রংধনু - পর্ব ১০ - তাবাসসুম রিয়ানা - ধারাবাহিক গল্প


ধীর গতিতে দরজার সামনে এগিয়ে আসে বিভান।তারপর দরজার হাতল মুচড়ে দিতেই খুলে এলো দরজা।বিভান অপরপ্রান্তে হাঁপিয়ে উঠা বেলাকে দেখে আর অপেক্ষা না করে জড়িয়ে ধরলো।বেলা প্রস্তুত ছিলো না এমনটার জন্য।লোকটাও না কি একটু দম নিতে ও দিবেনা।বেলা ধরতে পারছেনা বিভানকে।বিভানের বুকে আলতো করে হাত ছুঁইয়ে বলল,

'' আমাকে প্রবেশ করতে দেবেন না রুমে?"

বিভান সরে এলো।তারপর রুমে আসতেই বেলাও রুমে এলো ধীর পায়ে।হাতে একটা কাপড়ের ব্যাগ।বিভান বেলাকে পুরো পর্যবেক্ষণ করে বলল,

''বেলা আপনি এখানে?এসময়ে?সব ঠিক আছে তো?"

বেলা মাথা নিচু করে আছে।ওর চোখজোড়া ভারি হয়ে এসেছে।গাল বেয়ে ফোঁটা ফোঁটা অশ্রু ধারা গড়িয়ে পড়ছে।বিভান বলল, 

''কি হলো বেলা?আপনি কাঁদছেন কেন?কেউ কিছু বলেছে?আজ তো বিয়ে আপনার।চলে এলেন যে?"

বেলা বিভান কে ধাক্কা দিয়ে একটু সরিয়ে সোফায় এসে বসলো।বিভান বেলার সামনে হতভম্ব হয়ে দাঁড়িয়ে আছে।বেলা ভাঙ্গা কন্ঠে বলল,

''একটু পানি খাওয়াবেন?"
''জি অবশ্যই। "

বিভান পানি ঢেলে বেলার কাছে নিয়ে আসার সময়ে ফোন বেজে উঠে বিভানের। বেলাকে পানি দিয়ে বলল,

''একটা কল পিক করতে হবে।পানি খেয়ে নিন।"

বেলা গ্লাস হাতে নিয়ে মাথা ঝাঁকিয়ে সম্মতি জানায়।বিভান বেডে বসে ফোন বের করে দেখলো কিরনের কল।বিভান ভ্রু কুঁচকে কল রিসিভ করে। অপরপাশ থেকে কিরন বলল,

''একেবারে ভুলেই গেলে দেখছি।"
''না ভুলিনি।কিভাবে ভুলবো বলো?তা কেমন আছো?"
''আলহামদুলিল্লাহ। তা বেলা এসেছে?"
''ওনি আসবেন তা কি করে জানো?"

বলে বেলার পানে চায় বিভান।মেয়েটা কাল রাতে যে কাপড় পরে এসেছিলো সেটাই পরে আছে।চুল গুলো খোঁপায় বাঁধা তারপর আশেপাশের ছোট চুল গুলো বাতাসে উড়ছে।বিভান চোখ সরালো না।অপরপাশ থেকে কিরন বলল,

''কই আছো সেটা আমিই বলেছি।নাহলে আসতে পারতো তোমার কাছে?"
''আমার কাছে এসেছে মানে?"
''তোমার কাছেই তো এলো বোকা ছেলে।সে পালিয়ে এসেছে ঘর থেকে।"
''হোয়াট?"

বেশ জোরে শুনা গেলো বিভানের কথা।বেলা অবাক হয়ে বিভানের দিকে তাকায়।বিভান কথা টা বলে বেলা কে একপলক দেখে নেয়।অপরপাশ থেকে কিরন বলল,

''হোয়াট কি আবার?বিয়ে করছেননা ওনি।"
''কেন?"
''আরে বিভান তুমি বুঝতে পারছোনা?"
''না কিছুই বুঝছিনা।"

বিভানের অপদস্থতায় বেলার ভীষন হাসি পাচ্ছে। লোকটাও না? কিছুই কি বুঝতে পারছেনা?তবে নিের কাজে বেলার ভীষন খারাপ লাগছে।কিভাবে পারলো পুরো পরিবারকে রেখে চলে আসতে?ওর বাবা মা ভাইবোন।সকালে চারটায় ঘুম ভেঙ্গে গেছিলো ওর।নামাজ পড়ে নেয় সাঁঝ আর ও।নামাজ পড়ে সাঁঝ শুয়ে পড়ে।বেলা বারান্দায় বসে থাকে কিছু সময়।মাথা কাজ করছেনা।কি করতে যাচ্ছে ও?পরিবারকে ঠঁকাবে কি করে?কিন্তু বিভান ওনাকে তো ভালবেসে ফেলেছে বেলা।কি করবে ও?ও যদি বিভানের কাছে চলেই যায় বাবা মা কি মেনে নেবে না?হয়ত সময় লাগবে কিন্তু মেনে নেবে।তারপর ও মন সাঁয় দিচ্ছে না ঘরের বড় মেয়ে ও।কিন্তু সাঁঝের কথাগুলো ও ফেলবার মতো নয়।বেলা চিন্তায় বিভোর।সময় চলে যাচ্ছে।বেলার চিন্তায় ভাঁটা পড়েনি।পাঁচটা বাজে।একটু পর সবাই উঠে যাবে।রুমে আসে বেলা একটা ব্যাগে প্রয়োজনীয় কাপড় চোপড় পাসপোর্ট নিয়ে নেয়।তারপর সাঁঝের দিকে তাকায়।একটা কাগজ আর কলম নিয়ে বসে বেলা।তারপর কিছু লিখে সাঁঝের পাশে এসে বসে।ডুকরে কেঁদে উঠে বোনের কপালে চুমু খায়।ফিসফিসিয়ে বলতে থাকে।

''সাঁঝ তোর কথা মেনে নিয়েছি।চলে যাচ্ছি আমি তার কাছে।আমাকে মাফ করে দিস পারলে।সবার খেয়াল রাখিস সোনা।"

তারপর উঠে বাবা মায়ের রুমে আসে।দুজনের পা স্পর্শ করে সালাম দিয়ে নিঃশব্দে কেঁদে ফেললো।তারপর বলতে থাকলো,

''মাফ করে দিয়েন আব্বা আম্মা।পারলে মেয়েটাকে মাফ করে দিয়েন।"

কুঞ্জন হুমায়রা আর লাবনী কে চুমু খেয়ে নিশাদের রুমে আসে বেলা।আদনান আর নিশাদ ঘুমুচ্ছে। বেলা খাটের পাশে ফ্লোরে বসে নিশাদ আদনান দুজনের হাত স্পর্শ করে।তারপর কিছু বলতে পারেনা।কান্না করে দেয়।বেলা আর অপেক্ষা না করে বেরিয়ে আসে।কিরনের নম্বরে কল দেয়।অপরপাশ থেকে ঘুমঘুম কন্ঠে কল রিসিভ করে কিরন।বেলা বলল,

''কিরন ভাই আমি বেলা।"
''জি বেলা বলো।"
''ভাই বিভান সাহেব কই থাকেন?"
''ধানমন্ডি অরনেট।কেন বেলা?"

বেলা সংকোচ না করে সব বলে দেয়।কিরন অনেকটাই অবাক।ও জানতো বিভান বেলাকে পছন্দ করে কিন্তু বেলা এতো বড় পাগলামী করবে তা ওর জানা ছিলো না।কিরন বলল,

''সত্যি ওর কাছে যাবে?"
''জি ভাইয়া?"
''তোমাকে এড্রেস পাঠাচ্ছি।চলে যাও।"
''জি ধন্যবাদ।"

বেলা কিরনের পাঠানো ঠিকানায় চলে আসে বিভানের কাছে।বিভান বেলার সামনে বসে আছে। বিশ্বাস হচ্ছেনা শ্যামবতী ওর কাছে চলে এসেছে।ওকে ও ভালবাসে ওর শ্যামবতী।বিভান কি বলবে ভেবে পাচ্ছিলোনা।বেলা আড়চোখে তাকায় বিভানের দিকে।বিভান বেলার দিকে একটু ঝুঁকে বলল,

''কেন এসেছেন বেলা?"
''ইদরীস কে বিয়ে করতে পারবোনা আমি।"
''শুধু এই কারনেই এসেছেন?আপনার বাবা কে বললেই বিয়ে আটকাতো।"

বেলার এখন রাগ হয়।লোকটার জন্য ও সব ছেড়ে এসে গেছে আর সেই কিনা বলছে বাবাকে বললে বিয়ে আটকাতো।
_________________________________________
রেগে উঠে দাঁড়ায় বেলা।তারপর কান্নার সুরে বলল,

''একদম ঠিক বলেছেন।বাবা মাকে বললেই তো বিয়ে ভাঙ্গতো।আসার দরকারই ছিলোনা।আমি গেলাম তাহলে।"

বেলা উঠে দাঁড়িয়ে চলে যাচ্ছিলো।বিভান হেসে বেলার হাত ধরে বলল,

''আরে ম্যাম কাজী আসার পর দুজনে গিয়ে সালাম করে আসবো।অতো রেগে যাচ্ছো কেন?"

বেলা অশ্রুসিক্ত চোখে বিভানের দিকে তাকায়।বিভান বলল,

''একটু পর কিরন কাজী নিয়ে আসছে।আপনি ফ্রেশ হয়ে নিন।"

বেলা কাঁদতে ছিলো।বিভান কাছে এসে বেলাকে বুকে টেনে নেয়।বেলা বিভানের বুকে গিয়ে কাঁদতে থাকে।একটু পর বিভান বলল, 

''বেলা আপনাকে তুমি করে বলতে পারি?মানে আমরা একে অপরকে ভালবাসি একটু পর বিয়ে ও হবে।" 

বেলা মলিন হেসে বলল,

''কখন না করলাম আমি?"
''তাহলে তুমিই বলবো।নাহলে বাবুরা এসে শুনবে ওদের পাপা মাম্মাকে আপনি করে বলছে।তখন ওরা কি মনে করবে?"

বেলা ভ্রু কুঁচকে বলল,

''এখানে বাবুটা আসলো কোথা থেকে?
''আমাদের একটু পর বিয়ে হবে তারপর খুব ভালবাসবো তোমাকে তারপর,,,,,,,,"

বিভানকে কথা শেষ করতে দিলোনা।বেলা মুখ চেপে ধরে বিভানের।তারপর হেসে বলল,

''নির্লজ্জ আপনি।চুপ থাকেন।বাজে কথা বলে।"

বিভান বেলার হাত সরিয়ে বলল,

''বাজে কেন?তোমাকে ভালবাসি খুব।"

বেলা হেসে বলল,

''সরুন ফ্রেশ হয়ে নেই।"
''যাও।"

বেলা ওয়াশরুমে গিয়ে ফ্রেশ হয়ে নেয়।একটা শাড়ী পরে বেরিয়ে আসে।বিভান মুগ্ধ চোখে বেলা কে দেখছে।বেলাকে জলপাই রং এর শাড়ীতে অপরুপ লাগছে।তারপর হঠাৎ কপাল কুঁচকে নেয় বিভান।বেলা এতক্ষন বিভানের সুন্দর হাসি মুখ টি দেখছিলো।হঠাৎ বিভানের কপাল কুঁচকানোয় অবাক হয়ে বলল,

''সব ঠিক আছে?"
''কিছু নেই।"
''কি নেই?"

বিভাব হেসে বেলার কাছে এসে বেলা কে ড্রেসিংটেবিলের সামনে বসিয়ে ওর মাথায় চুমু খেয়ে বেলার কাঁধে আলতো করে ঠোঁট ছুঁইয়ে দিতে থাকে।বেলার পুরো শরীর জমে গেছে।নড়ার শক্তি কই যেন হারিয়ে গেছে।এবার মাথা উঠায় বিভান।আয়নায় তাকিয়ে বেলার লজ্জা মাখা মুখ দেখে বলল,

''এখন ঠিক আছে।"

বেলা কিছু বলতে চাইলে বিভান বলল,

''ভালোবাসি।"
''আমিও ভালবাসি।"

বলেই মাথা নিচু করে নেয়।বিভান কিছু বলতে যাবে তখনই নক হয়।বিভান দরজা খুলে দেয়।এদিকে জুলেখা বানু দুধ জ্বাল দিয়েছে সবার জন্য।সকালে সবার জন্য দুধ জ্বাল দেয়।বেলার জন্য আজ বাদাম দিয়েছে।মেয়েটার বিয়ে চলে যাবে আজ।দুধ নেড়ে ওনি বেলার রুমে এসে ভাবলো থাক একটু পরে উঠানো যাবে ঘুমাক।বজ তো রেস্ট ও হবেনা মেয়েটার।
জুলেখা বানু সরে যায়।এদিকে দরজা খুলে বিভান কিরন আর কাজীকে দেখতে পায়।কিরন বলল,

''ঢুকতে দাও।"

বিভান সরে আসে।কাজী এসে সোফায় বসলো।বিভান বলল,

''আমার আরেকজন বন্ধু ও আসছে।সাক্ষী থাকবো আমরা।"

বেলা মাথা নিচু করে বসে আছে।সকাল দশটা।বেলার রুম থেকে কোন সাড়া শব্দ নেই।সাঁঝ ও বের হচ্ছেনা।জুলেখা বানু চিন্তায় পড়ে গেছে।অন্তত সাঁঝের উঠে যাওয়ার কথা ছিলো।সাঁঝকে ডাকার জন্য আবার রুমে এগুতেই দেখলো সাদা কাগজ দরজার নিচে।কাগজটি হাতে নেন জুলেখা বানু।নিশাদ ও উঠে ফ্রেশ হয়ে নিয়েছে।আজ বড় কর্মব্যাস্ত দিন যাবে ওদের।
এদিকে বেলা আর বিভানের বিয়ে পড়ানো হলো কিরনের বন্ধু আসার পর।বিভান বলল,

''সরি কিছু খাওয়াতে পারছিনা তোমাদের।এতো ঘটা করে বিয়েটা হলো।"

কিরন হেসে বলল,

''চিন্তা নেই।আর শুনো কিছু যেন না ভাঙ্গে।জরিমানা দিতে হবে কিন্তু।"
''কি বলো একমাসের বেশি আছি।এতোদিন ভাঙ্গি নাই।এখন ভাঙ্গবে কেন?"
''আরে এখন তখন এক না।বুঝলে? চলি আমরা?"

বিভান ফিসফিসিয়ে বলল,

''লাগামহীন কথা ছেলেটার।পাজি একটা।"

!!!!

প্রচন্ড জোরে চিৎকার করে কেঁদে উঠেন জুলেখা বানু।ওনার কান্নার শব্দে দৌড়ে এলো নিশাদ আর আদনান ঘুম ভাঙ্গলো ইকরাম রাহমানের।সবাই দৌড়ে এলো।সাঁঝ ও বেরিয়ে এসেছে।নিশাদ কিছুটা চিন্তিত মুখে জিজ্ঞেস করে,

''আম্মা কি হইছে?"

কাঁদছেন জুলেখা বানু।ইকরাম রাহমান রেগে বললেন,

''কি হলো?কাঁদো কেন?"
''বেলা চইলা গেছে।"

ইকরাম রাহমান অবাক।কি বলছে ওনার স্ত্রী?নিশাদ বলল,

''আম্মা কি বলো এসব?"

আদনান কাগজটা হাতে নিলো।জুলেখা বানু অঝোরে কাঁদতে থাকেন।আদনান চিঠিটা পড়তে শুরু করে।সেখানে লেখা ছিলো,
প্রথমত সবার কাছে মাফ চেয়ে নিচ্ছি।জানিনা কাজটা ঠিক কি ভুল করেছি।কিন্তু অনেক চিন্তা করে দেখলাম ভালবাসাহীন কোন সম্পর্কে জড়াতে পারিনা আমি।বিভানকে খুব ভালবাসি আমি।খুব দেরি করেই বুঝতে পেরেছিলাম। কিন্তু ওনাকে ছেড়ে আর কারোর সাথে থাকতে পারবোনা।ইদরীস লোকটা খুব খারাপ প্রকৃতির।সে আমাকে গৃহবন্দী করে রাখতে চেয়েছিলো।বিভান ভারতীয়। কিন্তু সে খুব ভালো।সত্যি আমাকে ভালবাসে।আমাকে মাফ করে দিও তোমরা।তোমাদের সবাইকে খুব ভালবাসি।খুব কষ্ট হয়েছে যেতে কিন্তু এতো বড় কোরবানী দিতে পারলাম না।আবার ক্ষমা চেয়ে নিচ্ছি।নিশাদ আদনান সাঁঝ কুঞ্জন লাবনী হুমায়রা কে নিয়ে ভাল থেকো আব্বা আম্মা।আমাদের জন্য দোয়া করো।
ইতি বেলা
ইকরাম রাহমান জ্ঞান হারিয়ে ফেলেন। নিশাদ বাবাকে ধরে আদনানের সাহায্যে খাটে শুইয়ে দিলো।সাঁঝ মনে মনে খুব খুশি।কিন্তু পরিবারের জন্য খারাপ লাগছে ওর।নিশাদ দৌড়ে বেরিয়ে গেলো ডাক্তার আনতে।আদনান বাবার মাথার কাছে বসে আছে।হুমায়রা বুঝতে পারছেনা কি হয়েছে।আপু কই জানে না ও?কখনো দেখা হবে কিনা তাও জানে না ও।জুলেখা বানু কেঁদেই যাচ্ছেন।মেয়ের এমন কর্মে লজ্জিত ওনি।সাঁঝ এক কোনায় দাঁড়িয়ে সব দেখছে।আপা ভালো থাকলেই হলো।পরিবার একসময় স্বাভাবিক হবে।আপা আর দুলাভাইকে ও মেনে নেবে সবাই।এদিকে কিরন যেতেই বিভান পিছনে ফিরে।বেলা মুচকি হাসছে নিচে তাকিয়ে।বিভান এগিয়ে আসে বেলার কাছে। তারপর বলল,

''আমার এখনো বিশ্বাস হচ্ছেনা যে তোমায় পেয়েছি।"

বেলার মুখ লজ্জায় লাল হয়ে আসে।বিভানের দিকে তাকিয়ে বলল,

''আপনার সামনেই আছি বিভান।"

বিভান বেলাকে নিয়ে খাটে বসলো।বেলার কান্না পাচ্ছে।কে জানে ওর বাবা মা কি করছে?ওর ভাইবোনেরা কেমন আছে?বেলা ডুকরে উঠে।বিভান বেলার দিকে পলকহীন ভাবে চেয়ে আছে।বেলা বলল,

''কিভাবে চলে আসলাম বিভান?বড় মেয়ে আমি।"
''সব ঠিক হয়ে যাবে।"
''লজ্জা করছে আমার।মুখ দেখাবো কি করে?"
''পাপ করিনি আমরা বেলা।ইসলামী শরীয়তে আমার স্ত্রী তুমি।এভাবে বিয়ে করা ঠিক হয়নি।তবে হয়ত নসিবে এমনটাই লেখা ছিলো।আমরা তোমাদের বাসায় যাবো মাফ চেয়ে নিবো।"

বেলা কাঁদতে কাঁদতে বলল,

''সাহস পাচ্ছিনা বিভান।"
''বেলা পরশুদিন যাবো।পরিস্থিতি তখন একটু হলে ও ঠান্ডা হবে।চিন্তা করোনা।তুমি বসো নাস্তার অর্ডার করছি।"

বেলা মাথা নেড়ে বলল, 

''একদমই মন চাইছেনা।আমার নিজেকে দোষী মনে হচ্ছে।"
''নিজেকে দোষী ভেবোনা বেলা।তুমি বসো আমি আসছি।"

বেলা বালিশে মাথা রেখে কাঁদতে থাকে।সবার কথা খুব মনে পড়ছে।আব্বা আম্মা ভাইবোন গুলো।বিভান ফোনে খাবার অর্ডার করতে গেছে।বেলার ঘুম পাচ্ছে খুব।সারাদিনের ক্লান্তিতে ওর ভীষন মাথা ভার হয়ে আছে।নিজের কাজে লজ্জিত বেলা।এমন টা না করলে পারতো না?কিন্তু বিভান কে তো পেতোনা।ও কি করে বিভান কে ছাড়া নিজের জীবনে অন্য কাউকে মেনে নিতো?বেলা আর কিছু ভাবতে পারেনা।ঘুমের আঁচলে নিজেকে সঁপে দেয়।এদিকে ফোনে কথা শেষ করে ফিরে এসে বেলা কে ঘুমন্ত অবস্থায় দেখতে পায় বিভান।একটু হেসে বেলার পাশে বিছানায় বসে।বেলার কপাল গাল হাতে আলতো করে ছোঁয় বিভান।বেলাকে বিয়ে করেছে ও কিছুক্ষন আগে।ওর স্ত্রী বেলা।বেলা কে ভীষন ভালবাসে ও।কখনো পাবে ভাবতেই পারেনি।বেলার গাল কপাল ভিজে আছে।বিভান উঠে এসি বাড়িয়ে দিয়ে বেলার গায়ে কম্বল টেনে দেয়।বেলার এবার যেন আরাম লাগছে।বিভান সোফায় বসে রইলো।নিজের ও খারাপ লাগছে।বেলার বাবা মা ওর ভাইবোনের কতোটা খারাপ লাগছে।হঠাৎ বেলার ফোন বেজে উঠে।বিভান দেখলো বেলার ফোনে নিশাদের কল। বিভান বুঝতে পারছেনা কি করবে।না পারছে কাঁটতে না পারছে ধরতে।বিভান কল টা দেখছে।কি করে ধরবে ও?এতক্ষনে হয়ত জেনে গেছে সবাই বেলা কোথায়।বিভান ফোনটাকে উল্টো করে রাখলো।একসময় নাস্তা ও চলে এলো।বিভান নাস্তা ঢেকে দিয়ে বেলার পাশে এসে শুয়ে পড়ে।তারপর কম্বলের একটা কোনা নিজের গায়ে দিয়ে বেলার হাতের ওপর খুব ধীরে হাত রাখতেই বেলা ওর বুকে মুখ গুঁজে দিলো।বিভানের কেমন লাগতে শুরু করে।একদম অন্যরকম অনুভূতি যার নাম ভালোবাসা।বিভান বেলার কপালে থুতনি ঠেঁকিয়ে চোখ বুজে নেয়।
এদিকে
বিকেলে ইকরাম রাহমান উঠে বসেন।ভীষন খারাপ লাগছে।লজ্জায় নিজের মাথা নত হয়ে গেছে।ঘরে বেলার মামা মামী আর কাজিনরা এসে গেছে।
_________________________________________
মামারা দুজনেই অবাক।তাদের জানামতে বেলা এমন কখনোই ছিলোনা।তাহলে কিভাবে করতে পারলো এমন টা?বড় মামা ইফতেখার এসে ইকরাম রাহমান কে বললেন,

''ইকরাম দেহো যা অইছে অহন তো বর পক্ষরে জানাইতেই অইবো।হেগোরে আওনের থাইক্কা মানা করতে অইবো।আদনান আর নিশাদ মেহমানগোরে মানা করতাছে।"

ইকরাম রাহমান ডুকরে কেঁদে উঠেন।বলেন,

''চিন্তা ও করতে পারিনাই বড় মাইয়া এমন করবে।এতো লজ্জা দিলো।"
''অহন কাইন্দা কি অইবো?আমনে কথা কন পোলার বাপের লগে।"

ইকরাম রাহমান চিন্তায় পড়ে যান কি বলবেন?কারন বদরুজ্জামান সাহেব কিভাবে নিবেন ওনার কথা কে জানে?তারপর ও জানাতে তো হবেই।ভেবেই কল দেন বদরুজ্জামানকে।
বেলার ঘুম ভাঙ্গে পৌনে পাঁচটায়।চোখ খুলে দেখলো পাশে সোফায় বসে আছে বিভান।বেলা চোখ মুছে বলল,

''ঘুমাননি আপনি?"
''হুম।কেন?"
''না এমনি।আমি ফ্রেশ হয়ে নেই।কটা বাজে?"
''৪.৪৫ বাজে।"
''ওহ এতো সময় হয়ে গেলো ডাকলেননা যে?"
''তোমাকে ডাকতে মন চাইলো না।"
''ওহ।আমি মুখ ধুয়ে আসি।"

বেলা বাথরুমে চলে যেতে থাকে।পিছন থেকে বিভান বলল,

''একটু জলদি করো।খিদে পেয়েছে খুব।"

বেলা পিছনে ফিরে অবাক কন্ঠে বলল,

''খাননি আপনি?"
''উহুম।ঐযে টেবিলে ব্রেকফাস্ট। "
''আপনি খান নাই কেন?"
''তুমি ঘুমাবে আর আমি একা খাবো?যা মুখ ধুয়ে আসো।লাঞ্চ করে আসি আমরা।"
''শিওর।"

বেলা বাথরুমে চলে গেলো।হাত মুখ ধুয়ে বেরিয়ে আসে ও।বিভান ধূসর বর্নের একটা শার্ট আর একটা জিন্স প্যান্ট পরে নিয়েছে।বেলা ভিতরে ঢুকে চুল খোঁপায় বাঁধতে শুরু করে আঁচড়ে।বিভান বেলার দিকে পলকহীন ভাবে তাকিয়ে থাকে কিছুক্ষন।নিশাদের কথাটা কি বলবে?বেলার কষ্ট হবে।তারপর ও বলতে হবেই।বিভান বেলার দিকে এগিয়ে আসে।বেলা চিরুনী রেখে পিছে ফিরে খেয়াল করলো বিভান ওর পাশে।বেলা মুচকি হাসলো।বিভান স্বাভাবিক কন্ঠে বলল,

''নিশাদের নম্বর থেকে কল এসেছিলো।"

বেলার মুখ খানা ফের মলিন হয়ে এলো।চোখের কোনে পানি চিকচিক করছে।ও ধরে আসা গলায় বলল,

''ধরেছিলেন?"
''না।কারন এখন ধরা ঠিক হবেনা। পরশুদিন গিয়েই কথা বলবো।এখন আমি যাই বলবো ওনারা বুঝবেননা।কারন এখন ওনারা রেগে আছেন জানামতে।"
''না ঠিক আছে বিভান।ঐদিনই কথা হবে।"

দুজনে নিচে নেমে আসে।ক্যাফেতে ঢুকে লাঞ্চের অর্ডার করতে গেলো বিভান।বেলা একটা চেয়ারে বসে পড়লো।আশেপাশে তাকাচ্ছে।রীতিমতো ভয়ে কাঁপছে ও।তখনই সাঁঝের কল এলো।
ইকরাম রাহমান প্রচন্ড রেগে ক্ষোভে ফেটে পড়েছেন।কিছুক্ষন আগে বদরুজ্জামানের সাথে কথা বলেছিলেন ওনি।
বদরুজ্জামান বলছিলেন,

''আপনারা এতো বড় ঠঁকবাজ হবেন জানা ছিলোনা।আপনার চরিত্রহীন মেয়েকে আমার ছেলের সাথে বিয়ে দিতে চেয়েছিলেন।আপনার কারনেই আমার সহজ সরল ছেলেটার কতো কষ্ট হচ্ছে।আপনার নষ্টা মেয়ের ভালো জীবনে ও হবেনা।একবার ও ভেবেছেন আমাদের মেহমানদের সামনে কতোটা অপমানিত হতে হবে।আসলে আপনারা ছোট লোক বুঝলেন।আমাদের টাকা দেখে আপনাদের মাথা গরম হয়ে গিয়েছিলো তাই চরিত্রহীন মেয়েকে বিয়ে দিতে চেয়েছেন।আপনারা নগন্য অসভ্য।আপনাদের ঘর বাড়িই কেমন ছিঃ!!!!এতো পুরান আমলের বাসায় কেমনে থাকেন?ভেবেছিলেন মেয়েকে বিয়ে দিয়ে নতুন বাসা পাবেন টাকা পয়সা পাবেন।দেখলেন আল্লাহ তা 'আলা যাই করেন ভালোর জন্যই করেন।ঠকবাজ প্রতারক!!!!"

বলেই কল কেঁটে দিয়েছিলেন।ইকরাম রাহমান কিছুই বলতে পারেননি।লজ্জায ক্ষোভে ওনার শরীর ফেঁটে যাচ্ছে।এদিকে সাঁঝ বোনকে কল দেয় রুমে এসে।বেলা কল রিসিভ করতেই সাঁঝ বলল,

''ভাল আছিস আপা?"
''আমার একদম শান্তি লাগছেনা।তোরা কি করিস?"
''আপা বাসার অবস্থা খারাপ।আব্বাকে ইদরীসের বাবা অপমান করেছে অনেক।আব্বা চিল্লাচিল্লি করছে।"

বেলার চোখজোড়া ভার হয়ে আসে।সাঁঝ বেলা অবাক করে ফিসফিস করে বলল,

''আপা পরে কল করছি।"
''কি হয়েছে?"

সাঁঝ কিছু না বলে কল কেঁটে দেয়।বিভান ফিরে আসে বেলার কাছে।বেলা চোখ মুছে নেয়।
বিভান এসে বেলার পাশে বসে বলল,

''এখন নাস্তা দেবে ওরা।লাঞ্চ নেই।"
''সমস্যা নেই।মাফ করবেন। আমার কারনে খেতে পারেননি আপনি।"
''সরি বলার কিছুই নেই।তোমার কাল ঘুম হয়নি তাই ঘুমিয়েছো।"

বেলা মাথা নিচু করে নেয়।কিছুক্ষন পর নাস্তা চলে আসে।বেলা খেতে পারছেনা কিছু।আসলে খাওয়ার ইচ্ছাই শেষ।বিভান খেয়াল করে বেলার প্লেটের সবই আছে।বেলার হাত আলতো করে স্পর্শ করে বিভান।বেলা ওর দিকে ভেজা চোখে তাকায়।বিভান কিছু না বলে প্লেটটা কাছে নিয়ে বেলাকে খাইয়ে দিতে শুরু করে।

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন