কিছুটা নীরব হয়ে রইলো বেলা।কি শুনছে ও?ব্যাপারটা কি ঘটছে?কি বলবে ও?কিছু কি বলার আছে?কিছুষন পর তারা চলে আসবে।ঠিক বিকেল পাঁচটায়।ছেলে নাকি সময়ের সম্পর্কে সচেতন।তাহলে সময়ের ওলটপালট হবেনা।শরীর পুরো ঠান্ডা হয়ে এলো বেলার।চোখের সামনে সব ঝাপসা হয়ে আসছে।ও অন্ধ হয়ে যাচ্ছেনা ওর চোখজোড়ায় জন্ম নেয়া অশ্রুগুলো ভারি হয়ে যাচ্ছে যা খানিক বাদেই গড়িয়ে পড়বে।বেলা নিজেকে শক্ত করে রাখলো।কান্না করবে কেন ও?দেখলেই তো বিয়ে হয়ে যায়না।তাইনা?যদি ওকে ওর পরিবারকে ছেড়ে যেতে হয়?কি করে থাকবে ও?বেলা এ মুহূর্তে একটু শুতে চাইছে।মাথার পিছন ঘাড় থেকে ব্যাথা করছে।বেলা খাটের কাছে এসেই বসে পড়লো।তারপর শুয়ে পড়ে বিছানায়।ওর এখন ফ্রেশ হয়ে নেয়া উচিৎ ছিলো।কিন্তু ওর শরীরে এতটুকু শক্তি নেই। কিছু ভাবতে পারছেনা বেলা।ওর চোখজোড়া ভারি হয়ে আসছে।অনূভব করলো গাল বেয়ে অশ্রু গড়িয়ে পড়ার ঘটনা।চোখ বুজে নেয় বেলা।ঘুমিয়ে যায় অজান্তেই।
পাঁচটায় ইদরীস ও তার বাবা মা চলে আসে ইকরাম রাহমানের বাসায়।জুলেখা বানু রেগে যাচ্ছেন।বেলা এখনো ঘুমুচ্ছে কি মনে করে?ও জানে এখন ওরা আসবে।ওনি সাঁঝকে ডেকে বলতে শুরু করেন,
''সাঁঝ যা তোর আপারে উঠা।ওরা আইছে আর ও এখনো ঘুমাইতাছে।"
সাঁঝ বেলার রুমে চলে আসে।বেলা বিছানায় ডান দিকে কাঁত হয়ে ঘুমুচ্ছে।সাঁঝ বোনের পাশে বসে ওর কাঁধ ধরে ডাকতে থাকে।
''আপা ওরা চলে আসছে।"
বেলার ঘুম ভেঙ্গে যায় সাঁঝের ডাকে।বোনের দিকে ফিরে বলল,
''আগে ডাকবিনা?"
''বেশিক্ষন হয়নাই।এখন গল্প করতেছে।উঠে আয়।"
বেলা উঠে ফ্রেশ হয়ে নেয়।ওরা এখন বসে আব্বা আর নিশাদের সাথে কথা বলছে।ততক্ষনে বেলা ফ্রেশ হয়ে হালকা গোলাপি বর্নের জামদানী কাপড়ের স্যালোয়ার কামিজ পরে নেয়।চোখে সবসময়কার মতো কাজল।তারপর মাথায় ঘোমটা টেনে নেয়।জুলেখা বানু ওর রুমে এসে মেয়ে কে দেখে বেশ খুশি হয়ে বলেন,
''ওদের খুব পছন্দ হবে আমার মাইয়ারে।দেখিস সাঁঝ তোর আপারে পছন্দ হইবো।"
বেলা মলিন হাসে মায়ের দিকে।জুলেখা বানু আর সাঁঝ মিলে বেলাকে ওদের সামনে নিয়ে আসে।ছেলের দিকে একবার ও তাকায়নি বেলা।সেখানে বসতেই সমস্ত ভয় ওর ওপর জেঁকে বসলো।বেলা একদম সোজা হয়ে বসে আছে।লোকটার মা এসে ওর পাশে বসলো।তারপর বলল,
''তুমি কুরআন খতম দিছো?"
''জি।"
কাঁপন ধরা কন্ঠে বলল বেলা।ওনি বললেন,
''একটা সুরা কও তো।"
বেলা সুরা ফিল বলে থামলো।মহিলা মনে মনে যেন খুশিই হন।তারপর ওকে জিজ্ঞেস করেন,
’'রান্না বান্না পারো?"
''জি মোটামুটি। "
''ওহ ভালা।একটু দাঁড়াও তো।"
বেলার ভীষন খারাপ লাগছে তারপর ও দাঁড়িয়ে পড়ে।তারপর দু এক কদম হেঁটে আবার ও বসে পড়লো আগের জায়গায়।মহিলা খুব খুশি।বেলার চুল খুলে ফেলেন।তারপর বলেন,
''মাইয়ার চুল মাশাল্লাহ।"
মায়ের এসব একদম ভাল লাগছেনা ইদরীসের।সে বলল,
''কি করছো এসব মা?এখন এসব কেউ দেখেনা।"
''চুপ থাক।আমার বৌরে একদম পুরাপুরি পছন্দ কইরাই নিমু।কি কও বেলা?"
বেলার কান্না পাচ্ছে।ওকে এমন ভাবে চেক করা হচ্ছে যেন হাঁট থেকে গরু কিনছে।তারপর ও কোনমতে বেলা বলল,
''জি।"
ইদরীস বলল,
''ওনার সাথে একটু কথা বলবো আপনারা যদি কিছু মনে না করেন।"
ইকরাম রাহমান স্ত্রীর দিকে তাকান।জুলেখা বানুর মুখে বিস্ময় ফুঁটে উঠেছে।ইকরাম রাহমান বললেন,
''যান বাবা।বেলা নিয়া যা ওনারে।"
ওরা বারান্দায় এসে দাঁড়ায়।লোকটা বলল,
''আমি দুঃখিত আমার মা এমন করবেন জানতাম না।"
''ইটস ওকে।কিছু মনে করিনি।"
''হুম।আপনি তো জব করেন।বিয়ের পর ও কি করবেন?"
''ইচ্ছে তো আছে।"
''অবশ্যই করবেন।করতে হবে।তবে একটা সময় অফ করতে হবে।কারন আপনি যখন মা হবেন তখন বাবুর পিছনে ও সময় দিতে হবে।"
''জি।"
''পড়াশুনা তো বাকি আছে তাইনা?"
''জি।"
''আচ্ছা।মাস্টার্স করার ইচ্ছা আছে?"
''জি।"
''কিন্তু আমি শীঘ্রই বাবু নিতে চাই।হয়ত এ জন্য আপনাকে পড়াশুনা বন্ধ করতে হতে ও পারে।"
''দেখুন আমার মনে হয়না এজন্য পড়াশুনা অফ করতে হবে।"
''তাও ঠিক।আপনি চালিয়ে যেতে পারলে আমার প্রবলেম নেই।"
বেলা কিছু বললনা।লোকটা বলল,
''আমাদের যাওয়া উচিৎ।"
''জি চলুন।"
সেদিন নাস্তা করে চলে যায় ওরা।পরদিন সকালে ইদরীস ইকরাম রাহমান কে জানায় বেলাকে বিয়ে করতে রাজি সে।ইকরাম রাহমান জানান বেলার কথা ওনি জানিয়ে দেবেন শীঘ্রই।এদিকে সেদিন কলেজ প্রাঙ্গনে বিভানকে দেখতে পায় বেলা।অবাক হয়ে যায় ও।ওর ভার্সিটি কিভাবে চিনলো লোকটা?সেদিন তো কলেজ থেকে দূরে এসেছিলো।আর আজ মাঠেই চলে এলো।বেলা অন্যদিকে চলে যাচ্ছিলো।বিভান দৌড়ে এসে ওর সামনে দাঁড়ায়।তারপর বলল,
''ভালো আছেন বেলা?"
''আপনি এখানে কেন?চলে যান।"
''শুনুন আপনাকে খুব মনে পড়ছিলো তাই এলাম।চলুন কোথাও বসি।"
''কোথা ও যাচ্ছিনা আপনার সাথে।প্লিজ চলে যান।"
''দেখুন বেলা কাল বলেছিলাম আপনার পিছু এতো সহজে ছাড়ছিনা।আপনাকে ভালবাসি আমি। সেটা আপনি বুঝতে পারছেননা কেন?"
বেলা বেশ রেগে গেলো।শক্ত গলায় বলল,
''দেখুন এটা আমার ভার্সিটি।এখানে এমন তামাশা করার মনে হয়না।চলে যান।"
বিভান বেলার কাঁধে হাত রেখে কিছু বলতে গেলে বেলা ঝাড়ি দিয়ে বিভানের হাত ফেলে দিলো।বিভান বলল,
''কথা বলতে চাইছি।চলে আসুন।না হলে কোলে নিয়ে নিবো।আমি কিন্তু লজ্জা পাইনা।কিন্তু আপনার ভীষন লজ্জা লাগবে।"
_________________________________________
বেলা ভাবতেই পারছেনা বিভান এভাবে কথা বলছে।এখন ও না করলে যদি লোকটা সত্যি ওকে কোলে তুলে নেয় ভীষন লজ্জায় পড়তে হবে ওকে।তাই বেলা বলল,
''চলুন তাহলে।"
''শুকরিয়া।"
ওরা পাশেই এক কোনায় গিয়ে বসলো ছাউনির নিচে।বেলা একটু দুরত্ব বজিয়ে বসলে ও বিভান ওর পাশ ঘেঁষে বসতেই বেলা চোখ রাঙ্গিয়ে তাকায় বিভানের দিকে।বিভান হেসে বলল,
''বেলা আমার কথা শুনুন।বুঝার চেষ্টা করুন।আমার ভালবাসা মিথ্যে হলে কখনো আপনার পিছু নিতাম না।"
''এখন বুঝে কি হবে?আমি আপনার সাথে চলে যাবো?আপনার গলা ধরে ঝুলে যাবো?কি মনে করেছেন বেলা আপনার এসব কথায় গলে যাবে?নেভার।আমি আপনাকে ভালবাসিনা আগে ও বলেছি।আর আমার বিয়ে ঠিক হয়ে গেছে।আমি বললে বিয়ে টাও হয়ে যাবে।"
বেশ শক্ত গলায় বলল বেলা।
বিভানের পুরো শরীর কেমন কেঁপে উঠলো।কোনমতে নিজেকে সামলে বলল,
''আপনি তো হ্যা বলেননি এখনো।"
''বলবো। সময় কি চলে গেছে নাকি?"
''আপনি বলতে পারেননা বেলা।"
''কেন পারবোনা।তাকে আমার ভালো লেগেছে।বিয়ে করবো আমি।আর প্লিজ আমার পিছু নেয়া ছেড়ে দিন।"
বলে বিভান কে কথা বলার সুযোগ সময় না দিয়ে উঠে ক্লাশে চলে যায় বেলা।বিভান একদম স্তব্ধ হয়ে যায়।দেখতে আসার খবরটা ও জানতো।কিন্তু বেলা এতো সহজে রাজি হবে এটা ওর জানা ছিলো না। বিভান সেখানে কতোটাসময় বসেছিলো জানা নেই ওর।এদিকে সেদিন বেলা হ্যা বলে দেয়।তবে মনের অতি বিরুদ্ধে।কারন বিভানকে পিছু ছাড়াতে চায় ও।বেলার হ্যা বলার পর হতে বিয়ের প্রস্তুতি চলতে থাকলো।এইতো সেদিন বেলাকে আংটি পরিয়ে গেলো ইদরীসের মা বাবা।বেলা বুঝতে পারছেনা পারছেনা সময়টার অনুভূতি নিতে।ও চায় বিভান ওকে ছেড়ে চলে যাক।কিন্তু সেটা হয়না বিভান ওর পিছু নেয়া বাড়িয়ে দিয়েছে।বেলা যেখানে যায় সেখানে বিভানকে দেখতে পায়।শপিংমলে ও পর্যন্ত এসে গিয়েছিলো তবে কাছে আসেনি দূর থেকে বেলা ইশারা করেছিলো।বেলা বুঝতে পারেনা ওর প্রত্যেক সময়ের খবরাখবর বিভান কিভাবে পায়?ওকে ফলো করছে নাতো।ওর নম্বর ট্র্যাক করেনি তো?বেলার হলুদ শেষ হয়ে যায়।তবে খুব নরমালি হয়েছিলো সব।দুদিন পরই ইদরীস নামক লোকটার সাথে বিয়ে ওর তারপরই ওর পরিবার ছেড়ে চলে যাবে।বিভান নামক লোকটাও থাকবে না ওর জীবনে।বেলাদের ঘরে এসে গেছে ওর মামাতো খালাতো ভাই বোনেরা।সবাই একসাথে মজা করছে।নিশাদ খেয়াল করছে বিয়ে ঠিক হওয়ার পর থেকে বেলা একদম চুপ হয়ে গেছে।তেমন কথাও বলে না কারোর সাথে।এমনকি একয়দিন কলেজে ও যায়নি ও।
বিভান হোটেলের সামনে একটা বেঞ্চে বসে আছে।ও জানে বেলার হলুদ আজ।ও হয়ত শ্যমবতীকে হারিয়ে ফেলতে যাচ্ছে।কিন্তু ও তো হারাতে পারেনা।ওর ভালবাসা সত্যি। ও বেলা কে চায় খুব করে।বিভান চোখ মুছে সিগারেটো লম্বা টান দিয়ে সেটাকে রাস্তায় ফেলে পা দিয়ে চেঁপে ধরলো।ও হাল ছাড়বেনা।বেলাকে পেয়ে ছাড়বেই।পাশের হোটেল রুমের দিকে চোখ যায় বিভানের।রুম টা ওর।এখানে আছে আর এক সপ্তাহ।এরই মাঝে কিছু করতে হবে।বেলাকে বুঝাতে হবে ও কতোটা ভালবাসে।
বেলা বিছানায় শুয়ে আছে।সাঁঝ বেলার মেহেদী তে লেবু আর চিনি মিক্স করে তুলা দিয়ে লাগাচ্ছে তাহলে রং গাঢ় হবে।সাঁঝ বলল,
''আপা!!"
''বল।"
''তুই কি সত্যিই রাজি বিয়েতে?"
বোনের দিকে অবাক চোখে তাকায় বেলা।তারপর বলল,
''হুম কেন?"
''আপা তুই রাজি না আমার মনে হচ্ছে।মনের বিরুদ্ধে গিয়ে কিছু করবিনা।"
''দেখ সাঁঝ তুই খুব ছোট বুঝতে পারছিসনা তুই।আমি রাজি।এসব বলিসনা আমার সামনে।"
''আপা আমি সত্যিই বলছি তুই রাজি না।"
বেলা এবার বোনের কথায় অবাকের পাশাপাশি ভীষন রাগ হলো।ও উঠে বসে বলল,
''একটা কথা বল বিভানকে তুই তোর নাম্বার দিয়েছিস তাইনা?"
সাঁঝ চুপ হয়ে গেলো।ধরা পড়ে গেছে ও।কিন্তু বোনের খুশির জন্য সবটা বলতে হবে ওকে।দেরি হয়ে যাবার আগে।
!!!!
বিদ্ধস্ত একটি রাস্তা বেয়ে হেঁটে চলেছে বিভান।গায়ে সাদা একটি পাঞ্জাবী জড়ানো ওর।দুপাশে আছে কালো রং এর গাছ।আগুন জ্বলছে এখানে ওখানে।বিভান বুঝতে পারছেনা সময়টা কখন?কারন আকাশের রং পুরো পরিবেশ কিছুটা আঁধার আলোর মাঝে।বিভান জানে না ও কেন এ রাস্তা ধরে হাঁটছে কারন পরিবেশটা চেনে না ও।রাস্তাটাও পরিচিত না।ও দিল্লিতে প্রত্যেকটা রাস্তা গলি সব চিনে।কিন্তু এ জায়গাটাকে না মনে হচ্ছে বাংলাদেশ না ইন্ডিয়া না মুম্বাই না দিল্লি।তাহলে কোথায় ও?বিভান খেয়াল করছে যতো দূর এগুচ্ছে ততো বেশি আগুন জ্বলছে।ও বিস্ময় নিয়ে দুপাশে চোখ বুলিয়ে হেঁটে যাচ্ছে সামনে।থামতে পারছেনা।কোন এক অদৃশ্য শক্তি ওকে টেনে নিয়ে যাচ্ছে।হাঁটতে হাঁটতে হঠাৎ বিভসন খেয়াল করলো ও এতটাসময় একটা পাহাড়ের ওপর হাঁটছিলো যেখানে বেলার সাথে ওর দ্বিতীয়বার দেখা হয়েছিলো কথা হয়েছিলো সীমিত।আশেপাশে তাকিয়ে সামনে তাকায় বিভান।বেলা ওর সামনে দাঁড়িয়ে। বিভানের চোখে ঘোর লেগে গেলো।এতো সুন্দর কেন লাগছে বেলাকে?গায়ে কালো শাড়ী জড়ানো।লম্বা চুল গুলো বাতাসে উড়ছে।বেলার চোখে পানি কিন্তু হাসছে ও।বিভান বেলার কাছে এগিয়ে আসতেই বেলা মাথা নেড়ে এগুতে নিষেধ করলে বিভান বলল,
''না করো না।আপনাকে চাই বেলা।ভালবাসতে চাই।"
বেলার চোখজোড়ায় অশ্রু ভারি হয়ে আসে।ও ভাঙ্গা গলায় বলতে থাকলো,
''তা সম্ভব নয় বিভান।আপনার হতে পারবোনা।চাই আপনাকে খুব করে চাই কিন্তু পারবোনা আপনাকে নিজের করে নিতে।"
বলে আর দুয়েক পা পিছিয়ে গেলো বেলা।বিভান ওর দিকে এগিয়ে বলল,
''জেন পারবেনা তুমি?আমাদের দেশ আলাদা ধর্ম নয়।ভালবাসা তো হারাম নয় বেলা।তোমাকে সত্যিই চাই।তোমার সরলতা আমাকে তোমার দিকে নিয়ে এসেছে।"
বিভানের এগুনোয় বেলা আরো পিছিয়ে বলল,
''জানি বিভান আমাদের ধর্ম এক কিন্তু সমাজ তো ভিন্ন।আমাদের কখনো মেনে নেবেনা সমাজ।"
''মানিয়ে নেবো বেলা।পিছাবেননা পড়ে যাবেন।"
''আপনাকে ভালবেসে মৃত্যু হলে কষ্ট থাকবেনা বিভান।"
পুরো কথাটা যেন হাওয়ায় মিলিয়ে গেলো সাথে তীক্ষ্ন চিৎকার।সামনে বেলা নেই।একটু আগেই পাহাড় থেকে পড়ে গেছে ও।বিভান আরেকটু এগিয়ে গেলো।সামনে ঘন কালো অন্ধকার।কিছুই দেখা যায়না।বিভান উঠে বসে।নিজেকে হোটেল রুমে দেখে কিছুটা আশ্বস্ত হলে ও পরক্ষনে প্রচন্ড ভয় জেঁকে ধরলো ওকে।কি দেখলো এটা?বেলা ঠিক আছে তো?এখন সাঁঝকে কল দিতে ও পারবেনা কারন অনেকটাই রাত হয়ে গেছে।বিভানের মন বড় অস্থির রুপ ধারন করেছে।বিছানায় বসে পুরো স্বপ্নটাকে ভাবতে লাগলো।ওর লোম খাড়া হয়ে গেছে।বিভান ঘড়ি দেখলো।তিনটা বাজে।ফজরের আজান হতে সময় আছে।ও এতক্ষন কি করবে?কিছু না ভেবেই ওয়াশরুমে চলে গেলো ওজু করতে।তারপর ফিরে এসে নফল নামাজ আদায় করতে দাঁড়িয়ে গেলো।এদিকে সকালে বেলা ড্যান্স ক্লাশে চলে আসে।আজ একদম নাচতে পারলোনা।বারবার তাল হারিয়ে ফেলছিলো।ওর নিজেরই কেমন লাগছে।এমন কখনো হয়নি তাহলে আজ নাচতে পারছে না কেন?ক্লাশ শেষে টিচার্স রুমে এসে বসলো এক মগ লাল চা নিয়ে।পাশে বসে আছে আশফিয়া ম্যাম।ওনি বেলাকে দেখে বললেন,
''তোমাকে এমন লাগছে কেন বেলা?"
বেলা কিছুটা অবাক হয় ম্যামের কথায়।তারপর শান্ত গলায় বলল,
''কেন ম্যাম?কি হয়েছে?"
''কোন মেন্টাল প্রেশারে আছো?"
''না ম্যাম তেমন কিছু না।"
''তোমার তো কাল বিয়ে।আজ এমন হয়ে আছো।তোমার গলায় কেমন অসুস্থতার ভাব।কি হয়েছে বলো। "
''না ম্যাম আসলে একটু চিন্তা লাগছে।তেমন কিছুনা।একটু ভয় লাগা কাজ করছে এতুটুকুই।"
আশফিয়া ম্যাম হেসে বললেন,
''বেলা ভয় লাগা টা স্বাভাবিক।মেয়েদের স্বাভাবিক ভাবেই এক সময় হাজবেন্ডের ঘরে যেতে হয়।তোমার মা ও এসেছে আমি ও গিয়েছি।তোমাকে ও যেতে হবে।সো এটা নিয়ে এত দুশ্চিন্তা করোনা।তুমি খুব ধৈর্যশীল কাঁটিয়ে উঠতে পারবা।"
''জি ম্যাম দোয়া করবেন।"
''সেটা তো অবশ্যই করি।তা জব করবে তো?"
''জি ম্যাম ওনি করতে বলেছেন।তবে একটু জলদি বেবি নিতে চাইছেন।বললেন হয়ত স্টাডি ও ছাড়তে হবে।"
বেলার কথায় ছিটকে গেলেন আশফিয়া ম্যাম।ভ্রু কুঁচকে বললেন,
''কি বলো এসব?মাথা ঠিক আছে?পড়াশুনা কি আমরা করিনি?জানো সাতমাসের প্রেগন্যান্ট অবস্থায় ইন্টার পরীক্ষা দিয়েছি।পড়াশুনা শেষ করেছি বিয়ের পর।"
বেলা মাথা নিচু করে।ওর নিজেরই ভালো লাগেনি ইদরীসের কথা।তারপর ও বলার মতো কিছুই পেলোনা।বেলাকে চুপ থাকতে দেখে আশফিয়া ম্যাম বললেন,
''একথা গুলো তোমার হবু বর বলেছে?"
''জি ম্যাম।"
''বিয়েতে হ্যা বললে কেন?সে তোমাকে চাকরানী বানিয়ে রাখবে।তুমি খুব ভাল মেয়ে বুদ্ধিমতি ও। এভাবে কেন হা বললে?দুনিয়ায় ছেলের অভাব পড়েছে?"
''না ম্যাম তা না।আসলে,,,,,,"
''কি আসলে কি?কাজ টা ঠিক করো নি।তোমাকে এই লোক পড়াশুনা করতে দেবেনা যতদূর মনে হচ্ছে।তার কথায় ঠিক নেই।"
বেলা জানে সেটা।তবে বিয়েতে হ্যা বলেছে বিভান যেন চলে যায় ওকে ছেড়ে।
________________________________________
আশফিয়া ম্যাম আবার কি যেন ভেবে বললেন,
''আচ্ছা তুমি কি কোন প্রেশারে পড়ে বিযেটা করছো না তো?বলো আমাকে?কোন প্রেশার?"
''না ম্যাম।সেটা না।ওনাকে ভাল লেগেছে আমার।"
''আই কান্ট বিলিভ বেলা।তুমি এমন মেয়ে নয়।তুমি শুধু একজনের চেহারা দেখে তাকে বিয়ে করছো বিশ্বাস করতে পারছিনা। কোন ঘাপলা আছে।"
আশফিয়া ম্যাম আরো কিছু বলতে গেলে বেলা উঠে দাঁড়িয়ে বলল,
''আমাকে ছুটি নিয়ে আসতে হবে প্রিন্সিপালের কাছ থেকে।"
কথাটা বলে বেরিয়ে আসে বেলা।কথাগুলো সত্যি।তবে ও অসহায়।না করতে পারেনি।কিভাবে না করতো?বিভান ওর পিছুই ছাড়ছিলোনা।বিভানের সাথে ওর যায়না।লোকটা খুব ভালো।সে অনেক ভালো কিছুর যোগ্য বেলার নয়।বেলার সমাজ যেমন ওনাকে মেনে নেবেনা ঠিক তেমনি বিভানের সমাজ ও।ওদের দেখা হওয়াটাই ভালো ছিলো না।কেন দেখা হয়েছিলো।কেন না চাইতে ও মন দিয়ে দিলো?ওয়াশরুমে ঢুকে যায় বেলা।কাঁদতে লাগলো।ওর বাবা ভীষন ঘৃনা করেন দিল্লির মানুষকে।তাদের ছায়টাও মাড়াতে চাননা।দাদা খুন হয়েছিলো বলে।সেদিন ছুটি নিয়ে ঘরে ফিরেনি বেলা।ধানমন্ডি লেকে চলে আসে।এ জায়গাটা বড় শান্তির।লেকের পানি গুলো দেখলে কেন যেন মনটা ঠান্ডা হয়ে আসে।বেলা চোখ মুছে নিয়ে খেয়াল করলো ফোন ভাইব্রেট করছে।ব্যাগ থেকে ফোন বের করে দেখলো নিশাদের কল।কল রিসিভ করে বেলা নিশাদ কে কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে বলল,
''আমি বলতে পারবোনা কই আছি।শান্তির জায়গা লাগবে আমার।চিন্তা করিসনা ঠিক আছি।"
বলেই কল কেঁটে দেয়া বেলা।নিশাদ ফোন রেখে অবাক।আপা কখনোই এমন করেনা।আজ কন্ঠস্বরটা ও কান্না জড়িত ছিলো।কি হয়েছে আপার?ব্যাপারটা জানতে হবে। আপার শান্তির জায়গা কোথায় হতে পারে?পানি ভীষন পছন্দের।এখানে পানি কোথায় আছে?নিশাদ ভাবছে পাশ্ববর্তী কোন লেক কিংবা কিছুর কথা।তারপর বেরিয়ে পড়লো ভার্সিটি থেকে।হাঁটতে হাঁটতে ধানমন্ডি লেকে চলে আসে নিশাদ।ভিতরে ঢুকে হাঁটতে শুরু করে।কিছুদূর এগিয়ে দেখলো একটা বেঞ্চে বসে আছে বেলা।নিশাদ দুটো আইসক্রিম কিনে বোনের পাশে এসে বসলো।হাতের কোনটা বেলার দিকে ধরে বলল,
''আইসক্রীম গলে যাওয়ার আগে খেয়ে নে।"
বেলা ভাইয়ের দিকে তাকিয়ে নিজেকে সামলাতে পারেনা।নিশাদকে জড়িয়ে ধরে কান্না করে দিলো।নিশাদের চোখ ও ভরে এসেছে।
''কি করবো নিশাদ?কেমনে যাবো তোদের ছেড়ে?আমি তো জীবন্ত লাশ হয়ে থাকবো সেখানে।প্লিজ আটকা আমাকে ভাই।আমি পারবো না রে।"
নিশাদ কিছু বলতে পারলোনা।বলার অবস্থায় নেই ও।শুধু মাত্র বেলার চুলে হাত বুলিয়ে স্বান্তনা দিতে থাকলো।ঘরে যাবার পথে সবার জন্য আইস্ক্রীম কিনে নিলো বেলা। আজই তো ঘরে শেষ দিন ওর।মানুষ গুলোর দেখা কবে পাবে কে জানে?বিকেলে কাজিনরা এলো।ওদের সাথে সময় কেঁটে গেলো ভালভাবেই।মামা মামী রাও এসেছিলো।বেলা কে দোয়া দিয়ে গেলেন।তারপর এলো রাফসান স্মিতা আর কাকি।
নিশাদ রাফসান দেখে প্রচন্ড রেগে শলা ধরতেই আদনান ওর হাত চেঁপে ফিসফিসিয়ে বলল,
''ভাইয়া করিসনা এমন।কাল আপার বিয়ে মনে আছে তো?একটু কষ্ট করে সহ্য করে নে।"
নিশাদ রাগী কন্ঠে বলল,
''কুত্তার বাচ্চার সাহস কিভাবে হয়েছিলো সাঁঝকে বাজে কথা বলার?আপার জন্য এতো খারাপ প্রপোজাল আনার?"
''ভাইয়া ওরা যেমন তেমন কাজই করবে বাদ দে। "
কাকি বেলার কাছে এসে ওর মাথায় হাত রেখে বললেন,
''ভালো থাকিস।হয়ত তোরা ভাল প্রস্তাব এনেছিস।আশা করি সব ভালোই হবে।"
''জি কাকি দোয়া করবেন।"
''হুম।"
কাকি পাঁচহাজার টাকা বেলার হাতে গুঁজে দিলেন।বেলা নিতে না চাইলে বললেন,
'রাগ কাকা আর ভাইবোনের ওপর।টাকা আনি দিয়েছি নিয়ে নে।"
''কাকি রাগের জন্য না।আপনাদের দোয়া লাগবে।"
''আর কারো না থাকলে আমার দোয়া আছে।"
বেলা হাসে।কাকি চলে যায়।রাত হয়ে আসে।নয়টা বাজলো সবে।খাটে বসে আছে বেলা।বুক কাঁপছে ওর।হঠাৎ রুমে প্রবেশ করলো সাঁঝ।হেসে বলল,
''ছাদে যাই চল।"
''ভালো লাগছেনা।আমার পাশে এস বস।"
সাঁঝের মুখ কালো হয়ে আসে চিন্তায়। বোনের পাশে বসতেই বেলা সাঁঝের হাত চেঁপে ধরে চোখোর পানি ছেড়ে দিলো।কথা ও বলতে পারছেনা।কেঁদে কেঁদে বলল,
''আমি চলে যাওয়ার পর বড় মেয়ে তুই।তার বাবা মাকে দেখে রাখতে হবে।আমার দায়িত্ব গুলা পালন করতে হবে।আমার না থাকাটা বুঝতে দিসনা কাউকে।আমি কিভাবে যাবো বল,?আমি নিজেকে বুঝাতে পারছিনা।তোদের ছাড়া থাকতে হবে দিনের পর দিন মাসের পর মাস।আমি কিভাবে থাকবো বল?চিন্তায় আসলেই গা কেঁপে উঠে।নিজেকে সামলাতে পারিনা।"
বোনের কথায় সাঁঝের চোখ ভরে আসে।সাঁঝের মাথায় ঘুরছে অন্য কথা।বেলা বিভানকে ভালবাসে সেটা সাঁঝ বুঝে গেছে কিন্তু বেলা বুঝতে চাইছেনা।বাবার ঘৃনার কারনে এতবড় কোরবানী ওর বোন দিচ্ছে।
সাঁঝ বেলাকে জড়িয়ে ধরে।