ভয়াবহ যন্ত্রণা চারিদিক থেকে গ্রাস করলে অগ্নিদগ্ধ হওয়ার মত একটা জীবন কাটতে থাকে। মনে অসুখ, শরীরেও অসুখ। টানা দুদিন জ্বরে পড়ে রইলো কিন্তু কেউ দেখতেও এলো না। চাচী এসে একবার ভাত দিয়েই চলে গেছে। নেই কোনো আপনজন, নেই কোনো পরিচিত ব্যক্তি। মশার কামড়ে অংশীর তখন প্রাণ যায় যায় অবস্থা। খাবার মুখে দিলেই বমি আসছে, মাথা ঘুরে বারবার পড়ে যাচ্ছে অংশী। চোখ ফেটে জল আসে। বুক ফেটে বেরিয়ে আসে আর্তনাদ। বমি করে পুরো ঘর ভাসিয়ে ফেললো অংশী। সেই বমির গন্ধে আবারও বমি আসে। সেই ঘরেই শুয়ে শুয়ে শরীরের অবস্থা ভয়াবহ খারাপ হয়ে গেলো। অংশী ধরেই নিলো ও আর বাঁচবে না। এখানেই ওর জীবনের সমাপ্তি। কিন্তু মরে গেলে দাফন করারও লোক নেই, এতটাই অসহায় অবস্থায় মরতে হবে ওকে৷ একই জামায় কয়েকদিন কেটে গেছে, জামাতেও লেগে গেছে বমি। নিজেকে অসহ্য লাগছে অংশীর। জীবনটা এখানেই শেষ হয়ে যাক।
অংশী পেটে হাত বুলিয়ে গভীরভাবে বাচ্চাকে অনুভব করে বললো, 'আমার লক্ষীটা রে, তোর মা তোরে বাঁচাইতে পারলাম না রে। আমি মইরা যাইতাছি, তুইও দুনিয়ায় আওনের আগেই মইরা যাবি। কি করমু বল, মাপ করিস তোর মায়রে।'
অশ্রুতে গলা ভিজে গেলো অংশীর। অজ্ঞান হয়ে পড়লো আবারো।
অংশী হুশ ফিরলে দেখলো ও একটা অচেনা ঘরে শুয়ে আছে। কিছুটা অবাক হয়েই তারাহুরো করে উঠে বসলো। এমন সময় একটা মেয়ের গলা শুনতে পেলো, 'কি গো, মইরাই তো যাইতাছিলা।'
তাকিয়ে দেখে লিমা। কাছে এগিয়ে এসে লিমা অংশীর পাশে বসলো। সহানুভূতির সাথে বললো, 'আমাগো জীবনের কোনো দাম নাই বুছছো? গিয়া দেখি মরার মত ঘরে পইড়া রইছো। তাই নিয়া আইছি। শুনো, ওষুধ টষুধ খাইয়া তারাতারি সুস্থ হইয়া যাও। তোমারে এক জায়গায় নিয়া যামু।'
লিমার আন্তরিকতার মুগ্ধ হলো অংশী। লিমা ওকে গরম ভাত এনে দিলো, জল গরম করে দিলো। নিজের জামাকাপড় দিয়ে বললো, 'গোসল কইরা নেও।'
লিমা অংশীকে ওষুধও এনে খাওয়ালো। দীর্ঘদিন পর গোসল করে খানিকটা ফুরফুরে শরীরে বিছানায় এসে বসলো অংশী। লিমা অংশীর হাত ধরে বললো, 'তোর জীবনের কাহিনি আছে আমি বুজছি। স্বামী ছিলো না রে?'
অংশী কোনো কথা না বে একটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়লো। লিমা বললো, 'শোন। তোর ভালোর জন্যেই তোরে কই, আমার লগে কামে যাবি? ভালো খাইতে পারবি, ভালো পড়তে পারবি। কুনো কুনো দিনে পাঁচ হাজার টেকাও কামাই করি। বুজছিস? এইভাবে বাঁচতে পারবি না। আমার লগে চল।'
অংশী কিছুক্ষণ নিশ্চুপ হয়ে রইলো। ওর কণ্ঠস্বর দিয়ে বহুদিন কথা বেরোয় না। অনেক কষ্টে বললো, 'কি কাম?'
লিমা অংশীর কানের এসে ফিসফিস করে বললো, 'মাগীবাজি বুজোস? হুনতে ভালা লাগবো না জানি। পুরুষ মানুষরে খুশি করা কাম। আমরা হ্যার লগে কয়ডা ঘন্টা থাকমু, হ্যায়রা খুশি হইয়া টাহা দিবো বুজছোস?'
অংশী অবুঝের মত ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে রইলো। কিছুই বুঝতে পারলো না। লিমা ওর চাহনি দেখেই বুঝতে পেরেছে অংশী আসলে কতটা নির্বোধ। ও হেসেই লুটোপুটি। বললো, 'তুই কি কচি খুকি? এইগুলাও বুজোস না? সেক্স বুজোস?'
অংশী দুদিকে মাথা নাড়লো। লিমা আবারও হেসেই কুটিকুটি। শব্দ করে হাসতে লাগলো ও। হাসি থামিয়ে বললো, 'আয় তোরে বুঝাই দিই। ক্যামনে পুরুষ মানুষের লগে থাকতে হয়..'
আবারও অট্টহাসি লিমার। অংশী হা করে তাকিয়ে রইলো। অনেকদিন পর কারো উচ্চস্বরে হাসি দেখছে ও। শেষ কবে মাহিবের হাসি দেখেছিলো মনে নেই। অংশী চোখ পিটপিট করে তাকিয়েই রইলো। লিমা যখন পুরো ব্যাপারটা খোলাখুলি ভাবে অংশীকে বুঝিয়ে বললো, তখন কাটা দিয়ে উঠলো অংশীর শরীর৷ নিজের কানকেও অবিশ্বাস্য মনে হচ্ছিলো। শরীরে রক্ত ছলকে ওঠে অংশীর। মনে হতে থাকে পায়ের নিচ থেকে মাটি সরে গেছে। এ কি করে সম্ভব!
লিমা হাসছে আর বলছে, 'করবি নাকি বল? একদিনে একটা পুরুষ রে দিবি। তাতেই অনেক হইবো। আমার কাছে মেলা বড়লোক পাটি আছে। বহুত টাহা পয়সা।'
অংশীর শরীর জ্বালা করছে। কেবলই মাহিবের কথা মনে পড়ছে ওর। মাহিব কি ওকে এমন মেয়েদের মত ব্যবহার করেছে? অংশীর শিরা উপশিরায় আগুন ধরে গেলো।
লিমা ওকে বুঝিয়ে বললো কিভাবে তাদেরকে খুশি করতে হয়, কিভাবে সন্তান জন্মদান না হওয়ার জন্য পদ্ধতি নিতে হয়। অংশী শুনতে শুনতে আগুন হয়ে উঠছিলো। মাহিবের প্রতি ঘৃণা, অপমানে লাল হয়ে উঠলো ওর মুখ। অংশী জানত বিয়ে হলেই বাচ্চা হয়। সন্তান হওয়ার এই অদ্ভুত নিয়ম অজানা ছিলো ওর। তাই তো নিজেও আজ এক কঠিন যুদ্ধক্ষেত্রের যোদ্ধা।
লিমার সব কথা নিশ্চুপ হয়ে শুনে গেলো অংশী। মনে হলো, জীবনকে এরা কতটাই নিম্ন পর্যায়ে নিয়ে গেছে। কারো কারো কাছে শরীর একটা খেলনা পুতুল মাত্র। নিজের শরীরটাকে এরা ইচ্ছেমতো খেলায় নিয়োগ করে। খেলা শেষ হয়ে গেলে বড়লোকরা আবার ছুড়ে ফেলে দেয়। মেয়েরাও নিজেদের এই জীবন মেনে নেয় অকপটে। দিব্যি হেসেখেলে বেড়ায়, রাত্রিবেলা অন্যের শরীরের নিচে নিজেকে সঁপে দেয়। বিনিময়ে হাসতে হাসতে টাকা নিয়ে বাসায় ফেরে। কিভাবে পারে! এই নরকের মত জীবনকে কিছুতেই মেনে নিতে পারবে না অংশী। এটা খারাপ কাজ, যারা এসব করে তারা ভালো নয়। ওর সন্তান জানবে ওর মা একজন খারাপ মহিলা, এটা কিছুতেই হতে পারে না।
অংশী লিমাকে কোনো উত্তর না দিয়ে ঘরে ফিরে এলো। সারাঘরে মাছি উড়ছে, একটা কুকুর শুয়ে আছে অংশীর কম্বলের উপর। দ্রুত এসে কুকুরটাকে তাড়িয়ে দিয়ে ঘর পরিষ্কারের কাজে লেগে গেলো অংশী। দূর্গন্ধে বমি আসার জোগাড়। আজ চোখে, মুখে, কানে, সর্বাঙ্গে আগুন জ্বলছে। বিচিত্র জগতের জন্য জন্ম নিচ্ছে ধিক্কার।
সারারাত নানা কথা ভাবতে ভাবতে কেটে গেলো। রাতে ভালোমতো ঘুম হলো না অংশীর। রাতে কাজে যাওয়ার আগে লিমা আবারও এসেছিলো অংশীর দ্বারে। অংশী কোনো উত্তর না দিয়ে লিমাকে ফিরিয়ে দিয়েছে। নির্ঘুম রাতে শত অব্যক্ত কষ্ট হানা দিলো অংশীর মস্তিষ্কে। মাহিবের ভালোবাসা, প্রতারণা, মাহিবকে হারানো, একটা অনাগত সন্তান, শত যাতনায় কেটে গেলো সারাটা রাত।
পরদিন বাড়িওয়ালা চাচীর সাথে ইট ভাঙার কাজে এলো অংশী। কিন্তু অংশীর দূর্বল শরীর দেখে ওকে আর কাজ দিলো না কেউ। হতাশ হয়ে রাস্তায় রাস্তায় ঘুরতে লাগলো। সন্ধ্যা হবার পরও বাড়ি ফিরতে ইচ্ছে করছিলো না ওর।
হলুদ আলো জ্বলে উঠলে ফুটপাত ধরে হাঁটতে হাঁটতে অচেনা শহরকে অবাক চোখে দেখছিলো অংশী। মনে বড় অশান্তি। যেদিকে তাকায় শুধু মরুভূমির মত মনে হতে থাকে। হঠাৎ দেখলো কিছু মেয়ে ফুটপাতে সেজেগুজে এসে দাঁড়িয়েছে। বিভিন্ন ভঙ্গিতে পুরুষদেরকে আকৃষ্ট করার চেষ্টা করছে, হাসছে। মন ভুলানো নীতি অনুসরণ করছে। পুরুষরাও ছোঁক ছোঁক করছে ওদের পাশে। অংশীর বুঝতে বাকি রইলো না এরা কারা। এরা নিশ্চয়ই লিমার দলেরই মেয়ে। কেউ হয়তো ইনকামের উদ্দেশ্যে এ কাজে নেমেছে। কিন্তু অংশীর মত অনেকেই আছে যারা হাজারো কষ্ট বুকে নিয়ে এ পথে পা বাড়িয়েছে, কেউবা পরিস্থিতির শিকার হয়ে। নিজেকেও শেষ পর্যন্ত এই দলে নাম লিখাতে হয় কিনা সেই ভেবে শিউরে উঠলো অংশী।
২৩!!
প্রীতম এই তিনদিনে অনেক বাসা খুঁজে ব্যাচেলার মেয়ের জন্য বাসা না পেয়ে একটা হোস্টেল দেখে এসেছে। সেখানেই নিয়ে যেতে হবে অংশীকে। অংশী কি অবস্থায় আছে কে জানে। কিন্তু ঘরের ব্যবস্থা না করে অংশীর সামনে আসতেও লজ্জা করছিলো প্রীতমের।
বস্তিতে এসে প্রীতম দেখে অংশী একটা পাইপের উপর বসে আছে। কয়েকজন মহিলা উৎসুক চোখে ওকে দেখছে। অংশীর গালে হাত, আনমনে ভাবছে কিছু একটা। প্রীতম কাছে এসে বললো, 'অংশী..'
তেমন ভাবান্তর হলো না অংশীর। ও কেমন যেন পাথর হয়ে গেছে। প্রীতম আবারও ডাকলো, 'অংশী শুনছো?'
এবার মুখ তুলে তাকায় অংশী। শুষ্ক মুখ, চোখ দুটো লাল হয়ে আছে। অংশীকে দেখেই বুকের ভেতর খানখান হয়ে যেতে চাইলো প্রীতমের। ইচ্ছে করলো অংশীকে জাপটে ধরে বুকের ভেতর পিষে ফেলে। কি করুণ দেখাচ্ছে মেয়েটাকে। এ দৃশ্য মেনে নিতে প্রচন্ড কষ্ট হলো প্রীতমের।
অংশী বললো, 'কি প্রীতম ভাই?'
-‘তোমার চেহারার এ কি হাল হয়েছে অংশী?'
-'আর চেহারা, জীবনটাই তো শ্যাষ হইয়া গ্যাছে।'
-'অংশী, এভাবে বোলো না। তোমার এই কষ্ট আমি আর নিতে পারছি না। আরেকবার ভেবে দেখা যায় না অংশী?'
-'এই মরারে নিয়া আপনে আর ভাইবেন না। একজন রাস্তার মেয়েরে ক্যান ঘরে তুলবার চান প্রীতম ভাই?'
প্রীতম ইতস্তত করে অংশীর পাশে বসে পড়লো। মৃদু স্বরে বললো, 'আমি তোমার এই কষ্ট সহ্য করতে পারছি না।'
-'আর আইসেন না এইখানে। মাইনষে খারাপ কইবো।'
-'আসবো না। আমি তোমাকেও এখানে থাকতে দেবো না। বিয়ের জন্য তোমাকে বলবো না। তুমি আরো সময় নাও। কিন্তু আজকে এখান থেকে চলো। একটা বাসা দেখবে।'
অংশী প্রীতমের দিকে না তাকিয়েই জানতে চাইলো, 'কিসের বাসা?'
-‘তোমার জন্য একটা হোস্টেল দেখেছি। মানে বাসা আর কি। তুমি দেখবে চলো পছন্দ হয় কিনা।'
অংশী নির্বিকার ভঙ্গীতে বললো, 'দেখন লাগবো না। আমি সবখানেই থাকবার পারুম।'
-'ঠিকাছে, চলো তবে।'
হোস্টেল দেখে পছন্দ হলো অংশীর। সেখানে একাই থাকতে হবে। অবশ্য একা নয়, অংশীর ঘরে আরো দুজন মেয়ে থাকে। মেয়েদুটোকে দেখে অতি আধুনিক মনে হলো। অংশীর দিকে ভ্রু কুঁচকে তাকালো ওরা। কে জানে অংশীর সাথে থাকতে ওদের আপত্তি জাগে কিনা।
প্রীতম হোস্টেলের জন্য বিছানাপত্র ও অংশীর জন্য প্রয়োজনীয় সবকিছুর ব্যবস্থা করে দিলো। সেদিনই হোস্টেলে উঠে গেলো অংশী। চলে আসার সময় প্রীতমের বুক ফেটে যেতে চাইছিলো। কিন্তু অংশীকে জোর করতে পারলো না। মেয়েটাকে একলা ফেলে যেতেও মন চাইলো না। কিছুই করার নেই। একটা ভালো বাসা ভাড়া নেয়ার অনেক চেষ্টাই করেছে। কেউই ব্যাচেলার মেয়েকে বাসা দিচ্ছে না। এই মুহুর্তে হঠাৎ করে সাবলেট বাসা ও পাওয়া যাচ্ছে না। ভাগ্যিস হোস্টেলে ম্যানেজ করা সম্ভব হয়েছে। নয়তো ওই বস্তিতে থাকলে আরো ভয়াবহ অবস্থা হতো অংশীর। এখন অন্তত নিরাপদে ঘুমাতে তো পারবে- এই আশ্বাস নিয়ে ফিরে গেলো প্রীতম।