রংধনু - পর্ব ০৬ - তাবাসসুম রিয়ানা - ধারাবাহিক গল্প


বেশ সতর্কতা অবলম্বন করেই নেমে গেলো ওরা।নিশাদ আর আদনান বোনদের সাথে হাঁটছে রুমকি রবিনের হাত ধরে রেখেছে।কিরন বিভানকে ধরে আছে।বিভানের সামনেই বেলা হেঁটে যাচ্ছে।বেলা হাঁটতে হাঁটতে সাঁঝকে বলল,
''নেমে তো গেলাম উঠতে কষ্ট হবে।"
সাঁঝ হাঁপিয়ে নিতে নিতে বলল,
''হ্যারে আপু।এখনই দম আটকে আসছে।উঠবো কি করে?"
''আমি আছি তো। সমস্যা নেই।"
রবিন বলল,
''সামনে হেঁটে গেলে স্পীডবোট আছে।ভাড়া করতে হবে।বিশ পচিশ মিনিটের পানি পথ পার করলেই জাফলং সামনে থাকবে আমাদের।"
নিশাদ একটু হেসে বোনদের সাথে এগিয়ে চলল।সাঁঝ হঠাৎ দৌড়ে যেতে লাগলো।হাসছে ও জোরে জোরে।মজা পাচ্ছে খুব সবার বুঝতে বাকি রইলোনা।নিশাদ জোরে বলল,
''সাঁঝ আস্তে।সামনে পানি। "
সাঁঝ চিৎকার করে বলল,
''কিছু হবেনা ভাইয়া।মজা লাগছে খুব।"
আদনান ও দৌড়ে গিয়ে সাঁঝের কাছে চলে গেলো।সাঁঝকে কাছে পেয়ে ওর ঝুঁটি টেনে বলল,
''দৌড়াচ্ছিস কেন এভাবে?"
বেশ রেগে গেলো সাঁঝ।ঝাঁঝালো কন্ঠে বলতে শুরু করলো,
''তোর কি সমস্যা?তোর পা দিয়ে তো দৌড়াচ্ছিনা আর।"
''দৌড়াচ্ছিস না তো কিন্তু বুড়ি মেয়ে এভাবে দৌড়াচ্ছিস সেজন্য বললাম।"
''আমি বুড়ি হলে তুই কি?মোটু ড্রাম একটা।"
আদনান রেগে নিশাদের দিকে তাকিয়ে বলল,
''ভাইয়া কি বলছে ও দেখো।"
নিশাদ হেসে বলল,
''আগে কে বলেছিলো।তুই ওর গায়ে পড়ে ঝগড়া করছিলি।সাঁঝ এভাবে বলতে হয়না।ও বড় তোর।"
সাঁঝ রাগী গলায় বলল,
''ওকে ও বলে দাও আমার সাথে যেন ঝগড়া করতে না আসে।"
বেলা হাসছে ভাই বোনকে দেখে।দূর থেকে বেলার হাসি দেখছে বিভান।বেলা হেসে বলল,
''কি শুরু করলি তোরা?ফাজিলের দল গুলো।সাঁঝ আমার কাছে আয় তুই।"
সাঁঝ আদনানের পিঠে ঘুসি মেরে বোনের পাশে এসে দাঁড়ায়।আদনান চোখ রাগায় সাঁঝের দিকে।রবিন বলল,
''নিশাদ চলো বোট ঠিক করি। "
নিশাদ হেসে রবিনের সাথে পানির কাছে চলে গেলো।স্পীডবোটের ভাড়া বেশি তারওপর আবার বেশি মানুষ ধরবেনা যেখানে ওরা নয়জন।তাই ইঞ্জিন চালিত নৌকা ঠিক করা হলো।
সবাই একে একে উঠে বসতে থাকে।নৌকার দুপাশে অনেক গুলো চেয়ার আর মাঝে হাঁটার জায়গা।বেলার সামনের একটা চেয়ারে বসে আছে বিভান আর কিরন।বেলা বিভানকে কে দেখে চোখ সরিয়ে নেয়।বিভান কিরনের সাথে গল্প করছে।রবিন উঠে দাঁড়িয়ে ছবি তুলল সবার।ছবি তোলার সময়ই বিভান আর বেলার চোখাচোখি হয়। অজান্তেই বেলার ঠোঁটের কোনে হাসি ফুঁটে উঠে যা বিভানের কাছে স্নিগ্ধ মনে হচ্ছিল।বিভান ও মুচকি হাসে কিন্তু পরক্ষনেই মুখ সরিয়ে নেয়।