বিছানায় বিভান কাজ করার মাঝে বেলাকে একপলক দেখে নেয়।বেলার চোখজোড়া তিনটা টিকিটে আটকে আছে।গোয়ার টিকিট এগুলো।
ফ্ল্যাশব্যাক
তখন রান্না সেড়ে রুমে আসতেই মেয়ের হাসি শুনতে পায় বেলা।অনেক জোরে হাসছিলো পূর্না।বেলা কিছুটা বিস্মিত হয়।মেয়েটা এভাবে হাসছে কারন কি?বেলা দ্রুতপায়ে রুমে এসেই দেখলো পূর্না টিকিট নিয়ে লাফাচ্ছে আর বলছে,
''আমলা গুততে দাবো!!তমুদ্দ দেকবো!!!অনেকদিন তাকবো!!!!ইয়াহু!!!!!
বেলা কিছুটা অবাক।ঠোঁটে হাসি ফুঁটে উঠেছে ওর।মেয়েটা কে খুশি দেখে মনটা ভরে গেলো।বিভান পাশে বসে মেয়েকে দেখে হাসছে।বেলা কে দেখে পূর্না খাট থেকে নেমে মায়ের কাছে এসে দাঁড়িয়ে টিকিট গুলো বেলার দিকে উঁচু করে বলল,
''মা দেকো।বাবা তিকিত এনেতে। আমলা কাল তমুদ্দ দেকবো।"
বেলা মেয়ের উৎসাহে হেসে দিয়ে বলল,
''আম্মু এগুলো রাখো।আমরা ফ্রেশ হয়ে নেই। তোমার হাতে পায়ে ময়লা লোগে গেছে না মা?"
বিভান কিছুটা গম্ভীর স্বরে বলল,
''ওকে ফ্রেশ করে দিয়েছি আমি।কাল দুপুরের ফ্লাইট।প্যাকিং সাড়তে হবে।"
বেলা পূর্নাকে কোলে নিয়ে বিছানার একপাশে শুয়ে দিয়ে পূর্নাকে জড়িয়ে আধশোয়া হলো।বেলা পাশে ঘুমুলে পূর্না দ্রুত ঘুমিয়ে পড়ে। বিভান বেলার দিকে চোখ তুলে তাকালো।পূর্না মায়ের গাল স্পর্শ করছে ঘুমুঘুমু চোখে। বিভান শান্ত স্বরে বলল,
''ওকে ঘুম পাড়িয়ে দাও।আমরা প্যাকিং করে নিবো। "
বেলা চুপ করে মেয়েকে ঘুমপাড়াচ্ছিলো।বিভান বলল,
''বেলা আমরা পাঁচদিনের ট্রিপে যাবো।আসতে যেতে দুদিন আর মাঝে পাঁচদিন,মোট সাতদিন।"
বেলা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলল,
''হুম।"
পূর্না ঘুমুতেই বেলা উঠে লাগেজ সামনে নিয়ে তিনজনের কাপড়চোপড় বের করে আনে।বিভান স্ত্রীকে দেখছে।বেলা একদম চুপচাপ হয়ে আছে কথাই বলছেনা।বিভান উঠে এটা ওটা এগিয়ে দিতে থাকে। কাপড় মোটামুটি গোছানো হলে বেলা সেগুলো রেখে বিছানার চাদর ঠিক করছিলো।এরমাঝে বেলা একটা কথাও বলেনি। বিভান উঠে বেলার হাত ধরে বলল,
''আসো আমার সাথে। "
বেলা বিরক্তিসূচক শব্দ করে ফিসফিসিয়ে বলল,
''চাদর ঠিক করছি দেখেননা?"
রুমের আলো নিভিয়ে বেলাকে টেনে বের করে আনে বিভান।তারপর অন্যএক রুমে নিয়ে দরজা ভিড়িয়ে বেলাকে দাঁড় করায় বিভান। বেলা চোখ রাঙ্গিয়ে কিছুটা রাগী সুরে বলল,
''এমন কেন করছেন?"
বিভান কিছুটা রাগী গলায় বলল,
''বেশি করছো তুমি।কথা বলছো না কেন?খারাপ লেগেছে সেটা আমাকে বলবে তো।না বলে মনের মধ্যে আটকে রাখার কোন মানে হয়না। "
''কি বলবো আপনাকে?মাঝে মাঝে এমন আচরন করেন যেন কিছুই করিনি আপনাদের জন্য।গত তেরবছর যাবৎ কি করিনি?সব সহ্য করে গেছিলাম শুধু আপনার জন্য।কিসের কমতি রেখেছিলাম?ভালবাসায় কখনো ঘাটতি ছিলো বলে মনে হয়না আমার।কিন্তু আপনার!!!নুন থেকে চুন খসলে আপনি আমাকে চিনেননা যা তা বলে বসেন।
আমি মেয়ের জন্য কিছু করিনা?ঘরে কতক্ষন থাকেন আপনি?কতক্ষন দেখেন ওকে?বিভান আমি ওর মা।অনেক কিছু সামলে ওকে দেখি সবচেয়ে ভালো দেয়ার চেষ্টা করি।যখন মা হতে পারছিলাম না তখন আমার কিন্তু কম হাহাকার ছিলোনা।কিন্তু আপনি আমাকে সেটা নিয়ে ও কথা শুনিয়েছেন। কিছু বলার নেই বিভান।আমি যা পেয়েছি শোকর আদায় করি আল্লাহর কাছে আশার থেকে ও অনেক বেশি পেয়েছি কিন্ত মাঝে মাঝে আপনার কথা খুব কষ্ট দিয়ে ফেলে আমি আর নিতে পারিনা এসব।"
বিভান কথা গুলো শোনার সময় বেলাকে দেখছিলো। ওর চোখজোড়া জ্বলজ্বল করছিলো। বিভানের ভীষন খারাপ লাগতে থাকে বেলার কথা গুলোয়।বেলা মিথ্যা বলেনি। বিভানের অনেক দোষ আছে এই সংসারে। কিন্তু বাবুকে নিয়ে ও মন থেকে এসব বলেনি।ভীষন চিন্তিত ছিলো ও।ব্যাবসায়ে এত বড় প্রজেক্ট লস ওর জন্য সহজ ছিলোনা।বিভান ধপ করে সোফায় বসে পড়ে মাথার দুপাশে হাত চেঁপে ধরে। বেলা কথা থামিয়ে বিভানের দিকে তাকায়।লোকটা কিছু না বলে এভাবে বসে পড়লো।কি হয়েছে তার?যখন সে ভীষন চিন্তা করে তখন এমন করে।বিভান হঠাৎ বলল,
''বেলা আমি তোমাকে ঐদিন মন থেকে কিছুই বলিনি।তুমি ভুল বুঝোনা প্লিজ।আমি খুব সমস্যায় আছি।এর মাঝে ও গোয়ার টিকিট করে ফেললাম। কিন্তু এত বড় প্রজেক্টটা হাত ছাড়া হয়ে গেলো আমার। কি করবো আমি বলো?আমি সত্যি দুঃখিত।আমাকে মাফ করে দিও।"
বেলার চোখভরে আসে।বিভানের সামনে বসে হাত দুটো নিজের হাতে নিয়ে নরম গলায় বলল,
''আমি ও সরি অনেক কিছু বলে ফেললাম।কিন্তু আমি আমি এগুলো এভাবে বলতে চাইনি।বিভান আমি জানতামনা আপনার এতবড় লসের কথা।মাফ করবেন।আর চিন্তা করবেননা যে ক্ষতি হয়েছে সেটা দ্রুত পূর্ন হবে।আল্লাহর কাছে দোয়া করেন আমি ও করবো।সব ঠিক হয়ে যাবে।"
বিভান মাথা উঠিয়ে বেলার দিকে তাকায়।বেলার চোখে পানি জমে আছে।বিভান ওকে টেনে বুকে নিয়ে কপালে চুমু দিয়ে ওর কাঁধে মুখ ডুবিয়ে দেয়।দুহাত পেঁচিয়ে বেলাকে আষ্টেপৃষ্টে জড়িয়ে নেয়।বেলা মৃদু হেসে টিকিট তিনটে দেখতে দেখতে বলল,
''পূর্না কতো খুশি ছিলো তাইনা বিভান?"
''হুম।"
বিভান একটু এগিয়ে এসে বেলার হাতের টিকিট গুলো স্পর্শ করে বলল,
''অনেক খুশি ছিলো।"
বেলা বিভানের কাঁধে মাথা রেখে মৃদু হাসে। বিভান বেলার লম্বা চুলে আঙ্গুল চালাতে থাকে।বিভান বেলার মাথায় আঙ্গুলের চালনা করতে করতে বলল,
''চলো ঘুমিয়ে যাই। সকালে আমাদের অনেক কাজ।"
বেলা শুয়ে পড়ে বিভানের বুকে মাথা রেখে।
.........................এদিকে সেদিন বিকেলে সাঁঝ অফিস থেকে বেরিয়ে আসতেই দেখলো সাইমন দাঁড়িয়ে।সাঁঝের চেহারা ম্লান হয়ে ছিলো।সাইমনের হাতে একটা প্যাকেট আর পানির বোতল।সাঁঝ নিচে নেমে আসতেই সাইমন ওর দিকে এগিয়ে এলো।সাঁঝ কিছু বলতে পারছেনা। ওর মুখ শুকিয়ে গেছে।সাইমন সাঁঝের হাত ধরে গাড়ির ভিতর এসে বসে। সাঁঝের দিকে প্যাকেটটা বাড়িয়ে বলল,
''ধরো খেয়ে নাও লাঞ্চও হয়ত করোনি।"
সাঁঝ প্যাকেটটা হাতে নিয়ে সেটাকে ধীর হাতে খুলছিলো।সাইমন প্যাকেটটা হাতে নিয়ে সেটাকে খুলে দিতে দিতে বলল,
''শুনো যা হয়েছে হয়েছে।ওসব নিয়ে মন মরা হয়ে থাকার কারন নেই সাঁঝ।"
সাঁঝ অবাক দৃষ্টিতে সাইমনের দিকে তাকিয়ে বলল,
''কি হয়েছে আবার?"
সাইমন সাঁঝের মুখে পরোটা আর সবজি দিয়ে বলল,
''আমি জানি সব।তোমার ফোন নষ্ট করে দিয়েছে আঙ্কেল আমার ব্যাপারে জেনে।তবে ভাইয়া সব সামলে নিয়েছে।"
সাঁঝ পরোটা গিলে বলল,
''ভাইয়ার সাথে আপনার কথা হয়েছে?"
সাইমন মাথা ঝাঁকিয়ে সাঁঝের মুখে আরেকটু পরোটা দিয়ে বলল,
''হুম হয়েছে আজ সকালেই।আমি তো ভীষন ভয়ে ছিলাম না জানি ওনি কি বলেন। কিন্তু ভাইয়া সকল শঙ্কা দূর করে সুন্দর করে কথা বললেন।আমার ভীষন ভালো লেগেছে ওনার সাথে কথা বলে।ভাইয়া তোমাকে খুব ভালবাসেন।দূর্ভাগ্যবশত আমি এমন একটা ভাই পাইনি।"
কথা শেষে দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে এলো সাইমনের বুক চিরে।সাঁঝ বলল,
''সাইমন প্লিজ মন খারাপ করবেননা।আমি আছি তো।আর ভাইয়া তো আপনারও ভাই।তাছাড়া আল্লাহ তা'লা চাইলে হয়ত সিয়াম ভাইয়া নিজের ভুল বুঝতে পারবেন।"
সাইমন নিজের হাত রুমালে মুছে বলল,
''সেটার আশা রাখিনা সাঁঝ।আগে কেউ ছিলোনা ভাইয়া ছাড়া।তবে তুমি আছো এখন।আর কাউকে লাগবেনা।"
সাঁঝ হেসে সাইমনের বুকে মাথা রাখে।সেদিন ঘরে পৌছে সাঁঝ শুনতে পেলো পাশের রুম থেকে আম্মা আব্বাকে বলছিলেন,
''তুমি কি বলো তো? মাইয়াডারে এতো বাজে কথা শুনাইলা।ওর গায়ে হাত তুললা। নিজের মাইয়ারেকি চিনোনা।আমগোর সাঁঝ কিন্তু এমুন না তুমি জানো।তারপর ও এমন করলা কেন?"
''তুই কিন্তু চুপ থাক।তোর পোলার মতো কথা কইস না।আমার তো এবাসায় কোন জায়গাই নাই।গেলাম নিচে কাজ আছে।কিছু লাগলে ফোন দিস।"
আব্বা বেরিয়ে গেলেন দরজা শব্দ করে লাগিয়ে।
সেদিন সন্ধ্যায় ফিরে এলো নিশাদ।আসার পথে ইদ্রি কে মেসেজ করে ফোন বের করে,কষ্ট কি জানো?যখন শুনি অষ্টাদশী ছোট ভাইয়ের হাতে সিগারেটের মতো জীবনঘাতক নেশাদ্রব্য।কষ্ট কি জানো? যখন বারবার চাকরী চলে যাবার ভয় হৃদয়ে জেঁকে বসে।কষ্ট কি জানো?যখন শত চেষ্টাতে ও তোমার মান ভাঙ্গাতে পারিনা।এতটাই জড়িয়ে পড়েছি যে সকল কষ্ট তোমার কষ্টের কাছে ম্লান হয়ে গেছে।"
..............................ফোনের রিংটোনে কেঁপে উঠে ইদ্রি।ঘুমন্ত চোখ ডলে ভালমত চারিদিক দেখার চেষ্টা করছিলো ও।তারপর কোনমতে পিঠের নিচ থেকে ফোনটা বের করে সামনে এনে দেখলো নতুন মেসেজ এসে আছে।মেসেজ বক্সে ঢুকে মুহূর্তের জন্য চোখজোড়া ভার হয়ে আসে।উঠে বসে মেসেজ টা পড়তে থাকে বারবার।ওর এখন রুমে দমআটকে আসছে। কোনভাবেই বসতে পারছেনা ও। ইদ্রি ফোন হাতে নিয়ে দৌড়ে ছাদে চলে আসে।তারপর মেসেজ টা আবার ও পড়ে।চোখের কোনা বেয়ে অশ্রু গড়াচ্ছে।বারবার নিশাদের আগের মেসেজ গুলো পড়তে থাকে।ছাদে শীতল মৃদু হাওয়া বয়ে যাচ্ছে। মেসেজ পড়ার মাঝে মনটা কেমন যেন ভালো হয়ে উঠে। চোখের কোনা জ্বলছে।সামনে তাকিয়ে খানিকটা হাসে ইদ্রি।
!!!!
বাহিরে ঝুম বৃষ্টি হচ্ছে।ইমতিয়াজ জানালার বাহিরে তাকিয়ে দীর্ঘশ্বাস ছাড়ে।ল্যাপটপে মৃদু স্বরে বাজছিলো,
আমার সারাটি দিন
মেঘলা আকাশ
বৃষ্টি তোমাকে দিলাম
আমার সারাটি দিন
মেঘলা আকাশ
বৃষ্টি তোমাকে দিলাম
শুধু শ্রাবণ সন্ধ্যাটুকু
তোমার কাছে চেয়ে নিলাম
আমার সারাটি দিন
মেঘলা আকাশ
বৃষ্টি তোমাকে দিলাম..............
কফির মগে চুমুক দিয়ে ইমতিয়াজ চিন্তার সাগরে ডুবে যায়।চোখের সামনে ভেসে আসে সাঁঝের স্নিগ্ধ হাসি মুখ আর কাজল রাঙ্গানো চোখ।চোখের কোনা জ্বলজ্বল করে উঠে ইমতিয়াজের।নিজের ভালবাসাকে অপরের হাতে তুলে দেয়ার মতো দূর্বোধ্য কাজ আর নেই হয়ত।
সেদিন ফোনে নিশাদকে সাইমন এর ব্যাপারে তথ্য দেয়ার সময় একটা মুহূর্তে জন্য ইমতিয়াজের মনে হচ্ছিলো যে ও ভুল বলে দিক....সাইমনকে নিশাদের চোখে দুশ্চরিত্রধিকারী বানিয়ে দিক।সুযোগের ব্যাবহার করে নিজের ভালোবাসা ছিনিয়ে নিক...কিন্তু পরমুহূর্তে তমার কথাটা মনে পড়লো.. তমা ওকে বলেছিলো,
"তুই পারবি.. তোর কাছে কেউ ঠকবে না.."
সেই ব্যাপারটা মনে করেই ইমতিয়াজ নিজের বিবেককে সামলে সঠিক কথাটাই বলেছিলো বেস্টফ্রেন্ডকে..বিনিময়ে সারারাত ঘুমাতে পারেনি ভালোবাসা হারানোর যন্ত্রনায়..এই মুহূর্তে অফিসে কাঁচের বাইরে ঝুম বৃষ্টির দিকে তাকিয়ে ইমতিয়াজ সাঁঝকে ভাবছে ও যেখানে সাঁঝ কখনোই ওর হবার নয়।ও তো অন্যকারোর।হঠাৎ মনের কোন এক জায়গায় তমা নামটি জেঁকে বসে।তমার কথা মনে হতেই হুট্ করে মনে হলো তমার বাসায় যাওয়ার পর সেদিন যখন ও তমাকে জড়িয়ে কাঁদছিলো কিংবা ও তমাকে সব খুলে বলছিলো তখন তমার চোখে করুণ একটা আকুতি দেখতে পাচ্ছিলো..যেন কিছু চাপা দিতে চাচ্ছে..অনেক পুরানো কোনো ক্ষত যেই ক্ষত কিছুতেই সামনে আসতে দেয়া যাবে না...বারবার ওর সেই বুদ্ধিদীপ্ত আঁখিজোড়া চিকচিক করে উঠছিলো কিন্তু অশ্রু গড়িয়ে পড়ার আগমুহূর্তে ও নিজেকে গুটিয়ে নিচ্ছিলো...কিন্তু কেন? কি লুকাতে চাচ্ছে তমা?ওর এতগুলো বছরের পুরানো বন্ধু যে ওর এমন অনেক কিছু জানে যা নিশাদ পর্যন্ত জানেনা সেই কাছের মানুষটা হুট্ করে জীবনে আবার আবির্ভাব হলো...নতুন রূপে..এই রূপের আড়ালের রহস্য টা জানতে হুট্ করে ছটফট করে উঠলো ইমতিয়াজের মন.. কি হয়েছে তমার..??যাই হোক ও সেটা জেনেই ছাড়বে এবং যদি পারে তো নিজের সবটুক দিয়ে তমার জন্য কিছু করবে...সেদিনের সেই দৃষ্টির রহস্য সমাধান করেই ছাড়বে ইমতিয়াজ..ওর বিপদে যেই মানুষটা ওকে সঠিক রাস্তা দেখিয়েছে তাকে তার প্রাপ্য ফিরিয়ে দিবে.যেভাবেই হোক..ভেবেই ইমতিয়াজের হৃদয়টা কেমন করে উঠে।বান্ধুবীর রহস্যময়ী দৃষ্টির রহস্য জানার জন্য অন্তরটা জ্বালা করতে শুরু করেছে।আরেক মগ কফির জন্য কল দেয় ক্যাফেটেরিয়ায় ল্যান্ডলাইন যোগে।তারপর ফোন বের করে সেখানে কল লগে ঢুকে একনিশ্বাসে তমার নম্বর বের করে কল দেয়।
...............................অফিস থেকে বেরিয়ে পাশের ছাউনির নিচে দাঁড়ায় আদনান।ওকে গাড়ি দিয়ে আসে তবে আজকের দিনে গাড়ি আসবেনা।ড্রাইভারের বাবা ভীষন অসুস্থ তাই সে বাড়ি গেছে সপ্তাখানিকের জন্য।আদনান রুমালে নিজের ভিজে যাওয়া মুখ মুছে পকেট থেকে ফোন বের করে।হঠাৎ পাশ থেকে জুতার হিলের তীক্ষ্ণ শব্দে পাশ ফিরে তাকায় আদনান। মুহূর্তের জন্য যেন হারিয়ে যায় ও।ডান পাশ থেকে প্রিয়াশা এগিয়ে আসছে মাথার ওপর ওড়না ধরে।আদনান কিছু বলতে পারেনা।বলার কিছু পাচ্ছে না ও।প্রিয়াশা এসে কিছুটা দূরত্ব রেখে দাঁড়ায় আদনানের পাশে। আদনান সামনে চোখ ঘুরিয়ে আড়চোখে প্রিয়াশাকে দেখার চেষ্টা করছে।মেয়েটা কাকভেজা হয়ে আছে।ওড়না টেনে নিজের ভেজা শরীর ঢেকে রাখার চেষ্টা করছে।আদনান সামনে তাকিয়ে মৃদু কন্ঠে বলল,
''রাস্তায় একটা বাসও নেই লোকজন ও তেমন নেই বললেই চলে আমরা ছাড়া।"
আদনানের কথায় প্রিয়াশা বাপাশে মাথা ঘুরিয়ে আদনানের দিকে তাকায়। আদনান সামনে তাকিয়ে মৃদু হাসছে। প্রিয়াশা ধীর কন্ঠে বলল,
''সেটাই দেখতে পাচ্ছি। "
আবার চুপ হয়ে যায় ওরা। দুজনের মাঝে পিনপতন নীরবতা বিরাজ মান।আদনান পাশ ফিরে তাকায় প্রিয়াশার দিকে ওর ঠোঁটের কোন ঘেষে আটকে রয়েছে মন ভুলানো হাসি।বৃষ্টির সাথে দমকা বাতাস ওদের শরীরকে ছুঁইয়ে গেলো।প্রিয়াশা এতটুকু হয়ে আসে শীতল বাতাসের স্পর্শে।আদনান প্রিয়াশাকে সম্পূর্ণ ভাবে দেখছে।ওর চোখজোড়া দ্রুত পলক ফেলছে।আদনান নিজের কোটটা খুলতেই প্রিয়াশা খানিকটা উত্তেজিত হয়ে উঠে মনে মনে। ভাবছিলো আদনান হয়ত সিনেমার মতো ওকে কোট পরিয়ে দেবে।কিন্তু তেমন কিছুই হয়নি।আদনান কোটটা একটু ঝেড়ে আবার পরে নিয়ে বলল,
''সিনেমার মতো বাস্তবে কিছু হয়না। সেটা যদি কেউ বুঝতো?"
প্রিয়াশা কিছুটা অবাক হয়ে আদনানের দিকে তাকায়।ও এটাই ভাবছিলো কিন্তু লোকটা কিভাবে বুঝলো?আর সে ওকে অপমান করলো না তো?প্রিয়াশা সামনে তাকিয়ে বাসের অপেক্ষা করতে থাকে।হঠাৎ কি যেন হলো আদনান প্রিয়াশার দিকে একটু সরে এলো।ঠোঁটের কোনে দুষ্টু হাসি লেগে রয়েছে আদনানের। পাশে দাঁড়িয়ে থাকা প্রিয়াশাকে এভাবে দেখতে বেশ ভালো লাগছে। ব্যাপারটা ওর জন্য অন্যদিন থেকে সবচেয়ে ভালো বলাই চলে। দুজনে একা রাস্তা ফাঁকা।ঝুম বৃষ্টি সেই সাথে।প্রিয়াশাকে ভালবেসে কাছে টেনে নেয়ার অধিকার থাকলে এই মুহূর্তে ও এই সুযোগ হাতছাড়া করতোনা কখনো।প্রিয়াশা আদনান কে কাছে আসতে দেখে কিছুটা সরে দাঁড়ায়।আদনান হঠাৎ প্রিয়াশার হাতের আঙ্গুলের মাঝে নিজের আঙ্গুল ঢুকিয়ে দিয়ে আলতো ভাবে প্রিয়াশার হাত স্পর্শ করে।প্রিয়াশার বুক প্রচন্ড অস্থিরতায় কাঁপতে শুরু করে।কম্পিত হৃদয়ে পাশে তাকিয়ে ওদের হাত দুটোকে দেখে।আদনানের ভেজা হাত প্রিয়াশার কোমল হাতকে কেমন আষ্টেপৃষ্টে বেঁধে আছে।চোখ তুলে আদনানকে দেখে প্রিয়াশা।আদনান সামনে তাকিয়ে ফোনে কি কাজ করছে।যেন ওদের হাত ধরা স্বাভাবিক।প্রিয়াশা মৃদু হাত নেড়ে নিজের হাত ছাড়ানোর চেষ্টা করে।কিন্তু ওকে অবাক করে দিয়ে আদনান নিজের বাঁধে দৃঢ় করে প্রিয়াশার হাতে।প্রিয়াশা ধীর স্বরে বলল,
''ছাড়ুন।"
আদনান কিছু বলছেনা।সে নিজের কাজ করে যাচ্ছে।প্রিয়াশা কিছু না বলে স্মীত হেসে সামনে ফিরে। আদনান ওর আরো কাছে এগিয়ে আসে।প্রিয়াশার বাহুর সাথে আদনানের হাতের বাহুর ছোঁয়া লাগতেই ভেতরটা কেমন কেঁপে উঠে প্রিয়াশার।এ কেমন পরিস্থিতিতে ফেলল ওকে ভগবান।আদনান প্রিয়াশার দিকে তাকায় ফোন থেকে চোখ সরিয়ে। প্রিয়াশার গালে লেগে থাকা বৃষ্টির পানি ওর গলায় পড়ছে।আদনান পাগল হয়ে যাচ্ছে ভেতর ভেতর।এ কেমন আকর্ষন রয়েছে মেয়েটার মধ্যে যা আদনানকে ঠিক থাকতে দিচ্ছেনা?মেয়েটার জামার ওপর দিয়ে ও ওর ঢেউ খেলানো কোমড় আদনানের চোখকে ফাঁকি দিতে পারেনি।আদনান প্রিয়াশার খোপা করা চুলের দিকে তাকায়। এগুলোকে খোঁপা অবস্থায় নয় বরং খোলা অবস্থায় বেশি মানায়।আদনান আর অপেক্ষা করতে পারেনা হাত এগিয়ে দিয়ে প্রিয়াশার চুলের কাঁটা খুলে দেয়।এতে ওর চুল গুলো পিঠের ওপর এলোমেলো ভাবে পড়ে যায়।প্রিয়াশার ভয় হচ্ছে অজানা আতঙ্কো বুক ধুকপুক করছে।ও কাঁপানো কন্ঠে বলল,
''স্যার কি করছেন আপনি?"
আদনান ক্ষীন আর কিছুটা গম্ভীর স্বরে বলল,
''যেটার জন্য অনেকদিন অপেক্ষা করছিলাম। "
প্রিয়াশা আদনানের দিকে তাকায়নি তবে বিস্ময়ে লজ্জায় মাথা নিচু করে নেয়।আদনান এগিয়ে প্রিয়াশার দিকে।ঠোঁট এগিয়ে যায় প্রিয়াশার ভেজা গালের দিকে হঠাৎ পিছন থেকে মেয়েলি কন্ঠে আদনান বেশ বিরক্ত হয়।পিছনে ফিরে দেখলো সৃষ্টি দৌড়ে আসছেছাতা নিয়ে ।আদনান দুষ্টু হেসে সরে এলো প্রিয়াশার থেকে। ওর হাত ছেড়ে বলল,
''কি সুন্দরী চলে এসেছো?"
প্রিয়াশা এমন কথায় অবাক হয়ে আদনানকে একপলক দেখে পিছনে তাকিয়ে সৃষ্টিকে দেখতে পায়।সৃষ্টি এগিয়ে আদনানের অপরপাশে দাঁড়িয়ে বলল,
''কি যে বলেননা স্যার??"
''সত্যিইতো বললাম।তা কেমন কাঁটছে অফিসে সময়?"
''বেশ ভালো স্যার।আপনি এতোটা সাহায্য করেন সব অনেক সহজ লাগছে।কি যে বলবো স্যার?"
প্রিয়াশার মনে হলো আদনান হয়ত সৃষ্টিকে আশা করছিলো এতটা সময় ধরে।সেই মুহূর্তে বাস থামলো।তিনজনে দ্রুত উঠে পড়ে বাসে।বাসে ও প্রিয়াশাকে আদনান আর সৃষ্টির ফ্লার্টিং কথাবার্তা সহ্য করতে হচ্ছিলো।রেগে গিয়ে ও নিজেকে নিয়ন্ত্রনে নিয়ে আসে প্রিয়াশা।রাগলে চলবেনা।দম আটকে বাকিটা রাস্তা পার করে প্রিয়াশা।
.........................অফিসের কাজ শেষ করে উঠে দাঁড়ায় নিশাদ।সব ফাইল পত্র গুছিয়ে নিয়ে ল্যাপটপ অফ করে সেটাকে ব্যাগে ঢুকিয়ে নিচে নেমে আসে নিশাদ।গেট থেকে বেরিয়ে পরিচিত একটা গাড়ি দেখে কিছুটা অবাক নিশাদ।গাড়িটাকে আগে কোথাও দেখে ছিলো কিনা মনে পড়ছেনা ওর।নিশাদকে অবাক করে দিয়ে গাড়ির দরজা খুলে একটা ছাতা খুলে যায়।তারপর ইদ্রি বেরিয়ে আসে সেই ছাতা নিয়ে।নিশাদ মুহূর্তের জন্য থমকে যায়।ইদ্রি ধীর পায়ে এগিয়ে আসতে থাকে নিশাদের দিকে।নিশাদ ভীষন অবাক ইদ্রির আগমনে।মেয়েটা আজ ওর অফিসে উপস্থিত!!!ঠিক নিশাদের সামনে দাঁড়িয়ে আছে ভাবতেই মনটা কেমন করতে থাকে নিশাদের।ইদ্রি থমথমে কন্ঠে বলল,
''পড়তে এসেছি।ফিজিক্স বুঝিয়ে দিবেন। কয়েকটা এ্যাসাইনমেন্ট জমে আছে।সেগুলো কিভাবে লিখলে ভাল হবে দেখিয়ে দিতে হবে। "
নিশাদ ভ্যাবচেঁকা খেয়ে বলল,
''হুম।"
ইদ্রি বলল,
''বলেন কই গিয়ে বসতে পারি।সময় নেই আমার হাতে।"
নিশাদ এবার গলা পরিষ্কার করার ফাঁকে নিজেকে স্বাভাবিক করার চেষ্টা করতে করতে বলল,
''পাশেই একটা ক্যাফে আছে........."
নিশাদের কথা শেষ না হতেই ইদ্রি নিশাদের হাতে ছাতা ধরিয়ে সামনে হাঁটতে শুরু করে।
নিশাদ বেশ অবাক।তবে ভালো লাগছে।অন্তত মেয়েটাকে আজ অনেকদিন পর দেখতে পেয়েছে।ওর পুতুলটা আজ নিজেই ওর কাছে এসেছে।কারনটা ওকে দেখার কিংবা পড়তে আসা যাই হোকনা কেন ওর জন্য ইদ্রির দেখা পাওয়টাই অনেক।ওরা ক্যাফেতে এসে বসলো পাশাপাশি দুটো চেয়ারে।ইদ্রি বাহিরের দিকে।আর নিশাদ জানালার পাশে।ইদ্রি নিজের ল্যাপটপে খুঁজে খুঁজে পড়া দেখাতে থাকে নিশাদকে।নিশাদ ইদ্রিকে দেখছে বারবার পড়া দেখার ফাঁকে।আর ওর ঠোঁটজোড়া মৃদু প্রসারিত করে হাসছিলো। পড়ার ফাঁকে ইদ্রি বলল,
''এক্সকিউজ মি।আমি একটু আসছি।"
নিশাদ ধীরে বলল,
''হুম।"
ইদ্রি ক্যাফের বাথরুমে যাবার জন্য পা বাড়ালো।নিশাদ ওর ল্যাপটপ দেখছিলো।হঠাৎ একটা ফোল্ডার ওর সামনে চলে আসে। ফোল্ডারের নাম ছিলো মাই লাভ।নিশাদ বেশ অবাক ফোল্ডারে ঢুকতক গিয়ে দেখলো সেটা পাসওয়ার্ড প্রোটেক্টেড।নিশাদের কেমন যেন খারাপ লাগে।ইদ্রি কি লুকাচ্ছে ওর কাছে যেখানে কোন কিছু গোপন থাকার কথা না ওদের মাঝে।নিশাদ বারবার পাসওয়ার্ড দিতে থাকে। হঠাৎ কি মনে করলো Iidreelovesnishad।সাথে সাথে ফোল্ডারটি খুলে যেতেই নিশাদের বিস্ময়ের সীমা রইলোনা।সেখানে ছিলো নিশাদের পঁচিশ হাজার ছবি।ওদের প্রথম দেখা ইদ্রির জন্মদিন থেকে শুরু করে জাদু ঘরে যাওয়া,নিশাদের ওকে প্রত্যেকদিনের পড়াতে যাওয়া,প্রত্যেকটা ছবি খুব সুন্দর করে সাজানো। আবার ছবি গুলোর নিচে সুন্দর করে লেখা লাভ ইউ নিশাদ।আপনাকে চাই। কি হ্যান্ডসাম আমার বর।নিশাদ মৃদু হাসছিলো সেগুলো দেখে।নিশাদ ছবি গুলো থেকে বেরিয়ে একটা নোট পেলো।সেখানে ঢুকে দেখলো কয়েকটা নোট লেখা। নিশাদ সেগুলো দেখতে শুরু করে।নিশাদকে নিয়ে ইদ্রির কিছু মিষ্টি কথা।নিশাদ যেন ওকে চড় দিয়েছিলো ভালবাসার কথা বলায় সেদিন ইদ্রি কতোটা কষ্ট পেয়েছিলো সেটা ওর লেখায় নিশাদ বুঝতে পেরেছিলো। আর যেদিন নিশাদ ওকে অপমান করেছিলো রাতে সেদিন রাতে ইদ্রি নিজের ল্যাপটপে অনেকবার লিখে রেখেছিলো ভালবাসি নিশাদ ভালবাসি নিশাদ...........হঠাৎ পায়ের শব্দে পাশে তাকায় নিশাদ।ইদ্রি থম ধরে দাঁড়িয়ে নিজের ল্যাপটপ আর নিশাদকে দেখছিলো। নিশাদ কিছু বলবে তার আগেই ইদ্রি ল্যাপটপ হাতে নিয়ে বলল,
''অনেক হয়েছে আজ আর নয়।"
বলেই দৌড়ে বেরিয়ে গেলো ইদ্রি।নিশাদ বুঝতেই পারলোনা হঠাৎ কি হলো?