প্রেমবিলাস - পর্ব ১১ - আরিশান নূর - ধারাবাহিক গল্প


এভাবেই সময় কাটতে লাগলো। শ্রাবণ আর বাসা থেকে বের হয় না। শ্রাবণ বুঝতে পারছে আবারো ভয়ংকর সেই ব্যাধির কাছে ধরা খেতে হবে তাকে৷ এই ব্যাধির সাথে লুকাচুরি খেলায় সে জিতবে না। পরিত্রান ও পাবে না সে। 

আলিয়া সেদিন চলে যাওয়ার পর তিন বার তার সাথে ফোনে কথা হয়েছে৷ তিন বারে মোট এগারো মিনিট কথা হয়েছে৷ প্রথম দিন পাচ মিনিটের মতো কথা হলো। এরপর বাকি দুইদিন তিন মিনিট করে করে৷ 

আলিয়ার সাথে তেমন গভীর কথা হয় নি। সোনা দাদিকে নিয়ে আলিয়া টেলি চিকিৎসা দিয়েছে৷ দাদির অবস্থা খুব খারাপ। আলিয়া একবার এসে দেখা করে যেতে চাচ্ছে কিন্তু সময়ের অভাবে পারছে না। 

শ্রাবণ বিছানায় শুয়ে আছে৷ সন্ধ্যা হয়ে গেছে। ছয়টা বাজে। ছোট দিনের বেলায় ছয়টা মানে অনেক বেলা! মশার ভন ভন আওয়াজে অতিষ্ঠ শ্রাবণ। এইখানে মশার খুব উপদ্রব। তার শরীরটা গরম করেছে৷ মনে হয় ভিতর দিয়ে জ্বর যাচ্ছে৷ 

হুট করে পাশের রুম মানে সোনা দাদির রুম থেকে গোঙ্গানোর শব্দ ভেসে উঠল। শ্রাবণ দেরি না করে উঠে বসল। তার গা কাপছে৷ এই রুম থেকে পাশের রুম যেতে মনে হচ্ছে মাঈল পার করতে হবে। শ্রাবণের পা অসার হয়ে আসছে। সে কষ্ট করে এক পা, দুই পা আগাচ্ছে৷ 

রুমের পর্দা টেনে অপর রুমে যেতেই হুট করে কারেন্ট চলে গেল। শ্রাবণ চমকে উঠে। বাকি দৃশ্য তার জানা৷ কিন্তু সে চায় না এটা হোক। কিন্তু সে নিরুপায়। 

দাদির আর্তনাদের শব্দ ভেসে আসছে শ্রাবণের কানে। সে দুর্বল গলায় বলে, শ্রাবণ রে আমি মনে হয় না আর বাচব! 

শ্রাবণ আরেক দফা চমক খায়। দাদি কেমনে জানল সে বাচবে না? সে ও কি ভবিষ্যৎ দেখতে পায়? শ্রাবণ ঘামতে লাগল। প্রচুর পানির পিপাসা পেয়েছে তার! 

শ্রাবণ মাথায় হাত দিয়ে নিজের চুল নিজেই টানতে থাকে। তার খুব কষ্ট হচ্ছে! এ কষ্ট, যন্ত্রণার উৎপত্তিস্থল হলো মন! 

দাদি হাসফাস করতে করতে বলে, বাবা রে,,,কলেমা টা একটু বল শুনি,,,,,,মরার আগে কালেমা শুনি। 

শ্রাবণের গলা দিয়ে কথা বের হচ্ছে না। চোখ দিয়ে টপটপ করে পানি পড়ছে। সে অনেক কষ্ট করে বলে, লা ইলাহা ইল্লাল্লাহু মুহাম্মাদুর রাসুলুল্লাহ( সাঃ)। 

এই এক লাইন বলতেই শ্রাবণের জান যায় যায় অবস্থা! 

শ্রাবণ টর্চ লাইট জ্বালালো। তারপর দাদির কাছে গিয়ে বসল৷ দাদির মাথায় পাশে বসে বলে, ঔষধ আনব? 

--না রে,,,,,পানি খাব। পানি দে একটু৷ 

শ্রাবণ চোখ বুজে ফেলে। সে জানে দাদির পানি খাওয়া হবে না। শ্রাবণ কিছু কিছু ব্যাপার আগেই ধারণা করতে পারে! 

সে উঠে দাড়ালো এবং টেবিলের কাছে গিয়ে জগ থেকে পানি ঢালনো। তখনি লাইটের ব্যাটারি এক্সপায়ার হয়ে যায় এবং ধপ করে নিভে গেল৷ 

শ্রাবণ ছোট্ট করে একটা আর্তনাদ শুনল। পেছন ঘুরে তাকাতেই কেপে উঠে সে। কেমন গা ছমছমে ভাব। রুমটাতে শোকের ছায়া নেমে পড়েছে। রুমের জড়বস্তু গুলো কি বুঝে গেছে এই রুমেত মালিক আর নেই!

শ্রাবণের হাত থেকে সিসার গ্লাসটা পড়ে যায়। সে হাটু গেড়ে বসে কান্না করতে লাগলো আর বিড়বিড় করে বলে, আমাকেই কেন এসব দেখতে হয়? আমি কেন অন্যদের মতো নই? 

কারেন্ট চলে আসল। শ্রাবণের মাথা তোলার সাহস হচ্ছে না। তবুও সে মাথা তুলল। সোনা দাদি বিছানায় গা ছেড়ে দিয়ে শুয়ে আছে। মুখ দিয়ে ফেনা পড়ছে আর মুখটা একটু হা করে খোলা৷ 

মুখ খোলা দেখেই শ্রাবণ বুঝে যায় সে ওইদিন ভুল দেখেনি। দাদি সত্যি আর নেই৷ 

শ্রাবণ একটা বিকট চিৎকার দেয়। সেই চিৎকার ছোট বাড়িটার বাইরে শো শো করে চলে৷ 

কিছুক্ষনের মধ্যে ই প্রতিবেশী রা চলে আসল। শ্রাবণ মেঝেতে বসে থাকে। বাত্ এশায় দাদির কবর দেওয়া হয়। দাদির কেউ নেই জন্য আর প্রতিবেশী রা দেরি করেনি। সঙ্গে সঙ্গে দাফন কার্য করে ফেলে। শ্রাবণ ও মসজিদে গিয়েছিল। জানাজার নামাজ ও পড়েছে৷ 

তারপর আবারো কুঞ্জি ভিলায় চলে আসে। নিজের রুমে গিয়ে শুয়ে পড়ে। প্রচন্ড খারাপ লাগছে তার। মাথায় খুব ব্যথা করছে। মনে হচ্ছে গলা থেকে মাথাটা কেটে ফেললে সে শান্তি পাবে। বাইরে হীম শীতল হাওয়া বইছে৷ শ্রাবণ চোখ বন্ধ করে ছিল। হুট করে চোখ খুলে এবং উঠে বসে৷ 

তারপর আশেপাশে তাকিয়ে কিছু একটা খুজতে লাগে। আস্তে আস্তে শ্রাবণেত মুখের রঙ বদলাচ্ছে। কিছুটা লাল বর্ণ ধারন করছে। চোখ ও লাল হতে লাগলো। শ্রাবণ তার চুল টেনে ধরে। এতো জোড়ে টেনে ধরে যে হাতের মধ্যে কয়েকটা চুল এসে পড়েছে৷ 

শ্রাবণ বিকট জোড়ে তিন তিনবার চিৎকার দিল৷ তারপর আশেপাশের সব কিছু ভাংচুর করতে লাগলো। এই মূহুর্তে শ্রাবণের মায়া মায়া চেহারায় হিংস্রতা বিরাজ করছে । 

★★★

তিন দিন ধরে শ্রাবণের সাথে আলিয়ার কোন যোগাযোগ নেই। আলিয়া দিনের বেশির ভাগ সময় শ্রাবণ কে কল দিতে দিতে কাটিয়ে দিচ্ছে৷ ওপাশ থেকে রিং হতে হতে ফোন আপনা-আপনি থেমে যায়। প্রতিবার ই আলিয়া আশায় থাকে এইবার ফোন ধরবে শ্রাবণ । কিন্তু ইজ এন্ড এভ্রি টাইম তাকে হতাশ হতে হচ্ছে। 

শ্রাবণের সাথে এগারো মিনিট কথা বলেই আলিয়া যে তার প্রতি দুর্বল হয়ে পড়েছে তা আলিয়ার মতো বুদ্ধিমতী মেয়ে দিব্যি টের পাচ্ছে। কিন্তু শ্রাবণ অসুস্থ! সিজোফ্রেনিয়া খুবই ভয়ংকর মানসিক ব্যাধি। মানসিক অসুখের অনেক স্টেপ আছে। এর মধ্যে সিজোফ্রেনিয়া খুবই ভয়াবহ। রোগীর সুস্থ হওয়ার চান্স যে কতো শতাংশ এটা কেউ বুঝতে পারেনা। সেই সাথে রোগীর শরীরে ব্রেইম টুইমারের মতো ভংকর অসুখ ও বহন করতে পারে। মনের সাথে শরীরের মিল ওতপ্রোতভাবে। মন ভালো থাকলে শরীর আর মন অসুস্থ থাকলে শরীর ও আস্তে আস্তে অচল হতে শুরু করে। 

আলিয়া ফোন হাতে বারান্দায় দাঁড়িয়ে আছে। শ্রাবণের ফোন ধরার অপেক্ষায় ছিল সে৷ কিন্তু শ্রাবণ ফোন ধরেনি। আলিয়ার চোখ বেয়ে এক ফোটা অবান্তর অশ্রু পড়ল। 

হুট করে ফোন বাজায় আলিয়া প্রথমে কেপে উঠলেও পর মূহুর্তে উত্তেজিত হয়ে যায়। শ্রাবণ কল করেছে কি? 

সে মোবাইলের স্ক্রিনটা চোখের সামনে আনল। না শ্রাবণ কল দেয় নি। কল দিয়েছে আয়ান। আলিয়া কল কেটে দিল। তার কিছুই ভালো লাগছে না। দুপুরে ভাত ও খায় নি সে। আলিয়া ঠিক করল সে কুঞ্জি ভিলা আবারো যাবে শ্রাবণ কে দেখতে। 

যেমন ভাবনা তেমন কাজ। আলিয়া রেডি হয়ে রওনা হলো। যাওয়ার পথে এক ধরনের অস্থিরতা কাজ করতে লাগলো তার। 

কুঞ্জি ভিলা পৌছাতেই মন খারাপেরা এসে তাকে ঘিরে ধরল। ১৮ নং বাসার সামনে যেতেই আবারো চোখ যায় গাছ তিনটার দিকে। 

সেকি! তিনটা গাছই কেউ ছিড়ে ফেলেছে। গোড়া গুলো পড়ে আছে শুধু । এই দৃশ্য দেখে আলিয়ার কেমন যেন লাগে। 

সে যেই না পা বাড়াবে ওমনি কেউ তার হাত খপ করে ধরে ফেলে। আলিয়া তাকিয়ে দেখে রুমানা (যাকে আলিয়া হাসপাতালে নিয়ে গিয়েছিল) 

--আপা এই বাসায় যাইয়েন না৷ (রুমানা ল

--কেন? 

--আর বইলেন না৷ পাগল আছে এই বাসায়। সামনেই গেলেই মার-ধর করে। বেধে রাখা হয়েছে। দুইদিন আগেও ভালো ছিল। পড়শু থেকে এমন উদ্ভট আচরণ করছে। 

আলিয়ার বুক হুহু করে উঠে। সে এক দৌড়ে বাসায় ভেতরে ঢুকে পড়ে। শ্রাবণ চেয়ারের সাথে বাধা। চারপাশে সব কিছু এলোমেলো হয়ে পড়ে আছে৷ ঘরে আলো নেই বললেই চলে। 

শ্রাবণের কপালে রক্ত জমাট বেঁধে শুকিয়ে গেছে৷ 

আলিয়া শ্রাবণের এই করুন দৃশ্য দেখে কেদে দেয়। 

সে দাদিকে খুজতে থাকে। কিন্তু বাসা ফাকা। হুট করে আলিয়া দরজার সাথে হোচট খায়। এতে কিছুটা শব্দ হয়। ফলে শ্রাবণ টের পেয়ে যায় কেউ এসেছে৷ 

সে চোখ তুলে আলিয়ার দিকে তাকালো। রক্তবর্ণ চোখ। আলিয়া শ্রাবণের চোখ দেখেই ভয় পেয়ে যায়। আতকে উঠে। এই শ্রাবণ তার অপরিচিত। 

শ্রাবণ আলিয়াকে দেখে অস্থিরতা শুরু করে। পাগলামি বেড়ে যায় তার। চেয়ারের সাথে দড়ির বাধনটা খুলে আলিয়ার দিকে ছুটে আসে। এবং আলিয়া কে সজোরে থাপ্পড় মারতে লাগে৷ একটা না দুইটা না পর পর আক্রমণ চালায়৷ 

আলিয়া স্তব্ধ হয়ে যায়। সে বুঝতে পারছে শ্রাবণ আবারো অসুস্থ হয়ে পড়েছে। শ্রাবণ আলিয়াকে ধাক্কা দিয়ে মেঝেতে ফেলে দেয়। এতে ভীষণ জোরে ব্যথা পায় আলিয়া। কপাল ফেটে এক-দুই ফোটা রক্ত গড়ালো তার। 

কিন্তু এতেও শান্ত হয় না শ্রাবণ। তারপর সে রুমের আসবাবপত্র ভাংচুর করতে লাগলো। বিকট শব্দ হতে লাগলো। শ্রাবণের মুখ দিয়েও শা শা শব্দ বের হচ্ছে। সম্ভবত নিশ্বাস নিতে কষ্ট হচ্ছে ওর।
আলিয়া উঠে দাড়ালো এবং শ্রাবণের কাছে গিয়ে বলে, শ্রাবণ প্লিজ শান্ত হও। 

এই কথা শুনে শ্রাবণ আরো রেগে গেল এবং আলিয়ার গলা চেপে ধরে! 

আলিয়া বাচার জন্য ছটফট করছে। ছোটাছুটি করছে৷ কিন্তু শ্রাবণের সাথে পেরে উঠতে পারছে না সে৷ 

হুট করে আলিয়ার চোখ গেল, শ্রাবণ আকা প্রেমবিলাস স্কেচটার দিকে। চেয়ারে নিচে পড়ে আছে। 

স্কেচটা কেউ মাঝখান দিয়ে ছিড়ে ফেলেছে,,,,,
আলিয়ার চোখ ঝাপসা হতে লাগলো। গলা দিয়ে উউ শব্দ বের হচ্ছে তার। নিশ্বাস আটকে গেছে,,
.
.
.
চলবে...........................

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন