পরাণ প্রিয়া - পর্ব ০৩ - রাবেয়া সুলতানা - ধারাবাহিক গল্প


___কাজী সাহেব বিয়ে পড়ানোর জন্য দোয়া পড়া শুরু করতেই মীম এসে,দাঁড়ান!
সবাই যেনো বিস্ময়কর চোখে সদর দরজার দিকে তাকালো।
মীম এগিয়ে এসে জাহিলের সামনে দাঁড়াতেই,জাহিল ভয়ে ভয়ে উঠে দাঁড়িয়ে, তুমি এইখানে?
মীম তাচ্ছিল্য হাসি দিয়ে, অবাক হচ্ছো?
জিহাল দাঁত মুখ খিচিয়ে, এখানে কেনো এসেছো তুমি?
-কেনো এসেছি তুমি বুজতে পারছো না?ভয় পাচ্ছো তাই তো? এখন আমি আসছি একটু পর পুলিশও আসবে।তখন দেখি তোমার এসব চল-চাতুরী কোথায় যায়?
একে একে সবাই দাঁড়িয়ে পড়লো।জাফর মীমের কাছাকাছি এসে,আপনি কে? এইখানে এসে ঝামেলা করছেন কেনো?
-সেটাই তো সমস্যা,আমি কে? আমি ওর বিয়ে করা প্রথম স্ত্রী। মেয়ে বিয়ে দিচ্ছেন এইসব খবর নেননি।ছেলের আরেকটা বউ আছে।এক বছরের একটা বাচ্চা আছে।
কথাটা শুনে সবাই স্তব্ধ স্থির হয়ে গেছে।ইভা অনিলা, নুর জাহান বেগম, সবার যেনো জ্ঞান হারানোর অবস্থা

ভিতরে রুম থেকে সবাই দৌড়ে ড্রইংরুমে আসলো।মোশারফ হোসেন নিরব দর্শকের মতো ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে সব কিছুকে বুজার চেষ্টা করছেন।

সবাই আসলেও প্রিয়তা উঠে আসেনি।কিছু একটা যে হয়েছে তা ঠিক বুজতে ফেরেছে।
জাফর মীমকে কব্জি ধরে টেনে, আপনার সমস্যা কী ভেঙ্গে একটু বলবেন? এইটা ভদ্রলোকের বাড়ি।

-আপনি এখনো কিছু বুজতে পারেননি? ওইযে শয়তান, বদ মহিলাটি দাঁড়িয়ে আছে ওনাকে জিজ্ঞেস করুন।ছেলের বিয়ে দেওয়া হচ্ছে।এমন বিয়ের কপালে ঝাঁটা মারি আমি।
কথাটা বলেই দৌড়ে এসে জাহিলের কলার টেনে,তুই কোনো কথা বলছিস না কেনো?
ইভা আর সহ্য করতে না পেরে মীমকে নিজের দিকে ঘুরিয়ে, ও আমাদের বাড়ির জামাই হতে যাচ্ছে,আর তুমি কিনা ওর কলার টেনে ধরেছো?

-আপনাদের জামাই তো পরে হবে।আগে আমার স্বামী।আমি আমার স্বামীকে যা ইচ্ছে তাই করবো তাতে আপনাদের কী?

ইভা কথাটা শুনে আর কিছু বলতে পারলো না।এর মাঝেই পুলিশ এসে জাহিলকে থানায় নিয়ে গেলো।
জাহিলকে নেওয়ার পর সব কিছু যেনো থমথমে হয়ে গেছে।
নুর জাহান বেগম কান্নাকাটি শুরু করেছে,কী হবে প্রিয়তার? কতো কষ্ট করে যা একটা ছেলে জোগাড় করলাম শেষে কিনা বিয়েটাই হলো না।এখন মেয়েটার কী হবে? পাঁচ জনে পাঁচ কথা বলতে এখন আর মুখে বাঁধবে না।আল্লাহ কেনো আমায় এইসব দেখার আগে উঠিয়ে নিলো না?
কথা গুলো বলতে বলতে প্রলাপ করে বকতে লাগলেন।
প্রিয়তা যেনো স্তব্ধ স্থির হয়ে গেছে।পাথরের মুক্তির ন্যায় বসে আছে সে।আত্মীয় স্বজনেরা মুখের উপর অনেক কথা বলেই বিদায় নিলো।জুহি প্রিয়তার পাশে বসে আছে।
ইভা আর অনিলা ক্রোধ দেখিয়ে প্রিয়তার রুমে গিয়ে,
-কিরে তুই এখনো বসে আছিস?ফাঁসি দেসনি?
আরে তোর তো মরে যাওয়া উচিত। বুড়ো বয়সে যা একটা পাত্র জোগাড় করেছে মা সেটাও শেষমেষ তোর কপালে জুটলো না।তোর জায়গা যদি আমি হতাম না আরও আগেই আত্মহত্যা করতাম।তোর জন্য আমরা সমাজে আর মুখ দেখাতেও পারবো না।
ইভার চেঁচানো কথাগুলো শুনে, প্রিয়তা ইভার দিকে তাকাতেই, কার জন্য নিজেকে বিলিয়ে দিয়েছি? ইভা তোর সন্তানের জন্য জাফরের কাছে হাতে পায়ে ধরেছি।অবৈধ সন্তান নিয়ে যখন জাফর তোকে মেনে নিচ্ছিলো না তখন তোর শ্বাশুড়ি দশ লাখ টাকার বিনিময়ে  তোকে ঘরে তোলে নিয়েছে।সে টাকা আমার বাবা তোর জন্য রেখে যায়নি।আমি দিয়েছি।এই বুড়ো বোনটাই দিয়েছে।আর আজ আমি তোদের কাছে এতোটাই বোঝা হয়ে গেছি? কথাগুলো প্রিয়তা মনে মনে বললেও শব্দ করার সাহস যেনো তার নেই।ইভা থামতেই এবার অনিলা বললো,আপু বিশ্বাস কর, তোকে দেখলে আমার ঘৃণা লাগে, তোকে দেখলে আমার রাঘ হয়।তোর এই জীবনটা পুরোই বৃথা।
এতোদিন তো ভালোই ছিলি।তুই কী ভাবিস আজ থেকে তোকে সবাই সহজ ভাবে মেনে নিবে।তোকে ভালো চোখে দেখবে? দেখবে না।সবাই বলবে নিশ্চয়ই তোর কোনো সমস্যা আছে যার কারণে তোর বিয়ে হতে হতেই ভেঙ্গে যায়। 

সালমা বাগম জুহিকে নিয়ে একপাশে দাঁড়িয়ে সব শুনছিলো।সালমা বেগমের ইচ্ছে করছে এই দুইটা মেয়েকে কষিয়ে থাপ্পড় দিতে।যে মেয়েটার বিয়ে ভেঙ্গেছে তাঁর মনের অবস্থাটা কেউ একটা বার দেখলো না।একটা মেয়ের তখন কতটা কষ্ট হয় এই মেয়েগুলোর সে ধারণা নেই। ওরা বোন হয়ে কীভাবে পারে এসব করতে?

ইভা প্রিয়তার হাত টেনে হেছড়ে খাট থেকে নামিয়ে ড্রইংরুমে নিয়ে যাচ্ছে,

-ইভা আমার লাগছে।এভা আমাকে ছাড়, বিশ্বাস কর আমি হাতে ব্যাথা পাচ্ছি।
ইভার যেনো কানেই যাচ্ছে না কথাগুলো। 
সালমা বেগম ধরতে গিয়ে যেনো থেমে গেলো।কারণ ইভার চেহারায় ভয়ংকর আগুনের মতো ফুটে উঠেছে। 

-মা, তোমার এই মেয়েকে এই বাড়ি রাখা আর সম্ভব নয়।ও যদি এই বাড়িতে থাকে তোমার যে আরেকটা মেয়ে আছে তাকে আর বিয়ে দিতে পারবে না।ওর মতো বেহায়া, অপয়া, অলক্ষ্মী মেয়ে দুনিয়াতে আর একটাও নেই।তুমি যদি এই অপয়ার সাথে কোনো সম্পর্ক রাখতে চাও তাহলে আমরাই তোমার সাথে কোনো সম্পর্ক রাখবো না।

নুর জাহান বেগম কী বলবে বুজতে পারছে না।কী থেকে কী হয়ে গেলো।মেয়েটা তো বিয়ে করতে চায়নি।আমিই তো জোর করলাম।
নুর জাহান কিছু বলার আগেই মোশারফ হোসেন বললেন,এক মিনিট! 
জোরালো কন্ঠটা শুনে সব নিস্তব্ধ হয়ে গেলো।সাবাই অবাক হয়ে মোশারফ হোসেনের দিকে তাকিয়ে আছে।
-আমি মোশারফ হোসেন,আমার ছেলে নিবিড় এই শহরের বিখ্যাত বিজনেসম্যান  ইশতিয়াক ইসলাম নিবিড়। আপনাদের যদি কোনো সমস্যা না থাকে আমিই এই মেয়েকে আমার ছেলের বউ করে নিতে চাই।

কথাটা শুনে জুহি দৌড়ে বাবাকে জড়িয়ে ধরে আস্তে করে,আব্বু,,,

-আমি এতোক্ষণ সব দেখেছি বুজেছি।যতটা বুজেছি এমন লক্ষ্মী এবং ধৈর্য্যশীল মেয়ে এই জগতে খুঁজে পাওয়া খুবে মুশকিল। তোমরা তো বোন তাই না? 
আমার ভাবতেও অবাক লাগে বোন হয়ে বোনকে এতোটাই অপমান অসম্মান কেউ করে?
আমি মোশারফ এখনে দাঁড়িয়ে বলছি একদিন তোমরাই ওর পায়ে ধরে ক্ষমা চাইবে? 
অনিলার দিকে তাকিয়ে,এই মেয়ে তুমি বললে না, ওকে দেখলে তোমার ঘৃণা হয়? আজ আমি বলে যাচ্ছি একদিন  তুমি নিজেই ওকে দেখে তোমাকে ঘৃণা করবে।হিংসা জ্বলেপুড়ে ছাই হবে।
নুর জাহান বেগম তড়িৎ ভাবে উঠে গিয়ে মোশারফ হোসেনের সামনে দাঁড়িয়ে আপনি সত্যি আপনার ছেলের সাথে আমার মেয়ের বিয়ে দিবেন?

-হ্যাঁ দিবো।তবে একটা শর্তে।

-আপনি যা বলবেন আমি রাজি।দেনাপাওনা যা লাগে আমি দিবো।আমার মেয়ে চাকরি করে।
কথাটা শুনেই মোশারফ হোসেন এবার তীক্ষ্ণ চোখে তাকাতেই ইভা বললো,মা তুমিও না।তোমার এই আপদ মেয়েকে কেইবা বিনা পয়সায় ঘরে তুলে নিবে? ওনি বিজনেসম্যানের বাবা বিজনেসের চাল ওনি খুব ভালোই জানবেন।আর আমার মনে হয়না ওনার ছেলে সুস্থ বা স্বাভাবিক। হয়তো প্রতিবন্ধীও হতে পারে। কেউতো আর জেনে বুজে এই বুড়ীটাকে ঘরে তোলে নিবে না।দাঁত মুখ খিছিয়ে কথাগুলো ইভা বলতেই মোশারফ হোসেন ধমক দিয়ে, এই মেয়ে তোমার সাথে আমি কোনো কথা বলছি না।তোমার মতো এতো নিচ একটা মেয়ের সাথে কথা বলে আমার সম্মান আমি নিচে নামাতে চাই না।আমার ছেলে কী সেটা তুমি আসলেই দেখতে পাবে।আর আমি তোমাকে আমার ঘরের লক্ষ্মী দিয়েই প্রমাণ দিবো তোমার মতো বেয়াদব মেয়ের থেকে ও হাজার গুন ভালো।

নুর জাহান বেগমকে উদ্দেশ্যে করে বললো,আমার কিচ্ছু চাই না শুধু চাই আমার ঘরে লক্ষ্মীর সাথে আপনাদের আর কোনো সম্পর্ক থাকবে না।

সালমা বেগম মোশারফ হোসেনের কাছে গিয়ে, তুমি এইসব কী বলছো তোমার ছেলে মেনে নিবে?
আমার খুব ভয় হচ্ছে গো।

-সালমা ছেলে আমার, রাজি আমি করাবো।
জুহি তোর ভাইয়াকে ফোন দিয়ে এখুনি এইখানে আসতে বল।

জুহি খুশিতে যেনো আত্মহারা । সাথেই ফোন নিয়ে নিবিড়কে জরুরী ভাবে আসতে বলে দিলো। 

নিবিড় হন্তদন্ত হয়ে ছুটে আসলো প্রিয়তাদের বাড়িতে।
নিবিড়কে দেখে সবাই অবাক।ইভা নিজের চোখকেই বিশ্বাস করতেই পারছে না।লম্বাচওড়া, ফর্সা, মুখ ভর্তি চাপদাড়ি,এক অন্য রকম মায়া আছে লোকটার মুখে।
ইভা ভেবেই পায়না সত্যিই কী এই ছেলে বিয়ে করবে? জীবনেও না।তবে এই ছেলে কে হাতছাড়া করা যাবে না।বুড়ীটাকে বিয়ে করতে রাজি না হলে রিয়ার কথা যেই করে হোক বলতে হবে।কথাটা ভাবতেই যেনো ইভার মনে স্বস্তি ফিরে এলো।

নিবিড় এসে বিস্ময়কর চোখে চারদিকে একবার তাকিয়ে, বাবা আপনি আমায় এইখানে কেনো এতো জরুরী ভাবে ডাকলেন?আপনি জানেন? আমি মিটিং থেকেই ছুটে আসলাম। 

মোশারফ হোসেন গম্ভীর হয়ে বসে আছে।
সবাইকে উদ্দেশ্য করে বললো,আপনারা একটু আমাকে একা আমার ছেলের সাথে কথা বলতে দিন।
কথাটা বলতেই সবাই উঠে গেলেও ইভা বললো,আমি থাকি?
মোশারফ হোসেন রাগন্বিত চোখে তাকাতেই ইভাও চলে গেলো।
ইভার পায়চারী যেনো বেড়ে চলছে।নিবিড় কী করবে এই বিয়ে?

নিবিড়কে ইশারা করে বসতে বলে,আমি তোর বিয়ে ঠিক করেছি।আর বিয়েটা এখুনি হবে।

-মানে? বাবা আপনি এইসব কী বলছেন?

-আমি এখানে সবাইকে কথা দিয়ে ফেলেছি।আর আমার এইটা বিশ্বাস আমার ছেলে কখনো আমার উপর কথা বলবে না।কারণ আমি সেই শিক্ষা দিইনি।

-মেয়েটা কে বাবা?

-জুহির ম্যাডাম। 

-কিন্তু ওনার তো,,,,,

নিবিড়কে থামিয়ে,না বিয়েটা হয়নি।মোশারফ হোসেন সব খুলে বলতেই নিবিড় চুপ করে আছে।কিছু বলতে পারছে না।মনে মনে ভাবছে,বাবা কী করে এমন একটা কথা আমাকে বলতে পারলো? 
তখনি জুহি এসে পাশে বসে,ভাইয়া আমিও চাই ম্যাডাম আমার ভাবী হয়ে আমাদের বাড়ি যাবে।আমার সঙ্গী হয়ে সারাজীবন আমার সাথে থাকবে।প্লিজ ভাইয়া তুই রাজি হয়ে যা। 

নিবিড় নিচের দিকে তাকিয়ে আছে কান্নাক্লান্ত টকটকে লাল চোখে। 

মোশারফ হোসেন নিবিড়কে কিছু না বলেই জাফরকে বললো,আমার ছেলে রাজি।কাজী সাহেবকে ডাকুন।

কথাটা শুনেই উদ্বিগ্নতার চোখে তাকিয়ে দীর্ঘশ্বাস ফেলে নিজেকে সংযত করে নিলো নিবিড়। 

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন