বিভানের হাসির রহস্য বুঝতে পারেনা বেলা।লোকটা ফাজলামো সবসময়ই করে তবে এমন রহস্যময় হাসি দেয়ার মানে কি?একে তো কথা লুকিয়েছে তার ওপর তার রহস্যজনক হাসি।বেলাকে এমন তাকিয়ে থাকতে দেখে বিভান জুলির সামনেই ওকে বাহু বন্ধনে আবদ্ধ করে বিভান। তারপর কপালের সামনে থেকে চুল সরিয়ে সেখানে আলতো করে চুমু দিয়ে একটু সরে এসে বলল,
''যাও বেলা রানী রেডি হয়ে নাও।বের হতে হবে তো।"
বেলা সরে আসে বিভানের বাহুবন্ধন থেকে।সামনে বসে থাকা জুলিকে দেখতে পায় ও।সে বিস্ফোরিত চোখে ওদের দেখছে।লজ্জাশরম বলতে কি কিছু নেই বিভানের।এভাবে এই কালী মহিলাকে চুমু খাচ্ছে।জুলি কিছু বলতে পারছেনা আর না পারছে সহ্য করতে।বেলা রেগে বলল,
''আমি রুমে যাচ্ছি।"
তারপর হেঁটে লিফটের দিকে এগুলো বেলা।বিভান যখনই আসতে নিবে জুলি বলল,
''বৌয়ের পিছু পিছু কি করো সারাদিন?"
বিভান রেগে ওর দিকে তাকায়। তবে আশেপাশে অনেক লোক।তাই চিৎকার না করাই ভালো।দুষ্টু হেসে বিভান ভ্রু নাচিয়ে বলল,
''তা জানতে হলে রাত দুটোয় আমাদের রুমে এসো।জবাব পেয়ে যাবে।"
আর অপেক্ষা করেনা বিভান।লিফ্টের দরজা আটকে যাচ্ছিলো বিভান দ্রুত গিয়ে দরজাটাকে থামায় সুইচ টিপে তারপর ঢুকে বেলার পাশে দাঁড়ায়।বেলা ওর দিকে তাকাচ্ছে ও না।বিভান বেলাকে কিছু বলতে পারেনা দুজন মহিলার কারনে।শুধু বেলার হাত ধরে রেখেছে শক্ত করে।রুমে এসেই বেলাকে দেয়ালের সাথে চেঁপে ধরে বিভান।বেলা বিভানকে সরানোর জন্য পিছনের দিকে ধাক্কা দেয় কিন্তু বিভান আরো ঘনিষ্ঠ হয়ে ওকে জড়িয়ে ধরে তারপর নেশাযুক্ত কন্ঠে জিজ্ঞেস করে,
''কি হয়েছে তোমার?কেন এমন করছো? কথাও বলছোনা।"
বেলা রেগে জোরে বলল,
''সরুন আমার থেকে।আপনার এসব ঢং ভালো লাগছেনা।"
বিভান রেগে বেলাকে আরো জোরে চেঁপে ধরে দেয়ালের সাথে।ওর চিবুক ধরে মুখটা একটু উঁচু।করে বেলার মাথা দেয়ালের সাথে লাগা।ব্যাথা লাগছে ওর।বিভানের অনেক রাগ লাগছে।চেঁচিয়ে বলল,
''কখন থেকে তোমার ফাজলামো।সহ্য করছি খেয়াল আছে?কিছু বলছো ও না কিন্তু তেড়ামী করছো।বেলা খুব খারাপ হবে বলে দিলাম!!!খুব খারাপ হবে।"
''কি মারবেন আমাকে?মারেন?আমার থেকে কথা লুকিয়ে কি মজা পেলেন?কতোটা টেনশনে আমি ছিলাম খেয়াল আছে আপনার?"
চিৎকার করে বলতে থাকে বেলা।বিভান অবাক হয়ে যায়।কি বলছে বেলা?কোন কথা লুকানোর কথা বলছে।বিভান এবার রেগে জিজ্ঞেস করলো,
''কি বলছো এসব?কে কথা লুকিয়েছে তোমার থেকে?মাথা ঠিক আছে?"
''ঠিক আছে বিভান।একদম ঠিক আছে।তবে নিশাদ আর কুঞ্জনের কথা লুকিয়ে ভালো করেননি।নিশাদ কুঞ্জনকে কিভাবে মেরেছে সম্পূর্নটুকুই লুকিয়েছেন।শুধু আপনিই না আমার বোন ও।"
বিভানের মাথায় হঠাৎ ব্যাপারটা কাজ করলো।বেলা কি করে জানলো?কে বলল ওকে?বিভান স্বাভাবিক কন্ঠে জিজ্ঞেস করে,
''কে বলল এসব?"
''যেই বলেছে সেটা আপনার জানার দরকার নেই।তবে আপনার থেকে এমনটা আশা করতে পারিনি।আমার ভাই দুটো এতো অসুস্থ তা জানালেননা আপনি।উল্টো আমাকে আঘাত করলেন।"
কথা গুলো বলে বেলার চোখমুখ কুঁচকে এলো।গাল বেয়ে অশ্রু গড়িয়ে পড়তে থাকে।বিভানের হুঁশ হয়।বেলার চুল গুলো অগোছালো হয়ে গেছে।দাঁড়িয়ে উল্টোদিকে ফিরে কাঁদছে বেলা।বিভান দৌড়ে এসে পিছন থেকে জড়িয়ে আকুতির স্বরে বলল,
''মাফ করো বেলারানী।এমনটা করার কোন উদ্দেশ্য ছিলোনা।জুলির সামনে ও কথা বলছিলেনা দেখে রাগ হয় আমার।তুমি জানো জুলির নজর আমার ওপর।আর সেখানে আমার শক্তি তুমি।আর সেখানে তুমি রাগ করে থাকলে আমি কিভাবে জুলর নজর থেকে বাঁচবো বলো?দিন শেষে আমি ও একজন পুরুষ বেলা।আমরা পুরুষরা জানোইত কেমন হই?বেলা আমি তোমাকে ছাড়া আর করোর দিকেই তাকাতে চাইনা।"
বেলা একটা হাত দিয়ে নিজের পেটের ওপর রাখা বিভানের হাতটাকে ছোঁয়।তারপর কাঁদো গলায় বলল,
''আর কখনো কোন কথা লুকোবেননা প্লিজ।আমার ভীষন চিন্তা হচ্ছিলো।"
বিভাব আবার ও বলল,
''তোমাকে সাঁঝ বলতে নিষেধ করেছিলো।কারন তুমি এখানে কতো দূরে ওদের থেকে।ওদের কোন খারাপ খবর শুনলে তোমার খারাপ লাগবে চিন্তা করবে।ওরা যেমন নিজেদের কষ্টটা একে অপরের সাথে শেয়ার করতে পারে তুমি তো পারবানা তাইনা।এ বিষয় গুলো ভাইবোনের সাথে শেয়ার করা ভালো হাজবেন্ডের সাথে না।আর তুমি ওদের সাথে সবসময় যোগাযোগ ও করতে পারোনা তাইনা?তাই ও বলেনি আমাকে ও বলতে দেয়নি।"
বেলার ভীষন খারাপ লাগছে।ওরা তো ওর কথা ভেবেই জানায়নি।বিভানের কথাগুলো তো ঠিক।বেলা সামনে ফিরে বিভানকে জড়িয়ে ওর বুকে মাথা রেখে বলল,
''এভাবে কিছুক্ষন থাকি?ভালো লাগছে আমার।"
বিভান কিছু না বলে বেলার কপালে চুমু দিয়ে ওর কোমড় জড়িয়ে ধরে দুহাতে।
.......................................
ইদ্রি কিছুটা সময় লেকে কাঁটিয়ে উঠে দাঁড়ায়।নিশাদকে দেখতে গেলে ব্যাপারটাকি খুব বেশি খারাপ দেখাবে?দেখাক ও পরোয়া করে না কোন কিছুর।ও যাবে নিশাদের কাছে। তাকে কাছ থেকে দেখবে।তার কপালে আলতো করে হাত বুলাবে।তাহলেই ওর শান্তি।কথা গুলো ভেবেই গাড়ির কাছে আসে ইদ্রি।ড্রাইভার ভিতরে বসে ধুমপান করছে।ইদ্রি বলল,
''ভাইয়ার বন্ধু নিশাদ ভাইয়ের বাসা চিনেন?"
ইদ্রির কথায় লোকটা উঠে বসে বলল,
''চিনি তো।কেন?কেডা যাইবো?"
''আমাকে নিয়ে যাবেন প্লিজ।"
বিনয়ের সুরে বলল ইদ্রি।ড্রাইভার আবার ও বলল,
''স্যাররে কি কমু?"
''বইলেন শপিং এ গেছিলাম।একটা বানায় বলে দিয়েন।কিন্তু আমাকে নিয়ে চলুন।"
''আচ্ছা উডেন।"
ইদ্রি গাড়িতে উঠে বসে।গাড়ি শব্দ করে চলতে লাগলো রংধনু নিবাসের পানে।ইদ্রি গাড়ির জানালা দিয়ে বাহিরে তাকায়।কেন যেন প্রকট চিন্তার মাঝে ও শান্তি লাগছে।বুক ভরে নিশ্বাস নেয় ইদ্রি।কাঁঠালবাগান এলাকাটা আসলে বেশ লোকালয় পূর্ন।তবে এদের মন হয়ত পুরোটাউ পরিষ্কার যেমন টা নিশাদের।গাড়ি রংধনু নিবাসের সামনে থামলো।ইদ্রি চোখতুলে তাকায় নাড়িটির দিকে।এমন এলাকায় এধরনের বাড়ি আগে দেখেনি ও।এতো সুন্দর বাড়িটি।সামনে মাঠ।দুপাশে ফুলবাগান।তবে ফুল গুলো শুকিয়ে গেছে।ড্রাইভার বেরিয়ে এসে দরজা খুলে দেয়। ইদ্রি বেরিয়ে আসে গাড়ি থেকে।তারপর ধীর পায়ে এগুতে দালানটির গায়ের রং পেস্ট কালার।একতলার একটা বাড়ি।দলানের গায়ে ছত্রাক পড়ে গেছে।তবে আশেপাশে গাছগাছালিতে পরিপূর্ণ। ইদ্রি সামনে এগিয়ে দরজার সামনে দাঁড়ায়।কলিংবেল বাজাতেই কে যেন ভিতর থেকে মেয়েলি গলায় বলল,
''আসছি।"
ইদ্রি তার আসার অপেক্ষায়।ভিতর থেকে কেউ দরজা খুলল।একটি মেয়ে পনের ষোল বছর বয়সের হবে।অতোটা লম্বা না হলে ও আয়তন ঠিক আছে।গায়ের রং ফর্সা,ওর চোাখের পাপড়ি গুলো বেশ লম্বা।সবচেয়ে আকর্ষনীয় অংশ হলো চোখ জোড়া। মেয়েটি ম্লান হেসে বলল,
''আপনি?"
''এটা নিশাদ ভাইয়ার বাসা না?"
বেশ অস্বস্তি লাগে ইদ্রির।মেয়েটা বলল,
''জি।আপনি?"
''ওনি আমাকে কম্পিউটার শিখান।তুমি কে?"
''আমি লাবনী ভাইয়ার ছোট আদুরে বোন।"
''ওহ।তোমাদের কথা খুব শুনেছি খুব কিউট তুমি।স্যার আছে?"
''জি আছে।আসুন আপু।"
ইদ্রি ভিতরে ঢুকতেই বারান্দায় ইকরাম রাহমানকে দেখে দাঁড়ায়।ইকরাম রাহমান চশমার ফাঁকে ওকে দেখছেন।লাবনী বলল,
''আব্বা ভাইয়ার বন্ধু ইমতিয়াজ ভাইয়া আছেনা?ওনার বোন।"
ইকরাম রাহমান একটু কেঁশে বললেন,
''তুমি ইদ্রি না?"
''জি আঙ্কেল।"
নরম সুরে বলল ইদ্রি।ইকরাম রাহমান বললেন,
''ভালো আছো?তোমার ভাই আসেনি?"
''না আঙ্কেল ভাইয়ার কাজ আছে।তাই আমি এসেছি স্যারকে দেখার জন্য।"
''ওহ।যাও দেখে আসো।"
''জি।"
ইদ্রি আসার সময় আনারস মাল্টা কিনে এনেছিলো।কুঞ্জনের কথা জানতো না ও।ডাইনিং রুমে এসে দেখলো জুলেখা বানু কুঞ্জনকে খাওয়াচ্ছে।উজ্জ্বল শ্যামলাবর্নের ছিপছিপে দেহের অধিকারী কুঞ্জন।একটা ব্যাপার হলো সবার চেহারা খুব মায়াবী।লাবনী ইদ্রিকে বলল,
''ওনি আমার মা আর পাশের জন আমার ভাইয়া কুঞ্জন।"
ইদ্রি খেয়াল করলো কুঞ্জনের গায়ে ব্যান্ডেজ লাগানো।ইদ্রি জুলেখা বানুকে সালাম দিয়ে কুঞ্জনকে উদ্দেশ্য করে বলল,
"'ওনার কি হয়েছে?"
লাবনী বলল,
''দুষ্টুমি করেছে সেটার শাস্তি।ভিতরে আসুন ভাইয়ার রুমে। ইদ্রি ধীর পায়ে নিশাদের রুমে প্রবেশ করে।সে ঘুমে।ইদ্রি লাবনীকে বলল,
''স্যার ঘুমোচ্ছে।"
''আপু তুমি বসো ভাইয়াকে ডাকি।"
''লাগবেনা।ওনার শরীর ভালো না।আমি এখানে একটু বসবো।বেশিক্ষন থাকবোনা।"
''ওকে।"
লাবনী বেরিয়ে গেলো।ইদ্রি আস্তে করে নিশাদের পাশে বসে ওর দিকে তাকিয়ে থাকে।গায়ে শার্ট নেই।বুকে হালকা লোম।ইদ্রির কেমন যেন নেশা লাগছে লোমগুলোর প্রতি।ও হাত বাড়িয়ে সেগুলো আলতো করে ছোঁয় তারপর হাত সরিয়ে এনে নিশাদের কপাল স্পর্শ করে।চোখ ভারি হয়ে আসতে চায় ওর।তবে অদম্যশক্তি ব্যাবহার করে নিজেকে সামলে নেয়।
.......................................
সাঁঝের দিন গুলো যেন কাঁটতেই চায়না।রিদ্ধিকে পড়াতে যায় ঠিকই তবে মন যেন সেখানে থাকেনা।ওর কাছেই নেই।কেমন এক অজানা অপূর্নতায় বুকটা খাঁখাঁ করছে।এ অপূর্নতা আর সহ্য হচ্ছেনা।সাইমনকে দেখতে ইচ্ছে করছে, কথা বলতে ইচ্ছে হচ্ছে কিন্তু এর কিছুই ও পারছেনা।
!!!!
আষাঢ় মাস শুরু না হলে ও সাঁঝের মনের আষাঢ় মাস ঠিক শুরু হয়ে গেছে।ভেতর ভেতর হৃদয়টা দিনক্ষন বুঝেনা শুধু কাঁদতে থাকে সবসময়। কোন কাজেই আজ কাল মন বসাতে পারেনা। ভেতরটা শূন্যতায় ভরে গেছে।সাইমন লোকটাই কি এ শূন্যতা পূরন করতে পারবে?কিন্তু সাঁঝ তো কখনো তাকে নিয়ে এত দূর পর্যন্ত ভাবেনি।কখনো ভাবেইনি এতোটা মিশে যাবে তার সাথে সময়ের আবর্তে।কেন সে লোকটার কথা এতোটা ভাবে?কেন তার শূন্যতা এতোটা বেদনাদায়ক?সাঁঝ ভেবে পায়না। এর কোনটারই উত্তর জানা নেই ওর।সময় গুলো যেন থেমে থেমে যাচ্ছে তাকে ছাড়া।পরনের উড়নাটার একটা মাথা উঠিয়ে মুখের ঘাম মুছে নেয় সাঁঝ।লিফ্টের ভেতর এতোটা ভিজে গেছে।ঘাম মুছে নিতে নিতে লিফট হঠাৎ থেমে গেলো।উড়না ঠিক করে দাঁড়িয়ে গেলো।লিফটের দরজা খুলে সাইমন ভিতরে প্রবেশ করে।সাঁঝ প্রচন্ড অবাক ওকে দেখে।লোকটা ওর দিকে তাকাচ্ছেনা।নিজের মতো দাঁড়িয়ে ফোনে কি যেন করছে।সাঁঝ কিছু বলতে গিয়ে ও পারেনা শুধু পলকহীন ভাবে তাকে দেখা ছাড়া।লিফট বেজমেন্টে এসে থামতেই দরজা খুলে গেলো।সাইমন যেন তাড়াহুড়া করেই বেরিয়ে গেলো।সাঁঝ ও দৌড়ে বেরিয়ে এলো।এদিক ওদিক খুঁজতে লাগলো।তার গাড়িটা নেই।সাঁঝ দৌড়ে বেরিয়ে আসে।যতোদুর চোখ যায় লোকটা নেই।না চাইতে ও রাস্তার মাঝে কেঁদে ফেলে ও।গায়ের উড়নাটাও ঠিক জায়গায় নেই।সাঁঝ হেঁটে হেঁটে এগুতে থাকে।কিন্তু তার দেখা মেলেনি।এভাবে কতটাসময় হাঁটলো জানা নেই ওর।হঠাৎ মনে হলো ও খুব দূরে এসে গেছে।আশেপাশে চোখ ঘুরিয়ে খুঁজতে থাকে তাকে।কিন্তু পায়নি।পিছনে ঘুরে হাঁটতে থাকে ও।পাশে একজন রিক্সা ওয়ালা দেখে সাঁঝ থামালো রিক্সাটাকে। ভাড়া ঠিক করে উঠে পড়ে।সারারাস্তায় কাঁদছিলো ও।লিফ্টে কেন কথা বলেনি ও?কেন তার সাথে মন ভরে দুটো কথা বলতে পারেনি?আজকাল তার দুষ্টু কথা গুলো খুব মনে পড়ে ওর।সাইমনকে ভীষন সুন্দর দেখাচ্ছিলো।কয়েকটাদিনে আরো বেশি সুন্দর হয়ে গেছে সে।শুধু সাঁঝ হারিয়ে গেছে তার থেকে।ভাবনার সমুদ্রে ডুবে যায় ও।সাইমনকে নিয়ে ভাবাটা এখনকার বিষয় হয়ে উঠেছে।
.......................................
ইদ্রির ঠোঁটের কোনে আলতো হাসি।তার বুকের লোম গুলো ঘন কালো।বুকের লোম এতোটা আকর্ষনীয় হয় জানাছিলো না ওর।লোমগুলোয় হাত বুলাতে বুলাতে সাঁঝের চোখ গেলো নিশাদের চেহারায়।ঘুমে অনেক মায়াবী লাগছে তাকে।ইদ্রি লোম থেকে হাত উঠিয়ে ওর কপাল স্পর্শ করে।সেখানে হাত ছুঁয়ে দিতে শুরু করে।এরই মাঝে হুমায়রা রুমে ঢুকে।ভাইয়ের সাথে ইদ্রিকে এত ঘনিষ্ট হয়ে বসতে দেখে ওর কেমন যেন লাগে।ভাই ঘুমোচ্ছে কিন্তু মেয়েটা এতো কাছে কেন?এদিকে ইদ্রি হুমায়রাকে আসতে দেখে হাত সরিয়ে নিলো।হুমায়রা একটু হেসে বলল,
''ইদ্রি তাইনা?"
ইদ্রি ও হাসে।মাথা ঝাঁকিয়ে বলল,
''জি আপু।আপনি?"
''আমি হুমায়রা।টেবিলে নাস্তা দিয়েছি খেতে এসো। "
''জি আসছি আমি।"
হুমায়রা বেরিয়ে গেলে ইদ্রি আবার ও নিশাদের কপালে হাত রাখে।এতটা সময় ওদের কথা শুনে ঘুম কিছুটা ভেঙ্গে গেছিলো নিশাদের।তবে চোখ খুলতে পারছিলোনা।ইদ্রি হাত রাখতেই আধো চোখ খুলে নিশাদ।ওর চোখজোড়া ঝাপসা হয়ে আছে।ইদ্রিকে খুব কষ্টে চিনতে পারে।মৃদু কন্ঠে বলল,
''তুৃমি এখানে?"
ইদ্রির কান্না আসতে চায়।তবুও সামলে নিয়ে বলল,
''আপনাকে দেখতে এলাম।ফোন করেছিলাম রিসিভ করেননি।"
''ইমতিয়াজ আসেনি?"
সে একই কন্ঠে নিশাদের প্রশ্ন।ইদ্রি বলল,
''না। ভাইয়া আসেনি।"
''ওহ।"
নিশাদ নিজের কপালে রাখা ইদ্রির হাত আলতো করে স্পর্শ করে বলল,
''হাতটা সরাও ইদ্রি।আমার ভালো লাগছেনা।"
ইদ্রি হাত সরিয়ে নেয়।ভীষন খারাপ লাগছে ওর।নিশাদ এতোটা অসুস্থ হয়ে গেলো ভাবতেই কান্না পাচ্ছে ওর।নিশাদ আবার ও চোখ বুজে নিয়ে বলল,
''জলদি চলে যেও বাসায়।আমি একটু সুস্থ হলে আসবো।যা করতে বলেছিলাম করে রেখো।"
ইদ্রি সামনে তাকিয়ে মাথা নিচু করে।ও এমন কথা আশা করেনি।তবে আশা করার মতো কিছু নেই।ও বেরিয়ে আসে রুম থেকে।সাঁঝ ততক্ষনে এসে গেছে।হুমায়রা সাঁঝকে ইদ্রির কথা বলেছিলো।সাঁঝ ডাইনিং টেবিলে বসে পানি পান করছিলো।নিশাদের রুমের দরজায় শব্দ হতেই পিছনে ফিরে তাকায়।ইদ্রি ও সাঁঝকে দেখে মৃদু হাসে।সাঁঝ বলল,
''তুমি ইদ্রি না?"
''জি আপু।আপনি?"
''আমি সাঁঝ।নিশাদ ভাইয়ার বোন।"
সাঁঝ নামটা শুনে ইদ্রির মুখে উজ্জ্বল হাসি ফুঁটে উঠে।সাঁঝের পাশের চেয়ারটায় বসে বলল,
''আপনাদের কথা নিশাদ ভাইয়া খুব বলে।আপনি একটা শার্ট দিয়েছিলেন।সেটা ও জানি।"
''তাই।আর কি কি জানো?"
''অনেক কিছু।স্যার আপনাদের খুব ভালোবাসে।"
সাঁঝের সাথে গল্প করতে করতে ইদ্রি খানিকটা নাস্তা খেয়ে নেয়।ওকে জলদি বেরুতে হবে।নাহলে বাসায় চিন্তা করবে।নাস্তা সেড়ে উঠে দাঁড়ায় ইদ্রি।জুলেখা বানু বললেন,
''একটু খায়া যাও মা?
ইদ্রি বিনয়ের হাসি দিয়ে বলল,
''আন্টি ঘরে জলদি ফিরতে হবে।বাসায় আব্বু আম্মু চিন্তা করবে তো।পরে আরেকদি আসবো নে।আপনার রান্না অনেক মজা।"
''তুমি খায়া গেলে খুব ভালা হইতো।"
''আরেকদিন এসে আপনার হাতে ভাত খেয়ে যাবো।"
অবশেষে বেরিয়ে গেলো ইদ্রি।যাবার আগে সবার সাথে বিদায় নিলো।শুধু নিশাদের থেকে বিদায় নিতে পারেনি।
.......................
সেলিম আহমেদ পাঁচশত টাকা নিয়ে সেই যে গেলো আর আসলোনা।আদনানের চিন্তা হচ্ছে।এটা ওর ঢাকায় ফেরার টাকা।সেলিম আহমেদ এই কোম্পানির মালিকের চামচা।তার কাছে পাঁচশত টাকা নাই শুনে বেশ অবাক লাগে আদনানের।কারন মালিক শান্ত মল্লিকের প্রায় সব কাজ সেলিম করে দেয় আর বিনিময়ে বেশ টাকা ও পায়।তার নাকি বেশ কয়েকটি ফ্ল্যাট আছে গাড়ি আছে অথচ আজ বলল পাঁচশত টাকা লাগবে তার নাকি পকেট খালি।আদনান দিয়ে দিলো।হঠাৎ সালেক এসে ওর পাশে বসে বলল,
''কি বন্ধু এখানে এমন তীর্থের কাকের মতো বসে আছো কেন?কারো অপেক্ষা?"
''হ্যা।সেলিম সাহেবের।"
''তুমি ও টাকা দিয়া ফাঁইসা গেলা নাকি?"
সালেক হাসছে।আদনান কিছুটা অবাক হয়ে সালেকের পানে চেয়ে বলল,
''মানে?কি হয়েছে?ওনি আসবে একটু পরই।"
''তুমি এই আশা রাইখোনা।বেডায় মা**চো*। এখানে আসার পর থেকে সবার কাছে থেকে টাকা নিয়া গায়েব হয়ে যায়।এখন আমি সহ আরো অনেকের সামনে আসেনা।আমার থেকে দুহাজার নিছিলো।।এখনো দেয় নাই।"
আদনান কি বলবে বুঝতে পারছেনা।ওর হাত পুরো খালি।এটাই ছিলো ওর শেষ সম্বল এখন ঘরে ফিরবে কেমন করে।সালেক বলল,
''সেলিমরে পাইলে তোমার ভাগ্য নাহলে আফসোস করো গিয়ে।"
আদনান কিছএ বলতে পারেনা।ব্যাপারটা আগে জানলে এমনটা কখনোই করতোনা।
তারপর ও আরো কিছুটা সময় অপেক্ষা করবে।তা না হলে সকালে বসকে গিয়ে বলে দিবে।প্রায় আরো একঘন্টার মতো অপেক্ষা করে আদনান কিন্তু আসেনি সেলিম।রাগে দুঃখে নিজের চুল ছিড়তে ইচ্ছে করছে।কি করে ফেললো ও?রুমে এসে শুয়ে পড়ে আদনান।যতো সময় যাচ্ছে কান্না করতে ইচ্ছে হচ্ছে ওর।তবে কাঁদবেনা।ছেলে মানুষ কাঁদেনা।বড় ভাই ও কখনো কাঁদেনি।ও নিজে ও কাঁদবেনা।
..........................
রাত দশটা।হোটেলের ব্যালকনি বেয়ে শীতল হাওয়া ভেসে আসছে।পুরো হোটেল টা বাহিরের স্নিগ্ধ বাতাসে ভরে আছে।হোটেলে রুমের বাহিরে হাঁটাহাঁটি করছে জুলি।ওর চোখে মুখে এমন ভাব যেন ঘুম পাচ্ছেনা তাই হাঁটতে বেরিয়েছে।হাঁটতে হাঁটতে একবার বিভানের রুমের সামনে এসে দাঁড়ায়।নাহ কথা বার্তা ছাড়া কোন আওয়াজ নেই।ও সরে এসে ব্যলকনিতে গিয়ে দাঁড়ায়।এদিকে বিভান আর বেলা নিজেদের কাপড় গুছাচ্ছে।পরদিন সন্ধ্যায় ওদের ফ্লাইট দিল্লী ফিরবে ওরা।কাপড় আরো আগেই গুছানো ছিলো তবে কিছু ছোটখাটো কিছু বাকি ছিলো।সেগুলো ও গুছিয়ে নেয় ওরা।
বিভান ফ্রেশ হতে যায়।বেলা আধশোয়া হয়ে সাঁঝের নম্বর চেক করে।তারপর ভাবনা চিন্তা না করে কল দেয় ও।অপরপাশ থেকে কয়েকবার রিং হওয়ার পর কল রিসিভ করে সাঁঝ।বেলার মুখে হাসি ফুঁটে উঠে।সাঁঝ বলল,
''আপা কি খবর?"
''আলহামদুলিল্লাহ তুই কেমন আছিস?"
''ভালো।ভাই কেমন আছে?"
''ভালোই।নিশাদ আর কুঞ্জন কেমন আছে।"
''ভালোই আছে।"
বেলা দীর্ঘশ্বাস ফেললো।তারপর বলল,
''ভালো কথা লুকাতে শিখে গেছিস।"
সাঁঝ কিছুটা অবাক হয়ে বলল,
''কোন কথা আপা?"
''তুই মনে কর কোন কথা।নিশাদ কুঞ্জন কে মারলো দুজন এত অসুস্থ কই একবার ও বলিস নি।কেন জানতে পারি?
সাঁঝ বলল,
''আপা এখানে থাকলে তোকে বলতাম।তাহলে তোর খারাপ লাগলে ও আমাদের সাথে শেয়ার করতে পারতি।সত্যি লুকানোর জন্য না বলিনি।"
''বড় হয়ে গেলি অনেক।আব্বা আম্মা কেমন আছেন?"
''এইতো।তোরা দিল্লী কবে যাচ্ছিস?"
''কাল সন্ধ্যায় ইনশাআল্লাহ। "
''হুম।"
সাঁঝের কথা গুলো স্বাভাবিক লাগছেনা।সাঁঝ তেৃন কোন কথা ও বলছেনা। বেলা জিজ্ঞেস করলো,
''তুই ঠিক আছিস?কথা গুলো স্বাভাবিক না।কি হলো?"
''না আপা ঠিক আছি।"
''মনে হয়না।"
''আপা সত্যি মাথা খুব ব্যাথা। তাই কথা কম বলছি।"
''ঠিক আছে।তাহলে ঘুমা।আমি ও ঘুমাবো।"
সাঁঝ ফোন রেখে মন করে বসে থাকে।আসলেই মন টা খুব বেশি খারাপ।সাইমনের নম্বরটা আরো একবার চেক করে সাঁঝ।লোকটা কল দেয়নি এখনো।আর কি দেবে সে?হয়ত ভুলেই গেছে সাঁঝকে।