ফুঁপাচ্ছিলো আবার কেঁদে উঠেছে।সন্ধ্যা ছয়টা বাজে।ইমতিয়াজ শার্ট প্যান্ট পাল্টে আবার ও বোনের রুমের দরজায় নক করতে শুরু করে।বিকেলে ঘুমাচ্ছিলো ও।ঘুম ভাঙ্গার পর মায়ের কাছে বোনের কথা শুনে একটু চিন্তিত হয় ইমতিয়াজ।এমন কি ছবি দেখেছে যে মেয়েটা এমন করছে?আসলেই কি মুভি দেখেছে?নাকি অন্য কোন সমস্যা হয়েছে বোনটার?তারওপর আজ নিশাদের জন্য ওরা সারপ্রাইজ পার্টি প্ল্যান করেছে।অন্তত এখন ইদ্রি দরজাটা খুললে ও নিশ্চিন্তে বের হওয়া যাবে।ইদ্রির দরজায় নক করছিলো ইমতিয়াজ।অপরপাশ থেকে থমথমে গলায় ইদ্রি বলছিলো,
''একা ছাড় আমাকে।ভালো লাগছেনা আমার।"
ইমতিয়াজ আবার বলল,
''ইদ্রি বের হ তুই।কি হয়েছে বলবি?"
''ভাইয়া প্লিজ যা তুই।আমার ভালো লাগছেনা।"
ইমতিয়াজ চিৎকার করে বলল,
''তুই বের না হলে আমি সরবোনা এখান থেকে।জলদি দরজা খুল।এগুলো কেমন ফাজলামি করছিস। বের হয়ে আয়।"
ইদ্রি চিৎকার করে বলল, 
''আমার যখন ইচ্ছা হবে তখন বের হবো। প্লিজ ভাইয়া যা।"
ইমতিয়াজ রেগে সরে এলো।তারপর পুরোপুরি রেডি হয়ে বেরিয়ে এলো।রাস্তায় এসেই নিশাদকে কল দেয়।নিশাদ কল রিসিভ করছিলোনা।ইমতিয়াজ আবার ও নিশাদের নম্বরে কল লাগায় কিন্তু রিং হয়ে কল কেঁটে যাচ্ছে।ইমতিয়াজ কিছুটা চিন্তিত মুখে নিশাদের নম্বরের দিকে তাকিয়ে থাকে।এই ছেলে কই গেলো কে জানে?ইমতিয়াজ কল্যান কে কল দেয়।কল্যান জানালো নিশাদ কারোর কল রিসিভ করছেনা।ইমতিয়াজ কিছু না বলে কল কেঁটে দেয়।তারপর অনেক ভেবে চিন্তে নিশাদের বাসার উদ্দেশ্যে রওনা হয়।আধ ঘন্টার মাঝে পৌছে গেলো ইমতিয়াজ।গাড়ি লক করে গেটের ভিতর ঢুকে ও।নিশাদদের বাসার সামনে এসে কলিংবেল বাজানোর পরপরই দরজা খোলার শব্দ পায়।ইমতিয়াজ দাঁড়িয়ে ভাবছিলো ইদ্রির কথা।হঠাৎ বোনের এমন পাগলামীর মানে কি?তখনই দরজা খুলে গেলো ইমতিয়াজ সাঁঝকে দেখে অনেকটা চমকে উঠে।সাঁঝ একদম ঘরোয়া সাজে।চুল গুলো খোঁপা করা।উড়নার একপাশ কোমড়ে বাঁধা।সাঁঝ ইমতিয়াজকে দেখে অবাক চাহনিতে বলল,
''ভাইয়া ভিতরে আসুন।"
ইমতিয়াজ হালকা হেসে ভিতরে প্রবেশ করতে করতে বলল,
''নিশাদ কই?"
