রংধনু - পর্ব ৫১ - তাবাসসুম রিয়ানা - ধারাবাহিক গল্প


মেয়েকে খাওয়াতে গিয়ে প্রচন্ড বিপদে পড়ে বিভান।ভেবেছিলো পূর্না হয়ত ওর কাছে সুন্দর করে খাবে কিন্তু তেমন হয়নি কিছু।পূর্নার সামনে প্লেট আনতেই মেয়ে দৌড়ে বারান্দায় চলে গেলো।বিভান প্লেট রেখে বারান্দায় গিয়ে মেয়েকে এনে খাটে বসিয়ে বলল, 
''বসো মা।খেয়ে নাও।"
পূর্না মাথা ঝাঁকিয়ে বলতে লাগলো,
''কাবোনা।আমি কাবোনা।"
বিভান মেয়েকে কোলে বসিয়ে বলল,
''কেন খাবেনা আম্মু?খেতে হবে তো।"
''কাবোনা।নিতে নামবো।"
পূর্না নিচে নেমে আসতে চায়।বিভান ওকে টেনে ধরে রাখার চেষ্টা করে ও পারছেনা।পূর্না নেমে সোফার নিচে লুকিয়ে বলল,
''আমি নাই।"
মৃদু হেসে বিভান খাট থেকে নেমে সোফার সামনে বসে নিচে উঁকি দেয়।পূর্না হাসছে।বিভান ওর হাত ধরে টেনে বলল,
''আসো।"
পূর্না জোরে চিৎকার করে বলল,
''কাবো না বললাম তো।"
বিভান কিছুটা রেগে গেলো।অফিস থেকে ফিরে এমন করা যায়?তারওপর এতো বড় প্রজেক্ট হাত ছাড়া হয়ে গেলো।কতো গুলো টাকা ইন্ভেস্ট করেছিলো সব পানিতে।বিভান চড়া গলায় বলল,
''আসো তুমি।নাহলে মার খাবা।"
পূর্না বেরিয়ে জোরে চিৎকার করে বলল,
''কাবোনা।মা আমাকে ককনো মালে না।তুমি পতা।"
বিভান রেগে কোলে টেনে নেয় মেয়েকে জোর করে।তারপর খাটে এনে বসিয়ে ওর গাল চেঁপে একটু খাইয়ে দিতেই কান্না করতে থাকে পূর্না।যার কারনে মুখ থেকে খাবার বেরিয়ে এলো অনেকখানি।মেয়ের কান্নায় বিভান কিছুটা নরম হয়ে এলো।ও কি বেশিই রেগে গেলো মেয়ের সাথে?মেয়েকে বুকে টেনে বিভান ওর চোখজোড়া মুছে দিয়ে বলল,
''সরি মা।একটু খেয়ে নাও।সারাদিনে খাওনি কিছু।"
পূর্না কান্নার বেগ বাড়িয়ে বলল,
''আমি একন কাবোনা। মা বলেতিলো পলে কাওয়াবে।আমি মাল আতে কাবো।"
মেয়ের কথায় বিভানের বুকে দমকা হাওয়া বয়ে যায়। বেলা কে ও অনেক কিছুই শুনিয়ে দিয়েছিলো। বেলা নিশ্চয়ই অনেক চেষ্টা করে মেয়েকে খাওয়াতে ব্যার্থ হয়েছিলো। ছোট্ট বাচ্চাকে খাওয়ানোর ব্যাপারে অনেকেই বলেছিলো ভীষন ধৈর্যের প্রয়োজন হয়। বেলার তো ধৈর্য কম নয়।সেখানে বিভান একটুতেই মেয়ের ওপর রেuyগে গিয়েছিলো। কাজটা ঠিক হয়নি বিভসনের।নিজের রাগকে সংযত রাখার প্রয়োজন ছিলো ওর।বেলাকে যা না তা বলে কথা শুনিয়েছিলো। বাবুকে নিয়ে কথা শুনিয়েছিলো যেখানে বেলাই পূর্নাকে দেখে শুনে রাখে বিভানের অনুপস্থিতিতে।অথচ বেলাকে এসব শুনিয়ে দিলো বিভান যেখানে বেলা সবচেয়ে খুশি ছিলো পূর্নার আগমনে।বেলা তো মা। একটা সন্তানের জীবনে মায়ের দাবি সবচেয়ে বেশি সেখানে বেলাকে অপমান করলো বিভান। যাকে সে সবচেয়ে বেশি ভালোবাসে।বিভান খেয়াল করে মেয়ে এমনিতেই খেতে চায়না। ওকে গল্প বলে খাওয়াতে হয়। এক গল্প বারবার ঘুরিফিরিয়ে বলতে হয়। পূর্না খাওয়ার একপর্যায়ে কাক দেখতে চাচ্ছিলো।বিভান ফোনে কাক দেখালে পূর্না সরাসরি দেখার জেদ করতে থাকে।শেষমেশ মেয়েকে খাইয়ে রুমে আসে বিভান। পূর্নার কাপড় চোপড় ময়লা হয়ে গেছে।বিভান মেয়েকে ফ্রেশ করিয়ে খাটে বসিয়ে দিয়ে বারান্দায় এসে দাঁড়ায়।পাশে বেলা দাঁড়িয়ে আছে গ্রিলে কপাল ঠেঁকিয়ে।বিভান বেলাকে দেখতে থাকে।কোন মুখে ডাকবে?বেলা ভীষন কষ্ট পেয়েছিলো নিশ্চয়ই।বাজে কথা বলেছিলো। বিভান একটু এগিয়ে আসে বেলার দিকে তারপর ওর কাঁধে হাত রাখতেই বেলা হাত সরিয়ে বেরিয়ে যায় বারান্দা থেকে।বিভান সেদিকে অনেকটা সময় তাকিয়ে থেকে বাহিরে তাকায় আকাশের দিকে।অনেকটা সময় কাঁটিয়ে বিভান রুমে এসে দেখলো বেলা খাবার সাজিয়ে রেখে খাটে অপরপাশ ফিরে শুয়ে পড়েছে । পূর্না বেলার পাশ ঘেষে শুয়ে। বিভান খাটে বসে পূর্নাকে ফিসফিসিয়ে প্রশ্ন করলো,
''মা খেয়েছিলো?"
''না কায়নি। "
বিভান দীর্ঘশ্বাস ফেলে বেলার দিকে তাকায়।তারপর ওর কাঁধ ধরে হালকা ঝাঁকিয়ে ডাকতে থাকে কিন্তু বেলার সাড়াশব্দ নেই । অনেকটা সময় ডাকার পর ও বেলা উঠেনি। বিভান ডাইনিংরুমে খাবার ঢাকনা দিয়ে ফ্রিজে ঢুকিয়ে রুমে এসে শুয়ে পড়ে।আজ নিজের পেটে ও কোন দানা পানি ঢুকেনি। খিদায় পেট মোচড়াচ্ছে।কিন্তু বেলা বিভানের দিকে একটাবারের জন্য ও ফেরেনি।এদিকে পূর্নাও মাকে জড়িয়ে ঘুমিয়ে।সেরাতটা এভাবেই কেঁটে যায় ওদের।
পরদিন সকালে বেলা পূর্নাকে নাস্তা করিয়ে বিভানের নাস্তা টেবিলে সাজিয়ে বারান্দায় এসে দাঁড়ায়।লোকটা কাল রাতে ও কিছুই খায়নি।অনিচ্ছাসত্ত্বেও বেলা জোর করে ঘুমিয়ে পড়েছিলো।কারন বিভান কোন কিছু না জেনে ওকে যা তা বলেছিলো।কেন বুঝেনা সে?বেলা পূর্নাকে কতো টা ভালবাসে। পূর্না ছাড়া ওর জীবনটা অসম্পূর্ণ। বেলার চোখজোড়া আবার ভিজে আসে।হঠাৎ শাড়ীর আঁচলে টান পড়ায় বেলা চোখ মুছে পাশে তাকায়।পূর্না আধোকন্ঠে বলল,
''বাবা তোমাকে নাত্তা কেতে বলেতে। "
''খাবোনা। তোমার বাবাকে খেতে বলো। "
পূর্না আচ্ছা বলে দৌড়ে চলে যায়।বেলা পিছনে তাকিয়ে বিভানকে দেখতে পায়।কিছুক্ষনের জন্য একে অপরের চোখে আটকা পড়ে গেলো।কিন্তু বেলা শীঘ্রই চোখসরিয়ে নেয়।
...........................কফির মগে শেষ চুমুক দিয়ে ইমতিয়াজ ম্লান হেসে বলল,
''খুব ভালো কফি বানিয়েছিস। "
তমার মৃদু হেসে গলা শক্ত করে বলল,
''কফির কথা বলে তুই প্রসঙ্গ পাল্টাতে পারিসনা। কি হয়েছে তোর?হঠাৎ এভাবে এসে কাঁদছিলি।"
ইমতিয়াজ তাছিল্যের হাসি দিয়ে কিছু বলতে গেলে তমা ওর হাত চেঁপে ধরে বলল,
''প্লিজ বল।আর ঘুরাবিনা কথা।অনেকক্ষন ধরে এমন করছিস।"
ইমতিয়াজ বাধ্য হয়ে সাঁঝের ব্যাপারে সব বলে দিলো।ইমতিয়াজের কথা গুলো শোনার মুহূর্তে তমার শুধু একটা কথাই মনে হচ্ছিলো ইমতিয়াজ ঠিক তেমনটাই অনুভব করে যেমন টা তমা করে তবে ওর অনুভূতি অন্য কারোর জন্য।ইমতিয়াজ কথা বলে তমাকে বলল,
''আমি কি করবো বল?আমি যতো ভাবতে যাই দূর্বল হয়ে পড়ি।"
তমা হেসে ইমতিয়াজের হাত স্পর্শ করে বলল,
''পারবি তুই।আমি জানি তুই পারবি।"
ইমতিয়াজ তমাকে টেনে আবার ও বুকে নিয়ে নেয়।তারপর বলতে লাগলো,
''সেদিনকার মতো আজো উদ্ধার করলি।থ্যাংক ইউ দিয়ে ছোট করবোনা।শুধু চাইবো সবসময় এভাবে পাশে থাকবি।
 তমার চোখজোড়া জ্বলজ্বল করে উঠে। ম্লান হেসে বলল,
''অবশ্যই থাকবো।"
ইমতিয়াজ সরে এসে বলল,
''আসি আমি। পরে কথা হবে।"
তমা থামায়নি ইমতিয়াজকে।ইমতিয়াজ চলে গেলো সেদিন।ঘরে পৌছে ইমতিয়াজ একজনকে কল দেয়।তারপর কথা শেষ করে শুয়ে পড়ে। চোখের কোনা বেয়ে অশ্রু বিন্দু গড়িয়ে পড়ে।সেই অশ্রু বিন্দু মুছে ইমতিয়াজ অনুভব করলো আজ বুকটা বেশ হালকা লাগছে। একদম হালকা। যেন সব সমস্যা দূর হয়ে গেছে।
................................যেই ছোট্ট মানুষটাকে সামনে বসে নির্দ্বিধায় পড়িয়েছি অনেকগুলো দিন, যার অনুরোধে তাকে নিয়ে ঘুরতে গিয়েছি বিনা সংকোচে দুইটি দিন সেই ছোট্ট মানুষটার সামনে যেতেও আজ আমার ভীষণ লজ্জা লাগছে।। তাকে কোন এক রাতে ছাদের কোণায় দাঁড়িয়ে বাজে অপমান করেছিলাম।। সেই অপমানের কষ্ট আজ দ্বিগুন ভাবে আমার কলিজাটা ছিড়ছে  কারণ আজ আমার নিজের সাথেও সেরকম কিছু হয়ে গেছে।।।। 
ক্ষমা করে দিও পারলে ইদ্রি"মেসেজটা লিখে শুয়ে পড়ে নিশাদ।কতোদিন এভাবে রেগে থাকবে ওর প্রিয়তমা।নিজের অভাবের কারনে ভালবেসেও বুকে জড়িয়ে নিতে পারেনি ছোট্ট পরীটাকে।আজ যখন সব ওদের অনুকূলে তখন ওদের মাঝে অভিমানের দেয়াল দাঁড়িয়েছে।আর এ অভিমানের কারন ও সেটা পরিষ্কার।কারন সেদিন রাতে ওর ব্যাবহার কোনভাবেই গ্রহনযোগ্য ছিলো না অষ্টাদশী ইদ্রির জন্য।এ অভিমানের দেয়াল এতো সহজে ভাঙ্গবেনা সেটা জানা নিশাদের।তবে চেষ্টা চালিয়ে যাবে ও।হঠাৎ  ফোনের ভোঁতা আওয়াজে নিশাদ চিন্তার জগৎ থেকে বেরিয়ে আসে। ফোন হাতে নিয়ে অবাক হয়ে যায়।
দুঘন্টা আগে,
সাঁঝ যখন সাইমনের ব্যপার পুরোটা বলে তখন নিশাদ বলেছিলো,
''ওর নম্বরটা দে।একদিন ফ্রি হয়ে ওর সাথে কথা বলবো।"
সাঁঝ মৃদু হেসে সাইমনের নম্বর দিয়ে দেয় নিশাদকে।নম্বরটি সেভ করে রেখেছিলো নিশাদ।
নিশাদ কিছুটা অবাক হয়ে কল রিসিভ করতেই অপরপাশ থেকে একটি চিন্তিত কন্ঠ শুনতে পায়।
''আসসালামু আলাইনকুম।নিশাদ ভাই বলছেন?"
''জি ভাই।আপনার পরিচয়?"
''আমি সাইমন আহমেদ রুদ।সাঁঝের নম্বরটা কয়েকঘন্টা যাবৎ বন্ধ।ও কল ধরছিলোনা বলো চিন্তা হচ্ছিলো।"
''ওর ফোন ভেঙ্গে গেছে।তা মিঃ সাইমন আপনি ওর কি হন?"
''একচুয়ালি আমি সাঁঝের সিনিয়র কলিগ।ওর সিভিতে গার্জিয়ানের নম্বরে আপনার নম্বরটাই ছিলো।"
''ওহ।তা বেশি দরকার ওকে?"
''আসলে ওর নম্বর এভাবে অফ থাকেনা কখনো।তাই ভাবছিলাম ও  ঠিক আছে কিনা।"
নিশাদ একটু হাসলো তারপর বলল,
''আচ্ছা মিঃসাইমন সাঁঝকে আমি বলবো আপনাকে কল ব্যাক করতে।টেনশন করবেননা সবই ঠিক আছে।"
''থ্যাংক ইউ ভাইয়া।"
কল কেঁটে সাইমন বড় নিশ্বাস ছেড়ে সাইমনের নম্বরের দিকে তাকিয়ে হেসে ফেলে।আজ ওর ইদ্রির মতো সাঁঝের ভালোবাসায় লুকোচুরির মতো ছোট্ট আনন্দটা বিদ্যমান ।নিশাদের নম্বরটি সাঁঝ ওকে দিয়েছিলো ইমার্জেন্সিতে কল দেয়ার জন্য।আজ যখন সাঁঝকে কল দিয়ে পাচ্ছিলোনা তখনই নিশাদের নম্বরটির চিন্তা ওর মাথায় আসে।আর তাই না পেরেই নিশাদকে কল দিয়ে বসে সাইমন।এদিকে পরদিন সকালে নিশাদ নাস্তা শেষ করে উঠে দাঁড়াতেই একটা কল পায়।সেটা রিসিভ করে কথা শুনে ফোন কেঁটে চোখ বন্ধ করে দীর্ঘশ্বাস ছাড়ে।

!!!!

পুরোনো ফোনটায় একবার নজর বুলিয়ে সামনে দাঁড়িয়ে থাকা বৃদ্ধ রিক্সাওয়ালা কাকুর দিকে তাকায় নিশাদ।
ফ্ল্যাশব্যাক
সাঁঝ উঠে মায়ের সাথে কাজ করতে শুরু করেছিলো।নিশাদ উঠে বোনকে দেখে অবাক।এখন কাজ করার মানে কি?অফিস আছে মেয়েটার।নিশাদ টেবিলে বসতেই সাঁঝ ভাইয়ের সামনে নাস্তার প্লেট রাখতেই নিশাদ দেখলো সাঁঝের গালের এককোনা লাল হয়ে আছে। চোখের কোনা ভিজে আছে।নিশাদ স্বাভাবিক কন্ঠে বলল, 
''তোর অফিস আটটায় না?এখনো ঘরে কি করছিস?"
সাঁঝ ধরে আসা গলাকে স্বাভাবিক করে নিয়ে বলল,
''যাবোনা।"
নিশাদ কিছু বলার আগে সাঁঝ সামনে থেকে চলে গেলো।নাস্তা করে উঠে দাঁড়ায় নিশাদ।রুমে গিয়ে কিছুটা জোরপ ডাকলো, 
''সাঁঝ!!!"
কিছুসময় পর দৌড়ে আসে সাঁঝ।নিশাদ ওর হাতে আইফোনটা ধরিয়ে দিয়ে বলল,
''এটা রাখ। আজ বিকেলে ফোন কিনে দিবো আমি।"
সাঁঝের চোখের কোনা জ্বলজ্বল করে উঠে। ম্লান কন্ঠে বলল,
''লাগবেনা ভাইয়া ফোন তোর দরকার আছে।আমি ঘরেই থাকবো ফোন দরকার নেই। "
নিশাদ কিছুটা চড়া কন্ঠে বলল,
''অনেক্ষন ধরে না না করছিস কিছু লাগবেনা যাবিনা।কিছু বলিনি।বাবা যাই বলুক সব কথা ধরে মন খারাপের মানে হয়না সাঁঝ। ওনার কথার কোন ঠিক ঠিকানা নেই। তুই এটা রাখ।রাতে সাইমন কল করেছিলো তোর ফোন বন্ধ পেয়ে।ওকে কল ব্যাক করে কথা বলে নিস।বেচারা চিন্তা করছিলো।আর ওকে বলিস কবে ফ্রি আছে আমি দেখা করবো।"
বলেই বেরিয়ে এলো নিশাদ পুরোনো ফোনটা নিয়ে।রিক্সায় উঠে পড়ে নিশাদ।রিক্সায় বসেই সিম ঢুকিয়ে ফোন টা অন করে ও।তারপর মেসেজ অপশনে গিয়ে ইদ্রির নম্বরে মেসেজ পাঠালো ''সরি"
এদিকে হাতে ভাইয়ের আইফোন পেয়ে কিছুক্ষনের জন্য স্তব্ধ হয়ে থাকে।কাল রাতে নাকি সাইমন কল দিয়েছিলো।ভাইয়া বলেছে ওর সাথে দেখা করবে।চেহারায় মৃদু হাসি ফুঁটে উঠে সাঁঝের।তারপর আর দেরি না করে রেডি হতে শুরু করে অফিসের জন্য।ঘর থেকে বেরুনোর সময় ইকরাম রাহমানের সামনে পড়ে সাঁঝ। ভ্রুকুঁচকে মেয়ের যাওয়ার দিকে চেয়ে ছিলেন।সাঁঝ কিছু না বলে বেরিয়ে আসে। রিক্সা ঠিক করতে করতে সাইমনের নম্বর বের করে নিশাদের ফোনে।তবে ফোন করতে গিয়ে কিছুটা দ্বিধা বোধ করতে থাকে।নিশাদের ফোন থেকে সাইমনকে কল করতে কেমন অস্বস্তি বোধ করতে থাকে।
সাইমনকে রাস্তার ওপাশে রেস্টুরেন্টের সামনে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে মৃদু হাসে নিশাদ।ওকে সাইমন এখানে আসতে বলেছিলো।নিশাদ রাস্তা পেরিয়ে সাইমনের কিছুটা নিকটে আসতেই সাইমন একটু হেসে বলল,
''আসসালামু আলাইকুম ভাইয়া।ভালো আছেন?"
''ওয়ালাইকুম আসসালাম। আপনি কেমন আছেন? "
''আলহামদুলিল্লাহ। আপনি কল করেছিলেন।সব ঠিক আছে তো?"
নিশাদ মাথা ঝাঁকিয়ে বলল,
''সব ঠিক আছে।আপনার সাথে কথা ছিলো।"
সাইমন কিছুটা সৌজন্যের হাসি দিয়ে বলল,
''ভিতরে বসে কথা বলা যাক ভাইয়া।"
রেস্টুরেন্টের কোণায় ছোট্ট টেবিলে বিপরীতভাবে দুইজন পুরুষ বসে আছে. একজনের দৃষ্টি টেবিলে গুটিয়ে রাখা হাতের দিকে আরেকজনের দৃষ্টি তার মুখের দিকে...প্রচন্ড দ্বিধায় আর আশঙ্কায় এসির মধ্যেও ঘামছে সাইমন.. মাথা নিচু করে ভাবছে সামনে বসা নিশাদকে যাতে এমন কিছু বলে যেন সে বোনের উপরে না রাগ করে বা বোনকে ভুল না বুঝে...এদিকে নিশাদ সাইমনকে পর্যবেক্ষণ করতে গিয়ে ভাবছে সৃষ্টিকর্তা তার বোনটাকে হয়তো ভালো কোনো মানুষের হাতেই তুলো দেয়ার ব্যাবস্থা করেছেন...এখানে আসার আগে ইমতিয়াজ ওকে ফোন করে বলেছিলো "তুই ছেলেটার উপরে ভরসা রাখতে পারিস..তার কিছু পারিবারিক জটিলতা আছে কিন্তু মানুষ হিসেবে সে সৎ পরিশ্রমী আর চরিত্রবান....আর সে নিজে আর্থিকভাবে সাবলম্বী যা সাঁঝের সবথেকে বেশি প্রয়োজন.." কথাগুলো ভাবতে ভাবতে নিশাদ বলে উঠলো 
"আপনি সেদিন রাতে আমাকে ফোন করেছিলেন সেটা কি ওর অফিসের কলিগ হিসেবে না কি অন্যকিছু?" 
মাথা টুকে সামনে তাকিয়ে সাইমন বলল 
"আমি আপনার বোনকে অনেকদিন ধরেই ভালোবাসি..আপনার কাছে সত্যিটাই বলবো আজ...না সেদিন আমি ফোন করেছিলাম আমার ভাভালোবাসার মানুষটার খোঁজ নিতে.. এরকম কখনো হয়নি যে সাঁঝের ফোন এতক্ষন ধরে অফ..আমাদের মনোমালিন্য বা অভিমান যাই হোক ওর ফোন বন্ধ পাইনি কখনো...তাই সেদিন এতটাই ভয় পেয়েছিলাম যে কিছুক্ষনের জন্য মনে হচ্ছিলো ওকে হারিয়ে ফেলেছি..তাই আপনাকে কল করতে বাধ্য হয়েছিলাম...আমার পরিচয় মিথ্যা হলেও উদ্দেশ্যে কোন অসততা ছিলনা নিশাদ ভাইয়া..সাঁঝ তার পরিবারে সবথেকে বেশি যে মানুষটাকে ভরসা করে সেটা আপনি..আর আপনার কাছে মিথ্যা বলতে আমার বিবেক বাধা দিচ্ছিলো..কিন্তু যেহেতু সাঁঝ আমার কথা কিছু জানায়নি আপনাকে নিজ থেকে তাই সেদিন মিথ্যা পরিচয় দিয়েছিলাম.. আমি আপনাকে এতটুক কথা দিতে পারি আপনার বোনকে সবসময় সুখী রাখতে না পারলাম এক কষ্ট পেতে দেব না...ওর সাথে প্রতারণা করবো না.. ওর অপব্যাবহার করবোনা... আমার জীবনে যদি কেউ এই মুহূর্তে আপন কেউ থাকে তাহলে সেটা সাঁঝ যে এই মুহূর্তে একমাত্র পিছুটান..নয়তো ওই দেশ ছেড়ে সব ছেড়ে চলে যেতে আমি দ্বিতীবার ভাববোনা..আরো অনেক কিছু হয়তো বলতে পারতাম কিন্তু আমার মুখে আসছে না....এখন আপনি যা বলবেন আমি তাই মাথা পেতে নিবো..কারন আপনি আমারও বড় ভাই..শুধু সাঁঝের না.."
কয়েক সেকেন্ড চুপ থেকে নিশাদ বললো 
"আর যদি আপনার কথার খেলাফ করেন তাহলে?"
"সেইদিন দেখার সুযোগটাও আমি আপনাকে দিচ্ছিনা বেঁচে থাকতে" 
"কথা দিচ্ছেন তো?" 
"সাঁঝের ভাইকে না আমি আমার নিজের ভাইকে আজ কথা দিচ্ছি আমার ভালোবাসার মানুষের যত্নে আমি ত্রুটি রাখবোনা" 
"বেশ...কথাটা আজীবন মনে রাখবেন  আর কিছু আমার চাওয়ার নেই আপনার কাছে...আমার সবথেকে দুর্বল জায়গাটা আপনার কাছে আমানত থাকবে.." 
এতটুক শুনে সাইমন খুশিতে বিষ্ময় ভরা দৃষ্টি নিয়ে তাকালো নিশাদের দিকে..সেদিক তাকিয়ে মৃদু হেসে নিশাদ বললো 
"আজ তাহলে উঠি...আমার আর্জেন্ট কাজ আছে আসলে..." 
বলে উঠতে নিলেই সাইমন একটা ছোট প্যাকেট নিশাদের হাতে ধরিয়ে দিয়ে বলে উঠলো 
"ভাই এই ফোনটা সাঁঝকে দিয়েন বাসায় গিয়ে..আমি ওকে অনেকবার কল করেছি কিন্তু ধরছেনা..ওর ফোন ভেঙে গেছে আপনি বলেছিলেন..ও তো অফিসে যায় ফেরে সন্ধ্যায়..সাথে ফোন না থাকলে খবর নিতে পারিনা....ও আমাকে একবারও কল দেয়নি ফোন ভাঙার পর থেকে..রাগ করে আছে কিনা জানি না কোন কারনে..এদিক আপনি আজ কল দিয়ে দেখা করতে চাইলেন.. তাই ভাবলাম আপনাকে দিয়েই ওকে দেয় ফোনটা...." 
"সেদিন আমার বাবা আপনাদের একসাথে দেখে ফেলেছিল বিধায় রাগ করে ওর ফোন ভেঙেছিল..তাই ও আপনাকে হয়তো কল দিতে ভয় পাচ্ছিলো..আমি ওর থেকে আপনার কথা সব শুনেছি রাতে বাসায় ফিরে..আর তাই আজ ডিরেক্ট মিট করতে এসেছি..কিন্তু ওকে তো আমিই ফোন কিনে দিতাম.. আপনার দেয়া লাগবে কেন..."
"সবসময় তো আপনি দিয়েছেন এবার আমি দেই প্লিজ........!!" বলে অনুরোধের দৃষ্টিতে তাকিয়ে নিশাদের হাতদুটো ধরে বলে উঠলো সাইমন...প্রচন্ড অবাক হলেও সেটা সামলে নিশাদ কিছুটা ইতস্তত হয়েই প্যাকেটটা নিয়ে বলল 
"আচ্ছা ঠিক আছে...আমি ওকে দেব এটা বাসায় গিয়ে....ও আপনাকে কল দিবে টেনশন করবেন না.." 
"ভাইয়া আরেকটা অনুরোধ.. আমাকে আপনি নয় তুমি করে বললে আমি খুব খুশি হবো...বড় ভাইয়ের মুখে আপনি মানায়না.."
হেসে উত্তর দিলো নিশাদ 
"ঠিক আছে সাইমন..তুমি সাবধানে ঘরে ফিরো আর নিজের খেয়াল রেখে.. বুঝতেই পারছো তোমার গুরুত্ব আমার কাছে অনেক বেড়ে গেছে এখন থেকে.. আসি আজ..আল্লাহ হাফেজ" 
"আল্লাহ হাফেজ ভাইয়া..ভাল থাকবেন..আবার দেখা হবে"
নিশাদ আর সাইমন বেরিয়ে আসে একসাথে। দুজন শেষ বিদায় নিয়ে হেঁটে যে যার গন্তব্যে চলে যায়।
.........................এদিকে বেলা সেদিন বিকেল পূর্নাকে নিয়ে পাশের একটা পার্কে চলে যায়।পূর্না খুব বিরক্ত হচ্ছিলো।খেতে চাচ্ছিলোনা আর না চাইছিলো ঘুমোতে। বেলা না পেরে মেয়েকে নিয়ে বেরিয়ে পড়ে পার্কের উদ্দেশ্যে।পার্কে গিয়ে দেখলো অনেক বাচ্চারাই খেলছে।পূর্না মুহূর্তের মাঝেই ওদের সাথে মিলে গেলো।বেলা একটা বেঞ্চে বসে বাচ্চাদের খেলা ধুলা দেখছে।বাচ্চাদের মন বড় পরিষ্কার।একে অপরের সাথে খুব সহজে 
মিশে যেতে পারে।
রান্না শেষে বেলা খাটে এসে শরীর এলিয়ে দেয়।পাশে পূর্না খেলছে পুতুল দিয়ে।বেলা মেয়ের মাথার চুল ঠিক করে দিয়ে বলল, 
''কেমন লেগেছে আম্মু আজ?"
পূর্না খিলখিল করে হেসে ফেলে বলল,
''কুব বালো লেগেতে।দানো মা দিয়া বলতে আমাকে আবালো দেতে বলেতে।"
বেলা ভ্রু উঁচু করে বলল,
''তাই আম্মু আর কি বলল?"
পূর্না মায়ের বুকের সাথে লেগে গিয়ে বলল,
''আর বলেতে ওল স্কুলে বুত্তি অয়ে দেতে।"
বেলা মেয়ের আধোবোল কথা শুনে শব্দ করে হেসে ফেললো।পূর্না মায়ের গালে চুমু দিয়ে বলল, ''মা দানো তুনাল মা নেই। "
''ও কার সাথে এসেছিলো তাহলে?"
''ওল কালামনিল তাতে। "
''ওহ।"
বেলা মেয়েকে টেনে জড়িয়ে শুয়ে পড়ে। সন্ধ্যায় ফিরে আসে বিভান।বেলা পাকঘরে কাজ করছিলো।বিভান এসে বেলাকে দেখে পাকঘরে চলে যায়। বেলার পিছনে দাঁড়িয়ে ফিল্টার থেকে গ্লাসে পানি ভরাতে ভরাতে বলল,
''কেমন গেলো সারাটাদিন?"
বেলা চুপ করে নিজের কাজ করছিলো।বিভানের এভাবে কথা বলায় বেলা অবাক।তবে নিজেকে স্বাভাবিক রেখে কাজ করে যাচ্ছে। বিভান এসে পিছন থেকে বেলার কোমড় জড়িয়ে ধরে ওর কানো গালে ঠোঁট চেঁপে চুমু দিয়ে বলল,
''বললে না যে কেমন গেলো?"
বেলা বিভান কে সরিয়ে দেয়ার চেষ্টা করে ব্যার্থ হলো।বেলাকে এমন করতে দেখে বিভান বলল,
''এমন করছো কেন?কথা বলো বেলা। "
বেলা কিছুটা উঁচু গলায় বলল,
''কি কথা বলবো আপনার সাথে?কি নিয়ে কথা বলবো?আমি তো খুব খারাপ মা।মা হবার যোগ্য রাখিনা। এমন মা কখনো কারোর ভালো স্ত্রী হতে পারেনা।"
বিভান বেলাকে জড়িয়ে ধরে বলল,
''বেলা আমি খুব টেনশনে ছিলাম।দেখো আমি কখনো এমন করেছি?"
বেলা বিভান সরিয়ে দিতে থাকে। কিন্তু বিভান সরছে না বরং হাতের বাঁধন আরো শক্ত করছে বেলার পেটে।বেলা আর না পেরে বলল,
''বিভান প্লিজ বের হন।ভালো লাগছেনা।"
''বেলা শুনো না।দেখো তুমি এমন করলে আমি কার কাছে যাবো বলো?বেলা প্লিজ কথা শুনো।"
বেলা জানে বিভান এখন যাবেনা।কোন ভাবে তাকে এখান থেকে বের করতে হবে। লোকটার শরীর থেকে ঘামের বোঁটকা গন্ধ আসছে।বেলা বলল,
''আপনার বডি স্প্রে শেষ আগে বলেননি কেন?"
''তুমি কিনে এনো।বেলা এবার তো অন্তত কথা শুনো।"
''আপনি রুমে গিয়ে ফ্রেশ হন।আমি আসছি চা নিয়ে।"
বেলার মাথার কোনায় চুমু দিয়ে চলে গেল। বেলার চোখের কোনা জ্বলজ্বল করে উঠে। ও জানে লোকটার মন একদম পরিষ্কার। কিন্তু তার কিছু কথা না চাইতে ও হৃদয় ছিদ্র করে ফেলে।

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন