জয় এসে দেখে জীবন হাঁটু গেড়ে নিচে বসে আছে। তার চোখ টকটকে লাল।
'জীবন এভাবে বসে আছিস কেন? তোরা বের হবি কখন? এয়ারপোর্টে গিয়ে তো পৌঁছুতে হবে।'
জীবন কিছু বলছে না। জয় বলল,
'ভেবলি কোথায়? '
'স্পৃহা চলে গেছে? '
'কি! কোথায় গেছে? '
'আমাকে ছেড়ে চলে গেছে।'
এবার জীবনের চোখ বেয়ে পানি পড়তে লাগলো। জয় এসে জীবনকে ধরে তুলে বলল,
'কি বলছিস এসব? ভেবলি তোকে ছেড়ে কেন যাবে? '
'সব কিছু আমার জন্য হয়েছে। আমি সত্যিই স্পৃহাকে অনেক কষ্ট দিয়েছি। আমার ভুলের জন্য স্পৃহা আমাকে ছেড়ে গেছে জয়।'
জয় জীবনের কথা কিছু বুঝতে পারছে না।
'আমি কিছুই বুঝতে পারছি না। কি হয়েছে আমাকে খুলে বল প্লিজ। '
জীবন জয়কে সবকিছু বলল। সব শোনার পর জয় বলল,
'স্পৃহা সম্পূর্ণ সত্যি না জেনে তোকে ভুল বুঝেছে। নূপুর তোকে ব্ল্যাকমেইল করছিল।
আমি তো জানি তুই স্পৃহাকেই ভালোবাসিস। ওকে বলবি বলবি করেও নানা বাধায় পড়ে বলতে পারিস নি।'
'স্পৃহা আমাকে ভালোবাসে জয়। এটা আমি আজ জানতে পেরেছি। আগে জানলে হয়তো এসব হতো না। স্পৃহা যাবার আগে আমাকে ওর ভালোবাসার কথা জানিয়ে দিয়ে গেছে।'
'স্পৃহা তোকে অনেক আগে থেকেই ভালোবাসে গাধা। খালামণি স্পৃহা নিয়ে যাবার পর যখন অন্য জায়গায় ওর বিয়ে দিতে চাইছিল। তখনই মারিয়া আপু আমাকে সব জানায়। আর তাই তো আমি নিজে তোকে স্পৃহাকে বিয়ে করতে বলেছিলাম। '
'তুই আমাকে এটা আগে কেন বলিস নি?'
'আচ্ছা এখন তুই শান্ত হ। আর এটা বল ভেবলি কোথায় গেছে? '
'আমি জানি না। হয়তো তোদের বাসায় যাবে।'
'তুই ওকে আটকালি না কেন? '
'কি করে আটকাতাম? সেই অধিকার স্পৃহা আমার থেকে নিয়ে নিয়েছে। আমাকে ওর কসম দিয়ে গেছে।'
'তুই সত্যিই একটা ছাগল। এই রাতের বেলায় ওকে একা ছেড়ে দিলি। স্বামী স্ত্রীর মধ্যে রাগারাগি হবে, ঝগড়া হবে তাই বলে ভেবলি বাড়ি থেকে বের হয়ে যাবে? আর তুইও যেতে দিবি? জোর করে হলেও তো ওকে আটকাবি।'
'তখন আমি কিছু বুঝতে পারছিলাম না। স্পৃহা খুব কাঁদছিল রে। আমি না চাইতেও ওকে কষ্ট দিয়ে ফেলেছি। স্পৃহা মনে হয় কখনো আমাকে ক্ষমা করবে না।'
'আরে দূর ক্ষমা করবে কি করবে না তা পরে দেখা যাবে। আগে চল স্পৃহাকে ফিরিয়ে আনি। নাহলে তোদের ফ্লাইট মিস হয়ে যাবে।'
'স্পৃহা আমার সাথে ফিরবে? '
'গাধার মত কথা বলিস না তো। আর আগে চোখ মুছ। তুই ছেলে হয়ে কাঁদছিস কেন?'
জয় হয়তো ভেবেছে ওদের মধ্যে ছোটখাটো ঝগড়া হয়েছে। তাই সে এখনো এতটা স্বাভাবিক আছে। কিন্তু জীবন জানে স্পৃহা তার কাছে আর ফিরে আসবে না। যাবার আগে স্পৃহা ডিভোর্সের কথা বলে গিয়েছে। বারবার ঐ কথাগুলো ভেবে জীবন অস্থির হয়ে উঠছে। কোনোভাবেই নিজেকে স্বাভাবিক রাখতে পারছে না। ওরা দু'জন স্পৃহার খোঁজে জয়দের বাসার উদেশ্যে বেরিয়ে গেল।
স্পৃহা কান্না করতে করতে ক্লান্ত পায়ে রাস্তার পাশে ফুটপাত ধরে হাঁটছে। সে আজ জীবনকে ছেড়ে চলে এসেছে। কিন্তু এখন কোথায় যাবে, কার কাছে যাবে কিছুই বুঝতে পারছে না। খালামণি, মারিয়া, জয় ওকে অনেক ভালোবাসে। ওরা স্পৃহার এই অবস্থা সহ্য করতে পারবে না। স্পৃহাও তাদের কাছে গিয়ে তাদেরকে টেনশনে ফেলতে চায় না।
'সবাই থাকতেও আজ আমার কেউ নেই। নিজেকে বড্ড একা মনে হচ্ছে। আমার সাথে কেন এমন হলো? আমি তো কখনো এমন লাইফ চাই নি। সব সময় সবাইকে নিয়ে আমি ভাল থাকতে চেয়েছিলাম।'
স্পৃহা চারিদিকে তাকিয়ে দেখছে। তাকে সাহায্য করার মত এখানে কেউ নেই। নির্দিষ্ট করে তার যাওয়ার কোনো জায়গা নেই। তবুও স্পৃহা হাঁটছে। খালামণির বাসায় সে যাবে না। কোথায় যাবে তাও জানে না। জয় জীবনকে নিয়ে তাদের বাসায় এলো। মারিয়া ওদের দেখে বলল,
'কিরে তোরা এখানে কেন? এয়ারপোর্টে যাবি না?'
জয় বলল,
'যাব। আমার ফোন ফেলে গেছি। তা নিতে আসছি।'
'তুই যে করিস না জয়। স্পৃহা কোথায়?'
স্পৃহা কোথায় এই কথা শুনে জীবন জয় একে অপরের দিকে তাকালো। তার মানে স্পৃহা এখানে আসেনি। স্পৃহা এলে মারিয়া নিশ্চয়ই তার কথা জিজ্ঞেস করতো না। তবুও জয় মারিয়াকে দেখিয়ে তার রুম থেকে ঘুরে আসলো। বাইরে এসে জীবন বলল,
'স্পৃহা তো এখানে আসেনি। কোথায় গেছে ও?'
'বুঝতে পারছি না। আমাদের বাসায় আসতে তো এতো সময় লাগার কথা না। রাস্তায় আছে নাকি এখনো? '
'জানি না। আমি কিচ্ছু বুঝতে পারছি না। সব দোষ আমার। আমার জন্যই স্পৃহা চলে গেছে। '
'আরে নিজেকে দোষ না দিয়ে আগে ওকে খুঁজে বের কর। তুই কেন ওকে একা যেতে দিলি? কোথায় খুঁজব ভেবলিকে?'
জীবন মাথায় হাত দিয়ে রাস্তায় হাঁটু গেড়ে বসে পড়লো। জয় এবার রেগে গিয়ে বলল,
'বসে পড়লি কেন? তোর আর স্পৃহার মধ্যে ঠিক কি হয়েছে বল তো।'
জীবন অসহায় ভাবে জয়ের দিকে তাকিয়ে রইলো। কিছুক্ষণ দু'জন চুপ করে নিজেদের দিকে তাকিয়ে থেকে জীবন উঠে দাঁড়াল। বলল,
'স্পৃহা যেখানেই থাকুক। আমি ওকে খুঁজে বের করবোই। কোথাও যেতে দিব না ওকে। ওকে পেলে জোর করে হলেও আমার সাথে নিয়ে যাব। কোনো কথা শুনবো না ওর।'
জয় আর জীবন আবার বেরিয়ে গেল। দু'জনই রাস্তার দু'পাশে চোখ রেখে স্পৃহাকে খুঁজছে। হয়তো স্পৃহা রাস্তায় কোথাও বসে আছে।
স্পৃহা কোথায় যাবে ভেবে পাচ্ছিল না। এক সময় এসে সে রাস্তার পাশে একটা গাছের নিচে বসে পড়লো। রাত বাড়ছে। লোকজন যেন তাকে কীভাবে দেখছে। রাত আরো বাড়ার আগে স্পৃহাকে কোথাও যেতে হবে। স্পৃহা হাঁটুতে মুখ গুজে বসে বসে কাঁদছে।
'কোথায় যাব? কার কাছে যাব এখন? উনি কি আমাকে খুঁজছেন?'
হঠাৎ সামনে থেকে কারো কথা শুনে স্পৃহা মাথা তুলে তাকালো।
'মা তুমি এতো রাইতে এহানে বইয়া আছো ক্যান?'
স্পৃহা যেন অন্ধকারে আলো দেখতে পেল। রিকশাওয়ালা চাচাকে দেখে স্পৃহা কেঁদে ফেলল।
'কি হইলো মা কান্তাছো ক্যান? কি হইছে? '
চাচা স্পৃহার সামনে বসলেন। স্পৃহা কাঁদতে কাঁদতে বলল,
'আমার কোথাও যাওয়ার জায়গা নেই চাচা। আমি কোথায় যাব বুঝতে পারছিলাম না।'
'যাওয়ার জায়গা নাই? তোর জামাই কই? আর জয় বাবার কি হইছে? '
'সবাই থাকতেও আজ আমার পাশে কেউ নেই চাচা। আমি উনার থেকে চলে এসেছি। এই অবস্থায় আমি খালামণির বাসায় যাব না। ওরা আমাকে এভাবে দেখে কষ্ট পাবে। আর খালামণির বাসায় গেলেও। উনি ওখানে গিয়ে আমাকে আবার নিয়ে আসবে। আমি উনার কাছে ফিরতে চাই না। আমি বাবা মা'র কাছে চলে যাব। কিন্তু এতো রাতে কীভাবে যাব। আমার কাছে টাকাও নেই।'
স্পৃহার কান্না দেখে উনি বললেন,
'কান্দে না মা। তুমি আমার লগে চলো। আমার বাড়িত থাকবা। আমারে তুমি চাচা ডাকো না? আমারও তোমার মত দুইটা মেয়ে আছে। তুমি আমার মেয়েগোর লগে থাকবা। কাল সকালে আমি নিজে তোমারে তোমার বাপ মা'র কাছে দিয়া আসমু। এহন তুমি রাইতের বেলা রাস্তায় বইসা থাইকো না। দিনকাল ভালা না মা।'
স্পৃহা উনার কথায় ভরসা করে উনার সাথে যাবে ভেবে নিয়েছে।
'কি হইলো আমারে বিশ্বাস করো না? আমি তোমারে মা ডাকি। মায়ের ক্ষতি হোক তা আমি চাই না। আমার লগে গেলে তোমার কোনো ক্ষতি হইব না।'
স্পৃহা উঠে দাঁড়াল। চোখ মুছে বলল,
'আপনাকে আমি বিশ্বাস করি চাচা।'
'তাইলে চলো। রিকশায় ওঠো। '
রাত দশটায় ওদের ফ্লাইট ছিল। এখন এগারোটা বাজে। জীবন এখনও স্পৃহাকে খুঁজে পায় নি। রাত এগারোটা বেজে গেছে। স্পৃহা এখন কোথায় আছে তা ভেবেই জীবন অস্থির হয়ে আছে।
'জয় স্পৃহা কোথায় যেতে পারি। আমার মাথা কাজ করছে না। মেয়েটা হঠাৎ হাওয়ায় মিলিয়ে গেল নাকি? কখন থেকে খুঁজছি ওকে তো এখনো পেলাম না।'
জয়ও বুঝতে পারছে না তাদের এখন কী করা উচিত।
'ভেবলি কোথায় গিয়ে বসে আছিস বোন। এতো রাগ কেউ করে? তোর কিছু হয়ে গেলে আমরা কীভাবে ঠিক থাকবো? নিজেকে কখনো ক্ষমা করতে পারব না। তুই যেখানেই থাকিস স্পৃহা ফিরে আয়। আর টেনশন দিস না বোন।'
জয় জীবনের উপরও রাগ করতে পারছে না। জীবন আগে থেকেই স্পৃহাকে নিয়ে অনেক টেনশনে আছে। স্পৃহাকে খুঁজে খুঁজে জীবনের অবস্থাও খারাপ হয়ে গেছে।
জীবন রাস্তার মাঝে বসে পড়লো।
'জয় স্পৃহাকে আমরা পাব না। স্পৃহা আমার উপর রাগ করে আমাদের ছেড়ে অনেক দূরে চলে গেছে। আমি স্পৃহাকে হারিয়ে ফেলেছি।'
'বাজে কথা বলিস না তো। স্পৃহা কোথায় যাবে আমাদের ছেড়ে? এ শহরে আমরা ছাড়া ওর আর কে আছে? '
'জানি না। স্পৃহার কিছু হলে আমি কি করবো নিজেও জানি না। এতো রাতে কোথায় যাবে ও? আগের বারও স্পৃহা কিছু বাজে ছেলের হাতে পড়েছিল।'
জয় ধমক দিয়ে জীবনকে থামিয়ে দিয়ে বলল,
'উল্টাপাল্টা কথা ভাবিস না। বসে থাকলে হবে না। আমাদের স্পৃহাকে খুঁজতে হবে। আল্লাহ তুমি আমার ভেবলির কিছু হতে দিও না। ভেবলিটা যে বড্ড বোকা।'
'জয় স্পৃহা ওর বাবা মা'র কাছে চলে যায় নি তো? কিন্তু সেখানে কীভাবে যাবে? স্পৃহা তো সাথে করে ফোন টাকা কিছুই নেয় নি। খালি হাতে বেরিয়ে গেছে।'
এতো রাতে স্পৃহার খুঁজে ওখানে কল করলে সবাই চিন্তায় পড়ে যাবে। যা করার সকালে করতে হবে। স্পৃহা রিকশাওয়ালা চাচার সাথে উনার বাসায় চলে এসেছে। এখানে আসার পর উনার দুই মেয়েকে স্পৃহার সাথে খুব মিশে গেছে। রাতে না খেয়ে স্পৃহা ওদের সাথে শুয়ে পড়ে।
সারারাত জীবন আর জয় রাস্তায় কাটিয়েছে। রাতে ঘুমায় নি বলে দু'জনের চোখই লাল হয়ে আছে। এখন ওরা কি করবে কিছু ভাবতে পারছে না। স্পৃহা কোথায় যেতে পারে?
'জীবন তুই এখন বাসায় যা। রাতে একটা বারও চোখের পাতা এক করিস নি। তোকে অসুস্থ লাগছে। এখন বাসায় গিয়ে ফ্রেশ হ। তারপর আমরা আবার স্পৃহাকে খুঁজতে বের হবো।'
'স্পৃহা কোথায় আছে আমি কিচ্ছু জানি না। ঠিক আছে না ওর সাথে কিছু ঘটে গিয়েছে কোনো কিছু জানি না। আর তুই বলছিস আমি বাসায় চলে যাই। বাসায় গিয়ে আমি নাকে তেল মেখে ঘুমাই।'
'আমার মন বলছে ভেবলি যেখানে আছে ঠিক আছে। আর তাছাড়া আমরা দিন রাত ২৪ ঘন্টা রাস্তায় বসে থাকলে ওকে পাব?'
'না পাই। তবুও আমি বাসায় গিয়ে শান্তিতে বসে থাকতে পারব না। সকাল তো হয়েছে তুই একবার স্পৃহার বাসায় কল কর না।'
'সকাল ছয়টায় কল করলে সবাই সন্দেহ করবে। এখন কাউকে স্পৃহার ব্যাপারে কিছু জানানো যাবে না। তাহলে দুই বাড়ির একটা মানুষকেও সামলানো যাবে না। তখন অবস্থা আরো মুশকিল হয়ে যাবে।'
'তবুও তুই একবার খোঁজ তো নে।'
জয় স্পৃহার বাসায় কল করে। তোহা কল তুলে।
'কে ভাইয়া? এতো সকাল সকাল কীভাবে আমাদের কথা মনে পড়লো? তুমি তো এখন আমাদের ভুলেই গেছ। আপু আছে না তোমাদের কাছে এখন আর আমাদের দিয়ে কি করো।'
'কথা কম বল বাচালনি। খালামণি কোথায়?'
'এতো সকালে কোথায় থাকতে পারে বলে তোমার মনে হয়।'
'তুই বড্ড কথা ঘুরাস। আচ্ছা জীবন আর স্পৃহা তোদের বাসায় গেছে?'
'না তো। কেন? '
'আরে ওরা বলেছিল যাবে। আমি ভেবেছি হয়তো চলে গেছে। আমিও আসবো ওদের সাথে। '
'সত্যি?'
'হুম। '
'দাঁড়াও আমি মা'কে বলছি।'
'আরে নাহ। খালামণিকে বলিস না। আমরা গিয়ে সবাইকে সারপ্রাইজ দিব।'
'আচ্ছা। '
কল রেখে জয় জীবনের দিকে তাকালো।
'স্পৃহা ওখানেও যায়নি।'
এটা শুনে জীবন গাড়িতে সজোরে একটা ঘুষি দিলো।
'তাহলে স্পৃহা কোথায় গেল?'
জয় অনেক বোঝানোর পর জীবন বাসায় চলে এসেছে। সারারাত বাইরে ছিল। একটুও ঘুম হয়নি। তাই এখন মাথাটা ভারি ভারি লাগছে। জীবন ফ্রেশ হয়ে কিচেনে গিয়ে কড়া করে এক কাপ কফি বানিয়ে খেলো। একটু ঘুমিয়ে নিতে পারলে ভালো হতো। কিন্তু তার হাতে এখন সময় নেই। এখন ঘুমালে চলবে না। স্পৃহাকে খুঁজতে হবে। স্পৃহা কোথায় আছে তা না জানার পর্যন্ত জীবন স্বস্তিতে বসতেও পারবে না। মেয়েটা ঠিক আছে নাকি আল্লাহই জানে। জীবন স্পৃহার রুমে গেল। সবকিছু ঠিকই আছে রুমে শুধু স্পৃহাই নেই। জীবন চোখ বন্ধ করে কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থেকে স্পৃহাকে অনুভব করার চেষ্টা করলো।
'এবার তুমি আমার সাথে ফিরলে তোমাকে আর এই রুমে থাকতে দিব না স্পৃহা। অনেক ভুল করেছি আর না। এবার থেকে আমরা দু'জন আমার ঐ রুমে থাকবো। তুমি আমি মিলে আমার রুমটাকে আমাদের রুম বানাবো।'
জীবন বেডে গিয়ে শুয়ে পড়লো। চোখ বন্ধ করে বলল,
'কোথায় তুমি স্পৃহা? তোমার সব রাগ,সব অভিমান ভাঙিয়ে দিব। তুমি শুধু একবার দেখা দাও। রাগ করে আমার থেকে অনেক দূরে চলে যেও না। তোমার কাছে ক্ষমা চাওয়ার আমাকে একটা সুযোগ দিবে না তুমি? তুমি তো আমাকে ভালোবাসো। ভালোবাসার মানুষকে এতো সহজে ছেড়ে চলে যাবে? '
চোখ বন্ধ করে শুয়ে রইলে জীবনের কানে স্পৃহার কন্ঠ ভেসে এলো। যাবার আগে স্পৃহা তার কানে কানে বলেছিল "অনেক ভালোবাসি আপনাকে " স্পৃহা এটাও বলেছিল "আপনাকে ভালোবাসা আমার জীবনের সবথেকে বড় ভুল" স্পৃহা কথা, স্পৃহার কান্নামাখা চেহারা মনে হতেই জীবন উঠে বসলো। রুম থেকে বেরিয়ে এলো। সে এখন কী করবে দাঁড়িয়ে এটা ভাবলো। তারপর জয়কে কল করলো,
'কোথায় তুই? '
'বাসা থেকে বের হচ্ছি। স্পৃহার কোনো খোঁজ পেয়েছিস?'
'না। তবে আমার মনে হয় স্পৃহা আজকের ভেতরেই চট্টগ্রাম যাবে। '
'আমারও তাই মনে হচ্ছে। কারণ এখানে থাকার মত তার কোনো জায়গা নেই। '
'আমিও আজই চট্টগ্রাম স্পৃহাদের বাসায় যাব।'
'এই শোন শোন। স্পৃহা ওখানে আছে নাকি শিওর না হয়ে যাস না। তুই ওখানে গিয়ে স্পৃহাকে না পেলে খালামণি আরো উল্টা প্যাচ করবে। তখন আরো ঝামেলা তৈরি হবে।'
'হুম, তাই রাতে যাব। স্পৃহা তো বাসায় যাবেই। ওকে না নিয়ে আমি ঢাকায় ফিরবো না। স্পৃহার রাগ ভাঙাতে যদি এক বছরও লাগে তাহলে এক বছরই আমি ওখানে থাকব। স্পৃহাকে না নিয়ে ফিরবো না এটাই ফাইনাল।'
'কিন্তু এখানে তোর অফিস, তোর বাসা, তোর বড় আম্মু,,,
'আরে দূর কিসের অফিস, কিসের বাসা আর কিসের কি? আগে বৌ পরে বিজনেস। আর বড় আম্মু টেনশন করবে না। আমি এখন ওবাড়িতে একদমই যাই না। না বুঝে স্পৃহাকে অনেক কষ্ট দিয়েছি। এখন স্পৃহা আমাকে ক্ষমা করলেই হলো। আর কিছু চাই না আমার।'
'ছোট থেকে ভেবলি এভাবে কারো সাথে রাগ করতো না। কিন্তু মাঝেমধ্যে রাগ করলে ওর রাগ ভাঙানো মুশকিল হয়ে যেত। দেখি তুই কীভাবে ওকে ফিরিয়ে আনিস। আর এই যাত্রায় তো আমি তোকে কিছু করিনি। কিন্তু ভবিষ্যত যদি ভেবলি কোনোদিন একটুও কষ্ট পাই। তাহলে আমার হাত থেকে তোকে কেউ বাঁচাতে পারবে না।'
স্পৃহাকে ঘিরে এবাড়িতে যেন উৎসব বেধে গেল। চাচা চাচি উনার দুই মেয়েরা স্পৃহাকে কোথায় বসাবে, কী খাওয়াবে, ওর জন্য কী করবে ভেবে অস্থির হয়ে উঠেছে। চাচি এমন করছে যেন উনার বড় মেয়ে অনেকদিন পর শ্বশুরবাড়ি থেকে বাবার বাড়িতে এসেছে। সত্যিই উনারা গরীব হতে পারেন,কিন্তু উনাদের মন অনেক বড়। আর্থিক ভাবে সচ্ছল না হলেও শখ আহ্লাদের কমতি নেই। মন টাই বড়। এরা মন থেকে মানুষকে ভালোবাসতে পারে এটাই বা কম কিসে?
'তুমি রাইতেও না খাইয়া ঘুমাইছ মা। এহনও খাইবা না কইলে কেমনে হইব কও?'
'চাচি বিশ্বাস করুন আমার খিদে নেই।'
চাচি মন খারাপ করে বললেন,
'আমরা গরীব। রোজ রোজ তোমগোর মত ভালা খাওন জুটাইতে পারি না। শাক ভাত খাইয়াই দিন পার করি। আমগোর খাওন তোমার মুখে ভাল্লাগব না। তাই বইলা কি তুমি কিছুই খাইবা না? না খাইয়া থাকবা?'
'চাচি দোহাই আপনার এভাবে বলে আমাকে লজ্জা দিবেন না। চাচাকে আমি কখনও পর করে করিনি। এখানে আসার পর আমার একবারও মনে হয়নি আপনারা আমার আপন কেউ না। আপনাদের এতো ভালোবাসা পেয়েছি এটা আমার কাছে কতটা তা বলে বোঝাতে পারবো না। চাচা আমাকে এখানে না নিয়ে আসলে রাতের বেলা আমি কোথায় যেতাম তা আমিও জানি না। আপনাদের কথা আমি কখনও ভুলতে পারব না।'
চাচা বললেন,
'মা তুমি আজই চইলা যাইবা?'
'হ্যা চাচা। এতক্ষণে হয়তো বাসায় সব জানাজানি হয়ে গেছে। আজ বাসায় না গেলে টেনশন করে করে আমার বাবা মা মরেই যাবে।'
'আইচ্ছা তাইলে আমি তোমারে দিয়া আসমু।'
'তার দরকার হবে না চাচা। এখানে আপনার কাজ আছে। কাজ ফেলে আপনাকে যেতে হবে না। আমাকে বাসে তুলে দিলেই আমি যেতে পারবো। '
'আইচ্ছা। '
স্পৃহা একটু লজ্জা পেয়ে বলল,
'চাচা আমাকে কিছু টাকাও দিতে হবে। আমার কাছে এক টাকাও নেই। '
চাচা হাসতে হাসতে বললেন,
'দেখো মেয়ের কান্ড। চাচা ডাকো আবার চাচার কাছে টাকা চাইতে লজ্জাও পাইতাছো। তুমি জানো না মা। জয় বাবা আমগোর কত উপকার করছে। তুমি তার বোন তোমার লাইগা কিছু করতে পারলে আমার নিজের ভালো লাগবো। '
স্পৃহা বিকেলে চট্টগ্রামে ওর বাবার বাসায় গিয়ে পৌঁছায়। বাসায় গিয়ে দেখে তালা দেয়া। স্পৃহা দরজার সামনে বসে পড়ে বলল,
'মা বাবা তোহা হয়তো এখনো স্কুলেই আছে। কখন আসবে ওরা। চার টার আগে তো বাবা মা ফিরবে না। না জানি তোহাটা আজ কখন ফিরে। কতক্ষণ বাইরে বসে থাকবো?'স্পৃহা বেশ কিছুক্ষণ বসে রইলো। কয়টা বাজে সেটাও দেখতে পারছে না।
'ঘড়ি ফোন কিছুই তো সাথে নেই। কয়টা বাজে। আর কতক্ষণ অপেক্ষা করবো?'
স্পৃহা উঠে দাঁড়াল। রাস্তায় গিয়ে দেখলো তোহা আসছে কিনা। সেখানেও কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকার পর তোহাকে দেখতে পেল। তোহা ব্যাগ কাঁধে হেলতে দুলতে হেঁটে হেঁটে আসছে।
'এই শয়তান মেয়ে গুণে গুণে পা ফেলছে নাকি? আমি কখন থেকে অপেক্ষা করে বসে আছি। আর সে নেচে নেচে হাঁটছে।'
স্পৃহা তোহাকে ডেকে এগিয়ে গেল। তোহা স্পৃহাকে দেখে আকাশ থেকে পড়লো। আকাশ কাঁপানো চিৎকার দিয়ে দৌড় দিলো।
'আপু! আপুরে! তুই কখন এলি?'
'চিৎকার পরে করিস। আগে বাসায় এসে দরজার তালা খোল। সেই কখন থেকে বাইরে বসে আছি।'
'জীবন ভাইয়া কোথায়? ইশ দেখলি নতুন জামাই। বিয়ের পর শ্বশুরবাড়ি এসে দরজায় তালা দেয়া দেখে কী ভেবেছে হয়তো।'
জীবনের নাম শুনে স্পৃহার মুখ কালো হয়ে গেল। জীবন তার সাথে আসেনি। সে একাই এসেছে এটা জানার পর তোহা কি করবে কে জানে? বাবা মা'ই বা কী ভাববে। নিশ্চয়ই ভাববে স্পৃহা ঝগড়া করে চলে এসেছে।
তোহা আগে আগে এসে দরজা খুলে ভেতরে গেল।
'জীবন ভাইয়া কোথায় আপু? দেখতে পাচ্ছি না তো।'
স্পৃহা তার রুমের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। তোহা কাঁধ থেকে ব্যাগ রেখে স্পৃহার পেছন পেছন যাচ্ছে। আর জিজ্ঞেস করছে,
'কি হলো কথা বলছিস না কেন? কখন থেকে জিজ্ঞেস করছি ভাইয়া কোথায়। তুইও তো চুপ মেরেই আছিস।'
'তোর ভাইয়া আসেনি। আমি একাই এসেছি।'
তোহা অবাক হয়ে বলল,
'আসেনি? '
'না।'
'তুই সত্যিই একা এসেছিস?'
'হুম। '
তোহা বেডে বসে ছিল। উঠে দাঁড়িয়ে স্পৃহার কাছে গিয়ে চোখ ছোট করে জিজ্ঞেস করল,
'তুই কি রাগ করে বা ভাইয়ার সাথে ঝগড়া করে চলে এসেছিস?'
স্পৃহা কাপড় দিয়ে ওয়াশরুমে ঢুকতে ঢুকতে বলল,
'তার সাথে আমি রাগ করতে যাব কেন? '
'তাহলে একা এসেছিস কেন?'
স্পৃহা আর কোনোকিছু না বলে ওয়াশরুমে ঢুকে গেল। তোহা বাইরে থেকে অনেক কথাই বলল। তার একটা কথাও স্পৃহার কানে গেল না। স্পৃহা ভাবছে জীবন কি তাকে খুঁজছে? নাকি সে নূপুরের কাছে চলে গেছে। আচ্ছা জীবন কি তাকে নেওয়ার জন্য এখানে চলে আসবে? বাসায় ফিরে যাওয়ার জন্য তাকে জোর করবে? জীবন জোর করলে স্পৃহা তখন কি করবে?
'ধ্যাত কি ভাবছি আমি। উনি আমাকে নিতে আসবেন না। আমি চলে এসে উনার আরো উপকার করেছি। এখন উনি নূপুরের কাছে যেতে পারবেন। আমার জন্য উনার মন কাঁদবে না। উনি তো আমাকে ভালোবাসেন না।'
তোহা এখনো স্পৃহার রুমেই বসে আছে। স্কুল ড্রেসও চেঞ্জ করেনি। স্পৃহা ওয়াশরুম থেকে বের হয়ে তোহাকে দেখে রাগ করে বলল,
'এখনো তুই এখানে বসে আছিস? ড্রেসও চেঞ্জ করিস নি। স্কুল থেকে ফিরেছিস হাত মুখ ধুবি তো।'
'তুই যতক্ষণ আমার কাছে সত্য না বলিস ততক্ষণ আমি কিছুই করবো না। এখানেই বসে থাকবো। '
'থাক বসে আমার কি। আমি কিচেনে যাচ্ছি। মা নিশ্চয়ই রান্না করে ফ্রিজে রেখে গেছে। আমি খাবার গরম করছি। তুই খেলে হাত মুখ ধুয়ে আয়। নইলে এখানেই বসে থাক।'
স্পৃহা সত্যি সত্যিই চলে গেল। তোহা অবাক হয়ে শুধু স্পৃহাকে দেখছে।
'দূর আপুটা এমন হলো কীভাবে!'
তোহা পুরো বিকেল স্পৃহার পেছনে পড়ে ছিল। স্পৃহা এবার বিরক্ত হয়ে বলল,
'তুই কি চাস তোর জ্বালায় আমি এখান থেকে চলে যাই? '
'এভাবে বলছিস কেন? '
'তাহলে আমাকে শান্তি দিচ্ছিস না কেন তুই? তোদের কথা মনে হলে আমি আসতে পারবো না। ঝগড়া করেই কি আসতে হবে।'
'না। জয় ভাইয়া সকাল সকাল ফোন দিয়েছিল। তোরা এসেছিস নাকি তা জিজ্ঞেস করছিল। বলেছে তুই জীবন ভাইয়া জয় ভাইয়া একসাথে আসবি। এখন দেখি তুই একা এসেছিস। তাই এতো কিছু জিজ্ঞেস করছি।'
স্পৃহা আনমনা হয়ে বলল,
'জয় ভাইয়া ফোন দিয়েছিল? তার মানে উনি ভাইয়াকে সব বলেছেন। আর ভাইয়াও আমাকে খুঁজছে। উনি কি জানে আমি এখন এখানে আছি? রাতে কোথায় ছিলাম এটাও জানেন নাকি?'
স্পৃহার এই কথাগুলো তোহা শুনে নি। কারণ সে বিরবির করে বলেছে।
বিকেলে মা বাবা ফিরে এসেছে। স্পৃহা তোহার সাথে মিলে বাবা মা'কে সামলে নিয়েছে। দুই বোনের বানানো কাহিনী শুনে কেউ আর সন্দেহ করে নি। অনেক দিন পর মেয়ে বাড়ি এসেছে এই খুশীতে তানিয়া ভালো খাবার রান্না করছে। স্পৃহা যা যা পছন্দ করে আজ বাড়িতে সেগুলোই রান্না হবে। পুরো সন্ধ্যা দু বোন আড্ডা দিয়েছে। এসবের মাঝেও জীবনের কথা মনে করে স্পৃহার মন খারাপ হয়েছে। ওরা বসার ঘরের সোফায় বসে টিভি দেখছিল। মা পপকর্ন বানিয়ে দিয়েছে। তোহা আর স্পৃহা সেটা নিয়েই কাড়াকাড়ি করে খাচ্ছিল। কলিং বেল বাজলে স্পৃহা তোহাকে বলল,
'যা গিয়ে দরজা খুলে দে।'
'তুই দে।'
'আমি পারবো না। শ্বশুরবাড়িতেও কাজ করি। বাবার বাড়ি এসেও কাজ করবো? '
'কর। ওখানে করতে পারিস এখানে করলে সমস্যা কি?'
'তুই আমাকে কাজ করতে বলছিস? দাঁড়া মা'কে বলি।'
তোহা চেঁচিয়ে উঠে বলল,
'এই না না দাঁড়া। আমিই যাচ্ছি। তুই বড্ড কাজ চোর হয়ে গেছিস আপু। আগে তুই সব কাজ করতি। এবার আসার পর আমাকে দিয়ে সব করাচ্ছিস।'
স্পৃহা পপকর্নের বাটি কোলে নিয়ে সোফার উপর পা তুলে আরাম করে বসলো। তোহা গিয়ে দরজা খুলে দিয়েছে। স্পৃহা টিভির দিকে চোখ রেখে তোহাকে ডেকে বলল,
'কে এসেছে রে?'
তোহা মুখ টিপে হেসে বলল,
'তুই এসে দেখ কে এসেছে। '
'পারবো না। তুই আমার জন্য ফ্রিজ থেকে আইসক্রিম নিয়ে আয়। তাড়াতাড়ি আনবি।'
'এখানে আসার পর থেকেই তো খাই খাই করছিস। আর কত খাবি? এতো দিন না খেয়ে বরের টাকা বাঁচিয়েছিস নাকি?'
'মা'কে বলবো তুই আমার খাওয়া নিয়ে কথা বলছিস?'