বেলার কেমন যেন লাগতে থাকে।বিশ মিনিট পর ওরা পৌছে গেলো ওদের গন্তব্যে।কিছু রাস্তা পার করলেই সামনে ঝড়না।সবাই হাঁটতে থাকে।দুপাশে কিছু দোকান আছে।স্থনীয় লোকেরা ইন্ডিয়ান সাবান শ্যম্পু বেঁচছে।কাপড় চোপড়ের দোকান ও দেখতে পায় ওরা।কিছু দূর যাওয়ার পর ঝড়নার মুগ্ধ করা ধ্বনি কানে লাগে ওদের।সবাই লম্বা লম্বা পা ফেলে এগিয়ে যায় সেদিকে।রাস্তা ঘাট ভালো না।পাথুরে।বড় বড় পাথর জায়গায় জায়গায়।ঝড়না দেখতে পায় ওরা।উঁচু পাহাড় থেকে তীব্র গতিতে জলধারা গড়িয়ে পড়ছে।পাহাড়ে কিছু ছেলেরা উঠে বসে আছে।বেলা নিশাদ কে বলল,
''কি সাহস দেখাচ্ছে এগুলো।"
''পড়লে বুঝবে আরকি।"
ঝড়নার পানি তীব্র গতিতে পড়ছে।স্রোতের তীব্রতা কমাতে বড় বড় পাথর রাখা আছে।সাঁঝ দৌড়ে নেমে গেলো সাথে রবিন রুমকি আদনান ও।নিশাদ বলল,
''আপা চল নামি।"
বেলা আমতা আমতা করে বলল,
''তোরা নাম।এখানে ঠিক আছি আমি।"
''মজা হবে। চল আপা।"
বেলা বারবার না করা সত্ত্বেও নিশাদ মানেনি।বোনকে নিয়ে নেমে পড়ে।এদিকে কিরন নামবে কিন্তু বিভান জেদ করছে ও নামবেনা।কিরন বলল,
''দেখো তোমার ভালো লাগবে।একটু নেমে দেখো।"
''দেখো তোমার কথা মেনে এসেছি।আর কিছু করতে বলো না।"
বিভানের কন্ঠে রাগের আভাস পেয়ে কথা বাড়ায়নি কিরন।নিজে ও নেমে গেলো পানিতে।বিভান সবাই কে ভিজতে দেখছে।বেলা উঁচু একটি পাথরে বসে আছে।সাঁঝ আদনানের সাথে পানি নিয়ে খেলা করছে।নিশাদ রবিনের সাথে কি নিয়ে কথা বলছে।বেলার গায়ের শাড়ীটা ওর গায়ের সাথে একদম লেগে গেছে।বেলা শাড়ীর আঁচল টাকে অপর কাঁধে টেনে গায়ে জড়িয়ে নেয় ভালো মতো।বিভান দূর থেকে বেলা কে দেখছে নতুন ভাবে।খোঁপা করা চুল গুলো খুলে পিঠের ওপর এলিয়ে পড়েছে।শরীরে ফোঁটা ফোঁটা পানি জমে আছে।বিভানের লোভ বেড়ে যাচ্ছে বেলাকে দেখার লোভ।বেলা আজ যদি ওর স্ত্রী হতো পারতো না ভালোবাসার আবেশে জড়িয়ে নিতে?পারতো না নিজ হাতে চুলের পানি গুলো মুছে নিতে? পারতো না এই সুন্দর জায়গাটার স্বাদ একসাথে নিতে।বাস্তবে না হোক মিথ্যেমিথ্যি মেয়েটাকে বৌ বললে ও মনের কোন এক স্থানে প্রচন্ড শান্তি পাচ্ছে বিভান।হঠাৎ বেলা কিছু না বলে পানি থেকে উঠে বিভান থেকে একটু দূরত্ব রেখে দাঁড়ায়।ঠান্ডায় সমস্যা আছে ওর।বেশি সময় থাকলে জ্বর ঠান্ডা বেঁধে যায়।
________________________________________
ব্যাগ থেকে একটা গামছা বের করে হাত চুল মুছে নিচ্ছে বেলা। বিভান পাশে আড় চোখে বেলা কে দেখে নেয়।বেলা নিজের কাজে ব্যাস্ত।বিভান বেশ অপ্রস্তুত হয়ে  বলল,
''উঠে এলেন যে?"
বিভান কে কথা বলতে দেখে বেলা অনেকটাই অবাক।তারপর গলা পরিষ্কার করে বলল,
''ঠান্ডায় থাকতে পারিনা আমি।"
''ওহ।এক্স্ট্রা কাপড় আনেননি?"
''না আনা হয়নি।বের করে রেখেছিলাম কিন্তু ঘরেই রয়ে গেলো।"
''ওহ।"
বিভান চুপ হয়ে গেলো।বেলা বলল,
''আপনার কেমন লাগছে এখানে?"
''বেশ ভালো।জায়গাটাও বেশ।"
বেলা হেসে বলল,
''পিছনে ইন্ডিয়া কিন্তু।"
''হুম জানি।তবে এখান থেকে আমার বাড়ি যাওয়া যাবেনা।"
''গেলে কি চলে যেতেন?"
''ইচ্ছে হলে যেতাম।"
''হুম।আপনি কই থাকেন?"
''নিউ দিল্লি।"
''ওহ।"
বেলা চুপ হয়ে গেলো।বিভান অনেকটা সময় চুপ থেকে বলল,
''বিজনেস ম্যানেজমেন্টে অনার্স মাস্টার্স করেছি। এখন বিজনেস করছি পাশাপাশি থিসিস।"
বেলা হাসছে।বিভান বলল,
''আপনার সম্পর্কে কিছু বলুন।"
বিভানের প্রশ্নে বেলা কিছুটা লজ্জা পেয়ে বলল,
''আমরা সাত ভাই বোন।আমি বড় তারপর নিশাদ আদনান তারপর সাঁঝ।আর বাসায় আরো তিনজন আছে।ছোট দু বোন আর এক ভাই।"
''বাহ অনেক জনই তো।"
''জি।বাবা সরকারি চাকরী করছেন।আমি অনার্স ফাইনাল ইয়ারে পড়ছি আর নাচের স্কুল আর কোচিং সেন্টারে জব করছি ।"
''ওহ।নিশাদ কি করছে?"
''ও অনার্স থার্ড ইয়ারে ভর্তি হয়েছে।আদনান ইন্টার সেকেন্ড ইয়ারে পড়ছে।আর সাঁঝ ক্লাশ সিক্সে ভর্তি হয়েছে।"
''আপনাদের থেকে ও বেশ ছোট।"
''কিন্তু ও খুব বুদ্ধিমতি।ওর সাথে কথা বললে আপনার মনে হবে এডাল্ট কারোর সাথে কথা বলছেন।"
''হুম।দেখতে খুব সুন্দর ও।"
বেলা হাসে।বিভান বেলাকে দেখে একটু হাসলো।বেলা বলল,
''আপনার ফেমেলিতে কে কে আছেন?"
''বাবা মা আছেন তবে ওনারা সেপারেট হয়ে গেছেন।বাবা মুম্বাই থাকেন।এখানে প্রায়ই আসেন।"
''ওহ।সেপারেট কেন? আপনার প্রবলেম নাহলে বলতে পারেন।"
''এক্চুয়ালি ওনাদের মাঝে মিউচুয়াল আন্ডারস্ট্যান্ডিং এর বড্ড অভাব।তাই তাদের মনে হয়েছে সেপারেশনে ভালো থাকবেন তারা।দুজন দুমেরুর মানুষ।"
''এমন বিয়ে গুলো সন্তানদের ওপর খুব ইফেক্ট করে।"
''হুম।"
''আপনার আর কোন ভাই বোন নেই?"
দীর্ঘ নিশ্বাস ছাড়ে বিভান তারপর বলল,
''দূর্ভাগ্যবশত আমি একাই।"
বেলা বলল,
''ভাই বোন আসলেই আল্লাহর দেয়া নেয়ামত।"
''সেটা আপনাদের দেখে বুঝতে পারছি।"
বলেই বেলার দিকে হাসে বিভান।কিছুকষন পর সবাই উঠে এলো।বেলার এরই মধ্যে বেশ ঠান্ডা লাগতে শুরু করেছে।নিশাদ আর আদনান কোথা থেকে যেন কাপড় পাল্টে নিলো।ওরা যেখানে গাড়ি রেখে এসেছিলো সেখানে একটা রেস্টুরেন্ট আর কিছু দোকান আছে কাপড়ের।ওরা সেখানে এসে পৌছালো।সবাই বেশ ক্ষুদার্ত।বেলা কাশতে শুরু করেছে।নিশাদ বলল,
''আপা চল তোকে আর সাঁঝকে কিছু জামা কিনে দেই।"
বেলা কিছু বলতে পারলোনা।ওর নাক মুখ কামড়াচ্ছে। নিশাদ দুবোনকে নিয়ে মার্কেটে এলো।এখানে গেঞ্জী প্যান্ট শার্ট এগুলোই আছে।স্যালোয়ার কামিজ কিংবা শাড়ী নেই।বাধ্য হয়ে বেলা আর সাঁঝ দুজন দুটো টিশার্ট আর ট্রাউজার কিনলো।বেলা কাপড় পাল্টে একদম লজ্জায় পড়ে গেলো।এগুলো পরে কিভাবে যাবে ও?কেন যে কাপড় রেখে এলো?নিজের ওপর রাগ লাগতে শুরু করে বেলার।কাপড় পাল্টে ওরা রেস্টুরেন্টটায় এসে বসলো। সেখানে বাকিরা ও আছে।বেলা একপাশে বসে পড়লো।বিভান বেলাকে দেখে অবাক।যতোবারই দেখেছিলো হয়ত শাড়ীতে নয় স্যালোয়ার কামিজে।তবে ওয়েস্টার্নে ও বেশ লাগছে বেলাকে।রবিন খাবার অর্ডার করে দিয়েছে।খাবার খেয়ে সবাই গাড়িতে বসে পড়লো।রওনা হয়ে গেলো রাফিজ সাহেবের বাড়ির পথে।রাস্তায় বেলাকে বেশ অসুস্থ লাগলো।কাঁশি দিচ্ছিলো খুব।হঠাৎ বিভান বলল,
''আমার কাছে সবসময় কিছু টেবলেটস থাকে।আপনারা কিছু না মনে করলে ওনাকে দিতে পারি।নাহলে জ্বর চলে আসবে।"
নিশাদ না করতে পারেনা।বিভান একটা টেবলেট নিশাদের হাতে ধরিয়ে দিলো।বেলা কে খাইয়ে দেয়া হয় টেবলেটটি।তারপর ও বেলার কাশি একেবারেই কমতে চায়না। কিছুক্ষন পরপরই কেশে চলেছে আর বেলার শরীরেও কাঁপুনির সৃষ্টি হয়েছে।নিশাদের ভীষন খারাপ লাগছে এভাবে বোনকে দেখে।বিভান না পেরে বলল,
''সাঁঝ মিস বেলাকে একটু হিট দেয়ার ট্রাই করো আর ঘরে গেলে র চা দিও।"
বিভানের কথায় সাঁঝ বোনকে একদম জড়িয়ে ধরে বসে থাকে।বেলার কাঁপুনি কমে এসেছে।আগের চেয়ে।ঘরে পৌছে আদনান আর নিশাদ বেলাকে ধরে রুমে নিয়ে গেলো।সেদিন কিরন আর বিভান এতটাই ক্লান্ত ছিলো যে গেস্ট হাউজ পর্যন্ত যাওয়ার শক্তিই পাচ্ছিলো না।কিন্তু এখানে থাকার ও জায়গা নেই।তাই ডিনার করেই বেরিয়ে পড়ে ওরা।
বেলা নাকি ঘুমিয়ে পড়েছিলো সেই সময়টায়।গেস্ট হাউজে গিয়ে ও শান্তি পাচ্ছিলোনা বিভান।বিছানায় শুয়ে এপাশ ওপাশ করছিলো।
তারপর বাধ্য হয়ে ফোন মোবাইল হাতে নেয়।
রুমকি কে বিছানায় দেখো রবিন বিছানায় এসে বসে।রুমকি একটু হেসে চোখ বুজে নেয়।রবিন ওর পাশে শুয়ে রুমকিকে জড়িয়ে কাছে টেনে নেয়।তারপর রুমকির চিবুক ধরে নিজের দিকে নিয়ে আসতে থাকে।দুজনের মাঝে কোন দূরত্ব নেই।একে অপরের নিশ্বাসের ঘ্রানে মেতে আছে ঠিক সেই সময়টাতে রবিনের ফোন বেজে উঠে।চেহারায় প্রচন্ড বিরক্তি ফুঁটে উঠে রবিনের।অন্ধকারে ফোন খুঁজতে শুরু করে সারা বিছানা জুড়ে।

!!!!

এত রাতে বিভানের কল দেখে কিছুটা অবাক হয় রবিন।হঠাৎ ওকে কল করলো কেন?রুমকি রবিনের ফোনে বিভানের নম্বর দেখে বলল,
''কল ধরো কি বলতে চায় শুনো?"
''উফ এ সময়ে কি মনে করে কল দেয় মানুষ?ধ্যাৎ!!"
রবিন খাট থেকে নেমে বারান্দায় চলে আসে।কল রিসিভ করে কানে রাখে।অপরপাশ থেকে বিভান বলল,
''আ'ম সরি এ সময়ে কল করার জন্য।"
''ইটস ওকে বিভান ভাই।বলেন!!"
বিভান চিন্তায় পড়ে যায়।বেলার কথা কিভাবে জিজ্ঞেস করবে?কেমন শুনাবে ও বেলার কথা জানতে চাইলে।বিভান দ্বিধা বোধ করছে।কিভাবে জিজ্ঞেস করবে।বিভানকে চুপ দেখে রবিন বলল,
''কি হলো?কিছু বলছেননা?"
''সবাই কেমন আছে?"
''আলহামদুলিল্লাহ। কিন্তু বিন্তীর বান্ধুবী বেলার খুব জ্বর।ডাক্তার ডাকা হয়েছিলো কিন্তু লোকটা আসেনি।"
বিভানের বুকটা কেমন যেন করে উঠে।সুস্থ মানুষটা অসুস্থ হয়ে ফিরলো।বিভান বলল,
''জ্বর কমেনি?"
''না ভাই।বিন্তী বলল ওর কোল্ড এলার্জী আছে।ঠান্ডায় থাকতে পারেনা।আর আজ তো পানিতে অনেক সময় পর্যন্ত ছিলো।তা আপনারা কেমন আছেন?"
বিভান বেলার কথায় খুব চিন্তিত হয়ে পড়ে।রবিনের কথা যেন ওর কান পর্যন্ত যাচ্ছেনা একদম চুপ হয়ে গেছে।রবিন বলল,
''আছেন?"
''এইতো বলেন।"
''আপনারা কেমন আছেন?"
''ভালই।মিস বেলার খেয়াল রাখবেন। "
''জি।"
''আল্লাহ হাফেজ। "
কথাটা বলেই কল রেখে দেয় বিভান।রবিন অবাক।আর কিছু না বলে ওকে বলার সুযোগ না দিয়ে কল কেঁটে দিলো এই লোক।অদ্ভুত তো!!!ফোন নিয়ে রুমে চলে আসে রবিন।রুমকি জিজ্ঞেস করলো,
''কি বলল ওনি?"
''তেমন কিছুনা।সবাই কেমন আছে জানতে চাইলো।বেলার কথা শুনে কেমন যেন হয়ে গেলো।"
''যেমন?"
''মানে খুব চিন্তিত হয়ে গেলো যেন।মনে হচ্ছিলো শুনে কিছুটা কষ্ট পেয়েছেন।"
''ওহ হুম।"
রুমকি ও কেমন চিন্তায় ডুবে গেলো।রবিনের সহ্য হচ্ছেনা।এমনিতেই অস্থির হয়ে আছে।বৌটাকে কাছে পেতে চায় এই মুহূর্তে।আর কিছুই ভাবনায় আনতে চাইছেনা এখন।তাই ডান হাতের কবজি চেঁপে ধরে রুমকির।একটানে বালিশে শুইয়ে দিয়ে ওর গলায় মুখ ডুবিয়ে দেয় রবিন।রুমকির গলায় রবিনের নাকের গুতো লাগায় কিছুটা ব্যাথা পেয়ে কাতরে উঠে।বৌয়ের কাতরানি শুনে ভয় পেয়ে যায় রবিন।মাথা তুলে রুমকি কে দেখে বলল,
''কি হলো?"
''যেভাবে গলায় মাথা রাখলে ব্যাথা পেয়েছি।"
রবিন হালকা হেসে বলল,
''গলার কোথায়?"
রুমকি আঙ্গুল দিয়ে গলার মাঝখানটায় দেখিয়ে দিতেই রবিন সেখানে আলতো চুমু খেয়ে বলল,
''এখন ঠিক হয়ে যাবে।"
এদিকে বেলার ঘুম আসছেনা।কিছুক্ষন পরপর উঠে বমি করছে।গলা দিয়ে কফ যাচ্ছে।বিন্তীর ভয় লাগছে।কি করবে ও?কিছু খায়ও নি বেলা। আর এখন এমন করছে।বাথরুম থেকে এসে খাটে বসে বেলা।পুরো গা কাঁপছে।কেন যে ভিজতে গেলো। না নামলেই পারতো।বেলাকে আসতে দেখে বিন্তী উঠে বসে বেলার কপালে হাত ছো্ঁয়ায় জ্বর তেমন নেই।কিন্তু গা কাঁপছে বেলার সেটা বিন্তী বুঝতে পারছে।বেলা কে টেনে দেয়ালের সাথে হেলান দিয়ে বসিয়ে দিলো বিন্তী।তারপর রুম থেকে বেরিয়ে গেলো।কিছুক্ষন পর একটা সিদ্ধ ডিম দুধ আর বমির ট্যাবলেট নিয়ে ফিরে এলো বিন্তী।বেলা অসুস্থ কন্ঠে বলল,
''এগুলো কেন করতে গেলি?"
''নিজের অবস্থা দেখছিস?কিছু খাসনি তারপর ও বমি করছিস।"
''খাবোনা রে।আমার খুব খারাপ লাগছে।"
বিন্তী এসে বেলার পাশে বসে ডিমের খোসা ছাড়াতে ছাড়াতে বলল,
''কথা কম।এগুলো খেয়ে ট্যাবলেট নে।ভালো লাগবে।"
বেলার কোন কথা শুনলো না বিন্তী জোর করে খাওয়ালো দুধ ডিম আর মেডিসিন।অনেক রাত করে ঘুমিয়েছিলো বেলা।সকালে জ্বর কমেই গিয়েছিলো।শরীর ঘেমে জ্বর ছেড়ে দেয়। সকালে নিশাদ বোনের কাছে এসে বসে।সাঁঝ আগের থেকেই বেলার পাশে বসে চুল টেনে দিচ্ছে।নিশাদ বোনের গালে হাত রাখে।বেলাকে খুব ক্লান্ত দেখাচ্ছে।বেলা চোখ খুলে তাকায় গালে ছোঁয়া পেয়ে।ভাইকে দেখে একটু হাসে।নিশাদ গুমড়ে উঠে।বেলা কিছু বলতে চেয়ে ও পারছেনা।নিশাদ বলল,
''সরি আপা।তোকে পানি তে নামতে বলেছিলাম।মাফ করে দে।"
বেলা খুব কষ্টে কথা বলল এবার।ভাইকে ধরে বলল,
''আমি এমনি নেমে যেতাম।সরি বলিস না।"
''আমার কারনে নেমেছিলি আপা সত্যি সরি।"
''আরে বোকা যা হবার তাই হয়েছে।জ্বর টা অন্যভাবে ও আসতে পারতো।কাঁদিসনা।নাস্তা করেছিস?"
''হুম।তুই করিসনি?"
''সাঁঝ খাইয়েছে।"
নিশাদ সাঁঝের দিকে তাকিয়ে বলল,
''তুই খেয়েছিস?"
''জি ভাই।"
''ওকে।আপা আমি তোর জন্য আনারস নিয়ে আসি।জ্বরের মুখে ভালো লাগবে।"
''তুই বাজারে যাবি?"
''হ্যা রবিন ভাই যাবে।"
''ট্রেনের টিকিটের কোন কিছু হলো?"
''না আপা কোন খবর আসেনি।"
''উফ অফিস ভার্সিটি সব পড়ে আছে।"
নিশাদ দরজার কাছে যেতে যেতে বলল,
''আগে সুস্থ হয়ে নে।তারপর দেখা যাবে।"
বলেই বেরিয়ে যায় নিশাদ।সাঁঝ আজ প্রথম ভাইকে কাঁদতে দেখলো।ওর জানামতে নিশাদ সবচেয়ে কঠিন মনের।আপার জন্য ভাইয়ের অনেক মায়া আর আজ কেঁদেই দিয়েছিলো ভাই।যতোটা কঠোর ওপর থেকে ভিতরে ততোটাই নরম।
_________________________________________
সকাল থেকেই বিভানকে খুব বেশি অস্থির লাগছে কিরনের।ব্যাপারটা কি সেটা বুঝতে পারছেনা কিরন।রবিনদের ঘর থেকে নাস্তা পাঠানো হয়েছে।নাস্তার বক্স আর প্লেট নিয়ে বিভানের সামনে বসে কিরন।বিভানের সেদিকে খেয়াল নেই। ও ভাবছে অন্য কিছু।কিরন নাস্তার প্লেট বিভানের কাছে রেখে বলল,
''খেয়ে নাও।"
কিরনের কথা যেন শুনতে পায়নি বিভান।ও ভ্রু কুঁচকে নিজের ভাবনার জগতে পড়ে আছে।কিরন কিছুটা বিরক্ত হয়ে বলল,
''তোমার কি হয়েছে বলবে?কেমন হয়ে গেছো।কি নিয়ে এতো ভাবনা তোমার?
কিরনের কথায় ভাবনার জগৎ থেকে ফিরে এলো বিভান।নিচে তাকিয়ে নাস্তার প্লেট দেখে বলল,
''কখন আনলে?"
অবাকের চরম সীমায় কিরন।তারমানে এতক্ষন যা বলল বিভানের কানে কিছুই যায়নি।কিরন বলল,
''দুদিন আগে দিয়ে গেছে রবিনদের দারোয়ান।খেয়ে নাও।"
বিভান রেগে রুটি মুখে নেয়।বিভান সেদিন রাফিজ সাহেবের ঘরে যায়নি একবারও।ও চায় বেলার জন্য জন্ম নেয়া মায়াটা ওর মাঝেই থাকুক।কারন ওদের মিলটা সম্ভব না।ও যা চায় তা হবার নয়।শুধু শুধু কষ্ট দিয়ে লাভ কি?তবে নিজেকে যতোই সরাতে চাইছিলো ততোটাই উন্মাদ হয়ে পড়ছিলো বিভান।এদিকে পরপর দুদিন প্রচন্ড বৃষ্টিপাত হয়েছিলো সিলেটে।এর মাঝে নিশাদ ট্রেনের টিকিট ও পেয়ে যায়।পরদিন বিকেলে ট্রেন ছাড়বে।কিরন খবর টা বিভান কে জানাতেই প্রচন্ড কষ্ট পায় বিভান।ও কি দেখা পাবেনা বেলার?সারাটাদিন অস্থিরতায় কাঁটিয়ে দেয় বিভান।এদিকে বেলার জ্বর কমেনি।আজ আবার ও এসেছে।খাটে শুয়ে আছে বেলা।সাঁঝ কাপড় গুছাচ্ছে সাথে আদনান ও।বেলার কাপড় গুঁছিয়ে নিজের কাপড় গুছাতে থাকে সাঁঝ।নিশাদ ঔষধ আনতে গেলো।এরই মাঝে মুষল ধারে বৃষ্টি।কমার কোন খবর নেই।ফারজানা আন্টি রান্না করে বেলার কাছে এসে বসেন।তারপর ওর জ্বর মেপে বললেন,
''খেয়ে নে।তারপর ঔষধ দিচ্ছি।"
''জি আন্টি।"
কিরন বাজারে গিয়েছিলো।সেখান থেকে কিছু কমলা নিয়ে গেস্ট হাউজে চলে যায়।সেখানে গিয়ে দেখলো বিভান নেই।কিরন সারা ঘর খুঁজে ও পেলো না বিভানকে।প্রচন্ড চিন্তিত হয়ে পড়লো।বিভানের নম্বরে কল দিয়ে ফোন বন্ধ পেয়ে বেরিয়ে যায় বিভানকে খুঁজতে।এদিকে পাশের ঘরের কাজের মেয়ে লতিফা দৌড়ে এসে বেলাকে খুঁজতে থাকে।ফারজানা আন্টি লতিফাকে দেখে বলল,
''কিরে এখানে কেন তুই?"
''বেলা আফু কই?হেতিরে একটা বেডায় খুঁজে।"
''বেডা!!কার কথা বলিস?''
''আগে কন বেলা আফু কেডা?আর কই ওনি?"
ফারজানা কিছু টা অবাক হয়ে লতিফাকে বেলার কাছে এনে বলল,
''তোমাকে খুঁজছে ও।দেখো কি বলে।"
মেয়েটাকে চেনেনা বেলা।তারপর সৌজন্যের হাসি দিয়ে বলল,
''কি বলবে?"
''আফনেরে একটা বেডা খুঁজতাছে।যান গিয়া।"
বেলা অবাক।ওকে খুঁজবে কে?নিশাদ বাহিরে।ওর জ্বর সেটা ভালো করেই জানে।তাহলে বাহিরে কেন ডাকছে?বেলা বলল,
''কে ডাকছে?"
''সিনিনা।হের কথাও কেমুন জানি?আমনে যায়া দেহেন।"
বেলা উঠে উড়না গায়ে জড়িয়ে মাথায় ঘোমটা টেনে বেরিয়ে এলো।বৃষ্টি একটু কমে আসলে ও হচ্ছে এখন ও।লতিফা ও বেরিয়ে আসে বেলার সাথে তারপর গাছের দিকে ইশারা করে বলল,
''উহানে খাড়ায়া রইছে।যান কথা কন।"
বেলা অন্ধকারে ঠিক বুঝতে পারেনা কে সে।তারপর ও এগিয়ে গেলো সেদিকে।লোকটার কাছে এসেই বেলা অবাক।এ তো বিভান।ওনি এখানে এতো বৃষ্টিতে কি করছেন?বেলা বলল,
''আপনি এখানে?ভিতরে আসুন বৃষ্টি হচ্ছে।"
বিভান কি বলবে বুঝতে পারছেনা।কোনমতে সাহস নিয়ে বলল,
''ভিতরে না।এখানে বলতে হবে খুব দরকারি।"
''জি বলুন।"
''মিস বেলা খারাপ মনে করবেননা আমাকে প্লিজ।আমি খুব চেষ্টা করেছিলাম কিন্তু কোন ভাবেই নিজেকে আটকাতে পারছিনা।জানেন এতোদিন আপনাকে এভয়েড করেছিলাম যেন দূরে থাকতে পারি।আপনাকে দেখিনি যেন মায়া কাঁটাতে পারি।আমি পারিনি মিস বেলা।আমি অসহায়।"
বেলা অবাক।লোকটা কি বলছে হঠাৎ?বেলা জিজ্ঞেস করে উঠে,
''বিভান কি বলছেন আপনি?কিছু বুঝতে পারছিনা আমি।"
''বেলা আপনার মায়ায় জড়িয়ে গেছি আমি।নিজেকে শত চেষ্টায় ও আটকাতে পারিনি।আপনাকে ছেড়ে থাকাটা কঠিন হয়ে যাচ্ছে ক্রমাগত।আমি নিরুপায়।আপনার মায়ায় আমি কঠিন ভাবে জড়িয়ে গেছি।কোনভাবেই বেরুতে পারছি না।আমার হবেন প্লিজ?"

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন