অপরপাশ থেকে কোনো জবাব না পেয়ে বিরক্তির সাথে পেছনে ফিরে অর্জুন। পেছনে ফিরতেই যা দেখে তাতে বিরক্তি আরো ও বেড়ে যায়। পুনরায় দৃষ্টি বাহিরের দিকে স্থির করে সে। বিদ্রুপের স্বরে বলে,
- কি দেখতে এসেছো এখানে? আমি বেঁচে আছি কি না সেটা নাকি আমি অসহায় অবস্থার মজা দেখতে এসেছো।
- আপনাকে দেখতে এসেছি।
অন্নার উত্তর শুনে কোনো কথা বললো না অর্জুন। শুধু এক দৃষ্টিতে বাহিরে তাকিয়ে থাকলো। অন্না এখনো দরজার কাছেই দাঁড়িয়ে রইলো। আজ কলেজ ছুটি, বিকেলে কোচিং ছিলো অন্নার। কোচিং থেকে বাসায় যাবার পথে অর্জুনদাদের বাড়ি পড়ে। উঁচু চারতলা দালান। আজকাল ঢাকায় চারতালা দালান পাওয়াই দুষ্কর। এই দালানটা বেশ পুরোনো। তাই তো নতুনত্বের ছিটাফুটাও নেই। সিড়ি দিয়ে উঠে তিন তলায় অর্জুনের বাসা। অর্জুনের থেকে অনেক ছোট অন্না। মিতালীর উছিলা না পেলে হয়তো অর্জুনদাকে এক নজর দেখাও হতো না। কি করবে লোকটাকে দেখার জন্য মনটা বেহায়া হয়ে উঠেছে। খুব ভালো করে জানে তার উপস্তগিতিতে লোকটা খুশি হবে না। তবুও অন্না এই বেহায়াপনা কাজটা করলো। অর্জুন সিগারেটে সুখটান দিচ্ছে ঘন ঘন। অন্নার চাহনী যে তাকে আপাদমস্তক দেখছে এটা ভেবে খানিকটা বিরক্ত লাগছে অর্জুনের। দৃষ্টি বাহিরে রেখেই অর্জুন বললো,
- দেখা হয়ে গেলে, প্রস্থান নিতে পারো।
- দেখা হলে আমি নিজেই চলে যাবো।
বলেই এগিয়ে অর্জুনের কাছে এসে দাঁড়ালো অন্না। মেয়েটা দেখতে কৃষ্ণার মতো সুন্দরী নয়। তবে খুবই মায়াবী চেহারা। গোলগাল, চশমা পড়া মেয়েটাকে দেখলেই মন চায় গালটা খানিকটা টেনে দেই। দু পাশে ঘন কেশ দিয়ে ঝুটি করে রেখেছে আরোও মায়াবী এবং কিশোরীসুলভ লাগছে। অর্জুন তাই চেয়েও তাকে বকতে পারছে না। অবশ্য একজনের রাগটা অন্যের উপর দেওয়াটা হয়তো সুপুরুষের কাজ নয়। ঠান্ডা গলায় সে বলে উঠে,
- তোদের কি ভাই বোনের অভ্যাস এটা, একজন আঘাত দেয় তো অন্য জন এসে মলম লাগায়?
- দাদাভাই তোমাকে আঘাত দেয় নি অর্জুনদা, দাদাভাই কি করে জানতো বলো তুমি তার বিবাহিত স্ত্রীর প্রেমে মত্ত হবে। আমিও যে তোমাকে সাবধান করি নি তা কিন্তু নয়।
- ঠিক ই বলেছিলি তুই আগুন নিয়ে খেলতে খেলতে আজ আগুনেই পুড়ছি আমি।
- একটা উটকো প্রশ্ন করবো?
অন্নার এরুপ প্রশ্নে ভ্রুযুগল কুঞ্চিত করে অর্জুন তার দিকে তাকায়। অর্জুনের চাহনী দেখে ঠোঁট বিস্তৃত করে কোমল হাসি দেয় অন্না। তারপর বলে,
- ভষ্ম করে দিও না, প্রশ্নটা খুব সোজা "নৌকাডুবি" পড়েছো?
- হুম
- আচ্ছা বলতো, কবি কেনো রমেশের সাথে শেষকালে কমলার মিলখানা দেয় নি?
- কারণ রমেশ হেমনলিনীকে ভালোবাসতো, আর কমলা তো তার স্ত্রী নয়।
- প্রথমটি ঠিক নয়, দ্বিতীয়তটি ঠিক। রমেশ কমলাকে নিজের মনে ঠিক ঠায় দিয়েছিলো। কিন্তু ওইযে কমলা নলিনাক্ষের স্ত্রী ছিলো। চাইলে হয়তো তাকে নিজ স্ত্রী হিসেবে রেখে দেওয়া যেত। কিন্তু সেটা ধর্মে সইতো না। তোমার ক্ষেত্রেও ঠিক তাই, তুমি কৃষ্ণাকে ভালোবাসলেও বিয়েটা তার দাদাভাই এর সাথে হয়ে গিয়েছে। তাদের বিয়েটা আর পাঁচটা বিয়ের মতো নয়, তবুও বিয়েটা হয়েছে।
- দেবদা তো তাকে ভালোবাসে না, শুধু বিয়ের মিথ্যে জালে আটকে রেখেছে!
অর্জুনের কথায় অন্না হি হি করে হেসে দেয়। অন্নার হাসির ঝলকানি সারা ঘরে গুঞ্জছে। অবাক দৃষ্টিতে অর্জুন তার দিকে তাকিয়ে আছে। এবার মৃদু কন্ঠে সে বলে,
- ভুল জানো তুমি, দাদাভাই মনের এক কোনায় কৃষ্ণাবতীর মূর্তি স্থাপন করেছে। প্রতি সময়ে সেই মূর্তিকে পূজে সে। আর কৃষ্ণা সে তো তার মাষ্টারমশাই বলতে অজ্ঞান। তুমি তাদের মাঝে কেবলই তৃতীয় ব্যক্তি। অনেকটা সৌদামিনীর মতো। তার অবস্থা আরোও খারাপ৷ তাই আমি চাই তাদের মাঝে তৃতীয় জন হয়ে নিজেকে আর জ্বালিয়ো না।
- এই সব যুক্তি যে মন মানতে চায় না অন্না।
অর্জুনের স্বর কাঁপছে, কষ্ট হচ্ছে তার। এ যেনো অসহ্য যন্ত্রণা। পুরুষের কাঁদতে নেই, মেয়েদের সামনে তো নাই। তাই সে জলের স্রোত আটকে রাখছে। কিন্তু গলায় কষ্টগুলো কুন্ডলি পাকাচ্ছে। অন্না মলিন কন্ঠে বলে,
- জানি মন কোনো যুক্তি ই মানে না। বড্ড বেহায়া। তবে ক্ষতিটা কিন্তু আপনার। আজ এখানে কৃষ্ণা আসতে চেয়েছিলো। তার মনে অপরাধবোধ কাজ করছে। প্রতিনিয়ত এই অপরাধবোধের খোঁচায় খোঁচায় মেয়েটা নাজেহাল। ও চেয়েছিলো তোমার কাছে এসে তোমার পা ধরে ক্ষমা চাইবে। তোমার মনের কষ্ট না কি তার জীবনে অভিশাপের মতো কাজ করবে। আমি তাকে সেই কাজটা করতে দেই নি। আমার মনে হয়েছে এই কাজটা ভালো হবে না। শুধু শুধু তোমার ঘা তাজা হবে।
- তাই তার বদলে তুই এসেছিস আমার ঘা য়ে মলম দিতে?
- তোমার ঘায়ে মলম দেবার মতো ক্ষমতা আমার নেই। শুধু কথা কইতে এসেছি। কথা শেষে চলে যাবো। আর সত্যি বলতে আমিও চাই না তুমি কষ্ট পাও৷ তার দুটো কারণ রয়েছে। এক, আমি চাই কৃষ্ণা সুখী হোক। কম কষ্ট মেয়েটা এই সতেরো বছরে৷ তোমার কষ্টটা তার জীবনে অভিশাপ না হোক। আর দুই, সেটা তোমার না জানলেও হবে।
কথাটা বলে দীর্ঘশ্বাস ছাড়ে অন্না। এই দীর্ঘশ্বাসে আক্ষেপের প্রবল ছাপ রয়েছে। মনটা যে তারও বেহায়া। অর্জুনের মূর্তি সেও যে একটা কোনায় স্থাপন করেছে। প্রতিনিয়ত তাকে পূজে সে। এটা বয়েসের দোষ নাকি, কবি সাহিত্যিকের মতে ভালোবাসা সেটা জানার ইচ্ছে এই বেহায়া মনটার নেই। সে শুধু পাগলের মতো অর্জুনকে সুখী দেখতে চায়। হঠাৎ অর্জুনের প্রশ্নে স্বম্বিত ফিরে অন্নার।
- বয়স কত রে তোর?
- আগামী মাসে আঠারো হবে, কেনো বলতো?
অর্জুনের ঠোঁটের কোনায় একটা ভুবনভুলানো হাসি ফুটে উঠে। এই হাসিতেই তোর বারংবার নিজেকে ধ্বংস হতে দেখে অন্না। মৃদু কন্ঠে তখন অর্জুন বলে উঠে,
- তোকে দেখলে আগে মনে হতো খুব ছেলেমানুষ তুই, এই বাচ্চা মেয়েটাকে গাল টেনে দিয়ে যদি একটা চকলেট ধরিয়ে না হয় তবে কেঁদে ভাষাবে। কিন্তু আজ আমার সব ধারণায় পানি ফেলে দিলি। এতো বুঝদার মানুষ করে হলি তুই? আমার অনুভূতিগুলোর সকল ব্যাখ্যা যেনো তোর কাছে আছে। কারণটা কি জানতে পারি?
অর্জুনের প্রশ্নে শুধু ম্লান হাসি হাসে অন্না। উদাসীন কন্ঠে বলে,
- কারণটা অহেতুক। শুধু এটুকু বলবো, তোমার জ্বালায় আমিও জ্বলছি। এর চেয়ে বেশি কিছু বলতে চাই না। শুধু শুধু বাক্য নষ্ট হবে।
অর্জুন অবাক দৃষ্টিতে অন্নার দিকে তাকিয়ে থাকে। মেয়েটাকে কখনোই বুঝতে পারে না সে। দেবদার সাথে ভালো সম্পর্ক থাকাকালীন প্রায় ভট্টাচার্য মঞ্জিলে তার যাওয়া পড়তো। তখন এই মেয়েটাকে দেখতো। গোলগোল চোখে সবসময় তার দিকে তাকিয়ে থাকতো। ছোট বলে কখনো ততটা গুরুত্ব দেয় নি অর্জুন। কিন্তু মেয়েটা কত বড় হয়ে গেছে তাই না! হঠাৎ ঝিরঝির করে বৃষ্টি শুরু হলো। শীতের এই সময়ে বৃষ্টি যেনো দূর্লভ বস্তু। অন্নার শান্ত দৃষ্টি এখনো বৃষ্টির দিকে স্থির। আর অর্জুনের দৃষ্টি তার দিকে৷ ল্যাপটপে এখনো গাণ চলছে। একের পর এক গাণ। কিন্তু অপরিকল্পিতভাবেই আবহাওয়ার সাথে গাণটি মিলে গেছে।
"শাঙনগগনে ঘোর ঘনঘটা, নিশীথযামিনী রে।
কুঞ্জপথে, সখি, কৈসে যাওব অবলা কামিনী রে।
উন্মদ পবনে যমুনা তর্জিত, ঘন ঘন গর্জিত মেহ।
দমকত বিদ্যুত, পথতরু লুন্ঠিত, থরহর কম্পিত দেহ
ঘন ঘন রিম্ ঝিম্ রিম্ ঝিম্ রিম্ ঝিম্ বরখত নীরদপুঞ্জ।
শাল-পিয়ালে তাল-তমালে নিবিড়তিমিরময় কুঞ্জ।
কহ রে সজনী, এ দুরুযোগে কুঞ্জে নিরদয় কান
দারুণ বাঁশী কাহ বজায়ত সকরুণ রাধা নাম।
মোতিম হারে বেশ বনা দে, সীঁথি লগা দে ভালে।
উরহি বিলুন্ঠিত লোল চিকুর মম বাঁধহ চম্পকমালে।
গহন রয়নমে ন যাও, বালা, নওলকিশোরক পাশ।
গরজে ঘন ঘন, বহু ডর পাওব, কহে ভানু তব দাস।"
অর্জুনের দৃষ্টি এখনো অন্নার দিকে। আর অন্না সে হাত বাড়িয়ে বছরে প্রথম বৃষ্টিতে আলিঙ্গন করতে ব্যাস্ত_________
এক সপ্তাহ পর,
সকাল ১১টা,
হঠাৎ কলিংবেলের আওয়াজে রান্নাঘর থেকে ছুটে যায় কৃষ্ণা। আজ ছুটির দিন, এই সকালে ঘরের চার ব্যাটা গিয়েছে বাজারে। খুব জোরদার খাবার দাবারের আয়োজন করা হবে আজ। সকাল থেকে ঘরের তিন রমনী হেসেলে নিজেদের দান করেছেন। ছেলেরা বাজার করে ক্লান্ত শরীরে দাঁড়িয়ে থাকবে। তাই ছুটে দরজা খুলতে গেলো কৃষ্ণা। কিন্তু দরজা খুলতেই পা জোড়া স্থির হয়ে গেলো। কারণ দরজার ওপারে সৌদামিনী দাঁড়িয়ে আছে। সৌদামিনী এই সকালে কেনো এসছে এইটা কৃষ্ণার জানা নেই। তবে মনের কোনে ক্ষীণ ঝড় উঠতে লাগলো। তার মাষ্টারমশাই এই দিদিমনীকে ভালোবাসতেন। এই কথাটা জানার পরে হয়তো কোনো স্ত্রীর পক্ষে ব্যাপারটা স্বাভাবিকভাবে নেওয়াটা সম্ভব নয়।
- আমায় ভেতরে ঢুকতে দিবে না?
কথাটা শুনে দরজাটা ছেড়ে দেয় কৃষ্ণা। মৃদু কন্ঠে বলে,
- মাষ্টারমশাই ঘরে নেই।
- কিন্তু আমিতো তোমার কাছে এসেছি। হ্যা দেবের সাথেও কথা আছে, তবে তোমার সাথে কথা বলাটাই আমার আসার উদ্দেশ্য।
বুকে কামড় পড়ে কৃষ্ণার। সৌদামিনী কি তবে দেবব্রতকে চাইতে এসেছে কৃষ্ণার কাছে! তখন সৌদামিনী বলে........
.
.
.
চলবে..............................