মেঘের খামে অনুভূতি (অন্তিম পর্ব ২৫)


আরশি নূপুরের গালে শব্দ করে চড় মেরে বলল,
'তোমাকে জীবনের কাছে পাঠিয়েছিলাম ঐ মেয়েকে জীবনের লাইফ থেকে বের করতে। তুমি কি করলে? উল্টো ওদের মিলিয়ে দিয়ে চলে আসলে!'
নূপুর আরশির হাত ধরে বাকিয়ে পেছনের দিকে চেপে ধরলো। আরশি আহ বলে চিৎকার করলো। নূপুর ওর কানের কাছে গিয়ে দাঁতে দাঁত চেপে বলল,
'ভেবো না আমি অবোলা নারী। তোমরা বাবা মেয়ে মিলে আমাকে যেভাবে নাচাবে আমি সেভাবেই নাচব। মাঝখানে আমি তোমাদের ফাঁদে পড়ে গিয়েছিলাম। একটু দুর্বলও হয়ে গিয়েছিলাম। তাই বলে এই না যে,তুমি আমার গায়ে হাত তুলতে পারবে। আমাকেও তুমি চেনো না আরশি। দরকার পড়লে আমি তোমার এই হাত ভেঙে দিতেও পারি।'
'নূপুর ছাড়ো। লাগছে আমার।'
'লাগুক না। একটু কষ্ট পেয়ে দেখো। তুমি আমকে জীবনের কাছে পাঠাও নি। আমি নিজেই ওর কাছে ফিরতে চেয়েছিলাম। কিন্তু 
আরশি নূপুরের থেকে নিজেকে ছাড়িয়ে নিয়ে দাঁড়াল। হাত ডলতে ডলতে নূপুরের দিকে তাকালো। 
'জীবন আমাকে পাগলের মত ভালোবাসতো। আমাকে ছাড়া ও এক মুহূর্তও থাকতে পারতো না। সেই জীবন আমাকে ফিরিয়ে দিয়েছে শুধুমাত্র স্পৃহার জন্য। তোমাকে তো জীবন কখনো ভালোই বাসে নি। তাহলে তুমি কীভাবে ওর কাছে যাবে? স্পৃহার সামনে জীবন আমাকে বেছে নেয় নি। তোমাকে নিবে সেটা তুমি ভাবো কীভাবে? জীবন এখন শুধু একজনকেই ভালোবাসে। আর সে হলো স্পৃহা। তুমি চাইলেও কখনো জীবনকে পাবে না। তাই বলছি ভালোই ভালোই ওদের থেকে দূরে সরে আসো।'
'তুমি আমাকে ধমকি দিচ্ছ।'
'না। শুধু বলে দিচ্ছি। তুমি হাজার চেষ্টা করেও ওদের আলাদা করতে পারবে না। আমি তো আমার নিজের ভুলের জন্য জীবনকে হারিয়েছি। কিন্তু জীবন কোনো ভাবেই স্পৃহাকে হারাবে না। '
কথাগুলো বলে নূপুর চলে গেলে ঠিক জায়গায় দাঁড়িয়ে আরশি ফুঁসতে লাগলো।
'আমার গায়ে হাত দেয়া, না? এর শোধ তো আমি নিবোই। তুই জীবনকে হারিয়েছিস এখন তুই সব হারাবি। সব। তোকে দেখিয়ে দিব এই আরশি কী কী করতে পারে।'

কলিং বেল বাজলে স্পৃহা ঘর থেকে বেরিয়ে এলো। তার জিনিসপত্র জীবনের রুমে নেওয়া হয়েছে কাল রাতে। স্পৃহা সেগুলোই গোছাচ্ছে। 
'এই সময়ে কে এলো? উনি তো এখন। এতো তাড়াতাড়ি তো ফিরে আসার কথা না।'
স্পৃহা গিয়ে দরজা খুলে দিলো। সাথে সাথেই জীবন ভেতর ঢুকে স্পৃহাকে জড়িয়ে ধরলো। চোখের পলকে এমন কিছু হবে স্পৃহা ভাবে নি। সে ভয় পেয়ে গিয়ে বলল,
'আপনি এই সময়ে? এতো তাড়াতাড়ি ফিরে এলেন যে?'
'বৌয়ের কথা মনে পড়লে কি আর অফিসে বসে থাকতে ভাল্লাগে বলো?'
'মশাই কাজ কর্ম বাদ দিয়ে বৌ নিয়ে বসে থাকলে চলবে? '
'শুধু চলবে কি, দৌড়াবে। আমার বাবা এতো কিছু রেখে গেছে তা শুধু আমি কেন আমার ছেলে মেয়েরাও খেয়ে শেষ করতে পারবে না।'
'আমার শ্বশুর আব্বা উনার ছেলে নাতি নাতনিদের জন্য এতো কিছু রেখে গেছেন। তাহলে আপনি আপনার ছেলে মেয়ে নাতি নাতনিদের জন্য রেখে যাবেন না।'
'আগে তো ছেলে মেয়ে আসুন। তারপর নাহয় নাতি নাতনির চিন্তা করবো। এখন পর্যন্ত তো নিজের ছেলেপুলেই এলো না। তুমি এখনই তাদের ছেলেপুলের চিন্তা করছো।'
স্পৃহা লজ্জা পেয়ে মাথা নামিয়ে নিলো। জীবন স্পৃহার গালে পরপর কয়েকটা চুমু দিয়ে বলল,
'সারাদিন অফিসে বসে থাকলে ছেলেপুলে নাতি নাতনি আসবে কোত্থেকে বলো তো? তুমি কেমন বৌ আমার। বরকে একটুও ভালোবাসো না। অন্য লোকের বৌয়েরা কোথায় তাদের বরকে তাড়াতাড়ি বাসায় ফিরতে বলে। আর আমি তাড়াতাড়ি বাসায় ফিরে এলে তুমি জিজ্ঞেস করো এতো তাড়াতাড়ি চলে এলেন কেন? আন-রোমান্টিক বৌ আমার।'
জীবন স্পৃহার গলায় নেমে এলে স্পৃহা তাকে সরিয়ে বলল,
'সরুন তো। অফিস থেকে ফিরে চেঞ্জ করতে হয় না আপনার? ইস কি বিশ্রী গন্ধ আসছে শরীর থেকে। ছাড়ুন আমাকে আগে গিয়ে ফ্রেশ হয়ে চেঞ্জ করে আসুন। তারপর বৌকে আদর করবেন।'
স্পৃহা নাক কুঁচকে হেসে ফেললো। জীবন বলল,
'তবে রে! দাঁড়াও দেখাচ্ছি তোমাকে। আমার সাথে মজা নেওয়া হচ্ছে না?'
জীবন স্পৃহার দিকে এগোতে নিলে স্পৃহা পিছিয়ে যেতে যেতে বলল,
'এইযে একদম এগোবেন না। ওখানেই দাঁড়ান। কাছে আসবেন না বলছি। '
জীবন হাসতে হাসতে বলল,
'না না। একদম কাছে এগোবো না। আমি তো দাঁড়িয়েই আছি। এই দেখো দাঁড়িয়ে আছি তো।'
স্পৃহা দৌড় দিলো। জীবন তার পেছনে দৌড়াতে দৌড়াতে বলল,
'কি গো বৌ দৌঁড়ে পালালে কেন? দাঁড়াও না। এই বৌ,,, কোথায় যাবে তুমি? তোমাকে তো আজ এতো সহজে ছাড়ছি না। তোমাকে আমি 
স্পৃহা গিয়ে ঘরে দরজা দিলো। জীবন দরজার ধাক্কা দিতে দিতে বলল,
'স্পৃহা ভালো হবে না কিন্তু। একবার হাতের কাছে পেলে তখন কিন্তু আর ছাড়া পাবে না।'

রাতে দু'জন এক সাথে বসে খাওয়া শেষ করলো। টুকটাক কথা বলতে বলতেই স্পৃহা খাবার টেবিল গুছিয়ে নিলো। জীবন উঠে স্পৃহার পেছন পেছন কিচেনে গেল। রুমে অনেকক্ষণ ধরে ফোন বাজছে। স্পৃহা জীবনকে বলল,
'ফোন তুলছেন না কেন? কতক্ষণ ধরে রিং হচ্ছে।'
'তুমি জানো স্পৃহা এই ফোন আমার সবচে বড় শত্রু। যতবার তোমার কাছে গেলাম ততবারই এই ফোন বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে। আমার তো ইচ্ছে করছে পৃথিবী থেকে ফোনের ব্যবহার তুলে দেই। সব সময় আমার রোমান্সের মুডের তেরোটা বাজায়।'
'হুম বুঝেছি। এবার গিয়ে ফোন ধরুন। জরুরি কল হয়তো। দেখছেন না বারবার কেটে যাবার পরেও কল করছে।'
'হুম যাচ্ছি। '
ফোন তোলার ইচ্ছা না থাকলেও জীবনের যেতে হলো।
'রামিম ভাইয়া! শালার এখনো তো দেখছি ভাইয়াও আমার পেছনে পড়েছে।'
জীবন ফোন তুলে বলল,
'হ্যা ভাইয়া 
জীবন কথা শেষ করার আগেই ওপাশে রামিমের ভীত গলা শোনা গেল।
'কোথায় ছিলি তুই? কতক্ষণ ধরে তোকে ফোনে ট্রাই করছি। কি করছিলি?'
'কি হয়েছে ভাইয়া? শান্ত হও তুমি। তোমার গলা এমন শোনাচ্ছে কেন? কোনো সমস্যা হয়েছে? '
'প্রভার পেইন হচ্ছে। আমি কি করবো কিছুই বুঝতে পারছি না। ওকে হসপিটালে নিয়ে যাব। কাকে জানাবো। কি করবো কিছুই বুঝতে পারছি না। আমার এই সময়ে তোকে আমার পাশে চাই ভাই। তুই যত তাড়াতাড়ি সম্ভব চলে আয়। আমার মাথা কাজ করছে না। প্রভার ভীষণ কষ্ট হচ্ছে। আমি ওর কষ্ট সহ্য করতে পারছি না জীবন।'
জীবনের এখন নিজের উপরই রাগ হচ্ছে। রামিম ভাইয়া সব সময় তার পাশে থেকেছে। আর আজ রামিম ভাইয়ার এমন একটা দিনে সে পাশে নেই। ফোনও তুলে নি। 
'আমি এক্ষুনি আসছি ভাইয়া। এইতো দুই মিনিটের ভেতর আসছি। তুমি ভাবীর পাশে থাকো। কোনো চিন্তা করবে না। সব ঠিক হয়ে যাবে। এম্বুলেন্স কল করেছ?'
'হ্যা কিন্তু ওরা এখনো এম্বুলেন্স নিয়ে আসছে না।'
'ওকে। আমি গাড়ি নিয়ে আসছি। গাড়ি করেই ভাবীকে নিয়ে হসপিটালে যাব। তুমি ধৈর্য রাখো। আসছি আমি।'
'তাড়াতাড়ি আয় ভাই।'
'হ্যা হ্যা আসছি।'
ফোন রেখে জীব স্পৃহাকে ডাকলো। 
'স্পৃহা আমি বের হচ্ছি।'
স্পৃহা রুমে এসে বলল,
'কোথায় যাচ্ছেন?'
'ভাবীর পেইন হচ্ছে। ভাইয়া কি করবে বুঝতে পারছে না। ভাবীকে নিয়ে হসপিটালে যেতে হবে।'
'আমিও যাব প্লিজ। '
'যাবে? তাহলে চলো। লেট করো না। আমাদের যত তাড়াতাড়ি সম্ভব ওখানে পৌঁছুতে হবে।'
জীবন ড্রাইভ করছে। রামিম স্পৃহা প্রভার পাশে বসে আছে। স্পৃহার কোলে প্রভার মাথা রাখা। স্পৃহা বলছে, 
'কাঁদবেন না ভাবী। এইতো আমরা হসপিটালে চলে এসেছি। কিছু হবে না আপনার। সব ঠিক হয়ে যাবে। একটু ধৈর্য ধরুন। ভাবী আল্লাহকে ডাকুন। উনিই সব ঠিক করে দিবেন।'
রাত দশটায় প্রভা ছেলে সন্তান জন্ম দিলো। ফুটফুটে ছোট বাচ্চা প্রভার কোল আলো করে এই দুনিয়াতে এলো। রামিম ছেলেকে দেখে সাথে সাথে নার্সকে জিজ্ঞেস করলো,
'আমার ওয়াইফ কোথায়? ও ঠিক আছে তো?'
'জি উনি ঠিক আছেন। উনাকে ক্যাবিনে শিফট করা হয়েছে। আপনারা এখন উনার সাথে দেখা করতে পারেন।'
রামিম দৌঁড়ে প্রভার কাছে চলে গেল। স্পৃহার কোলে ছোট বাচ্চা। স্পৃহা ওকে কোলে নিয়ে পাথর হয়ে গেল। অন্য রকম একটা অনুভূতি কাজ করছে তার মাঝে। মা হওয়ার আনন্দ যেন সেও অনুভব করতে পারছে। জীবন স্পৃহার পাশে এসে দাঁড়াল। স্পৃহার ঠোঁটে হাসি। কিন্তু হাত কাঁপছে। জীবন বাবুর দিকে তাকালো। নিস্পাপ একটা শিশু খুঁটিয়ে তাকে দেখছে। জীবন স্পৃহার কানের কাছে গিয়ে ফিসফিস করে বলল,
'আমারও এমন একটা ফুটফুটে মেয়ে চাই স্পৃহা। আমরাও এমন একটা বাচ্চার বাবা মা হবো।'
স্পৃহা জীবনের মুখের দিকে তাকিয়ে হেসে তার বুকে হেলান দিয়ে দাঁড়াল। 

রায়হান নূপুরের ব্যাপারে সবকিছু জেনে গেছে। নূপুর আগে একটা ছেলেকে ভালোবাসতো। আর সেই ছেলের জন্যই কিছুদিন আগেই বাড়ি ছেড়ে চলে গিয়েছিল। এটা জানার পর রায়হানের বাবা মা নূপুরের বাসায় এসে ওর বাবা ভাইদের অনেক কথা শুনিয়ে যায়। নূপুরের সামনেই ওর বাবা মা'কে অপমান করে। এনগেজমেন্ট ভেঙে দিয়ে আংটি ফেরত দিয়ে যায়। 
ওরা চলে যাবার পর নূপুরের বড় ভাই নূপুরের সামনে এসে দাঁড়িয়ে বললেন, 
'আজ খুশি হয়েছিস তো তুই? এবার তোর মন ভরেছে? লোকে আমাদের বাসায় এসে তোর জন্য আমাদেরকে অপমান করে যায় এটা দেখে তোর মনে শান্তি হচ্ছে তো? ছোট থেকে এতো ভালোবাসা দিয়ে তোকে বড় করার এটাই প্রতিদান দিলি আমাদের। আমরা এটারই যোগ্য ছিলাম।'
নূপুর ভাইয়ের কথা শুনে কাঁদছে। ভাইয়া চলে গেলে ভাবীও আজ তাকে কথা শোনাতে পিছুপা হলো না।
'কখনো তোমাকে ননদ মনে করিনি। সব সময় নিজের ছোট বোনের মত দেখেছি। তোমার সব আবদার পূরণ করার চেষ্টা করেছি। শেষে তুমি আমাদের সাথে এমনটা করলে? আরে নিজের কথা না-ই বা ভাবতে। একবার তোমার ভাইদের কথা তো ভাবতে পারতে। ওরা সবাই তোমাকে কতটা ভালোবাসে তা জানো তুমি? তোমার জন্য আজ বাইরের মানুষ ওদেরকে অপমান করে চলে গেল। ওরা কতটা কষ্ট পেয়েছে বুঝতে পারছো তুমি? তোমার মত মেয়ের সত্যিই বেঁচে থাকার কোনো অধিকার নেই।'
'ভাবী!'
ভাবীও চলে গেল। নূপুর রুমে গিয়ে দরজা লাগিয়ে দিলো।
প্রভার বাচ্চাকে দেখার জন্য তার শাশুড়ি আর আরশি এসেছে। তার শ্বশুর আসেনি। জীবন আর স্পৃহাও এসেছে। আজ সবাই অনেক খুশি। তবে আরশি স্পৃহা আর জীবনকে একসাথে দেখে খুশি হতে পারছে না। এখানে আসার পর থেকেই স্পৃহা বাবু কোলে নিয়ে বসে আছে। প্রভা বলল,
'কি বাচ্চাদের অনেক ভালোবাসো মনে হচ্ছে। তা নিজেরা কবে একটা বাচ্চা নিবে? আমাদেরও তো চাচা চাচী হতে ইচ্ছে করে বলো।'
স্পৃহা লজ্জা পেয়ে বলল,
'আল্লাহ চাইলে খুব শীঘ্রই হতে পারবেন ভাবী।'
'সত্যি বলছো? মেয়ে হলে কিন্তু আমার দেওয়া নাম রাখতে হবে। নাহলে আমি খুব রাগ করবো।'
স্পৃহা হেসে মাথা নাড়িয়ে বলল,
'আচ্ছা। '
রামিম আরশির সাথে কথা বলার জন্য সুযোগ খুঁজছে। এতক্ষণে সে সুযোগ পেয়েও গেল। আরশিকে টেনে ব্যালকনিতে নিয়ে এলো। এদিক টায় কেউ নেই। 
'কি হয়েছে ভাইয়া আমাকে এভাবে টেনে নিয়ে এলে কেন? এখানে আমার কি কাজ?'
'তোকে একটা কথা বলব আরশি। তুই আমার বোন হতে পারিস ঠিকই। কিন্তু কখনো তুই আমাকে ভাই মনে করিস নি। তুইও বাবার মতই হয়েছিস।'
'এসব কি বলছো ভাইয়া? আমি বোন হয়ে ভাইকে ভাই মনে করি না? তুমি বলতে চাইছো আমি তোমাকে ভালোবাসি না?'
'ভালোবাসিস কি বাসিস না তা তুই জানিস। আমি কিন্তু তোকে সত্যিই অনেক ভালোবাসি রে। তাই ভাইয়ের অধিকার নিয়ে তোর সামনে দাঁড়িয়েছি। তোকে কিছু কথা বলতে চাই। '
'বলো কি বলবে।'
'জানি না তুই কি চাস। বা কি করছিস। আমি এটুকু জানি তুই জীবনকে পছন্দ করিস। কিন্তু আরশি দেখ জীবনের তো বিয়ে হয়ে গেছে। সে এখন স্পৃহার স্বামী। তুই চাইলেও আর জীবনকে পাবি না। তাই তোর কাছে আমার একটা অনুরোধ তুই জীবনকে ভুলে যা। ওদের জীবন থেকে দূরে সরে যা। জীবন আর স্পৃহাকে একসাথে ভালো থাকতে দে।'
আরশি বুঝতে পারছে না সে কি বলবে। রামিম আবার বলল,
'এসব করে তুই শুধু কষ্টই পাবি। এভাবে জোর করে কারো ভালোবাসা পাওয়া যায় না। কখনো কেউ কাউকে জোর করে পেয়েছে? শুনেছিস কখনো? তুইও এসব করে জীবনকে পাবি না। অবশেষে দেখবি তোর পাশে কেউ নেই। তোর কাছের মানুষ গুলো তোকে ভুল বুঝে ছেড়ে চলে যাবার আগে তুই নিজেকে শুধরে নে বোন।'
'ভাইয়া আমি
'তুই যার কথায় এসব করছিস তাকে আমি খুব ভালো করে চিনি। যে নিজের স্বার্থের জন্য নিজের ভাইকে পর্যন্ত ছাড়েনি। সে কিকরে তোর ভালো চাইবে বল?'
'বাবা ছোট চাচাকে
আরশি কথা শেষ করার আগেই বলল,
'তুইও জেনে রাখ আমাদের বাবা কেমন। অবশ্য ঐ লোকটাকে বাবা বলতে এখন আমার ঘৃণা লাগে। ও কারো বাবা ডাক শোনার যোগ্য না।'
'আমি কিছুই বুঝতে পারছি না ভাইয়া। '
'আমার কথা শুনলে সব বুঝবি। আমাদের বাবা নামের ঐ লোকটা জীবনকে এতিম করেছে। জীবনের বাবা মা,,, ওই লোকটা তার নিজের ভাই আর ভাইয়ের বৌকেও মার্ডার করেছে।'

আরশি দেয়াল ধরে দাঁড়িয়ে গিয়ে বলল,
'কি বলছো তুমি এসব ভাইয়া? '
'হুম। ঐ লোকটা জীবনকে মারতে চেয়েছিল। চাচা চাচীর একমাত্র সন্তান ছিল জীবন। চাচার সবকিছু জীবন পাবে। সেটা ভেবেই জীবনকে সরিয়ে দিতে চেয়েছিল। সেদিন জীবনের গাড়ির ব্রেক কেটে রেখেছিল। ভাগ্যক্রমে সেদিন জীবন গাড়ি নিয়ে বের হয়নি। জীবন বাইক নিয়ে বের হয়ে যায়। আর গাড়ি নিয়ে চাচা চাচী বের হয়। বাবার এমন একটা নোংরা প্ল্যানে জীবনের কিছু না হলেও ওর বাবা মা দুনিয়া ছেড়ে চলে যায়। জীবনের সাথে এসব কিছু ঘটার পেছনে বাবার হাত আছে আরশি। তুই কীভাবে এই লোকের কথায় এসে জীবনের সুখ নষ্ট করতে চাইছিস?'
আরশির হাত পা কাঁপছে। সে এসব শুনে আর দাঁড়িয়ে থাকতে পারলো না। ধপ করে নিচে বসে পড়লো। আরশির চোখ বেয়ে টপটপ করে পানি পড়ছে। 
'বাবা! আমাদের বাবা চাচা চাচীকে মেরে ফেলেছে? বাবা কাউকে খুন করেছে? বাবা এমনটা করতে পেরেছে ভাইয়া?'
'তুই জানিস না। কিন্তু আমি জানি এই লোক নিজের স্বার্থের জন্য সব করতে পারে সব।'
'আমি বিশ্বাস করতে পারছি না ভাইয়া। বাবা কীভাবে জীবনের সাথে এমন করার কথা ভাবতে পারে। বাবা কীভাবে এতটা নিচে নামতে পারে? আমাদের বাবা এমন না ভাইয়া। তুমি মিথ্যা বলছো তাই না ভাইয়া? সত্যি করে বলো না ভাইয়া তুমি এসব মিথ্যে বলেছ।'
রামিম আরশির মনের অবস্থা বুঝতে পেরে তার পাশে বসে বলল,
'সত্য মেনে নে বোন। আমাদের বাবা এমনই। ওকে বাইরে থেকে যেমন দেখা যায়। ও ভেতর থেকে মোটেও তেমন না। ও তোকেও ব্যবহার করছে। আমি কেন এতো বছর ধরে তোদের ছেড়ে আছি? কেন আমি বাড়ি ছেড়ে চলে এসেছি? প্রভার জন্য? না রে বোন। আমি প্রভার জন্য তোদের ছেড়ে আসি নি। ঐ লোকের সম্পর্কে সব জেনেও আমি কীভাবে ওর সাথে একই ছাঁদের নিচে থাকতাম বল তো? ওকে দেখলে আমার রাগ হতো। জীবনের কষ্ট দেখলে ইচ্ছে করতো ঐ লোকটাকে আমি মেরে দেই। জীবন ওর বাবা মা'কে হারিয়ে অনেক কষ্ট পেয়েছে। জীবনটা পুরোপুরি একা হয়ে গেছে। ওকে দেখলে আমার নিজেকে অপরাধী মনে হয়। কারণ আমিও তো ঐ লোকেরই অংশ। আজও আমি জীবনকে কিছু জানাতে পারিনি। ভয় হয় আমার। জীবনের সামনা করার মত এতো সাহস আমার নেই। জীবন ওর বড় আব্বুকে পছন্দ করে না এটা সত্য। কিন্তু ও হয়তো কখনো ভাবেও নি, ওর বড় আব্বু ওকে মারতে চাইবে। ওর বাবা মা'কে মারবে। এসব জানলে জীবন বেঁচে থাকার শক্তিই হারিয়ে ফেলবে।'
'তুমি সব জেনেও কেন ঐ লোকটাকে শাস্তি দাও নি ভাইয়া? কেন ওকে ছেড়ে দিয়েছ? এতো জঘন্য কাজ করার পরেও ও কেন খোলা হাওয়ায় ঘুরছে। কেন ওকে জেলে দাও নি? কেন ভাইয়া? কেন? '
আরশি আর ভাইয়ের বাসায় থাকতে পারলো না। দূর থেকে জীবনকে দেখে কষ্টে তার বুক ফেটে যাচ্ছে। আরশি বাসায় চলে এলো। সোজা বাবার ঘরে চলে গেল। আনোয়ার হোসেন আরশিকে দেখে বলল,
'ভাইয়ের ছেলেকে কেমন দেখলে?'
'ভাইয়ের ছেলের সাথে আজ অন্য একজনের আসল চেহারাও দেখে এলাম বাবা। উপস্ সরি তোমাকে বাবা ডেকে ফেললাম। ভুলেই গিয়েছিলাম। তুমি তো কারো মুখ থেকে বাবা ডাক শোনার যোগ্যই না।'
আনোয়ার হোসেন আরশির কথা শুনে থতমত খেয়ে উঠে দাঁড়ালেন। আরশি বলল,
'উঠছো কেন? বসো বসো। আমি আরো যা যা বলবো তা শোনে তুমি দাঁড়িয়ে থাকতে পারবে না। দাঁড়ানোর শক্তি হারিয়ে ফেলবে তুমি। আজ জেনেছি তুমি একটা খুনি। তুমি নিজের আপন ভাই আর তার বৌকে খুন করেছ। কীভাবে তুমি এতটা নিচে নামতে পারলে? তুমি জীবনের সম্পত্তি পাবার জন্য আমাকে ইউজ করছো? তুমি ভেবো না আমি ভাইয়ার মত চুপ করে থাকবো। তুমি যদি জীবনের চুল পরিমাণ ক্ষতিও করো বা ওর ক্ষতি কথা চেষ্টাও করো তাহলেও আমি পুলিশকে সব বলে দিব। আমি তোমাকে জেলে দিব মনে রেখো আনোয়ার হোসেন। তুমি এসব কার জন্য করছো? এই সম্পদ এসব কার জন্য? তোমার নিজের ছেলে মেয়ের জন্যই তো। তুমি নিজের ছেলে মেয়ের কথা ভাববে শুধু? তোমার ভাইয়ের ছেলে আর তোমার ছেলের মধ্যে পার্থক্য কি বলো তো বাবা? আমরা সবাই তো একই রক্তের। আমি আর ভাইয়া তো এসব চাই না বাবা। তবুও কেন তুমি এসব করছো? আমরা কি কখনো সবাই সাথে মিলেমিশে একসাথে থাকতে পারবো না বাবা? '
কাঁদতে কাঁদতে আরশি ফ্লোরে বসে পড়লো। আনোয়ার হোসেন চেহারা শক্ত করে দাঁড়িয়ে আছেন। ফরিদা দরজার সামনে দাঁড়িয়ে আরশির সব কথাই শুনলো। তিনি মুখে আঁচল চেপে ধরে দরজার আড়ালে চলে গেলেন। এখানে দাঁড়িয়ে নিঃশব্দে কাঁদতে থাকলেন। 
পরের দিন সকালেই আরশি মা'কে নিয়ে ভাইয়ের কাছে চলে গেল। যাবার আগে বাবাকে বলে গেল,
'তুমি কখনো আমাদের চাও নি। তুমি টাকাপয়সা বিষয়সম্পত্তি চেয়েছ। তাই আজ তোমার কাছে এসবই থাকলো। তোমার আপন জনেরা কেউ তোমার কাছে নেই। তোমার চারপাশে একবার তাকিয়ে দেখ। তুমি পুরোপুরি একা হয়ে গেছ। কেউ নেই তোমার সাথে। এটাই তোমার জন্য সবচেয়ে বড় শাস্তি। সারাজীবন তোমাকে একাই থাকতে হবে। তোমার মত মানুষের সাথে থাকাও কারো জন্য অভিশাপ।'

স্পৃহার চোখ বাধা। জীবন তাকে যেন কোথায় নিয়ে যাচ্ছে। স্পৃহা বলল,
'আমার চোখ এভাবে বেঁধে রেখেছেন কেন? আর আপনি আমাকে কোথায় নিয়ে যাচ্ছেন?'
'তুমি এতো প্রশ্ন করো কেন? কোথায় নিয়ে যাচ্ছি তা সেখানে গেলেই তো দেখতে পারবে।'
'কিন্তু আপনি বলবেন তো। 
'চুপ। আর কোনো কথা না। এসে গেছি।'
জীবন দরজা খুলে দিয়ে স্পৃহাকে নিয়ে ভেতরে ঢুকলো। স্পৃহার চোখে বাধা কাপড়টও খুলে দিলো। স্পৃহা চোখে হাত দিয়ে বলল,
'কিছুই তো দেখতে পারছি না।'
'ওয়েট। লাইট না জ্বালালে দেখবে কি করে? আগে তো আলো জ্বালিয়ে নিই।'
জীবন সুইচ দেওয়ার সাথে সাথে পুরো ঘর আলোয় ঝলমল করতে লাগলো। নীল রঙের ছোট ছোট আলো জ্বলছে চারদিকে। স্পৃহা অবাক হয়ে জীবনের দিকে তাকিয়ে বলল,
'এসব কি!'
'সারপ্রাইজ। ভেতরে চলো আরো অনেক কিছু আছে।'
জীবন স্পৃহাকে নিয়ে এগিয়ে যেতে লাগলো। গোলাপের পাঁপড়ি বিছানো পথ। তার মাঝ দিয়ে হেঁটেই ওরা এগোচ্ছে। রুমের ভেতর কোনো লাইট নেই। পুরো রুমেই ছোট বড় মোমবাতি জ্বলছে। স্পৃহার পছন্দের সব ফুল দিয়ে রুমটা সাজানো হয়েছে। বিছানায় লাল গোলাপের পাঁপড়ি দিয়ে হার্ট বানানো। 
'এসব,,,এসব কি?'
'বলেছি না সারপ্রাইজ। এটা আমাদের বাসর ঘর। তোমার মনে নেই বিয়ের দিন আমাদের বাসর ঘর সাজানো হয়নি। আজ পর্যন্ত তো বাসরই করতে পারলাম না।'
'আপনি এসব কখন করেছেন? '
'সারাটা দিন কি এমনি এমনি তোমাকে খালামণির বাসায় থাকতে দিয়েছি? '
'ওহ তাহলে আমাকে ওখানে পাঠিয়ে আপনি এসব করেছেন? '
'জি ম্যাডাম। আপনি বাসায় থাকলে তো এসব করতে পারতাম না।'
স্পৃহা খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে ঘর সাজানো দেখছে। জীবন স্পৃহার পেছনে ঘেঁষে দাঁড়িয়ে জিজ্ঞেস করলো,
'পছন্দ হয়েছে? '
'হুম। খুব পছন্দ হয়েছে। '
'আমার মিসেসের পছন্দ হলেই আমার কষ্ট সার্থক।'
স্পৃহা আরো কিছু বলতে যাচ্ছিল। তার আগেই জীবন তাকে কোলে তুলে নিলো। 
'করছেন কি! কোলে তুলে নিলেন কেন? '
'এখানে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে গল্প করে টাইম ওয়েস্ট করবো নাকি? এতো কষ্ট করে সব এরেঞ্জড করেছি শুধু দেখার জন্য?'
'তাহলে? '
'আজ তোমাকে নিয়ে ভালোবাসার নতুন অধ্যায় রচনা করবো।'
বলেই জীবন দুষ্টু হাসি দিলো। স্পৃহা জীবনের গলা জড়িয়ে ধরে লজ্জা পেতে তার বুকে মুখ লুকালো। জীবন স্পৃহাকে কোলে নিয়ে বেডের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। 

সকালে স্পৃহার আগে জীবনের ঘুম ভেঙে যায়। জীবন পলক হীন দৃষ্টিতে স্পৃহার মুখের দিকে তাকিয়ে আছে। গতরাতের কথা ভেবে জীবন একটু হাসলো। কত শান্তিতেই না তার বুকে মাথা রেখে ঘুমিয়ে আছে মেয়েটা। এভাবে বেশিক্ষণ স্পৃহার দিকে তাকিয়ে থাকতে পারলো না জীবন। তার ফোন বেজে উঠলো। স্পৃহার ঘুম ভেঙে যাবে ভেবে জীবন আলতো করে স্পৃহার মাথা বালিশের উপর রেখে উঠে গেল। খুব সাবধানে ফোন হাতে নিয়ে জানালার কাছে চলে এলো।
'জয় বল।'
'কোথায় তুই? '
'এতো সকালে আর কোথায় থাকব? বাসায়।'
'বিশ মিনিটের ভেতর একটু আসতে পারবি?'
'হ্যা। কিন্তু কি হয়েছে বলবি তো।'
'তুই আয় তারপর দেখতে পারবি।'
জীবন বেডের কাছে গিয়ে স্পৃহাকে দেখলো। ফ্লোর থেকে শার্টটা কুড়িয়ে নিয়ে গায়ে পড়ে নিলো। স্পৃহাকে ঘুরে রেখেই বেরিয়ে গেল সে।
'কি হয়েছে বল।'
'কাল রাতে নূপুর সুইসাইড করার চেষ্টা করেছে। '
'বলিস কি? এখন কেমন আছে? আর এই কথা তোকে কে বললো?'
'এখন ভালো আছে। জীবন আমি একটা সিদ্ধান্ত নিয়েছি।'
'কি সিদ্ধান্ত বল।'
'আমি নূপুরকে বিয়ে করবো। '
'মানে? কি বলছিস তুই? নূপুরের তো এনগেজমেন্ট হয়ে গেছে। তাহলে তুই কীভাবে ওকে বিয়ে করবি।'
'নূপুরের এনগেজমেন্ট ভেঙে গেছে। রায়হান ওকে বিয়ে করবে না বলে দিয়েছে।'
'তুই এসব জানলি কীভাবে? '
'যেভাবেই জানি তা দিয়ে তোর কাজ নেই। এখন নূপুর হসপিটালে আছে। আমি আজই বাড়িতে আমাদের বিয়ের কথা বলবো।'
'কিন্তু নূপুর রাজি হবে তো? আর তুই তো ওকে ভালোবাসিস না।'
'বিয়ের পর সব ঠিক হয়ে যাবে। এক সাথে থাকতে থাকতে আস্তে আস্তে ভালোবাসাও তৈরি হয়ে যাবে।'
'তুই কি এসব আমাদের জন্য করছিস? মানে স্পৃহার কথা ভেবে? '
'আরে নাহ। নূপুর মেয়েটা তোকে ভালোবেসেছে। তার বিনিময়ে তোর ভালোবাসা চেয়েছে। কিন্তু কারো বানানো প্ল্যানে ফেঁসে গিয়ে সে তোকে হারিয়ে ফেলেছে। এখন পরিবার আপন জনও তাকে অপরাধী ভাবছে। মেয়েটা সত্যিই কষ্ট পাচ্ছে রে। ভালোবাসা ছায়া তো ও অন্য কিছু চায় নি। আমি ওকে বিয়ে করে সুখে রাখতে চাই। দেখ অন্য কারো সাথে আমার কখনো ভালোবাসার সম্পর্ক তৈরি হয়নি। তাই নূপুরকে ভালোবাসতে আমার তেমন অসুবিধা হবে না। আমি ওর সাথে মানিয়ে নিতে পারবো। '
জয় মুখে যত কিছুই বলুক না কেন জীবন জানে জয় এসব স্পৃহার জন্য করছে। নূপুরের এই অবস্থা দেখে জীবন নিজেকে অপরাধী ভাববে। আর তা দেখে স্পৃহাও কষ্ট পাবে। সবার খুশির কথা ভেবেই জয় এই সিদ্ধান্ত নিয়েছে। নিজের কথা একটি বারও ভাবেনি সে।

দুই সপ্তাহ পরে বাড়ির সবার অনুমতি নিয়ে খুব ধুমধাম করে জয় আর নূপুরের বিয়ে হলো। নূপুরও আগের কথা ভুলে যাবার চেষ্টা করছে। সব মানুষের জীবনেই একটা কষ্টকর অতীত থাকে। নূপুর ভাগ্যকে মেনে নিয়ে জয়কে মন থেকে স্বামী হিসেবে মেনে নিয়েছে। তার ভাগ্যে জীবন না, জয় লিখা ছিল। এতকিছুর পর নূপুর এটা বুঝে গেছে এই লোকটা তাকে কখনও কষ্ট পেতে দিবে না। সব সময় তার পাশে থাকবে। 
আট মাস পর, 
জীবন স্পৃহা, জয় নূপুর, মারিয়ার বাবা মা সোম সবাই অপারেশন থিয়েটারের সামনে দাঁড়িয়ে আছে। মারিয়াকে ভেতরে নেওয়া হয়েছে। আজ ওর ডেলিভারির ডেট। সোম ছটফট করছে। এক জায়গায় দাঁড়িয়ে থাকতে পারছে না। সবারই চিন্তা হচ্ছে। এসব কিছুর মধ্যে স্পৃহা হঠাৎ করে সেন্সলেস হয়ে গেল। তাকেও ভর্তি করা হলো। জীবন রক্ত শূন্য মুখে ডক্টরের সামনে বসে আছে। 
'আমার ওয়াইফের কি হয়েছে ডক্টর? ও ঠিক আছে তো। সিরিয়াস কিছু হয়নি তো?'
'টেনশন করবেন না। এই সময় সবার ক্ষেত্রেই এমন হয়। হঠাৎ করে এতো চাপ সহ্য করতে পারেন নি। উনি অনেক টেনশন নিয়ে ফেলেছিলেন।'
'বুঝলাম না ডক্টর। এই সময় মানে? '
ডক্টর হেসে বললেন, 
'আপনি জানেন না? আপনার স্ত্রী প্রেগন্যান্ট। আপনি বাবা হতে যাচ্ছেন।'
একটু পরেই মারিয়া ছেলে সন্তান জন্ম দিলো। এই পরিবারে এক সাথে দু'টো খুশি নেমে এলো৷ একদিকে মারিয়ার ছেলে আর অন্য দিকে স্পৃহা মা হতে যাচ্ছে। 

সাত মাস পর, 
জীবন স্পৃহাকে নড়তেও দেয় না। স্পৃহা যা লাগবে চাইবার আগে তা হাতের কাছে এনে দেয়। স্পৃহার বাবা মা তোহা জীবনের বাসায় চলে এসেছেন। জীবন অফিসে থাকে। এই সময়ে স্পৃহাকে একা রাখা যাবে না। 
নাক কুঁচকে স্পৃহা বলল,
'আমি দুধ খাবো না। তুমি জানো তো দুধ খেলে বমি আসে। এসব খেতে আমার ভালো লাগে না।'
স্পৃহা এখন সব কিছু নিয়ে বাচ্চাদের মত বায়না করে। কিচ্ছু খেতে চায় না। জীবন ঠিক একটা বাচ্চার মত স্পৃহাকে সামলায়। ওর খেয়াল রাখে।
'দুধ না খেলে কীভাবে হবে বলো তো? দেখছো না দিন দিন তুমি কত রোগা হয়ে যাচ্ছ। তুমি ঠিক মত না খেলে আমাদের মেয়েও তো তোমার মতই রোগা হবে। ওর জন্য হলেও তুমি খেয়ে নাও প্লিজ লক্ষীটি।'
স্পৃহা জীবনের মুখের দিকে তাকিয়ে আর না করতে পারলো না। দুধ মুখে নিয়েই জীবনের উপর ছেড়ে দিলো। 
'দেখলে তো বললাম দুধ খেলে বমি হবে। দেখো তোমার শার্ট খারাপ করে ফেলেছি। সত্যিই আমি খুব বাজে। নিজে কোনো কাজ করতে পারি না। তোমার একটুও খেয়াল রাখতে পারি না। তুমি আমার খেয়াল রাখো। উল্টে আমি তোমাকে আরো বিরক্ত করি।'
জীবন এক হাতে স্পৃহাকে জড়িয়ে ধরে বলল,
'তোমার কিচ্ছু করতে হবে না। আমি সব করতে পারবো। তোমার খেয়াল রাখবো। আমাদের মেয়ের খেয়াল রাখবো। আবার নিজেরও খেয়াল রাখবো। তুমি শুধু আমার পাশে থেকো। তুমি পাশে থাকলে আমার আর কিচ্ছু লাগবে না। কিচ্ছু না।'
'শোনো আমার যদি কিছু হয়ে যায়।'
কথা শেষ করার আগেই জীবন রেগে গিয়ে বলল,
'একদম ওসব কথা মুখে আনবে না। আমি কিন্তু খুব রাগ করবো।'
স্পৃহা হেসে ফেলে বলল,
'আচ্ছা বলবো না। এখন বলো তো তুমি কাকে বেশি ভালোবাসবে। বাবুকে নাকি বাবুর আম্মুকে?'
'বাবুর আম্মু তো আমার জীবন। বাবুর আম্মুকে ছাড়া কি বাবুকে পেতাম? আমি তো বাবুর আম্মুকেই বেশি ভালোবাসি। তবে বাবু আসলে ওর সামনে মিছেমিছি বলবো বাবুকে বেশি ভালোবাসি। তখন তুমি কিন্তু রাগ করবে না। বুঝলে?'

তিন মাস পর, 
জীবন পায়চারি করে যাচ্ছে। স্পৃহার জন্য তার টেনশন হচ্ছে তার পা কাঁপছে। এখনো কেউ বের হচ্ছে না কেন? ভেতর থেকে তো বাচ্চার কান্নার শব্দও আসছে না। কি হচ্ছে ভেতরে?

দুই বছর পর, 
জীবন আর স্পৃহা তার মেয়েকে নিয়ে খালামণির বাসায় এসেছে। নূপুর প্রেগন্যান্ট। স্পৃহা নূপুরের সাথে বসে গল্প করছে। মারিয়া মায়ের সাথে রান্নাঘরে। জীবন জয়ের সাথে একটু বেরিয়েছে। 
স্পৃহার মেয়ে চিৎকার করে উঠলে স্পৃহা মারিয়া সবাই দৌঁড়ে তার কাছে গেল। মারিয়া বলল,
'কি হয়েছে রোজা?'
রোজা কাঁদতে কাঁদতে বলল,
'খালামণি রেজওয়ান আমাকে মেরেছে।'
মারিয়া চোখ পাকিয়ে নিজের ছেলের দিকে তাকালো বলল,
'রেজওয়ান তুমি রোজাকে মেরেছ কেন? '
'আম্মু রোজা আমাকে ভাইয়া ডাকে না কেন? আমি ওর বড়। ও কেন আমাকে নাম ধরে ডাকে। '
রোজা বলল,
'তুমি পঁচা। আমি তোমাকে ভাইয়া ডাকবো না। তুমি শুধু আমাকে মারো। আমি পাপার কাছে সব বলে দিব। আম্মু পাপা কোথায়? আমি পাপাকে নিয়ে বাসায় চলে যাব।'
স্পৃহা বলল,
'মা তুমি ভাইয়াকে নাম ধরে ডাকো কেন? ভাইয়া তোমার বড় হয় তো।'
'রেজওয়ান পঁচা। ওকে আমি ভাইয়া ডাকবো না। সাবাব ভাইয়া ভালো। আমাকে অনেক আদর করে।(সাবাব রামিমের ছেলে)।'
মারিয়া রোজাকে কোলে নিয়ে বলল,
'রেজওয়ানকে আমি অনেক বকে দিব মা। তুমি রাগ করো না। সত্যিই ও পঁচা। ওর সাথে তুমি কখনও মিশবে না।'
ওরা চলে যাবার সময় রেজওয়ান রোজার দিকে তাকিয়ে ভেংচি কেটে বলল,
'রেজওয়ান পঁচা। সাবাব ভাইয়া ভালো। আমি তোর সাবাব ভাইয়াকেও মারবো। ভেবলি একটা।'
 
  
   
                                  —(সমাপ্ত)—

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন