রংধনু - পর্ব ১৬ - তাবাসসুম রিয়ানা - ধারাবাহিক গল্প


লিফটের কোনা ঘেষে দাঁড়িয়ে আছে সাঁঝ।লোকটা অপর কোনায় দাঁড়িয়ে আছে।সাঁঝ ঘেমে একাকার হয়ে গেছে।আঙ্গুল দিয়ে নাকের ডগায় লেগে থাকা ঘামের কনা মুছে নিয়ে সামনের লোকটাকে দেখে।লোকটা ওর সামনে শার্টের কয়েকটা বোতাম খুলে একসাইড নেড়ে বাতাস করতে থাকে।সাঁঝ মাথা নিচু করে ফোনে সময় টা দেখে নিয়ে ফোনটা ব্যাগে রেখে দেয়।লোকটা সাঁঝের দিকে চেয়ে হঠাৎ বলল,

''আমি সাইমন আহমেদ রুদ।আপনার?"

সাঁঝ কিছু বলেনি তবে ভাবছে লোকটা হঠাৎ কথা বলতে শুরু করলো।কোন বাহানা না তো?সাঁঝ ভ্রু কুঁচকে সাইমনের দিকে চেয়ে আছে।সাঁঝকে চুপ দেখে সাইমন বলল,

''এই যে কিছু জিজ্ঞেস করলাম?"

সাইমনের ডাকে সাঁঝ চমকে উঠে।চোখজোড়ার পলক দ্রুত পড়তে থাকে ওর।সাইমন সাঁঝের চোখের পলক নড়তে দেখে বলল,

''আপনার চোখ দুটো খুব সুন্দর।একদম ডিমের মতো।"

সাঁঝ প্রচন্ড অবাক।লোকটার কথায় কি বলবে ভেবে পাচ্ছেনা।চোখ আবার ডিমের মতো হয়নাকি?সাঁঝের ভ্রু কুঁচকে এলো।গলায় তীব্র ঝাঁঝ এনে বলল,

''ফ্লার্ট করছেন। সাহস কম না আপনার।?"

সাইমন শয়তানি হাসি দিয়ে বলল,

''এখানে সাহস দেখানোর অধিকার আছে আমার।"

সাঁঝ রেগে গেলো।ওর মাথা জ্বলছে।লোকটা পেয়েছে কি?এতো ভাব দেখাচ্ছে যেন লিফট ওনার।সাঁঝ এবার তেড়ে এলো সাইমনের দিকে।লোকটা একদম পলকহীন ভাবে ওকে দেখছে।ঠোঁটে বাঁকা হাসি।সেটা উপেক্ষা করে সাঁঝ বলল,

''এমন ভাব দেখাচ্ছেন যেন লিফট আপনার।"

তাচ্ছিল্যের হাসি দিলো সাইমন।তবে কিছুই বলেনি।সাঁঝ সরে এলো সাইমনের থেকে।সাঁঝ ভয় পাচ্ছে। অনেকক্ষন হয়ে গেলো।লিফট ও খুলছেনা।সাঁঝের ভয় লাগছে ভীষন।সাইমনের মুখে হাসি।সে সিগারেট ধরিয়ে লম্বা টান দিয়ে বলল,

''ভীত লাগছে আপনাকে।"

সাঁঝ এবার ভাবলো ভয় পেলে চলবেনা।লোকটা সুযোগ পেয়ে ওকে হেনস্তা করার চেষ্টা করবে।সাঁঝ শক্ত গলায় বলল,

''একদম না।"
''সেটা আপনার কপালের ঘাম অশ্রু বলে দিচ্ছে।"

সাঁঝ চোখ মুছে নিয়ে চোখজোড়া বড় করে বলল, 

''দেখুন এবার।"

সাইমন তাকায়নি।সিগারেটে টানছে।মুখে হাসি টেনে বলল,

''হুম।লুকানোর চেষ্টা করছেন।মেয়েদের এ একটাই সমস্যা জানেন?"

এবারও তাকায়নি সাইমন সাঁঝের চোখে।সাঁঝ বলল,

''কি বলছেন?"
''হুম ঠিকই বলছি।"

বলে হাতের সিগারেট টাকে মুচড়ে নিভিয়ে বলল,

''আপনার ফোনের টর্চ জ্বালিয়ে দিন।আমার আবার নিজের ইজ্জতের চিন্তা আছে খুব।"

সাঁঝ খুব রেগে গেলো।চিৎকার করে বলল,

''কি বলতে চান?একবার বলেন মেয়েদের সমস্যা আছে।আবার নিজের ইজ্জত নিয়ে ভয় পাচ্ছেন?হাউ চিপ মাইন্ড!!"

সাইমনের ঠোঁটে হাসি।ও বলল,

''টর্চ জ্বালান।আপনাকে ভয় করছে আমার।"

সাঁঝ অজান্তেই তেড়ে এলো সাইমনের দিকে।ওর অনেকটাই কাছে এসে বলল,

''বেশি বাড়াবাড়ি করছেন।"

সাইমন সরে গেলো একটু।গ্লাসের সাথে ওর পিঠ আটকে আছে।তারপর বলল,

''একটু সরে দাঁড়ান। "

সাঁঝ খেয়াল করলো লোকটার খুব কাছে ও।ঝটকে সরে এলো।সাইমন বলল,

''টর্চ প্লিজ।"

সাঁঝ টচ জ্বালাতেই সাইমন ওর ফোনটা সাঁঝের হাত থেকে নিয়ে সাঁঝের মুখের দিকে ধরলো।সাঁঝ রেগে। লোকটা ওর ফোন নিয়ে নিলো।সাঁঝের রাগান্বিত মুখ দেখে মজা লাগছে সাইমনের।ও বলল,

''আপনি মেয়েটা খুব রোমান্টিক। "
''কি বাজে বকছেন।আমি রোমান্টিকের কি করলাম?"

তাচ্ছিল্যের সুরে বলল সাঁঝ।উড়নার একসাইড নেড়ে নিজেকে বাতাস করতে লাগলো।সাইমন লিফটে বসে বলল,

''বসুন।"
''লাগবেনা।"

সাইমন একটু নড়তেই লিফট ভয়নাক ভাবে নড়ে উঠতেই সাঁঝ ও বসে পড়ে।সাইমনের দিকে রেগে তাকাতেই ও বলল,

''রোমান্টিক কারন ঐ যে রেগে কাছে চলে এসেছিলেন।"
''এমন কিছুনা।"

সাইমন হেসে বলল,

''আপনার গলার কালো তিল।"

সাঁঝ রেগে গলায় উড়না টেনে বলল,

''লিফটে একা মেয়েকে পেয়ে লুচ্চামি করতে চাইছেন?লিফট একবার খুলে দিক বাড়িওয়ালা কে বিচার দিয়ে আপনাকে বাড়ি ছাড়া করবো।"

সাইমনের মুখের হাসি যেন যাচ্ছেইনা।ও বলল,

''কাকে বিচার দিয়ে কাকে বের করবেন ম্যাম?বাসা আমার জায়গা আমার,জমি আমার।আপনি আমাকে বিশ্বাস করতে পারছেননা।আসলে না করাটাই স্বাভাবিক।তবে এক সপ্তাহ আগে চলে যান।আপনাকে বাঁচিয়ে ছিলাম মিঃ সাহেদের হাত থেকে।আর আজ আমি আর আপনি লিফটে একা।আপনার ভয় হচ্ছে কিছু কি করে বসি নাকি আপনাকে?"

সাঁঝ এবার লজ্জা পেলো।এতটাসময় ওরা লিফটে কিন্তু লোকটা ওকে একদম উল্টাপাল্টা কিছু করেনি।বরং ওকে সাহায্য করার চেষ্টা করছে।ওর পা ব্যাথা করছিলো ওকে বসিয়েছে, ওর সময় কাঁটানোর জন্যই গল্প করছিলো।সাঁঝ ম্লান হাসে।সাইমন একবার সাঁঝের দিকে তাকিয়ে আরেকটা সিগারেট ধরায়।সাঁঝ বলল,

''আমি আসলে সরি।থ্যাংকস বলতে চেয়েছিলাম সেদিনকার জন্য।আসলে কারোর সাথে এভাবে এমন পরিস্থিতিতে পড়িনি।"

সাইমন লম্বাটান দিলো সিগারেটে। সেটার ধোঁয়া ছেড়ে বলল,

''আপনার হাঁপানি আছে।"

সাঁঝ লোকটার দিকে অবাক চোখে তাকায়।লিফটে এতক্ষনে ওর অজ্ঞান হয়ে পড়ে থাকার কথা।লোকটা কিভাবে জানলো?বেলা নাস্তা বানাচ্ছিলো।ওর সামনে এসে দাঁড়ায় সাজিয়া খালা।নাক শিটকে বলল,

''গোসল সেড়েছো? নাকি অপবিত্র গায়ে পাকঘরে ঢুকেছো?"

বেলার হাত থেমে যায়।রুটি গোল করায় ব্যাস্ত ছিলো ও।কিছুসময় থেমে আবার ও বেলতে থাকে।
_________________________________________
সাজিয়া খালা পাত্তা না পেয়ে বলল,

''খুব বেয়াদব তুমি।কথার উত্তর দিচ্ছো না।"

বেলার চোখে পানি।রুটি বেলছে এখনো।সাজিয়া খালা আবার ও বলেন,

''নাকি আমাদের ছেলে তোর নোংরা শরীর স্পর্শ ও করেনি।ইসস তোদের দেশে যা ময়লার গন্ধ!ওহ গড।আমার তো দম আটকে আসে।কিভাবে যে বিয়ে করলো বিভান?"

বেলা এবার থেমে গিয়ে বলল, 

''তাহলে আপনার নাস্তা বাহির থেকে অর্ডার করিয়ে দেই?আপনি তো আমার নোংরা হাতের নাস্তা খাবেননা তাইনা?"

সাজিয়া খালা চিৎকার করে কাঁদতে শুরু করেন।বেলা তাওয়ায় রুটি দিয়ে অবাক হয়ে থাকে।বিভান রুকমনী বন্দনা আখতার নেমে আসেন।সাজিয়া খালা বিভানকে ধরে বলেন, 

''আব্বু দেখ তোর বৌ আমাকে কি বলে?"

বিভান অবাক।ভ্রু কুঁচকে বেলার দিকে তাকায়।বেলার কপালে ক্লান্তির ছাপ।মুখে ভয় প্রকাশ পেয়েছে।সাজিয়া খালা বলেন,

''বিভান তোর বৌ আমারে কি বলে?কিছু বল তোর বৌকে?"

বন্দনা আখতার বললেন,

''কি বললি তুই বেলা?আমার বোনটা মাত্র এসেছে।কি বলেছিস তুই?"

সাজিয়া খালা বললেন,

''ও মিথ্যা বলবে।আমি বলছি।আমি বললাম ওকে সাহায্য করবো নাস্তা বানানোয়।আমাকে বলে আমাকে নাস্তা দিবেনা। বাহির থেকে কিনে এনে খেতে।"

বেলা অশ্রু জড়িত চোখে সাজিয়া খালাকে দেখে বলল, 

''এটা কি বললেন খালা?"
''তো কি বলবো?মিথ্যা বলিনি।"

বেলা কিছু বলতে গেলে বিভান বলল,

''চুপ থাকো বেলা। মা খালাকে নিয়ে যাও।"

বেলার হাত চেঁপে ধরে টেনে রুমে নিয়ে যেতে থাকে বিভান।বেলার অবাক লাগছে।লোকটাকি ওকে বিশ্বাস করতে পারছেনা?এই তের বছরের সংসারে বিশ্বাস করতে পারেনি?বেলাকে রুমে এনে ছেড়ে দিলো। তারপর খাটে বসে পড়লো বিভান।দুহাতে মাথা চেঁপে ধরলো।বেলা বিস্ফোরিত চোখে লোকটাকে দেখছে।কেন এমন করছে সে?বেলা বলল,

''বিশ্বাস করতে পারছেননা আমাকে?"

বেলার কথায় উঠে দাঁড়ায় বিভান।তারপর শক্ত গলায় বলল,

''বিশ্বাস করি বেলা।তবে চুপ থেকো খালা যতোদিন আছে।কথা শুনে সহ্য করার চেষ্টা করো।"

বেলা অবাক দৃষ্টিতে বিভানের দিকে চেয়ে বলল,

''আপনাকে চিনতে পারছিনা।তের বছর আগের বিভান আপনি নন।"

বিভান কিছু না বলে বেরিয়ে গেলো ফোন হাতে নিয়ে।বেলা খাটে এসে বসে বিভানের যাওয়ার দিকে চেয়ে রইলো।তার মানুষটা তাকে বিশ্বাস করতে পারেনি।সেদিন ঘরে ফিরতেই হুমায়রা এসে নিশাদের দিকে তোয়ালে এগিয়ে দিলো।নিশাদ বলল,

''আব্বা বাসায়?"
''হুম ভাইয়া।তোকে এতো টায়ার্ড লাগছে?"
''এমনিই।এক কাপ চা করে দিতে বল সাঁঝকে।"

নিশাদ সামনে এগুতে থাকলে পিছন থেকে হুমায়রা বলল,

''বুবু নাই বাসায়।"

নিশাদ পিছে ফিরে বলল,

''কই গেছে?"
''রিদ্ধি কে পড়াতে।"

নিশাদ ঘড়ি চেক করে বলল,

''এটাইমে যায় নাকি?"
''গেলো তো।"
''ওকে।তুই করে দে।চিনি ছাড়া।"
''জি ভাইয়া।"

নিশাদ রুমে এসে শার্ট প্যান্ট পাল্টে ফ্রেশ হয়ে খাটে বসে চিৎকার করে ডাকলো,

''লাবু কলিজা কই তুই?

লাবনী পড়ছিলো।পাশ থেকে মা বললেন,

''যারে লাবনী।তোর আহ্লাদের ভাই ডাকতেয়াছে।"
''আমারে না আম্মা।"
''তোরেই ডাকে যা।"

লাবনী ভাবলো ভাইয়া এভাবে ডাকেনা।তাহলে আজ কেন?লাবনী নিশাদের রুমে আসতেই নিশাদ বলল,

''এদিকে আয়।"

লাবনী ম্লান হেসে বলল,

''ভাইয়া তুই আমাকে এই নামে ডাকলি যে?"
''ডাকতে পারিনা?আমাদের সবার ছোট তুই।আচ্ছা আজ থেকে তোকে এভাবেই ডাকবো।"

লাবনী হেসে ভাইকে জড়িয়ে ধরে।নিশাদ বলল,

''হইছে অনেক আদর।পড়াশুনার কি খবর?সামনে মেট্রিক মনে আছে তো?"
''হুম ভাইয়া।"
''কুঞ্জন সব ক্লাশ করে?"

লাবনী কেমন চুপ হয়ে গেলো।তারপর হেসে বলল,

''করে ভাইয়া।"

এরই মধ্যে হুমায়রা চা বানিয়ে আনে।নিশাদ হুমায়রাকে উদ্দেশ্য করে জিজ্ঞেস করে,

''পরীক্ষা সামনের সপ্তাহে না?"
''জি ভাইয়া।"

চায়ের কাপ নিশাদের হাতে দিয়ে বলল হুমায়রা।চায়ের কাপে চুমুক দিয়ে নিশাদ বলল,

''কলম স্কেল পেন্সিল যা লাগবে লিস্ট বানিয়ে দিবি।একসাথে নিয়ে আসবো।"
''ওকে ভাইয়া।লাবনী পড়তে যা।"

বোনের কথায় লাবনী পড়তে চলে গেলো।নিশাদ বলল,

''সাঁঝ এলো না এখনো।"
''ভাইয়া হয়ত পড়াচ্ছে সময় নিয়ে।"

নিশাদ কাপ রেখে সাঁঝের নম্বরে কল দেয়।সাইমন লোকটা বেরিয়ে গেলো।লিফট থেকে। লিফট ছেড়ে দিতেই বেরিয়ে গেছিলো সে।সাঁঝ লোকটার যাওয়ার দিকে তাকাতে তাকাতে রিদ্ধিদের বাসার বেল চাপলো।

!!!!

সময়জ্ঞান বেশ ভালো আছে সাইমন আহমেদ রুদের।তবে লিফটে তার আধঘন্টা সময় টা যে কিভাবে কেঁটে গেলো বুঝতে পারছিলো না।লিফটে কতোটা সময় কাঁটিয়েছিলো জানে না ও।ঘরে ফিরতেই ভাবি নিপুন এসে বলেন,

''কিরে এতো ঘেমে গেছিস?কইছিলি?"

রুদ একটু হেসে বলল,

''লিফটে আটকে ছিলাম।ভাই কই?"
''তোর ভাই কাজে গেলো।এই লিফট টা নষ্ট জানিস তুই।অন্যটা দিয়ে আসতি।"
''ভাবি অন্যটা দিয়ে আসতে পারতাম।কিন্তু ভাড়াটিয়ারা আছে।কারোর প্রবলেম হতে পারে।মেকানিক ডাকে না কেন ভাই?"
''দেখো রুদ তুমি আমাকে ওসব বলো না।যা বলার সিয়াম কে বলো।"
''ভাই আগেই ঠিক করতো শুধু তোমার ঘ্যানঘানানি কমিয়ে আনো।তাহলে ঠিক হবে।নাহলে কারোর জান চলে যেতে পারে।"

কথা গুলো বলে চলে যাচ্ছিলো সাইমন।নিপুন খুব রেগে পিছন থেকে চিৎকার করে ডেকে উঠে,

''কি বলতে চাও তুমি?তোমার ভাইয়ের কান ভরি আমি?"

পিছনে ফিরে সাইমন।শার্টের হাতা গুটে নিতে নিতে বলল,

''ভাবি চিৎকার করে সত্যকে মিথ্যা বানাতে পারবেনা।আর আমার সামনে চিৎকার করবেনা। খুব ইরিটেশন হয়।"

বলে চলে যেতে নিয়ে আবার ও পিছে ফিরে রুদ।তারপর কি যেন ভেবে বলল,

''কফিটা যেন সবসময়কার মতো ঠান্ডা না হয়ে যায়।মাথাটা খুব ধরে আছে।রুমে পাঠিয়ে দিয়ো কফি।"

নিপুন কিছুই বলতে পারেনা।কারন এ জমির অর্ধেকের বেশির মালিক সাইমন।কারন সিয়াম বোকা সোকা।তার দ্বারা এতো বড় জমি কোম্পানি কোনটারই খেয়াল রাখা সম্ভব না।বর্তমানে সাইমন ওদের কোম্পানীর রক্ষনাবেক্ষন করছে।নিপুন রাগ সামলে কাজের লোককে দিয়ে কফি পাঠালো সাইমনের রুমে।আজ সিয়াম বুদ্ধিমান হলে সাইমন ওর সাথে এতোটা বেয়াদবি করতে পারতোনা।ঠিক ঠিক ওর জায়গা দেখিয়ে দিতে পারতো নিপুন।এদিকে সেদিন রাতে নিশাদ হুমায়রার বই গুলো দেখছিলো।হুমায়রা ভাইয়ের পাশে বসে আছে।গনিত বই দেখতে দেখতে নিশাদ বলল,

''তোর সিলেবাস কমপ্লিট?"
''জি ভাইয়া।"

নিশাদ বইটা ঘুরে ফিরে দেখতে থাকে।তারপর আবার ও জিজ্ঞেস করলো,

''সব সাবজেক্টের সিলেবাস কমপ্লিট?"
''জি ভাইয়া।সব রিভাইস চলছে।"
''আচ্ছা।ভালো মতো পড়াশুনা কর।ভাল ভার্সিটিতে ভর্তি হতে হবে।"

হুমায়রা কিছু বলেনি তবে মুচকি হাসলো।নিশাদ হুমায়রার রুম থেকে বেরিয়ে আসতেই ওর ফোন বেজে উঠে।রুমে এসে ফোন হাতে নেয় নিশাদ। ইমতিয়াজ কল করছে।খাটে বসে কল রিসিভ করে নিশাদ।অপরপাশ থেকে ইমতিয়াজ বলল,

''কিরে তোরে বললাম না ইদ্রিকে কম্পিউটার শিখাতে আসতে?"

নিশাদ কিছুটা ইতস্তত হয়ে বলল,

''আসলে আমি কিভাবে,,,,,,,?
''কিভাবে মানে?তুই কম্পিউটার ইঞ্জিনিয়ার। কিভাবে শিখাবি মানে কি?"
''নারে সেটা না।আসলে আমি তোদের ঘরে আসবো।বাসায় আঙ্কেল আন্টি ও আছে।আর আমার ও অফিস আছে। "
''ইটস ওকে।বাবা কিছুই মনে করবেনা।তুই নিশ্চিন্তে আসবি।আর তোর অফিসের সব ঝামেলা শেষ করে আসবি সমস্যা নেই। "

নিশাদ না করতে পারেনি।তবে ইদ্রি মেয়েটা ওকে ভীষন অস্বস্তিকর অবস্থায় ফেলেছিলো সেদিন।সামনে যে কি করে আবার?নিশাদকে চুপ দেখে ইমতিয়াজ বলল,

''কিরে বেটা কিছু বল?কবে আসবি?"
''কাল আটটায় আসি।"
''ওকে।ইদ্রি রেডি থাকবে তুই চলে আসিস।"
''হুম।"

নিশাদ বসে থাকে চিন্তিত মুখে।এদিকে সন্ধ্যায় ফিরে আসে বিভান।বেলা সবার নাস্তা রেডি করছিলো।পাকঘর থেকে বিভানকে দেখে কিছু বলতে পারেনা।বিভান আজ বেলাকে খুঁজেনি সরাসরি রুমে চলে গেছে।বেলা স্বামীর যাওয়ার দিকে কিছুক্ষন তাকিয়ে থেকে চুলা বন্ধ করে রুমে আসার জন্য প্রস্তুত হয়।সিড়ি বেয়ে উঠে এসে বিভানকে না পেয়ে বারান্দা আর বাথরুমে খুঁজে দেখলো তবে পায়নি।তারপর রুম থেকে বেরিয়ে এসে সিড়ির দিকে এগুচ্ছিলো।হঠাৎ পাশে চোখ পড়তে খেয়াল করলো মায়ের রুমে বিভান।কি যেন বলছে ও।তাই বেলা চুপচাপ নিচে নেমে এলো।
বিভান ঘরে ফিরে মায়ের রুমে এসেছে আজ।খালা আর মা দুজনেই ওর দিকে চেয়ে হাসে।বিভান মৃদু হেসে পকেট থেকে দুটো টিকিট বের করে খালার দিকে এগিয়ে দিয়ে বলল,

''এটা আপনার আর রুকমনীর।"

সাজিয়া হাসিমুখে টিকিট দুটো নিতে নিতে বলল,

''এগুলো কিসের টিকিট বাবা?"
''ইসলামাবাদ যাচ্ছেন কাল।সেটার প্লেনের টিকিট।"

প্রচন্ড অবাক সাজিয়া।টিকিটে চোখ বুলিয়ে ভাগীনার দিকে চেয়ে আছেন।বন্দনা আখতার বললেন,

''এগুলো কি বলছিস বিভান?"
''মা ঠিক বলছি।কাল খালার ফ্লাইট দুপুরে।"
''তোর খালা তো আরো কয়েকদিন থাকবে।"

বিভান মৃদু হেসে বলল,

''মা খালার চলে যাওয়া ভালো হবে।জনার সংসার আছে তাইনা?আর ইশান ভাইয়ের বিয়ে হয়েছে।ভাবি পরিস্কার থাকে নাকি সেটাতো খালার দেখার দায়িত্ব তাইনা?"

বিভানের কথা শুনে প্রচন্ড অবাক সাজিয়া খালা।বললেন,

''কি বলছিস বিভান।বৌয়ের পরিষ্কার থাকার দায়িত্ব আমি কেন নিবো?"
''আপনি শাশুড়ী না?সকালে গোসল করে কিনা সেটা আপনার জানতে হবে। যাই হোক খালা কাল হয়ত দেখা হবেনা।আমার অফিস আছে।আল্লাহ হাফেজ।আমি আসি।"

বলেই রুম থেকে বেরিয়ে আসে বিভান।বেলা নাস্তা রেডি করে সকলের রুমে পৌছে দিয়ে নিজেদেরটা রুমে নিয়ে এল।বিভান বসে আছে খাটে।বেলা পাকোড়া আর চা নিয়ে খাটে রেখে এক কোনায় বসে পড়ে।
________________________________________
ও হয়ত ভেবেছিলো লোকটা কিছু বলবে। কিন্তু সে নিজের মতো খেতে শুরু করেছে।বেলা চুপচাপ চায়ের কাপে চুমুক দিতে থাকে।বিভান আড় চোখে বেলাকে দেখে নেয়।সকালে ঘুম থেকে উঠে নিচে আসার সময় বেলা আর খালার কথোপকথন শুনতে পায় বিভান।ভীষন রাগ হয় ওর।বেলাকে যাচ্ছেতাই বলছিলো খালা।বেলা কিছু বলার পর খালার মিথ্যা অপবাদ বিভানকে অনেক বেশি অবাক করে।তাই বেলা কে রুমে নিয়ে এসেছিলো ও।বেলা যেন কিছু না বলে সেজন্য ও সতর্ক করে দিয়েছিলো।তবে বেলা যে ভীষন কষ্ট পেয়েছে তা জানে বিভান।তবে বেলাকে যেন আর অপমানিত হতে না হয় তাই কথা বলতে না করে বিভান।বিভান বেলার দিকে তাকিয়ে থাকে কিছুক্ষন।তারপর চা শেষ করে কাপড় চোপড় নিয়ে ফ্রেশ হতে চলে যায়।ফ্রেশ হয়ে এসে বেলাকে রুমে পায়নি বিভান। তাই কিছু কাজ নিয়ে বসে পড়েছিলো।ডিনার রেডি করে নেয় বেলা।সবাই নিচে এসে খেতে বসে।সাজিয়া খালা বেলাকে বলতে গিয়ে পাশে বিভানকে দেখে চুপ হয়ে যায়।বন্দনা আখতার ও ছেলের কাজে খুব অসন্তুষ্ট।দুজনেই রাগান্বিত চোখে বেলাকে দেখতে থাকে।খাওয়ার পর সব পরিষ্কার করে বেলা রুমে এসে দেখলো বিভান একপাশে শুয়ে পড়েছে।বেলা এসে ওর পাশে শোয়।প্রচন্ড নীরবতা গ্রাস করে আছে দুজনকে।বিভান বেলাকে একবার দেখে ধীরে বলল,

''আ'ম সরি বেলা।তখন এভাবে বলা ঠিক হয়নি।"

বেলা চুপ করে শুয়ে আছে।হাতের আঙ্গুলে শাড়ীর এক কোনা পেঁচিয়ে নিতে নিতে বলল,

''ইটস ওকে।"

বলেই অপরপাশ ফিরে ঘুমোতে গেলে বিভান ওর কাঁধে হাত রেখে থামায়।তারপর ওর কাঁধের চিবুক রেখে বলল,

''বেলা প্লিজ  রাগ করে থেকোনা।আমার সত্যিই কাজটা ঠিক হয়নি।"
''আমার ঘুম পাচ্ছে। ছাড়ুন আমাকে।"
''বেলা প্লিজ কথা শুনো আমার।"
''বিভান একটু সরে গিয়ে শুয়ে পড়ুন।আমার ভালো লাগছেনা।"

বেলার কথায় কিছু বলতে পারেনা বিভান। সরে গিয়ে শুয়ে পড়ে।
এদিকে পরদিন সকালে নিশাদ অফিসে যাওয়ার জন্য রেডি হয়।তখনই সাঁঝ নিশাদের রুমের সামনে এসে দাঁড়ায়।হাতে একটি শপিং ব্যাগ।নিশাদ পাশে তাকিয়ে বলল,

''ভিতরে আয়।"

সাঁঝ চুপচাপ ভিতরে এসে নিশাদের দিকে ব্যাগটি এগিয়ে বলল,

''ভাইয়া তোর জন্য।"

নিশাদ প্যাকেট হাতে নিয়ে বলল,

''কি এটা?"
''দেখ খুলে।"

নিশাদ প্যাকেটটি থেকে বেগুনী রং এর নতুন একটি শার্ট বের করে আনে।নিশাদ অবাক।ওর বেশ পছন্দ হয়েছে।সাঁঝ বলল,

''ভাইয়া কেমন হয়েছে?"
''তুই এতো টাকা খরচ করলি কেন?"
''ভাইয়া টাকার কথা কেন বলছিস?আমার বড় ভাইকে গিফট করতে পারিনা আমি?"
''তা পারিস।কিন্তু শার্টটা দামী মনে হচ্ছে।টাকা জমাতে পারিস না?"
''এরপর থেকে জমাবো। শার্টটা পরে দেখ। "

নিশাদের হেসে শার্টটা গায়ে জড়িয়ে নিয়ে বলল,

''খুব ভাল লাগছে সাঁঝ।"

সাঁঝ খুশি তে কেঁদে বলল,

''খুব ভাল লাগছে ভাইয়া।"

নিশাদ বোনকে বুকে টেনে নেয়।ওর ও যে চোখ ভরে এসেছে।সাঁঝকে সরিয়ে নিশাদ বলল,

''যা এক কাপ চা করে দে।"
''জি ভাইয়া।"

হাসি মুখে চলে যায় সাঁঝ।নিশাদ টেবিলে এসে বসতেই দেখলো আদনান শার্ট প্যান্ট পরে কোথাও যাওয়ার জন্য প্রস্তুত।নিশাদকে দেখে কিছু সময়ের জন্য থমকে গেলো আদনান। তারপর বলল,

''ভাই অনেক মানিয়েছে শার্টটা।কে আনলো?"
''সাঁঝ দিয়েছে।"

বলেই হাসে নিশাদ।ওর হাসি দেখে বুঝা যাচ্ছে কতো টা খুশি।আদনান বলল,

''বাহ কালার টা সুন্দর খুব।"
''হুম।তা কই যাস?"
''একটা ইন্টারভিউ আছে ভাই।"
''ওকে।কই সেটা?"
''ধানমন্ডির একটা অফিসে।আলমাসের পাশে।"

নিশাদ চুপ করে রইলো।আদনান বেরিয়ে পড়লো।জুলেখা বানু চিৎকার করছেন,

''কুঞ্জইননা কই তুই?খাইতে আয়।"

রুম থেকে কোন প্রকার জবাব আসেনি।নিশাদ খেয়াল করলো কুঞ্জন একদম চুপ করে খেতে বসেছে।আজ কাল বেশ চুপচাপ থাকে ও।একদম ফাজলামো করেনা আগের মতো।নিশাদ ভ্রু কুঁচকে ভাইকে দেখতে থাকে।এদিকে সকালে 
সাজিয়া খালা আর রুকমনী বের হওয়ার জন্য রেডি।বেলা ওদের দেখে অবাক।কারন এতো আগে যাওয়ার কথা ছিলোনা।তবে ব্যাপারটা পরিষ্কার করলেন খালা নিজেই।এসে বললেন,

''ঠিকই তো ভাগীনার কান ভরে দিলি।তোর কারনে ও আমাদের যেতে বাধ্য করেছে।"

বেলা বুঝতে পারেনি।বিভান কাজে যাওয়ার জন্য নিচে নামতে থাকে।আজ কিছুটা দেরি করে বেরিয়েছে।বিভান কে দেখে আর কিছু বলেননি খালা।বেলা চুপ করে ছিলো।যাওয়ার সময় রুকমনী বেলাকে বলল,

''জানো ভাবি কাল তোমাকে মা যা বলেছিলো সেজন্য ভাইয়া আমাদের জন্য টিকিট নিয়ে আসছে।"

বেলা অবাক চোখে রুকমনীর দিকে তাকিয়ে থাকে।তারপর বলল,

''আমি দুঃখিত। আমার কারনে তোমরা চলে যাচ্ছো।"
''ইটস ওকে ভাবি।ভাইয়া ঠিক করেছে একদম।আমি পরে এসে ঘুরে যাবো।"
''ঠিক আছে।"

ওরা বেরিয়ে গেলো।বিভান ব্যাগ ঠিক করে জুতা পরে বেলার দিকে তাকায়।বেলার চোখে পানি।লোকটা ওর জন্য এতো করলো।আর ও কাল কথাই বলেনি।বিভান বেলাকে টেনে ওর কপালে ঠোঁট ছুঁয়ে বলল,

''আসি। খেয়াল রেখো নিজের।"

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন