মেঘের খামে অনুভূতি (পর্ব ০৮)


স্পৃহা এদিকেই যাবে। কিন্তু ড্রাইভার লোকটাকে তার কেনই যেন সুবিধার মনে হলো না। তাই স্পৃহা যেতে না করে দিয়েছে। স্পৃহা না করলেও লোকটা যাচ্ছে না। স্পৃহা কিছু বুঝে ওঠার আগেই কোত্থেকে দু'টা ছেলে এসে তার হাত চেপে ধরে জোর করে তাকে সিএনজিতে উঠাতে লাগলো। স্পৃহা কিছু না বুঝে চিৎকার দিতে নিলে, একটা ছেলে তার মুখ চেপে ধরলো। সিএনজিতে তুলেই ছেলেটা একটা কাপড় দিয়ে তার মুখ বেধে দিলো। স্পৃহা আর চিৎকার দিতে পারছে না। তার সাহায্যের জন্য কাউকে ডাকতে পারছে না। স্পৃহা হাত পা ছুড়তে শুধু করে দিয়েছে। সামনে যে ছেলেটা সিএনজি চালাচ্ছিল সে পেছনে ঘাড় ঘুরিয়ে বলল,
'মাইয়াডার হাত পা ভালো কইরা বাঁধ না। দেখস না ছুটাছুটি শুধু করে দিছে। পাবলিক টের পাইলে গণধোলাই দিব।'
অন্য একটা ছেলে বলল,
'তুই গাড়ি চালা। তোরে পাকনামি করতে কে কইছে? শুধু হাত পা বাঁধমু না। শালিরে একেবারে অজ্ঞান কইরা দিমু।'
'যা ভালো মনে করস কর। কিন্তু একটু তাড়াতাড়ি কর।'
'হ করতাছি।'
স্পৃহা ওদের সব কথাই শুনছে, কিন্তু কিছু বলতে পারছে না। আর না কিছু করতে পারছে। দু'টা ছেলের সাথে সে তো আর শক্তি খাটিয়ে পারবে না। ছেলে দু'টোর মুখ বাঁধা ছিল। স্পৃহার হাত বেঁধে ফেলার আগে সে টান দিয়ে একটা ছেলের মুখ থেকে কাপড় খুলে ফেললো। ছেলেটার মুখ দেখার পর তাকে চিনতে স্পৃহার দুমিনিটও লাগলো না। এটা তো ঐ ছেলেটা যাকে জীবন মেরেছিল। স্পৃহা ঐ ছেলের মুখ দেখে ফেললে সাথের ছেলেটা বলল,
' মাইয়া তো তোর মুখ দেখে ফেললো। মুখে কাপড়টা ভালো করে বাঁধ।'
'চুপ কর তুই। দেখুক। দেখতে দে। এই শালীর জন্য ঐদিন ঐ শালা আমারে অনেক মারছে। আজ এর খবর করে ছাড়মু। দেখি আজ ঐ শালা এরে আমার হাত থেকে বাঁচাতে আসে কিনা। ঐদিন তো খুব হিরোগিরি করছিল।'
স্পৃহা কি করবে কিছুই বুঝতে পারছে না। এই জানোয়ার গুলোর হাত থেকে নিজেকে কীভাবে বাঁচাবে সে? কীভাবে এদের হাত থেকে মুক্তি পাবে। কেউ তো জানবেও না স্পৃহা কি অবস্থায় আছে। খালামণি জয় তারা কি তাকে খুঁজে বের করতে পারবে। এই ছেলে দু'টাই বা তাকে কোথায় নিয়ে যাচ্ছে? কি করবে এরা স্পৃহার সাথে? ছেলেটা তার ঠিক কতটা ক্ষতি করবে? স্পৃহা আর কিছু ভাবতে পারলো না। তার আগেই ছেলেটা তার মুখে কিছু একটা স্প্রে করে তাকে অজ্ঞান করে দিলো।
যে সিএনজি চালাচ্ছে সে জিজ্ঞেস করলো, 
'কই যামু এহন?'
পেছনের ছেলেটা তিক্ত গলায় চেঁচিয়ে বলল,
'কই যাবি জানস না? আবার জিগাস ক্যান? তোরা আমার মাথা খারাপ করিস না। যেখানে যাবার কথা ছিল সেখানে যা। শুধু এই মা** রে তুইলা নিয়া মজা পামু না। সাথে ঐ কুত্তার বাচ্চারে পাইলে হইতো। ওর মার খাইয়া আমি তিন সপ্তাহ হাসপাতালে ছিলাম। এহনও শরীরের প্রতিটা অঙ্গে ব্যথা করে। মরার আগের দিনও আমি ঐ কুত্তার বাচ্চার কথা ভুলমু না। ওরে তো একদিন না একদিন এর শিক্ষা দিমুই। আগে মাইয়ারে বুঝাইয়া নেই। আমি কি জিনিস।'

নূপুর জীবনের সাথে আজ সারাদিন ঘুরেছে। এতটা সময়ে নূপুর তেমন কোনো কথাই বলেনি। জীবন নিজে থেকে কিছু জিজ্ঞেস করলে শুধু তার উত্তর দিয়েছে। নদীর পাড়ে নিরিবিলি একটা জায়গায় এসে জীবন কার থাকামো। নূপুরের দিকে তাকিয়ে বলল,
'এখানে নামবে? '
নূপুর অন্য কিছু ভাবছিল। তাই সে জীবনের কথা শুনতে পায়নি। জীবন নূপুরকে ধাক্কা দিলে নূপুর বলল,
'হ্যা? বলো। কি বলছিলে?'
জীবন দীর্ঘশ্বাস চেপে বলল,
'নামবে এখানে? জায়গাটা,,,
জীবন কথা শেষ করার আগে নূপুর গাড়ির দরজা খুলে নেমে দাঁড়াল। সন্ধ্যা হয়ে এসেছে। চারিদিকে এখনো পুরোপুরি অন্ধকার হয়নি। কিন্তু দিনের আলো এখন আর নেই। ঠান্ডা বাতাস বইছে। জীবন গাড়িতে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। নূপুর জীবনের থেকে কিছুটা দূরে চুপ করে দাঁড়িয়ে আছে। জীবন ভাবছে হঠাৎ করে কি হলো মেয়েটার? কেন এমন চুপচাপ হয়ে গেল? বড়সড় কোনো সমস্যায় পরেছি নাকি? কিছু তো বলছেও না। না বললে জীবন বুঝবে কিভাবে নূপুর কোন সমস্যায় পরেছে। 

মেহেরুন তার স্বামী মারিয়া,সোম,জয় স্পৃহার বাবা,মা,তোহা সবাই স্পৃহার চিন্তায় অস্থির হয়ে আছে। স্পৃহা প্রতিদিন দুপুরের একটু পরেই বাসায় ফিরে আসে। আজ সন্ধ্যা হয়ে গেল। কিন্তু এখনো বাসায় ফিরছে না। ক্লাস শেষ করে কাউকে কিছু না বলে কোনো বান্ধবীর বাসায় চলে যাবে স্পৃহা তেমন মেয়ে না। আর কারো সাথে গেলেও ফোন করে বলে নিবে। অনুমতি না নিয়ে তো স্পৃহা বাড়ি থেকেই এক পা বের হয় না। এই কয়দিনে স্পৃহা যাদের সাথে মিশেছে, এতক্ষণে জয় তাদের সবার বাসায় খোঁজ নিয়েছে। কিন্তু সবার একই কথা। স্পৃহা ক্লাস শেষ করে বাসায় যাবার জন্য সবার সাথে বেরিয়ে এসেছে। তানিয়া মেয়ের কথা ভেবে ভেঙে পড়েছেন। পলাশ কি করবে বুঝতে পারছেন না। কোথায় গেল উনার মেয়ে? মারিয়া বলল,
'জয় স্পৃহার কোনো খোঁজ পেয়েছিস? ও কি কোনো বন্ধুর বাসায় গেছে?'
জয় কান থেকে ফোন নামিয়ে বলল,
'না আপু স্পৃহা কারো বাসায়ই যায়নি।'
সোম বলল,
' স্পৃহার ফোন লাগছে? '
'না ভাইয়া। দুপুরের পর থেকে ফোন অফ আসছে।'
জাহিদ আহমেদ বললেন, 
'আমাদের আর দেরি করলে চলবে না জয়। অনেক তো অপেক্ষা করলাম। এখন আর পারবো না। পুলিশকে একটা... 
জাহিদ আহমেদ কথা শেষ করতে পারলেন না। পলাশ রেগে বললেন,
'পুলিশ কেন? আমার মেয়ের কিছু হয়নি। ও ফিরে আসবে।'
মেহেরুন বললেন, 
'পলাশ তুমি রাগ করছো কেন? আমরা তো বলছি না স্পৃহার কিছু হয়েছে। স্পৃহা ঠিক আছে। তবুও একবার পুলিশকে জানিয়ে রাখা উচিত। স্পৃহা কথা ভেবেই একবার থানায় যাওয়া উচিত।'
তানিয়া কিছু বলতে পারছে না। তিনি শুধু কেঁদে যাচ্ছেন। জয় বলল,
'বাবা ঠিক বলেছ। চলো আমরা থানায় যাই।'
মারিয়া বলল,
'হ্যা চল। আমি আর সোমও যাব।'
ওরা সবাই বেরিয়ে গেল। মেহেরুন বাসায় বোনের কাছে আছে। তানিয়াকে কাঁদতে দেখে উনি কি বলে সান্ত্বনা দিবে ভেবে পাচ্ছেন না। স্পৃহার জন্য তারও খুব চিন্তা হচ্ছে। 
'কাঁদিস না তানিয়া। স্পৃহার কিচ্ছু হয়নি। ওরা তো স্পৃহাকে খুঁজতে বেরিয়েছে। দেখবি জয় স্পৃহাকে নিয়েই বাসায় ফিরবে। তুই ধৈর্য ধর। তোর মেয়ের জন্য আল্লাহ কাছে দোয়া কর। মায়ের দোয়া আল্লাহ কবুল করবেন।'
স্পৃহার জন্মদিনের জন্য চট্টগ্রাম থেকে ওর বাবা মা বোন এসেছে। সারাদিন খাটাখাটুনি করে মারিয়া সোম জয় সবাই মিলে বাড়ি সাজিয়েছে। মেহেরুন নিজের হাতে কেক বানিয়েছেন। যে মেয়েটার জন্য এতকিছু করা হয়েছে। সেই মেয়েটাই এখনো বাসায় ফিরছে না। যাকে নিয়ে সমস্ত আয়োজন তাকেই খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। মেয়েটা ঠিক আছে তো? 

জীবন আর চুপ করে থাকতে পারছে না। নূপুরকেও এভাবে চুপ থাকতে দেখে তার ভালো লাগছে না। জীবন বলল,
'নূপুর কি হয়েছে তোমার? কিছু তো বলবে। তোমাকে এভাবে দেখতে আমার সত্যিই আর ভালো লাগছে না। কি হয়েছে আমাকে বলো প্লিজ।'
নূপুর ভাবছিল সে যা বলতে এসেছে, সে কথাগুলো কিভাবে জীবনকে বলবে? জীবন সব শুনে তাকে ক্ষমা করতে পারবে তো? জীবনের কথায় নূপুরের হুঁশ ফিরলে নূপুর বলল,
'জীবন আমি তোমাকে খুব জরুরী কিছু কথা বলার জন্য এসেছিলাম। কিন্তু কথাগুলো কীভাবে বলবো তাই ভেবে পাচ্ছিলাম না। সারাদিন তোমার সাথে থেকে শুধু এটাই ভেবেছি কীভাবে তোমাকে সব বলবো।'
'কি বলবে বলো। আমি শুনছি তো। তুমি এভাবে চুপ থাকলে আমার ভালো লাগে না নূপুর।'
অন্ধকারে কিছুই স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে না। নূপুর জীবনের মুখের দিকে তাকিয়ে মনে মনে বলল,
'আমি তো সাহস জুগিয়ে উঠতে পারছি না জীবন। কীভাবে আমি তোমাকে বলবো। আমি তোমাকে কষ্ট দিতে চাই না। পারবো না আমি তোমাকে কষ্ট দিতে। তোমাকে ছাড়া বাঁচতে পারব না। আবার তোমার সাথেও থাকতে পারবো না। আমার ভাগ্যে যে তুমি নেই জীবন।'
'কি হলো নূপুর বলো। প্লিজ আর চুপ থেকো না। কিছু তো বলো প্লিজ।'
নূপুর জীবনের দিকে ফিরে বলল,
'আমাকে বাড়ি পৌঁছে দাও জীবন। শরীরটা ভালো লাগছে না। আমি এক্ষুনি বাড়ি যেতে চাই।'
'কিন্তু তুমি তো বলেছিলে আমার সাথে তোমার জরুরী কথা আছে। তা বলার জন্যই তো আজ দেখা করতে বলেছিলে।'
'এখন আমি কোনো কথা বলতে পারব না। আমার প্রচন্ড খারাপ লাগছে। তুমি প্লিজ এখন কিছু জিজ্ঞেস করো না। তুমি আমাকে বাসার কাছে দিয়ে আসলেই চলবে।'
নূপুর গাড়িতে এসে বসলে জীবন দীর্ঘশ্বাস ফেলে ড্রাইভিং সিটে বসে গাড়ি স্টার্ট দেয়। নূপুর বাইরের দিকে মুখ করে তাকিয়ে আছে। তার এখন চিৎকার করে কাঁদতে ইচ্ছে করছে। জীবন ড্রাইভ করে যাচ্ছে। মাঝে মাঝে নূপুরের দিকে তাকাচ্ছে। 

ছেলে তিনটা স্পৃহাকে এখানে এনেছে দুপুরের দিকে। এখন সন্ধ্যা হয়ে গেছে। এখনো স্পৃহার জ্ঞান ফিরেনি। জীবন যাকে মেরেছিল,যার প্ল্যান অনুযায়ী স্পৃহাকে কিডন্যাপ করা হয়েছে তার নাম রুবেল। আর সাথের দু'জন থেকে একজনের নাম আশরাফুল। আরেক জনের নাম লিটন। রুবেল লিটনকে ধমক দিয়ে বলল,
'ক্লোরোফর্ম কতটুকু দিয়েছিলি? এটার এখনো জ্ঞান ফিরছে না কেন?'
লিটন মাথা চুলকে বলল,
'একটুই তো দিয়েছিলাম।'
'একটু দিয়েছিলি তাহলে এখনো অজ্ঞান হয়ে পড়ে আছে কেন?'
আশরাফুল ভেতর থেকে বেরিয়ে এসে বলল,
'আর কোনো চিন্তা নাই। আমি মাইয়ার হাত পা মুখ ভালোমত বেঁধে দিয়ে আসছি। জ্ঞান ফিরলেও আর চিৎকার চেচাঁমেচি করতে পারব না।'
রুবেল বলল,
'ভালো করছোস। শালীরে জন্মের শিক্ষা দিয়া ছাড়মু। এই লিটন তুই এখানে থাক। এদিকটা পাহারা দে। আমি মাল নিয়া আসি। আজ জলসা জমামু।'
রুবেল আশরাফুলকে নিয়ে চলে গেল। 

জীবন নূপুরকে তার বাসার গলির সামনে নামিয়ে দিয়ে এসেছে। নূপুর গাড়ি থেকে নেমে জীবনের সাথে একটা কথাও বলেনি। একবার পেছনে না ফিরেই গলির ভেতর ঢুকে গেল। জীবন ওখানে কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থেকে গাড়ি ব্যাক করে চলে আসলো। কিছুদূর এসে একটা দোকানের সামনে দু'টা ছেলেকে দেখতে পেল। জীবন বুঝতে পারলো সে ঐদিন যে ছেলেটাকে মেরেছিল। ওখানে ঐ ছেলেটা আছে। জীবন ভাবলো ঐ দিন রাগের মাথায় ছেলেটাকে অনেক মেরেছিল। আজ একবার গিয়ে কি ওর সামনে দাঁড়াবে। ওর কাছে ক্ষমা চাওয়ার প্রশ্ন আসে না। তবুও একবার দেখবে ছেলেটা এখন ঠিক আছে কিনা। জীবন গাড়ি থেকে নেমে এসে ওদের দিকে এগিয়ে আসতে আসতে ডাকলো, 
'এই ছেলে! এই এদিকে আসো। হ্যা তোমাকেই বলছি। নীল শার্ট।'
জীবনকে এদিকে আসতে দেখে হঠাৎ রুবেলের মাথায় আগুন ধরে গেল। রুবেল বিরবির করে বলল,
'কুত্তার বাচ্চা। তুই আমাকে মেরে, এখন আমাকে ডাকছিস? কি ভেবেছিস আমি তোকে ভুলে গেছি? ভালোই হয়েছে আজ ঐ মেয়েটাকে তুলে এনেছি। এখন তোকেও পেয়ে গেলাম। দু'টাকে এক সাথে শিক্ষা দিব। ঐদিন তোর দিন ছিল,আজ আমার দিন। তোর ভাগ্যই তোকে আমার কাছে টেনে আনছে।'
রুবেল যেন আশরাফুলের কানে কি বললো। বলে জীবনের দিকে হাসি মুখ করে এগিয়ে আসছে। জীবন বলল,
'কি অবস্থা? ঠিক আছো? শরীর স্বাস্থ্য ভালো?'
'হ্যা ভাই সব ভালো। আপনার খবর কি?'
'এইতো চলছে। এদিকে কি করছিলে?'
'একটু ঘুরতে বের হয়েছিলাম।'
'ওহ।'
'আপনি কই যান ভাই? গাড়ি থেকে নামলেন দেখলাম। আপনার বাড়ি কি এদিকেই?'
'না। এদিকে একটা কাজে এসেছিলাম। আচ্ছা তোমরা থাকো। আমি যাই তাহলে।'
'যাবেনই তো। আপনাকে আটকে রাখমু না। যান ভাই। বেঁচে থাকলে আবার দেখা হবে। ভালো থাকবেন। আল্লাহ হাফেজ ভাই।'

রুবেল কথাটা বলে শেষ করে হাসলো। জীবন কিছু বুঝে ওঠার আগেই পেছন থেকে আশরাফুল আধ ভাঙা একটা ইট দিয়ে সজোরে জীবনের মাথায় আঘাত করে। মাথায় আঘাত পেয়ে জীবন জ্ঞান হারিয়ে মাটিতে লুটিয়ে পড়ে। জীবনের মাথা ফেটে রক্ত গড়িয়ে পরছে। রুবেল জীবনের পাশে এক হাঁটু গেড়ে বসে জীবনের এই অবস্থা দেখে হাসছে। আর বলছে, 
'ঐদিন তলপেটে তোর ঘুসি খেয়ে আমি রক্ত বমি করছিলাম। মুখে ঘুসি লেগে ঠোঁট ফেটে গেছিল। তিন চারদিন কিছু খেতে পারি নাই। শরীরে ব্যথা তো আছেই। তুই কি ভাবছোস? গাড়ি থেকে নেমে হাসি মুখে আমার খোঁজ খবর নিবি। আর আমি আগের সব ভুলে গিয়ে তোকে ছেড়ে দিব? না মামা। আমি তো এতটাও ভদ্র না। একটা মেয়ের জন্য আমি জীবনের প্রথম অতটা মার খাইছিলাম। ঐ মেয়ে তোর কে হয়? কি লাগে তোর? ওর পেটে হাত দিছি তাতে তোর এত জ্বলছে কেন? আজ তোর সামনে ঐ মেয়ের সমস্ত শরীরে হাত দিমু। ভিডিও কইরা ইন্টারনেটে ভাইরাল করমু। দেখি তুই কি করতে পারিস।'
রুবেল আশরাফুলকে ডেকে উঠলো,
'ঐ আশরাফুল এরে ধর। ঐ মাইয়ার কাছে নিয়া যা।'
আশরাফুল আমতা আমতা করে বলল,
'কিন্তু এরে কেমনে নিয়া যামু?'
'ঐ গাধা। বুদ্ধি কি মালের সাথে মিশাইয়া খাইছোস? এ গাড়ি নিয়া আসছে না? ওর গাড়িতে করেই ওরে নিমু। দেখ গাড়িতে চাবি লাগানো আছে। তুই ওরে তাড়াতাড়ি গাড়িতে তোল। লোকজন দেখলে সমস্যা হইব।'

জাহিদ,পলাশ, সোম,মারিয়া,জয় এখন থানার ভেতরে দাঁড়িয়ে আছে। তারা থানায় স্পৃহার মিসিং কেস লিখাতে এসেছে। পুলিশ অফিসার জয়ের দিলে তাকিয়ে বললেন, 
'মেয়েটাকে কখন থেকে পাওয়া যাচ্ছে না?'
'সকালে ভার্সিটিতে গিয়েছে। প্রতিদিন তো দুপুরের পরপরই ফিরে আসে। কিন্তু আজ রাত হয়ে গেল তবুও ফিরলো না স্যার।'
জয়ের চোখে মুখে যে চিন্তার ছাপ তার কিছুই অফিসারের মুখে দেখা গেল না। এমন কেস উনাদের কাছে দিনে দশটা আসে এমন ভাব করে অফিসার বললেন, 
'হতে পারে উনি নিজের ফ্রেন্ডের সাথে গেছেন। রাতটা হয়তো ওখানেই থাকবে।' 
জাহিদ বললেন, 
'না অফিসার। আপনি বুঝতে পারছেন না। স্পৃহা আমাদের না বলে কখনো কোথাও যায়নি। আর গেলেও ও তো আমাদের ফোন করে অন্তত জানাবে।'
'হয়তো কোনো কারণে জানাতে পারছেন না। বা জানাতে চাইছেন না।'
এই অফিসারের কথা শুনে রাগে মারিয়ার মাথা ফেটে যাচ্ছে। এই লোকটাকে কে পুলিশের চাকরি দিয়েছে? এ তো মানুষের সমস্যাকে কোনো গুরুত্বই দেয় না। তাদের সমস্যা সমাধান করবে কি। মারিয়া বলল,
'স্যার আপনি হয়তো আমাদের সিচুয়েশানটা বুঝতে পারছেন না। সামান্য কারণে তো আমরা থানা পর্যন্ত চলে আসিনি। আপনি আমাদের কথাগুলো শুনুন। স্পৃহার মিসিং কেস নিন। আর ওকে খুঁজে বের করুন প্লিজ।'
'ম্যাডাম আপনি কি শিওর দিয়ে বলতে পারবেন, স্পৃহা মেয়েটা নিজে থেকে কারো সাথে যায়নি।'
জয় চেঁচিয়ে উঠে বলল,
'আপনি কি বলতে চাচ্ছেন?'
'দেখুন এমন কেস আমাদের কাছে প্রতিদিন কম করে হলেও চার পাঁচটা তো আসেই। মেয়ে মিসিং হয়। বাবা মা মেয়েকে খুঁজতে খুঁজতে হয়রান হয়ে থানায় এসে ডায়রী করেন। আমরাও আমাদের সাধ্যমত চেষ্টা করে মেয়েকে খুঁজে বের করি। তারপর দেখা যায় মেয়ে নিজের ইচ্ছে থেকেই গিয়েছে। সোজা বাংলায় বয়ফ্রেন্ডের সাথে ভেগে গেছে।'
পলাশ আর এসব কথা শুনতে পারছে না। একেতো মেয়েকে নিয়ে উনার চিন্তা হচ্ছে। আর এখন এই অফিসার আজেবাজে কিসব কথা বলছে। এই অবস্থায় সোম মাথা ঠান্ডা রেখে বললো,
'আমরা শিওর দিয়ে বলতে পারি স্পৃহা নিজে থেকে কারো সাথে যায়নি। এমনকি স্পৃহার বয়ফ্রেন্ড তো দূর কোনো ছেলে বন্ধুও নেই। স্পৃহা ওর বাবা মা খালামণিকে না বলে কোথাও যায়না। আজও যায়নি। আমাদের সবার মনে হচ্ছে স্পৃহা বড় কোনো সমস্যায় পরেছে। কেউ ওকে কিডন্যাপ করেছে। স্যার আপনার কাছে অনুরোধ করছি। আপনি আমাদের কেস নিন।'
মনে হয় অফিসারের মন কিছুটা পরিবর্তন হলো। তিনি বললেন, 
'ঠিক আছে। আমি আপনাদের সব কথা মেনে নিচ্ছি। এতদিন মিথ্যা কেসের পেছনে ঘুরে আজ যদি এই কেসের গুরুত্ব না দিই। আর শেষে সত্যিই মেয়ের সাথে কোনো অঘটন ঘটে যায়। কিন্তু ২৪ ঘন্টা পার না হলে তো মিসিং কেস নেওয়া যাবে না।'
জয় বলল,
'তাহলে আমরা এখন কি করবো স্যার? এখন কি আমরা এভাবে হাতে হাত রেখে বসে থাকবো? কিছু করবো না?'
'করবো তো অবশ্যই। আচ্ছা এর মাঝে কি আপনাদের কাছে কোনো কল এসেছে। মানে কিডন্যাপারের কল। অনেক সময় কিডন্যাপার কিডন্যাপ করে তো মুক্তিপণের টাকা চেয়ে কল দেয়। আপনাদের কাছে তেমন কোনো কল এসেছে?'
জাহিদ বললেন, 
'না। তেমন কোনো কল তো এখনও আসেনি।'
অফিসার ভেবে বললেন, 
'তাহলে তো একটু সমস্যা হয়ে গেল। উনি মিসিং হয়েছে তার এখনো ২৪ ঘন্টা হয়নি। কেউ কলও করেনি। উনাকে পাওয়া যাচ্ছে না মাত্র তো ৬ ঘন্টা হলো। হতে পারে ২৪ ঘন্টার মধ্যে উনি ফিরে আসলেন। আবার,,,
অফিসার উঠে দাঁড়িয়ে গেলেন। কনস্টেবলকে ডেকে বললেন,
'ইদ্রিস গাড়ি বের করো। এভাবে বসে থেকে ২৪ ঘন্টা পার হওয়া আর কারো কলের অপেক্ষা করা বোকামি হবে। আমি এখনি উনাকে খুঁজতে বের হবো। মেয়েটার কিছু হতে দেওয়া যাবে না। যে করেই হোক আমি উনাকে খুঁজে বের করবোই।'

স্পৃহাকে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। এর মধ্যেই এই কথা মেহেরুনের প্রতিবেশীরা জেনে গেছেন। কেউ কেউ মেহেরুনের বাড়িতে এসেছেন সত্যটা জানার জন্য। তানিয়া পুরোপুরি ভেঙে পরেছে। সকাল থেকে মেয়েকে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। এখন পর্যন্ত তার কোনো খোঁজ মিলে নি। একজন মা কীভাবে পারবে এই সময়ে ঠিক থাকতে। প্রতিবেশীর কেউ কেউ নানান কথা বলছে। আজকালকার মেয়ে কিছুই বলা যায় না। ওরা কিছু না ভেবে বাবা মা পরিবারের মুখে চুনকালি মেখে প্রেমিকের সাথে পালিয়ে যেতে পারে। মেয়েটাকে বাইরে থেকে যতই সাদাসিধে মনে হোক। ভেতরে ভেতরে কি আছে তা তো কেউ বলতে পারবে না। অনেকেরই মনে মনে চোর থাকে। মেহেরুন প্রতিবেশীর এই কানাঘুষো আর সহ্য করতে পারছিল না। স্পৃহাকে নিয়ে এরা এমন কথা কীভাবে ভাবতে পারছে? কিকরে বলছে এসব কথা? মুখে বাঁধছে না? 

ওরা স্পৃহাকে যেখানে এনে রেখেছে। সে ঘরটা কিছুটা পুরোনো গুদামঘরের মতন। এই বড় বড় কিসের যেন বাক্স। তেলের ডাম, ভাঙা কাঠের চেয়ার। ধানের বস্তা দিয়ে বোঝাই করা। ভেতরে কোনো লাইট নেই। গুদামঘরের নানান ফাঁকা জায়গা দিয়ে বাইরে থেকে সরু আলো ভেতরে প্রবেশ করছে। ধুলো পড়া জিনিসপত্র থেকে কেমন চাপা একটা গন্ধ আসছে। স্পৃহা মিটমিট করে চোখ খুলে চারপাশটা দেখার চেষ্টা করলো। কিন্তু অন্ধকারে কিছুই দেখতে পেল না। স্পৃহার মাথা ভারি ভারি লাগছে। চোখ খুলে রাখতে কষ্ট হচ্ছে। মুখ বাধা তাই শব্দ করতে পারছে না। স্পৃহা মাথা তুলতে গিয়ে বুঝতে পারলো তার দুই হাত পেছনে নিয়ে বেঁধে রেখেছে। পা'ও বাধা। স্পৃহা নড়তে পারছে না। উঠে বসার মত শক্তি তার মাঝে নেই। স্পৃহা কয়েকবার মুখে শব্দ করতে গিয়ে আবার জ্ঞান হারিয়ে ফেললো। 
জীবনকেও গাড়ি থেকে নামিয়ে স্পৃহার সাথে এনে রাখলো। জীবনও অজ্ঞান হয়ে আছে। রুবেল চেঁচিয়ে লিটনকে ডাকতে লাগলো, 
'লিটন! লিটন। ওই হারামজাদা কই গেলি?'
লিটন কোত্থেকে দৌঁড়ে ভেতরে এসে বলল,
'কি হইছে ডাকস ক্যান? মাইয়া কি পলাইছে?'
'কই গেছিলি তুই? লাত্থি মারমু একটা। কোনো কাজ পারো না। একটা কাজ দিছি এটাও তোমার দ্বারা হয় না,না?'
'আরে একটু বাইরে গেছিলাম। এক নাম্বার পাইছিল।'
'মেয়েটার জ্ঞান ফিরছিল?'
'জানি না তো। আমি যতক্ষণ ছিলাম তখন তো ফিরে নাই।'
'আচ্ছা।'
লিটন জীবনের দিকে তাকিয়ে বলল,
'এরে কই পাইছোস?'
'যেখানেই পাই তা দিয়া তোর কাম কি? তুই শুধু এদের উপর নজর রাখ। ছেলেটার জ্ঞান ফিরলে,মেয়েটার সাথে যা করার এর সামনে করমু। ঐদিন অনেক তেজ দেখাইছিল।'
আশরাফুল এতক্ষণে বলল,
'রুবেল বসরে খবর না দিয়া আমরা একা একা ফুর্তি কইরা গেলে, বস জানলে রাগ করবো। আর কোনো ঝামেলা হইলে সামলাইব কে? আমার মনে হয় বসকে জানানো উচিত।'
'কিসের বস? কে বস? আমি নিজেই নিজের বস। মালটারে আমি তুলছি। অন্য কাউকে এর ভাগ দিমু কেন?'
লিটন বলল,
'আশরাফুল ঠিক কইছে। একা একা ঝামেলা মাথায় নিয়া লাভ নাই। তার থেকে ভালো জনি ভাইরে খবর দেই। জনি ভাই এসব বিষয় ভালো করে হ্যান্ডেল করতে পারে। কোনো পুলিশ কেস হলেও জনি ভাই-ই দেখবে।'
'তাইলে খবর দে। ফোন দিয়া তাড়াতাড়ি আসতে বল। রাত বাড়তেছে। দুইটারে আবার জায়গা দেখে ফেলে রেখে আসতে হবে। আর ছেলেটার জ্ঞান ফিরা। ও সবকিছু নিজের চোখে না দেখলে মজা পামু না।'
রুবেল বাইরে চলে গেল। তার পেছন পেছন লিটন আর আশরাফুলও বেরিয়ে গেল। ওরা যাবার কিছুক্ষন পরই জীবনের জ্ঞান ফিরলো। মাথায় প্রচন্ড ব্যথা করছে। চোখের সামনেও যেন সবকিছু অন্ধকার লাগছে। জীবন অনেক কষ্টে চারপাশে দেখার চেষ্টা করলো। ঝাপসা ঝাপসা দেখা যাচ্ছে। নোংরা পুরোনো গুদামঘরে আছে সে। কিন্তু সে এখানে কীভাবে এলো? ঐ ছেলেটা কি তাকে এখানে নিয়ে এসেছে? জীবন সবকিছু মনে করলো কথা বলতে বলতে পেছন থেকে যেন তার মাথায় কেউ আঘাত করেছিল। আর চোখ খুলে সে এখানে। মানে ঐ ছেলেটাই সব করেছে। কিন্তু তাকে এখানে এনে ওর লাভ কি? প্রতিশোধ নেবার জন্য এমনটা করেছে? জীবনের শুধু হাত বাধা ছিল। মুখ আর পা খোলাই ছিল। জীবন আস্তে আস্তে সোজা হয়ে বসলো। তার পাশেই পায়ের কাছে চোখ যেতে জীবন হতভম্ব হয়ে গেল। কে এই মেয়েটা? এরা ওর সাথে এই মেয়েটাকেও কেন এখানে এনেছে? জীবন পায়ে শক্তি খাটিয়ে গড়িয়ে মেয়েটার কাছে গেল। মুখ বেধে রাখা তবুও জীবন চিনতে পারছে। 
'স্পৃহা! এ স্পৃহা নয় তো? হ্যা এ তো স্পৃহাই। স্পৃহাকে এরা কোথায় পেয়েছে? ওকে কখন এখানে এনেছে? স্পৃহা মিসিং হয়েছে বাড়ির সবাই এক কথা জানে তো? জয়, জয় কি ওকে খুঁজছে না? কি করবে এরা স্পৃহার সাথে?'
মাথার ব্যথায় জীবন 'আহ' শব্দ করে উঠে আবার বলতে লাগলো, 
'ওহ গড! যে করেই হোক, আমাকে এদের হাত থেকে স্পৃহাকে বাঁচাতেই হবে।'
জীবন স্পৃহাকে ডাকতে লাগলো,
'স্পৃহা! এই স্পৃহা। স্পৃহা তুমি আমার কথা শুনছো? স্পৃহা প্লিজ জাগো। প্লিজ স্পৃহা।'
হঠাৎ করে দরজা খোলার শব্দ হলো। কেউ ভেতরে এসেছে।

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন