পরাণ প্রিয়া - পর্ব ১০ - রাবেয়া সুলতানা - ধারাবাহিক গল্প


__নিবিড় আস্তে আস্তে মুখ কানের কাছে এগিয়ে নিতেই,ছোটো ভাইজান, আপনারে খালাম্মা,,,,, বলেই শেফালী নিচের দিকে তাকিয়ে আছে।এইভাবে আচমকা আসাটা তাঁর উচিত হয়নি ভেবেই নিচের দিকে তাকিয়ে আছে লজ্জা কিংবা ভয়ে।
নিবিড় প্রিয়াতার থেকে মুখ সরিয়ে,তুমি যাও আমি আসছি।
শেফালী আর একমুহূর্তের জন্যও দাঁড়িয়ে না থেকে তড়িঘড়ি করে রুম থেকে বেরিয়ে গেলো।
প্রিয়তা আস্তে করে বললো,শেফালী আপা এখন কী ভাববে?আপনি মাঝে মাঝে কি যে করেন আমি বুজতেই পারি না।এইবার তো ছাড়ুন।মা আপনাকে ডাকছে।
নিবিড় গম্ভীরমুখে প্রিয়তাকে ছেড়ে প্যান্টের পকেটে হাত দিয়ে,কলেজে গিয়ে ওই ছেলেটার সাথে ওই ভাবে হাসি মুখে কথা বলার কি আছে? কি হয় ছেলেটা আপনার? তার সামানে দাঁত বত্রিশটা দেখিয়ে হাসতে হবে? 

-কি আজে বাজে কথা বলছেন? ওনি আমার কলিগ এই ছাড়া আর কিছুই না।
-হুম তা তো দেখেই আসছি নিজের চোখে।
-শুনুন, আমি আপনার মতো নয়।অফিসের পিএর সাথে বসে বসে প্রেম করবো।
-হোয়াট? 
-কেনো আপনি বুজতে পারছেন না?অবশ্য সত্যি কথা কেউই বুজতে পারে না।
-জাস্ট শাটাপ মিসেস প্রিয়তা।ও আমার পিএ হতে পারে কিন্তু আগে আমার ভালোবাসার মানুষ। পিএ হওয়ার আগে থেকেই ওকে আমি ভালোবাসি। 
-তাহলে বিয়ে করে ফেলতেন। পিএ করতে গেলেন কেনো।তখন যদি বিয়ে করতেন আজ আর এইদিন না আমাকে দেখতে হতো না আপনাকে।
কথাটা বলেই প্রিয়তা রুম থেকে বেরিয়ে গেলো।

সালমা বেগম বসে পেপার পড়ছেন।প্রিয়তাকে আসতে দেখে,কিরে তুই একা এলি নিবিড় কোথায়? 
প্রিয়তা কিছু না বলে,শেফালী আপা এককাপ চা দাও।
এমন সময় নিবিড় এসে সোফায় বসতে বসতে, শেফালী আপা আমায় এক কাপ কফি দাও।
মা,তুমি ডেকেছো আমায়?
-হু।
-কি বলবে বলো। আমার অফিসে যেতে হবে।তনুসা মেয়ে হয়েও আমার সব দিক সামলে নিচ্ছে।
-হু,সেটা তো দেখছি।
শেফালী এসে নিবিড়কে কফি আর প্রিয়তাকে চা দিয়ে চলে গেলো।
নিবিড় কফির কাপে চুমুক দেওয়া মাত্রই সালমা বেগম বললেন, আমি এই বছরই নাতি বা নাতনি চাই।ঘরটা ফাঁকা ফাঁকা হয়ে আছে।
কথাটা বলতেই নিবিড় ফুড়ুৎ করে মুখ থেকে কফি বের করে, মা তোমার মাথা ঠিক আছে?
-আমার মাথা একদম ঠিক আছে।
প্রিয়তা তুই কিছু বলছিস না কেনো?

প্রিয়তা মুচকি হেসে মনে মনে ভাবছে, রাক্ষসটাকে দেখাচ্ছি মজা।আমাকে তখন ভয় লাগানো? এইবার টের পাবেন।
-মা আমিও কিন্তু তাই ভাবছি।আমাদের ঘরে ছোটো একটা বেবির দরকার। মা আপনি জানেন?  ওনাকে আমি একি কথা বার বার বলছি কিন্তু ওনি আমার কোনো কথায় শুনছেন না।উল্টো বলে এই ঘরে নাকি বেবির দরকার নেই। 

নিবিড় অবাক হয়ে,কিহ্ এই কথা আমি তোমাকে কখন বলেছি প্রিয়তা।আমিও চাই আমাদের একটা বেবি আসুক।
নিবিড় শেষের কথাটা দাঁতের সাথে দাঁত লাগিয়ে বলে, মা তুমি যা ভালো মনে করো এই বাড়িতে তাই হবে।বাবি নিশ্চয়ই আসবে। 
কথাটা প্রিয়াতার দিকে তাকিয়েই বললো। 

প্রিয়তা মনে মনে ভাবছে, আল্লাহ ভালো জানে,রুমে গেলে আবার কি করে বসে।হনুমানটার কোনো বিশ্বাস নেই।ওনাকে যে করেই হোক এখন অফিসে পাঠাতে হবে।
প্রিয়তা মৃদু গলায় বললো, আপনি অফিসে যাবেন না?
যান,ওইখানে আপনার জন্য তনুসা অপেক্ষা করছে।

-মা আর কিছু বলবে?
-হু,
-বলো।
-নাদিয়ার একটা খবর নেয়ে দেখবি? মেয়েটার কথা বড্ড বেশি মনে পড়ে এখন। কোথায় আছে কী করছে।আমি জানি বাবা তোর কাছে নাদিয়ার খবরটা নেওয়া কোনো ব্যাপার নয়।তবুও তুই খবর নিচ্ছিস না।আমি জানি বাবা তোরও খুব কষ্ট হয়।কারণ পৃথিবীর সকল ভালোবাসা থেকে তোদের ভালোবাসা যে আলাদা। তুই নাদিয়ার কোনো কষ্ট সহ্য করতে পারতি না।নাদিয়াও ছিলো একি রকম।

নিবিড় নিরব স্থিতিশীল মুক্তির মতো গম্ভীর হয়ে বসে আছে।চোখ দুটো টলমল করছে।প্রিয়তা অবাক হয়ে ভ্রু কুঁচকে সালমা বেগমের দিকে তাকিয়ে, মা, নাদিয়া কে? নাদিয়ার সম্পর্ক কি তোমাদের সাথে?

সালমা বেগমের চোখ থেকে কয়েক ফোটা নোনা জল গড়িয়ে পড়তেই মুছে নিলো।প্রিয়তার দিকে তাকিয়ে,আমার বড় মেয়ে।নিবিড়েরও বড়।নিবিড় আর নাদিয়া পিঠাপিঠি ভাইবোন ছিলো।নাদিয়াকে কখনো বুজতেই দেয়নি নিবিড় তার ছোটো। সবসময় বড় ভাইয়ের মতো আগলে রেখেছে।হাজারও অন্যায় একনিমিষেই ক্ষমা করে দিয়েছে।কিন্তু নাদিয়া মস্ত বড়ো ভুল করেছিলো তো সেদিন যেদিন আমার দূর সম্পর্কের দেবরের ছেলেকে ভালোবেসে বিয়ে করে।
-তাহলে আপনারা মেনে নেননি কেনো মা? ভালোবাসা তো অন্যায় নয়।
কথাটা শুনে নিবিড় প্রিয়তার দিকে গম্ভীর হয়ে তাকিয়ে আছে।
-নারে মা,ভালোবাসা অন্যায় নয়।কিন্তু সে বিয়ে করার পরেই তো কোথায় গেছে আমরা কেউ জানি না।
-আপনারা ছেলের বাড়িতে খবর নেননি?
-দূর সম্পর্কের আত্মীয়, কখনো দেখাও হয়নি ওই ছেলেকে।তবে তোর বাবা ওদের বাড়ি চিনতো।কিন্তু ওনারা কেউ দেশে থাকেন না।বহু বছর আগে ওর বাবা মা মারা যায়।আর এক ভাই আছে ওরা দেশে নেই পুরো পরিবার নিয়ে মালেশিয়ায় থাকে।

-কিন্তু মা এইটা কেমন কথা,একটা মানুষ তো আর উধাও হয়ে যেতে পারে না।আপনারা খোঁজ নেননি কেনো?

-তোর বাবা তো রাগে দুঃখে স্টোক করেছিলো তখন। আর নিবিড়ও নিজের জেদের কাছে হারতে চায়নি।
কথাটা বলে দীর্ঘ শ্বাস ফেললো সালমা বেগম।

নিবিড় কিছু না বলেই নিজের রুমে চলে গেলো।সালমা বেগম তাঁর পুরনো ক্ষতটাতে আবার উতলিয়ে দিয়েছে।রুমে এসে বারান্দার গ্রিল ধরে দাঁড়িয়ে গম্ভীর হয়ে বাহিরের দিকটা দেখছে।

প্রিয়তাও পিছন পিছন এসে পিছনে দাঁড়িয়ে, স্যরি মিস্টার নিবিড়, আসলে আমি মজা করতে গিয়ে আপনার এতোটা লাগবে আমি বুজতে পারিনি।আসলে জানেন আমার কোনো ভাই নেই তাই আমি বুজি ভাইয়ের অভাবটা কতখানি। 

নিবিড় স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে আছে।

মিস্টার নিবিড় আমি একটা কথা বলবো? আপনি আপুকে খুঁজে নিয়ে আসুন।আমি জানি আপনি পারবেন।আপনার অসাধ্যের কিছু নেই।আপনি ভিতরে ভিতরে কষ্ট পেয়ে নিজেকে শেষ করে দিচ্ছেন কেনো?
আপনি আপুকে নিয়ে আসলে এই ঘরটা পরিপূর্ণ হবে।আপুর নিশ্চয়ই এখন ছেলে মেয়ে সব আছে।আপুর ছোটো ছোটো বেবি গুলো আসলে আপনাকে আর বেবির জন্য মায়ের কাছ থেকে কথা শুনতে হবে না।আমাদের দেড় বছর এমনিই কাটিয়ে দিতে পারবো।

নিবিড় গ্রিল থেকে হাত ছাড়িয়ে প্রিয়তার দিকে রাগন্বিত চোখে তাকিয়ে প্যান্টের পকেটে হাত দিয়ে, আর কিছু বলার আছে?না থাকলে এইখান থেকে যান।

-মিস্টার নিবিড় আপনি আমার কথাটা ভেবে দেখুন।আপনি চাইলে আপুকে নিয়ে আসতে পারেন।
ভাইবোনের ভালোবাসা কখনো আরেকটা ভালোবাসা আটকাতে পারে না।

-গেটআউট, আউট। 
প্রিয়তা কিছু বলতে যেতেই নিবিড় ধমকিয়ে, আউট। আপনাকে বললাম না,আমার সামনে বেশি আসবেন না? আপনি কেনো বুজেন না আপনাকে দেখলে আমার অসহ্য হয়।আমার দম বন্ধ হয়ে আসে।প্লিজ যান এইখান থেকে।
প্রিয়তা কিছু বললো না।বারান্দা থেকে দৌড়ে চলে এলো।

প্রিয়তা রান্নাঘরে শেফালীর সাথে হাত লাগিয়ে সব রান্না সেরে নিলো।সালমা বেগমের মন ভালো নেই সকালের ঘটনাটার পর থেকে।প্রিয়তা ভেবেই নিয়েছে যেই করে হোক বাড়ির মেয়ে বাড়িতেই ফিরিয়ে নিয়ে আসবে।মিস্টার নিবিড়কে আবার রাতে ভালোভাবে বুজিয়ে বললে হয়তো রাগ করে থাকবেন না।ওনি যতই আমার উপর রাগ দেখাক না কেনো মনটা এতোটাই খারাপ নয়।হয়তো অজানা কষ্ট ওনাকে চেপে আছে।

কলিং বেলের শব্দ শুনে প্রিয়তা গিয়ে দরজা খুলে তনুসাকে দেখে,আপনি?
-কেনো আমি কী এইবাড়িতে আসতে পারি না?
-আমি তা বলিনি।আসুন ভিতরে আসুন।
তনুসা ভিতরে আসতে আসতে, স্যার কোথায়? 
-আপনি বসুন ওনি গোসলে গিয়েছেন।
তনুসা বসতে বসতে, আচ্ছা বাড়ির বাকীরা কোথায় কাউকে দেখছিনা!
-মাও গোসল করছেন।বাবা কয়েকদিনের জন্য গ্রামের বাড়িতে গিয়েছে।আর জুহিতো কলেজে।
-ওহ্ আচ্ছা!
কথাটা বলে প্রিয়তা নিজের রুমের দিকে যেতেই, মাঝ পথে প্রিয়তা ডাকটা শুনে থমকে দাঁড়িয়ে পিছনে ফিরে দেখে তনুসা বুকে হাত বেঁধে দাঁড়িয়ে আছে।
-কিছু বলবেন?
-স্যার তোমাকে কিছু বলেনি?
প্রিয়তা একটু অবাক হওয়ার ভান করে,কোন ব্যাপারে? 
-প্রিয়তা আমি ন্যাকামি একদম পছন্দ করি না।স্যার তো তোমাকে ডিভোর্স দেওয়ার কথা।ইমপ্যাক্ট আমার ব্যাপারে তোমাকে সব বলারও কথা!
-প্রিয়তা আস্তে আস্তে এগিয়ে এসে,আপনার লজ্জা করে না এইসব বলতে? একজনের স্ত্রী থাকা শর্তেও আপনি তাকে নিয়ে ভাবছেন।আপনি তাকে জোর করছেন তাঁর স্ত্রীকে ডিভোর্স দেওয়ার জন্য।এইটা কী ঠিক হচ্ছে?
-শাটাপ।তুমিই আমাদের মাঝখানে এসে পড়েছো।আমাদের মাঝে এসে এখন আবার আমাকেই কথা শুনাচ্ছো?

-তনুসা আপনি জানেন না,স্ত্রীর ক্ষমতা কতটা। ভালোবাসলেই স্ত্রী হওয়া যায় না।স্বামীর ভালোবাসা যতটা পবিত্র প্রেমিকের ভালোবাসা ততটাই নোংরা। 
স্বামীর চোখে স্ত্রীর জন্য যে ভালোবাসা থাকে সেটা চিরন্তন। আর প্রেমিকের ভালোবাসা মোহ কেটে গেলেই আপনাকে রাস্তার পতিতাদের সাথে তুলনা করতেও সময় নিবে না।

তনুসা রাগে সাপের মতো ফসফস করতে করতে,শাটাপ প্রিয়তা,তুমি তোমার লিমিট ছেড়ে যাচ্ছো।তুমি জানো স্যার জানলে তোমার অবস্থা কী হতে পারে?

-কথায় কথায় দুই একটা ইংরাজী আমিও বলতে পারি তনুসা।আর আমার লিমিট কতখানি তা আমার ভালো করেই জানা আছে।তবে তোমার জানা নাই তুমি তোমার অফিসের বসের ওয়াইফকে অপমান করছো।তাঁর জন্য তোমার অবস্থাটা কী হতে পারে চিন্তা করেছো?এইটা তোমার অফিস নয় তোমার ছলনা দিয়ে আমার স্বামীকে ভুলিয়ে রাখবে।এইটা আমার বাড়ি।এইখানে তোমার আইন নয় আমার আইন চলবে।তোমাকে সম্মান দিয়ে আপনি বলে সম্মান দিয়েছিলাম কিন্তু আর না।বাড়িতে যেহেতু এসেছো খেয়ে যাবে।এখন যদি যাও সারাজীবনের জন্য তোমার স্যারের কাছ থেকে চলে যাবে।কথাটা বলেই প্রিয়তা রুমে গিয়ে দরজা আটকিয়ে হাঁপাতে হাঁপাতে প্রিয়তা তুই ছিলি তখন ওই তনুসার সামনে? আমি তো ভাবতেই পারছি না।তুই তনুসাকে এতোগুলো কথা শুনিয়ে দিবি।নিজেকে নিজে কথাগুলো বলেছে প্রিয়তা।
আচ্ছা আমাকে জীনে ধরলো না তো।ড্রেসিংটেবিলের সামনে দাঁড়িয়ে না তো আমি তো ঠিক আছি।তাহলে তখন তনুসাকে কথাগুলো কীভাবে বললাম?
নাকি আমি স্বপ্নে ছিলাম? 
 নিজের শরীরে নিজে চিমটি কেটে এইতো দেখি সব ঠিক আছে।তার মানে প্রিয়তার স্বামীর জন্য প্রিয়তা রাগতেও পারে? আমি কী ওনাকে ভালোবেসে ফেলেছি? যার কারণে তনুসাকে একচুলও ছাড় দিতে চাইনি।

-কেউ আছো?আমাকে খাটের উপর থেকে তোয়ালেটা দিয়ে যাও।

প্রিয়তা নিবিড়ের কথা শুনে,তোয়ালেটা নিয়ে এগিয়ে ওয়াসরুমের দরজায় গিয়ে,এই নিন!
-আপনি ছাড়া কী বাড়িতে কেউ নেই নাকি?
-আছে তবে এইরুমে নেই।
কথাটা বলেই প্রিয়তা পা ঘুরিয়ে আসতেই পানিতে স্লিপ খেয়ে পড়তেই নিবিড় পিছন থেকে ধরে,সমস্যা কি আপনার?  সিনেমার নাইকাদের মতো হাঁটতেও হেলেদুলে এসে সেই আমার গায়েই পড়েন।

-আমি পড়ে যাই তাতে আপনার কি? আপনাকে আমি ধরতে বলেছি? 
কথাটা বলতেই নিবিড় প্রিয়তাকে হাত থেকে ছেড়ে দিতেই মাটিতে পড়ে যায়।নিবিড় পিছনে ফিরে না তাকিয়ে রুমে চলে আসে।
-আরে আপনি এইটা কী করলে?আমাকে ফেলে দিলেন?আমি আপনার কোন বাড়া ভাতে ছাই দিয়েছি বলুন তো।কথাটা বলে প্রিয়তা নিজে নিজে উঠে দাঁড়িয়ে, বিড়বিড় করে,হনুমান কোথাকার। 
নিবিড়ের যেনো প্রিয়তার কোনো কথায় কানে যাচ্ছে না।তোয়ালে দিয়ে চুল মুছে নিয়ে রেডি হয়ে রুম থেকে বেরিয়ে গেলো।

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন