সেদিন অনেক ভেবেছিলো নিশাদ।ইমতিয়াজ আর ওর ফ্রেন্ডশিপ আর অন্যদিকে ইদ্রি।নিশাদেরই কি ভুল ছিলো ইদ্রিকে রাতটায় চিন্তা করে,মনের অজান্তে ভালবেসে।এটা সত্যি ইদ্রিকে শুধু রাতটায় ভাবতে পারে ও।যখন চারিদিক নিস্তব্ধ হয়ে যায়।সবাই নিদ্রাচ্ছন্ন হয়ে পড়ে যখন মনে হয় জীবনটায় কাউকে দরকার যাকে অন্তত জড়িয়ে ঘুমোতে পারবে।যখন মনে হয় এমন কেউ দরজা খুলে ওর সামনে দাঁড়িয়ে দুহাতে গলা জড়িয়ে বলবে ভালবাসি।নিশাদ তখন কপালে চুমু দিয়ে বলবে খুব মনে পড়ছিলো তোমাকে তখন কি ইদ্রির চেহারাটাই ভাসে না ওর চোখে?ভাসে।আজ কাল তো খুব বেশি মনে পড়ে।অনেকটা বেশি মন খারাপ হয় যখন মনে হয় মেয়েটাকে আঘাত করে পিছে ফিরে তাকায়নি ও।নিশাদের বুকটা হঠাৎ খালি হয়ে আসে।চোখের কোনে পানি জমা হয়ে মুক্তোর মতো।জ্বলজ্বল করছে।ইদ্রিকে ভালবেসেই কি ইমতিয়াজ আর ওর বন্ধুত্ব ভেঙ্গে যাবে?ইমতিয়াজ ওর সবচেয়ে প্রিয় বন্ধু।ওর ছোট্টবেলার বন্ধু।ইমতিয়াজ কষ্ট পাবে ও না গেলে অপরদিকে ইদ্রিকে দেখতে হবে সেখানে গেলে।নিশাদ কি করবে?খাটে এপাশ ওপাশ করছিলো নিশাদ।হঠাৎ মনে হলো পাশে যেন কেউ বসলো।নিশাদ পাশে তাকিয়ে ইকরাম রাহমান কে দেখে কিছুটা অবাক হয়ে বলল,
''আব্বা তুমি?"
''কোন সমস্যা হইছে তোর বাবা?ইদানীং কেমন জানি হয়া গেছোস।"
ইকরাম রাহমানের মুখ নিমিষেই মলিন হয়ে যায়।নিশাদ উঠে বসে হালকা হাসলো।ততক্ষনে জুলেখা বানু ও এসে ছেলের রুমে উপস্থিত।নিশাদ অনেকটাই অবাক।হঠাৎ এতো রাতে মা বাবা ওর রুমে কি করছেন?জুলেখা বানু ছেলের পাশে এসে খাটে বসলেন।ইকরাম রাহমান মায়া ভরা কন্ঠে বললেন,
''কাজ কেমন চলে আব্বা?"
''জি ভালো আব্বা।আপনারা এতো রাতে!!!সব ঠিক আছে?"
''হ ঠিক আছে।কেন আইতে ফারিনা তোর রুমে?"
জুলেখা বানু পান চিবোতে চিবোতে বললেন।নিশাদ ম্লান হেসে বলল,
''পারেন।"
ইকরাম রাহমান গলা পরিষ্কার করে বললেন,
''শোন আব্বা অতো ভনিতা করতে পারিনা।ফজলুল কাকার কথা মনে আছে তোর?ঐ যে লক্ষীপূর বাড়ি?"
নিশাদ কিছু মনে করার চেষ্টা করছিলো।হঠাৎ বলল,
''ঐযে সমপাড়ার পাশে যে বড় মেয়ে বিয়া দিছিলো?"
''হু।তুই বিয়াত যাইয়া প্যান্ট নষ্ট কইরা ফালাইছিলি।"
বাবা মায়ের মুখে এমন কথা শোনার জন্য মোটেও প্রস্তুত ছিলো না নিশাদ।লজ্জায় মুখ এতোটুকু করে ফেললো।ইকরাম রাহমান বললেন,
''অহন ওর ছোট মাইয়া ফারজিয়া পড়াশুনা শেষ করছে কেবল।এহন তোর যদি কোন আপত্তি না থাহে তাইলে ডাইকা আনুম।হেরা অহন ঢাকাত আছে।"
বাবার কথায় চমকে উঠে নিশাদ।বুঝতে দেরি হয়নি কি বলতে চাচ্ছে ইকরাম রাহমান।নিশাদ কিছুটা অপ্রস্তুত বোধ করতে শুরু করে।নিজেকে কিছুটা সামলে বলল,
''আব্বা আমি এহন এসব কিছুই ভাবতেছিনা।আমার কাজ আছে।তারওপর সাঁঝ ওর ও একটা সাইড হলো না।বোনরে বিয়া দিয়াই আমি করুম।এর আগে না।"
ইকরাম রাহমান কিছুটা রেগে বললেন,
''তোর বয়স অইতাছে।তাকা নিজের দিকে।"
স্বামীকে রেগে যেতে জুলেখা বানু বললেন,
''না রাইগা সুন্দর করে বুঝাইলেই পারো।"
বলেই ছেলের হাত ধরেন জুলেখা বানু।বলতে থাকেন,
''আব্বা দেখ জন্ম মৃত্য বিয়াশাদী আল্লাহর ইচ্ছায় চলে।এহন দেইখা রাখ পরে নাহলে বিয়া করবি নে।"
নিশাদ মাথা নেড়ে বলল,
''না আম্মা এহন না।আমি এসব ভাবতেছিনা এখন।খুব টায়ার্ড লাগতাছে।তোমরা গিয়া ঘুমাও।পরে কথা হবেনে।"
ইকরাম রাহমান অনেকটা আশা নিয়ে এসেছিলেন ছেলের কাছে।আশাহুত হয়ে রেগে বেরিয়ে গেলেন।নিশাদ সেদিকে তাকালোনা।জুলেখা বানু ছেলের মাথা হাতিয়ে বেরিয়ে গেলেন।নিশাদ দীর্ঘবাস ফেলে।ও কি আদৌ পারবে কখনো নিজের জীবনে কাউকে জড়াতে ইদ্রি ছাড়া?সেরাত টা নির্ঘুম হয়ে গেলো নিশাদের জন্য।বিছানায় গড়াঘড়ি করে ও ঘুমোতে পারেনি ও।
........................বিভান পাশ ফিরে বেলার দিকে তাকায়।বিভানের দিকে পিঠ দিয়ে পূর্নাকে জড়িয়ে ঘুমাচ্ছে বেলা।বিভান হাত বাড়িয়ে বেলার খালি পিঠ আলতো করে স্পর্শ করে হাত সরিয়ে নেয়।কেমন অস্থিরতা কাজ করছে ওর সারা বুক জুড়ে।শোয়া থেকে উঠে বসে বিভান।আজকাল সিগারেটের নেশা হয়ে গেছে ওর।সিগারেট আর লাইটার হাতে নিয়ে ব্যালকনিতে চলে আসে বিভান।সিগারেট ধরিয়ে গ্রিলে হাত রেখে দাঁড়ায় ও।হঠাৎ খেয়াল করলো ওর ফোনটা কেঁপে কেঁপে উঠছে।ফোনটা সামনে এনে দেখলো বন্দনা আখতার কল করছেন।বিভান কল কেঁটে টেবিলে রেখে দেয়।হঠাৎ ওকে কল করার মানেটা কি?হাজারবার খুন করে ও কি ক্ষান্ত হননি?ওর অজান্তেই ওর হৃদয়কে হাজার বার ছুরিকাঘাত করে ও শান্ত হননি?আর কতো মারবেন?আর কতো ধোঁকা দেবেন।ওগুলো কি কম ছিলো যে এখন আবার কল করছেন।বিভানের বুক হঠাৎ অনেকটা ভারি হয়ে উঠে।একপর্যায়ে মনে হতে থাকে নিশ্বাস নিতে কষ্ট হচ্ছে।গলা বন্ধ হয়ে আসছে।ও কি মারা যাচ্ছে।ওর জীবনের শেষ অধ্যায় কি এসে গেছে।হঠাৎ চেয়ারের ওপর ধপ করে বসে পড়ে বিভান।কপাল বুক ঘেমে একাকার হয়ে গেছে।নিজেই বুক চেঁপে মালিশ করতে থাকে।চোখজোড়া ভিজে আসে বিভানের।পরক্ষনেই মনে হলো ও আসলে মরে যাচ্ছেনা।ওর ভেতরের ভাল মানুষটাই হয়ত মরে গেছে।সব আবেগ অনুভূতি সব শেষ হয়ে গেছে।সিগারেটে লম্বা দুতিন টান দিয়ে সেটাকে হাতে নিয়ে আসে বিভান।এই সিগারেটের মতোই সবার জীবন ক্ষনস্থায়ী।এই সল্পস্থায়ী জীবনে সবাই কতো কিছুর স্বপ্ন দেখে কতো আশা বুনে রাখে।তবে সবার সব আশা পূরন হয়না। ওর পূরন হয়েছিলো যেদিন বেলাকে প্রথম দেখে মনের কোন এক কোনে চিনচিনে ব্যাথা অনুভুত হয়েছিলো।যেদিন বেলাকে প্রথম বারের মতো কাছে পেয়েছিলো।সেদিন তো ওর সব আশাই পূরন হয়েছিলো তাহলে এখন কেন ও নিরাশ হচ্ছে?বেলাকে কাছে না পাওয়ার যন্ত্রনা ওকে চিরে খাচ্ছে?বেলাকে তো ওর খুব পেতে ইচ্ছে করছে।কিন্তু বেলাই কেমন দূরে সরে গেছে।অবশ্য এখানে তো ও নিজেই দায়ী।
এদিকে বেলার ঘুম ভেঙ্গে গেলো।আসলে চোখ লেগে এসেছিলো ওর।এখন তো ঘুমটাও হয়না ওর। অর্ধেকটা রাত জেগেই কাঁটিয়ে দেয়।ঘুমভাঙ্গতেই সিগারেটের হালকা ঘ্রান ওর নাকে এসে লাগে।বেলা ঘ্রান নিতে নিতে চোখ খুলে পাশে তাকায়।সেখানে লোকটা নেই।বেলা লাফিয়ে উঠে খাটে বসে।ব্যালকনিতে দেখলো বিভানের পা দেখা যাচ্ছে।বেলা বসে বিভানকে দেখতে থাকে।কি যে একটা যন্ত্রনা শুরু হয়ে গেছে বুকের ভেতর।ও কি গিয়ে দেখবে লোকটা কি করছে?কি হয়েছে তার?সে তো কখনোই এমন টা করেনা।কিছুক্ষন পর বেলা খেয়াল করলো বিভান এদিকে আসছে।ও শুয়ে বিভানের অপেক্ষা করতে থাকে।বিভান কিছুটা হেলেদুলে এসে বেলার পাশে শোয়।হঠাৎ বেলার দিকে তাকিয়ে কি যেন ভাবতে থাকে।তারপর বেলার গাল ধরে নিজের দিকে ফিরিয়ে ফিসফিস করে বলছিলো,
''পেতে চাই তোমাকে এই মুহূর্তে বেলা।দেবে?প্লিজ।"
বেলা চোখবুজে রেখেছিলো।ওর ভীষন কান্না পাচ্ছে তবে ও কাঁদবেনা।কারন কম অবহেলা পায়নি ও লোকটার কাছ থেকে।কষ্ট দিয়েছে লোকটা ওকে।বেলা চোখ বুজে রইলো।বিভান হঠাৎ কি যেন হলো বেলার কাছে এসে ওর কপালে তারপর ঠোঁটে আলতো করে চুমু দিয়ে ফিসফিসিয়ে বিভান বলল,
''ভালোবাসি।"
বলেই ঘুমিয়ে গেলো বিভান অপরদিকে ফিরে।
...........................পরদিন সকালে সাঁঝ রিদ্ধিকে পড়াতে আসে।আজ অবশ্য কলেজ ছিলো না তাই পড়াতে চলে এলো।রিদ্ধি ওকে দেখে কিটকিটিয়ে হেসে বলছিলো জানো সিয়াম ভাইয়া আর ওনার ওয়াইফ এ বাসা ছেড়ে চলে গেছে।এটায় এখন ভাড়াটিয়ারা থাকবে।সাঁঝ কিছুটা অবাক হওয়ার ভান করে বলল,
''কে ওনারা?"
''আমাদের বাড়িওয়ালা যার ছোট ভাইয়ের সাথে তুমি ঘুরতে।"
সাঁঝ অনেকটা লজ্জা পেয়ে বলল,
''এসব কে বলল তোমাকে?"
''আমি দেখেছি।তবে কাউকে বলবো না।"
সাঁঝ কিছুটা থম ধরা কন্ঠে বলল,
''তুমি পড়ো।"
খানিক পরেই সাঁঝ রিদ্ধিকে জিজ্ঞেস করলো,
''শুনো।"
''জি মিস।"
''একটা কথা বলবে?"
''জি মিস বলো।"
''ঐ যে ওনারা কই গেছেন?"
''বনশ্রী।"
''ওহ।"
সাঁঝের মনটা কেমন যেন খারাপ হয়ে যায়।রিদ্ধিকে পড়িয়ে বেরিয়ে এসে খেয়াল করলো জিনিস পত্র নামাচ্ছে।সাঁঝ বেরিয়ে আসে।সাইমন কে খুব মনে পড়ছে ওর।চটজলদি ফোন বের করে সাঁঝ। সাইমনের মেসেজ গুলো বের করে পড়তে থাকে।
তারপর সাইমনের নম্বরটা বের করে সেখানে কল দেয়।রিং হচ্ছিলো ওর নম্বর।হঠাৎ কল রিসিভ হতেই সাঁঝ বলল,
''আপনি কই?"
অপরপাশ থেকে মোটা গম্ভীর কন্ঠে কেউ বলল,
''এই মেয়ে কে তুমি?কাকে চাও?"
সাঁঝ কি বলবে ভেবে পেলোনা।কন্ঠ সাইমনের নয়।বয়স্ক লোকের।সাঁঝ বলল,
''আ আমি ওনার অফিস থেকে বলছি।স্যার কে দরকার ছিলো।"
''ওই জানোয়ারটা এখনো ঘুমোচ্ছে।"
''ওকে।"
সাঁঝ ফোন কেঁটে কিছুক্ষন নম্বরটির দিকে তাকিয়ে হঠাৎ হেসে দেয়।সাঁঝের কল দেয়ার কিছুক্ষন পরই সাইমনের ঘুম ভাঙ্গে।বিছানার পাশে ফোন না পেয়ে অনেকটা চিন্তিত হয়ে যায়।কি করবে? কে নিলো ফোনটা?এখানে চোর আসার সম্ভব না কারন খুব কড়া পাহাড়া দেয়া হয়।সাইমন উঠে ফ্রপশ হয়ে নিয়ে রুমে যেতেই দেখলো মামীরা বসে পিঠা বানাচ্ছেন।সাইমনকে দেখে তারা বললেন,
''উঠলে?তোমার মামা তোমাকে দেখলে খবর আছে।"
সাইমন কিছুটা ভয় পেয়ে যায়।তারপর বলল,
''মামী আমার ফোনটা দেখেছেন?আসলে অফিসে কল করতাম।"
বড় মামী এসে বললেন,
''আরে তোমার ফোনতো তোমার মামার হাতে দেখলাম।"
সাইমন কি বলবে ভেবে পেলোনা।ছোটমামী তখন বলতে লাগলেন,
''সাইমন তুমি বসো তোমার নাস্তা দিচ্ছি।"
সাাইমন মাথা ঝাঁকিয়ে বসে পড়ে টেবিলে।
!!!!
পূর্না কে গোসল করানোর জন্য রেডি করছিলো বেলা।রোদ এখন ও আছে।গোসল করিয়ে মেয়েটাকে ছাদে নিয়ে গেলে ভালো হবে।পূর্নার পরনের ফ্রকটা ওর মাথার ওপর দিয়ে টেনে খুলে ফেলে বেলা।তারপর গায়ে সাদা লোমশ তোয়ালে জড়িয়ে দিলো।পূর্না সেই তোয়ালে পরে কোমড় দুলিয়ে মাথা ঝুলিয়ে হাত নেড়ে নাচছে।বেলা মেয়েকে এতোক্ষন নাচতে দেখে ওকে টেনে চুমু খেয়ে বলল,
''ওলে আমার মেয়েটা কতো সুন্দর করে নাচছে।আগে গোসল করো তারপর খেয়ে মাকে নেচে দেখাবে ওকে?"
পূর্না জোরে জোরে মাথা ঝাঁকিয়ে বেলার গলা জড়িয়ে ধরলো।বেলা মেয়েকে সেভাবে কোলে তুলে নেয়।সেই মুহূর্তে বিভান বেরিয়ে আসে।আজ একদম যুবক লাগছে।গালের বড় মাঝারি সাইজের দাঁড়ি গুলো খোঁচা খোঁচা দাঁড়িতে পরিনত হয়েছে।বেশ সুন্দর লাগছে।সেই চৌদ্দ বছর আগের বিভান আজ বেলার সামনে।বেলা একটু হেসেই পরক্ষনে থেমে গেলো।বিভান ও মুচকি হাসে।কিন্তু বেলা বিভানের ঘোর কাঁটিয়ে ওকে পার করে বাথরুমে চলে যায় পূর্না কে নিয়ে।বিভান যতক্ষন বেলাকে দেখছিলো কাল রাতের কথা মনে পড়তেই মৃদু হাসতে অন্তত স্ত্রীকে প্রায় একমাস পর এভাবে ছুঁয়ে দিতে পেরেছে।ওর ঘ্রানে মিশে যেতে পেরেছিলো কিছু সময়ের জন্য।ভিতর থেকে ঝড়নার শব্দ আর ছোট্ট পূর্নার আধো বোল।পূর্না বলছিলো,
''তুইঙ্কেল তুইঙ্কেল লিতেল স্তাল হাউয়াই ওয়ান্দাল হোয়াত ইউ আল।আপ আবাব দা,,,,,,,,,,,, বুলে গেতি মা।"
বেলা তখন বিভানের মনে ঝঙ্কার তুলে হেসে বলল,
''ওরে আম্মু তোমাকে আবার শিখিয়ে দিবো ওকে?"
''ওতত্তে।"
বিভান এবার হেসে বাথরুমের দিকে তাকায়।পূর্না ওদের ঘর না ওদের জীবনটাকে ভরিয়ে তুলেছে।ওর মেয়ে পূর্না ওর আর বেলার মেয়ে।মেয়েটা কে ফুলের মতো করে বড় করবে বিভান।
পূর্নাকে গোসল করিয়ে বেলা ওকে একটা গোলাপী ফ্রক পরিয়ে বলল,
''চলো ছাদে যাই।"
পূর্না ফের জোরে মাথা ঝাঁকায়। মেয়েকে কোলে নিয়ে বেলা চলে যেতে নিবে তখনই বিভান গেঞ্জী পরে বলল,
''আমি ও যাবো।"
বেলা কিছু না বলে থেমে যায়।পূর্না বেলার কোল থেকে নেমে দৌড়ে বিভানের কাছে এসে বলল,
''তাললে বাবাল কোলে উতে দাবো।"
বেলা মেয়ের দিকে চোখ ছোট করে তাকিয়ে বলল,
''এখন মাকে ভুলে গেছিস?"
বিভান বেলার কথায় হেসে মেয়ের গালে চুমু দিয়ে বলল,
''আমার আম্মাটা।"
বেলা মৃদু হাসে মেয়ে আর স্বামীর দিকে তাকিয়ে।পূর্না মায়ের দিকে তাকিয়ে হাসতে হাসতে বলল,
''আলে বোকা আমি কি দুদনের কোলে একতাতে উততে পাববো?তোমাল কোলে তবতময় উতি তাই আদ বাবাল কোলে।"
বেলা হেসে দেয় শব্দ করে।বিভান মেয়ের গালে চেঁপে বলল,
''পাকা মেয়ে আমার ছাদে চলেন আগে।বাহিরে ও তো যাবো তাইনা?"
বেলা বাহিরে যাবার কথায় অবাক হলে ও কিছু না বলে সিড়ি বেয়ে উঠে যেতে থাকে।বিভান ও মেয়ে কে নিয়ে বেলার পিছু পিছু উঠে যেতে থাকে।বেলা পিছন থেকে মেয়ে আর স্বামীর কথা শুনছিলো।বাবা মেয়ের খুনশুঁটি গুলো ওর খুব বেশি পছন্দের।ওরা এসে নিচে মাদুর বিছিয়ে বসে।পূর্না এসেই বেলা আর বিভানের মাঝে বসে বিভানের দিকে চেয়ে জোরে বলল,
''বাবা!!!"
বিভান হেসে বলল,
''কি আম্মু?"
''আদকে অনেক গুলো পুতুল তিনে দেবে ওত্তে?"
বিভান মেয়ের দুগাল চেঁপে বলল,
''ওকে আম্মু।"
''বাবা তুনো?"
''কি মা?"
''মা দাবেনা?"
বিভান বেলার দিকে তাকিয়ে শান্ত স্বরে বলল,
''অবশ্যই যাবে।কেন যাবেনা?"
বেলা ভ্রু কুঁচকে বিভানের দিকে তাকায়।বেলাকে আজ চমৎকার লাগছে বিভানের চোখে।বেলার হলদেটে গাল দুটো লাল হয়ে গেছে রোদের আঁচে।বিভান মেয়ের দিকে তাকিয়ে গান ধরলো
Hoshwalon Ko Khabar Kya
Bekhudi Kya Cheez Hai
Ishq Ki Jaye Phir Samajhiye ..
Zindagi Kya Cheez Hai
Hoshwalon Ko Khabar Kya
Bekhudi Kya Cheez Hai...
Unse Nazar Kya Milin Roshan Fizaein Ho Gayee.......
বেলা বিভানের মুখের দিকে অনেকটা সময় পর্যন্ত চেয়েছিলো।লোকটার কন্ঠ ভীষন সুন্দর।তার চেয়ে ভালো লাগছিলো বেলার লোকটা ওর জন্য গেয়েছে।কিন্তু বিগত দিনগুলোয় তার অবহেলা গুলো বেলাকে ভীষন কষ্ট দিয়েছে।সেগুলো ভুলতে পারেনা বেলা।লোকটা ওর কষ্ট দেখেনি।বেলা অন্যদিকে ফিরে তাকায়।চোখ ভরে আসে ওর।বিভান সেটা বুঝতে পেরে কিছু টা মন খারাপ করে মেয়েকে কোলে নিয়ে বসে থাকে।এদিকে বিকেলে ওরা রেডি হয়ে নেয়।বিভান পূর্নাকে ফিসফিসিয়ে বলল,
''যাও মাকে বলো রেডি হতে।বলো তুমি না গেলে বাবা যাবেনা।বাবা না গেলে আমার পুতুল কেনা হবেনা।যাও বলো।"
পূর্না দৌড়ে এসে কেঁদে ফেলে বেলার সামনে।বেলা বসে চা খাচ্ছিলো।মেয়েকে এই প্রথম কাঁদতে দেখে কিছুটা ভয় পেয়ে বলল,
''কিরে আম্মু কি হইছে?"
''বাবা বলেতে তুমি না গেলে বাবা দাবেনা।আমাল পুতুল কেনা অবেনা।মা তলো না।"
পূর্না কাঁদতে থাকে।বেলা ফিসফিসিয়ে রেগে বলল,
''লোকটাও না!!!!"
বলেই উঠে দাঁড়ায়।পূর্না হঠাৎ হেসে দৌড়ে বিভানের কাছে গিয়ে চিৎকার করে বলল,
''মা দাবে।"
বেলা মেয়েকে এভাবে হাসতে দেখে অবাক।এতক্ষন কেঁদে মুখ ফুলিয়ে ফেলেছিলো আর এখন হাসছে।এই বয়সে এখনই এতো নাটক।বাকি বয়স তো পড়েই আছে।তখন না জানি এই মেয়ে কি করে।
....................সেদিন দুপুরে নিশাদ ভাত খাচ্ছিলো। পাশে কুঞ্জন আর তারপাশে আদনান।ইকরাম রাহমান অনেক আগেই খেয়ে বেরিয়েছেন কাজে।তিন ভাই আর লাবনী চুপচাপ খাচ্ছে।সাঁঝ গোসলে চলে গেলো আর হুমায়রা কলেজে।হঠাৎ জুলেখা বানু এসে নিশাদের পাশে দাঁড়িয়ে বললেন,
''আব্বা একটা কথা কই।রাগ করিস না।"
নিশাদের খাওয়া থেমে গেলো।পানি খেয়ে মায়ের দিকে না তাকিয়ে বলল,
''আম্মা কালকের বিষয় হলে না বলাই ভালো।আমি আমার সিদ্ধান্তে অটল।তুমি খেয়ে নাও।"
''আব্বু আগে শোন কথা।"
নিশাদ খাওয়া ছেড়ে উঠে দাঁড়িয়ে রেগে বলল,
''এখন খাইতে ও শান্তি নাই তাইনা?আমি কোন মেয়ে দেখবোনা।"
বলেই শব্দ করে হেঁটে রুমে গিয়ে দরজা লাগালো নিশাদ।জুলেখা বানু থমকে গেলেন।ছেলের এমন আচরন ওনার সাথে।আদনান কুঞ্জন লাবনী ও অবাক।ভাই এমন করল কেন হঠাৎ।আদনান জুলেখা বানুকে বলল,
'দেখতেছিলা ভাইয়ার পছন্দ হইতেছেনা আবার কেন বলতে গেলা?"
জুলেখা বানু কেঁদে ধমকের সুরে বলতে লাগলেন,
''কাউরই আমার কথা ভাল্লাগেনা।মইরা গেলে বুঝবি মা কি আছিলো।আল্লাহ আমারে নিয়া গেলানা কেন পোলাগোর ঝাড়ি খাওনের আগে?কাঁদতে কাঁদতে পাকঘরে চলে গেলেন জুলেখা বানু।লাবনীর কান্না চলে এলো।ভাইয়ারা মায়ের সাথে এমন আচর কেন করলো?মা তো কাঁদছে।কুঞ্জন বলল,
''ভাইয়া বড় ভাইয়া বকে গেলো তুমি ও বকলা।মা কষ্ট পাইছে।"
আদনান কুঞ্জনের দিকে গরম চোখে তাকিয়ে উঠে চলে গেলো রুমে।কুঞ্জন বলল,
''কেমন নাটক করে এরা দেখলি লাবু?"
লাবনী ফিসফিসিয়ে বলল,
''চলো মাকে দেখে আসি।"
''খাওয়া শেষ করি আমি।তুই ও খেয়ে চল।"
''ওকে।"
কিছুক্ষনের মাঝেই সাঁঝ বেরিয়ে এলো।এতো চিৎকার শুনে জলদি বেরিয়ে এসে কুঞ্জনকে জিজ্ঞেস করলো,
''কি হইছে?"
''বড় ভাইয়া আর মেজ ভাইয়া মায়ের সাথে চিল্লাইছে।মা বড় ভাইয়ারে বারবার কি বলতে চাইতেছিলো।ভাইয়া না করছিলো কিন্তু পরে রেগে চলে গেছে।"
''তো আদনান ভাই কেন রাগ করলো?"
''ভাইয়া না খেয়ে উঠে গেছে।মা বারবার বড় ভাইকে ঐ কথা বলতেছিলো দেখে।"
সাঁঝ কিছুটা বিরক্ত মাখা শব্দ করে পাকঘরে চলে গেলো।জুলেখা বানু পিছে ফিরে কাঁদছেন।সাঁঝ বলল,
''আম্মা আসো ভাত খাও।"
''খামু না আমি।তোগরে আমি জ্বালাই এই জন্য পোলা দুইডা না খাইয়া চইলা গেছে।"
সাঁঝ মায়ের পিঠে হাত বুলিয়ে দিতে দিতে বলল,
''মা।ভাইয়ার যা পছন্দ না কইরোনা।ভাইয়া তো কখনো চিল্লায় না তোমার সাথে।"
''হ সবাইরে বিরক্ত করি আমি।ভাইয়ের বোন হইছোস বড়।যা এহান থেকে।"
''আম্মা চলো।চলো না।ভাইয়া বুঝলে দেখো তোমারে জড়াইয়া ধরবো।কাইন্দোনা চলো।"
জুলেখা বানু সামনে ফিরে কেঁদে বললেন,
''পোলা দুইডা খাইলোনা তো।"
''তুমি আসো আমি ডাকতেছি।"
জুলেখা বানু এসে টেবিলে বসেন।সাঁঝ নিশাদের রুমের দরজা নক করে।নিশাদ কিছু না বলায় ও একটু খুলে দরজাটা।মাথা ঢুকাতেই নিশাদ রেগে বলল,
''কি হইছে?"
''খাইতে আয় ভাইয়া।"
''আমার খিদা নাই যা এখান থেকে।"
''ভাইয়া প্লিজ চল।নাহলে আম্মা খাবেনা।কান্না করতেছে।আদনান ভাই ও খায়নি।"
নিশাদ কিছু বললনা।সাঁঝ বেরিয়ে এসে আদনানের রুমে গিয়ে দেখলো ও ঘরে নেই।সাঁঝ ডাইনিং রুমে এসে দেখলো এক ভিন্ন দৃশ্য।নিশাদ মাকে পিছন থেকে জড়িয়ে বলছিলো,
''আম্মা মাফ করে দিও।আর এমন হবেনা।তুমি চেনোনা তোমার ছেলেকে?আম্মা আমার ভালো লাগেনা কিছু।বুঝো তুমি?আম্মা যখন বিয়ে করবো তোমারে বলবো।কিন্তু আল্লাহর দোহায় এই কথা আর বইলোনা আমারে।"
''আইচ্ছা আব্বা কমুনা।খাইতে বও।"
নিশাদ মায়ের পাশে বসে খেতে থাকে।সাঁঝ হেসে দেয় অশ্রু সিক্ত চোখে।তারপর নিজে ও বসে বলল,
''আম্মা আদনান ভাই বাসায় নাই।বাহিরে গেলো মনে হয়।"
''ওহ আইচ্ছা।আইলে আমারে কইস।"
''জি আম্মা। "
সেদিন বিকেলে নিশাদ ইমতিয়াজের নম্বরে কল দেয়।ইমতিয়াজ ফোন ধরেই বলল,
''যাবি?"
নিশাদ হেসে বলল,
''শালা মাথায় এটাই ঘুরতেছে এখনো?"
''দেখ ফাজলামিনা।তুই না গেলে আমি ও যাবোনা।"
''আমি যাবো।বাট একটা শর্ত।"
''কি?"
''আমি হোটেলে থাকবো।"
...........................সাইমন মামা নানা খালা মামী খালুদের সাথে বসেছিলো।দুপুরে ফোনটা হাতে পেয়ে কলিজাটা যেন ঠান্ডা হয়ে গেলো।কল লগে গিয়ে সাঁঝের নম্বর দেখে ভয়ে ওর হাত পা ঠান্ডা হতে শুরু করে।সাঁঝ কল দিয়েছিলো এবং দুমিনিট কথাও হয়েছিলো।তাহলে কি মামা ওর সাথে কথা বলেছে?মামা হঠাৎ সবার সামনে বলল,
''তুই এখানে শিফট হয়ে যা।ঐখানে তোর ভাই ভাইয়ের বৌ থাকুক।ওদের ও প্রাইভেসি আছে।"
সাইমন গম্ভীর গলায় বলল,
''মামা আমি তো ওদের কোন কিছুতে আটকে রাখিনি।বরং ওনারা ওনাদের মতোই আছে।আমি এখানে কেন আলাদা হবো।ওখানে আমার জব আছে।"
''সেটা বুঝলাম।এখানে ও তোদের কোম্পানির ব্রাঞ্চ আছে।এখানেই অফিস করবি।"
সাইমন উঠে দাঁড়িয়ে বলল,
''মামা আমি এখানে শিফট হবোনা।বিয়ের পর আপনারা আমার মাকে মেনে নেননি।এমনকি ঐ লোক চলে যাওয়ার পর ও আপনারা আমার মাকে ফিরিয়ে নেননি।সেক্ষেত্রে আমার এখানে থাকার প্রশ্নই আসেনা।"
তখনই বড় মামী বললেন,
''সাইমন এগুলো কেমন আচরন মামার সাথে?"
সাইমন মামীর দিকে তাকিয়ে বলল,
''মামী অতীতটা ঘেঁটে দেখেন।সব মনে পড়ে যাবে।আপনি আমার মায়ের বেস্টফ্রেন্ড ছিলেন।কিন্তু আপনার ভাই আমার মাকে প্রেগন্যান্ট অবস্থায় ফেলে চলে গেছে।তখন তো নিতে পারেননি।এমন কি আপনি মামার কান ভরেছেন সেটা কারোর অজানা নয়।আমি এখানে আর থাকবোনা।এক্ষুনি বের হবো।"
বড় মামা রেগে সাইমন কে মারতে গেলে নানা বললেন,
''যেও না তুমি।ও যা বলল মিথ্যে বলেনি।অনেক ভুল করে এসেছি।হয়ত মৃত্যুর আগে এটাই আমার শেষ সময় প্রায়শ্চিত্তের জন্য।"