মেঘের খামে অনুভূতি (পর্ব ১৬)


প্রভার মুখে নূপুরের নাম শুনে জীবন রামিম একবার নিজেদের দিকে তাকালো। সাথে সাথেই রামিম বলে উঠলো, 
'প্রভা তুমিও না। বলেছিলাম না জীবন আজ তার বৌকে নিয়ে আসবে। এই দেখো এ হচ্ছে স্পৃহা জীবনের বৌ।'
প্রভা কিছু বুঝতে না পেরে কপাল কুঁচকে মুখ বাকিয়ে রামিমের দিকে তাকালে রামিম তাকে চোখে ইশারা করে কিছু বলল। তারপর প্রভা বলল,
'ওহ ভুলেই গিয়েছিলাম। এখন তো জীবন ফ্রেন্ডের সাথে না বৌয়ের সাথে আসবে। এসো ভাই স্পৃহা। দেখো তো,কথায় কথায় তোমাদেরকে কতক্ষণ দাঁড় করিয়ে রেখেছি।'
স্পৃহা সবটাই ধরতে পেরেছে। এরাও তাহলে নূপুরের কথা জানে। স্পৃহার ভেতরটা ভেঙেচুরে যাচ্ছে। তবুও সে স্বাভাবিক রইলো। প্রভা স্পৃহাকে ভেতরে নিয়ে বসালো। রামিম জীবনকে টেনে নিয়ে ওদের আড়ালে চলে গেল।
'এসব কি জীবন? তুই তো নূপুরকে বিয়ে করতে যাচ্ছিলি। তাহলে এসব কিকরে হলো? কিছু বলছিস না কেন?'
'নূপুর আমাকে বিয়ে করবে না। সে আরেকজনের সাথে এনগেজমেন্ট করে নিয়েছে।'
'আর তাই তুই স্পৃহাকে বিয়ে করেছিস?'
'হুম।'
'এমনি এমনি একটা মেয়েকে বিয়ে করে নিলি? ও তোর সাথে সারাটা জীবন কাটাবে কি করে? তুই কি ওকে ভালোবাসিস?'
'না।'
রামিম বিরক্ত হয়ে বলল,
'তাহলে বিয়ে করলি কেন? নূপুরের থেকে প্রতিশোধ নেয়ার জন্য? এই মেয়েটার জীবন কেন নষ্ট করছিস তুই। স্পৃহা নূপুরের কথা জানে?'
'আমি জানি না। নূপুরের কথা আমি কখনো ওকে বলিনি।'
'কেন বলিস নি? তোর উচিত ছিল স্পৃহাকে আগে থেকেই সবটা জানিয়ে দেয়া। বেচারি আজ কতটা কষ্ট পেয়েছে বুঝতে পারছিস। তখন দেখলি না প্রভার মুখে অন্য করো নাম শুনে ওর মুখটা কেমন লাল হয়ে গেছিল।'
'স্পৃহাকে নূপুরের কথা বলবো? '
'হুম। বলাটা জরুরি।'
'স্পৃহা কষ্ট পাবে হয়তো।'
'এটা তোর আগে ভাবা উচিত ছিল গাধা। বিয়ে দু'জন মানুষের সারাটা জীবনের প্রশ্ন। এক বছর বা দু'বছরের কথা না। এভাবে হুট করে বিয়ে করে নিলেই তো হলো না।'
'আচ্ছা। আমি স্পৃহাকে জানাবো। তবে আজ না। এমনিতে ওর শরীরটা ভালো যাচ্ছে না।'
'যত তাড়াতাড়ি জানাবি ততই ভালো।'
'হুম।'
'এখন চল। ওরা একা আছে। '
রামিমের কথাগুলো জীবনকে অনেক ভাবাচ্ছে। জীবন চেয়েছিল স্পৃহা যেন কখনো কষ্ট না পায়। কিন্তু এখন দেখা যাচ্ছে জীবনই স্পৃহাকে সবচে বড় কষ্ট দিবে। যতই স্পৃহা জীবনকে না ভালোবাসুক। তবুও তো একটা মেয়ে কখনো নিজের স্বামীকে অন্য কারো সাথে সহ্য করতে পারবে না। স্পৃহা তো সরলসোজা মেয়ে। সে তো আরো আগে পারবে না।
রাতে সবাই একসাথে ডিনার করে ওরা ছাঁদে চলে এসেছে। ছাঁদে চাঁদর পেতে বসে চারজনে গল্প করছে। এই কিছু সময়ে প্রভা স্পৃহার সাথে অনেক মিশে গেছে। স্পৃহার স্বভাব ছিল অচেনা কারো সাথে সহজে মিশতে পারে না। কিন্তু সে প্রভার সাথে অল্পতেই মিশে গেছে। প্রভা যেন কি বলছে স্পৃহা তা শুনে শব্দ করে হাসছে। জীবন রামিমের সাথে কথা বলছিস। স্পৃহার হাসির শব্দ শুনে সে বারবার স্পৃহার দিকে তাকাচ্ছে। রামিম এটা ধরতে পেরে বলল,
'জীবন তুই কি জানিস তুই স্পৃহাকে ভালোবেসে ফেলেছিস।'
রামিমের কথা শুনে জীবন স্পৃহার দিক থেকে চোখ ফিরিয়ে নিয়ে বলল,
'কি যা তা বলছো বলো তো!'
'যা তা নারে পাগলা। তুই স্পৃহাকে ভালোবেসে ফেলেছিস। কিন্তু এটা তুই নিজেই জানিস না।'
'তুমি জানো আমি শুধু একজন কে-ই ভালোবাসতাম।'
'হুম জানি। কিন্তু তুই এখন নূপুরকে না স্পৃহা ভালোবাসিস। এটা আমি বাজি ধরে বলতে পারি।'
'হঠাৎ তোমার মাথায় এসব ভাবনা উদয় হলো কোত্থেকে বলো তো?'
'আজ সারাটা সন্ধ্যা দেখলাম তো। তুই স্পৃহার প্রেমে হাবুডুবু খাচ্ছিস। তখন টিভি দেখার সময় তুই টিভির দিকে কম স্পৃহার দিকে বেশি তাকিয়ে ছিলি। স্পৃহা যখন প্রভার সাথে কিচেনে ছিল। তখন তুই নানা বাহানাই কিচেনে উঁকি দিয়েছিস। বিনা প্রয়োজনে ওকে ডেকে এনেছিস। খাওয়ার সময় দেখলাম তো। বাবাহ! আমি আমার প্রেগন্যান্ট বৌয়ের যতটা না খেয়াল রাখি। তুই তার থেকে বেশি স্পৃহার খেয়াল রাখিস। আচ্ছা ওসব বাদ। এখন তুই কি করছিস তা একবার দেখ। বসে আছিস আমার সাথে অথচ তোর সবটুকু মনোযোগ স্পৃহার উপর। স্পৃহার হাসি দেখে তোর মুখেও যে হাসির রেখা ফুটে উঠেছে তা আমি স্পষ্ট দেখতে পারছি। এতকিছুর পরও তুই বলবি,তুই স্পৃহাকে ভালোবাসিস না?'
'তুমি যেমন ভাবছো তেমন কিছুই না।'
রামিম হেসে বলল,
'তুই সেই ঘাড় ত্যাড়াই রয়ে গেলি। এখনো অস্বীকার যাচ্ছিস।'
'আমি কীভাবে স্পৃহাকে ভালোবাসতে পারি?'
'কেন পারিস না। শোন গাধা ভালোবাসা কখনো বলেকয়ে হয় না। কে কাকে কখন ভালোবেসে ফেলে তা কেউ বলতে পারে না। তুইও নিজের অজান্তেই স্পৃহাকে ভালোবেসে ফেলেছিস। তুই যত তাড়াতাড়ি এটা মেনে নিবি ততই তোর জন্য ভালো হবে। আর স্পৃহার কথাও একবার ভেবে দেখ। সেও কিন্তু তোকে ভালোবাসে।'
'দূর! তোমার মাথা এলোমেলো হয়ে গেছে ভাইয়া। কি সব বলছো।'
'মাথা আমার এলোমেলো হয়নি। মাথা তোর এলোমেলো হয়েছে। দু'টা মেয়ের মধ্যে তুই ফেঁসে গেছিস। কাকে ভালোবাসবি কাকে ছাড়বি তা বুঝতে পারছিস না। এমন বেশিদিন চললে তুই কিন্তু শেষে দু'জনকেই হারাবি। তাই আমার কথা মেনে নে। আগের সবকিছু ভুলে গিয়ে স্পৃহাকে নিয়ে ভালো থাক।'

'সেদিন তোমার ভাইয়া আমার বাবার হাতে যা দৌড়ান খেয়েছিল না! অন্ধকার রাতে ঝোপঝাড়ের মধ্য দিয়েই ছুটেছিল। পা থেকে জুতা খুলে রয়ে গেছিল। আগের কথা ভাবলে এখনো আমি একা একাই হাসি। বিয়ের আগে যা পাগলামি করেছে। আল্লাহ!'
প্রভার কথা শুনে স্পৃহা শব্দ করে হাসছে। সাথে প্রভাও। স্পৃহা হেসে হেসেই বলল,
'ভাইয়া আপনাকে অনেক ভালোবাসে তাই না ভাবী?'
'হুম। তা আর বলতে? ভালো না বাসলে এমন এমন পাগলামি করতো নাকি? দেখছো না বাবা হতে যাচ্ছে তবুও তার পাগলামি কমে না।' 
প্রভা মুহুর্তেই হাসি থামিয়ে বলল,
'সত্যিই স্পৃহা ও আমাকে অনেক ভালোবাসে। আমার জন্য নিজের বাড়ি ছেড়ে দিয়েছে। ওর বাবা আমাকে মেনে নেয় নি দেখে ও ওর বাবাকেও ছেড়ে দিয়েছে। জানো স্পৃহা, আমি না এমনটা চাই নি। আমার জন্য রামিম ওর বাবা মা বোনের থেকে দূরে আছে এটা আমার একটুও ভালো লাগে না। আমি সব সময় চাইতাম শ্বশুর শাশুড়ি ননদ সবার সাথে মিলেমিশে থাকতে। কিন্তু আমার ভাগ্যে এমনটা লিখা নেই। আমার সন্তান কখনো দাদা দাদীর আদর পাবে না। এটা ভেবে ভীষণ কষ্ট হয়।'
স্পৃহা প্রভার হাত ধরে কাঁদো কাঁদো গলায় বলল,
'সব ঠিক হয়ে যাবে ভাবী। একদিন আমরা সবাই একসাথে থাকবো। জেঠা জেঠি মা আপনাদের মেনে নিবেন। আপনার বেবি আমাদের সবার মাঝে বড় হয়ে উঠবে। আমরা সবাই ওকে অনেক আদর করবো।'
প্রভা স্পৃহার দিকে তাকিয়ে হঠাৎ করে হেসে বলল,
'আরে পাগলী তুমি কাঁদছো কেন?'
'কাঁদছি না তো।'
প্রভা স্পৃহার দিকে একনজরে তাকিয়ে ভাবছে,
'মেয়েটা কত সহজসরল। আমার কষ্টের কথা শুনে ওর চোখে পানি এসে গেছে। আজকাল এমন মেয়ে হয় নাকি? জীবন সত্যিই ভাগ্যবান। স্পৃহার মত একটা মেয়ে ওর বৌ হয়েছে।'
প্রভা স্পৃহার মুড ঠিক করার জন্য অন্য কথায় চলে গেল।
'জীবনও তোমাকে অনেক ভালোবাসে,না?'
স্পৃহা হঠাৎ কি বলবে বুঝতে পারছে না। 
'হয়তো বাসে।'
প্রভা চোখ ছোট ছোট করে তাকিয়ে মুখ বাকিয়ে বলল,
'হয়তো বাসে মানে? তুমি জানো না?'
'উনি তো কখনো বলেন নি।'
স্পৃহা মুখ ফসকে এই কথাটা বলে ফেলেছে। 
'মানে! তোমরা হাজবেন্ড ওয়াইফ তবুও তুমি এই কথা বলছো? জীবন কখনো তোমাকে আই লাভ ইউ বলেনি? কখনো ভালোবাসা প্রকাশ করেনি? মানছি তোমাদের বিয়েটা আর সবার মত স্বাভাবিক ভাবে হয়নি। তবুও তো তোমরা একমাসের মত হবে একসাথে আছো। এতদিনেও তোমরা স্বাভাবিক হতে পারো নি?'
প্রভা কথাগুলো জোরে জোরে বলছে। স্পৃহা লজ্জায় মরে যাচ্ছে। জীবন শুনলে কি ভাববে? প্রভা আবার বলল,
'দাঁড়াও আমি জীবনকে জিজ্ঞেস করছি। কি পেয়েছে সে হুম? '
প্রভা জীবনকে ডাকতে নিলে স্পৃহা তার হাত ধরে বলল,
'ভাবী দোহাই লাগে। প্লিজ উনাকে ডাকবেন না। আমি উনার সামনে লজ্জায় পরতে চাই না।'
'এই মেয়ে কি বলে এসব? নিজের স্বামীর সামনে আবার লজ্জা কিসের?'
'তবুও ভাবী। আপনি উনাকে কিছু বলবেন না। এটা আপনার কাছে আমার অনুরোধ।'
প্রভা হাসতে হাসতে বলল,
'আচ্ছা যাও বলবো না। দেখো মেয়ের লজ্জা কতো! এতো লজ্জা পেলে চলবে?'
রাতে ওরা বাসায় চলে এসেছে। রামিম জীবনকে থাকার জন্য অনেক জোড়াজুড়ি করেছে। তবুও সে থাকে নি। প্রভা তো স্পৃহাকে আসতেই দিচ্ছিল না। অনেক রাতে বাসায় ফিরে ক্লান্ত হয়ে স্পৃহা ঘুমিয়ে পড়েছে।কিন্তু জীবন ঘুমাতে পারছে না। রামিম ভাইয়ার বলা কথাগুলো তাকে অনেক ভাবাচ্ছে। সত্যিই কি সে স্পৃহাকে ভালোবাসতে শুরু করেছে? না না। এটা কীভাবে সম্ভব? জীবন শুধু নূপুরকেই ভালোবাসতো। সে আর কাউকে ভালোবাসতে পারবে না। 

পরের দিন অফিসে একটা মিটিং ছিল। মিটিং শেষ করে জীবনের এখানে তেমন আর কোনো কাজ নেই। সে বাসায় ফিরে আসার জন্য বের হতেই রায়হানের সাথে দেখা হয়ে গেল। 
'আরে রায়হান সাহেব। কেমন আছেন? '
'এইতো স্যার। আলহামদুলিল্লাহ। '
'তা বিয়ে কবে করছেন?'
'ওদের বাড়ি থেকে একটু সময় চেয়েছেন। নূপুরের দাদী অসুস্থ। তাই বিয়ের ডেট একটু পিছিয়ে গেছে।'
'ওহ।'
জীবন মুখে একটু হাসি টেনে বলল,
'তা বিয়ের দাওয়াত পাবো তো? এনগেজমেন্টের সময় কিন্তু জানান নি।'
'অবশ্যই পাবেন স্যার। এনগেজমেন্টের সময় কাউকেই জানাতে পারিনি স্যার। আসলে আমার বাবা সবকিছু এতো তাড়াতাড়ি ঠিক করে ফেললেন।'
জীবন রায়হানের কাঁধে হাত রেখে বলল,
'আরে সমস্যা নেই। এনগেজমেন্টে বলেননি। বিয়েতে বলবেন। আমি আপনার সিচুয়েশান বুঝতে পেরেছি। তা একদিন আপনার হবু বৌকে নিয়ে আমার বাসায় আসলে আমি কিন্তু অনেক খুশি হতাম।'
'আসবো স্যার। '
'আচ্ছা আজ তাহলে আসি।'
'জি স্যার।'
জীবন চলে গেলে রায়হান বলল,
'স্যারের সম্পর্কে যতটুকু শুনেছিলাম স্যার তার থেকে অনেক ভালো মানুষ। অল্প বয়সে এতো বড় কোম্পানির মালিক হয়ে গেছেন তবুও উনার মাঝে কোনো অহংকার নেই।'
জীবন বাসায় ফিরে এসে দেখে স্পৃহা এখনো ভার্সিটি থেকে ফিরে নি। একা বাসায় স্পৃহাকে ছাড়া ভালো লাগবে না। তাই জীবন আর ভেতরে ঢুকলো না। অফিসের ড্রেসেই কার নিয়ে আবার বেরিয়ে পড়লো। স্পৃহাকে নিয়ে একেবারেই বাসায় ফিরবে। 

জীবন গাড়ি থেকে নেমে স্পৃহার জন্য অপেক্ষা করছে। তার ফোন বেজে উঠলে সে ফোন রিসিভ করে কানে নিলো,
'কিরে এতদিন পর কোত্থেকে? '
'শালা হারামি। তুই কোনো কথাই বলবি না। আমি নাহয় তোর খোঁজ নিই নি। তাই বলে তুইও আমাকে ভুলে যাবি?'
'আরে ভুলিনি রে। একটু ব্যস্ত ছিলাম।'
'এতো কিসের ব্যস্ততা তোর?'
'গাধা তোর বোনকে নিয়েই ব্যস্ত ছিলাম। বোনকে এতো আদর দিয়েছ এখন সে নিজে নিজে কিছুই করতে পারে না। বোনকে শ্বশুরবাড়ি পাঠাবি এই কথা কি ভুলে গিয়েছিলি? একটু আধটু টুকটাক কাজ শিখালে কি এমন ক্ষতি হতো? তাহলে এখন আর আমাকে কামলা খাটতে হতো না।'
জীবনের কথা শুনে জয় হেসে দিয়ে বলল,
'উচিত হয়েছে। তোরও একটু শিক্ষা হোক। তোকে শিক্ষা দেবার জন্যই বোনকে কাজ শিখাই নি।'
'হাসবি না একদম। তোকে সামনে পেলে তোর দাঁত ভেঙে ফেলতাম।'
'বিয়ে করেছ মামু। এখন তো একটু প্যারা সহ্য করতেই হবে।'
'হুম সহ্য করছিই তো।'
'আচ্ছা এখন বল, আমার বোন তোকে এতো কি প্যারা দিচ্ছে? '
'সেদিন রাতে মাথা ব্যথায় কেঁদে কেটে অস্থির হয়ে পড়েছিল। আমি তো ভয় পেয়ে গিয়েছিলাম। ভেবে পাচ্ছিলাম না হঠাৎ করে ওর কি হয়ে গেল। বিশ্বাস কর সেই রাতে এক ফোঁটাও ঘুমাতে পারিনি।'
'স্পৃহার তো মাঝে মাঝে মাইগ্রেনের ব্যথা হয়। '
'এই কথা আমাকে আগে জানাবি না?'
'এখন স্পৃহা কেমন আছে? '
'এখন ভালোই আছে। এই জয় শুনেছি তুই নাকি জব করছিস।'
'হুম। কতদিন বেকার বসে থাকবো? কিছু একটা তো করতেই হতো?'
'মানে কি এসবের জয়? তোকে বলেছিলাম আমার কোম্পানিতে জয়েন করতে। আমি তোকে ৫০% শেয়ার দিতাম। তুই কেন শুধু শুধু অন্য কোথাও জব নিতে গেলি? আমার কোম্পানি কি তোর না? তুই আমাকে পর ভাবিস?'
'আরে দোস্ত তেমন কিছুই না। কিছুদিন এই জবটা করতে থাকি না। ভালো না লাগলে তখন তোর কাছে চলে আসবো।'
'আচ্ছা। মনে থাকে যেন।'
'হু। এখন কোথায় তুই? '
'স্পৃহার ভার্সিটির সামনে। ওকে নিতে এসেছি। '
'ওকে। তাহলে এখন রাখি।'
'সময় পেলে বাসায় আসিস। অনেক দিন হলো আড্ডা দেই না।'
'আসবো। ভেবলিটাকেও অনেকদিন ধরে দেখি না। একদিন যেয়ে তোদেরকে নিয়ে আসবো।'

স্পৃহা ভার্সিটির গেট থেকে বের হয়ে দেখে একটা রিকশা দাঁড়িয়ে আছে। স্পৃহা সেদিকে এগিয়ে গিয়ে বলল,
'চাচা আপনি? '
'হ মা। তোমার ছুটি হইছে? '
'হ্যা।'
'তাইলে রিকশায় উইঠা পড়ো। তোমারে নামাইয়া দিয়া আহি।'
'কিন্তু,,, চাচা আপনি কি প্রতিদিন আমার জন্য দাঁড়িয়ে থাকেন?'
'হ।'
'এতে তো আপনার ক্ষতি হয়। আমার জন্য দাঁড়িয়ে না থেকে অন্য কাউকে তুলে নিলে তো ভাড়া পেতেন।'
'অতো টেকা দিয়া কি করমু মা? তোমারে রিকশায় তুলতে আমার ভালা লাগে। তোমার লগে কথা কইলে মনে শান্তি পাই। টেকার থেইকা মনের শান্তি বড় না মা?'
স্পৃহা আর কিছু না বলে রিকশায় উঠে গেল। 
'তা চাচা আপনার ছোট মেয়ে এখন কেমন আছে? '
'বেশি ভালা না। ছোট মাইয়া টার সব সময় অসুখবিসুখ লাইগ্যাই থাকে। তুমি মনে হয় কিছুদিন এদিকে আহো নাই।'
'না। মাঝখানের কয়েকটা দিনে অনেক কিছু হয়ে গেছে।'
'জয় বাবা এহন কই থাকে? তারেও তো দেহি না।'
'ভাইয়া জব নিয়েছে। অফিস করে আর এদিকে আসতে পারে না।'
'পোলাটা অনেক ভালা। তার মনটা অনেক বড়। সে আমারে কত সাহায্য করছে। ছোট মেয়েরে তো সে-ই ইস্কুলে ভর্তি করাইছে। আগে মাঝে মধ্যে আমার বাড়িত যাইত। এহন যায় না।'
এই রিকশাওয়ালা চাচাকে জয় আগে থেকেই চিনতো। জয়ই উনার সাথে স্পৃহার পরিচয় করিয়ে দেয়। প্রথম কয়েকদিন ইনিই স্পৃহাকে বাসায় পৌঁছে দিয়েছে। লোকটা মিশুক প্রকৃতির। মা ডেকে একমুহূর্তে সবাইকে আপন করে নেয়। স্পৃহাও উনাকে নিজের চাচার মতই সম্মান করে।
জীবন কোত্থেকে এসে লাফিয়ে চলতি রিকশায় উঠে পড়ে। স্পৃহার পাশে বসে হাঁপাতে হাঁপাতে বলল,
'কখন থেকে তোমার পেছনে দৌড়াচ্ছি। এতো ডাকলাম, তুমি একটা ডাকও শুনলে না?'
স্পৃহা চোখ বড় বড় করে বলল,
'আপনি কোত্থেকে এলেন? '
জীবন ফোন রাখতে রাখতে স্পৃহা বের হয়ে গিয়েছিল। সে পেছনে তাকিয়ে স্পৃহাকে ডাকার আগে স্পৃহা রিকশায় উঠে পড়ে। তখন জীবন স্পৃহার রিকশার পেছনে দৌঁড়ে আসে। কিন্তু ততক্ষনে ওরা অনেক দূরে চলে আসে। 
'তোমাকে নিতে এসেছিলাম। কিন্তু আমি ফোনে কথা বলতে বলতে তুমি রিকশা নিয়ে নিলে। তাই আমাকে এতটা রাস্তা দৌড়াতে হলো।'
'আপনি গাড়ি নিয়ে আসেন নি? গাড়ি থাকতে দৌড়াতে গেলেন কেন?'
জীবন জিহবায় কামড় দিয়ে বলল,
'সত্যিই তো।'
এতক্ষণে রিকশাওয়ালা চাচা পেছনে ফিরে তাকালো। জীবনকে দেখে তিনি বললেন, 
'এই তুমি কে? হঠাৎ কইরা দৌড়াইয়া রিকশায় উঠে পরলা!'
'চাচা রাগ করবেন না। আমি ওর হাজবেন্ড। মিসেসকে ধরার জন্যই আমার এই অবস্থা।'
রিকশাওয়ালা চাচা স্পৃহা দিকে ফিরে বলল,
'তোমার বিয়া হইয়া গেছে? '
স্পৃহা মাথা নেড়ে "হুম" বললো। জীবন উনাকে বলল,
'চাচা রিকশা ঘুরিয়ে ভার্সিটি গেটে ফিরে যান। ওখানে আমার গাড়ি ধার করানো আছে।'
ফিরতে ফিরতে চাচা আর জীবন অনেক কথা বললো। ওদের প্রায় অর্ধেক কথাই হলো স্পৃহাকে নিয়ে। স্পৃহা ওদের মাঝে কোনো কথা না বলে চুপচাপ শুধু ওদের কথা শুনলো। গাড়ির কাছে নেমে জীবন ভাড়া দিতে চাইলে উনি প্রথমে নিতে চান নি। জীবন জোর করে উনার শার্টের পেকেট টাকা গুঁজে দিয়ে বলল,
'অন্য কোনো দিন নাহয় ফ্রিতে আপনার রিকশায় ঘুরবো। কিন্তু আজ টাকা নিতেই হবে।'

জীবন তার চেয়ারে বসে একটা ফাইল দেখছিল।
'আসবো স্যার?'
'আসুন।'
জীবন ফাইলে চোখ রেখেই বলল,
'বসুন।'
রায়হান জীবনের সামনে বসে বলল,
'স্যার আপনি কি ব্যস্ত?'
জীবন ফাইলটা পাশে রেখে রায়হানের দিকে চেয়ে বলল,
'না। বলুন কি বলবেন। '
রায়হান একটু ইতস্তত করে বলল,
'স্যার আসলে 
'আরে রায়হান সাহেব বলুন তো। আমার সাথে কথা বলতে আপনার ফর্মালিটি মেইনটেইন করতে হবে না। আপনি সরাসরি বলতে পারেন।'
'স্যার আমার বড় ভাইয়া ভাবীর বিয়ের দশ বছর পর সন্তান হয়েছে। তার জন্যই বাড়িতে ছোটখাট একটা অনুষ্ঠান করা হবে। আর আমার প্রমোশনের জন্যও। আমার বাবা মা চাইছেন আপনিও যেন যান। ভাইয়া নিজেই আপনাকে বলতে আসছিল। আমিই বারণ করেছি।'
'রায়হান সাহেব আপনাদের ফ্যামিলি প্রোগ্রামে আমি! মানে ব্যাপারটা অন্য রকম লাগবে না?'
'না স্যার। আপনি গেলে সবাই খুশি হবে। আমার কাছে আপনিও আমার ফ্যামিলি মেম্বারই। সেই অধিকার নিয়েই আপনার কাছে এসেছিলাম। আপনি গেলে আমিও অনেক খুশি হতাম।'
'আচ্ছা দেখি। যদি কোনো ইম্পর্টেন্ট মিটিং না থাকে তাহলে যাব।'
'অনুষ্ঠান রাতে হবে স্যার। আপনি অবশ্যই ম্যামকে নিয়ে আসবেন।'
'ওহ। রাতে তাহলে আসা যাবে। কিন্তু আপনার ম্যাম আসবে কিনা,,,
'স্যার আপনি বললে উনি না করবেন না।'
'ওকে। আমরা আসবো।'
'তাহলে স্যার আমি এখন আসি। অফিসে আমার কাজ আছে।'
রায়হান চলে যাচ্ছিল জীবন ডেকে বলল,
'রায়হান সাহেব আপনার ভাইয়া বেবি মেয়ে?'
'জি স্যার।'
রায়হান চলে গেলে জীবন চেয়ার থেকে উঠে দাঁড়িয়ে বলল,
'রায়হান সাহেব আপনি আমার কাজটা একটু সহজ করে দিলেন। আমাকে আর কাঠখড় পুড়িয়ে নিজে থেকে কিছু করতে হবে না। ধন্যবাদ আপনাকে।'
জীবন ঠোঁট বাকিয়ে ভিলেন স্টাইলে হাসলো।

দু'দিন পর, 
আজ ছুটির দিন। জীবন সকাল থেকে বাসায়ই আছে। স্পৃহা ঘর গোছাচ্ছিল। জীবন এসে বলল,
'স্পৃহা চলো।'
'কোথায় যাব?'
'একটু বাইরে বের হবো।'
'কেন? '
জীবন এবার হালকা বিরক্ত হয়ে বলল,
'আহ স্পৃহা! তুমি আজকাল অনেক প্রশ্ন করো। বলেছি বের হবো। সামান্য কেনাকাটা করে ফিরে আসবো।'
স্পৃহা জীবনের সামনে দিয়ে গিয়ে বেডে রাখা কাপড় গুলো হাতে নিয়ে বলল,
'আজ আমার অনেক কাজ আছে। এই সব গুলো কাপড় ধুঁতে হবে। আপনি বাসায় আছেন, দুপুরের জন্য রান্না করতে হবে।'
স্পৃহা যেতে নিলে জীবন তাকে ধরে হাত থেকে কাপড় গুলো রেখে বলল,
'কোনো কাজ করতে হবে না। তুমি আগে আমার সাথে চলো।'
'হঠাৎ কি পাগলামি শুরু করলেন বলেন তো? আজ আবার কার জন্য কেনাকাটা করবেন? আপনি তো সপ্তাহে সপ্তাহে এটা ওটা কিনতেই থাকেন।'
'ধুর।'
জীবন স্পৃহা হাত ধরে তাকে টেনে নিয়ে গেল। নয়তো স্পৃহা কথা বলতেই থাকতো। 
শপিংমলে গিয়ে জীবন স্পৃহাকে মেয়ে বাবুদের সব ড্রেস পছন্দ করতে বলল। স্পৃহা সবার সামনে জীবনকে কিছু জিজ্ঞেসও করতে পারছে না। সে নিজে নিজেই বিরবির করছে, 
'লোকটা পাগল হয়ে গেল নাকি? বাচ্চাদের কাপড় উনি কাকে পরাবেন? নিজে তো ছেলে। মেয়ে বাবুদের কাপড় আমার জন্য নিচ্ছেন নাকি? দূর কি সব ভাবছি আমি। হায় হায় উনি আমাদের বাচ্চার জন্য আগে থেকেই ড্রেস কিনে রাখছেন না তো? কিন্তু আমাদের বাচ্চাই বা কোথায় থেকে আসবে। ওহ বুঝেছি, উনি রামিম ভাইয়ার বাবুর জন্য এগুলো নিচ্ছেন। আমিও না সত্যিই একটা ভেবলি। মাঝে মাঝে কি যে ভাবি নিজেই জানি না।'
জীবন স্পৃহাকে ধাক্কা দিয়ে বলল,
'নিজের সাথে পরেও কথা বলতে পারবে। আগে ড্রেস চোজ করো।'
স্পৃহার পছন্দমতোই সবকিছু কেনা হয়েছে। চোখের সামনে এতো এতো ড্রেস দেখে স্পৃহার যেন মাথাই খারাপ হয়ে গিয়েছিল। সে তো জীবনকে বলেও ফেলেছে, 
'শুনুন না, এখানে যত ড্রেস আছে সব নিয়ে নিই?'
জীবন চোখ মুখ খিচে এমন ভাবে স্পৃহার দিকে তাকালো। স্পৃহা ভয়ই পেয়ে গেছিল। আমতা আমতা করে সে বলল,
'না মানে সবগুলোই তো সমান সুন্দর। কোনটা রেখে কোনটা নিব বুঝতে পারছি না।'
জীবন উত্তরে তার কানের কাছে মুখ নিয়ে বলল,
'এখনই এই অবস্থা হচ্ছে, নিজের বাচ্চার জন্য যখন ড্রেস নিতে আসবে তখন কি করবে? তোমার জন্য কি পুরো মল কিনে নিব? এতো টাকা কিন্তু আমার এখনো হয়নি।'
লজ্জায় স্পৃহা লাল হয়ে যাচ্ছিল। জীবন হঠাৎ মুখ ফসকে কি বলে ফেলেছে তা সে নিজেও বুঝতে পারেনি। দু'জনই লজ্জায় আর একে অপরের দিকে তাকাতে পারেনি। স্পৃহা গাড়িতে জীবনের পাশে বসে আছে। কিন্তু সে জীবনের দিকে তাকাচ্ছে না। কথাও বলছে না। জীবন এমন কিছু বলে বোকা হয়ে গেল।
'এটা কি বললাম আমি? জীবন তুই কি ছাগল? ছাগল না হলে ছাগল মার্কা কথা তোর মুখ দিয়ে বের হলো কীভাবে? নিজেদের বাচ্চার চিন্তা করছিস। ডাফার একটা। না জানি স্পৃহা কি ভাবছে।'

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন