রংধনু - পর্ব ৫৫ - তাবাসসুম রিয়ানা - ধারাবাহিক গল্প


জীবনে এখন রাত দিন সকাল দুপুর সব এক মনে হয়।যখন সুখী হতে চায় তখন অতীত আঁকড়ে ধরে। বেদনা ভরা ওর অতীত জীবনটা ।প্রিয়জনকে হারানোর তীব্র যন্ত্রনা বুকে চেঁপে ধরে বেঁচে আছে মেয়েটা।স্বয়ং মা বাবাকে ধুকে ধুকে মরে যেতে দেখেছে ।ছোট্ট কলিজার টুকরো ভাইটাকে আফিমের তীব্র নেশায় রাত কাঁটাতে দেখেছে। 
মনে পড়ে গেলো সেই কালরাতের কথা যেদিন তন্ময় এসে ওর সামনে দাঁড়ায়।চোখজোড়া টকটকে লাল।  নাক বেয়ে গড়িয়ে পড়ছে তাজা রক্ত। তমা ভাইকে এ অবস্থায় দেখে কেঁদে ফেলল। ও যে হাসপাতাল থেকে ছুটে পালিয়ে এসেছে তা বুঝতে সময় লাগলো  তমার।  তন্ময় বলে উঠেছিল, 
''ভাই আমাকে বাঁচা আমি ওখানে যাবো না আর।"
তমাকে কখনোই আপু বলেনি তন্ময়।তমা সবসময় ওকে বড় ভাইয়ের মতো সাপোর্ট করতো কিন্তু কিছু অসৎ সঙ্গে বখে গিয়েছিলো তন্ময়। এটাই কাল হয়ে দাঁড়ালো।।। তন্ময়কে নিয়ে অস্ট্রেলিয়াতে বেশ কয়েক বছর ছিল ওর বাবা মা। তমা তখন বড় ভাইয়ের সাথে বাংলাদেশে ছিল। আর তখনই তন্ময়ের জীবনের এমন পতন ঘটে।ওরা আলাদা হয়ে যাওয়ার পর তন্ময় ওর সাথে প্রথম দুবছর খুব যোগাযোগ করতো কিন্তু সময়ের সাথে সাথে যোগাযোগ কমে যায়। অবস্থা আরো বেশি খারাপ হওয়ায় ওকে নিয়ে আর্জেন্ট দেশে ফেরত আসে বাবা মা।। আর এসেই রিহ্যাবে ভর্তি করে রেখে আসতে হয় তন্ময়কে 
এসব ভাবতে ভাবতে তমার চোখজোড়া ভরে আসে।
ওভাবে সেদিন ভাইকে আসতে দেখে তমা বলে উঠছিল  
''তুই এখানে কেন তন্ময়?"
তন্ময়কে খুব অস্থির দেখাচ্ছিল যেন কিছু লুকানোর চেষ্টা করছে, সে বলে উঠলো
''ভাই আমি আর ওখানে যাবোনা।ওরা আমাকে ড্রাগস নিতে দেয়না। আমি ড্রাগস ছাড়া থাকতে পারছিনা।  ভাই সাহায্য কর প্লিজ ।রাস্তার মাঝে ভাইয়ের এমন পাগলামী দেখে তমাও মুহূর্তের জন্য ভাইকে সাহায্য করার চেষ্টা করবে ভেবে উঠেছিল।
কিন্তু সেই সুযোগ আর হলো না।।। হুট্ করে দ্রুতগামী ট্রাক এসে ওর সুন্দর শরীরকে মুহূর্তেই পিষে দিয়ে যায়।
গলা ছেড়ে চিৎকার করে উঠে  তমা।রাস্তায় বসে ভাইয়ের রক্তাক্ত শরীর জড়িয়ে কেঁদে উঠে। দৌড়ে গিয়েও ভাইকে বাঁচাতে পারেনি ও।ততক্ষণে  এ্যাসাইলাম থেকে গাড়ি চলে আসে।তমাকে রাস্তায় বসে তন্ময়ের লাশ ধরে কাঁদতে দেখে ওরা নিজেদের অশ্রু নিয়ন্ত্রনে রাখতে পারেনি।
ভাইয়ের মৃত্যুর পর গ্রাজুয়েশন শেষ করে তমা।। এরপর হুট্ করে বাবা মাও চলে গেল। বাবা মা আর তন্ময়ের মৃত্যুর পর বড় ভাই তিহানের চেহারা পাল্টে গেল...বিষয় সম্পত্তি কোনকিছুতেই  তমাকে অংশীদার করতে চাইলো না, ওর ভরণপোষণও দিতে চাইলো না..তমার ভাগ্য সহায় যে নানা বাড়ি হতে প্রাপ্য এই ছোট ফ্ল্যাটটা মা ওকে দিয়ে গিয়েছিলেন. এই ফ্ল্যাটটা ভাড়া দিয়ে হোস্টেলে থেকে টিউশনি করে বাহিরে পড়তে যাওয়ার জন্য চেষ্টা করে যাচ্ছিল তমা.. স্কলারশিপটাও পেয়ে গেল..ফুল ব্রাইট স্কলারশিপ নিয়ে পিএইচডি করে অস্ট্রেলিয়াতে যেদিন পিআর পায় সেদিন দুচোখ দিয়ে কেবল অশ্রু ঝরছিল  ওর....আজ ও সম্পূর্ণ স্বনির্ভরশীল.. এই সুদূর অস্ট্রেলিয়ায় ওর আপন কেউ না থাকলেও ওর নিজের বেঁচে থাকার জন্য কারো কাছে হাত পাততে হবে না... চাকরিটাও পেয়ে গেছিল সময়মতো.. তারপর কদিন আগে মনে হলো দেশে তো থাকবেইনা শুধু শুধু ফ্ল্যাটটা রেখে মায়া বাড়িয়ে কি লাভ..তাই দেশে এসেছে এটা বিক্রি করে যা পাবে সব এতিমখানায় দান করে চলে যাবে..সবই ঠিক ছিল....
কিন্তু হঠাৎ করে জীবনে এসে দাঁড়ালো ওর প্রথম প্রেম প্রথম ভাল লাগা প্রথম ভালোবাসা....ষোলো বছর আগে যাকে প্রথম দেখায় মনে ধরেছিল আজ অব্দি সেই আছে তমার মনে...কত কত বিয়ের প্রপোজাল পেল কিন্তু আগাতে পারলো না..মন যদি না টানে সেই কমিটমেন্টে গিয়ে দুইজন মানুষ কষ্টই পাবে...তাই কৌশলে তমা এড়িয়ে গেছে.... 
এখন ওর মনে হচ্ছে ও দেশ ছাড়তে চায় না কোথাও যেন অদৃশ্য পিছুটান আছে ওর...কিন্তু ও যাকে ভালোবাসে সে ওকে কেবল বন্ধুর চোখেই দেখেছে..মায়া অনেকে বেড়ে গেলে ফিরতে কষ্ট বেশি হবে তাই যত দ্রুত সম্ভব এখানের কাজ শেষ করে তমা আবার ফিরবে ওর স্বস্তির একমাত্র জায়গা....ক্যানবেরা, অস্ট্রেলিয়া।
........................
শীতময় একটি শুক্রবার সন্ধ্যা..দিন ছোট আর রাত বড় হয় ডিসেম্বর মাসটায় এমনিতে...সাড়ে পাঁচটা বাজে মসজিদ থেকে মাগরিবের নামাজ আদায় করে ঘরে ফিরলেন ইকরাম রহমান সাথে তিন ছেলেকে নিয়ে...কুঞ্জন টা নামাজ শেষে ভাই আর বাবার সাথে বেরিয়ে এসেই দৌড়ে গেলো দোকানে।সেখান থেকে তেতুলের আঁচার কিনে এনে ওদের সামনে এসে দাঁড়িয়ে বলল,
''বড় ভাইয়া খাবি?"
নিশাদ টক আচার দেখে কিছুটা ভ্রু কুঁচকে বলল,
''এসব অদ্ভুত জিনিস খাস কেন বল তো?"
আদনান হাসছিলো।কুঞ্জন আদনানের দিকে একটা প্যাকেট বাড়িয়ে বলল,
''তুই তো খাবি ভাইয়া।"
আদনান নিশাদকে একপলক দেখে হাতে নিয়ে নিলো।ইকরাম রাহমান এসব খেতে পারেন না ।নিশাদ কুঞ্জনের কাঁধে হাত রেখে বলল,
''চল। ঢের কাজ আজকে।সাতটার আগে ওরা চলে আসবে।"
সময় সুযোগ পেলেই ইকরাম সাহেব ছেলেদের নিয়ে মসজিদে নামাজ পড়ার চেষ্টা করেন ..তার ছেলেরাও ব্যাপারটা খুব সমর্থন করে...অন্য শুক্রবার হলে এ সময়টা নামাজ হতে ফিরে গোল হয়ে বসে সবাই আড্ডায় মেতে উঠে ।কিন্তু আজ যেন কাজের শেষ নেই খুশির শেষ নেই আবার সংশয়েরও শেষ নেই.. কারন একটু পরে সাইমন আর তার দাদি আসবে প্রাথমিক সাক্ষাৎ করতে সাঁঝের বিয়ের ব্যাপারে....হাজার ভালো হোক সাইমনের দাদির ব্যাবহার তবুও পিতা ইকরাম রহমান কিছুটা চিন্তিত.. হয়ত মেয়েরা বড় হলে বাবাদের চিন্তা একটু বেশিই বেড়ে যায়।
মেয়েটা আসলেই ভালো থাকবে তো?? সাইমন আসলেই ভালো মানুষ তো?? কয়দিন আগে ডিরেক্টলি সাইমনের দাদির সাথে ফোনে কথা হয়েছে ওনার.. যথেষ্ট ভদ্র মানুষ উনি...তবুও ইকরাম রহমান কিছুটা চিন্তিত...কন্যা দান করার বেলায় এমনই হাজারো চিন্তা ঘুরপাক খায় কন্যার পিতার মাথায়...এদিকে সকাল থেকে সাঁঝ বাবা ভাই কারোর সামনেই যেতে পারছিলোনা।অজানা এক সংকোচ ওকে জাপটে ধরে আছে।সারাটাদিন পাকঘর আর শোবার ঘরে কাঁটিয়ে দিয়েছিলো।লাবনী ও বোনের সাথে যতোটা পারছে সময় কাঁটিয়ে নিচ্ছে। কয়েকদিন পর তো যখন তখন বোনকে দেখতে পাবেনা। ।হুমায়রার হয়ত মনেই নেই বোন চলে যাবে।ও আছে নিজ দুনিয়ায় ব্যাস্ত।নামাজ থেকে ফিরে এসেই কুঞ্জন সাঁঝের রুমে এসে দাঁড়িয়ে মুখ ভেংচি কেঁটে লাবনীকে বলল,
''যেভাবে হাসছিস যেন তোকে দেখতে আসবে।সাঁঝ আপু ওর থেকে সাইমন ভাইকে সাবধানে রাখিস।বেচারা আবার এই পাগলের পাল্লায় না পড়ে।"
লাবনী রেগে কিছু বলতে যাচ্ছিলো তখনই সাঁঝ থামিয়ে বলল,
''বাজে বকিসনা।কি লাগবে?"
কুঞ্জন এসে ওদের কাছে দাঁড়ায়।কি যেন বলতে গিয়ে হঠাৎ লাবনীর চুল টান দিয়ে দৌড়ে বেরিয়ে গেলো।লাবনী চিৎকার করতে করতে কুঞ্জনের পিছে দৌড়ে গেলো।
সারা বাড়ি পোলাও রোস্টের ঘ্রানে ভরে গেছে ।ওরা বিয়ের কথা বলতে আসবে তবুও প্রথম আসছে। একটু ভালমন্দ খাওয়ানো উচিৎ। নিশাদ পাকঘরে এসে বলল,
''আম্মা কতোটুকু হইলো?"
জুলেখা বানু বললেন,
''হারাটাদিন কাম করতাছি।সাঁঝ কতোগুলো কইরা দিয়া গেলো।আমি ফারি নাকি এখন এত কাম।হুমায়রাডারে কতো ডাকলাম।একটুও আয়ে না।হারাদিন বই লইয়া কি করে কে জানে?"
নিশাদ বলল,
''সালাদ কাঁটা হইছে?"
''কুঞ্জন নিয়া আইছিলো।"
নিশাদ বেরিয়ে এসে দেখলো হুমায়রা ফোনে গভীর মনযোগ দিয়ে কি যেন করছে। নিশাদের কখনো ইচ্ছে হয়না ওদের সাথে রেগে কথা বলতে। কিন্তু মাঝে মাঝে রাগ লাগে হুমায়রার কাজে।কিছুটা রেগে বলল,
''এই ফোন ঘাঁটছিস কেন এখনো?মা কাজ করছে সারাদিন তোর চোখে পড়েনা?আজকের দিনে ও ফোন কেন ঘাঁটতে হচ্ছে তোর?একটু পর চলে আসবে ওরা।"
ভাইয়ের ধমকে কেঁপে উঠে হুমায়রা।ফোন রেখে নিঃশব্দে বেরিয়ে গেলো সে ।আদনানকে দিয়ে  কোক আর স্প্রাইঠ আনিয়েছে  নিশাদ।ইকরাম রাহমানকে  সোফায় বসে চোখের কোনা মুছতে দেখে ওর মনে হলো,
 কিছু ব্যাপারে বাবাকে আগে থেকে বলে রাখা ভালো.. সেটা ভেবেই বাবার পাশে এসে বসে নিশাদ।ইকরাম রাহমান ওর দিকে তাকান অশ্রুসজল চোখে।বললেন,
''কিছু কইবিনি?"
বাবার দিকে তাকিয়ে নিশাদের হৃদয় কেঁপে উঠে।আজ এই মানুষটার চোখে পানি।মেয়েকে যাই বলুননা কেন?কম ভালবাসেননা।নিশাদ বলল,
''আব্বা কাইন্দোনা।তোমার মাইয়া খুব ভালো থাকবো।তার আগে কিছু কথা জানাইতে চাই।তোমার জানা উচিৎ.......সাইমন ছেলে হিসেবে অনেক ভালো সে বিষয়ে কোন সন্দেহ নেই..কিন্তু ওর কিছু জটিলতা আছে পরিবারে..জটিলতা বলতে ওর ভাই ভাবি ওর তেমন খবর নেয়না এড়িয়ে চলে..হয়তো সেদিন ওর দাদির সাথে কথা বলার সময় এই ব্যাপারটা কিছুটা জানিয়েছেন তিনি তোমাকে.তো আজকে ওরা কথা বলতে আসলে তুমি ওদের ব্যাপারে কিছু জিজ্ঞেস না করলেই আমার মনে হয় ভালো হয় ...আর বিয়ের ডেটটা আজকেই ফাইনাল করে ফেলতে চাই..এখন তুমি কি বলো?"
"ওর ভাই ভাবি যদি সেরকম হয় তাহলে সাঁঝের থাকতে সমস্যা হইবো না??"
"আমার মনে হয় না।  কারন সাইমন বিয়ের পর দাদির বাসায় থাকবো। আমারে যতটুক বলছিলো...ওর দাদির স্পষ্ট কথা সাইমন একা একা কষ্ট করার থেকে ওনার সাথে থাকবে সাঁঝকে নিয়ে.. দাদির সাথে ওর বড় ভাইও তেমন যোগাযোগ রাখেনা বিধায় ওনার অনেক কষ্ট..সেটা সাইমনকে দিয়ে কিছুটা দূর করতে চান.."
"যদি তেমনটা হয় তাহলে সাঝেঁর জন্যই ভালা কারন পরিবারে ভালো একজন মুরুব্বি থাকা মানে মাথার উপরে ছায়া থাকা" 
নিশাদ কিছু বলতে নিবে তার আগেই কলিংবেল বেজে উঠলো...সাইমন বলেছিল ৭টার আগেই চলে আসবে..এখন সাড়ে ছয়টা বাজে..
এসব ভাবতে ভাবতে দরজার দিকে এগিয়ে গিয়ে খুলে দেখলো নিশাদ..
ক্রিম কালারের জামদানি পড়া একজন বৃদ্ধ মহিলা যার বয়স অনেক কিন্তু চেহারায় অনন্য সুন্দর একটা ব্যাক্তিত্ব নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। তিনি সাইমনের দাদি..
মাথায় খুব পরিপাটি করে হিজাব পড়া..পাশে একটি আঠারো উনিশ বছরে মেয়ে নীল জামা পড়ে দাঁড়িয়ে।আর তার পাশেই সাদা শার্ট আর ব্ল্যাক প্যান্ট পরে সাইমন দাঁড়িয়ে আছে...ওর হাতে মনে হয় কয়েক বাক্স মিষ্টি...মেয়েটার হাতেও কিছু জিনিস...হাসিমুখে তিনিই প্রথমে বলতে শুরু করেন
"আস্সালামু আলাইকুম...তুমি নিশ্চই নিশাদ..আমার আরেকটা বড় নাতি...তাইনা??"
কিছুটা বিচলিত হয়ে উত্তর দিলো নিশাদ 
"জি দাদি।ওয়ালাইকুম আসসালাম  প্লিজ ভিতরে আসুন....এস সাইমন..." 
বলে নিজে সরে গিয়ে ওনাদের ঢুকতে দিলো নিশাদ..হাত থেকে জিনিসগুলো নিয়ে টেবিলে রেখে ওনাদের ড্রইং রুমে বসলো..ততক্ষনে সাঁঝের বাবা মাও চলে এসেছেন।সাথে নানিও...অমন পরিপাটি গোছের মানুষদুটোকে দেখেই কেন জানি ইকরাম রহমানের মনে হলো তার মেয়ে ভুল জায়গায় ধরা দেয়নি....নিশাদ ভিতরে ঢুকেই লাবনীকে বললো ওনাদের জন্য জুস দিতে...আর সাঁঝের ঘরে গিয়ে দেখলো বোন তার ভয়ে জড়োসড়ো হয়ে আছে।গোলাপী স্যালোয়ার কামিজ আর স্নিগ্ধ সাজে সাঁঝ পরিপূর্ন।নিশাদ হেসে বললো, 
"কি হলো চেহারার এমন বারোটা বাজিয়ে রেখেছিস?
সাঁঝ ম্লান চেহারায় ভাইয়ের দিকে তাকাতেই নিশাদ হেসে বলল,
''ভয় পাসনা...ওনাদের দেখেই আমার ভালো লেগে গেছে..বাবা মায়ের পছন্দ হয়েছে আমি নিশ্চিত..."
"সত্যি বলছিস ভাইয়া??" 
কেঁদেই ফেললো সাঁঝ...
"হ্যা রে ...ডাকবো তোকে একটু পর কান্না করে চেহারা নষ্ট করলে মার খাবি...গেলাম..."
ইতোমধ্যে ঘরের ভিতরে এসে সবকিছু চেক করছিলেন সাঁঝের বাবা মা সেই মুহূর্তে নিশাদ ড্রইং রুমে ঢুকতে গিয়ে শুনতে পেলো দাদি বলছে, 
"কিরে ব্যাটা বারবার পর্দার আড়ালে নাতবৌকে খুঁজছিস নাকি...আজকে কি একবারে বিয়ে পড়ায় যাবো নাকি..খুব তো মনে হয় বাসর করার শখ জাগছে তোর আজকেই.." 
শুনে সাইমন ঘামতে লাগলো মাথা নিচু লজ্জায়...আর তখনই প্রবেশ করলো নিশাদ..নিজেও হেসে ফেললো ও... 
প্রাথমিক সন্ধ্যাকালীন নাস্তা আর আলাপ শেষে সাঁঝের ডাক পড়লো.. নিশাদ বোনের হাত ধরে ওকে নিয়ে আসলো..সেদিকে তাকিয়ে সাইমনের দাদি জাহানারা বেগমের  প্রথম কথাই ছিল, 
"আরো সুন্দর হয়ে গেছে আমার হবু নাতবৌটা...মাশাআল্লাহ এস এদিকে দাদুমনি..." কিছুটা অবাক হলো বাসার সবাই.. তারমানে আগেও দেখা হয়েছে ওদের.. ভেবে খুশিই হলো সবাই কিন্তু কিছু প্রকাশ কেউই করলোনা।এদিকে সাইমন আর সাঁঝ কিছুতেই মাথা উঁচু করে তাকাতে পারছেনা..লজ্জায় দফারফা অবস্থা দুজনেরই...অথচ কতদিনের পরিচয় ওদের....দাদি সাঁঝকে পাশে বসিয়ে উঠলেন.. 
"আমার দুষ্ট নাতিটা এই পুতুলের মতো মেয়েটাকে কিভাবে পটালো সেটাই ভেবে পাচ্ছিনা আমি..কিরে সাইমন জাদুটা কিভাবে করলি..?" এবার সাইমনের এতো লজ্জা লাগলো যে ও আরো গুটিয়ে গেলো..ওকে সহজ করতে নিশাদ ওর পাশে বসে কাঁধে হাত দিয়ে বললো 
"আমার বোন আর সাইমন দুজনই অনেক ম্যাচিউরড বিচক্ষণ..আল্লাহ ওদের ভালো রাখুক এটাই দোআ.."
জুলেখা বানু কিছু বলে উঠবেন তার কলিংবেল বাজলো আবার.. 
"এসময়ে কে এলো আবার"
 বলে নিজেই দরজার দিকে এগিয়ে গেলেন ইকরাম সাহেব..দরজা খুলে যা দেখলেন তাতে চোখ ছানাবড়া হয়ে গেলো হাত কেঁপে উঠলো পা দুটো অসাড় হয়ে আসলো...
এই দৃশ্য দেখার জন্য তিনি প্রস্তুত ছিলেন না কখনোই। 
!!!!

পুরো পৃথিবীটা যেন কেঁপে উঠলো ইকরাম রাহমানের।দরজার অপরপাশে সেই তেরবছর আগের ঘটনাকে নতুন করে দেখতে পারছেন।যেদিন তার রুহ টাকে টেনে ধরা হয়েছিলো,তার কলিজার একটা অংশ ছিড়ে গেছিলো। যাকে সে ঘর থেকে বের করে দিয়েছিলো সম্পর্কের শেষ দেখিয়ে সেই বেলা তার জেষ্ঠ্য কন্যা হাজির আর সেই বড় জামাই যাকে কখনো নিজের জামাইয়ের আদর দেয়ার কথা মনে আনেননি বরং দূরে ঠেলে দিয়েছিলেন।শরীর কাঁপছে ইকরাম রাহমানের।তবে ওনার কলিজার আগুনে পানি ঢেলে এক নতুন শিশুসুলভ আধবোল কন্ঠে কেউ বলে উঠলো,
''বাবা এই লাগি লাগি দেখতে লোকতা কে?"
সেই কন্ঠস্বরে ইকরাম রাহমান মেয়ে আর তার স্বামী বিভান থেকে চোখসরিয়ে নিচে দাঁড়িয়ে ছোট্ট পরীটিকে দেখতে পায়। লাল ফ্রক ওপরে মোটা জ্যাকেট কানটুপি,পায়ে মোজা হাত মোজা। লাল টুকটুকে গাল।হঠাৎ যেন অনূভব করলেন ওনি এই বাবুটিকে অনেক বছর ধরে চেনেন খুব ভালবাসেন।বুকে জড়িয়ে নিতে চান।এদিকে নিশাদ কুঞ্জন লাবনী আদনান ইকরাম রাহমানকে দরজার সামনে এভাবে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে বেশ অবাক।বাবা এভাবে কেন দাঁড়িয়ে আছে কেন?এসেছে কে?জাহানারা বেগমকে বলে ওরা দরজার দিকে এগুতে থাকে।এদিকে ইকরাম রাহমানের ঘোর কাঁটিয়ে বিভান মেয়েকে কোলে নিয়ে ইকরাম রাহমান কে উদ্দেশ্য করে বলল,
''আসসালামু আলাইকুম বাবা ও পূর্না আপনার নাতনী।"
তারপর মেয়ের দিকে চেয়ে বিভান আদুরে কন্ঠে বলল,
''আম্মু ওনি তোমার নানা ভাই।যাও ওনার কোলে খুব আদর করবেন।"া
ততক্ষনে সবাই চলে এসেছে দরজার সামনে।ইকরাম রাহমানের যেন এবার তর সইছেনা।পূর্নার চেহারার দিকে একপলক তাকিয়ে কোলে নিয়ে নেন।কুঞ্জন লাবনী ওরা বলছিলো,
''আব্বা আমাদের কাছে দেন।"
কিন্তু ওনি কাউকে পাত্তা দিলেননা।বলতে লাগলেন,
''কাউরেই দিমুনা। এইডা আমার কইলজার টুকরা আমার বড় নাতনী আমার বংশের বড় নাতনী।এডারে কইলজার ভিতরে ঢুকায়া রাখুম।"
বড় নাতনীকে পেয়ে এতোটাই খুশি যে মেয়ে আর মেয়ের জামাইকে প্রায় ভুলে বসেছিলেন ইকরাম রাহমান।
পূর্নার চিৎকার উপেক্ষা করে  নিজের রুমে চলে গেলেন।মানুষের বয়স হলে হয়ত এমনই হয়।নিজের খুব প্রিয় কাউকে অনেকবছর পর দেখলে হয়ত নিজেরাই বাচ্চা হয়ে যায় আর সেটা হয়েছিলো ইকরাম রাহমানের সাথে।এদিকে বেলা স্বামীর মুখে শুদ্ধ বাংলা শুনে অবাক।কিন্তু বাবা ভাই বোন কে দেখে ওর চোখজোড়া অশ্রুতে ভরে এসেছিলো যার কারনে বিভানকে জিজ্ঞেস করতে পারেনি সে বাংলা শিখলো কবে।লাবনী দৌড়ে বড় বোনকে জড়িয়ে ধরে।কিছু বলতে পারলো না ও। কান্নার দমক উথলে উঠছে।এদিকে সবার মুখে হাসি।পরিস্থিতি টা যতোটা উৎসব মুখর ছিলো বড় বোন আর দুলাভাইয়ের আগমনে আরো বেশি আমেজ পূর্ন হয়ে গেছে।তবে এই মুহূর্তে পরিস্থিতিটাকে সামলে নিতে নিশাদ নিজের আবেগটুকুকে একপাশে রেখে একটু এগিয়ে এসে বিভান বেলা দুজনকে বলল,
''আপা আর বিভান ভাই এভাবে সারপ্রাইজ দিবে বুঝতে পারিনি।হাসবো নাকি কাঁদবো বুঝতে পারছিনা।সাঁঝকে দেখতে আসছে।ড্রয়িংরুমে লোকজন আছে। আপনারা আমার সাথে আসেন।এই আদনান কুঞ্জন তোরা ওনাদের এ্যাটেন্ড কর আমি আসতেছি।"
ওদের পাঠিয়ে বেলা বিভানের লাগেজ ভিতরে ঢুকিয়ে ওনাদের নিজের রুমে নিয়ে এলো নিশাদ।এদিকে বাকিরা এখনো ঘোর কাঁটিয়ে উঠতে পারেনি। সবাই নিঃশব্দে সব দেখে যাচ্ছিলো।নিশাদ বেলা বিভানকে নিজের রুমে এনে  কিছুটা ধরে আসা কন্ঠে বলতে লাগলো,
''আমি তোকে আর ভাইকে অনেক বলতে চাইছিলাম।তোকে কল করেছিলাম ফোন ধরছিলিনা।আসলে ব্যাপার গুলা এতোটা দ্রুত হয়ে গেছে বুঝতে পারিনি।তারওপর প্রমোশনের পর থেকে কাজের চাপ বেড়ে গেছে। আর কথা হলো সাইমনের সাথে সাঁঝের বেশ কিছুদিন যাবৎ সম্পর্ক চলছিলো।আমি ওর সম্পর্কে খবর নিয়েছি বেশ ভালো।সাইমনের দাদি চাচ্ছিলেন সাঁঝকে দেখতে আসবেন তাই না করিনি আর।এবার বল কি করে এলি হঠাৎ?বাংলাদেশে চলে এলি অথচ জানালিনা৷ "
বিভান এতক্ষন নিশাদের কথা শুনে এগিয়ে এসে বলল,
''আমি বলছি নিশাদ..আমরা দু সপ্তাহ আগে গোয়া ঘুরতে গিয়েছিলাম..সেখানে দুদিন থেকে বাসায় ফেরার পর মনে হলো ক্রিসমাসের ছুটি উপলক্ষে দেশে আসা উচিত...বহু বছর হয়ে গেছে আসিনা...এদিকে পূর্ণাকেও দেখনি তোমরা...তোমার বোন মন খারাপ করে আমি বুঝতাম কিন্তু সাহস করে উঠতে পারিনি দেশে আসার কথা বলতে.. জানোই তো কিভাবে চলে গিয়েছিলাম তের বছর আগে...শেষ পর্যন্ত সাহস করে বলেই ফেললাম...ও রাজি হলো...কিন্তু সমস্যা হলো ভিসা পাসপোর্ট নিয়ে অনেক দৌড়াদৌড়ি করতে হয়েছে আমাদের..পূর্ণা যেহেতু এডপ্টেড চাইল্ড তাই ওর ক্ষেত্রে অনেক জটিলতা পাড়ি দিতে হয়েছে আমাদের...এদিকে লাগেজ গুছানোর কারণে সারা বাড়ি ওলটপালট হয়ে ছিল লাস্ট কয়েকটা দিন..তোমরা ভিডিও কল করলে ইচ্ছা করেই বেলা বেশি কথা বলতো না সারপ্রাইজ যদি বুঝে ফেল আশেপাশের অবস্থা দেখে সেজন্য...টানা তিন দিন ভিসা অফিসে সারাদিন থাকতে হয়েছে সব কিছু ঠিকভাবে করার জন্য..তারউপর এতদিন পরে আসছি খালি হাতেও আসতে ইচ্ছা হচ্ছিলোনা..তাই কিছু শপিংও করেছি শেষ মুহূর্তে..সব মিলিয়ে ফোনে কথা বলার সুযোগ হয়ে উঠেনি.. এখন যাই হোক সাঁঝকে যেই ছেলে দেখতে আসছে ওনারা অপেক্ষা করছে না ড্রইংরুমে..চলো সেদিকে যাই..আমাদের গল্প পরে শুনিও.." 
নিশাদ এতক্ষন বিভানের কথা শুনে স্তব্ধ ছিলো।লাস্ট কথাটা শুনে বিভানের সাথে যাওয়ার জন্য প্রস্তুনি নিলো।বিভান যাওয়ার আগে বেলাকে বলল,
''তুমি একটু রেস্ট করো।আর পূর্নাকে দেখো।একটু পর আমাদের জয়েন করো।"
বেলা কিছু না বলে স্বামী আর ভাইয়ের যাওয়ার দিকে চেয়ে রইলো।এদিকে বিভান কে দেখে সাঁঝের বুক কেমন করে উঠলো।তারমানে আপা আর বাবুও এসেছে।আনন্দে সাঁঝের চিৎকার করতে মন চাইছে কিন্তু সময়টা ঠিকনা।তাই চুপ রইলো সাঁঝ। এদিকে নিশাদ জাহানারা বেগম আর সাইমনকে উদ্দেশ্য করে বলল,
''ওনি আমার বড় দুলাভাই।মাত্র ইন্ডিয়া থেকে এসেছেন।বিভান বয়োজেষ্ঠ্য মহিলাকে স্নিগ্ধ হাসি দিয়ে সালাম জানায়।সাইমন মৃদু হেসে সালাম জানায় বিভানকে।বিভান সাইমনের সালামের উত্তর দিয়ে সোফায় বসে পড়লো।সবাই বেশ অবাক হলো যখন জাহানারা বেগম আর বিভান একে অপরের সাথে সহজে মিলে গেলেন।তাদের আলাপ আলোচনা এমন ছিলো যেন একে অপরকে বহুকাল ধরে চেনে।বিভানের সাথে গল্পে মেতে উঠেছেন জাহানারা বেগম। আসলে দুজনেই জমিদার বংশ থেকে এসেছেন।তাই হয়ত ওনাদের স্বভাব আচার আচরন মেলে কিছুটা।এদিকে মেয়ের জামাইকে দেখে জুলেখা বানুর বুক ফেঁটে কান্না আসতে চাইলো।মেয়েটাকে তের বছর আগে হারিয়ে ফেলেছিলো।আর আজ সেই  ঘা পূর্ন করে তার বেলা ফিরে এসেছে।বিভান আর জাহানারা বেগমের গল্প দেখে নিশাদ মাকে ইশারা করলো ভিতরে আসতে...ভিতরে আসার পর বলে উঠলো নিশাদ,
"আম্মা আপা দুলাভাই আমাদের সারপ্রাইজ দিতে না বলেই বাংলাদেশে আসছে...এখন কথা হলো ওদের তো আলাদা ঘর দিতে হবে থাকার...আব্বা পূর্ণাকে নিয়ে যে ভাগছে হুঁশ নাই আর...এদিকে বেলা আপা ভিতরে..তুমি ওর সাথে দেখা কর গিয়ে।" 
এতটুক শুনে জুলেখা বানু আর অপেক্ষা করতে পারেননা।এই মুহূর্তে মেয়েটাকে বুকে জড়িয়ে নিতে চান ওনি। অনেক কথা বলতে চান। ছেলেকে কিছু না বলে ভিতরের, ঘরে পা বাড়ালেন তিনি...যেয়ে দেখলেন 
তের বছর পর মেয়ে এসেছে.তার সাথে বাকি ভাইবোনগুলো গল্পে মশগুল..লাবনী, কুঞ্জন, আদনান এঘরে...বোনকে জড়িয়ে বসে আছে ওরা।।।।  মা কে আসতে দেখে  উঠে দাঁড়ালো বেলা..তারপর কোন কথা বার্তা ছাড়ায় মাকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে কেঁদে উঠে বেলা।।। কিছুক্ষনের জন্য কিছু বলতে পারলো না কেউই।।। জুলেখা বানু প্রথম কথা বলে উঠলেন,
"ভালো আছিস তো আম্মা?? জামাই ভালো রাখছে তো ??"
বেলা কান্না জড়িত কন্ঠে বলতে লাগলো,
''অনেক সুখে আছি আম্মা তোমাদের দোয়ায়।খুব ভালো রাখছে আমারে।"
মা মেয়ের এত বছর পর আবেগ ভালবাসা জড়ানো ক্রন্দনরত কিছু মুহূর্ত কাটলো...কিছুক্ষন পর জুলেখা বানু দেখলেন দরজার পাশে নাতনি কোলে স্বামী দাঁড়িয়ে আছেন.. বাবাকে দেখে বেলা এগিয়ে গিয়ে কিছু বলার আগেই উনি নিজেই বলে উঠলেন, 
"আমার নাতনির ঠান্ডা লাগতাছে..ওর শীতের কাপড় লাগবে আরো..বের করে দে.."
 বলে তিনি আবার চলে গেলেন। কিছু বলার সুযোগ পেলো না বেলা.. বাবা এখনো রেগে আছেন ভেবে কষ্ট পেয়ে পিছনে ঘুরলো সে..আসলে ইকরাম রহমান বুঝে উঠতে পারছেন না কিভাবে নিজের অনুভূতি প্রকাশ করবেন।। এত বছর শুধু রাগ দেখিয়ে এসেছেন তিনি।। এখন হুট্ করে তার অনুভূতির কণাগুলো দৌড়ে বের হয়ে আসতে চাইছে কিন্তু কিভাবে সেটা বোঝাবেন তিনি??? এদিকে পিচ্চি পূর্ণা এক হাতে মাথা চুলকাচ্ছে অন্যহাত নানার কাঁধে.. আশেপাশে তাকিয়ে ঝুটি নাড়িয়ে কিছুটা হতাশ হয়ে বুঝার চেষ্টা করছে 
"হচ্ছে টা কি এখানে..?"
ড্রইং রুমে গেলেন ইকরাম সাহেব নাতনিকে নিয়েই...গিয়েই শুনতে পেলেন সাইমনের দাদি বলছেন.. 
"বাবা বিভান..তুমিও তো সাঁঝের গার্জিয়ান..তোমাকেই বলি প্রথমে.. আমি আজ সাঁঝকে আংটি পরিয়ে যেতে চাই.."
নিশাদ বলে উঠলো 
"কিন্তু আমরা তো প্রিপারেশন নেইনি." 
"সমস্যা নাই আমরা নিয়ে এসেছি তাতেই চলবে.."
বলেই ব্যাগ থেকে একটা ছোট বক্স বের করলেন তিনি....সেদিকে তাকিয়ে ইকরাম রহমান হতভম্ব হয়ে বলে উঠলেন.
"আপনারা আংটি পরাবেন আমরা খালি হাতে বিদায় দেব এটা কি ঠিক হবে?" 
এবার কথা বললো বিভান।বলতে লাগলো,
"আচ্ছা আপাতত উপহার হিসেবে আমি এটা দিচ্ছি..পরে নতুন আংটি কিনে দেব।" 
বলে নিজের হাতের স্বর্ণের আংটিটা খুলে নিলো বিভান...ততক্ষনে সবাই ড্রইংরুমে চলে এসেছে..একটার পর একটা সারপ্রাইজের ধাক্কা চলছে যেন আজ এই বাড়িটায়।।। এই ধাক্কা কোথায় গিয়ে শেষ হবে কে জানে ...বিভান আবারো বললো 
"কিন্তু সাঁঝকে শাড়ি পরিয়ে আনা  হোক..একটু সময় দিন যদি আপত্তি না থাকে.."
"হ্যা হ্যা আমারও তাই মনে হয়..ঠিক আছে ওকে ভিতরে নিয়ে যাক.."বললেন সাইমনের দাদি.. 
"বেলা সাঁঝকে নিয়ে গিয়ে ওর জন্যে আনা কাতান সিল্ক শাড়িটা পরিয়ে নিয়ে আসো।। বেশি সাজিও না।। এমনিতেই সুন্দরী  মাশআল্লাহ আমার শালী" 
এদিকে এনগেজমেন্টের কথা শুনে বিষম খেল সাঁঝ।। তারমানে এই সারপ্রাইজের কথাই কাল রাতে বলেছিল সাইমন।।। ওর পুরো শরীরটা এক অদ্ভুত অনুভূতিতে কেঁপে উঠলো।। মনে মনে বললো 
"এনগেজমেন্ট !!!"
বিভানের ডাকে বেলা চলে এলো ড্রয়িংরুমে। বেলা কে দেখিয়ে বিভান জাহানারা বেগম কে বলল,
''ও আমার স্ত্রী সাঁঝের বড় বোন.....বেলা ওনি সাইমনের দাদি।"
বেলা মৃদু হেসে বলল,
''আসসালামু আলাইকুম দাদু। আসলে তাড়াহুড়ো করে এসেছি কথা বলতে পারছিনা।মাফ করবেন আমাকে।"
''না না নাতনী।সমস্যা নাই।বুঝতে পারছি।তুমি বরং সাঁঝকে নিয়ে তৈরি করে আনো।আমরা আছি।"
বেলা সাঁঝকে নিয়ে রুমে যেতে যেতে বলছিলো,
"আমার সময় তো খুব মাতব্বরি করছিলি আর নিজের প্রেমের কথা আমাকে বললি না একবারও"
 এবার আর কিছু বলতে পারলো না সাঁঝ।।রুমে এসে বোনকে জড়িয়ে কাঁদতে শুরু করলো।। ওকে থামিয়ে বেলা বলল 
"পরে তো বিচার হবে আপাতত তোর দুলাভাই এর আদেশ পালন করতে হবে।। এই লাবনী এদিকে যায় আর হুমায়রা কোথায়??'।।
লাবনী দৌড়ে এলো। বেশ কিছুক্ষন ধরে হাতড়ে হাতড়ে সামনে যা পেলো তাই দিয়ে সাঁঝকে সাজালো বেলা।।।। এই অল্পতেই ওকে এত স্নিগ্ধ লাগছে যা পার্লারে হাজার টাকা দিয়ে সাজালেও মনে হয় লাগে না।। এই সাজানোর হাতে মায়া আছে ভালোবাসা আছে।। সাজানো শেষে বলে উঠলো 
"ভেবেছিলাম দেশে এসে তোদের আমি সারপ্রাইজ দিবো কিন্তু উল্টা আমাকে সবথেকে বড় সারপ্রাইজটা তুই দিলি।।। কিন্তু আমি অনেক খুশি এই সারপ্রাইজ পেয়ে।। আচ্ছা তুই সিউর তো সাইমনই সেই মানুষ ??তোকে কি আসলেই বুঝে ও?"
"আপা আমি ভুল মানুষটাকে ভালোবাসিনি বিশ্বাস কর।। তুমি নিজেও প্রমান পাবে ইনশাআল্লাহ"
"ঠিক আছে"
এদিকে ড্রইং রুমে সাইমনের দাদি বলছিলেন 
"আপনাদের কিছু কথা খোলাসা করেই বলি।। হয়তো জানেন আমার এই নাতির আমি ছাড়া কেউ নেই।।। ওর বাবা মা অনেক আগেই মারা গেছে।। ভাই ভাবি সেরকম খবর নেয় না।।।। এদিকে আমার শরীরটাও আজকাল খুব বেশি চলে না।। বয়স হয়েছে বুঝেনই তো।।। আমাদের এদিকে আত্মীয়স্বজন তেমন নেই বললেই চলে।।। তাই আমি চাই বিয়েটা যত দ্রুত সম্ভব দিয়ে ফেলতে।। আর বিয়ের অনুষ্ঠান একসাথে দুইপক্ষ থেকে করতে।।।। যেহেতু লোকজন আমাদের কম আর তাছাড়া আজকাল অতিমাত্রায় জাঁকজমকের বিয়ে আমার মন টানে না কেন জানি।।। এই জাঁকজমকের ভিড়ে পারিবারিক ছোট ছোট আনন্দগুলো ফিকে হয়ে আসছে আমার মনে হয়।। সেটা আমি মাটি করতে চাই না।। এখন আপনারা কি বলেন?"
জুলেখা বানু বলে উঠলেন 
"কিন্তু বিয়ার তৈয়ারি তো নিতে অইবো তাই না ??বিয়ার লাইগা কেনাকাডা ও তো করতে অইবো।। "
"সব করবো আমরা আমাদের সাধ্যমত আপনারা আপনাদের সাধ্যমত।। কোন জোর নেই বা ডিমান্ড নেই আমার কিংবা আমার নাতির।।। "
নিশাদ বলে উঠলো 
"কবে ডেট দিতে চান দাদি?"
"আগামী দুই সপ্তাহের মধ্যেই "
কথা বললো বিভান 
"আসলে আমরা খুব স্বল্প সময়ের জন্য এসেছি।একুশ দিন আছে আমাদের হাতে।তাই চাইছি বিয়েটা সামনের সপ্তাহে করাতে।আপনার যদি কোন আপত্তি না থাকে তো।আর কেনাকাটা সকল এ্যারেঞ্জনমেন্ট হয়ে যাবে।আমরা সবাই যেহেতু আছি। করে ফেলবো সব।"
জাহানারা বেগম হেসে বললেন,
''তাহলে তাই হোক।আপনাদের ছাড়া বিয়েটাও অসম্পূর্ণ থাকবে।আর আপনারা ও তখন তাড়াহুড়া করতে থাকবেন।তাহলে সামনের সপ্তাহে জানুয়ারির এক তারিখে বিয়েটা সম্পন্ন করি।তাহলে এটাই ফাইনাল হলো।"
বিভান মাথা ঝাঁকালো।ইকরাম রাহমান নাতনীকে কে কোলে নিয়ে জামাইকে দেখছিলো। হঠাৎ করেই ছেলেটা যেন অনেক বড় দায়িত্ব নিয়ে নিচ্ছে।আংটি বের করলেন জাহানারা বেগম..... ধরিয়ে দিলেন সাইমনের হাতে।
সাইমন সাঁঝের হাত টা ধরার সাথে সাথেই ও কেঁপে উঠলো।।। ঘামতে লাগলো।।।। অতি কাছের মানুষটা আজ অফিসিয়ালি ওর বাগদত্তা হতে যাচ্ছে ভেবেই ওর মিশ্র অনুভূতি কাজ করা শুরু করলো।।। স্মৃতির পাতায় ভেসে উঠলো সেই প্রথম দেখা হওয়ার দৃশ্য টা।। লিফটে বারবার দেখা হওয়ার দৃশ্যগুলো।। ওকে বাসায় ড্রপ করা এরপর নিজেই ভুল বুঝে সাইমনকে ইগনোর করা এবং একটা সময় বুঝে ফেলা "ও ভালবাসে এই মানুষটাকে " সেইসাথে এই মানুষটাও ওকে ভালোবাসে।।। সাইমনের ওকে নিয়ে ইন্সিকিউরিটি ওদের ঝগড়া সব আজ ফ্ল্যাশব্যাকে আসতে লাগলো মনের পর্দায়।। ততক্ষনে আংটি পড়ানো শেষ।।। আর সাঁঝের মনে হলো আংটি পরিয়েছে আঙুলে আর অনুভূতির একটা সাগর ওকে ধাক্কা দিয়েছে ওর হৃদয়ে।।। চোখ দিয়ে গড়িয়ে পড়লো কয়েক ফোঁটা অশ্রু।।। 

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন