মেঘের খামে অনুভূতি (পর্ব ২৪)


দেখতে দেখতে কয়েক দিন কেটে গেল। এভাবে স্পৃহার রাগ একটু কমছে না। জীবন কি করবে ভেবে পাচ্ছে না। স্পৃহাকে সরি বলছে। তবুও স্পৃহা এমন জেদ করছে কেন? স্পৃহার বাবা মা তোহা কেউ বাসায় থাকে না সারাদিন। স্পৃহা আর জীবন একা থাকে সবটা সময়। এই সময়ে স্পৃহা জীবনের সাথে ভালো করে কথাও বলে না। একা একা জীবনের সময় মোটেও কাটতে চায় না। জীবন গোসল করছিল। স্পৃহা হয়তো রান্নাঘরে। হঠাৎ তার মাথা দুষ্টুমি বুদ্ধি আসলো। জীবন গলা ছেড়ে স্পৃহাকে ডাকতে লাগলো, 
'স্পৃহা! স্পৃহা! বৌ! এই বৌ শুনছো?'
স্পৃহা রান্নাঘর থেকে দৌড়ে এসে কুল পায় না। রুমে এসে বলল,
'কি হয়েছে? কোথায় আপনি? '
'বৌ আমি ওয়াশরুমে।'
'ওয়াশরুমে থেকে ওভাবে চেঁচাচ্ছেন কেন?'
'একটু এদিকে আসো না।'
'কোথায় আসবো আমি? '
'আরে আমার কাছে আসো। মাথায় একটু শ্যাম্পু করে দাও না।'
'আপনি এসব বাজে কথা বলার জন্য আমাকে এভাবে ডেকেছেন এতক্ষণ? '
'স্বামীর সেবা করবে এটা বাজে কথা? তুমি জানো না স্বামীর সেবা করলে আল্লাহ সওয়াব দেন।'
'আপনি সত্যিই একটা অসহ্যকর লোক। '
স্পৃহা চলে গেলে জীবন হাসতে লাগলো। 
'যতদিন তুমি আমার সাথে বাসায় না ফিরবে ততদিন তোমাকে এভাবেই জ্বালাবো।'
রান্নাঘরে গিয়ে স্পৃহা রাগে ফোসছে।
'এই লোকটা ওখানে থাকতেও আমাকে কষ্ট দিয়েছে। এখানে আসার পরও জ্বালাচ্ছে। ইনার জন্য কি আমি কোথাও শান্তিতে থাকতে পারবো না?'
চামচ হাতে নিয়ে নাড়াতে নাড়াতে স্পৃহা ভাবলো, 
'মিস্টার হাজবেন্ড আপনি আমাকে অনেক কষ্ট দিয়েছেন। আমি আপনার সাথে ফিরলেও আগে আপনাকে আমাকে দেওয়া কষ্ট গুলো ফেরত দিব। তারপর আপনার সাথে আমার সব হিসাব কাটাকাটি হবে। এতো সহজে আমি আপনার কাছে ফিরে যাব না।'
জীবন গোসল সেরে ওয়াশরুম থেকে বেড়িয়ে এসে আবার স্পৃহাকে ডাকতে লাগলো, 
'বৌ! ও বৌ। কোথায় তুমি? একটু রুমে আসো না।'
জীবন নিজে নিজেই হেসে বলল,
'বৌ হয়তো রাগ করেছে। যাই বৌকে আরেকটু রাগিয়ে দিয়ে আসি।
বৌ! স্পৃহা বৌ। ওগো বৌ শুনছো? ও আমাদের ফিউচার বাবুর আম্মু। '
স্পৃহা জীবনকে শুধু একটা টাওয়েলের পেঁচানো দেখে বলল,
'আপনার একটুও লজ্জা নেই তাই না? এভাবে টাওয়েল পেঁচিয়ে খালি গায়ে সারা বাড়ি ঘুরছেন।' 
'লজ্জা? লজ্জা থাকবে কেন? এটা আমার শ্বশুরবাড়ি। এখন পুরো বাড়ি ফাঁকা। শ্বশুর শাশুড়ি শালিকা কেউ নেই। বৌয়ের সামনে টাওয়েল পড়ে আসি আর খালি গায়ে আসি লজ্জা লাগবে কেন? '
স্পৃহা কোনো ভাবেই জীবনের সাথে কথায় পেরে উঠে না। মনে মনে স্পৃহা বলল,
'কি করলে এই লোক শাস্তি পাবে? কি বললে উনাকে দমানো যাবে? আমার কোনো কথাই তো উনি সিরিয়াস ভাবে নেন না।'
জীবন স্পৃহার পেছনে গিয়ে দাঁড়িয়ে কানের কাছে বলল,
'কি ভাবছো?'
স্পৃহা ভয় পেয়ে উঠে বলল,
'কিছু না। আপনি দূরে গিয়ে দাঁড়ান। '
স্পৃহার এই কথা শুনে জীবন এবার ওর কোমর জড়িয়ে ধরে বলল,
'যদি দূরে না যাই? '
'দূরে না গেলে,,, দূরে না গেলে আমি আপনার গালে গরম চামচের ছেঁকা লাগিয়ে দিব। তখন গাল পুড়ে বসে থাকবেন। '
চামচ হাতে জীবনকে দেখিয়ে কথাটা বলেছে স্পৃহা। জীবন তার দিকে গাল এগিয়ে দিয়ে বলল,
'আচ্ছা দাও ছেঁকা। এই নাও তোমার বরের গাল পুড়িয়ে দাও। দেরি করো না তাড়াতাড়ি করো।'
স্পৃহা পুরো ভেবাচেকা খেয়ে গেল। জীবন হেসে বলল,
'এসব কাজ তোমাকে দিয়ে হবে না। তুমি বরং আমার মাথা মুছে দাও। চুলে পানি জমে থাকলে তখন আবার তোমার বরের ঠান্ডা লেগে যাবে। আর ঠান্ডা লাগলে তখন তোমাকেই সেবা করতে হবে।'
'নূপুরকেও এসব কথা বলেই বুলাতেন তাই না? '
স্পৃহা খুব স্বাভাবিক ভাবেই কথাটা বলেছে। জীবন স্পৃহার কথার মানে বুঝতে না পেরে তার কোমর ছেড়ে একটু সরে গিয়ে জিজ্ঞেস করল,
'কি বললে? '
'যা বলেছি তা না বোঝার তো কিছু নেই। নূপুর রাগ করলে আপনি নিশ্চয়ই এসব কথা বলে ওর রাগও ভাঙ্গিয়েছেন? এমন মিষ্টি মিষ্টি কথাতেই তো মেয়েরা ভুলে যায়।'
জীবন থমথমে গলায় বলল,
'স্পৃহা তুমি কি বলছো বুঝতে পারছো তো? নূপুর আমার অতীত। তুমি নূপুরকে নিয়ে কথা বলে আমাকে কষ্ট দিতে চাইছো?'
'নূপুর অতীত হলেও তো আপনি এখনও ওকেই ভালোবাসেন। ওর কষ্টে আপনার মন কাঁদে। এখনো ওর চোখের পানি আপনি সহ্য করতে পারেন না। সবকিছু ফেলে ওর কাছে ছুটে যান। এমনকি নিজের বিয়ে করা বৌয়ের থেকে ওকে বেশি গুরুত্ব দেন।'
জীবন কিছুক্ষণ স্পৃহার মুখের দিকে তাকিয়ে থেকে কিছু না বলে রুমে চলে গেল।
'আমিও ঠিক এমন কষ্টই পেয়েছিলাম। যখন আপনি নূপুরকে বলেছিলেন আমাকে আপনি ছেড়ে দিতে পারবেন। আমার কষ্টের কিছুটা হলেও আজ আপনাকে ফেরত দিতে পেরেছি। একটু অপেক্ষা করুন না। সামনে আপনার জন্য আরো অনেক কিছু অপেক্ষা করছে ডিয়ার হাজবেন্ড। '

তোহা চার টার সময় স্কুল থেকে ফিরে এসেছে। ফ্রেশ হয়ে তোহা খেতে বসেছে স্পৃহা ওর পাশেই বসে আছে। দু'বোন টুকটাক গল্প করছে। তোহা কেমন উসখুস করছে দেখে স্পৃহা বলল,
'কিছু বলবি? পেটের ভেতর কোনো কথা ঘুরপাক খাচ্ছে। কিন্তু তুই সাহস করে কথাটা বলতে পারছিস না।'
'তুমি সব সময় কীভাবে আমার মনের কথা বুঝে যাও?'
'বুঝবো না? আমরা দু'জন বোন। এক মায়ের পেট থেকে জন্মেছি। ছোট থেকে তোকে দেখে আসছি। এখন বল আসল কথা কি?'
'আমাদের স্কুলের একটা মেয়েকে নিয়ে 
তোহা কথা শেষ করতে করতেই জীবন এসে ওদের পাশে বসলো। বলল,
'কী শালিকা দুই বোনে মিলে কি এতো কথা হচ্ছে? আমাকেও তোমাদের সাথে নেওয়া যাবে? একটু গল্প করতাম আরকি।'
তোহা হেসে বলল,
'অবশ্যই নেওয়া যাবে।'
'আচ্ছা তাহলে বসছি। কিন্তু আমি এখানে বসাতে অন্য কারো সমস্যা হবে না তো?'
তোহা স্পৃহার দিকে তাকিয়ে বলল,
'একটুও হবে না। তুমি বসো তো ভাইয়া।'
'এবার বলো কি বলছিলে।'
তোহা বলতে শুরু করলো,
'আমাদের সাথে একটা মেয়ে পড়ে। ও একটা ছেলের সাথে রিলেশনে ছিল।'
স্পৃহা চোখ বড় বড় করে বলল,
'এই বয়সেই? '
'আরে শোন না। সবটুকু শুনলে তোর চোখ কপালে উঠে যাবে। ছেলেটা ঐ মেয়েকে ছেড়ে চলে গিয়েছিল। তারপর অন্য একটা ছেলে মেয়ের লাইফে আসে। এখন আবার ঐ আগের ছেলেটা মেয়েটার লাইফে ফিরে আসতে চাইছে।'
স্পৃহা জীবনের দিকে তাকালো। জীবনকে খোঁচা দেওয়ার একটা সুযোগ পেয়ে গেছে সে। তোহা বলল,
'একবার চিন্তা কর আপু। এসব শুধু মুভিতে হতো। এখন তো চোখের সামনে এসব দেখছি। আমি তো বিশ্বাসই করতে পারছিলাম না কারো সাথে এমনটাও ঘটে।'
'বিশ্বাস না করার কি আছে? শুধু মুভিতে রিয়েল লাইফেও এমন হয়। তোর চোখের সামনেই তো আছে।'
কথাটা স্পৃহা জীবনকে উদেশ্য করে বলেছে। কিন্তু তোহা তা বুঝতে পারে নি। তোহা না বুঝলেও জীবন ঠিকই বুঝেছে। জীবনের মুখ কালো হয়ে গেল।
'রিয়েল লাইফেও একজন বৌকে ছেড়ে এক্স গার্লফ্রেন্ডের পেছনে ছুটে। দিনের পর দিন এক্সের জন্য বৌকে অবহেলা করে। এক সময়ে তো এক্সের জন্য বৌকে ছেড়ে দিতেও রাজি হয়ে যায়। আজকাল সবই সম্ভব রে বোন। আগে তো আমিও এসব বিশ্বাস করতাম না। কিন্তু এখন তো নিজের সাথেই 
বলতে বলতে স্পৃহা কথা ঘুরিয়ে ফেলল। 
'এখন তো নিজের চোখের সামনেই উদাহরণ আছে। তুই তো বললি মাত্র।'
'হুম। এখনকার ছেলে গুলো কাউকে মন ভালো বাসতেই পারে না। মন থেকে ভালোবাসলে কি ছেড়ে চলে যেতে পারতো? আর ছেড়ে চলে গিয়েছে ভালো কথা। এখন মেয়েটা অন্য একটা ছেলের সাথে ভালো আছে এটা তার সহ্য হচ্ছে না। এখন আবার সে ফিরে আসতে চাইছে। এই ছেলেগুলো যে কি চায় তা হয়তো তারা নিজেরাই জানে না। সব গুলো ক্যারেক্টারলেস।'
'ঠিকই বলেছিস।'
স্পৃহা তোহার কথায় মজা নিচ্ছে। জীবন চুপ করে ওদের কথা শুনছে। তার বলার মত কিছুই নেই। জীবন উঠে যেতে নিলে স্পৃহা বলল,
'আমি তো এমনও কিছু ছেলে দেখেছি যাদের সবাইকেই লাগবে। ঘরে বৌ লাগবে। বাইরে গার্লফ্রেন্ড লাগবে। তারা গাছেরও খাবে। আবার তলারও কুড়াবে। গার্লফ্রেন্ড চলে গেলে তাকে মানাতে ব্যস্ত হয়ে উঠবে। আবার বৌ চলে গেলে তাকে মানাতেও নানান কাহিনী করবে।'
জীবন আর দাঁড়াল না। এখানে দাঁড়ালে স্পৃহা খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে তার রাগ তুলে ফেলবে। মেয়েটা যা শুরু করেছে। 
স্পৃহা নিচে বিছানা করছে। জীবন রুমে এসে বিছানায় বসলে স্পৃহা আড়চোখে তাকে দেখে বলল,
'আপনি ফিরছেন কবে? '
জীবন বুঝতে না পেরে বলল,
'হ্যা? '
'জিজ্ঞেস করছি আপনি ঢাকা ফিরবেন কবে? '
'সেটা তো তুমি জানো। তুমি যেদিন যাবে আমিও সেদিন যাব। যতদিন তুমি না যাও ততদিন আমারও এখানে থাকতে কোনো সমস্যা নেই। এখন তুমি বলো তুমি কবে ফিরতে চাও?'
' আপনার আর নূপুরের কতদিনের রিলেশন ছিল?'
স্পৃহা শান্ত কন্ঠে এই প্রশ্ন শুনে জীবন হতবুদ্ধি হয়ে বলল,
'এ্যা?'
'আরে কতদিন একসাথে ছিলেন তা জানতে চেয়েছি।'
জীবন নিজেকে সামলে নিয়ে বলল,
'ছয় সাত মাসের মত একসাথে ছিলাম। কেন বলো তো?'
'নাহ ভাবছিলাম এতদিনের রিলেশন রেখে আমার কাছে থাকতে তো আপনার খুব কষ্ট হচ্ছে তাই না? নূপুরকে হয়তো মিস করছেন। ওর কথা মনে পড়ছে। তাই বলছিলাম আপনার মন চাইলে আপনি ফিরে যেতে পারেন। আমি আগেও যেমন কিছু বলিনি। এখনও কিছুই বলবো না। জোর করে কারো সাথে থাকার তো কোনো মানে হয় না।'
জীবন ভেবে পাচ্ছে না স্পৃহা হঠাৎ এসব কেন বলছে। আজ সকাল থেকেই স্পৃহা এমন করছে। গত দু'দিন তো ভালোই ছিল। আজ তার মাথায় এসব কথা আসলো কোত্থেকে? জীবনকে হতভম্ব অবস্থায় দেখে স্পৃহার বেশ মজা লাগছে। মনে মনে সো হেসে মরছে। 
'কি মিস্টার হাজবেন্ড। মজা লাগছে তো? আমার তো খুব মজা লাগছে আপনাকে খেপাতে। আপনার অসহায় মুখ দেখে প্রচুর হাসি পাচ্ছে।'
স্পৃহা গলা খাঁকারি দিয়ে বলল,
'এভাবেই বসে থাকবেন? আমি লাইট অফ করে দিচ্ছি কিন্তু। আপনার কিছু লাগলে বলতে পারেন। এনে দিচ্ছি। পানি খাবেন একটু? '
'না।'
'আচ্ছা তাহলে লাইট অফ করে দিচ্ছি। আমি আবার লাইট জ্বালিয়ে রেখে ঘুমাতে পারি না।'
স্পৃহা লাইট অফ করে মুখে বালিশ চাপা দিয়ে হাসছে। জীবন বোকার মতো এখনো ওভাবেই বসে আছে।

'অনেক হয়েছে স্পৃহা এবার বাসায় চলো। আমি তো আমার ভুল বুঝতে পেরেছি। তোমার কাছে ক্ষমাও চাইছি। তবুও কেন তুমি ফিরতে চাইছো না?'
স্পৃহা কিছু বলতে যাবে বাইরে থেকে তার মা ডাকলো। স্পৃহা মায়ের ডাকে চলে গেল। 
'হ্যাঁ মা কিছু বলবে? '
তানিয়া মেয়ের মাথা হাত রেখে বলল,
'মা রে আমি তো তোর মা। আমার কাছে তুই নিশ্চয়ই কিছু লুকাবি না।'
মায়ের কথা শুনে স্পৃহা চুপ করে আছে। মা হয়তো কিছু বুঝতে পেরেছে। 
'তোর আর জামাইয়ের মাঝে কি হয়েছে আমি জানি না। তবে তোকে দেখে এটুকু বুঝতে পারি তোদের মধ্যে সবকিছু ঠিক নেই। তুই এখানে এসেছিস দুই সপ্তাহ হয়েছে। এতদিনে একবারো তুই যাওয়ার নাম নিস নি। তুই এখানে আছিস বলে আমি কিছু মনে করছি না। এটা তোরই বাড়ি। তুই চাইলে সারাজীবন এখানে থাকতে পারিস। কিন্তু মা এখন তো তোর বিয়ে হয়ে গেছে। জীবন তোর স্বামী। তুই ওর সাথে যা করছিস তা কি ঠিক করছিল? ভেবে দেখ একটু ছেলেটা শুধুমাত্র তোর জন্য এখানে পড়ে আছে। আমি লক্ষ করেছি তুই ওর সাথে ভালোভাবে কথা বলিস না। কেন মা? তুই তো বড় হয়েছিস। সব বুঝিস। জেনে বুঝেও কেন স্বামীর সাথে সম্পর্ক খারাপ করছিস।'
স্পৃহা কি বলবে বুঝতে পারছে না। মা'কে সে সত্যিটা জানাতেও পারবে না। স্পৃহা মনে মনে বলল,
'মা তুমি জানো না। আমি এমনি এমনি উনার সাথে এসব করছি না। উনি আমাকে অনেক কষ্ট দিয়েছেন। আমার বিশ্বাস,আমার মন ভেঙে দিয়েছেন। প্রতি মুহূর্তে মনে হয়েছে উনি আমাকে দয়া দেখাচ্ছেন। আচ্ছা মা যে স্বামী স্ত্রীকে ছেড়ে দেওয়ার কথা বলতে পারে তার সাথে কীভাবে আমি ফিরে যাব। এতো সহজে কীভাবে তাকে ক্ষমা করে দিব?'
'স্পৃহা তুই আমার কথা বুঝেছিস তো? তোদের মধ্যে কোনো ভুল বোঝাবুঝি হলে তোরা সামনাসামনি কথা বলে তা মিটিয়ে নে। সমস্যা থেকে মুখ ফিরিয়ে নিলে তার সমাধান হয় না। তোরা একজন আরেকজনকে ইগনোর করলে তো কোনো সমস্যা সমাধান হবে না। জীবনের প্রতি তোর কোনো অভিযোগ থাকলে তুই তাকে খুলে বল। তুই না বললে তো জীবন তার ভুল বুঝতে পারবে না। তুই যথেষ্ট বুঝিস। আশাকরি আমার কথাগুলো তুই ভেবে দেখবি। আমি এখন স্কুলে যাচ্ছি। ফিরে এসে কথা হবে। '
মা চলে গেলে স্পৃহা স্তব্ধ হয়ে কিছুক্ষণ বসে রইলো। সে কি করবে তা ভাবছে। জীবনকে সে ভালোবাসে। তাকে একেবারে ছাড়ার কথা ভাবতেই পারে না। কিন্তু জীবনের দেওয়া কষ্টও এতো সহজে ভুলতে পারছে না। 

'শোনো স্পৃহা কাল আমরা ফিরে যাব।'
'আপনার ইচ্ছে হলে আপনি যান না, আমাকে জোর করছেন কেন? '
জীবন শান্ত গলায় বলল,
'তাহলে তুমি কি আমার সাথে ফিরবে না? '
'একবার বলেছি তো। না, ফিরবো না। '
'কেন জেদ করছো? তুমি তো আগে এতো জেদি ছিলে না। '
'আগে জেদি ছিলাম না। সহজসরল ছিলাম বলেই আপনি এতো কষ্ট দিতে পেরেছেন।'
জীবন নিচে স্পৃহার কাছে এসে ওর হাত ধরে বলল,
'বলেছি তো আমার ভুল হয়েছে। আগেও অনেকবার বলেছি। এই আবার বলছি আমাকে ক্ষমা করে দাও। সবকিছু ভুলে গিয়ে আমরা আবার নতুন করে শুরু করি। ফিরে চলো আমার সাথে।'
স্পৃহা ঝটকা মেরে হাত ছাড়িয়ে নিয়ে বলল,
'এতো সহজে কীভাবে ভুলে যাব বলুন তো? আপনি আমার সাথে যা যা করেছেন তা কি ভুলে যাওয়ার মত? নূপুরকে ফিরে পাবার জন্য আপনি আমাকে বিয়ে করেছেন। আমাকে আপনি ব্যবহার করেছেন। আমার মনের অবস্থা বোঝার চেষ্টা না করে আমাকে দিয়ে আপনার এক্সকে জেলাস ফিল করাতে চেষ্টা করেছেন। আমার হাজবেন্ড আমার থেকেও অন্য একটা মেয়েকে বেশি গুরুত্ব দেয় এটা আমি কীভাবে মেনে নিব বলুন তো। আমি মন থেকে আপনাকে ভালোবেসেছি। আর আপনি কি করেছেন? আমার সাথে নাটক করেছেন। এমনকি আপনি নূপুরকে দেখিয়ে প্রথম বারের মত আমাকে কাছে টেনে নিয়েছিলেন। আমার সাথে দিনের পর দিন মিথ্যা বলে গেছেন। '
'মানুষ ভুল করে। সে ভুল আবার শুধরেও নেয়। আমি মানছি আমিও ভুল করেছি। এখন আমি আমার ভুল শুধরে নিতে চাচ্ছি। তুমি কি আমাকে একটা সুযোগ দিবে না। কেউ ভুল করে তার ভুল বুঝতে পারলে তাকে একটা সুযোগ দিতে হয়। আমিও নিশ্চয়ই একটা সুযোগ পাবো। এই বার ক্ষমা করেই দেখো না। আর কখনো কোনো অভিযোগ করার সুযোগ দিব না।'
'মানুষ তার অজান্তে ভুল করলে তাকে ক্ষমা করা যায়। ভুল শুধরানোর জন্য তাকে আরেকটা সুযোগ দেওয়া যায়। কিন্তু কেউ জেনেশুনে ভুল করলে তাকে ক্ষমা করা যায় না। আর না সুযোগ দেওয়া যায়। আপনি জেনেবুঝে আমাকে চাল হিসেবে ব্যবহার করেছেন। অস্বীকার করতে পারবেন, আপনি আমাকে ব্যবহার করেন নি?'
স্পৃহার কথাগুলো শুনে জীবনের চোখ লাল হয়ে উঠছে। চোয়াল শক্ত হয়ে আসছে। জীবন স্পৃহার বাহু ধরে ঝাঁকিয়ে ঝাঁকিয়ে বলল, 
'কি বারবার এক কথা বলছো তুমি? তোমার সত্যিই মনে হয় আমি তোমাকে ব্যবহার করেছি? ব্যবহার করার মানে বুঝো তুমি? আমি তোমার হাজবেন্ড। ধর্মীয় নিয়ম মেনে সবাইকে সাক্ষী রেখে তিনবার কবুল করে আমি তোমাকে স্ত্রী হিসেবে গ্রহণ করেছি। তোমাকে ছোঁয়ার সম্পূর্ণ অধিকার আমার ছিল। তবুও আমি কোনদিন তোমার গায়ে হাত দেই নি। আমি চাইলেই তোমার সাথে ফিজিক্যাল রিলেশন করতে পারতাম। তুমি কিন্তু আমাকে আটকাতে পারতে না। কারণ তোমার উপর আমার অধিকার ছিল। আমি তোমাকে সম্মান দিয়েছি। তোমার ভালো খারাপের খেয়াল রেখেছি। এমনকি যখন আমাদের কোনো সম্পর্ক ছিল না। আমরা স্বামী স্ত্রী ছিলাম না। তখনও আমি তোমাকে বাঁচিয়েছি। সেদিন জঙ্গলে ঐ ছেলে গুলোর হাত থেকে তোমাকে না বাঁচালে আজ তোমার সাথে কি হতো, তুমি কোথায় কীভাবে থাকতে তা একবার ভেবে দেখেছো? তুমি যে বারবার বলছো আমি তোমাকে ব্যবহার করেছি। তা কি ঠিক স্পৃহা? আমি যদি তোমার সাথে সবকিছু করে এখন এসে নূপুরের জন্য তোমাকে মাঝ রাস্তায় একা ছেড়ে দিতাম। তাহলে তুমি বলতে পারতে আমি নূপুরকে পাওয়ার জন্য তোমাকে ব্যবহার করেছি। কিন্তু এখন তো আমি আমার ভুল বুঝতে পেরে সবকিছু ছেড়ে তোমার পেছনে ছুটে এসেছি। তবুও তুমি কীভাবে এই কথা গুলো বলতে পারছো। এতদিনে তুমি যদি আমার বাচ্চার মা হতে চলতে আর আমি তোমাকে ছেড়ে দিতাম তাহলে তুমি কিছু করতে পারতে? বলো। আমি কিন্তু তোমার কোনো ক্ষতি করিনি তবুও তোমার চোখে আজ আমি অপরাধী। কিন্তু স্পৃহা তুমি আমাকে যতটা খারাপ ভাবছো আমি কিন্তু ততটাও খারাপ না। বাংলাদেশে মেয়েদের ডিভোর্স হলে ৯০% ক্ষেত্রেই সমাজের মানুষ মেয়েদের দোষ দেয়। আমি চাইলেই তোমাকে ডিভোর্স দিয়ে নূপুরকে ফিরিয়ে নিতে পারতাম। আমি তা করিনি। কেন জানো? কারণ আমি তোমাকে সত্যিই খুব ভালোবাসি। সব কিছুতে আমার ভুল ছিল। আর তাই এতদিন মুখ বুঝে তুমি যা করেছ সব সহ্য করেছি। কিন্তু আজ তুমি যা যা বললে তারপর থেকে আমিই তোমাকে কখনো ক্ষমা করতে পারবো না। আমার সাথে তোমার ফিরে যেতে হবে না। তুমি এখানে থাকো। তবে কোনোদিন যদি বুঝতে পারো আমি মন থেকে তোমাকে ভালোবেসেছি তাহলে আমার কাছে ফিরে যেও। আমি সব সময় তোমার অপেক্ষায় থাকবো।'
জীবন রুম থেকে বেরিয়ে গেল। স্পৃহা পাথর হয়ে বসে আছে। সে সত্যিই জীবনকে কষ্ট দিয়ে ফেলেছে। খুব কষ্ট না পেলে জীবন এসব কথা কখনোই বলতো না। রাগ করে স্পৃহাকে ছেড়েও চলে যেত না। জীবনের কথাগুলো ভেবে স্পৃহার চোখ বেয়ে এমনি পানি পড়তে লাগলো। বাকিটা রাত আর স্পৃহা ঘুমাতে পারলো না। জীবন যে সেই বেরিয়ে গেছে রাতে আর রুমে ফিরেনি। স্পৃহা ভাবছে রাতেই কি জীবন ঢাকা ফিরে যাবে। আর ফিরে না গেলেও বাইরে কোথায় থাকবে?

সকালে জীবন ফিরে এসেছে স্পৃহার বাবা মা'র থেকে বিদায় নিয়ে ঢাকায় ফিরে আসার জন্য রওনা দিয়েছে। তানিয়া জীবনকে বললেন, 
'আজই চলে যাবে বাবা? আর কয়টা দিন থেকে যাও।'
'না মা। অফিসে ঝামেলা হয়ে গেছে। আজই ফিরে যেতে হবে। আমি আবার আসবো। আজ আসি।'
স্পৃহা দরজার কাছেই দাঁড়িয়ে ছিল। তবুও জীবন একবারো স্পৃহার দিকে তাকায় নি। চলে আসার আগে কিছু বলেও নি। জীবন চলে গেলে স্পৃহা রুমে গিয়ে কাঁদতে লাগলো, 
'খুব তো বলছিলেন আমাকে না নিয়ে ফিরবেন না। এখন আপনার কথার কি হলো? আমাকে রেখেই তো ফিরে গেলেন। আমি রাগ করে কি বলেছি না বলেছি তা নিয়ে আপনিও রাগ করে চলে গেলেন। এটাই আমার প্রতি আপনার ভালোবাসা,না?'
ঢাকায় ফিরে জীবন নিজের ফ্ল্যাটে যায় নি। সোজা অফিসে চলে গিয়েছিল। সারাদিন অফিসেই ছিল। বাসায় ফিরতে ইচ্ছে করছে না। স্পৃহা ফিরে নি। ও একা বাসায় গিয়েই বা কি করবে। তবুও রাতে বাসায় ফিরতে হলো। জীবন নিজের ফ্ল্যাটে এসে দেখে মেইন ডোর খোলা। অবাক হয়ে এক পা এক পা করে সে ভেতরে গেল। 
'বাসায় কে আছে? দরজা খোলা কেন? নিশ্চয়ই চোর ঢুকেছে।'
জীবন টেবিলের উপর থেকে ফুলদানিটা হাতে নিলো। কোথায় থেকে শব্দ আসছে সেদিকে কান পেতে আস্তে আস্তে এগিয়ে যাচ্ছে। রুমে গিয়ে স্পৃহাকে দেখে জীবন থ মেরে দাঁড়িয়ে গেল। স্পৃহা জীবনকে দেখে হেসে বলল,
'সারাদিন কোথায় ছিলেন আপনি? কতক্ষণ ধরে আপনার জন্য অপেক্ষা করছি জানেন? আপনার মাত্র আসার সময় হলো?'
জীবন কিছু বুঝতে পারছে না। স্পৃহা এখানে কোত্থেকে আসবে? জীবন তো স্পৃহাকে রেখে একা চলে এসেছিল। 
'কি হলো আপনার হাতে ওটা কেন? আমাকে চোর ডাকাত ভেবেছিলেন তাই না?'
স্পৃহা মুচকি হাসতে হাসতে জীবনের দিকে এগিয়ে এসে বলল,
'আপনি তো রাগ দেখিয়ে আমাকে রেখে চলে এলেন। একবারো ভাবলেন না আপনাকে ছাড়া আমি কীভাবে থাকবো।'
জীবন তোতলিয়ে বলল,
'তুমি এখানে? কীভাবে? কার সাথে এসেছ? কখনই বা আসলে?'
'এসেছি তো অনেক আগেই। জয় ভাইয়া গিয়ে নিয়ে এসেছে। বাসায় এসে আপনাকে পেলাম না। ভেবেছি অফিসে আছেন। তাই আর ফোন দিই নি। সারপ্রাইজ দিতে চেয়েছিলাম।'
জীবন স্পৃহার দিকে এগিয়ে তার কোমর জড়িয়ে ধরে বলল,
'আসবে তাহলে আমাকে ফিরিয়ে দিয়েছিলে কেন? তোমাকে রেখে একা চলে আসতে আমার কতটা কষ্ট হয়েছে জানো তুমি? '
'আপনি চলে আসার পর কষ্ট তো আমারও হয়েছিল।'
জীবন স্পৃহা ঘাড়ে আলতো করে চুমু দিয়ে বলল,
'রাগ কমেছে আমার বৌয়ের? '
স্পৃহা কেঁপে ওঠে মাথা নাড়িয়ে হ্যা বলল।
'আর কোনো অভিযোগ নেই তো? '
'না।'
'তাহলে এবার? '
স্পৃহা জীবনের দিকে ফিরে দাঁড়িয়ে ভ্রু কুচকালো।
'এখনো আলাদা রুমেই থাকবে নাকি? এই রুমে শিফট হবে না? '
'হুম। আগে আপনি ফ্রেশ হয়ে আসুন তারপর দেখা যাবে। '
'আমার তো আমাকে ছাড়তেই ইচ্ছে করছে না। এভাবেই দাঁড়িয়ে থাকতে মন চাইছে। '
স্পৃহা নাক কুঁচকে বলল,
'নিজের দিকে তাকিয়ে দেখেছেন একবার? ঘামে শার্ট ভিজে আছে। সারাদিন মনে হয় এভাবেই ছিলেন। যান তো আগে ফ্রেশ হয়ে আসুন। আমি তো আর কোথাও চলে যাচ্ছি না। এখানেই আছি। এবার আমাকে ছেড়ে ওয়াশরুমে যান।'
জীবন ওয়াশরুমে ঢুকে গেলে স্পৃহা একা একাই হেসে দিলো। তার সুখের সংসারে যেন আর কারো নজর না লাগে। অনেক বাধাবিপত্তি পেরিয়ে ওরা এক হয়েছে। জীবন আর স্পৃহার মধ্যে সব ভুল বোঝাবুঝি ভেঙে গেছে। 

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন