জীবনকে গাড়ি থেকে নামতে দেখে নূপুর ওর কাছে ছুটে এলো। নূপুর এসে জীবনকে জড়িয়ে ধরে বলতে লাগলো,
'আমি জানতাম জীবন তুমি আসবে। আমার কথা তুমি ফেলতে পারবে না। আমি তো জানি তুমি এখনো শুধু আমাকেই ভালোবাসো। তুমি চাইলেও কখনো আমাকে ভুলতে পারবে না। তুমি আমাকে এখনো ঠিক আগের মতই চাও।'
নূপুরের কথা শুনে জীবনের বিরক্ত লাগছে। সে নূপুরকে নিজের থেকে ছাড়িয়ে সোজা করে দাঁড় করিয়ে বলল,
'নিশ্চয়ই এসব বলার জন্য তুমি আমাকে এখানে ডাকো নি। তাই এসব বাজে কথা না বলে আসল কথা বলো। যে কথা জানার জন্য আমি এখানে এসেছি তা বলো।'
নূপুর মুখ কালো করে বলল,
'এসব বাজে কথা? আমি তোমাকে ভালোবাসি আর তুমিও আমাকে ভালোবাসো এই কথাটা কি বাজে কথা?'
'হ্যাঁ বাজে কথাই। এসব কথা শোনার মত সময় আমার কাছে নেই।'
'তুমি আমাকে ভালোবাসো না? '
'একসময় বাসতাম। কিন্তু এখন বাসি না। '
'জীবন! '
'আমার কথা শুনলে তুমি কষ্ট পাবে নূপুর। তাই বলছি কী বলার জন্য ডেকেছ তা বলো।'
জীবনের এই নতুন রূপ দেখে নূপুরের ভেতরটা ভেঙেচুরে চুরমার হয়ে যাচ্ছে। এটাই কি সেই জীবন? যে জীবন তাকে দেখার জন্য, তার সাথে কথা বলার জন্য পাগল হয়ে থাকতো। জীবন নূপুরকে এভাবে ভুলে যেতে পারলো? নূপুরের তো কোনো দোষ ছিল না। তবুও কেন তাকে এতো কষ্ট পেতে হচ্ছে।
জীবন বলল,
'নূপুর আমি বেশিক্ষণ থাকতে পারবো না। আমাকে যেতে হবে।'
জীবন কথা শেষ করার আগে নূপুর বলল,
'তোমার বৌ বাসায় তোমার জন্য অপেক্ষা করছে তাই তো? '
জীবন চুপ রইলো। নূপুর চেঁচিয়ে বলল,
'আমার সামনে ঐ মেয়েটার কথা বলতে তোমার খারাপ লাগছে না? আমার কষ্ট তুমি দেখতে পারছো না? আমি কোন অবস্থায় আছি একবার তা আন্দাজ করেছ জীবন?'
'তুমি তোমার কারনেই কষ্ট পাচ্ছ নূপুর। আমি তোমার অবস্থার কথা আন্দাজ করেছিলাম বলেই পরেরদিন তোমার কাছে ছুটে গিয়েছিলাম সত্য জানার জন্য। সেদিন তুমি আমাকে বিশ্বাস করো নি। আমার কাছে সবকিছু খুলে বলো নি। আমার হাত তুমি সেদিন ধরো নি। আমি তো বলেছিলাম হয়তো আমরা কাজী অফিসে গিয়ে বিয়ে করে সারাজীবনের জন্য এক হয়ে যাব। আর নয়তো তুমি আমার থেকে সবকিছু লুকিয়ে সারাজীবনের জন্য আমার থেকে দূরে চলে যাবে। আমি তোমাকে সুযোগ দিয়েছিলাম।'
নূপুর কাঁদছে। কাঁদতে কাঁদতে জীবনের হাত ধরে বলল,
'আমাকে আরেকটা সুযোগ দাও জীবন। আরেকবার আমাকে তোমার কাছে ফিরিয়ে নাও। আমি আর এসব সহ্য করতে পারছি না। ঐ মেয়েটার সাথে তোমাকে আর দেখতে পারছি না।'
'এখন আর কিছুই আগের মত নেই নূপুর। সবকিছু পাল্টে গেছে। তোমাকে ফিরিয়ে নেওয়া এখন আমার পক্ষে সম্ভব না।'
'কেন? তুমি কি আমাকে সত্যিই আর ভালোবাসো না?'
'আমি এখন অন্য একজনের হাজবেন্ড। তাকে আমি কথা দিয়েছি। কখনো তাকে ছেড়ে যাব না। তাকে কখনো কষ্ট দিব না।'
'আর আমাকে যে কথা দিয়েছিলে। তার কি হবে? সে কথাগুলো তুমি রাখবে না? '
'আমি আমার দেয়া কথা রাখতে চেয়েছিলাম। কিন্তু তুমি তোমার দেয়া কথা রাখো নি।'
'আমি তো আমার ভুল বুঝতে পেরেছি জীবন। তবুও কেন তুমি আমাকে ফিরিয়ে দিচ্ছ?'
'তোমার ভুল বুঝতে তুমি অনেক দেরি করে ফেলেছ।'
'তুমি কীভাবে এতো নিষ্ঠুর হতে পারছো জীবন? '
'নিষ্ঠুর না হলে যে অন্য একজনের সাথে অন্যায় হয়ে যাবে। বেইমানি করা হবে তার সাথে।'
'তুমি শুধু ঐ মেয়েটার কথাই ভাববে? '
'ঐ মেয়েটা আমার ওয়াইফ। ওর কথা ভাবা আমার কর্তব্য।'
'আর আমি তোমার কেউ না? '
'একসময় অনেক কিছু ছিলে। কিন্তু এখন,,,
জীবন থামলো। যত কিছুই হোক না কেন জীবন এখনো নূপুরের চোখের পানি সহ্য করতে পারছে না। তাই জীবন বলল,
'আসি নূপুর।'
নূপুর জীবনের হাত ছাড়ছে না। জীবন জোর করে তার হাত ছাড়িয়ে নিলো। জীবন ফিরে যেতে নিলে নূপুর পেছন থেকে বলল,
'তুমি জানতে চাইবে না কেন আমি তোমাকে দূরে ঠেলে দিয়েছিলাম। কোন কারণে তোমাকে নিজের থেকে দূরে সরিয়ে দিয়েছিলাম। তোমাকে ভালোবাসা স্বত্বেও কেন আমার তোমাকে ভুলে যেতে হয়েছিল।'
জীবন ফিরে তাকালো। বলল,
'কি হবে জেনে? কিছুই তো আর আগের মত হবে না। '
'না হলেও তোমাকে জানতে হবে। তুমি সত্যটা না জেনে আমাকে সারাজীবন দোষ দিয়ে যেতে পারবে না। আমি তোমার কথা ভেবেই, তোমার ভালোর জন্যেই তোমাকে ছাড়তে বাধ্য হয়েছিলাম।'
জীবন নূপুরের দিকে দু'পা এগিয়ে এসে বলল,
'মানে? '
'মানে আমি যদি ঐদিন তোমাকে ফিরিয়ে না দিতাম তাহলে আমি জীবনের জন্য তোমাকে হারিয়ে ফেলতাম। আমার থেকে দূরে থাকলেও আমি তোমাকে মাঝে মাঝে দেখতে পেতাম। কিন্তু আমার সাথে থাকলে হয়তো আর কখনো তোমাকে চোখের সামনে দেখতে পেতাম না।'
'কী বলতে চাইছো তুমি? '
'তোমার বড় আব্বু আনোয়ার হোসেন আমাকে ভয় দেখিয়েছিল। আমি যদি তোমাকে বিয়ে করতাম তাহলে উনি তোমাকে মেরে আমাকে বিধবা করে দিতো। উনার মেয়েও তোমাকে ভালোবাসে জীবন। উনি আমাকে বলেছিলেন, তুমি উনার মেয়ের না হলে অন্য কারো হতে পারবে না। উনি হতে দিবেন না। নিজের মেয়ের সুখের জন্য উনি তোমাকে খুনও করতে পারেন। আমি প্রথমে উনার কথা বিশ্বাস করিনি। আমি তো তোমাকে মন থেকে ভালোবেসে ছিলাম। একজনের মুখের কথায়, সামান্য ধমকে ভয় পেয়ে কীভাবে তোমাকে ছেড়ে দিতাম বলো? কিন্তু তুমি যেদিন বাইক অ্যাক্সিডেন্ট করলে। সেদিন রাতেও উনি আমায় ফোন দিয়ে বললেন ঐ অ্যাক্সিডেন্ট নাকি উনি করিয়েছেন। তা শুনে আমি অনেক ভয় পেয়ে গিয়েছিলাম জীবন। আমি তোমার থেকে দূরে সরে না আসলে উনি সত্যিই তোমাকে মেরে দিত। আমার জন্য তোমার কিছু হোক তা আমি কখনো চাইবো না।'
নূপুরের কথাগুলো শুনে জীবনের মাথায় যেন আকাশ ভেঙে পড়লো। নূপুর কী বলছে এসব? সব কিছুর পেছনে তাহলে বড় আব্বু দায়ী? বড় আব্বু জীবনের থেকে নূপুরকে দূর করে দিয়েছে।
'তুমি এসব কথা ঐদিন আমাকে কেন বললে না নূপুর?'
নূপুর কাঁদতে কাঁদতে বলল,
'আমি ভয় পেয়ে গিয়েছিলাম। ভেবে পাচ্ছিলাম না আমি কী করবো। তখন আমার যা ভালো মনে হয়েছে তাই করেছি। কিন্তু সত্য এটাই। আমি এখনো শুধু তোমাকেই ভালোবাসা জীবন। তোমাকে অন্য কারো সাথে আমি সহ্য করতে পারি না। তোমাকে যতবার ঐ মেয়ের সাথে দেখেছি ততবারই নিজেকে শেষ করে দিতে ইচ্ছে হয়েছে।'
নূপুর কাঁদতে কাঁদতে নিচে বসে পড়লো। জীবন ভেবে পাচ্ছে না সে এখন কী করবে? একদিকে নূপুর আর অন্যদিকে স্পৃহা। এখন সে কাকে রেখে কাকে ছাড়বে? নূপুরকে জীবন একসময় ভালোবাসতো। এখনো হয়তো মনের কোণে নূপুরের জন্য সামান্য অনুভূতি বাকি আছে। কিন্তু এখন তো সে স্পৃহার প্রতি দুর্বল হয়ে পরেছে। হয়তো সে স্পৃহাকে ভালোবাসে। এখন তার অনুভূতির সবটা জুড়ে স্পৃহাই বিরাজ করে। জীবন নূপুরের বাহু ধরে দাঁড় করালো। কাঁদতে কাঁদতে মেয়েটার কী অবস্থা হয়েছে। নূপুরকে এভাবে কাঁদতে দেখে জীবনেরও ভীষণ কষ্ট হচ্ছে।
'তুমি আমাকে দূরে ঠেলে দিও না জীবন। আমি তোমাকে ভালোবাসি। তুমি আমাকে নিজের কাছে ফিরিয়ে নাও। আমি তোমাকে ছাড়া অন্য কারো হতে পারবো না। আমি রায়হানকে বিয়ে করবো না। তুমি সবকিছু আবার আগের মত করে দাও জীবন। তোমাকে ছাড়া আমি সত্যিই বাঁচতে পারবো না।'
নূপুর জীবনকে জড়িয়ে ধরে কেঁদে কেঁদে কথাগুলো বলছে। জীবন তার মাথায় হাত রেখে বলল,
'শান্ত হও নূপুর। আমি সব ঠিক করে দিব। কিন্তু তার আগে একজনের সাথে আমার কিছু হিসাব মিলাতে হবে। ঐ লোকটা কেন আমাদের সাথে এমন করলো তার জবাব চাই। আমি ওকে এতো সহজে ছাড়বো না।'
রাগে জীবনের মাথা ফেটে যাচ্ছে। সবকিছু উলটপালট করে দিতে ইচ্ছে করছে। সবকিছু শুনে জীবন নূপুরের উপরও আর রাগ করতে পারছে না। নূপুর তো তার কথা ভেবেই এসব করেছে। জীবন নূপুরকে গাড়িতে বসালো। এখন নূপুরকে ওর বাসায় নামিয়ে দিয়ে বড় আব্বুর কাছে যাবে। গাড়িতে গোলাপের তোড়া আর শাড়ি গহনা দেখে নূপুর আরো কাঁদতে লাগলো। জীবন তা বুঝতে পেরেও কিছু বলল না।
'জীবন তুমি আমাকে ছেড়ে চলে গেলে আমি বেঁচে থাকতে পারবো না। তুমি শুধু আমার। তুমি অন্য কারো হতে পারবে না। তুমি তো আমাকে ভালোবাসো। তুমি আমাকে এত সহজে ভুলে যেতে পারবে?'
জীবনের চোখ আগুন লাল হয়ে আছে। কপালের রগগুলো ধপধপ করছে। জীবন চোখের সামনে সবকিছু অন্ধকার দেখছে। বারবার স্পৃহার মুখটা তার চোখের সামনে ভেসে উঠছে। নূপুরকে নামিয়ে দিয়ে জীবন সোজা বড় আব্বু বাসায় গেল। বড় আব্বুর নাম ধরে ডাকতে ডাকতে ভেতরে ঢুকলো,
'আনোয়ার হোসেন! আনোয়ার হোসেন! কোথায় তুমি? বেরিয়ে এসো আমার সামনে।'
জীবনের মুখে নিজের বড় আব্বুর নাম শুনে ফরিদার বুক কেঁপে উঠলো। উনি কখনো জীবনকে এই রূপে দেখে নি। এখন জীবনকে যেন একটা হিংস্র বাঘের মত লাগছে। আনোয়ার হোসেন স্টাডি রুমে ছিলেন। জীবন সেখানে গিয়ে উনার কলার ধরে টেনে চেয়ার থেকে তুলে দাঁড় করিয়ে বলল,
'আমার জীবন নিয়ে খেলার সাহস কি করে হয় তোমার? তুমি কোন সাহসে আমার সাথে এমনটা করেছো? উত্তর দাও। কেন করলে তুমি এরকম? '
জীবন উনাকে ঝাঁকিয়ে ঝাঁকিয়ে কথাগুলো বলছে। ফরিদা পেছনে এসে দাঁড়িয়ে এই দৃশ্য দেখে চেঁচিয়ে বললেন,
'জীবন! তুই কি পাগল হয়ে গেছিস? কি করছিস এসব তুই। তুই তোর বড় আব্বুর নাম ধরে ডাকছিস! ওর কলার চেপে ধরেছিস!'
জীবন আজ বড় আম্মুকেও পরোয়া করলো না। সেও ধমকে বলল,
'আমার আর এই লোকটার মাঝে আজ কেউ আসবে না। তুমিও না বড় আম্মু। ওর সাথে আমার অনেক হিসেব বাকি আছে। ও আমার সাথে কতটা নোংরা খেল খেলেছে তা তুমি জানো না। এই ছোট মনের লোকটা কাউকে সুখী দেখতে পারে না। আমার জীবনটা ও এলোমেলো করে দিয়েছে। আমার থেকে সব সুখ কেড়ে নিয়েছে। আমাকে এমন একটা পরিস্থিতির মুখে এনে দাঁড় করিয়ে, এখন আমি কি করবো তা ভেবে পাচ্ছি না। তোমার স্বামীর জন্য তিনটা মানুষের জীবন নষ্ট হওয়ার পথে।'
ফরিদা আর কিছু বলতে পারলেন না। জীবন আবার বলল,
'চুপ করে আছো কেন আনোয়ার হোসেন। কথা বলো। আমার প্রশ্নের উত্তর দাও। তুমি কেন তোমার ক্যারেক্টারলেস মেয়ের জন্য নূপুরকে আমার থেকে দূর করে দিলে? আমি তো সব সময় বলে এসেছি, আমি আরশিকে বিয়ে করবো না। তবুও কেন তুমি এমন করলে। তোমার ঐ চাল বুঝতে না পেরে নূপুরের থেকে প্রতিশোধ নেওয়ার জন্য আমি স্পৃহাকে বিয়ে করেছি। তুমি কি কখনো অন্যের ভালো দেখতে পারো না? নিজের স্বার্থটাই তোমার কাছে সবকিছু? তুমি আমার বাবার আপন ভাই হয়েও আমার বাবা মারা যাবার একমাস পর উনার অর্ধেক বিজনেস নিজের করে নিলে। তা জেনেও আমি চুপ থেকেছি। তোমাকে কিচ্ছু বলিনি। বড় আম্মু তোমার সব খবরই জানতো। আর তাই সব সময় বড় আম্মু আমাকে অফিসে বসার জন্য জোর করতো। আমি সব জেনেবুঝেও কখনো তোমাকে বা বড় আম্মুকে কিছু বুঝতে দিই নি। তুমি আমার বিজনেস,প্রপার্টি সব নিজের করে নিতে। তবুও আমাকে নিয়ে এই নোংরা খেলায় না নামতে। আরশিকে তুমি কেন আমার সাথে বিয়ে দিতে চাও তা কি আমি জানি না? তুমি কীভাবে এতটা নিচে নামতে পারো? ধনসম্পত্তির জন্য নিজের মেয়েকে ব্যবহার করতেও তোমার বিবেকে বাধলো না? এসবের জন্যই রামিম ভাইয়া তোমাদের ছেড়ে চলে গেছে। রামিম ভাইয়া ঠিকই বলেছিল স্বার্থের জন্য তুমি সব করতে পারো।'
জীবন আনোয়ার হোসেনের কলার ছেড়ে দিয়ে ফরিদার দিকে তাকিয়ে অসহায় গলায় বলল,
'তুমি বলতে পারবে বড় আম্মু, তোমার স্বামী কেন আমার জীবন নিয়ে খেলছে? ও কী চায় আমার কাছে? আমি কী দোষ করেছিলাম? কেন আমার জন্য দু'টা মেয়ে কষ্ট পাবে? নূপুর স্পৃহা কেউ তো ওর কোনো ক্ষতি করে নি। তবুও ওরা এই লোকটার নোংরা খেলার অংশ হয়ে প্রতিটা মুহূর্তে কষ্ট পাচ্ছে।'
ফরিদা জীবনের দিকে তাকিয়ে কাঁদছে। জীবন বলল,
'ওকে আজ আমি এতো সহজে ছাড়তাম না। আজ আমি ভুলে যেতাম ও আমার বাবার বড় ভাই। কিন্তু তোমার জন্য আমি ওকে কিছুই করতে পারলাম না। আমি সব সহ্য করতে পারলেও তোমার চোখে পানি সহ্য করতে পারবো না বড় আম্মু। এই লোকটা তোমার জীবনও নষ্ট করে দিয়েছে। তুমি কেন এতো বছর ধরে একে সহ্য করে যাচ্ছ? কেন এর থেকে আলাদা হয়ে যাচ্ছ না? এই ছোট লোকটা তোমার যোগ্য না বড় আম্মু।'
জীবন বেরিয়ে গেল। শুধু বড় আম্মুর জন্যই সে বড় আব্বুকে কিছু করতে পারে না। জীবন সব সময় দেখে এসেছে এই লোকটা এমনই। ওর বাবা বেঁচে থাকতে যখন কোম্পানিতে তিন লাখ টাকা চুরি হয়। তখনও তার বাবা বড় আব্বুকে কিছু বলেনি। সব জেনেও তিনি চুপ ছিলেন। জীবন ঐদিনের পর থেকেই তার বাবার কথা মনে করে কখনো বড় আব্বুকে কিছু বলেনি। দিনের পর দিন উনি সবার চোখের সামনেই অন্যায় করে গেছেন।
জীবন এখন কি করবে বুঝতে পারছে না। আজ সে স্পৃহাকে তার ভালোবাসার কথা বলতো। স্পৃহাকে নিজের করে নিতো। কিন্তু এখন স্পৃহাকে আপন করে নিয়ে নূপুরকে কীভাবে দূরে ঠেলে দিবে? এসবে নূপুরেরও তো কোনো দোষ নেই। জীবন তো নূপুরকেও কষ্ট দিতে পারবে না।
অনেক রাত হয়ে গেলেও জীবন বাসায় ফিরছে না। এদিকে জীবনের টেনশনে স্পৃহার হাত পা ঠান্ডা হয়ে যাচ্ছে। স্পৃহা ঘড়ির দিকে তাকালো রাত বারোটার উপরে বাজে। স্পৃহা দরজার সামনে পায়চারি করছে। তার কাছে মনে হচ্ছে এই বুঝি জীবন চলে আসবে।
'উনি এখনো বাইরে কি করছেন? কোনোদিনও তো এতো দেরি করেন না। আজ এতো দেরি হচ্ছে কেন? বারোটা বাজে এখনো ফেরার নাম নেই। কি করবো আমি? কাকে ফোন দিব? উনার ফোনও তো অফ আসছে।'
স্পৃহা কী করবে ভেবে পাচ্ছে না। এর আগে জীবন কোনোদিন এতো দেরি করে ফিরে নি।
'আজ যাবার সময় উনি তো বলেছিলেন তাড়াতাড়ি ফিরে আসবেন। সারপ্রাইজের কথাও কি যেন বলছিল। কোথায় নিয়ে যাবার জন্য আমাকে রেডি হয়ে থাকতে বলেছিলেন।'
স্পৃহা একবার রুমে যাচ্ছে আবার বাইরে আসছে। জীবন গাড়ি থেকে সবগুলো গোলাপের তোড়া ছুড়ে ফেলে দিল। শাড়ির প্যাকেটটা হাতে নিয়ে ফেলে দিতে গিয়েও রেখে দিলো। গাড়িতে কয়েকটা লাথি আর ঘুষি দিয়ে একটু দূরে গিয়ে দাঁড়াল। সিগারেট জ্বালিয়ে জীবন ভাবছে এখন সে কি করবে।
'স্পৃহা বাসায় আমার জন্য অপেক্ষা করছে। নূপুরও আমার জন্য কষ্ট পাচ্ছে। এখন আমি স্পৃহাকে ভালোবাসি। কিন্তু নূপুর আমার প্রথম ভালোবাসা ছিল। আমি কাকে সুখে রাখতে যেয়ে কাকে কষ্ট দিব? একদিকে নূপুর অন্যদিকে স্পৃহা। আমি এখন কাকে বেছে নিব। যা হয়েছে তাতে নূপুরেরও কোনো দোষ নেই। সে কেন কষ্ট পাবে? স্পৃহাকে আমি নিজের ইচ্ছায় বিয়ে করেছি। তাকেও বা আমি কীভাবে কষ্ট দিব?'
জীবনের মাথা এলোমেলো হয়ে যাচ্ছে। সে সত্যিই বুঝতে পারছে না এখন তার কি করা উচিত। জীবন গাড়ি নিয়ে বেরিয়ে পড়লো ঠিকই কিন্তু বাসায় ফিরে এলো না।
স্পৃহা না খেয়ে জীবনের জন্য অপেক্ষা করছিল। মেইন দরজার সামনে কিছুক্ষণ পায়চারি করছে। তারপর দরজায় হেলান দিয়ে বসে কখন এখানে ঘুমিয়ে গেছে সে জানে না।
একটার দিকে কলিং বেল বাজলে রামিম এসে দরজা খুলে। এতো রাতে জীবনকে এই অবস্থায় দেখে রামিম হতভম্ব হয়ে গেল। জীবন ঠিকমত দাঁড়াতে পারছে না। তার পা টলছে। চোখ লাল টকটকে হয়ে আছে। মাথার চুল গুলো এলোমেলো। গলার টাই ঢিলে হয়ে অর্ধেক খুলে গেছে। কপালে বিন্দু বিন্দু ঘাম। শার্ট ভেজা। রামিম এগিয়ে এসে জীবনকে ধরে বলল,
'তোর এই অবস্থা কেন? জীবন তুই ড্রিঙ্কস করেছিস? এই অবস্থায় এখানে কীভাবে এলি?'
জীবন অস্পষ্ট করে কি যেন বলছে। রামিম তার কথা কিছু বুঝতে পারছে না। জীবনের মুখ থেকে মদের গন্ধ আসছে। রামিম বলল,
'এই ছেলেটার কি হয়েছে আজ! ও নেশা করেছে? ওকে তো জোর করেও ড্রিঙ্ক করানো যেত না। আজ তাহলে এসব কেন করেছে? আর এতো রাতে আমার বাসায় কোত্থেকে এলো? স্পৃহা জানে জীবন কোথায় আছে?'
প্রভার ঘুম ভেঙে যাবার আগে রামিম জীবনকে রুমে নিয়ে গিয়ে শুইয়ে দিলো। শার্ট চেঞ্জ করে দিলো। রামিম জীবনকে পাশে বসে আছে। সে ভেবে পাচ্ছে হঠাৎ জীবনের কি হয়েছে।
'আজ দুপুরেই তো ওর সাথে কথা হলো। তখন তো বলছিল আজ নাকি স্পৃহাকে প্রপোজ করবে। দুপুরে হাসি খুশিই তো লাগছিল। এই কয়েক ঘন্টার ভেতর কি এমন হয়ে গেল। জীবন আজ হঠাৎ এমন পাগলামি কেন করলো?'
জীবন মনে হয় ঘুমিয়ে পড়েছে। রামিম আর কিছুক্ষণ জীবনের পাশে বসে থেকে। ঘর অন্ধকার করে দিয়ে বেরিয়ে গেল। তার মনে একটা চিন্তা লেগেই আছে।
সকালে জীবনের চোখ খুললে সে আস্তে আস্তে উঠে বসলো। মাথাটা ভারি ভারি লাগছে। উঠে বসতেও কষ্ট হচ্ছে। রামিম একটা গ্লাস হাতে নিয়ে রুমে ঢুকতে ঢুকতে বলল,
'উঠে গেছিস?'
জীবন মাথায় হাত দিয়ে বলল,
'হুম। '
'কেমন আছিস এখন?'
'মাথাটা প্রচন্ড ব্যথা করছে। সোজা হয়ে বসতেও পারছি না।'
'লাইফে প্রথম বার ড্রিঙ্কস করেছিস। মাথা তো একটু ভার লাগবেই।'
রামিম হাতে থাকা গ্লাসটা জীবনের দিকে এগিয়ে দিয়ে বলল,
'নে লেবু পানিটা খেয়ে নে। মাথা ব্যথা কমে যাবে।'
জীবন গ্লাস নিলো। তার কাল রাতের কথা মনে পড়ে গেল। সারারাত সে এখানে ছিল। তাহলে স্পৃহা কি একা বাসায় আছে? জীবন রাতে ফিরে নি স্পৃহা হয়তো তার জন্য টেনশন করছে। একা একা মেয়েটা ভয় পায় নি তো? রামিম বলল,
'কোন ভাবনায় ডুবে আছিস? পানিটুকু খা। না খেলে মাথা ভার কমবে না।'
জীবন এক ঢোঁকে গ্লাসের অর্ধেক পানি শেষ করলো। রামিম তার পাশে বসে বলল,
'কি হয়েছিল কাল?'
'হ্যা? '
'জিজ্ঞেস করেছি কাল রাতে কি হয়েছিল? কোনোদিনও তো তুই ড্রিঙ্ক করিস না। তাহলে কাল রাতে কার পাল্লায় পড়ে ড্রিঙ্ক করেছিস। আর রাতে মাতাল হয়ে নিজের বাসায় না গিয়ে আমার বাসায় এসেছিস কেন? তুই এখানে সেটা স্পৃহা জানে?'
'না।'
'না মানে? মেয়েটা টেনশন করবে না? তুই কাল বাসায় যাসনি কেন?'
'পরে সব বলবো। তার আগে এখন আমি বাসায় ফিরবো। স্পৃহা একা আছে।'
'যাবি কিন্তু কি হয়েছিল তা বলে যাবি তো নাকি? '
জীবন উঠতে উঠতে বলল,
'পরে সময় করে সব বলবো ভাইয়া। এখন যাই।'
জীবন চলে গেলে রামিম দরজার সামনে দাঁড়িয়ে ভাবছে,
'জীবনের সাথে এসব ঘটার পেছনে যদি বাবার হাত থাকে তাহলে এবার খুব খারাপ হয়ে যাবে। জীবনের সাথে আর কোনো অন্যায় আমি সহ্য করবো না। '
স্পৃহা ফ্লোরে শুয়ে ছিল। ঘুম ভাঙলে সে উঠে বসে। ফোনটা পাশেই পড়ে আছে। স্পৃহা ফোন হাতে নিয়ে দেখলো।
'সাড়ে সাতটা বাজে!'
স্পৃহা জীবনের রুমের দিকে তাকালো। দরজা লাগানো।
'তার মানে উনি এখনো ফিরেন নি? লোকটা কোথায় চলে গেলেন? আমাকে কিছু না জানিয়ে উনি তো কখনো বাইরে রাত কাটাবেন না। উনি খুব ভাল করেই জানেন আমি বাসায় একা আছি। তাহলে কি উনার কিছু হয়েছে? '
ভাবতে ভাবতেই কলিং বেল বেজে উঠলো। জীবন এসেছে ভেবে স্পৃহা দৌঁড়ে গেল। দরজা খুলে দিয়ে সামনে জীবনকে দেখলে পেল। জীবন কপালে হাত রেখে দেয়ালে ধরে দাঁড়িয়ে ছিল। স্পৃহাকে দেখা মাত্রই তার বুকে ছ্যাত করে উঠলো। মেয়েটা নিশ্চয়ই রাতে ঠিকমত ঘুমায় নি। সারারাত হয়তো তার জন্য অপেক্ষা করে জেগে ছিল।
জীবনকে চোখের সামনে দেখে স্পৃহার চিন্তা কিছুটা কমলো। জীবনের ফ্যাকাশে মুখ, এলোমেলো চুপ আর লাল চোখ দেখে স্পৃহা বলল,
'কোথায় ছিলেন আপনি? রাতে বাসায় ফিরেন নি কেন? আপনি জানেন আপনার জন্য আমার কতটা টেনশন হয়েছে? আপনি ফোনও অফ করে রেখেছিলেন।'
জীবন ক্লান্ত গলায় বলল,
'আমি এখন রুমে যাব স্পৃহা। '
জীবন স্পৃহাকে পাশ কাটিয়ে রুমে চলে গেল। স্পৃহা হঠাৎ জীবনের এমন অদ্ভুত ব্যবহার দেখে অবাক হয়ে তাকিয়ে রইলো।
'হঠাৎ করে কি হলো উনার? কাল পর্যন্ত তো ভালোই ছিলেন। আমার সাথে ভালো করে কথা বলছিলেন। আমাকে জোর করে খালামণির বাসা থেকে নিয়ে এলেন। সকালেও তো
স্পৃহা থেমে গিয়ে গালে হাত রাখলো। আজ সকালের ঘটনার পর স্পৃহা ভেবেছিল জীবন হয়তো তার সাথে স্বাভাবিক হয়ে গেছে। তাকে মেনে নিতে শুরু করেছে। কিন্তু এখন তো তার কাছে সবকিছুই উল্টো লাগছে। মনে হচ্ছে তার সামনে এটা অন্য কোনো জীবন চলে এসেছে। যে তার সাথে ভালো করে কথাও বললো না। তার কোনো প্রশ্নের উত্তর না দিয়ে তাকে এড়িয়ে গেল।
জীবন রুমে গিয়ে দুই হাতে মাথা চেপে ধরে বিছানায় বসে পড়লো। মাথাটা ছিড়ে যাচ্ছে। স্পৃহা জীবনের রুমের সামনে এসে দাঁড়াল। নক করবে কিনা ভাবছে।
'আসবো? '
জীবন স্পৃহার দিকে তাকালো। মাথা থেকে হাত নামিয়ে নিয়ে বলল,
'হুম। '
স্পৃহা ভয়ে ভয়ে ভেতরে এসেছে। সে ভাবছে অফিসে হয়তো কোনো ঝামেলা হয়েছে তাই জীবন রেগে আছে।
'আপনি ঠিক আছেন? '
'হুম।'
'আপনার অফিসে কি কোনো ঝামেলা হয়েছে? '
জীবন আবার একপলক স্পৃহার দিকে তাকালো। বলল,
'না।'
'আপনাকে চিন্তিত লাগছে। তাই জিজ্ঞেস করলাম।'
স্পৃহা একটু থেমে ইতস্তত করে জিজ্ঞেস করলো,
'রাতে আপনি কোথায় ছিলেন?'
কথাটা বলে স্পৃহা মাথা নিচু করে নিয়েছে। ভেবেছে তার এই কথায় জীবন হয়তো রাগ করবে। কিন্তু জীবন রাগ করলো না। সে শান্ত কন্ঠে বলল,
'স্পৃহা মাথাটা ছিড়ে যাচ্ছে। আমি এখন শাওয়ার নিব।'
জীবন উঠে ওয়াশরুমে চলে গেল। স্পৃহা এবারও ছলছল চোখে অবাক হয়ে দাঁড়িয়ে আছে।
'কি হয়েছে মানুষটার? এমন করছেন কেন? কোনো সমস্যা থাকলে আমাকে বলতে পারতেন। উনি আমাকে এভাবে এড়িয়ে যাচ্ছেন কেন?'
জীবন ঝর্ণার নিচে দাঁড়িয়ে আছে। স্পৃহাকে সে যত দেখছে ততই কষ্ট হচ্ছে। জীবন কি করে এই মেয়েটাকে কষ্ট দিবে? জীবন জানে সে এখন স্পৃহাকেই ভালোবাসে। কিন্তু নূপুরের প্রতিও তো তার একটা টান আছে। তার প্রতিও তো অবিচার করতে পারবে না। নূপুরও তো শুধু জীবনকেই ভালোবেসেছে।
স্পৃহা মুখে পানি দিয়ে রান্না করতে চলে গেল। জীবন রাতে কী খেয়েছে না খেয়েছে।
জীবন গোসল সেরে এসে ঘুম দিলো। স্পৃহা তাকে ডাকতে এসে দেখে জীবন ঘুমিয়ে আছে। স্পৃহা আর তাকে ডাকলো না। জীবনের মাথার পাশে বসে ভাবছে,
'সারারাত কোথায় ছিলেন? ফিরেই সকাল সকাল গোসল করলেন। এখন আবার না খেয়ে ঘুমিয়ে গেলেন।'