''ভাইয়া রুমে।আপনি বসুন আমি ডাকছি।"
''ওকে।"
সাঁঝ চলে যেতে থাকে।ওর যাওয়ার দিকে তাকিয়ে থাকে ইমতিয়াজ।মেয়েটাকে ভীষন সুন্দর আর মায়াবী লাগছিলো।ইমতিয়াজের আজ সাঁঝকে আরো বেশি ভালো লাগতে শুরু করেছে।কিছুক্ষনের মাঝেই নিশাদ ইমতিয়াজের সামনে হাজির।নিশাদকে দেখে ইমতিয়াজ রেগে গেলো।নিশাদ ট্রাউজার আর পাতলা গেঞ্জী পরে আছে।ইমতিয়াজ রেগে বলল,
''কিরে শালা এ অবস্থায় কেন তুই?কখন বের হইতি?"
ইমতিয়াজের কথায় নিশাদ অবাক হয়ে বলল, 
''কই যাবো?"
ইমতিয়াজ রেগে বলল,
''তোর ওপর না মেজাজ খারাপ হচ্ছে।তোর না আজ সন্ধ্যায় আমাদের সাথে থাকার কথা ছিলো?"
নিশাদের মনে পড়ে যায়।ও বলল,
''আসলে শরীর ভালো না।তাই শুয়ে ছিলাম।"
''কি হলো?"
''সকাল থেকে মাইগ্রেনের খুব ব্যাথা।এখন অবশ্য কম আছে।"
ইমতিয়াজ বলল,
''যেতে পারবি তুই?"
নিশাদ অনেকটা সময় চুপ থেকে বলল,
''তুই বোস আমি আসি।"
নিশাদ বেরুনোর পরেই চায়ের ট্রে নিয়ে রুমে প্রবেশ করে সাঁঝ।আরো কিছু নাস্তা ছিলো।ইমতিয়াজ এতো নাস্তা দেখে বলল,
''এতো কিছু কেন?আমি খাবোনা।"
সাঁঝ একটু হেসে বলল,
''কেন ভাইয়া।আপনি সচরাচর আসেননা তাই দিলাম।"
ইমতিয়াজ লজ্জামাখা হাসি দিয়ে বলল,
''বুঝেছি আসলে নিশাদের জন্য সারপ্রাইজ রেখেছি।এমনিতেই খাওয়া দাওয়া হবে।আমি শুধু চাই নিবো।"
সাঁঝ হালকা হেসে বলল,
''আচ্ছা।"
কিছুক্ষন পরই নিশাদ আর ইমতিয়াজ বেরিয়ে যায়।ইমতিয়াজ কিছুটা সময় সাঁঝের চিন্তায় থাকলে ও ইদ্রির কান্না ওকে আবার ও দুশ্চিন্তায় আঁকড়ে ধরলো।বন্ধুকে এমন চুপচাপ দেখে নিশাদ বলল,
''কিরে কিছু নিয়ে ভাবছিস?"
ইমতিয়াজ গভীর শ্বাস ছেড়ে বলল,
''ইদ্রিটা আজ খুব পাগলামী করছে।আগে এমন করেনি কখনো।"
নিশাদ কেমন যেন স্তব্ধ হয়ে যায়।বন্ধুর জবাব না পেয়ে ইমতিয়াজ বলতে লাগলো,
''আজ নাকি ফিল্ম দেখে এসেছিলো।ঘরে ফিরে রুমের দরজা আটকে কাঁদছে।কারোর সাথে কথা ও বলছেনা।ভাঙ্গচুর ও করেছে ওর রুমে।"
নিশাদ অবাক করা চাহনিতে ইমতিয়াজের দিকে তাকায়।তাহলে কি ওর কারনেই ইদ্রি এমন করছে?নিশাদ ঠান্ডা আওয়াজে জিজ্ঞেস করলো,
''তুই জানতে চাসনি কি হয়েছিলো ওর?"
''বলেনি।জানতে চেয়েছি। বাসায় গিয়ে কথা বলবো।"
''হুম।"
ইমতিয়াজ হেসে বলল,
''জানিস ও খুব জেদি।খুব বেশি নরম মনের।"
ইমতিয়াজ কিছু বলতে পারছিলো না। চুপচাপ ইমতিয়াজের কথা শুনে গেলো।মনে মনে বলতে লাগলো,
''মাফ করে দিস বন্ধু।আজ ওর এই কান্না শুধু আমার জন্য।চেয়ে ও তোকে কিছু বলতে পারছিনা।"
..........................সেদিন রাতে বিভান বেলা পূর্নার দুপাশে বসে আছে।পূর্না ওদের মাঝে।ছাদে শীতল হাওয়া বইছে।পূর্না সন্ধ্যা থেকেই বেলাকে খালা আর মামাদের কথা জিজ্ঞেস করে করে পাগল করে দিচ্ছে।মায়ের মুখে সেই নতুন ভাষা নিয়ে ওর উৎসাহের শেষ নেই।তারপর ওপর নতুন মানুষদের নিয়ে ওর প্রশ্ন তো আছেই।বেলা  মেয়ের প্রশ্নের জবাব দিতে দিতে পাশে বসে থাকা বিভানের পানে তাকায়।লোকটা বাহিরে তাকিয়ে আছে।বেলা মেয়ের দিকে তাকিয়ে মুচকি হেসে বলল, 
''আম্মু তোমার খিদে পেয়েছে?"
''না।তোমাল পেয়েতে?"
''না।আসো আমার কোলে।"
পূর্না বেলার কোলে উঠে ওর বুকে মাথা দিয়ে রাাখলো।বেলা পাশে তাকিয়ে বিভানকে দেখে।তারপর বিভানের হাত স্পর্শ করতেই বিভান ওর দিকে তাকিয়ে হাত সরাতে চায় কিন্তু বেলা ওর হাত আঁকড়ে ধরে ওর পাঁচ আঙ্গুল দিয়ে।যার কারনে বিভান আর হাত সরাতে পারেনা।বেলা বলল,
''বিভান থ্যাংক ইউ!!"
বিভান একপলক স্ত্রীর পানে চেয়ে বলল,
''কেন?"
''আমাকে এভাবে পরিপূর্নতা দান করা জন্য।"
''হুম।"
থমথমে কন্ঠে জবাব দিলো বিভান।বেলা এগিয়ে এসে বিভানের কাঁধে মাথা রাখে।বিভান পাশে তাকিয়ে বেলা দেখে কিন্তু কিছু বলেনা।বেলা বলল,
''জানেন আপনাকে পাওয়ার পর সবসময় এমন একটা মুহূর্তের অপেক্ষায় ছিলাম।আজ সেটা পূরন ও হলো।"
''যদি মিথ্যে না বলতে তাহলে তের বছর আগেই পূরন হতো।"
বেলা মাথা উঠিয়ে বিভানের দিকে তাকায়।বিভানের চোখ সামনের দালান গুলোয় নিবদ্ধ।বেলার চোখ জ্বল জ্বল করে উঠে।
''আপনি এভাবে আমাকে কষ্ট দিচ্ছেন বিভান।"
''আমি ক্ষতবিক্ষত হয়েছি তোমার আর মিস বন্দনা আখতারের কারনে।সেটার কি করবে?"
''মাফ চেয়েছিলাম আমি।আমি কি কম কষ্টে ছিলাম?আমি কি সন্তান হারাইনি?নাকি শুধু আপনিই হারিয়েছেন? বলেন।"
বিভান শুধু বলল,
''এসব কথা বলার সময় নেই।বাবু আছে আমাদের সাথে।"
বেলা সরে এলো বিভানের কাছ থেকে।অশ্রুসজল চাহনিতে চেয়ে রইলো মেয়ের মুখের দিকে।

!!!!

গতকাল থেকে কেঁদে কেঁদে চোখ মুখ ফুলিয়ে ফেলেছে ইদ্রি।মোবাইলে বারবার বান্ধুবীদের কল,মেসেজ আসছিলো সেগুলো ইগনোর করে রেখে দিয়েছিলো ইদ্রি।এখন কারোর সাথে কথা বলার অবস্থায় নেই ও।শুয়ে ছিলো ইদ্রি।এখন সম্ভবত ভোর চারটা।দুচোখে ঘুমের কোন চিহ্নই নেই বললেই চলে।কানে যখনই নিশাদের সেই কথা গুলো বাজতে থাকে তখনই মনে হতে থাকে ও শেষ হয়ে গেলো না কেন তখন?তার ভালোবাসাই যদি না পাওয়া গেলো তাহলে বেঁচে থেকে কি লাভ?আবার ও গুমড়ে কেঁদে উঠে ইদ্রি। গালটা ভীষন জ্বলছে।শোয়া থেকে উঠে বসে ল্যাপটপ হাতে নিয়ে সেটাকে খুলে।তারপর ছবির ফোল্ডারে গিয়ে নিশাদের পার্সোনাল ফোল্ডারে গিয়ে ছবি গুলো দেখতে থাকে।প্রায় একহাজার পঞ্চাশটার মতো ছবি।ছবি গুলো কে বড় করে করে দেখতে থাকে ইদ্রি।ফোল্ডারে অনেক্ষন ঘুরে বেরিয়ে আসে ইদ্রি।তারপর ইচ্ছে মতো আই লাভ ইউ নিশাদ টাইপ করতে থাকে।যতোবার লিখছিলো ততোবার চড়টা যেন ওর গালে আরো জীবন্ত হয়ে উঠছে।
ইদ্রি হঠাৎ ল্যাপটপ অফ করে ল্যাপটপের ওপর মাথা ঢেলে কাঁদতে থাকে।তখনই ওর কানে ফজরের আজানের ধ্বনি ভেসে আসে।মাথা উঠিয়ে জানালার দিকে তাকায় ইদ্রি।আগে নামাজ তেমন পড়া হয়নি ওর।আজ ওর খুব পড়তে ইচ্ছে হচ্ছে।আজ দোয়ায় লোকটাকে অনেক চাইবে।কারন তাকে চায় ইদ্রি অনেক বেশি চায় পাগলের মতো চায়।উঠে ওজু করে এসে জায়নামাজ বিছায় ইদ্রি।সারারাত দিন কিছু পেটে পড়েনি ওর।ভীষন দূর্বল লাগছিলো।নামাজ শেষ করে উঠে বিছানার কাছে আসতেই হঠাৎ খাটের সাথে ধাক্কা খেয়ে পড়ে যায় ইদ্রি।
সকাল আটটা ইমতিয়াজ অফিসের জন্য রেডি হচ্ছিলো।তখনই সৈয়দা বেগমের নক পড়ে ওর দরজায়।ইমতিয়াজ দরজা খুলতেই ওনি কান্না করতে শুরু করেন।বলছিলেন,
''মেয়েটার কোন খবর নাই বাবা।কিছু কর।কি হয়ে গেলো মেয়েটার?"
ইমতিয়াজ ভ্রু কুঁচকে চিন্তিত কন্ঠে বলল,
''ডাকছিলা?"
''হ্যারে। কোন সাড়া শব্দ নাই মেয়েটার।"
কান্নায় ভেঙ্গে পড়েন সৈয়দা বেগম। ইমতিয়াজ শার্টের বোতাম লাগিয়ে বেরিযে এসে ইদ্রির রুমের সামনে দাঁড়ায়।নক করতে থাকে।জোরে জোরে ইদ্রির নাম ধরে ডাকতে শুরু করে।নাহ কোন খবরই নেই।ইমতিয়াজ এবার জোরে জোরে বাড়ি মারতে থাকে দরজায়।হঠাৎ দরজা খুলে যায়।ওরা দেখতে পায় ইদ্রি ফ্লোরে পড়ে আছে ইদ্রি।ঠোঁট মুখ শুকনো হয়ে আছে।সৈয়দা বেগম আরো জোরে কাঁদতে লাগলেন।ইমতিয়াজ বোনকে কোলে তুলে ড্রাইভারকে কল দিয়ে ডাক্তার নিয়ে আসতে বলে।সৈয়দা বেগম মেয়ের পাশে বসে ওর হাত ধরে কাঁদছেন।ইমতিয়াজ রেগে বলল,
''কান্না বন্ধ করে ওর জ্ঞান ফেরাও।"
রানু খালা পানি আনতেই সৈয়দা বেগম ওর মুখে পানির ছিটা দিতে থাকেন।কিছুক্ষনের মাঝেই কেঁপে উঠে ইদ্রি।চোখ খুলে মাকে দেখে কান্না করতে চাইলে পিছনে ভাইকে রেগে তাকিয়ে থাকতে দেখে ভয় পেয়ে যায়।ইমতিয়াজ কিছু বলতে গেলে রানু খালা বলেন,
''ডাক্তার আইছে।"
ইমতিয়াজ ওনার দিকে একবার তাকিয়ে মায়ের দিকে চোখ সরিয়ে এনে বলল, 
''মা ডাক্তার চলে এসেছে।"
সৈয়দা বেগম উঠে দাঁড়ান।ডাক্তার এসে ইদ্রির পাশে বসে।ইমতিয়াজ বলল,
''সকালে রুমে ঢুকে দেখি জ্ঞান হারিয়ে পড়ে আছে।কাল সকাল থেকে রুমের দরজা বন্ধ করে রেখেছিলো।"
ডাক্তার সম্পূর্ন কথা শুনে ইদ্রির চেকআপ করে বললেন,
''ওর বোধহয় কাল সারাদিন কিছু খাওয়া হয়নি।আর কান্না কাটি ও হয়ত করেছে খুব।"
ইমতিয়াজ চুপ করে বোনের দিকে কড়া নজরে তাকালো তবে কিছু বললনা।ডাক্তার সাহেব পরক্ষনে বললেন,
''ভালো হয়ে যাবে।সারাদিন না খাওয়ায় মাথা ঘুরে গিয়েছিলো।কিছু খাইয়ে গ্লুকোজ খাওয়াবেন।"
ডাক্তার বেরিয়ে গেলো।ইমতিয়াজ ইদ্রির পাশে বসে রেগে বলল,
''আমি অফিস যাচ্ছি এসে তোর এসব নাটকের কারন শুনবো।"
তারপর সৈয়দা বেগমের দিকে তাকিয়ে ইমতিয়াজ বলল,
''আম্মা ওকে ভালোমতো খাওয়ায় দিবা।রুমের দরজা যেন না আটকানো দেখি আসার পর।"
কথা গুলো বলেই ইমতিয়াজ বেরিয়ে পড়ে।
.................................... ক্লাশ শেষে বেরিয়ে এসেছে সাঁঝ।শীত পড়বে পড়বে বলে হালকা ঠান্ডা ও লাগছে।ঝালমুড়ি ওয়ালা চাচা গায়ে ময়লা চাদর পেঁচিয়ে জুবুথুবু হয়ে রাস্তার এককোনায় বসে আছে।সাঁঝ হেঁটে হেঁটে সেদিকে এগুতেই ঝালমুড়িওয়ালা চাচা উঠে দাঁড়িয়ে বললেন,
''ঝালমুড়ি খাইবেননি?"
''জি চাচা।দেখিতো বেশি ঝাল দিয়ে বানিয়ে দিন।বোম্বায় মরিচ আছে?"
''হ আছে।বানাইতাছি।"
সাঁঝ দাঁড়িয়ে রইলো।ওর এখন ও বিশ্বাস হচ্ছে না সাইমন ওকে না বলে কুমিল্লা গিয়েছে।ভাবতেই মন মেজাজ ভীষন খারাপ হতে লাগলো।এইতো কাল বদটাকে কল দিয়োছিলো।ফোন ধরছিলোনা। রাত এগারোটায় কল দিয়েছিলো সাইমন।সাঁঝের চোখে ছিলো ঘুম ঘুম ভাব।সেই ঘুমন্ত আধো চোখে ফোনের ওপর উঠে থাকা নামটা দেখে মুচকি হাসি ফুঁটে উঠেছিলো সাঁঝের ঠোঁটের কোনায়।ফোন রিসিভ করে কানের রাখতেই সাইমন একটু শব্দ করে হেসে বলল,
''সরি সাঁঝ কল রিসিভ করতে পারিনি।বুঝোইতো সবাই এসেছে।এতো মানুষের ভীড়ে কল রিসিভ সহজ নয়।"
সাঁঝের হাসি মুখ কেমন যেন বিস্ময়ে পরিনত হলো।ভ্রু কুঁচকে জানতে চাইলো, 
''কই আপনি?"
''আমি কুমিল্লা আমার নানার বাড়ি।"
সাঁঝ অভিমানী কন্ঠে বলল,
''সেখানে চলে গেলেন আর একটা বার ও জানালেননা।কেন?"
সাইমন কিছুটা অবাক হয়ে বলল,
''সাঁঝ আমাকে কাজে আসতে হয়েছে।এভাবে রিয়্যাক্ট করার কি হলো?এখন তো জানালামই। "
''আগে জানানো আর যাওয়ার পরে জানানোয় তফাৎ আছে।"
সাঁঝের কথায় মনে হলো ভীষন রেগে ও।তবে সাইমন কোন কারন খুঁজে পাচ্ছেনা এমন রাগ দেখানোর।সাইমন শক্ত গলায় বলল,
''দেখো সাঁঝ আমি প্রচন্ড বিজি ছিলাম।তোমার ভাইয়ের জন্মদিন ছিলো তাই তুমি কথা বলার টাইম পাওনা আর আমাকে এসব বলছো?আমার কাজ অনেক বেশি ইম্পর্ট্যান্ট তোমার কাজের চেয়ে ও।"
সাইমনের কথায় অনেক টা অবাক হয়ে সাঁঝ উঠে বসে বলল,
''এভাবে কথা বলার কি হলো?যার যার কাজ তার কাছে ইম্পর্ট্যান্ট। আর কথা রইলো আমার ভাইয়ের।না জেনে কথা বলবেননা।আমার ছোট বোন সাথে ছিলো তাই কল কাঁটতে হয়েছিলো।আর কখনো আমার ভাইকে টানবেননা আমাদের কথায়।যাই হোক আপনার ইম্পর্ট্যান্ট কাজ শেষ হয়ে একটু টাইম থাকলে আমাকে দিতে পারেন।না পারলে ও প্রবলেম নেই।"
সাইমন কিছুটা আঁচ করতে পারে সাঁঝ অনেক রেগে গেছে।তবে ও নিজে ও এতো টায়ার্ড যে রেগে গিয়েছিলো।সাইমন কিছু বলতে নিলেই সাঁঝ কল কেঁটে ফ্লোরে ছুড়ে দেয় ফোন।যা বলার ওকে বলুক।ভাইয়াকে কেন টানবে?এর পর থেকেই সাইমন কয়েকবার কল দিয়ে গেছিলো সাঁঝ কল রিসিভই করলো না আর।কার্ডে কিছু ঝালমুড়ি নিয়ে সেটা মুখে দিয়ে রিক্সায় উঠে পড়ে সাঁঝ।একহাতে ঝালমুড়ি নিয়ে অপরহাতে ব্যাগের চেইন খুলে সেখান থেকে ফোন বের করে দেখতে থাকে কে কে কল দিলো।সাইমনের অনেক গুলো কল মেসেজ এসে আছে।মেসেজ গুলো ছিলো এমন, 
''প্লিজ কল রিসিভ করো কথা আছে।"
''সাঁঝ আ'ম সরি প্লিজ কল টা রিসিভ করো।"
''দেখো আমি কিন্তু চলে আসবো তুমি এমন করলে।"
''সাঁঝ এগুলো কেমন বেয়াদবী?কল জলদি রিসিভ করো।"
''সাঁঝ প্লিজ কল রিসিভ করো বলছি।সারাদিনে কিছু খাওয়া হয়নি আমার।"
এমনই আরো অনেক মেসেজ ছিলো।কোনটা রাগা ভাঙ্গানোর আবার কোনটা ধমকে পরিপূর্ণ। ফোনটা ফের ব্যাগে ভরে নেয় সাঁঝ।অভিমানে রাগে দুঃখে নিজের চুল ছিড়তে ইচ্ছে হচ্ছে ওর।
.................................এদিকে সেদিন রাতে বেলা কিছুই বলেনি বিভানকে।বিভান ও কিছু বলেনি।ওরা নিজেদের মতো শুয়ে পড়েছিলো।তেমনি পরদিন সকালে বিভান গোসল থেকে বেরিয়ে লক্ষ করেছিলো টেবিলে ওর নাস্তা সাজানো।বেলা পূর্না কে নাস্তা করাচ্ছে।বিভান চেয়ারে বসে রুটির এক কোনা ছিড়ে সবজি ভরে মুখে নিয়ে বেলা আর মেয়েকে দেখতে থাকে।ও ভাবছিলো বেলা হয়ত এসে কথা বলবে কিন্তু তা হয়নি।কিছুক্ষন পর বেলা এসে বিভানের নাস্তার প্লেট চেক করে চা বানাতে চলে যায়।বিভান একটু নিশ্বাস ছেড়ে খাবারে খাবারে মাখা মাখি  হয়ে যাওয়া পূর্নার দিকে তাকায়।ওর মুখ জামা খাবারে মেখে গেছে একদম।মেয়েটাকে খাওয়াতে বেশ ধৈর্য শক্তির প্রয়োজন হয়।খাবার মুখে নিয়ে বসে থাকে হা করে।বেলা একহাজার একটা গল্প শুনালে খাবার গিলে পূর্না।বিভান মেয়ের দিকে তাকিয়ে কথা গুলো ভাবতে ভাবতে ওর ঠোঁটের কোনে হাসি ফুঁটে উঠে।ততক্ষনে পূর্না বিভানের দিকে এগিয়ে আসছিলো।বিভান মৃদু হেসে বলল,
''যাও মা এগুলো ধুয়ে আসো।"
''দুবো না।তোমালে কোলে উতবো।"
''আগে ধুয়ে আসো।তারপরে কোলে নিবো।"
পূর্না এক নাগাড়ে মাথা দুলাতে দুলাতে বিভানের কাছে এসে  ওর প্যান্টে  ময়লা দুহাত রেখে বলল,
''বাবা কোলে নাও।"
বিভান কিছুটা রাগ হলে ও নিজেকে সংযত করে বলল,
''মা তুমি এটা কি করলে?বাবার প্যান্ট নষ্ট করে দিলে?বাবা অফিসে যাবেনা?"
বিভানের কথা শুনে পাকঘর থেকে দৌড়ে এলো বেলা চায়ের কাপ হাতে। কাপ টেবিলের ওপর বিভানের সামনে রেখে মেয়েকে কোলে তুলে বলল,
''চা খেয়ে প্যান্ট পাল্টে নিন।"
''একটু ধুয়ে নিলেই চলবে।"
বেলার দিকে তাকিয়ে বলল বিভান।কিন্তু বেলা তাকায়নি ওর দিকে।মেয়েকে কোলে নিয়ে বাথরুমে যেতে যেতে বলল,
''রাতে কি খাবেন সেটা বলে গেলে খুশি হবো।"
বেলার কথায় বিভান রাগ দেখলে ও অভিমানের ছোঁয়া একটু বেশিই পেলো।বিভান চা খেয়ে উঠে দাঁড়িয়ে বেসিনে চলে আসে।তারপর প্যান্টের ময়লা অংশটুকু ধুয়ে বেরিয়ে যায়।
........................রাতে ইমতিয়াজের কথায় নিশাদের মন প্রচন্ড অস্থির হয়ে উঠে।ইদ্রি নাকি সারারাত সারাদিন রুমের দরজা আটকে বসেছিলো।কি বলবে কি করবে কিছুই বুঝে উঠতে পারছেনা নিশাদ।মেয়েটা এমন পাগলামী কেন করছে?কেন এমন করছে?আসলে ইদ্রির বয়সী অর্থাৎ আঠারো বছরের মেয়েরা একটু বেশিই আবেগী হয়।এতো আবেগী হলে চলে না।কারন দুনিয়টা বড্ড কঠিন আর বাস্তবতায় পরিপূর্ণ। এখানে আবেগী হলে বাঁচা দুঃসাধ্য হয়ে উঠে।নিশাদ চেয়ে ও ইদ্রির ভালবাসায় না পারছে ধরা দিতে আর না পারছে দূরে যেতে।মেয়েটার কথা মাথায় ঘুরপাক খাচ্ছে।তবে এসব ভাবলে নিশাদের চলবে না ওকে যে ওর পরিবার দেখতে হবে।ইদ্রি রুপোর চামচ মুখে দিয়ে বড় হয়েছে সেখানে ওর মতো মধ্যবিত্তের ভালবাসার মর্ম বুঝবে কি করে?নিশাদের ভালবাসা কোন অংশে কম নয় হয়ত কিন্তু ওর পারিপার্শ্বিক সামাজিক অবস্থা ওকে দিচ্ছে না ইদ্রিকে ভালবেসে বুকে টেনে নিতে।তারওপর বয়সের ব্যাবধান তো আছেই।

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন