জীবন দরজা ঠেলে ভেতরে আসতে আসতে বলল,
'জয় তুই,,, '
ভেতরে এক পা দিয়ে সামনে তাকিয়ে জীবন হতভম্ব হয়ে দাঁড়িয়ে রইলো। তার মুখ হা হয়ে আছে। চোখ বড় বড় হয়ে যেন বাইরে বেরিয়ে আসতে চাইছে। স্পৃহা জীবনের কথা শুনে পেছনের ঘুরে আবার চোখের পলকে ওপাশ ফিরে দাঁড়ালো। দু'হাত দিয়ে নিজেকে ঢেকে নিলো। জীবন স্পৃহার উপর থেকে চোখ ফিরিয়ে নিয়ে ফ্লোরের দিকে তাকিয়ে বলল,
'সরি। এটা তো জয়ের রুম। আমি ভেবেছিলাম ভেতরে হয়তো জয় আছে। সরি। আমি বুঝতে পারিনি।'
জীবন এক মুহূর্তও না দাঁড়িয়ে চলে গেল। দুই মিনিটের ভেতর স্পৃহার সাথে কি হয়ে গেল। স্পৃহা তার কিছুই বুঝতে পারলো না। সে শুধু পাথর হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। মুখ দিয়ে কোনো কথা বের করতে পারছে না। স্পৃহা তার পুরো জীবনে আজকের মত এমন লজ্জাজনক অবস্থায় পরে নি। মারিয়া ভেতরে এসে স্পৃহা এভাবে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে বলল,
'কিরে ভূত টূত দেখেছিস নাকি? এভাবে হা করে দাঁড়িয়ে আছিস কেন?'
মারিয়ার কোনো কথাই স্পৃহার কানে যাচ্ছে না। মারিয়া স্পৃহার থেকে কোনো সাড়া না পেয়ে স্পৃহাকে ধাক্কা দিয়ে বলল,
'স্পৃহা তুই ঠিক আছিস তো?'
স্পৃহার খেয়াল হলে বলল,
'হ্যা? হ্যা আমি ঠিক আছি।'
'আচ্ছা। তাড়াতাড়ি আয় তোকে শাড়ি পরিয়ে দিই।'
স্পৃহা মনে মনে ভাবছে, সে আজকের পর থেকে কীভাবে জীবনের সামনে যাবে? এই ঘটনার পর তো জীবনের সামনাসামনি হওয়া অসম্ভব। জীবন সিঁড়ির মাথায় জয়ের সাথে ধাক্কা খেল। জয় পড়ে যেতে নিয়ে নিজেকে সামলে বলল,
'শালা ধাক্কা দিয়ে তো ফেলে দিচ্ছিলি। হাত পা ভাঙলে তুই জরিমানা দিতি নাকি?'
জীবন যেন জয়ের কথা কিছুই বুঝতে পারছে না। জয় আবার বলল,
'এই জীবন তুই ঠিক আছিস তো? দিনের বেলা ভূত পেত্নী দেখে এতটা ভয় পেলি নাকি? মুখটা একেবারে শুকিয়ে গেছে।'
জীবন বিরবির করে বলল,
'ভূত পেত্নী নারে দোস্ত। তার থেকেও বেশি কিছু দেখেছি।'
'ভূত পেত্নীর থেকে ভয়ঙ্কর কিছু?'
'না। আমি যে কি দেখেছি তা তোকে বলতে পারবো না। তবে যা হয়েছে খুব খারাপ হয়েছে। আমি এমনটা করতে চাই নি। বিশ্বাস কর দোস্ত আমি সত্যিই জানতাম না ঐ রুমে যে,,,
জীবন থেমে গেল। জয় কপাল কুঁচকে বলল,
'কি দেখেছিস তুই? আর কি খারাপ হয়েছে? কি করতে চাসনি বলছিস? এই জীবন, কি জানতি না? কিসের রুমের কথা বলছিস কিছুই তো বুঝতে পারছি না।'
'কিছু না দোস্ত। '
'কিছু না কি? ঠিক করে বল তোর কি হয়েছে।'
'কিছু হয়নি। চল বাইরে ফ্রেশ বাতাস নিয়ে আসি।'
'হ্যা চল।'
সবাই ছাঁদে মারিয়াকে হলুদ লাগাচ্ছে। জীবনের সামনে যাতে না পরতে হয় তাই স্পৃহা প্রথমে রুম থেকেই বের হতে চায়নি। ছাঁদে এসেও সবদিকে তার চোখ জীবনকেই খুঁজছে। স্পৃহা জীবনের থেকে পালিয়ে বাঁচতে চাইছে। এর মধ্যে কোত্থেকে মারিয়ার বড় ফুপু এসে স্পৃহার গালে হলুদ মাখিয়ে দিলো। হাসতে হাসতে বললেন,
'মারিয়ার পর কিন্তু তোমার পালা স্পৃহা। পছন্দের কেউ থাকলে এখনই বলে ফেলো। শুভ কাজে দেরি করতে নেই।'
উনার কথা শুনে সবাই হাসছে। স্পৃহার দাদী বললেন,
'আমার নাতনির যদি কেউ পছন্দ থাকত তাহলে তা সবার আগে আমি জানতাম। তার কোনো পছন্দের মানুষ নাই। যা করার তা আপনার আমারই করতে হবে।'
'তাহলে তোমার জন্যও ছেলে দেখা শুরু করি? কি বলো স্পৃহা? '
সবার কথা শুনে স্পৃহার কান্না পাচ্ছে। এই মানুষ গুলো তো দেখছি মারিয়া বিয়ে না দিয়েই স্পৃহার বিয়ে দিয়ে ফেলতে চায়। সবাই একে অন্যকে হলুদ মাখাতে ব্যস্ত হয়ে গেলে,স্পৃহা নিচে যাবার জন্য সিঁড়ির কাছে যেতেই জীবনও উপরে এলো। না চাইতেও দু'জনের আবার সামনাসামনি হয়ে গেল। স্পৃহা হাত দিয়ে গালে লেগে থাকা হলুদ মুছার চেষ্টা করছিল। জীবন পলকহীন ভাবে স্পৃহা দিকে তাকিয়ে রইলো। কাঁচা হলুদ রঙের শাড়িতে স্পৃহাকে কোনো হলুদ পরী থেকে কম লাগছে না। খোঁপায় সাদা ফুল। চোখে সামান্য কাজল। ঠোঁটে লিপস্টিক পর্যন্ত নেই। তবুও এই সামান্য সাজে স্পৃহাকে অপরূপ সুন্দর লাগছে। জীবন স্পৃহার উপর থেকে চোখ সরাতে পারছে না। স্পৃহাও ড্যাব ড্যাব করে জীবনের দিকে তাকিয়ে আছে। তার চারপাশে কি হচ্ছে তা সব ভুলে গেলে। হলুদ পাঞ্জাবিতে ছেলেটাকে যে এতো সুন্দর লাগবে তা স্পৃহা ভাবতেই পারেনি। হুড়মুড়িয়ে জয় এসে পেছন থেকে জীবনের কাঁধে হাত রেখে বলল,
'কিরে এখানে দাঁড়িয়ে আছিস কেন?'
জয়ের কথায় জীবনের ধ্যান ভাঙলো। জীবন বলল,
'তোর জন্যই তো দাঁড়িয়ে ছিলাম। তুই এতক্ষণ কোথায় ছিলি?'
'আরে বলিস না। আমি ঘড়িটা খুঁজে পাচ্ছিলাম না।'
'এখানেও তুই ঘড়ি পড়ে কি করবি?'
'বুঝিসই তো অভ্যাস।'
'অভ্যাস না এটা তোর বদঅভ্যাস।'
স্পৃহা এখনও আগের মতই দাঁড়িয়ে আছে। জয় স্পৃহার চোখের সামনে তুড়ি বাজিয়ে বলল,
'এই ভেবলি! তুই আবার কোন ধ্যান ধরলি?'
'হ্যা? না। কিছু না তো ভাইয়া।'
স্পৃহা জীবনের দিকে তাকিয়ে দেখলো জীবন একদম স্বাভাবিক আছে। সে নিজেই এতক্ষণ বেকুবের মত হা করে তাকিয়ে ছিল। লজ্জায় স্পৃহার নাক কান লাল হয়ে গেছে। জয় বলল,
'আমার আগে তোকে কে হলুদ মাখালো? ধুর এটা কিছু হলো? আমি আসতে আসতে আগে থেকেই তোকে সবাই ভূত বানিয়ে রেখেছে। চল, চল এখন আর দেরি করিস না।'
জয় স্পৃহা আর জীবনের হাত ধরে হলুদের স্টেজের কাছে নিয়ে এলো। ইচ্ছে মত স্পৃহার মুখে হলুদ মাখাল। জীবনকে ধরতে পারেনি নাহলে তাকেও হলুদ দিয়ে ভূত বানাতো। সবকিছুর মাঝে স্পৃহার চোখ বারবার জীবনের উপর চলে যাচ্ছে। কয়েকবার জীবনের চোখাচোখিও হয়ে গেছে। স্পৃহা মনে মনে বলল,
'আমি পাগল হয়ে যাচ্ছি নাকি? এমন লজ্জার একটা ঘটনার পরও বারবার ঐ ছেলের দিকে তাকাচ্ছি। স্পৃহা ভেবলি লজ্জা নাই তোর? অন্য একটা মেয়ের বয়ফ্রেন্ডের দিকে তুই কিকরে তাকাতে পারিস। নিজের চোখকে কন্ট্রোলে রাখ। তুইও তো দেখছি দিনদিন তোহার মত বেহায়া হয়ে যাচ্ছিস। বারণ থাকা সত্ত্বেও তোর মন বারবার ঐ ছেলেকে নিয়ে ভাবছে।'
স্পৃহাকে ধাক্কা দিয়ে মারিয়া বলল,
'একা একা কি সব বিরবির করছিস? ভূতে টুতে ধরলো নাকি?'
চারিদিকে অন্ধকার নেমে এসেছে। এখন বাড়ির ছোট বড় সবাই ছাঁদে আছে। একটু পরে জয় গান করবে। তার জন্যই সবাই অপেক্ষা করছে। মারিয়ার ছোট ফুপু ধরে ধরে সবাইকে মেহেদি পরিয়ে দিচ্ছে। মারিয়া সাথে সাথে স্পৃহাকে দু'হাত ভর্তি মেহেদি দিয়ে বসিয়ে রেখেছে। মারিয়া স্পৃহার কানে কানে বলল,
'স্পৃহা একটা হেল্প কর না প্লিজ। আমার ফোনটা নিচে রেখে এসেছি। সোম হয়তো হাজার বার কল করছে। আমাকে তো কেউ এখান থেকে উঠতে দিবে না। তুই নিচে গিয়ে আমার ফোনটা একটু নিয়ে আয় না। আমার রুমে বেডের উপরই পাবি।'
'কিন্তু আপু আমার দু'হাত ভর্তি মেহেদি। এই দেখো।'
স্পৃহা হাত মেলে মারিয়াকে দেখালো।
'সমস্যা নাই। শুকিয়ে যাচ্ছে। তুই দয়া করে একটু যা না। ময়না পাখি, ছোট্ট টিয়া বোন আমার।'
'আচ্ছা যাচ্ছি।'
স্পৃহা মারিয়ার পাশ থেকে উঠে গেল। কিন্তু সিঁড়ি দিয়ে নামতে গিয়ে আরেক সমস্যা হয়েছে। শাড়ির কুঁচি বারবার পায়ের সাথে আটকে যাচ্ছে। হাতে মেহেদি তাই কুঁচি গুলো ধরতেও পারছে না। স্পৃহা তোহাকে ডাকলো,
'তোহা একটু এদিকে আয় না।'
তোহার মেহেদি দেবার পালা চলছে। এক হাতে হয়ে গেছে এবার অন্য হাতে। তোহা গলা উঁচিয়ে বলল,
'আপু সিঁড়িতে আলো দেয়া হয়েছে। অন্ধকার নেই তো। তুই ভয় পাস না। একা একাই নিচে চলে যা। ওখানেও লাইট আছে।'
স্পৃহা কেন ডাকলো আর তোহা এতগুলো লোকের সামনে কি বললো। এখন সবাই ভাববে স্পৃহা ভীতু অন্ধকারে ভয় পায়। জীবন পাশেই একটা চেয়ারে বসে ছিল। সে উঠে দাঁড়ালে জয় বলল,
'তুই আবার কোথায় যাচ্ছিস?'
'আমার ফোনটা মনে হয় রুমে রেখে এসেছি ওটা আনতে যাচ্ছি।'
'আচ্ছা তুই বোস আমি যাচ্ছি।'
জয় উঠে এলো। সিঁড়ির কাছে এসে স্পৃহার মাথায় চাপড় মেরে বলল,
'ছাগলের মত ডাকছিলি কেন? হাজার ডাকলেও তোহা এখন আসবে না। তোর জন্য পুরো বাড়িতে লাইট দিয়েছি। কোথাও এতটুকু অন্ধকার নেই তবুও তুই ভয় পাচ্ছিস?'
'ভয় পাচ্ছি না।'
'তাহলে? '
'নিচে যাব।'
'তো যা না। বারণ করলো কে?'
'কীভাবে যাব?হাঁটতে পারছি না। শাড়ির কুঁচির সাথে পা বেজে যাচ্ছে। পড়ে যাব তো।'
'তুই আসলেই একটা গাধী। হাত ভর্তি মেহেদি নিয়ে নিচে যাবার দরকার কি?'
জয় স্পৃহার মুখের দিকে তাকিয়ে বলল,
'থাক হয়েছে আর মুখ কালো করতে হবে না। চল আমার সাথে। আমি তোর কুঁচি তুলে ধরছি তুই সাবধানে হেঁটে আয়।'
জয় আর স্পৃহা নিচে নেমে গেল। জীবন সিঁড়ির মাথায় দাঁড়িয়ে সবটা দেখলো। আনমনেই জীবনের কপাল কুঁচকে এলো। মুখে অস্পষ্ট একটা বিরক্তির ছাপ বেসে উঠলো। কিন্তু কেন এমনটা হলো তা তার নিজেও অজানা।
'কি নেওয়ার জন্য নিচে এসেছিস?'
'মারিয়াপুর ফোন।'
'এই আপুটা না আজব একটা জিনিস। সারাদিনই ফোন কানে লাগিয়ে রাখতে হয়? এতো কি কথা বলে সোমের সাথে?'
স্পৃহা কিছু বলল না। জয় বলল,
'তোর হাতে তো মেহেদি তুই কীভাবে ফোন নিবি? তোকে না পাঠিয়ে নিজে এসে নিয়ে যেতে পারলো না?'
'আপুকে ওখান থেকে আসতে দিবে না।'
'আচ্ছা তাহলে তুই দাঁড়া আমি নিয়ে আসছি।'
জয় নিজের রুমে গিয়ে জীবনের ফোন এনে, মারিয়ার রুমে গিয়ে ওর ফোনও নিয়ে আসলো।
'চল এখন যাই।'
'তুমি যাও। আমি একটু পানি খেয়ে আসি।'
জয় স্পৃহার হাতের দিকে ইশারা করে বলল,
'পারবি?'
'হুম।'
'আচ্ছা তাহলে তাড়াতাড়ি পানি খেয়ে আয়। দেরি করিস না। নিচে কেউ নেই। ভয় পাবি না তো?'
'না।'
জয় চলে গেলে স্পৃহা ডাইনিং এর দিকে এগোলো। অনেক কষ্ট করেও জগ থেকে গ্লাসে পানি ঢালতে পারলো না। স্পৃহা ফিরে যাবার জন্য পা বাড়ালে তার মনে হলো কেউ যেন তার দিকে তাকিয়ে আছে। আড়াল থেকে তাকে দেখছে। স্পৃহা এমনিতেই একটু ভীতু টাইপের। সে তাড়াহুড়ো করে ছাঁদে আসার জন্য পা চালালো। দুই সিঁড়ি উঠে শাড়ির কুঁচি পায়ের নিচে চলে গেলে স্পৃহা পড়ে যাচ্ছিল। এমন সময় পেছন থেকে কেউ এসে স্পৃহাকে ধরে ফেললো।
স্পৃহা ভয় পেয়ে চোখ বন্ধ করে দু'হাতে লোকটার গলা জড়িয়ে ধরে রাখলো। কিছুক্ষণ পরে মিটমিট করে চোখ খুলে সামনে জীবনকে দেখতে পেলো। জীবন স্পৃহার দিকে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। স্পৃহাও নিজেকে জীবনের কোলে দেখে হতবুদ্ধি হয়ে জীবনের দিকে চেয়ে রইলো। এভাবেই দু'জন দু'জনের দিকে বেশ অনেকক্ষণ চেয়ে রইলো। জীবন স্পৃহাকে কোলে নিয়ে ছাঁদের দরজার সামনে এনে নামিয়ে দিয়ে কিছু না বলে,এক মুহূর্তও না দাঁড়িয়ে নিচে চলে গেল। এতক্ষণ যা যা হয়েছে সব স্পৃহার মাথার উপর দিয়ে গেল।
স্পৃহা বলল,
'উনি আমাকে কোলে করে নিয়ে এসেছেন!'
স্পৃহা তার দু'হাত মেলে ধরলো। হাতের লেপ্টে যাওয়া মেহেদির দিকে তাকিয়ে জোরে শ্বাস ফেলে ছাঁদে চলে গেল।
জীবন রুমে এসে দেয়ালে সজোরে একটা ঘুসি মারলো। কিড়মিড় করে বলল,
'এমনটা কেন করলাম আমি? কেন করলাম? কেন ঐ মেয়েটাকে কোলে তুলে নিলাম? কেন?'
জীবন মাথার চুল টেনে ধরে বেডে বসে পরলো।
'মেয়েটা আমাকে নিশ্চয়ই ক্যারেক্টারলেস ভাবছে? আমি এমন একটা কাজ কীভাবে করতে পারলাম? নূপুর জানলে কী হবে? আমি নূপুরের সাথেই বা এতো বড় বেইমানি কীভাবে করতে পারলাম? নূপুর আমাকে বলেছিল এই মেয়েটার থেকে যেন দূরে থাকি। কিন্তু আমি কিনা শেষমেশ ওকে,,,
না! নাহ! আর ভাবতে পারছি না। যে করেই হোক এখন থেকে এই মেয়ের থেকে আমাকে দূরে দূরে থাকতে হবে। এই মেয়ে সামনে আসলে আমি কেন এমন হয়ে যাই? কেন নিজের উপর কন্ট্রোল থাকে না?'
জীবন উঠে দাঁড়ালো। পাঞ্জাবির কাঁধের কাছে মেহেদি লেগে আছে। জীবন ওয়ারড্রোব থেকে শার্ট বের করে চেঞ্জ করে নিয়ে ছাঁদে চলে গেল। জয়ের পাশে বসলে জয় বলল,
'কোথায় ছিলি তুই? আর চেঞ্জ করেছিস কেন?'
'পাঞ্জাবি ভিজে গেছিল। আমার ফোন কই?'
'এই নে। তোর লাভ ঊনত্রিশটা মিসড কল দিয়েছে। কল ব্যাক কর। নইলে আজ তোর রক্ষে নেই। শিওর আজ তোর ব্রেকআপ হয়ে যাবে।'
জীবন জয়ের থেকে ফোন নিয়ে অন্যপাশে চলে গেল। স্পৃহা কয়েকবার জীবনের দিকে তাকিয়েছে। কিন্তু জীবন স্পৃহাকে পুরোপুরি ভাবে ইগনোর করছে।
জীবন নূপুরের কল পেয়ে পরে আবার কল ব্যাক করেছে। কিন্তু নূপুর কল তুলছে না। রিং হয়ে বারবার কেটে যাচ্ছে। জীবন ভাবছে নূপুর হয়তো তার উপর রাগ করেছে। জীবন নূপুরকে ম্যাসেজ করে আবার স্টেজের কাছে ফিরে আসলো। অনেক রাত পর্যন্ত সবাই এখানে বসে আড্ডা দিয়েছে। জয় গান করেছে। জীবনকে অনেক জোড়াজুড়ি করেছে গান গাওয়ার জন্য। কিন্তু জীবনের মন খারাপ বলে সে রুমে চলে এসেছে। হঠাৎ জীবন চলে গেলে স্পৃহা মনে মনে বলল,
'হঠাৎ করে উনার আবার কি হয়েছে? সবার মাঝ থেকে চলে গেলেন কেন?'
পরের দিন স্পৃহা একবারের জন্যও কোথাও জীবনকে দেখতে পেল না। জীবন কি চলে গেছে? স্পৃহা কারো কাছে জিজ্ঞেসও করতে পারছে না। দুপুরে পার্লারের মহিলারা এসে মারিয়াকে সাজিয়ে দিলো। তোহাও উনাদের কাছেই সেজেছে। মারিয়া ধরেবেঁধে স্পৃহাকেও উনাদের সামনে বসিয়ে দিয়েছে। মারিয়া গাঢ় খয়েরী লেহেঙ্গা পরেছে। তোহা গাঢ় নীল আর স্পৃহা গাঢ় লাল। ওদের তিনজনকেই অসম্ভব সুন্দর লাগছে। একটু পরেই বরযাত্রী চলে এসেছে। সবাই বরকে নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পরেছে। তোহাও সবার সাথে বাইরে চলে গেছে। স্পৃহা একা মারিয়ার পাশে বসে আছে। মারিয়া বলল,
'তুইও নিচে যা।'
'না। আমি তোমার সাথে থাকি।'
'সোমকে দেখবি না?'
'পরে দেখব।'
'স্পৃহা কোনো কারণে তোর কি মন খারাপ?'
'মন খারাপ হবে কেন আপু?'
'তুই সকাল থেকেই কেমন অন্যমনস্ক হয়ে আছিস। কোনো কিছুতেই তোর যেন মন লাগছে না।'
'একটু পরে তো তুমি চলে যাবে তাই একটু একটু মন খারাপ লাগছে।'
'ধুর পাগলী! আমি অনেক দূরে যাচ্ছি নাকি? বিয়ের পর তো বেশিরভাগ সময় আমি এখানেই থাকবো।'
'হুম।'
'আমার পাগলী বোনটা এতটুকুতেই এমন মন খারাপ করলে কীভাবে হবে? তুই বুঝি বিয়ে করে শ্বশুরবাড়ি যাবি না? তখন তো মনে হয় কেঁদে কেটে সাগর বানিয়ে ফেলবি।'
বিয়ে পড়ানো হয়ে গেছে। একটু পর বরযাত্রী মারিয়াকে নিয়ে চলে যাবে। মেয়ে বিদায়ের পালায় সবার মন খারাপ। মেহেরুন এখন থেকেই কান্না শুরু করেছে। যাবার সময় মারিয়া মা খালামণি ফুপিদের জড়িয়ে ধরে অনেক কেঁদেছে। গাড়িতে ওঠার সময় তোহা আর স্পৃহাকে জড়িয়ে ধরেছে। স্পৃহাও এবার নিজেকে আটকে রাখতে পারলো না। সেও মারিয়ার সাথে কান্না জুড়ে দিয়েছে। মারিয়া চলে গেলে মেহেরুন স্পৃহা তোমাকে ধরে কাঁদছেন। জয় ওদের কাছে এসে বলল,
'মা কি শুরু করেছো বলো তো? তোমাদের কান্না দেখে তো মনে হচ্ছে আপুকে বিয়ে দিয়ে ভুল হয়ে গেছে। আপু আমাদের থেকে বেশি দূরে তো যায়নি। বিশ মিনিটের রাস্তা পার হলেই সোম ভাইয়ার ফ্ল্যাট।'
মেহেরুন থামছেনই না। স্পৃহাকেও কাঁদতে দেখে জয় ধমকিয়ে উঠে বলল,
'স্পৃহা একটা দিব তোকে। মায়ের পাগলামিতে তুইও যোগ দিচ্ছিস? এদিকে উঠে আয়। তোহা তুই আন্টির কাছে যা।'
স্পৃহাকে নিয়ে জয় এদিকে চলে এলো। একটা চেয়ার টেনে স্পৃহাকে বসিয়ে দিয়ে নিজেও অন্য একটা চেয়ার টেনে বসলো।
'এই পাগলী তুই কাঁদছিস কেন?'
স্পৃহা ফোঁপাতে ফোঁপাতে বলল,
'আপুর জন্য কষ্ট হচ্ছে। '
'আরে দুর কিসের কষ্ট? আপু তো কালই চলে আসবে। দেখ স্পৃহা তোরা কাঁদছিস বলেই মা এতটা ভেঙে পরছে। কোথায় তোরা দু'জন মা'কে একটু বুঝাবি তা না করে তোরাও মায়ের সাথে তাল মিলিয়ে কাঁদতে বসেছিস। নে এবার চোখটা মুছ তো।'
জয় স্পৃহা চোখের পানি মুছে দিচ্ছে। জীবন পুরোটা দিন স্পৃহার সামনে না পরার জন্য দূরে দূরে থেকেছে। এখনও দূরে থেকেই স্পৃহাকে দেখছে। কাঁদলে মেয়েটার নাকের ডগা লাল হয়ে যায়। তার কিছুটা লালচে ভাব দুই গালেও পরে। সব মিলিয়ে যেন কাঁদলেই ওকে আরো সুন্দর লাগছে। জীবন মনে মনে বলল,
'ধুর এসব কি ভাবছি আমি?'
জীবন জয়ের কাছে এগিয়ে এলো। স্পৃহার দিকে না তাকিয়ে বলল,
'জয় ডেকোরেটরের লোক তোকে খুঁজছে। গেটের কাছে যেতে হবে একবার।'
'আচ্ছা আসছি দাঁড়া।'
জয় উঠে দাঁড়ালে স্পৃহাও জীবনের কথা শুনে তার দিকে তাকালো। মনে মনেই সে বলে উঠলো,
'সারাদিন লোকটা কোথায় ছিল? একটা বারের জন্যও দেখলাম না। এখন হঠাৎ কোত্থেকে উদয় হলো?'
জয় স্পৃহাকে বলল,
'যা রুমে গিয়ে ফ্রেশ হয়ে নে।'
স্পৃহা হ্যা সূচক মাথা নাড়ালো। জয় জীবনের সাথে চলে গেল। জীবন যেতে যেতে ভাবলো,
'জয় স্পৃহার কত খেয়াল রাখে। ওদের দেখে যে কেউ অন্যকিছু মিন করে বসবে। সত্যিই কি ওদের মধ্যে তেমন কিছু আছে?'
নিজের এমন নিচু ভাবনার জন্য জীবন নিজেকেই গালি দিলো।
জীবন সন্ধ্যায় চলে যেতে চাইছিল। কিন্তু জয় তাকে যেতে দিলো না। আর একটা দিন থাকার জন্য জোর করলো। জীবনও জয়ের কথা ফেলতে পারলো না। আজ রাতটা থেকেই গেল। মারিয়া চলে যাবার পর যেন বাড়ি খালি হয়ে গেছে। স্পৃহা ছাঁদে দাঁড়িয়ে আছে। গতকাল রাতেও ছাঁদে কত মানুষের আড্ডা ছিল। অথচ আজ এখানে কতটাই না নিরবতা বিরাজ করছে। জীবন নূপুরকে কল করতে করতে ছাঁদে এসে দেখে স্পৃহা রেলিং ঘেঁষে দাঁড়িয়ে আছে। জীবন ফোন পকেটে রেখে স্পৃহার দিকে এগিয়ে গেল।
'একা এখানে কি করছো?'
স্পৃহা জীবনের কন্ঠ পেয়ে চমকে উঠে পেছন ফিরে তাকালো। জীবন কথাটা বলে যে বোকা বনে গেল। স্পৃহা বলল,
'দাঁড়িয়ে ছিলাম।'
'ওহ। মারিয়া আপুকে খুব মিস করছো না?'
'হুম। '
জীবন কিছুক্ষণ চুপ থেকে বলল,
'এখানে কতক্ষণ থাকবে?'
স্পৃহা যেন কথাটা বুঝতে পারলো না। সে জীবনের দিকে প্রশ্নসুচক দৃষ্টি নিয়ে তাকালে জীবন বলল,
'না মানে বেশি রাত করা মনে হয় ঠিক হবে না। তুমি একা আছো। এদিকটাই কেউ নেই।'
স্পৃহা হঠাৎ করে বলে উঠল,
'ধন্যবাদ।'
'হ্যা? '
'বলেছি ধন্যবাদ।'
'হুম। কিন্তু কেন?'
'ঐদিনের জন্য।'
জীবন ভ্রু উঁচিয়ে বলল,
'কোন দিনের জন্য? ঠিক বুঝলাম না।'
'আমার জন্য ছেলেটাকে মারলেন। আর আমি সেদিন একটা থ্যাংক্স পর্যন্ত দিলাম না। কিছু না বলেই ওখান থেকে চলে এসেছি।'
'ওহ। ব্যাপার না। আচ্ছা এখন নিচে যাওয়া যাক?'
'হুম।'
তোহা ছাঁদের সিঁড়ির মাথায় দাঁড়িয়ে স্পৃহাকে ডেকে বলল,
'আপু মা তোকে ডাকছে।'
'আসছি দাঁড়া।'
স্পৃহা চলে গেল। জীবন কিছুক্ষণ এখানেই দাঁড়িয়ে রইলো। রুমে গিয়েই তোহা স্পৃহাকে চেপে ধরলো,
'আপু আমি কিন্তু সব শুনেছি। ঐ দিনের ছেলেটা তাহলে জীবন? আমাকে আগে কেন বললি না। ছেলেটা কত ভালো। আমিই নাহয় ওকে তোর হয়ে থ্যাংক্স বলে দিতাম।'
'তোহা তুই চুপিচুপি আমার কথা শুনছিলি?'
'চুপিচুপি শুনবো কেন? আমি তোকে ডাকতে গিয়েছিলাম। তখন তুই বলছিলি।'
'শুনেছিস ভালো হয়েছে। এখন চুপ থাক। আর তোকে থ্যাংক্স বলতে হবে না। আমিই বলে দিয়েছি।'
তোহা কিছু বলতে যাচ্ছিল। স্পৃহা তাকে থামিয়ে দিয়ে বলল,
'এখন এই নিয়ে আর কোনো কথা শুনতে চাই না।'
'শোন না।'
'চুপ।'
'আপু...'
'চুপ। '
'অ্যাই,,,'
'বলছি না চুপ।'
'ধ্যাত!'
তোহা রেগে রুম থেকে বেরিয়ে গেল।
পরের দিন সকালে জীবন ওবাড়ি থেকে চলে এসেছে। রাতে দেরি করে শুয়েছিল বলে,স্পৃহা আজ ফজরের নামাজ পড়ে আবার ঘুমিয়ে যায়। তার উঠতে উঠতে প্রায় সাড়ে নয়টা বেজে যায়। স্পৃহার ঘুম ভেঙ্গেছে ঠিকই কিন্তু সে এখনো বিছানায় বসে আছে। তোহা রুমে এসে বলল,
'আপু জীবন চলে গেছে।'
'হ্যা? '
'ঐ ছেলেটা, জীবন ও আজ চলে গেছে।'
স্পৃহা চোখ ডলা দিয়ে পুরোপুরি ঘুম ভেঙে বলল,
'এটা আমাকে বলছিস কেন? বিয়ে বাড়িতে এসেছিল। এখন বিয়ে শেষ। সে নিজের বাড়িতে ফিরে যাবে এটাই তো স্বাভাবিক।'
'তোর সাথে দেখা করে গেল না?'
'আমার সাথে দেখা করে যাবে কেন?'
'কাল তোরা ছাঁদে কথা বলছিলি। আমি শুনেছি। আমি তো ভেবেছিলাম তোদের মধ্যে হয়তো কিছু চলছে।'
স্পৃহা রেগে বলল,
'তোহা সক্কাল সক্কাল আমার হাতে থাপ্পড় খেতে চাস না।'
তোহা স্পৃহার পাশে বসে বলল,
'সত্যিই তোদের মাঝে কিছু নেই?'
'কিছু কি থাকবে? তুই কি বলতে চাইছিস বল তো?'
'ধ্যাত! তুই যেন কিছুই বুঝিস না।'
'না। আমি বুঝি না। কিন্তু তুই অল্প বয়সে অনেক বেশি বুঝে ফেলেছিস। এখন এখান থেকে না গেলে তোর সব কান্ডকারখানা মা'র কাছে বলে দিব। অনেক পাকনা হয়েছ তুমি।'
'ধুর তোর সাথে ভালো করে কথাও বলা যাবে না। সারাক্ষণ শুধু একটাই ভয় দেখাতে থাকিস। মা'কে বলে দিব। এই করবো, সেই করবো। অভিশাপ দিলাম তোর জামাই তোকে অনেক জ্বালাবে। অনেক কষ্ট দিবে। একটুও ভালোবাসবে না।'
'আচ্ছা যা। আল্লাহ তোর অভিশাপ কবুল করুক। আমার এতো ভালোবাসার দরকার নাই।'
'ধ্যাত!'
তোহা রাগ দেখিয়ে বেরিয়ে গেল। স্পৃহা ভাবতে বসে পড়লো। কাল রাতে তো জীবন ওর সাথে ভালো ভাবেই কথা বলেছে। তাহলে যাবার আগে কেন একবার দেখা করলো না। একটা বাই বলেও তো যেতে পারতো। তার এখন যাবার এতো কিসের তাড়া ছিল?