বাসায় এসে গাড়ি থেকে নেমেও কেউ কিছু বলে নি। লিফটে দাঁড়িয়েও দু'জন দু'দিকে তাকিয়ে রয়েছে। জীবনের হাতে শপিং ব্যাগ। স্পৃহা ওড়না নিয়ে আঙুলে পেঁচাচ্ছে। ওদের এপার্টমেন্টে এসে স্পৃহা ওর রুমে চলে গেল। জীবন দু'হাতে শপিং ব্যাগ নিয়ে দাঁড়িয়ে মাথা কাত করে নিজের সাথেই কথা বলছে,
'এগুলো দিয়ে আমি কি করবো?'
'তুই কি করবি মানে? তোর মেয়েকে পরাবি।'
'আমার মেয়ে কোত্থেকে আসবে?'
'কোত্থেকে আসবে তা তুই জানিস। একটু আগে স্পৃহাকে তো তাই বললি।'
'দূর ওটাতো মুখ ফসকে বেরিয়ে গেছে।'
'মুখ ফসকে বেরিয়ে গেলেও তুই কিন্তু কথাটা খারাপ বলিস নি। তোর আর স্পৃহার একটা মেয়ে হলে ভালোই হবে, বল?'
জীবন হাত থেকে ব্যাগ ফেলে দিয়ে কান চেপে ধরে বল,
'দূর হ তুই। মাথার ভেতর বসে আজেবাজে কথা ভাবছিস।'
মাগরিবের নামাজ পড়েই ওরা বাসা থেকে বের হয়ে গেল। বের হবার একটু পরেই বৃষ্টি শুরু হয়ে গেল। জীবন বলল,
'এই অসময়ে আবার বৃষ্টি কেন রে বাবা!'
জানালার কাঁচ তুলে দিলো জীবন। স্পৃহা বৃষ্টি দেখছিল জীবনের এই কাজে তার বৃষ্টি দেখায় ব্যাঘাত ঘটলো। স্পৃহার মুখে বিরক্তির ছাপ স্পষ্ট ভেবে উঠেছে। পুরো রাস্তায় দু'জন চুপ করেই রয়েছিল। এবার স্পৃহা জীবনের দিকে ফিরে বলল,
'কাঁচটা নামান না।'
জীবন আড়চোখে একবার স্পৃহাকে দেখে কিছু না বলে কাঁচ নামিয়ে দিলো। স্পৃহা উঁকি দিয়ে বাইরে বৃষ্টি দেখছে। কিছুক্ষণ পর সে বাইরে হাত বাড়িয়ে দিলে জীবন স্পৃহা হাত ধরে টেনে ধমকে বলল,
'কি করছো হ্যা? বাইরে হাত দিচ্ছো কেন? ঠান্ডা জ্বর বাধানোর ইচ্ছে আছে নাকি? চুপচাপ বসে থাকো।'
জীবন আবার কাঁচ তুলে দিলো। স্পৃহা মুখ কালো করে মাথা নিচু করে বসে রইলো।সে এখনো জানে না ওরা কোথায় যাচ্ছে। পৌছুতে পৌছুতে বৃষ্টি থেমে গেছে। তবে আকাশের অবস্থা ভালো না। মনে হচ্ছে রাতে আবার বৃষ্টি নামলেও নামতে পারে। রায়হানদের বাড়ির সামনে এসে জীবন গাড়ি দাঁড় করালো। স্পৃহার দিকে তাকিয়ে বলল,
'নামো এবার।'
স্পৃহা সীটবেল্ট খুলতে নিয়েও পারছে না। কিন্তু সে জেদ করে জীবনকে কিছু বলছেও না।
'কি হলো? সীটবেল্ট খুলতে পারছো না? '
স্পৃহা কিছু না বললেও জীবন ঠিক বুঝতে পারছে।
'দাঁড়াও ওটা টানাটানি করে খুলতে পারবে না।'
কথাটা বলেই জীবন স্পৃহার দিকে ঝুঁকে এসে সীটবেল্ট খুলতে লাগলো। হঠাৎ জীবন স্পৃহার এতটা কাছে চলে এসেছে যে স্পৃহার দম বন্ধ হয়ে যাবার উপক্রম হলো। সে শক্ত করে দু'চোখ বুঁজে নিলো। স্পৃহার বুকের ভেতরের ধুকপুক শব্দ জীবন স্পষ্ট শুনতে পাচ্ছে। স্পৃহার গরম নিঃশ্বাস তার ঘাড়ের উপর পড়ছে। এই অবস্থায় আর কিছুক্ষণ থাকলে নিশ্চয়ই তার দ্বারা ভুল কিছু হয়ে যাবে। তাই জীবন তাড়াতাড়ি করে সীটবেল্ট খুলে দিয়ে স্পৃহার থেকে সরে এসে বলল,
'চলো।'
জীবন গাড়ি থেকে নেমে গেল। স্পৃহা চোখ খুলে বুক ভরে শ্বাস নিয়ে আস্তে করে বলল,
'আল্লাহ নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে যাচ্ছিল। আর কিছুক্ষণ এভাবে থাকলে মরেই যেতাম।'
রায়হান জীবন আর স্পৃহাকে ফ্যামিলির সবার সাথে পরিচয় করিয়ে দেয়। জীবন চারিদিকে ভাল করে দেখে নিয়ে মনে মনে বলল,
'যার জন্য এখানে আসা তাকেই তো দেখতে পাচ্ছি না। ও আসেনি নাকি? ড্যাম! নূপুর না এলে আমাদের এখানে আসাই বৃথা।'
বলা শেষ করে পেছন ফিরতেই দেখতে পেল নূপুর বাবু কোলে নিয়ে একজন মহিলার সাথে আসছে। নূপুরকে দেখে জীবন হাসলো। নূপুরের চোখ জীবনের উপর পড়লে সে ঠাঁই দাঁড়িয়ে গেল। স্পৃহা রায়হানের মায়ের সাথে কথা বলছিল। এখানে এসেই সে একটা ধাক্কা খেয়েছে। জীবন তাকে নিয়ে রায়হানের বাসায় কেন এসেছে? এখন নূপুরকে দেখে আরো বড় ধাক্কা খেল। এখন তার কাছে সব পরিষ্কার হয়ে গেছে। জীবন তাকে ব্যবহার করে নূপুরকে কষ্ট দিচ্ছে? আসার সময় স্পৃহার মন যতটা ভাল ছিল। এখানে ঠিক ততটাই মন খারাপ হয়েছে। ওরা এলে রায়হানের মা নূপুরের সাথে স্পৃহার পরিচয় করালেন।
'এ হচ্ছে আমার ছোট ছেলের বৌ। এখনো অবশ্য ওদের বিয়ে হয়নি। কিন্তু আংটি বদল হয়েছে।'
উনার কথাতেই স্পৃহার নূপুরের কাছ থেকে বাবু নিজের কোলে নিলো। স্পৃহা এখন না পারছে কাঁদতে। আর না পারলে নিজেকে সামলাতে। জীবন কেন এমন করছে তার সাথে?
রাতে সবাই একসাথে ডিনার সেরেছে। নূপুরের খাওয়া শেষ হয়ে গেলে সে উঠে যাবার সময় হাতের ধাক্কা লেগে ডালের বাটি স্পৃহার উপর পড়ে যায়।
'সরি সরি আমি দেখতে পারিনি। ইশ স্পৃহা তোমার শাড়ি তো পুরো নষ্ট হয়ে গেছে। চলো তোমাকে ওয়াশরুমে নিয়ে যাই। আমি সত্যিই খেয়াল করিনি। দুঃখিত বোন।'
জীবন বুঝতে পারছে না নূপুর এটা ইচ্ছে করে করেছে কিনা। কিন্তু নূপুরের এই কান্ডে তার সত্যিই রাগ লাগছে। জীবন উঠে দাঁড়িয়ে বলল,
'আমি নিয়ে যাচ্ছি। রায়হান ওয়াশরুম কোনদিকে?'
স্পৃহা পানি দিয়ে শাড়ি পরিষ্কার করার চেষ্টা করছে। তার শরীরেও ডাল লেগে গেছে। স্পৃহার নাকের ডগা লাল হয়ে গেছে। কাঁদতে ইচ্ছে করছে তার কিন্তু জীবন সামনে বলে পারছে না। জীবন স্পৃহাকে এভাবে দেখে বলল,
'দেখিতো। আমি পরিষ্কার করে দিচ্ছি।'
টিস্যু নিয়ে জীবন শাড়ির পেটের দিকটা পরিষ্কার করছে। জীবন ভাবতেই পারেনি এমন কিছু হবে। আগে জানলে কখনো স্পৃহাকে নিয়ে আসতো না। ওরা সবার থেকে চলে এসেছে অনেক সময় হয়েছে। রায়হান বলল,
'আমি গিয়ে দেখি স্যার কি করছেন।'
নূপুরের দ্বারা এমন কাজ হয়ে যাওয়ার সবাই লজ্জায় পড়েছে। নূপুর বলল,
'আপনি বসুন। আমি যাচ্ছি।' রায়হানের কিছু বলার অপেক্ষা না করে নূপুর চলে গেল।
'স্পৃহা সরি। আমার সাথে না এলে আজ এমনটা হতো না।'
'হুম।'
স্পৃহার কাঁদো কাঁদো মুখটা দেখে জীবনের বড্ড মায়া হচ্ছে,খারাপ লাগছে আবার রাগও হচ্ছে নিজের উপর। নূপুর তাকে অন্য কোনো মেয়ের সাথে সহ্য করতে পারে না। আর এই জন্যই হয়তো স্পৃহার সাথে এমন করেছে। কোনোকিছু না বলে জীবন হঠাৎ স্পৃহার কোমর ধরে ওকে কাছে টেনে নিলো। পেছন দিয়ে নূপুর 'স্পৃহা' বলে মাত্রই এসেছে। ওদের দু'জনকে এভাবে একসাথে দেখে নূপুর এখানে আর দাঁড়াল না। নূপুর চলে যাবার কিছুক্ষণ পর জীবন স্পৃহাকে ছেড়ে দিলো। একটু আগে স্পৃহার সাথে কি হয়েছে সে কিছুই বুঝতে পারলো না। জীবন এক সেকেন্ডও না দাঁড়িয়ে চলে গেল। জীবন চলে যাবার পর স্পৃহা দু'হাতে মুখ চেপে ধরে ধপ করে নিচে বসে পড়লো।
'কি হলো আমার সাথে! উনি কেন এমন করলেন?'
সবার থেকে বিদায় নিয়ে জীবন স্পৃহাকে নিয়ে চলে এসেছে। রায়হান অবশ্য আর কিছুক্ষণ থাকার জন্য জোড়াজুড়ি করছিল।
জীবন সামনের দিকে তাকিয়ে ড্রাইভ করছে। পাশেই স্পৃহা জানালা দিয়ে মুখ বের করে বসে আছে। ওরা বের হবার আগেই আবার বৃষ্টি শুরু হয়েছে। স্পৃহা এবার বৃষ্টিতে ভিজে যাচ্ছে দেখেও জীবন তাকে কিছু বলতে পারছে না। নিজেকে অনেক অপরাধী মনে হচ্ছে জীবনের। হঠাৎ তার কি হয়ে গিয়েছিল? কেন নিজের উপর থেকে কন্ট্রোল হারিয়ে ফেলেছিল? নূপুরের সাথে রিলেশনে ছিল সময় তো একদিন নিজে থেকে নূপুরের হাতও ধরেনি। তাহলে আজ কেন স্পৃহার সাথে এই কাজটা করলো?
বাসায় এসে অর্ধেক ভেজা অবস্থায় স্পৃহা রুমে এসে দরজা লাগিয়ে দেয়। চেঞ্জ না করে ভেজা নোংরা শাড়ি নিয়েই শুয়ে পড়ে। রুম অন্ধকার বাইরে বৃষ্টি হচ্ছে। বিদ্যুৎ চমকাচ্ছে মাঝে মাঝে বাজ পড়ছে। স্পৃহা ভয়ে কান চেপে ধরেছে। চোখে পানি বালিশে পরছে। ঠোঁট কামড়ে ধরে স্পৃহা বলল,
'আপনার থেকে পাওয়া জীবনের প্রথম কিস আমি এভাবে পেতে চাই নি। আমি চেয়েছি আপনি যেন আমাকে ভালোবেসে আমার কাছে আসেন। এভাবে আমি আপনার কাছে যেতে চাই নি। কেন করলেন এমন? কাকে কষ্ট দেবার জন্য? আপনাকে ভালোবেসে কি আমি অন্যায় করেছি? কেন ঐ মেয়েকে কষ্ট দেওয়ার জন্য আমাকে কাছে টেনে নিলেন?'
জীবন দেয়ালে পরপর কয়েকটা ঘুষি দিয়ে ক্লান্ত হয়ে বেডে বসে পড়লো। দু'হাতে মাথার চুল টেনে ধরে বলল,
'আজকের পর থেকে আমি কীভাবে স্পৃহার সামনে দাঁড়াব? মেয়েটা হয়তো আজকের পর থেকে আমাকে ঘৃণা করবে। কেন করলাম এমন? কেন? তখন কি হয়েছিল আমার? আমি কি ওর চোখে সেই আগের জীবন থাকবো?'
রাতে জীবন ঘুমাতে পারে নি। নিজের রুম থেকে বেরিয়ে এসে পুরোটা রাত স্পৃহার রুমের বাইরে পায়চারি করেছে। কয়েক বার দরজায় ধাক্কা দিয়েছে। কিন্তু ভেতর থেকে দরজা বন্ধ করা ছিল। জীবন এখানেই দরজায় হেলান দিয়ে নিচে বসে পড়লো।
'স্পৃহা কি ঘুমিয়ে পড়েছে? নাকি এখনো সজাগ আছে? কোনদিনও তো ভেতর থেকে লক করে ঘুমায় না। আজ কেন ভেতর থেকে লক করে রেখেছে। স্পৃহা ঠিক আছে? আমি কীভাবে এই মেয়েটাকে কষ্ট দিতে পারলাম?'
ভোর হবার একটু আগে আগে জীবনের চোখ লেগে এসেছিল। আবার সাথে সাথেই জেগে যায় সে। হালকা করে দরজায় ধাক্কা দেয়। না এখনো দরজা খুলে নি। জীবন ইচ্ছে করেও স্পৃহাকে ডাকতে পারলো না। সে যেন স্পৃহাকে ডাকার অধিকার হারিয়ে ফেলেছে। নিজেকে অপরাধী মনে হচ্ছে।
জীবন না খেয়েই কোনোরকম রেডি হয়ে অফিসে চলে গেল। সারাদিন অফিসের কাজে তার একটুও মন লাগেনি। সারাক্ষণ স্পৃহার চিন্তাই মাথায় ঘুরপাক খেয়েছে। আজ একটা মিটিং ছিল জীবন মিটিং না করেই দুপুরে বাসায় চলে এসেছে। বাসায় এসে দেখে স্পৃহা নেই। স্পৃহার রুমের দরজা খোলা।
জীবন স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে বলল,
'স্পৃহা তাহলে আজ ভার্সিটিতে গিয়েছে?'
জীবন বাইরে থেকে খাবার আনালো। স্পৃহা হয়তো না খেয়ে গিয়েছে। বিকেল পর্যন্ত জীবন স্পৃহার জন্য অপেক্ষা করলো। কিন্তু স্পৃহা আসার কোনো নাম গন্ধও নেই। চিন্তিত হয়ে স্পৃহার ফোনে কল করলো। ফোন স্পৃহার রুমে বাজছে।
'এই মেয়ে সাথে করে ফোন নেয় নি কেন?'
বিকেলটা জীবন ছটফট করে বাসায়ই কাটালো। তারপরেও যখন স্পৃহা এলো না তখন আর জীবন বসে থাকতে পারলো না। সন্ধ্যার একটু আগে আগে স্পৃহার চিন্তায় প্রায় পাগল হয়ে গাড়ি নিয়ে বেরিয়ে গেল।
'কোথায় গেছে এই মেয়ে? ওকে আমি কোথায় খুঁজবো? আমার উপর রাগ করে কোথাও চলে গেল না তো? ওহ গড! ভাবতে পারছি না আর। এমনিতে এই মেয়ের বিপদ মাথায় নিয়ে ঘুরে। ঐদিনের মত যদি বাজে ছেলেদের হাতে পড়ে যায়। এই শহরটা তো ভালো করে চিনেও না এই মেয়ে।'
জীবন মেইন রোডে ফুল স্পিডে ড্রাইভ করছে।
জীবন যখন স্পৃহার চিন্তায় পাগল হয়ে ড্রাইভ করছে তখন তার ফোন বেজে ওঠে। বিরক্ত হয়ে জীবন ফোন তুললো না। পরপর কয়েকবার বার ফোন বেজেই যাচ্ছে।
'গড! এই টাইমে কার এতো দরকার পড়লো। ফোন তুলছি না দেখেও বারবার ফোন করে যাচ্ছে।'
জীবন স্ক্রিনের দিকে না তাকিয়ে ফোন কানে নিলো।
'কে?'
ওপাশ থেকে জয় বলল,
'কিরে ধমকাচ্ছিস কেন? আমি। নাম্বার টাও দেখিস নি?'
'জয় এখন ফোন রাখ আমি ভীষণ টেনশনে আছি। পরে কথা বলবো।'
'আচ্ছা রাখছি। তার আগে একটা কথা শোন। স্পৃহা আমাদের বাসায়। সকালে নিয়ে এসেছি।'
হঠাৎ ব্রেক কষে জীবন বলল,
'স্পৃহা তোর বাসায়? '
'হুম। আজ সকালেই নিয়ে এসেছি। ওর ফোনটা বাসায় রেখে এসেছে তাই তোকে জানাতে পারেনি। আমিই তোকে জানিয়ে দিব বলেছিলাম। কিন্তু অফিসে এসে আর মনে ছিল না। তুই এখানে চলে আয়। আমিও বাসায় ফিরছি।'
জীবন জয়কে কি বলবে ভেবে পাচ্ছে না। রাগে তার মাথা ফেটে যাচ্ছে। জয়কে এখন হাতের কাছে পেলে চড়িয়ে লাল করে দিত। সে এতক্ষণ স্পৃহার চিন্তায় মরছিল। আর জয় বলছে তাকে জানানোর কথা নাকি ভুলে গেছে।
'জয় তোকে যদি এখন একবার হাতের কাছে পেতাম!'
জয় হেসে বলল,
'আরে বুঝি বুঝি ভেবলির জন্যই তোর এতো টেনশন হচ্ছিল।'
'হাসছিস তুই? তোর বাসায় গিয়ে কিন্তু তোর দাঁত ভেঙে আসবো।'
'আচ্ছা আর হাসবো না। তুই চলে আয় তাড়াতাড়ি।'
'হুম।'
ফোন রেখে জীবন স্বস্তির নিঃশ্বাস নিলো। পাশের সীটে ফোন রেখে তার সীটে হেলান দিয়ে গা ছেড়ে বসলো। চোখ বন্ধ করে স্পৃহার মুখটা মনে করার চেষ্টা করছে।
'অনেক ভয় পেয়েছিলাম স্পৃহা। তুমি অন্য কারো ফোন দিয়ে আমাকে জানাতে পারতে। আমাকে এতটা টেনশনে ফেলা কি তোমার ঠিক হয়েছে?'
জীবন চোখ খুলে ভাবলো। স্পৃহা হয়তো তার সাথে কথা বলতে চায় না। আর তাই ফোন দেয় নি। জীবন গতরাতে যা করেছে তার পর আর স্পৃহা তার সাথে স্বাভাবিক হতে পারবে না। জীবন ফ্ল্যাটে ফিরে গেল। গোসল সেরে ট্রাউজারস আর টিশার্ট পড়ে বেরিয়ে গেল। যাবার আগে স্পৃহা ফোনটাও নিয়ে নিলো।
দরজা খুলে স্পৃহা তার সামনে জীবনকে দেখতে পেল। জীবন স্পৃহাকে দেখে একটু হাসার চেষ্টা করলো। মারিয়া পেছন থেকে বলল,
'স্পৃহা কে এসেছে রে? জয়,সোম নাকি জীবন? '
স্পৃহা কিছু বলছে না। আবার দরজার সামনে থেকে সরছেও না। জীবন বলল,
'ভেতরে আসতে দিবে না?'
স্পৃহা সরে দাঁড়ালে সে ভেতরে চলে এলো। মারিয়া জীবনকে দেখে বলল,
'ওহ তুমি এসেছো। এসো এসো। দেখো না সোম আর জয়টা এখনো আসছে না।'
'জয় বলেছিল ও ফিরছে। মনে হয় রাস্তায় আছে।'
'আচ্ছা। স্পৃহা তুই জীবনকে রুমে নিয়ে যা।'
মারিয়া জীবনকে বলল,
'তুমিও তো অফিস থেকে ফিরেই চলে এসেছো?'
'হুম। '
'দেখলে কান্ড। কিরে দাঁড়িয়ে আছিস কেন? জীবনকে রুমে নিয়ে যা। হাত মুখ ধুঁয়ে একটু রেস্ট নিক। জয় আসলে ডেকে দিব।'
জীবন এখানে আসার পর স্পৃহা এখন পর্যন্ত একটা কথাও বলে নি। রুমে এসেও চুপ করে আছে। জীবন স্পৃহার ফোন ওর দিকে এগিয়ে বলল,
'ফোন রেখে এসেছিলে কেন? '
'মনে ছিল না।'
'এখানে আসবে আমাকে জানাবে না একবার?'
'ভাইয়া গিয়ে নিয়ে এসেছে।'
'মানলাম জয় নিয়ে এসেছে। কিন্তু এখানে আসার পর তো একবার জানাতে পারতে। আমি টেনশন
জীবন থেমে গেল। স্পৃহাও কিছু বলল না। তবে সে মনে মনে ভাবছে,
'উনি আজ এভাবে কথা বলছেন কেন? যেন আমি বড় কোনো অপরাধ করে ফেলেছি। না বলে চলে এসেছি তো কি হয়েছে? উনিও তো কত জায়গায় যান। আমাকে সব সময় বলে যান নাকি?'
জয় আর সোম একসাথে ফিরেছে। সোম এতো এতো মিষ্টি নিয়ে এসেছে। প্রথমে কেউ ব্যাপারটা বুঝতে পারেনি। কিন্তু ডিনারের পর সব স্পষ্ট হলো। মারিয়া প্রেগন্যান্ট আর তাই আজ সবাইকে একসাথে আসতে বলেছে। জয় খবরটা শুয়ে আনন্দে লাফিয়ে উঠেছে।
'সত্যি বলছিস আপু আমি মামা হবো? আমার যে কি খুশি লাগছে তোকে বলে বুঝাতে পারবো না। আমাদের ফ্যামিলিতে প্রথম বেবি আসবে। আপু তুই কিন্তু এখন থেকে এখানেই থাকবি।'
সোম বলল,
'তোমার বোন এখানে থাকলে আমার কী হবে? আমি বাসায় একা থাকবো নাকি? '
'আরে সোম ভাই। তুমিও এখানেই থাকবে। আমরা সবাই একসাথে থাকবো।'
মারিয়া খবরটা শুনে স্পৃহার অনেক আনন্দ লাগছে। স্পৃহা মারিয়া গলা জড়িয়ে ধরে বসে আছে। তার মুখ হাসি হাসি।
'আপু তোমার বাবুকে আমি এত্তো এত্তো আদর করবো। ওর জন্য সুন্দর সুন্দর ড্রেস কিনবো।'
মারিয়া এবার লজ্জা পাবার ভান করে বলল,
'তোদের কথা শুনে এবার কিন্তু আমার সত্যিই লজ্জা লাগছে। '
মারিয়ার কথা শুনে সবাই হেসে দিলো। জীবনও হাসছে। কিন্তু এসবের মাঝেও সে স্পৃহার দিকেই তাকিয়ে আছে। স্পৃহাকে জীবন আগে কখনো এতটা খুশি দেখে নি। এভাবে হাসতেও দেখে নি। মারিয়া জীবনের দিকে লক্ষ করে স্পৃহাকে বললো,
'এবার কিন্তু তোর পালা। আমি তো তোকে খালামণি বানাচ্ছি। কিন্তু তুই কবে আমাকে খালামণি বানাবি? কি জীবন খুব শীঘ্রই খুশির খবর পাবো তো?'
সবার সামনে মারিয়ার এই কথা শুনে স্পৃহা জীবন দু'জনই লজ্জায় পড়ে গেছে। স্পৃহার তো ইচ্ছে করছে দৌঁড়ে এখান থেকে পালিয়ে যাক। আর নয়তো মাটি ফাঁক করে ভেতরে ঢুকে যাক। সোম ওদের দু'জনের অবস্থা দেখে হাসতে হাসতে বলল,
'মারিয়া তুমিও বেচারা আর বেচারিকে লজ্জায় ফেলে দিলে। ওরা বাচ্চা নেওয়ার প্ল্যান করছে তা সবার সামনে বলবে নাকি? দেখবে একদিন মিষ্টি হাতে চলে এসেছে। আমরা নাহয় সেদিন বুঝে নিব মিষ্টি কিসের জন্য।'
ওদের এসব কথা শুনে স্পৃহা লজ্জায় মুখ তুলতে পারছে না। তবুও একবার জীবনের দিকে তাকিয়ে আরো লজ্জায় পড়ে গেল। জীবন তার দিকেই তাকিয়ে আছে। দু'জনের চোখাচোখি হয়ে গেলে স্পৃহা সাথে সাথেই চোখ নামিয়ে নিলো। লজ্জায় স্পৃহার নাক মুখ লাল হয়ে গেছে জীবনের হাসি পাচ্ছে। সবাই আড্ডা দিয়ে রাতে ওরা রুমে গেল। জীবন ভেবেছে ডিনার শেষ করে ও স্পৃহাকে নিয়ে বাসায় চলে যাবে। কিন্তু এখন দেখছে স্পৃহা ফিরে যাবার নামই নিচ্ছে না। অনেকক্ষণ ইতস্তত করে জীবন বলল,
'বাসায় যাবে না স্পৃহা? রাত তো অনেক হয়েছে এবার চলো সবাইকে বলে বেরিয়ে পড়ি।'
স্পৃহা যেন কানে ভুল শুনছে। সে বলল,
'আজ আমি এখানে থাকবো।'
জীবন অবাক হয়ে বলল,
'থাকবে? '
'হুম। '
'কিন্তু এখান থেকে তো আমার অফিস অনেকটা দূরে। কাল তো আমাকে অফিসে যেতে হবে।'
'তাহলে আপনি বাসায় চলে যান।'
স্পৃহার কথা শুনে জীবন এখন যতটা অবাক হচ্ছে এর থেকে আর বেশি অবাক হওয়া যাবে না। সে মনে মনে বলল,
'এই মেয়ের মাথা ঠিক আছে তো? আমার সাথে এটা কীভাবে কথা বলছে? আমাকে চলে যেতে বলছে! '
স্পৃহা শোবার জন্য বিছানা গোছাচ্ছে। জীবন বলল,
'তুমি সত্যিই যাবে না আমার সাথে? '
'একবার তো বলেছি।'
'আচ্ছা। তাহলে কাল অফিস থেকে এসে তোমাকে নিতে আসবো।'
'আপনার আসার দরকার নেই। আমি কয়েকটা দিন এখানে থাকবো। মারিয়া আপু চলে গেলে জয় ভাইয়ার সাথে আমি ফিরে যেতে পারবো।'
জীবন কি বলবে বুঝতে পারছে না। আজ যেন সে অন্য কোনো স্পৃহাকে দেখছে। এই স্পৃহা কোত্থেকে এলো। জীবন স্পৃহার এমন জেদি রূপ আগে কখনো দেখি নি। স্পৃহা যাবে না জীবনই বা কি করতে পারে। বাধ্য হয়ে তাকে একাই ফিরে আসতে হলো। জয় থাকতে বলেছিল কিন্তু সে অফিসের বাহানা দিয়ে চলে এসেছে।
জীবন স্পৃহাকে রেখে জয়দের বাসা থেকে চলে এসেছে আজ তিন দিন হলো। এই তিন দিনে জীবনের অবস্থা বেহাল হয়ে গেছে। তার কোন জিনিস কোথায় আছে কিছুই বলতে পারছে না। এমনকি তার জামা কাপড়ও খুঁজে পাচ্ছে না। জীবন বারবার এটা ওটার জন্য স্পৃহাকে কল করেছে। স্পৃহা আমার নীল শার্টটা কোথায়? স্পৃহা টাই পাচ্ছি না। স্পৃহা কিচেনের কোন জিনিস কোথায় রেখেছ? আমার কালো ঘড়িটা কোথায় রেখেছি মনে পড়ছে না। স্পৃহাকে ছাড়া যে জীবন এতটা অচল হয়ে পড়বে তা সেও ভাবতে পারেনি। স্পৃহার থেকে দূরে থেকে জীবন বুঝতে পারছে স্পৃহা তার লাইফে কতটা অংশ জুড়ে আছে। জীবন বারবার ভুলে যাচ্ছে স্পৃহা এখানে নেই। সে মাঝে মাঝেই স্পৃহাকে ডেকে উঠে। যেখানে যাচ্ছে সেখানেই স্পৃহার ছোঁয়া অনুভব করতে পারছে।
'এমন পাগল পাগল লাগছে কেন আমার? মনে হচ্ছে সত্যিই পাগল হয়ে যাব। এই বাড়িতে তো আগেও এতো বছর আমি একাই ছিলাম। কই কখনো তো এমন হয় নি। নিজের জিনিস কিছুই খুঁজে পাচ্ছি না। সব যেন এলোমেলো হয়ে গেছে। আগে একা থাকতেই ভালো লাগতো। কেউ এলে বরং বিরক্ত লাগতো। এখন তো একা থাকতে বিরক্ত লাগছে। মনে হচ্ছে স্পৃহা পাশে থাকলে ওর সাথে এই কথাটা শেয়ার করতে পারতাম। অফিসে যাওয়ার সময় ফাইল, ঘড়ি, টাই,ওয়ালেট খুঁজে পাগল হতে হতো না। বলার আগেই স্পৃহা হাতের কাছে এনে রাখতো। এতদিনে স্পৃহা আমার অনেকগুলো বদঅভ্যাস তৈরি করেছে।'
জীবন একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললো। তিন দিন হয়ে গেছে এখনো স্পৃহা আসছে না কেন? কবে আসবে সে? জীবনের তো এভাবে আর ভালো লাগছে না।